নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(লিখাটা অনেক বেশি ব্যাক্তিগত হয়ে গেছে। কিন্তু এ সবই জীবনেরই অংশ। আমার এ ভ্যাজর, ভ্যাজর, কেউ কেউ পড়েন। স্নেহ ভালবাসার চোখে দেখেন, তাই ভালও বলেন। আমার এ লিখার আরেকটা কারণ সময়ের নিয়মে আমিও থাকব না একদিন, আমার ছেলেরা হয়ত কোন এক অলস সময়ে পড়বে, চলে যাওয়া আমাদের কথা ভাববে। নীরদ বাবুর লেখা “The Autobiography of unknown Indian.” লিখাটা যেমন, আমারটাও তেমনি, “নাচেনা কোন একজনার লিখা”... না নীরদ বাবুর লিখার সাথে আমার লিখার কোনই তুলনা চলে না, শুধু রবীন্দ্র নাথের রঞ্জনায় যেমন লিখেছেন, “আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ” এর মত আমাদের দুজনার বাড়ীই কিশোরগঞ্জ।)
বাবা একে ডাক্তার তায় আবার পলিটিক্স করেন, দুনিয়ার লোকেদের আনা গোনা ছিল। বিচিত্র সব লোক! তো সেই দলে একজন প্রায়ই আসতেন, আমরা নাম দিয়েছিলাম শরৎচন্দ্র! শরৎচন্দ্রের বই এর প্রচ্ছদে সব সময় তাঁর একটা ছবি ছাপা থাকত, পেন এন্ড ইঙ্কে আঁকা লাইন ড্রয়িং বাবরী চুল মাথাটা একটু হেলানো। সেই লোকটিরও ছিল তেমনি চুল আর শরৎ বাবুর মত চোখ। সহসা শরৎ বাবু কেন এলেন? সে এক কাণ্ড বটে! একদিন আমি টেবিল কি আল্মিরার দেরাজে দেখি অনেক গুল একশ টাকার নোট, গুনে দেখি আঠার’শ টাকা কিংবা আইরিন দেখিয়েছিল এত গুল টাকা, ঠিক মনে নেই! তবে তার ভাষ্য ছিল শরৎ বাবু এই টাকা কয়টি বাইরের ঘরে ভুলে ফেলে গেছেন, শুধু তাই না তারপর বার দুয়েক এসেছেন বাবার খোঁজে কিন্তু টাকার কথা কিছুই বলেননি!
আমি উত্তেজনার চরমে! আমরা তিন ভাই বোন ভাগ করলে এক একজন পাবো ছয়শ টাকা! ছয়শ টাকা! এ তো বিরাট ব্যাপার! তখন একটা টেনিস বল কিনতে পারতাম দশ টাকায়, বড় ঢাউস একখান ঘুড়ি পেতাম দেড় টাকায়, সবচেয়ে সেরা পাঁচ নম্বর বলটার দাম ছিল দেড়শ কি দুইশ টাকা! অত টাকা দিয়ে যে কি করব! কিন্তু আইরিন তো টাকা গুলো ছাড়ছে না, খালি ঘুরাচ্ছে। কিছুই বুঝচ্ছি না! এদিকে বাবার ফেরার টাইম হয়ে যাচ্ছে। একদিন দুদিন যায়, শিকে আর ছিঁড়ছে না! এর মাঝে বাবা ফিরে এলেন এবং ভগ্ন হৃদয়ে দেখলাম টাকাগুলো সে বাবার হাতে তুলে দিল! কি না, বাবাই টাকা গুল দিয়ে গিয়েছিলেন আইরিন কে, একজন লোকের এসে নিয়ে যাবার কথা ছিল, তিনি আর আসেননি আর মাঝখান দিয়ে কয়েকটা দিন কি যে গেল আমার! মুহূর্তে স্বপ্নের বেলুনটা চুপসে গেল। ডজন খানেক টেনিস বল, ফুটবল, টিপ-নাটাই, ম্যারাডোনার পোষ্টার ইত্যাদি সব কিছু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! ফুঃ!
এমন বোকা ছিলাম! কি যে এক একটা কান্ড হত! এক সন্ধ্যায়, ফুলদি কিছু টাকা দিল, যাও তো ভাইয়া, এক দৌড়ে, সামুচা নিয়ে এস, বলে হাতে ষোল টাকা দিল, আমিও খুশি মনে টাকা পকেটে পুরে এক দৌড়, সেই সব চপ সামুচার আনন্দ, একালের বাচ্চাদের পিৎজা খাওয়ার আনন্দের মতই ছিল। গরম গরম সামুচা কিনে পকেটে হাত দিলাম, একি টাকা কোথায়, নাই দুই পকেটের এক পকেটেও নাই! মুখ চুন করে বাসায় ফিরলাম। ফুলদি আবার টাকা দিল এবং আবার একি ঘটনা। আমি লজ্জায় এতটুকু হয়ে বাসায় ফিরলাম, সবার সে কি হাসাহাসি, আসলে প্যান্টার পকেটটা ছিল ছোট আর দৌড়ে যাবার সময় পকেত থেকে টাকাটা, পিছলে গিয়েছিল পরে। আমার কি দোষ! সামুচা খাবার উত্তেজনাই যত নষ্টের মূল! সেদিন গেল আমাদের সামুচা খাওয়া! এ গল্প এখনো প্রায় প্রায়ই উঠে আসে! কত সহজ সুন্দর না ছিল দিন গুলি। সেই শীতটাই অন্যরকম ছিল। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ! ঢাকার বাসা থেকে ফুলদি চলে এসছে লম্বা ছুটি। সেবারই আমি প্রথম কবিতা লিখি। অন্যসব কবিতদের মত কবিতা লিখার কারণ একটি মেয়ে!
