নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রূপটান আর কি করে গাঁও গেরস্তের বৌ ঝিরা। তবুও নাসু সবার চোখ টানে, গাঁ গতরে বানটা একটু শক্ত পক্ত আর রংটা একটু টান টান হলেই হল, একবাক্যে সুন্দরী। নাসু অবশ্য খুব তেমন সুন্দরী না, কিন্তু মাজা গায়ের রঙ্গে আর আর ডাগর চোখ দুটোয় কি যেন একটা বুনো আকর্ষণ, লাউডগার মত একটা সতেজ হিলহিলে ভাব। মানুষ যে কারনে বুনো ঘোড়া কিংবা শম্বর কে পছন্দ করে, তাদের টান টান পেশিতে অদ্ভুত এক ছন্দ খুঁজে পায়, সেই একেই কারনে নাসু সবারই চোখ টানে। কারো কারো হয়ত বেশীই। তাই নাসুর সাথে সূর্যালীর বিয়েটা অনেকেই মেলাতে পারেনা!মানতেও পারে না। কামনার দগদগে ঘা নিয়ে, ঈর্ষায় জ্বলতে থাকে দিনমান। মোমেদ আলী মেম্বার, করিম চেয়ারম্যান কিংবা উঠতি যুবক টেরিকাটা ইসরাইলের চোখের সামনে দিয়ে অমন “ডাঙ্গর একটা মাইয়ার” ঐ হাভাতে সূর্যালীর ঘরে উঠা ওদের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়।
মোমেদ আলী কম তো চেষ্টা করেনি, শুধু জোরজবরদস্তি উঠিয়ে আনাটা ছিল বাকী, নাসুর বাপের শুধু এক গোঁ, মেম্বার এর সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিবে না। অবশ্য বিয়েটা চট জলদি যদি না হত মেম্বার হানা দিত। সিঁদও কাটত না, বেড়াও ভাংত না, কাগজে যেমন লিখে, ঠিক তেমন, প্রকাশ্য দিবালকে নিত উঠিয়ে। না আছে এদের আইন আদালতের ভয় না আছে লোক লজ্জা।
দু’মাস হয়ে গেল ঘর করছে নাসু সূর্যালীর, এখনো কেন যেন অতটা বুঝে উঠতে পারেনি মানুষটারে। সূর্যালী লোক মন্দ না, কিন্তু কাম ধান্দায় নাই। যেই “ব্যাডাইনতের কাম ধান্দা নাই হ্যারা আবার কেমুন ব্যাডাইন?” এই যে সাত দিন হইল “রক্সি সিনামা” থেকে তাড়ায়া দিল, ঘরে ঠায় বসা, কোন চেষ্টা চরিত্ নাই। “কয় তো কাম ছাড়সে, আসলে যে কি হ্যা জানে আর আল্লাহই জানে”, সিনামা হলে কাম কি ছিল? গেইটে দাঁড়াও টিকিট ছিড়, লোক ঢুকাও, তাও পারলো না! কপাল আমার! ভাবে নাসু। সংসারে নাই নাই কইরাও তো কম মুখ না, দুজন তো আছেই আবার “কইত্তে” এক “কানা ছ্যাড়া জুডাইসে”! “বাজারও নাহি থাকতু, আবুদুব খ্যাপাইতু ,হাইদু কানা, লাল মরিসের ভত্তা খানা,চৌক্ষে কিসু দেহেনা, কানাউলায় সারে না! এই সব শিলুক কইয়া কইয়া, এইডা দেইক্ষ্যা তার পেট পুড়সে, সিধা ঘরো আইন্যা তুলছে”। সে ও আছে সংসারে, খায় দায় অন্ন ধ্বংস কর,। আর দুইচারটা কুকুর বিড়াল তো সূর্যালীর পায়ে পায়ে ঘুরে, এখানেই শেষ না, “একটা আবার বেজি কিনছে গত মাসে পঁয়তিরিশ টেহা দিয়া, নাম দিসে-সোহাগী। ঢঙ্গ! সবাইরে এক মুইট ভাত দিলেও তো কম লাগে না, হায় এইরেই বুঝি কয় ,কপাল আমার হাডুরে।