নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শৈশব এবং জাদুর শহর (১২)

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৫



বাড়ী বদলে যায় আবার।
এবার এক ভূতুরে বাড়ীতে এসে উঠি। ভুত এফ এম এ যে কোন ভূতের বাড়ীর কথা আসলে আমার কল্পনায় এ বাড়িটিই চোখে আসে ভেসে, খুব অল্প সময় ছিলাম সে বাড়ীতে কিন্তু প্রথম দিনেই আমার একগাদা বন্ধু জুটে গিয়েছিল, এবং বিকেল বেলাতেই ফুটবল খেলতে চলে গেলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে! খেলা ছিল “খাতা ধরা”, এ ব্যাপারে কোন ধারনাই ছিল না আমার। কি না, সবাই দুই টাকা চাঁদা দিয়ে খাতা কিনেছিলাম কয়েকখানা, আমরা জিতে ছিলাম দুই পক্ষের খাতাই আমরা পেয়ে গেলাম। বিজয়ের আনন্দ! পুর ব্যাপারটি আমার জন্য এক “বিস্ময়” ছিল। এর আগে খেলে শিল্ড কি কাপ পেতাম, কিংবা শিল্ড কি কাপ ধরতাম বাজি, এই প্রথম “খাতা ধরা”! এক ইউনিক আইডিয়া! এর কিছুদিন পরে আমাদের মাঝে বেশ এক খানা সাঁজ সাঁজ রব পরে গেল, বড় একটা খেলা আসছে। আমার উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি, এক বড় ভাই বলেছে এবার খেলা হবে “চিল ধরা”, আমি তো এক্সাইট্মেন্ট এর চূড়ান্তে। জলজ্যান্ত একটা চিল, হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, যাকে শুধু দেখেছি দূর আকাশে, চোখ তুলে তাকাতে সাহস পাইনি কারন আমরা জানতাম চিল নাকি বাচ্চাদের চোখ তুলে নিয়ে যায়। কানের ব্যাপারটা তখনও জানা হয়নি। আমি চিন্তা করি, কি বিশাল একটা না ব্যাপার ঘটবে, যদি আমারা জিতি। কিন্তু খাতার মত তো ভাগ হবে না চিল কার কাছে থাকবে? এটাও ভাবিত করে। অবশেষে এসে গেল সে কাঙ্ক্ষিত দিন দূরের এক মাঠে গেলাম সব, আমি কল্পনায় দেখছি, আমরা মাঠে খেলছি, মাঠের এক পাশে খোলা একটা টেবিল সেখানে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে একটি চিল। আহা আমি এটাকে পুষব, আমার কাঁধে বসে থাকবে। নিজেকে হিরো মনে হতে লাগলো। মাঠে এসে আমি এদিকে তাকাই ওদিকে তাকাই, সবাই জিজ্ঞেস করে “কি খুঁজ?” আমি বললাম “চিল কই? চিল?” অন্যরা বলে কিসের চিল? “কেন আমাদের না চিল ধরা খেলা?” সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, সে বড় ভাই এর কথা ব্লল্লাম ও বলেছে “চিল ধরা খেলা”, সবাই হেসে উঠল ওর কথা বলায় একটু ঝামেলা থাকায় ও শিল্ড কে চিল বলেছে। আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারিনি। এ জীবনে আমার আর চিল পোষা হল না। হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, দূরের আকাশেই রয়ে গেল। তবে এখনও আমার সেই বিস্ময়-ভালবাসা রয়ে গেছে এ সাহসী পাখিটির জন্য।