আমাদের পিছের বাসায় থাকত কুসুম, পারুলরা! তাদের বড় বোনটি শারমিনদের সাথে পড়ত, উনার নাম বুঝি ছিল চম্পা, ঠিক মনে নেই, তবে কুসুম আমাদের এক ক্লাস উপরে পড়ত। এই সে মেয়ে যার জন্য আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম। ওদের মা আমাদের খুব ভালবাসতেন, সব সময় খোঁজ খবর রাখতেন, আমরা সবাই আর ওরা তিন বোন এক ভাই খুব হই চই করতাম। তো কুসুমদের এক আত্মীয় সুলতান ভাই এসেছিলেন সেবার, তিনি ছিলেন কবি। উনি বেশ কবিতা টবিতা বলে ভাব টাব নিলেন, পরদিন দেখি কুসুমও একখানা কবিতা লিখে ফেলেছে! কি কাণ্ড! এই কুসুম ছিল একটু ঝগড়াটে, আর খেলতে গিয়ে খুব ঝগড়া টগড়া হত, আমার খুবই রাগ ছিল! তো এই কুসুম কবিতা লিখে ফেলেছে, আবার সুলতান ভাই ও বেশ পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন! আমি বাসায় ফিরেই নামিয়ে ফেললাম দু তিন খানা কবিতা, এ আর এমন কি, খাতার কাগজ ছিঁড়ে, প্রচ্ছদ আঁকলাম “জিহুয়ার ভালুকের”, শেষ পাতায় লিখলাম, আমাদের প্রকাশিত পরবর্তী বই, “এক কালো রাত্রির কথা”! সে খানা এখনো আমার কাছে আছে, পুরনো কাগজ প্ত্রের ফাইলে। সে সব একদমই শিশুতোষ লিখা কিছুটা সুকান্তর হে সূর্য, শীতের সূর্যর ভাব নিয়ে শীত টিত সংক্রান্ত, “আমরা ছাত্র আমরা বল” এই জাতিও একটা! সেখানে বেশ মশাল আর শিকল টিকল দিয়ে ইলাস্ট্রেশন করা। আরেক খানা বড় ভাগ্নেকে নিয়ে, এখন সে কর্পোরেট অফিসের বড় বাবু। শুরুটা শিশুতোষ মূলক রোমান্স মনে হলেও আসলে তা নয়, বরং বেশ প্রতিহিংসা পরায়ণ আরম্ভই মনে হয়। তবে লিখা তো হল শুরু! তারপর কত জল বয়ে গেছে পদ্মা যমুনায়, কখন লিখি কখনও লিখিনা, কোথাও তেমন ছাপা টাপার সাহস করিনি, তবে খান চারেক লিখা কিছু পত্র পত্রিকায় বেরিয়েছে তাও এক যুগ আগের কথা, আর তেমন চেষ্টা চরিত্র করিনি তেমন।
আমার একখানা ডাইরি আছে শুরু হয়েছিল বোধ হয় দু’ হাজার সালে, প্রতি বছর দুয়েক পাতা করে লিখা, এই সতের বছরে বুঝি তিরিশ পাতাও লিখা হয়নি। ডাইরি প্রসঙ্গ আসলেই আমার জিম করবেট সাহেবের একটি কথা সব সময় মনে পরে, তিনি বলেছিলেন তোমার জীবন যাপন এমন হওয়া উচিত যেন তোমার রোজ নামচার খাতা কোথাও লুকাতে না হয়।জিম করবেট এক আশ্চর্য লোক। শুধু শিকারি নয় এক জন প্রাজ্ঞ দার্শনিক লুকিয়ে আছে তাঁর ভিতর, আমার মনে হয় রাতের পর রাত শিকারের মাচায় যখন সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে পার করতেন তখন নিজের ভিতর থেকে নিজেকে জাগিয়ে তুলতেন তিনি। বুদ্ধা যেমন বলেছেন, তেমনি ভাবে জ্ঞানকে জাগিয়ে তুলতেন। চিন্তাই তো নিজেকে জাগিয়ে তোলার অবলম্বন। তাই নিজের সাথে নিজের দেখা হয়াটা খুব দরকার, নিজেকে খুঁজে নিতে হয়, নিজেকে মন্থন করে সে অমৃত সুধার নির্যাস বের করতে হয়, এভাবেই মানুষ বিকশিত হয়, চেতনার ফুল নিষিক্ত হয়। আমাদের এই অস্থির সমাজ, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া, সময় খেকো জীবন যাপন, এতটুকু ফুরসৎ দেয়না আমাদের, মিনিট দশেক নিসচুপ বসি, খানিক ভাবি, মনকে স্থির করি। ইসলাম কিন্তু দিনে অন্তত পাঁচবার সেই সুযোগ করে দেয়, কিন্তু আমরা কি আর তা করি! ঝড়ের বেগে নামাজ পরেই ছুটি, কাজটা শেষ করতে হবে, টিভি শো টা না আবার শেষ হয়ে যায়, চুলোয় তরকারি না ধরে যায়! ছুট ছুট ছুট! ফলাফল? আমরা জানি না।