“ ভাবে নাসু। একটা দীর্ঘশ্বাস পরে নাসুর, তবু বুকের ভিতর একটা ক্যামন সুখের মত ব্যাথা তিরতির করে উঠে। চুলায় চুঙ্গা দিয়ে “ফু” দিতে দিতে ওর মানুষটারে দেখে, কি নিচিন্তে কানারে লয়া বাঘ বন্দী খেলায়! নাসুর গাঁ জ্বালা করে, না রদ্দুরে না, “ঘরে নাই টেহা ফয়সা, এইহান তামশা জুরসে”মনে মনে বলে। এখনো সে নতুন বউ কাপড়ে “নয়া বাস” ক্যামনে রাগ ঝারে, আবার ওদের এই নিরুদ্বেগ খেলাটাও অসহ্য লাগে। “ওই কানা উঠ, খাইস তেল লাগবু দোইররা লয়া আয়”। যদিও আজদিন চলবার মত তেল রয়েছে শিশিতে, তবু খেলা ভাঙ্গার এছাড়া আর পথ পায় না, কানা শিশি নিয়ে চলে যায়। নাসু চোখের কোনা দিয়ে তার মানুষটারে দেখে। “কী নিচিন্দে বইআ রইসে, দুই দিন বাদে ভাতও জুটতু না, কুনু হুঁশই যেমুন নাই”। রোদটা হঠাৎ চিড়বিড় করে উঠে, নাসুর পিঠ-পেট ঘামে ভিজে ভিজে উঠে, ঘাড় বেয়ে নোনা ঘাম নামে, ফোঁটায় ফোঁটায়, ঘাড়ের উপরের গুরি গুরি চুল গুলো লেপ্টে যায়, তেলচিক্কন ত্বকে, হাতের চুঙ্গা রেখে, একঢাল চুলে হাত খোপা করে। এই চিড়বিড়ানি রোদ মেজাজটাও ঝাঁঝাল করে তুলে। “হুনুইন এমুন নিচিন্দে বইআ রইলান, বাইত যে খাওন নাই, হুঁশ আসে কুনু?”
“আছে বউ আছে চিন্তা কইর না, উপায় একটা হইবই।“ বলতে বলতে নাসুর কাছে উঠে আসে, মুখোমুখি বসে, নাসুর হাঁটুতে একটা হাত রাখে মুখে একটা সরল সলাজ হাসি, নাসুর বড় ভালো লাগে, এই হাসি এই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সোহাগের সময় কাতু কাতু লাগে নাসুর, মুখ লুকিয়ে লাজুক হাসি গোপন করে নাসু। “মায়া আইসক্রিমের লগে কথা ফাইনালরে বউ, মালাই বেচাম আর রুজিনা টেহা আইব, আগের কাম একটা কাম হইল কুনু, ঠায় ঠ্যাঙের উপরে দাড়ায়া থাহ, মাস শ্যাষে ট্যাহা, দূর হালা সাধে এই কাম ছাড়সি।“
“ছাড়সুইন না ছাড়াইসে”, একটু ঝাঁঝালো শোনায় নাসুর ঠ্যাস দেয়া কথা। সূর্যালী আহত চোখে তাকায়, নাসুর বুকটা যেন ক্যামন করে উঠে, মনে হয় ওই মুখটা বুকে চেপে ধরে, আফসোস হয়, কেন এসব বলতে গেল “বেহুদা”। মনে মনে ভাবে এই মানুষটাকে আর জীবনেও কোন কষ্ট দিব না। “তেও জ্যান বুকের মিধ্যে কুড়া পক্ষী উড়া দিয়া উডে”। অনিশ্চয়তা আর আপাত সুখ এক অচেনা অনুভূতির সামনে যেন দাঁড় করায় নাসুকে।
“সত্যি বউ, হেরা তাড়াইসে না, মাডিডার উপরে বয়া কইলাম”। নাসুর আরও মন খারাপ হয়ে যায়, সূর্যালীর হাত দুইটা নিজের হাতে নিয়ে রুটির মত উষ্ণ গালে চেপে বলে, “মাফ, মাফ, মাফ, আমি না ঠিশি করলাম, মন কিসু রাহুইন্না যেন, আল্লাহর কসম, জীবনে আর যদি দুক্ষু দেই!” সূর্যালী দুহাত দিয়ে নাসুর তেল কালি মাখা মুখটা চেপে ধরে এমন একটা হাসি দেয়, নাসুর মনটা হু হু করে উঠে, বাউড়ি বাতাস যেন, বুকের ভিতের আবার ডানা ঝাপটায় “কুড়া পক্ষীডা”। “থাউক হইসে আর কিরা কাডন লাগদু না, ওহন রান্ধা বাড়া শ্যাষ কর, আমি দীঘিত বুরটা পাইরা আইতাসি”। “না এট্টু বইন”। নাসু চায় এমনই ওরা বসে থাক, সময় থেমে থাক, দূরের কাঁটাময় শিমুল গাছটা যেমন অনড়, তার ছায়াও থেমে থাক তেমন অনন্ত। মেঘ থেমে থাক, হাওয়া থেমে থাক, থেমে থাক বাঁশ ঝাড়ের মিহি পাতার ঝিরিঝিরি। থেমে থাক এ বিশ্ব চরাচর, শুধু ঘড়ির কাঁটার মত তার ভালোবাসা, তার সলাজ সবুজ ভালোবাসা টিক টিক করে জেগে থাকুক, জেগে থাকুক শুধু। দুধ চিতই এর মত ডুবিয়ে রাখুক তার “আউলা, ঝাউলা মানুষটারে”। পাক্কনের নিবিড় নকশায় সাজিয়ে দিক আপাত উদাস এ যুবকের হিজিবিজি জীবন। “নাহ, বইলে চলতু না, কাম আসে, টাউনো, যাওন লাগব, দিড়ং হইতাসে” বলে বসেই থাকে। আহা থাকুক একটু ভালবাসাসির সময় থেমে থাকুক খানিক!
