নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিশোরগঞ্জ আমার কাছে ছোট্ট সবুজ একটি শহর। রিকসার টুন টুন, গরুর গাড়ির ক্যাঁচ কোচ, সন্ধ্যায় ধুপের গন্ধ আর পাড়াময় পড়ার শব্দ। কখন ফেরিওয়ালার হাঁক, “লাগবো টিক্কা?”। হুঁকোর টিক্কা ফেরি করছে। স’মিলে কাঠ চেরাই এর শব্দ, কাঠের মিষ্টি গন্ধ। রিকশায় সিনামার বিজ্ঞাপন “রঙ্গমহলের রুপালি পর্দায়, রঙ্গমহলের রুপালি পর্দায়, মহা সমারোহে চলছে, মহা সমারোহে চলছে...” সে এক অন্যভুবনের ছবি! খুঁজলেও কোথাও পাবো না আর সে কোমল মখমল স্মৃতির শহরটিরে। প্রথম স’মিল দেখে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম অত্ত বড় মাইক্রোস্কোপ দিয়ে কি হবে? স মেশিন চিনতাম না। স’ মেশিন আর মাইক্রোস্কোপের সাদৃশ্য যে ব্যাপক এতে সন্দেহ নেই। ছড়ানো ছড়ানো বাড়ি ঘর। বড় বড় গাছ, বিশাল সব পুকুর। গাছের ছায়ায় ছায়ায় সরু পথ কারুর বাড়ির উঠোন মারিয়ে চলে গেছে দূরে। কত অচেনা গাছ আর আগাছা। সবুজ প্রাচীন শ্যাওলারা ছড়িয়ে আছে কারো বাড়ির ইটের পাঁজায়, সবুজ সে কি মসৃণ! বাকলহিন ইউক্যালিপটাসের কোমলতা যেন! কিছু দূর্বা ঘাস কি ঢেঁকি শাক ফনা তুলা। আসা যাওয়ায় নিরেট মাটির সাদা রেখা, দুপাশে অসমান্তরাল ঘাসেদের রেখা, পায়ের ঘায়ে কিনারায় হ্লদেটে-সাদা ঘাস তারপর সবুজ সাহসী ঘাসের দল, চওড়া চ্যাপ্টা ধাড়াল তলে শিশির জমে থাকত গোল! উৎসুক শিশু মন খুব কাছে গিয়ে দেখতাম ছবি সব উল্ট দেখায়, উত্তল অতসী কাচের ছবির মত! কি যে মায়া সে শিশিরে! বাবা বেরিয়ে যেতেন সকালে আমি দেখতাম কোটের উপর ওভার কোট চাপিয়ে, হাউন্ড টুথ চেকের ব্রাউন, ডার্ক ব্রাউনের বুনট, মাথার টুপিটা ঈষৎ বাঁকা করে পরে। ছবিটি আসলে সকালের নয়, সন্ধ্যার! হেঁটে যেতেন বেশ অনেকটা পথ। হাতে ছোট ব্যাগ ঘুড়িয়ে বুকের কাছে ধরা। কি যে উদাসী সে ভঙ্গী আমি ঠিক বুঝতাম সব কিছুতে থেকেও উনি সব কিছুর থেকে অনেক দূরের! টুন টুন করে একটা রিকশা আসত, বাবা উঠে যেতেন, কুয়াশায় হারিয়ে যেতেন। আমি দেখতাম আর কিছুক্ষন আমার ভাললাগত খুব। বাবার খুব প্রকাশ ছিল না, পক্ষপাতটা বুঝা যেত খানিক। একবার আমার হাম হল, বাবাকে ঢাকা আসতেই হবে, আমাকে নিয়েই এলেন ঢাকার বাসায় সারাক্ষন আমায় নিয়ে নিয়ে থাকলেন পাছে ওষুধ মিস হয়। সে সময়টুকুই শুধু উনাকে পেয়েছিলাম একদম নিজের করে। বাবার সাথে দাবা ফেডারেশনে যেতাম, পূর্বানীর কেক পেস্ট্রি সাঁটতাম। আহা অমন বেকারি আইটেম আর কোথাও বুঝি পাই না! আর বাসায় থাকলে দাবা খেলতাম দুজনে। তখন শিখিয়ে ছিলেন একটা “রুক” দিয়ে কিভাবে মাত করতে হয়। সাজাহানপুরের এ বাসাটি খুব সুন্দর ছিল একদম ঝিলের ধারে। সামনে আবার বেশ খানিকটা উঠান। এ গল্প পরেই হবে। এখন সেই কিশোরগঞ্জের কথাই বলি।
প্রথম বাসাটি ছেড়ে আমরা যে বাসাটিতে উঠে এলাম সে একদম শহরের মাঝখানে, হট্টগোলে ভরা। বাসার পাশে একচিলতে মাঠ, তারপর কাঠ চেড়াই এর কল। আরেকপাশে দুয়েক খানা বাড়ি রিকশা সারাইয়ের দোকান, ভাজাভুজির দোকান। অন্ধকার অন্ধকার মুদির দোকান, তারপর বিশাল মসজিদ। পাঁচ বেলা শুনতাম সে আযান, মধুর ছিল না মুয়াজ্জিনের কন্ঠ কিন্তু ছিল খুব করুন বিষণ্ণ, শ্লেষ্মা মিশান বৃদ্ধ কন্ঠ খানিকটা ভাঙ্গা, বুকের খুব গভীরে ক্যামন যেন একটা ব্যাথা-বোধ জাগে, জাগে একটা অপরাধবোধ। মাগরিবের আযান শুনলে মনে হয় সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। সে এক বিচিত্র অনুভুতি। সে মসজিদের ঈমাম সাহেব আমাকে সুন্দর করে নামাজ শিখিয়েছেন, প্রতি ওয়াক্ত মসজিদে যেতাম, শীতের ভোরে ফজরের নামাযে যেতাম, ঈমাম সাহেব আমাকে উদাহরণ দিতেন। কি সুন্দর দেখতে ছিলেন তিনি সফেদ সাদা দীর্ঘ দাড়ি, ফর্সা ছিপছিপে গভীর মায়াবী চোখ। নামায শেষে বাসায় ফিরার পথে দেখতাম খাবার দোকানটা খুলে গেছে, হিসহিস করে কেরোসিনের ষ্টোভ জ্বলছে। গরম কড়াই এ ভাজা হচ্ছে গুল্গুল্লা! এ গুলো আমরা খেতাম না, কিন্তু কোন এক দিন সে দোকানের লোকটি আদর করে ডেকে, প্লেটে দিল দুখানা। সে কি জিনিস আগে কখন খাই নি। অনুরোধে ঢেকি গেলার মত খেলাম, গোল গোল একমুঠো, ডুব-তেলে মচমচে ভাজা। খেতে বেশ ভাল, কলা-ময়দা চিনি কি গুড় দিয়ে বানানো, আট আনা দাম মাত্র। তারপর প্রায়ই খেতাম। আজ কাল আর দেখি না এ জিনিস।
বাসার কাছের এক চিলতে মাঠটাতে বড় বড় ঘাস ছিল আর খুব প্রজাপতি উড়ত, হলদে ডানা ছোট ছোট, দুর্মর মথ নয়। আমি বরাবর প্রজাপতির দলে, দুষ্টু মিষ্টি বালিকার মত, বয়স্ক ভদ্রলোক মথেদের গাম্ভীর্যের চেয়ে প্রজাপতিরা ঢের ভাল, কেন যেন মনে হত ওরাও বুঝি আমার সাথে খেলতে চাইত। সে মাঠটা পার হলে আড়াআড়ি, স’মিলের পিছে দিয়ে যেতে পারতাম এক খালাম্মার বাসায়, আমাদের অতি প্রিয়, আত্মীয় নন তারচেয়েও আপন। আমার সবচেয়ে বড় বোন আর মেজ বোনের বান্ধবি ছিলেন ইনারা তারপর এক সময় খুব কাছের হয়ে গেলেন, তাঁদের এক ভাই ৭১’ এ নিখোঁজ হয়ে যান, ভাইহিন সেই বোনেদের ভাই হয়ে রইলাম সব সময়। আমরা প্রায়ই যেতাম সে বাসায়। আমরা ঢাকা থেকে ফেরার পর আমাকে কোলে নিয়ে অনেক কেঁদেছিলেন এক আপা, তখন বুঝি নি সে ভালবাসা আজ বুঝি। সেই খালাম্মার বাসায় এক বার ভূতের উপদ্রব শুরু হল। যেতে খুব ভয় হয়। যখন তখন এই বড় বড় ঢিল পরে। রাত দুপুর দিন মান কোন কমতি নেই। এহেন অবস্থায় একদিন আমি আর শারমিন গেলাম সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময়। আমরা ফিরে আসব, দরজা খুলে যেই উঠানের সিঁড়িতে পা দিলাম এই বড় এক থান ইট এসে পরল পায়ের কাছে, দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম এখন কি হবে? আমরা মাঝের ঘড়ে বসে কথা বলছি, এমন সময় কাজের মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। দৌড়ে ওঘরে গেলাম দেখি বিছানার চাদরে রক্তাক্ত