সে বাসাটি ছিল সরকারি ফিসারির কাছে, বড় বড় পুকুর আর ঝুপ্পুস সব নারিকেল গাছ ছিল। খুব হাওয়া দিত। শন শন শব্দে নারিকেল পাতা গুল উড়ত। তখনই প্রথম কাঠের বলে ক্রিকেট খেলি, বন্ধু ছিল সজীব, ওর বড় ভাই আবার আমার মেজ ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন, ভাল ক্রিকেটার ছিলেন আমরা সজীবদের বাসার কাছের মাঠেই খেলতাম একসেট প্যাড থাকায় শুধু ফ্রন্ট ফুটে বাঁধতাম প্যাড। আমরা এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম, তুষার, অজয়, মাহাবুব, শাওন, বিপুল, সবুজ, মাসুদ মেয়েরা ছিল ইতি, শ্যমা, চন্দনা, নাদিয়া, গৌরি, প্রভাতী আরও কত। কি মিষ্টি একটা সময় ছিল। সজীব ছিল কিছুটা রোমান্টিক কিন্তু ক্লাস ফাইভে হঠাত্‌ ওর মা মারা গেলেন, আর ওর বাবা ছিলেন গভঃ স্কুলের নামকরা টিচার ছেলেকে এক ক্লাস উপরে তুলে সিক্সে ভর্তি করে নিজের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। কিন্তু সে বন্ধুত্ব এখনো রয়ে গেছে অমলিন।

আমাদের স্কুল ছিল অদ্ভুত সুন্দর এক জায়গা, পড়াশুনা, খেলাধুলা, কালচারাল এক্টিভিটিস সব একদম পরিপূর্ণ। আর সেই স্কুলের বড় আপা বেশ কয়েকবারই হয়েছেন দেশ সেরা শিক্ষক। সে স্কুলের মাঠটা তখন ছিল অনেক বড়, অত ঘাস টাস ছিল না, আমরা ওই ন্যাড়া মাথেই খেলতাম খুব। প্রথম যখন ঢাকা থেকে এসে ভর্তি হই একটা মজার জিনিস খেয়াল করি বেশির ভাগ ছেলে মেয়েই বই হাতে করে নিয়ে আসত, আমিও একদিন ফেল ফিলিংস থেকে স্কুলের পিছে আমার ব্যাগ ফেলে দিয়ে হাতে বই নিয়ে আসা শুরু করলাম। লম্বা খাতা গুলো পিছে তারপর বড় বই তারপর ছোট খাতা কি বইটা সামনে রেখে হাতটা মুড়িয়ে কনুই ভাঁজ করে বই গুলো ধরাই ছিল কেতা। আমি বোনদের সাথে সকাল সকাল আসতাম আর আমার স্কুল বসত নিচের ক্লাস গুলির ক্লাস শেষ হলে, আমরা বেঞ্চে বই রেখে জায়গা দখল করে খেলতে নামতাম।

কি খেলা, সেই ঝাঁ ঝাঁ রোদে কি করে খেলতাম ভাবলেও এখন মাথা ব্যাথা করে। আমরা বোর্ডের বই পেতাম বছরের শুরুতে, সে এক দারুন আনন্দের ব্যপার ছিল, আগে ভাগে এক ক্লাস উঁচু কারো কাছ থেকে এক সেট বই যোগার করতাম কিন্তু ভাল লাগত না পড়তে, যখন নতুন বই পেতাম, আহ এর কি যে আনন্দ কি করে যে বোঝাই। সেই নিউজপ্রিন্টের মোটা খসখসে কাগজ, কিন্তু কি দারুন সব ইলাস্ট্রাশন তন্ময় করে রাখত। খুব মজার একটা ঘটনা ঘটল একবার, বই পেলাম ক্লাস থ্রি’তে প্রথম বিজ্ঞান বই পেলাম ব্যাপারই অন্যরকম সায়েন্স বলে কথা, গল্পের বই এর মত একদিনই বিজ্ঞান বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি, ততদিনে অবশ্য আমি গড়গড় করে বাংলা পড়তে পারি, রবি ঠাকুর এর “গল্পগুচ্ছ” গোটাটাই বুঝি বা না বুঝি শেষ করে ফেলেছিলাম, ক্লাস টু এর ফাইনাল পরীক্ষার পর। পরদিন স্কুলে আমি বন্ধুদের বলছি, আমার বিজ্ঞান বই পড়া শেষ তখন পাশে ছিল এক ক্লাস উপরে পরা একটি ছেলে আমার এখনো মনে আছে ওর নাম আরমান বলেছিল বলত “সৌর জগত” কাকে বলে? আমার সোজা উত্তর আমি তো প্রশ্নের উত্তর শিখিনী, ব্যস তাদের অভিমত আমি মিথ্যে বলছি। বুঝতাই পারলাম না এমনই এমনই পাঠ্য বই পড়া যায়, খালি পরা তৈরি করার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে পড়তে হয় তা কিন্তু না।