আব্দুল্লাহ আবু সাইদ স্যারের লিখায় পড়েছিলাম সফলতা নয় সার্থকতাই জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত! কোথায় সার্থকতা কোথায় কি! অস্থির যাপিত জীবন, ছুটে চলা নিরন্তর, মনের কবরেজদের রমরমা বাজার তৈরি করছে সমাজে, তারা কাউন্সিলিং করেন টাকা নিয়ে কথা শুনেন, মন্দের কিছু নেই, কথা শুনবার আর কে আছে আমাদের, ছোট ছোট ঘর, ছোট ছোট সংসার, মন খুলে কথা কইবারও তো লোক লাগে। আজকাল ম্যাগাজিনে দেখি বিভিন্ন টিপস থাকে দশ মিনিট আলো নিভিয়ে বসে থাকুন, সুন্দর কিছু ভাবুন, মেডিটেট করুন! আধ্যাত্মিক গুরু মহাগুরুরা বনে পাহাড়ে সামরাজ্য গড়ে তুলেছেন, শিস্য পারিষদ সকাশে ধ্যানে মগ্ন হচ্ছেন! মন্দ কি মানুষ টাকা খরচ করে নিজেকে খুঁজে নিচ্ছে অন্যের হাত ধরে। দিন দিন মানুষ বড় একা হয়ে যাচ্ছে। শহরে নগরে কত মানুষ, কত কারবার, কত ভীর, কত ভাট্টা। কিন্তু সব কেমন যেন ছেঁড়া ছেঁড়া দ্বীপের মত, কখন জোয়ারের জল আসলে এক হয়, জল সরে গেলে সব দূরে দূরে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ একেক জন!
আমার শৈশব ছিল না এমনতর! কত লোক কত জন! ছোট ছোট দুঃখ ব্যাথা, না পাওয়ার বাইরেও ছিল এক বিশাল এবং বিচিত্র আনন্দময় পৃথিবী। এ সময় থেকে দেখলে মনে হয় বুঝি খুব কোমল পেলব ছিল সে দিনগুলি! সে সময়, সময় ছিল মানুষের, নিজেকে দেবার মত।সে সময়, সময় ছিল মানুষের, অন্যকে দেবার মত।সময় ছিল মানুষের! কত আত্মীয় অনাত্মীয়, অতিথ-বান্ধবের ছিল আসা যাওয়া। কত বিচিত্র সব লোক, বিচিত্র তাদের অভিজ্ঞতা। বাসায় মেহমান আসলে আমি তাঁদের সামনে ঘুরাঘুরি করতাম খুব, কিছুটা খাবার লোভ আর কিছুটা গল্প শুনবার লোভ। গল্প আমায় খুব টানে। এই বয়সেও, মানুষের মাঝে গল্প খুঁজি, লিখবার জন্য নয়, শুধুই জানবার জন্য একটা গল্প। কত সহজ গল্প ছড়িয়ে আছে, আমাদের আসে পাশে। রাস্তা বন্দী থাকলে আমি বোর হই না বড় একটা, আস পাশের মানুষ দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়, কারুর মুখে চেনা মানুষের আদল। কারুর ঈষৎ হাসি মুখ, কারুর বা ম্লান, কিংবা ক্লান্ত! এ হাজারো মুখে আমি খুঁজে নেই গল্প! এ এক মজার খেলা! আমার হাই স্কুল ছিল ধান্মন্ডি গভঃ বয়েজ, সে স্কুলের বাংলা টিচার ছিলেন তাহের স্যার, বিখ্যাত টিচার। একদিন ক্লাসে জিজ্ঞেস করলেন বলত “সব চেয়ে দ্রুত যান কোনটি”? একেক জন একেকটা বলছে, কেউ বলছে রকেট, কেউ বা সায়েন্স ফিকশন থেকে কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে মারছে গুল। কিন্তু স্যার সবকটাকে উড়িয়ে দিলেন, বললেন “মন”, আমরা অবাক আরে তাইত, মুহূর্তে চলে যাই অ্যান্টারক্টিকায়, তখন ছিল আমার অ্যান্টারক্টিকায় অবসেশন। স্কট, এমুনডসেন, এদের সব অভিযানের লিখা গুলো খবরের কাগজ থেকে কেটে ফ্লাইং ডাচ ম্যানের প্যাকেটে জমাতাম, তিনখানা, প্যাকেট আমার জমে ছিল। সেই মন কে তো কেউ বাঁধতে পারে না, সেই মনের ময়ূরপঙ্খী চড়ে চলে যাই, এই সব মুখেদের বাড়ি, অফিস দপ্তর, কোন বাঁধা নেই, কেউ বলবার নেই, আটকাবার নেই। বিজ্ঞান যতই বলুক মন বলে কিছু নেই, তবু মন বলে মন আছে। আমি তো কোন ছাড়! স্বয়ং সক্রেটিস ভাবতেন বুকের কাছে একটা কিছু আছে, মোটর ড্রাইভ জাতিও। আসলেই এই বুকের বাম পাশটায় শুধু বিজ্ঞানের হৃদপিণ্ডই নয় প্রেমিকেরও একটা মন আছে, না হলে অনেক বছর পরেও কেন কাউকে দেখে বুকের কাছটায় ছলাৎ করে উঠে! কিংবা কারো ছোট্ট কোন ডাক কি কথা কিংবা হাসি বা দৃষ্টি! কিংবা হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা কেন ঠিক এইখানটা খালি করে রাখে। মন বুঝি এক মস্ত লেগো ব্লকের বাড়ী, সবার নামে নামে একেকটা কিংবা অনেকগুলো ব্লক জুড়তে জুড়তে বড় হতে থাকে। কোনটা উজ্জল লাল কারো বা ঝলমলে সবুজ, দুষ্টু গুলো কালো কালো। কেউ চলে গেলে দূরে কিংবা হারিয়ে গেলে ব্লক গুলো খালি হয়ে যায়, ফাঁকা হয়ে যায়, শূন্য হয়ে যায়। কখন ভেঙ্গে পরে হুড়মুড় কখন নড়বড়ে হয়ে রয়ে যায় কিছু শূন্যতা আর ভরে না, আবার কিছু নতুন লাল হলুদে ভড়িয়ে রাখে, কিছু কচি, কিছু হাসি মাখা। এসব নিয়েই বেঁচে থাকা অহোরাত!
শামসুল হক সাহেবের লিখা আছে “মারজিনে মন্তব্য”, অনেকটা শিল্পীর রাফ স্কেচের মত, আমার এই “মানুশ-পাঠ” খেলাটা অনেকটা স্কেচের মত, মনে মনে অনেক দূর গল্প এগিয়ে যায়, কিছু কিছু লিখা আছে, কিছু আবার হারিয়ে যায়। এক সময় গতিশীল ছিল জীবন, কত ঘাট আঘাটায় যেতাম, কত মানুষের সাথে জানা শোনা হত, আরও মানুষ কে জানতে পারতাম। আজ কাল তা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে, কে জানে ক্রমেই সব গুটিয়ে যাচ্ছে কিনা, খেলা শেষের খেলার শুরু কিনা, কে জানে?
আহ! সেই শৈশব, সে ছেলেমানুষি পদ্য খেলা, বড়ই- ধনে পাতা গন্ধী রোদ ঝলমলে ফাগুন, ঝাঁ ঝাঁ গ্রীষ্মের একলা দুপুর, অঝোরে ঝরা শ্রাবণ, কুয়াসার ধুপছায়া, সব কেমন বদলে গেছে, কিন্তু মনটা আটকে আছে সেই সময়ের শূন্য সুতোয়।
সে শীতের দীর্ঘ রজনীর পর সময় যেন চলে গেল সহসা। বাবা অলিম্পিয়াডে দুবাই ছিলেন, ফুলদির বিয়ে হয়ে গেছে, আমরা তিনজন ছোট একা, বিমাতা গেছেন উনার বাবার বাড়ী, মেজ ভাই লোকাল গার্জিয়ান হয়ে ঢাকা থেকে এসেছে। হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান, স্টাইল এবং ফ্যাসনে কেতাদুরস্ত, আর রান্নায় অতুলনীয়। সেবার যে একটা হাঁস রান্না করেছিল, এখনো তার স্বাদ লেগে আছে। আমার থেকে বেশ বড়, যেমন শাসন করত তেমনি আবার দোস্তিও ছিল খুব। আর যেহেতু আমি সব চেয়ে ছিলাম ছোট সবার আদরে লাই পেয়ে গিয়েছিলাম, দীর্ঘদিন নাম ধরে ডাকতাম, একটু বড় হওয়ার পর লজ্জায় ডাকনামের সাথে ভাইটা যোগ করেছি। সে সময় প্রতিদিন দুপুরের পর কাইজার ভাই হাঁক ছাড়ত “হয়ে যাক একহাত”। দাবা নিয়ে বসে যেতাম। ও না জেতা পর্যন্ত খেলা চলতই। ফলাফল বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। সে সময় ওর একটা ফ্লানেল এর লাল চেক শার্ট ছিল ব্যান্ড কলার, বেশ পরে আমি উত্তরাধিকার সুত্রে সে শার্টটি পাই, অফ হোয়াইট নিবের প্যান্ট দিয়ে পরত ও, শিশু আমি মুগ্ধ চোখে, দেখতাম। পরে যখন সে ব্যাঙ্কার হল সকাল বেলা ঘুম ঘুম চোখে দেখতাম সেইভ করছে, দুহাতে আফটার সেইভ নিয়ে সশব্দে গালে মাখছে, চকচকে জুতো, আর নিখুত ডিম্পল ওয়ালা নটে টাই বেঁধে যাচ্ছে, আমি মুগ্ধ চোখে দেখতাম। আমি নিজে এখন ব্যাঙ্কে গেলে সুন্দর পোশাক পরে যেতেই পছন্দ করি, কিন্তু যেয়ে দেখি অফিসাররা বসে থাকেন চেক শার্টের সাথে, জংলি ছাপা টাই পরে, গলা চোদ্দ আর কলার ষোল শার্ট পরে, তখন নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।