হাতের ছাপ, এক কাদা মুরগির হার হাড্ডি ছড়িয়ে আছে, বিছানা জুড়ে। গা হিম করা ব্যাপার! মেয়েরা চিল চ্যাচানি শুরু করে দিয়েছে। এখন কি হবে? কি করব?! হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল আমার। মেয়েটাকে ডাক দিলাম, বিছানার চাদরের ছাপের সাথে ওর হাত মিলালাম, হুবুহু মিলে গেল, শুধু তাই নয়, আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে রঙ্গও রয়ে গিয়েছিল ওর। নিজেকে বেশ ফেলুদা কি শার্লক্ হোম্স মনে হচ্ছিল। উনাদের বাসার নাম ছিল “হাসেম মঞ্জিল” সুন্দর একটা ছায়া ছায়া উঠান ছিল। বড় বড় গাছ, চুনসুরকির প্রশস্ত দেয়াল। তখনও সে বাসায় দেখেছিলাম কাঁচা পায়খানা, কাজ সারলে প্যান থেকে চলে যায় পিছে কোথাও “ধাঙ্গড়রা” আসে তেলের ড্রামের গাড়ী নিয়ে, ময়লা নিয়ে যায়। সে আজ কাল আর ভাবা যায় না। সমাজের নিচু শ্রেণীর লোক এরা, মদ খায় হল্লা করে, কেলে কেষ্ট চেহারা, কিন্তু জীবনীশক্তিতে ভড়পুর। কথা গুলা ভারি মিষ্টি লাগত আমার। তেমনি একজন নিচুতলার মানুষ ছিলেন “শিবু’দা”! সামান্য মুচি! বাবার চেম্বারের সামনে এসে বসতেন, বুট পালিশ করতেন কি টায়ার এর স্যান্ডেল বানাতেন। কিন্তু অসামান্য ভদ্র মানুষ ছিলেন। কি সুন্দর ব্যবহার ছিল, আমরা সবাই ভালবাসতাম খুব। লোকমুখে শুনলাম কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মানুষ, মানুষই, শুধুই মানুষ! কি তার পদবী কি তার পেশা তাতে কি আসে যায়। তবে হতে হবে “মানুষ”! মানুষ আসলেই দ্বিজ। জন্মিলেই হয় না, নিজের ভিতর থেকে জন্মাতে হয়, পল্লবিত হতে হয়, সে চারা রোপণ করে পরিবার। এ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
নেই আজ অনেক কিছুই! সে শিক্ষা, সে ভ্যালুজ। মধ্যবিত্ত আজ বিরল নয় বিপন্ন প্রানি। আপোষে আপোষে জের বার হওয়ার যোগার। তাইত ভাল লিখবার কেউ নেই, নেই বলবার, কি করবার। পারা মহল্লায় দেখা যায় কত্ত দোকান, কত্ত পসরা। রঙ্গিন পেটফোলা চিপ্সের প্যাকেট, দিনমান ঝলসে যাওয়া পিঙ্গল মুরগি। জামা জুত বিলাস ব্যাসনের জমজমাট আড়ৎ। পুর দেশটিই যেন “বানিজ্যিক কার্যক্রম”।কোথাও দেখা যাবে না ভাল কোন বই কি গানের দোকান। পাড়ার বই-এর দোকানে থাকে শুধু গাইড বই আর ভুল ভাল ছাপা পাইরেটেড বই। দু চার খানা ভাল বই পাওয়া সত্যি দুষ্কর। আমার ছোট বেলায় পাওয়া পয়সার বেশিটাই যেত বই কেনায়। আমার মনে আছে কাচারি বাজারের কাছে ছিল ছাত্র বন্ধু লাইব্রেরী, পাশে ছিল সেলুন অবধারিত ভাবে ঝুলছে সায়গ বেঁধা দুলদুল কি হাসি মুখ বোরাকের বাঁধানো ছবি। নেতাজীর ছবিও থাকত তখন, দেশপ্রেম জাগাতে হত না এখনকার মত, এমনি জেগে থাকত। সে ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরী থেকে দুট বই কিনেছিলাম আসলে তিনখানা। একটা “বাদশা হল দরবেশ”, “ভুত-পেত্নির কথা” আর তৃতীয় খানা ছিল শরৎ বাবুর যা পড়বার বয়স তখনও