সে সময় সন্ধ্যা হলেই, ঝি ঝি কি ব্যাঙ্গের এক ঘেয়ে ডাকের সাথে সাথে পারায় পারায় পড়ার শব্দ পাওয়া যেত, ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান “অ্যা” সহযোগে, একই বাক্য বার দুয়েক করে বলে বলে রপ্ত করতে হত, বড়রা কান খাড়া করে রাখত, বাচ্চা পড়ছে কিনা। পৌরসভার টিম টিমে হলদে বাতি, ঝুপ্পুস সব গাছ পালার অদ্ভুতুড়ে ছায়া, রিকসার টুং টাং ঘণ্টি আর একটানা পড়ুয়াদের পড়া করার শব্দ কি যে এক আবহ তৈরি করত সে আর বলবার নয়। রাস্তার ধারের হিন্দু দোকানীরা সন্ধ্যা হলেই ধুপ ধুন জ্বালত, তার গন্ধ আর আস পাসের পত্র পল্লবের নিবিড় গন্ধ, মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকত। তবে রাতের খবর আমার কাছে তেমন কিছুই নেই কারন সন্ধ্যা হলেই আমি চোখ ছোট ছোট করে ঘুমিয়ে যেতাম, বোনেরা বলত এই এক্ষন আদিনার দাদুর মত ঘুমাল, হায় কে যে এই আদিনার দাদু জানিনা, উনি নাকি কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যেতেন, বাবা চেম্বার থেকে ফিরলে কখন উঠিয়ে খাওয়াতেন কখন উঠতেই পারতাম না, আর রাত্তিরে দুধ ভাত ছাড়া কিছুই খেতাম না। যেন অল্প আয়েসেই খাওয়া শেষ করা যায়। আর তাই খুব সকাল সকাল উঠতাম, কি যে কোমল সোনার মত সকাল গুলো ছিল! আর অপেক্ষায় থাকতাম কখন স্কুলে যাবো। স্কুল যে কি এক অমোঘ আকর্ষণ তা আর বলবার নয়।