সেই মন্থর অলস দিন গুলিতে চিঠিটি এল। নীল কালিতে লিখা। আইরিনের নামে। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম, বোনরা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে, বাবা লিখেছিলেন, লিভার সিরোসিস বাসা বেঁধেছে। আমরা জানতাম এ খুব কঠিন অসুখ। আমাদের এক আত্মীয়ের সে অসুখ হয়েছিল, খুব যত্ন নিতে হয়, কে নেবে এই যত্ন তারপর বাবার নিরন্তর ছুটছুটি। পার্টির কাজ, ফেডারেশনের কাজ, এর উপর স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশি হয়রানি! বাবার দীর্ঘ দিন ধরে ছিল গল ব্লাডারে স্টোন, ব্যাথা উঠলেই হট ওয়াটার ব্যাগ চেপে শুয়ে থাকতেন, একটু উহ আহ শব্দও করন না। কি অসীম ধৈর্য ছিল! নিজে ডাক্তার কিন্তু কেন যে ছোট্ট অপারেশন টুকু করালেন না! হয়ত সময়, হয়ত অভিমান, হয়ত উদাসীনতা! কি বিশাল এক বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবন ছিল তাঁর, কিন্তু এত সাধারন ছিলেন ব্যবহারে বা কথায় ভাবলে অবাক হতে হয়। গ্রামের কেউ এলে, পুতু (চাচা), ভাই, ভাইস্তা বলে মানুষদের সাথে এমন ভাবে কথা বলতেন যেন তাদেরি কেউ বুঝি খুব আপন। কোনদিনই দেখিনি উঁচু গলায় কথা বলতে। অর্থ যশ কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেন নি জীবনে। দেশ এবং মানুষ তাঁর কাছে ছিল সবার উপর।
সে গল ব্লাডার এর যন্ত্রণা আরও বড় হয়ে এলো। চিঠিতে জানালেন দুবাইতেই শরীর খারাপ করেছে, অলিম্পিয়াড শেষ করে ঢাকায় প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করিয়ে ফিরবেন। আমরা যেন চিন্তা না করি। কত আর বড় আমি ফাইভ থেকে সিক্সে উঠেছি কেবল। কলপারের বাতিটির সুইচ, সেই কালো স্প্রিঙ্গওয়ালা সিরামিক সুইচ, আমি লাফ দিয়ে জ্বালাতে পারি বার দুয়েকের চেষ্টায়, মাঝে মাঝে একবারেই পারি। আমি প্রতিবার সুইচ অন করার আগে মনে মনে একটি লটারি করতাম, যদি এক লাফে সুইচটা অন করতে পারি বাবার কিচ্ছু হবে না, শিশুতোষ ইচ্ছে পূরণ খেলা।
বালক কি জানে এই পৃথিবী কত কঠিন! কারো চাওয়া পাওয়ার বিন্দু মাত্র মুল্য তাঁর কাছে নেই! বাবা ফিরলেন পিজি হসপিটালে দিন দুয়েক থেকে কিশোরগঞ্জ ফিরলেন। এর মাঝে আইরিনের বিয়ের কথা বার্তা চলছে, মেজদি কিশোরগঞ্জ তাঁর জাপানিজ ডল পুতুলের মত মেয়ে কে নিয়ে, বাবা ঢাকা থেকে সব স্ন্যাকস, গ্র্যান্ড সুইটস থেকে মিষ্টি, এসব নিয়ে এলেন। সকাল বেলা থেকেই সেদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, এর মাঝে আমি আর বাবা বের হলাম, ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে হবে, স্টুডিওতে গেলাম, ফিল্ম ভরে, বাবা আমার একটা ছবি তুল্লেন, আমি বাবার একটা তুল্লাম, বাবার পরনে ছিল হালকা নীল সাফারি স্যুট। ছবিটা আইরিনের কাছে