হয়নি শুধু নামটা বড়দের কাছে শুনেছিলাম তাই ভাবলাম পড়লে নেহাতি মন্দ হয়না, সে বই অবশ্য তখন পড়তে পারিনি, বোনেদের ঠাট্টা তামাশায়, বইটার নাম মনে নেই, ব্রাউন প্রচ্ছদে কাল রঙ্গের শরৎ বাবুর ছবি ছিল আঁকা। মন এক তামাশা, কি যে থাকবে মনে আর কি যে নয় তার কোনই বুঝি নেই যুক্তি। লাল লোহার পুলটা মনে আছে খুব, কি যুক্তিতে কে জানে? একজন অন্ধ ফকির সেখানে রোজ আসত, ছিল সাত রঙ্গের কুদ্দুস মামা, বাবরী বাহারি চুল, উল্কার পণ্ডিত কাকা বৃদ্ধ তখন, লবংগ কি সিঙ্গারার সেই রমরমা নেই, চেয়ারে পা উঠিয়ে বসা, ঝাপসা চোখে হয়ত অতীতের জলুস গুল ভাবতেন বুঝি। লবঙ্গের ক্ষীর অনেক আগেই তিরহীত তখন। লোহার পুলের ঢাল বেয়ে রিকশা চলত কি জোড়ে, তাইতেই ছিল ছুটে চলার আনন্দ। কাঠের পুলটা ( এটার নামই কি ছিল গ্যাড়াসুন্দরী পুল?) ভয় ভয় লাগত খুব। আর লোহার পুলের দুপাশে ছিল পেডিস্ট্রিয়ান অ্যাকসেস কিন্তু ওদিকটায় যাওয়া যেত না। অঘোষিত পাবলিক টয়লেট হয়ে গিয়েছিল সে পাশটা। ধুলি ধুসর সে পুলটার কথা খুব মনে হয়, মাঝে মাঝে। নরসুন্দা তখনই হত যৌবন প্রায় স্থির পানিতে আজস্র কচুরিপানা, ফনাতোলা সাপের মত পাতা তার আর সাল্ভাদার দালির সারারিয়েলিস্টিক নীলচে বেগুনী ফুল, সুন্দর নিঃসন্দেহে খুব, যদিও অভিজাত ফুলের দলে এই ফুল নিতান্ত অপাংতেয়, তবুও আমার এ বড় প্রিয় ফুল, দেখলেই মনে হয় সাহসী বুঝি সে খুব, অবহেলা অনাদর এসব কে থোরাই কেয়ার করে, নাজুক নয় এতটুকু, মাথা উচু করে থাকে। আমার এমনই প্রিয়। খেটে খাওয়া মানুষদের পেশী বহুল শরীরে শত ধারায় প্রবাহিত স্বেদ স্রোত কিংবা ইট ভাঙ্গা-শ্রমিকের লালচে ধুলোয় ঢেকে যাওয়া মুখে শ্বেত শুভ্র হাসি আমার তেমনি সুন্দর লাগে। বেঁচে থাকা, শুধু বেঁচে থাকাই এক সুন্দর ছবি, এক নেশা, এক আনন্দ , অপরিমেয়। আল্লাহ সুবাহানাল্লাহ তালার এক নিয়ামাহ্! “গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়”। এই তো জীবনের আনন্দ! দীর্ঘ হউক সুন্দর হউক এ অনন্ত যাত্রা।
০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১৬
রবাহূত বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। আগের লিখা গুলো পড়েছেন? মতামত পেলে খুশি হব।
২| ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:০৭
মোস্তফা সোহেল বলেছেন: সময় গুলো কি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ভাল লাগল আপনার স্মৃতিচারনা। আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমারও অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১৭
রবাহূত বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। আগের লিখা গুলো পড়েছেন? মতামত পেলে খুশি হব।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:২০
রানা আমান বলেছেন: খুব সুন্দর করে লিখেছেন আপনার স্মৃতিকথা , পড়তেও ভাল লেগেছে ।