সেবার স্কুলে মিলাদের আগে আমাদের স্কুলের দপ্তরি আশরাফ ভাই এলো ক্লাসে, মিলাদের গানের জন্য নাম জমা দিতে আগ্রহিরা যেন বড় আপার রুমে যাই, ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেনে এসব কিছু পাই নই ভাড়া বাসার ক্যাম্পাস কত আর কি হবে! আমিও বন্ধুদের সাথে সাথে আপার রুমে হাজির, একে একে সবাই গাইছে কেউ টিকছে কেউ বাদ, সব শেষে আমি, আপা বললেন “গাউ” আমি শুনলাম “যাও” দরজার দিকে হাঁটা দিলাম, আপা নাম ধরে বললেন কোথায় যাও, একে তো অবাক আপা আমার নাম জানেন দুই গানের যে পরীক্ষা হবে তাই তো ছাই আমি জানি না, হামদ নাথ কি তাই জানিনা আবার কি গাইব। আমি কাচু মাচু মুখে বললাম, আমি তো শিখে আসি নি। আপা হেসে বললেন শারমিন (আমার পিঠাপিঠি বড় বোন) তো ভাল গান গায় ওর কাছ থেকে শিখে এসো। আমি তো আরও অবাক আসলে বড় আপার সাথে আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল, কিন্তু আমরা অনেক দিন ঢাকা থাকায় সেটা জানতাম না। তবে বাসায় ফিরে শিখে নিয়েছিলাম গান, “তাওহিদের এই মুরশিদ আমার মুহাম্মাদ রাসুল, আমার মুহাম্মাদ রাসুল”, আপা খুব খুশি আমাকে বললেন কোরাস না তোমাকে একা এই গান গাইতে হবে, সে কি কথা! আমি তো আকাশ থেকে পরলাম কোরাসে গাওয়া এক জিনিস আর একা গাওয়া, ক্লাসের সেরা গাইয়ে ছিল শ্যামা ওরা বাবা ছিলেন কলেজের টিচার, ও একা গাইবে আর আমি, শ্যামার ছিল তৈরি গলা, খুব সুন্দর কণ্ঠ খানিকটা ফাতিমা তুজ জোহরার মত হাস্কি। মনে নাই কিভাবে যেন ছুটকারা পেয়েছিলাম একা গাইবার হাত থেকে। আমার বরাবর স্টেইজ ভিতি আছে। এরও আগে আমাদের ধান্মন্ডির বাসায় বিশাল এক প্রোগ্রাম হয়েছিল, দাবা ফেডারেশনের, বাবা তখন ফেডারেশন এর প্রেসিডেন্ট, অনুষ্ঠানটা ছিল জুনিওর দাবা অলিম্পিয়াড, নিয়াজ ভাই (নিয়াজ মোরশেদ) তখন আপ কামিং স্টার, উপস্থাপনা করেছিলেন সে সময়ের টিভি স্টার রেশমা। এন্ডরু কিশোর গেয়েছিলেন “সমবেত বন্ধুগন আপনারাই বলুন, বলুন কি গাই, যখন সুযোগ দিয়েছেন”; সে কি জমজমাট অনুষ্ঠান, একুশে পদক পাওয়া নিপা আপা নেচেছিলেন, তো এহেন হাই ভোল্টেজ প্রোগ্রামে আমকে তুলে দেয়া হল, নিজেদের বাসায় প্রোগ্রাম, লন এ বিশাল স্টেইজ, ভি ভি আই পি লোক জনে ঠাসা। বোধহয় কে জি ওয়ান এ পড়ি, শুরুটা ঠিকই ছিল, টিনের চালে ঢিল টিল মারা বিষয়ক ছড়া, গড়গড় করে বলতে পারি, লাইন ছয়েক ভালোই গেল, হঠাৎ কি যে হল, সব একদম এদিক সেদিক হয়ে পুরা গুবলেট আমি চুপ দাঁড়িয়ে, সামনে বিশাল সব আলো, এখানেই শেষ না, পিছন থেকে হাওয়াইন গিটারিস্ট ট্যা ট্যা ট্যাঁও করে টিপিক্যাল বাংলাদেশী একটা কমেডি মিউজিক বাজিয়ে দিল। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, আর কিছু মনে নেই, নিজেকে আবিস্কার করলাম, কারো একজনের কোলে। সে ভিতি কিছু দিন মাস্টারি করার পর ছেড়েছে তাও সেই সব দিন গুলির বহু বছর পর।

তবে সেবার স্কুলের মিলাদে গেয়েছিলাম, তার পরের বছরও। ওই সময় গুল খুব ভাল লাগত, ক্লাস বাদ দিয়ে রিহার্সাল চলত, আবার স্কুল বেশ সিঙ্গারা কি লবঙ্গ খাওয়াত যদিও তখন লবঙ্গের ক্ষীর উধাও। বেশ একটা দোলা লাগা, পাখি ডাকা সুন্দর সময় ছিল।

সেই গাইয়ে শ্যামার সাথে আর কোনদিনই দেখা হয়নি কিন্তু একটা দুর্ঘটনার কারনে চিরদিন তার কথা আমার মনে থাকবে। তখন “জাতিও শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা” বলে একটা কম্পিটিশন প্রোগ্রাম চালু ছিল। আমরা তখন ক্লাস ফাইভের সেন্টার পরীক্ষা দিয়ে কিণ্ডারগারটেন ছেড়ে দিয়েছি, আমার সেজ বোনের বিয়ে ছিল, ঢাকার বাসায় অনেক দিন কাটিয়ে কিশোরগঞ্জ ফিরেছি, গভঃ বয়েজ স্কুলে ভর্তি শেষ, কি হবে চিন্তায় অস্থির, কিন্তু কিছু সিট খালি থাকায় আবার পরীক্ষা হল, চান্স পেলাম, সে সময় সে স্কুল থেক প্রতি বছর কেউ না কেউ স্ট্যান্ড করে। যাক দেরিতে স্কুলে ভর্তি হওয়ায় আমি স্কুল থেকে সে প্রতিযোগিতায় নাম দিতে পারিনি, একটা ক্লাব তাও অন্য পাড়ার, সেখান থেকে নাম দিলাম, পাঠক ভাবিত হবার কিছু নয় গানে নয় দাবা, যে একটি খেলায় কিঞ্চিৎ কনফিডেন্স আছে। একের পর এক খেলা হল, আমার স্কুলও আমার কাছে হারল গেইম টিচার বারিক স্যার কিঞ্চিৎ রুষ্ট হলেন, কেননা আমার মেজ ভাই ছিলেন এই স্কুলের চ্যাম্পিয়ন স্পোর্টম্যান আর আমি কিনা তার ভাই হয়ে! যাক উপজেলা, পার হয়ে ডিসট্রিক্ট চ্যাম্পিয়নও হয়ে গেলাম আনবিটেন। আমার ক্লাব খুব খুশি, এবার ময়মনসিংহ যাওয়ার পালা। ক্লাবের উৎসাহ শেষ, বারিক স্যার বললেন আমি উনাদের সাথে যেতে পারি, এক গাড়িতে সেই শ্যামা সে হয়েছিল গানে চ্যাম্পিয়ন, তার মা, আমার আগের স্কুলের বড় আপা, তার মেয়ে পপি আপা, স্যার এরা সব যাবেন, তবে শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে উঠেনি আমার। পরে সে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে আর শ্যামার মা মারা যান! খুবই দুঃখজনক।