আছে, দেখলে কেমন যেন মনে হয় মুখটা অনেক শুকিয়ে গেছে। বাবার স্বাস্থ্য বরাবর খুব ভাল দেখেছি মেদ ভুঁড়ি কিচ্ছু ছিলনা, যথেষ্ট বড় সড়, চওড়া হাড় ওয়ালা শক্ত পোক্ত মানুষ, খেতে পছন্দ করতেন কিন্তু পরিমিত খেতেন। ছবিটাতে সেই বাবা যেন নেই চওড়া কাঁধটা যেন নুয়ে আছে, আসলে ভিতরে ভিতরে কতটা ক্ষরণ হয়েছে, শারীরিক আর মানসিক, উপর থেকে কি আর যায় বোঝা! জীবনের ঝড় ঝাপ্টায় যুঝতে যুঝতে কোথায় কখন সে অটল প্রাচীরে চির ধরেছে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে, মরচে ধরে গেছে, সে খবর না বুঝেছি আমরা, না বুঝেছেন তিনি। কোন শৈশবে পিতা মাতা হারিয়েছেন, চাচা চাচি পিতা মাতার মত মানুষ করেছেন, আদর্শে শিক্ষায় প্রকৃত মানুষ করেছেন। আট সন্তানের জননী সুখ দুঃখের যে অংশীদার সে স্ত্রীও গত হয়েছেন, ছোট ছোট সন্তান রেখে। এ বিশাল সংসার, তাঁর পেশা, তাঁর রাজনৈতিক সামজিক কার্যক্রম সব সব সব কিছু কি পরিমাণ মানসিক চাপ সামলেছেন এখন ভাবলেও আতঙ্ক হয়। এ সব কিছু ধীরে নিরবে নিয়ে গেছে অমোঘ নিয়তির দিকে।
কথা ছিল ছেলে পক্ষরা এসে দেখবে কথা বার্তা বলবে, মধ্যস্ততা করেছিলেন নজরুল ভাবি (অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্ত্রী), আর তোতা ভাবি, বাবা খুব ইচ্ছুক ছিলেন না, আইরিন তখন মাত্র হায়ার সেকেন্ডারি পরে, কিন্তু দুই ভাবির অনুরোধ, আর হয়ত নিজের শরীরের কথা চিন্তা করে রাজি হয়েছিলেন। বিকেলে সবাই আসলেন কথা বার্তা হল, কথা পাকাও হয়ে গেল। আমার বোনের হবু শাশুড়ি (খালাম্মা, আদত আত্মীয়তা সুত্রে ছিলেন ভাগ্নি) আনন্দের অভাল্টিন কেক্টা খুব পছন্দ করে খেয়েছিলেন, পরে যখন গায়ে হলুদের কথা বার্তা চলছিল আমার খুব মনে আছে খালাম্মা বার কয়েক বলেছিলেন বেশি ঝামেলা করার দরকার নাই, ওইদিনের মত কেক টেক থাকলেই হবে। সবাই চলে গেল, কাকিমা এসছিলেন, মেজদি ছিল আর আমরা তিনজন ছিলাম, সন্ধ্যায় গল্প গুজব করলাম, রাত্রে বেলা সবাই খেয়ে টেয়ে, ফ্রিজে খাবার টাবার তুলছি, বাবা রাত্রে কিছুই খেলেন না। এই দিন আমি বাবার সাথে শুব কথা হল, রাত্রে যদি শরীর খারাপ করে। শুতে গেলাম প্রায় সাড়ে এগারটার দিকে দেখি বাবা তখনও সজাগ, চিরাচরিত ভঙ্গিতে ডান হাত কপালে আড়াআড়ি রাখা, আমি মশারি ফেলে গুজে বাবার পাশে শুলাম, বাবা অদ্ভুত কিছু কথা বললেন যার অনেক কিছুই বুঝি নি, আর যার অনেক কিছুই একান্তই আমার। একটা কথা ছিল তোমাদের অথই সায়রে ফেলে গেলাম। বাবা বুঝি তখন বুঝে গেছেন খুব, ঘনিয়ে আসছে ঘুমের ঘোর। আমাকে বললেন খারাপ লাগছে, গামলাটা দাও বমি করব। আমি তাড়াতাড়ি খাটের নিচ থেকে গামলাটা বের করে উঁচু করে ধরলাম, একগাদা রক্ত বমি হল, আমার হাত টাত ভড়ে গেল, তবু ধরে রাখলাম, শক্ত করে। কি কষ্ট কাউকে বলিনি সে কথা। বাবা বললেন, এইবার ডাক্তার ডাক। আমি রুম থেকে বের হলাম সবাইকে বললাম, কে ডাকবে ডাক্তার এত রাতে আমিই একমাত্র ছেলে মানুষ। আমাকেই যেতে হবে। কাকিমার বাবার বাড়ী হয়বাৎনগর মোড়ে, আমাদের বাসা থেকে দশ পনের মিনিটের পথ, আমার চাচাত ভাই, ওখানে আছে, ওকে নিয়ে ডাক্তার আনতে যেতে হবে। আমি ঘরের জামা স্যান্ডাল পরেই দৌড়ালাম। অন্ধকার