বড় ভালো ছিলেন তিনি!
আমরা ফিসারিতে যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, আমরা ছেড়ে আসার পর সেই বাসাতেই শ্যামারা ভাড়া এসেছিল, বাসা ছেড়ে আসার পর কোন একদিন ফিসারিতে সাঁতার টাতার কেটে আগের বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে দেখা করতে গেলাম কি কাজে কে জানে, দুটি বাসা পাশাপাশি, একতলা। মাঝখান দিয়ে ঢুকতে হয়, আমি নাম ধরে ডাকছি, আমাদের আগের বাসায় কেউ একজন গাইছে খুব সুন্দর “ শাওন ও রাতে যদি...” হঠাৎ সেই বাসার জানলা দিয়ে একটা চেনা মুখ দেখলাম, সে সময় গরাদ দেয়া জানালায় অর্ধেক পর্দা ঝুলত উপরের অংশটুকু ফাঁকা থাকত, সেই ফাঁকা দিয়ে কচিৎ একটা মুখ এসে চলে গেল। তারপর বারান্দার দরজা খুলে একজন ভদ্রমহিলা বের হয়ে এলেন। আমার নাম ধরে বললেন এসো বাসায় আমি লজ্জায় আধখানা হয়ে যাই, কাঁধে তোয়ালে এক হাতে ভেজা হাফ প্যান্ট। কিনা শ্যামা কয়েকদিন স্কুলে যায়নি ,কি পড়া হয়েছে একটু দাগিয়ে দাও না। কি জ্বালা! এ অবস্থায় কি আর পড়া দেখান যায়। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, এর মাঝে মোড়ায় বসে পড়া দাগাচ্ছি, ভাবলে এখনো কেমন লজ্জা লাগে। হায় কৈশর! জগতের নিগুর রহস্যের দ্বার খানিক খুলতে শুরু করছে তখন, বোঝা না বোঝার দোলাচলের দিন গুলির সেইসব ছোট ছোট ঘটনা, কত অর্থহীন বাক্য, কত দৃশ্য, রয়ে গেছে স্মৃতির কোন গলি ঘুচিতে। কে কোথায় সরে যায় ঘটনার ঘন ঘটায়, কারুর আবার দেখা মিলে কারুর আবার কখনই নয়।

আমি সব সময় খানিকটা পিছিয়ে পরা মানুষ, অনেক সহপাঠীরা যখন বেশ এগিয়ে অনেক কিছুতেই, আমি সে সব একটু কমই বুঝতাম, বই আর পাগলের মত খেলাই তখন ছিল জীবন আমার। দিন মান শুধু খেলা আর খেলা, শৈশব মানে তো এই ছিল, এখন কার মত, মাপা হাসি চাপা কান্না, ভারি বিদ্যার বোঝা নিয়ে স্কুলে যাওয়া তো ছিল না। ছিল না ইন্টারনেটের মত সর্বগ্রাসী জালিকা। সব আজ কাল আটকে আছি, লটকে আছি। শৈশব ছিল খোলা হাওয়া, শৈশব ছিল অবাধ সাঁতার। নিজের মত বেরে ওঠা।

কিশোরগঞ্জ ছাড়ার আগে শেষ মেস যে বাসাটিতে উঠে আসি সেটি ছিল শহরের একদিকের প্রায় শেষ প্রান্ত আমাদের বাসার পর আর দুয়েকটা বাড়ী তারপর প্রায় গ্রাম। শীতকালে স্কুল ছুটির পর ঢাকার বাসা থেকে ফুলদি আসলে আমরা হাটতে যেতাম , কত দূর যেতাম! কোথাও শীত কালের ফাঁকা খেত, কোথাও কলাই কি মটরের খেত, ধনে পাতা কি মৌরির গন্ধ মৌ মৌ করত। কি এক রূপকথার মত বিস্তার, এই সময় থেকে মাঠের পারাপার কিছুই দেখতে পাই না। হারিয়ে যাওয়া তেপান্তরের মাঠে শুধু কিছু আবছায়া পথের রেখা দেখি ক্ষীণ। কর্ম, ক্লান্তি পথের পাশের ঘাসের মত চেপে চেপে আসে, রেখা ক্ষীণতর হয়। কারুরটা মিলিয়ে যায় একদম। তারা সুখী মানুষ! অতীতহিন, স্মৃতিবিহিন শুধু ভেসে যাওয়া নিত্য সময়ের সাথে। আর কেউ কেউ অতীতচারী, এও মন্দ নয় তেমন, নিজের ফেলে আসা ছায়া, নিজের হারান ছন্দ, সব যেন মোজাইকের ছবির মত, না মিলে রং হুবুহু, না মিলে আকার কিন্তু সব মিলিয়ে একটা সুন্দর ছবি হয়ে যায় খুব।

ফুলদির বিয়ের ঠিক আগের শীতটা সেবার খুব সুন্দর ছিল। সে কি আনন্দের দিন গুলি যে ছিল! বাসায় থাকলে দাবা কি লুডু, দিন মান গল্প, কাড়াকাড়ি করে বই পড়া, আর বিকেলে হাঁটতে যাওয়া। ফুলদি একটা কবিতা লিখেছিল “আর দেরি নেই অগাস্ট মাসে ডিগ্রী পরীক্ষা...” আমরা উল্টো করে বলে বলে খ্যাপাতাম “আর দেরি নেই ডিগ্রী মাসে অগাস্ট পরীক্ষা”। তবে বলতে দ্বিধা নেই ছোট চার জনের মাঝে আমিই ছিলাম সব চেয়ে খেপচুরিয়াস। আর শারমিন খ্যাপানো টাকে একদম শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যে কোন ভাবেই আমাকে সে খ্যাপাতে পারত। এখন হাসি পায় আর তখন রাগে ফোঁস ফোঁস করতাম! শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই যে হত না তা নয়, কিন্তু পেরে উঠতাম না , একে তো বড় তার উপর স্বাস্থ্যে শক্তিতে আমার চেয়ে এগিয়েই ছিল, শুধু লম্বা চুল গুলোই যা একটু দুর্বলতা ছিল বেচারির। কোন একদিন ধুন্দুমার ফাইটিঙ্গের পর রন ক্লান্ত আমি ফোঁস ফোঁস করছি, আমাদের ভাই বোনদের বিছানা পাশাপাশি, ওদেরটা বড় আর আমার টা ছোট টান টান করে পাতা চাদর, দু বিছানার উপর দুটো জানালা। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, পাড়ার হুলোটা এসে হাজির, ‘দু’টি বিড়ালছানা’র ছবির মত, খয়েরি রঙ্গের হোঁৎকা একখানা, প্রথমে জানালায় তারপর লাফ দিয়ে আমারই বিছানায়, ময়লা পা গুলোর ছাপ ফেলে ফেলে হেঁটে দরজা দিয়ে চলে গেল! রাগ এ গা জলে যাচ্ছে, এর মাঝে শারমিনের হাসি যে হাসির একটাই অর্থ দাঁড়ায় “বেশ হয়েছে”! রাগ এ ফোঁস ফোঁস করছি আর সবাই হাসছে! উহ অসহ্য!
আহা কি মধুরই না ছিল সেই দিন গুলি! বড় হওয়ার পর খ্যাপালে আর রাগ করতাম না! আসলে বাবার মৃত্যুর পর সব কিছুই বদলে গেল। আমরা বুঝি অল্প দিনেই অনেক বড় হয়ে গেলাম! আর শুধুই আমরা দুজন নিজেদেরই একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলাম, এমন কোন কোথা নেই যা আমরা শেয়ার করতাম না। এক সাথে ছাদে উঠে কিংবা রিকশা দিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে কত গান গাইতাম। ও কখন শিখেনি কোথাও, কিন্তু কি যে ভালো গাইত, রুনা আর আশার গান ওর গলায় খুব ভাল আসত, আর ছোট কাল থেকে খুব ভাল নাচ করত, সেই যে অনুষ্ঠানে আমি সব গুব্লেট করলাম, সেখানে নিপা আপা এসেছিলেন, “নাচের নিপা”, একটা কথা বলেছিলেন আমার খুব মনে আছে। বলেছিলেন কিশোরগঞ্জে এর পর যদি কেউ নিপা হয় সে হবে শারমিন, খুব আদর করতেন ওকে। আর মজার কথা আমার ভাই বোনেদের মাঝে আমি ছাড়া সবাই নাচ শিখেছে, আমার অবশ্য ছেলেদের এই কলাটি বিশেষ প্রিয় নয়, তবে কিশোরগঞ্জ কিন্তু নাচের জগতে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে নিঃসন্দেহে!