রাত, না আছে ষ্ট্রীট ল্যাম্প না আছে চাঁদ কিংবা তারার আলো, চেনা পথ, আমি ছুটলাম, ঠিক মোড়ে ছিল গোরস্থান, দিনে দুপুরেও ওদিকে গেলে ভয় করত আর আজকে কোন ভয় কোন ভীতি কিচ্ছু না আমার কাছে, সেই থেকে বিশ্বাস মানুষ যত ছোটই হউক প্রয়োজনে সব করতে পারে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে “মামুন ভাই” কে সব বললাম, তারপর গেলাম ডাক্তার এর কাছে, ডাঃ এল, হারুন, এই গভীর রাতেও বিনা বাক্য ব্যায়ে কাকা চলে এলেন, স্থির হল সকাল বেলায় ঢাকা কি ময়মনসিংহ নেয়া হবে। কিশোরগঞ্জের এম্বুল্যান্স বোধ হয় নষ্ট ছিল ভৈরব না কোথা থেকে যেন এলো এম্বুলেন্স, চালিয়ে এনেছেন বাবার এক কালের কমপাউনডার সিরাজ ভাই। সকাল সকালই বাবাকে নিয়ে রওয়ানা হল আমি যেতে চাইলাম, বাবা বললেন তোমার বোনদের দেখবে কে, বেশ একটা গুরুদায়িত্ব নিয়ে বাসায় থাকলাম। ঢাকা থেকে অন্য ভাই বোনরা রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে এর মাঝে। আমাদের কথা হল কাল বাবা পরশু যাবো আমরা। এর মাঝে রোজই কেউ না কেউ বাবাকে দেখে ফিরছেন, আগের চেয়ে ভালো আছেন, আমরা আশায় বুক বাঁধছি, আর কারো না কারো সাথে যাবো এমন ভাবছি। এর মাঝে সেই কল পারের সুইচটা আমি প্রতিবার একলাফে জ্বালাতে পেরেছি, অসুখে পরা আর হস্পিটালে যাওয়া এর মাঝে বেশ যে মাস দুয়েক কেটে গেছে খেয়ালি করিনি, শুধু ভাবতাম বাবার নিশ্চয়ই কিছু হবে না।
দিন দুয়েক পরে তেমন কাউকে না পেয়ে আমরা তিনজন আর মেজদি রওয়ানা দিলাম, টিকিট কেটে বাসে উঠে বসলাম, এমন সময় দেখি খালাম্মা ( আইরনের শাশুড়ি), কি ব্যাপার খালাম্মও যাবেন নাকি। না উনি আমাদের ফিরিয়ে নিতে এসছেন। বাবরাই নাকি ফিরে আসছেন। খুসিতে মনটা ভড়ে উঠল, নিশ্চয়ই বাবা ভালো হয়ে গেছেন। এখন থেকে আমি খুব ভাল হয়ে যাবো অনেক পড়াশুনো করব, ঘোর দুপুরে ঘুড্ডি নিয়ে বেরুব না, বাবাকে অনেক হ্যাপি করব। ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরে এলাম, মেজদি তালা খুলছে বাসার, সাদা সুতি শাড়ী পরা, তালা খুলতে খুলতে হঠাৎ বলে উঠল বাবারই আসছেন মানে খালাম্মা? বাবা কি আর নাই? সবাই কান্না কাটি শুরু করল, আমাদের রুমের বিছানায়, আমি পড়ার টেবিলের কোনায় বসে, চুপ করে সব দেখছি, টেবিলে তখনও রাখা এই সেদিন দুবাই থেকে আনা চিলগোজা, ওয়াল নাটের প্যাকেট, সবুজ পামলিভের না খোলা মোড়ক, চকলেট সব! কি বলছে এরা সব। আমি উঠে কল পারে গেলাম এক লাফে না পা উঁচু করেই সুইচটা অন করতে পারলাম। যাক বাবা ঠিক চলে আসবেন, আমার অনেক কথা বলবার আছে, আমি কতটা লম্বা হয়ে গেছি, এই সুইচটা লাফ না দিয়ে জ্বালাতে পারি। আমি আবার ঘরে এসে সেই চেয়ারটায় বসে থাকলাম। এক সময় আইরিন এসে আমকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল ভাই কাঁদো ভাই কাঁদো বলে। শুরু হল কান্না, সে কান্না বুঝি আজো থামেনি, কখন চোখের জলে, কখনও বা শুধুই শুষ্ক ক্ষরণ, সবার অলখে। আমি দীর্ঘ দিন ভাবতাম হয়ত হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে বাবার সাথে। পৃথিবীতে কতই না মিরাকল ঘটে! হায় অবুঝ বালক মন তাই কি আর হয়, মৃত্যু এক অমোঘ নিয়তি!
বাবা ফিরলেন! নিথর দেহ, মুখটা খুব ক্লান্ত, ভুরু দুটো ঈষৎ কুচকে আছে, যেন কত কি করার বাকী রয়ে গেছে। কি যেন এক দুঃখবোধ! গভীর এক ক্লান্তি। কিন্তু একি সাথে মুখটা খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। খুব বেশি বয়স ছিল না মাত্র আটান্ন। অনেক লড়তে হয়েছে, বাইরে ঘরে। শৈশবে মা-বাবাকে হারানো, মধ্য চল্লিশে স্ত্রী- বিয়োগ এ সব ব্যাথা সইতে হয়েছে। বাবাকে শেষবার যখন দেখি এম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছে, গায়ের জামাটি বদলাতে চাইলেন, আমি একটা পাঞ্জাবি নিয়ে আসলাম, বলেছিলেন এটা খুলতে কষ্ট হবে, আর কি ফিরে আসবো? বুঝে গিয়েছিলেন, আমরা বুঝিনি, বুঝতে চাইনি। যাওয়ার আগে আইরিন কে ডেকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু লোকেদের ভিড়ে আর বলে যেতে পারেননি। কে জানে কি ছিল বলবার! জানা হল না।
বাবা বলে গিয়েছিলেন কবর যেন তাঁর বড়চাচার পাশে দেয়া হয়। তাই হল। বাবা আমাকে জিম্মাদারি দিয়ে গিয়েছিলেন, অন্তিম যাত্রার শুরুর আগে তাই আমাকে সম্মতি দিতে হল, এ কোন এক ধরনের রেওয়াজ, আমার অত বিষদ জানা নেই। কিন্তু আমার জন্য এ বিশেষ কিছু। তারপর, তারপর সব ক্যামন পাল্টে গেল। বাবা শুয়ে রইলেন কবরে। দিন কয়েক কেটে গেল ঘোরের মাঝে, কি হচ্ছে না হচ্ছে বুঝছি না কিছু। যে যা বলছেন করছি। এখানে ওখানে শোক সভা হচ্ছে কোথাও যাচ্ছি কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। বাবার দাফনের সময় রাজনৈতিক অনেক সহকর্মীরা গ্রাম পর্যন্ত গিয়েছিলেন ওবায়দুল হক, বি চৌধুরী ইনারা সব। আর জানাজার পরও অজস্র মানুষ অভিযোগ দিয়ে গেছে কেন একদিন রাখা হল না, কেন “ডাক্তার সাব” এর জানাজা পরতে পারল না। এত ভালোবাসা, এত দু’আ তিনি পেয়েছেন যা বলবার নয়। আজ এতদিন পরও কেউ যখনি জানতে পারেন আমি উনার ছেলে প্রথম কথাটি বলেন “উনি তো খুব ভাল মানুষ ছিলেন, খুব সৎ ছিলেন”। এ জায়গাটি আমাদের ভালো লাগার, আনন্দের। যখন ওয়ার্কস মিনিস্টার ছিলেন (প্রতিমন্ত্রী, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব একা তাঁরি ছিল), অনেক প্লট জমি চাইলে নামে বেনামে নিতে পারতেন, আজকাল যেমন হয় এম, পি , হলেই জমি বাড়ি সব হয়ে যায় ভোজভাজির মত, তিনি তা করেননি, কোন অনফেয়ার কোন কিছু তাঁর গোটা জীবনে করেননি। সততা এক কঠিন পরীক্ষা, প্রতিটি পরীক্ষায়, তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন, এ আল্লাহর এক নিয়ামাহ।
তারপর সব পাল্টে যেতে লাগল। কবরে ঘাস গজাবার আগেই মনে হল আমি বুঝি অনেক বড় হয়ে গেছি। শারমিনের সাথে আর বুঝি অত ঝগড়া হয় না। রাতে নিজের খাবারও খেয়ে নেয়া শিখে গেছি, দুধভাত ছাড়াও যে রাতে খাওয়া যায় শিখে গেছি। শুধু একটা জিনিস আগের মত রয়ে গেছে, সকালে উঠে বারান্দায় বসে ভাবা। কত কি ভাবতাম, ভাবতাম আমরা ঢাকার শান্তিবাগে তখন আমাদের বাসা ছিল, সেখানে গেলেই বুঝি বাবাকে পেয়ে যাবো। কিংবা হয়ত কোথাও গেছেন আমি স্বপ্ন দেখছি, স্বপ্ন ভাংলে বুঝি আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। এ দীর্ঘ দিন ভাবতাম কল্পনা করতাম, এখন মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, আমি রাস্তায় হঠাৎ বাবা বুঝি পাশ কাটিয়ে গেলেন সেই হালকা নীল সাফারি স্যুট পরা। ডাকতে ডাকতে কোথায় ভিড়ে হারিয়ে গেলেন, কি এক কুহক, কি এক মায়া এ জীবন! আমি আমার বাবা মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান, তাঁদের পাইনি বেশি কাছে, মা’কে তো পাইই নি, বুঝবার আগেই গেলেন চলে, বাবাও গেলেন খুব সহসাই, এখন দীর্ঘ অপেক্ষা আবার দেখা হবে, এবার আর হারাতে হবে না, যাদের হারিয়েছি তাঁদের আবার ফিরে পাবো নিশ্চিত। আল্লাহ্ তাঁদের সকল কে বেহেস্ত নাসিব করুন!
০৩ রা মে, ২০১৭ রাত ১২:১১
রবাহূত বলেছেন: আমিন! অনেক ধন্যবাদ! খুব ভালো থাকেন!
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা মে, ২০১৭ রাত ১১:৩৫
ঘাসফুল বলেছেন: বরাবরের মতো ঝরঝরে লেখা।
লেখা পড়ে সেই সময়ের শৈশবকে এখনো খুঁজে ফিরি...
আপনার বাবার প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা রইল। পরম করুণাময় ওনাকে কবুল করুন।