এমন একটি দিন বুঝি যায়নি যে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করিনি, কত অর্থ হীন কথকতা। খুব সুন্দর করে থাকতে ভালো বাসত বোনটি আমার! মাথা ভর্তি ছিল ঈষৎ লালচে চুল, যদিও খুব ছোট বেলায় ওর চুল গুলো ছিল কালো এবং ঝাটা মানে একদম স্ট্রেইট। আর আইরিনের ছিল কোঁকড়া কোঁকড়া। আমরা বলতাম কোঁকড়া চুলি, ঝাটা চুলি। কোন এক অদ্ভুত কারনে বড় হওয়ার পর চুল গুলো ওর কিছুটা ঢেউ ঢেউ হয়ে গেল। আমরা ছিলাম পার্টনার অফ অল ক্রাইম। লুকিয়ে বাবার চুরুট খাওয়া কি নিষিদ্ধ হজমি কি হাওয়াই মিঠাই খাওয়া! লুকিয়ে মুভি দেখা কি দূরে কোথাও চলে যাওয়া, দিকশুন্যপুরের মত কোথাও। সব কিছুতেই আমরা। যুঝতাম তেমনি আবার গলায় গলায় ছিল ভাব। ওর বড় ছিল আইরিন, আমাকে কখনই খ্যাপাত না, আর ঘুমের সময় ওর লম্বা নখ দিয়ে আমাকে পিঠ চুল্কে দিতেই হত, এখন যখন আমার ছেলেদের পিঠ চুল্কে দেই সেই গল্প ওদের বলি। আর আইরিন ছিল আমার ব্যাংক, জমা দেয়ার না, শুধু টাকা নেবার, ও খুব ভালো ছাত্রী ছিল বেশ স্টাইপেন্ড টাইপেন্ড পেয়েছিল, আর বাবাও ঢাকা আসলে কিংবা অন্যকোথাও গেলে ওর কাছে আমাদের খরচের টাকা দিয়ে যেতেন। অসময়ে কিছু খেতে চাইলে কিংবা খেলার কিছু লাগলেই “আইরিন”। আমার প্রথম স্টিলের ব্যাডমিন্টন র্যা কেট টা ওই কিনে দিয়েছিলো, আমি অবশ্য ধার নিয়ে ছিলাম সে ধার আর শুধিনি কখন, পৃথিবীর কিছু ঋণ থাকুক এমন! সব শোধ বোধ হয়ে গেলে যে হিসেবের খাতা শূন্য হয়ে যাবে। থাকুক কিছু ঋণ!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৩৪

ঘাসফুল বলেছেন: সন্ধ্যা থেকে এই পর্যন্ত ১২ টি পর্ব পড়ে ফেললাম, অসাধারন লেখা।

২| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১০:৫৯

রবাহূত বলেছেন: you made my day!thanks a lot.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.