সময় বুঝি সহসা থমকে তাকায়। নিয়তি মুচকি হাসে, কি আছে ওদের কপালে কে জানে? ওমন ভালবাসাসি কে জানে কখন মিলিয়ে যাবে, চাহিদা আর প্রাপ্তির ঘানিতে, প্রেমটা তেলের মত বেরিয়ে যাবে আর যা পরে রইবে তার পোশাকি নাম দাম্পত্য কিংবা সংসার। গরীব গুঁড়বোদের ঘরে অভাবটা বাঘের মত গুড়ি মেরে বসে থাকে, খাপ পেতে জানালার বাইরে বসে লেজের ঝাপ্টা মারতে থাকে, ধীরে ধীরে দেওয়ালে ফাটল ধরে, ভীত উঠে নড়ে, সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোথায় সুখ, কোথায় প্রেম, কীরা- কসম আর বুক মোচড়ানো সুখের টনটনানি, শুরু হয়ে যায় উঠতে বসতে আকথা, কুকথা, খিস্তি খেউর, শেষ মেশ বৌ কিলানো।
(২)
দিন দুয়েকের মাঝে, সূর্যালী কাজটা জুটিয়ে নেয়। মালাই-কুলফী ফেরী করে, কানারে নিয়া ঘুরে ঘুরে। নাসুর দিন কাটে ঘর-গেরস্তি, দেখতে দেখতে। দিন গুলি যেন একটা ছকে পরে যায়, প্রতিদিন দুপুরের একটু পর পর, বাব্লার ছায়াটা দীঘির সবুজ জলে একটু ঝুঁকতেই দূরে দেখা যায়, ওরা আসছে, মাঠ পাথারে, পায়ের ঘায়ে ধুলো উড়ে, দুজনের মাথায় চৌকো আইসক্রিমের নীল বাক্স, সূর্যালীর হাতে সোহাগীর দড়ি, সোহাগী গুটি গুটি পায়ে তুর তুর করে দৌড়ে দৌড়ে আসে। নাসুর হাত জুড়ায় তখন “হাগ-হুটকি” যাই জোটে সোনা মুখ করে খেয়ে নেয় সূর্যালী, কোন অভিযোগ নেই, রেডিওতে বাজে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। নাসু আর সুরুয ছক কেটে বসে বাঘবন্দি খেলে, নয়ত লুডুর ছক পাতে, কানা টুলে বসে ঘুমে ঢুলে আর জাল বুনে কি জালে গাবের আটা লাগায়। উঠানে গাছ গাছালীর ছায়া দীর্ঘ হয় ক্রমশ, দেউড়ীর বেড়ায় মেলা শাড়ি লুঙ্গি শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়। সূর্যের লালচে আলো তেড়ছা হতে থাকে। নাসু চুলায় জ্বাল ধরায়, একটু চায়ের বিলাসিতা করে কখন কখন, লাল চা করে, গুড়ের লাল চা। লালচে কনে দেখা আলোয় মুগ্ধ নয়নে তার “বউরে” দেখে সুরুয, খোলা বাহু দেখে দীর্ঘ, নাকের নাক চাবি দেখে, গ্রিবার বাঁক দেখে, দীর্ঘ আঙ্গুলের নড়াচড়া দেখে চা করবার সময়, “আহা বুকটা যেন ভরে না”। সুরুয উঠে, “ ঢাকায় যারা চাকরি গো করে তারা কেন পিরিতি করে প্রাণ সখি গো... সখি গো সে আইবো কোন মাসে” গান গাইতে গাইতে বাজারের দিকে এগোয়, গরমে তার বেচা বিক্রি মন্দ না। ঘরে ডাঙ্গর বউ। আহা গানে আরও দম বাড়ে সুখের... প্রাণ সখি গো...।
বেজীটা জুলু জুলু চোখে ঘুরে বেড়ায় বাড়িময়, নাসুর আর ভয় করে না, কানারেও এখন অনেক আপন লাগে। ভাবে আহা এইতো কত সুখ। কত্ত সুখ! নাসু গন্ধ তেলে বাঁধে চুল, চোখে পরে কালি তোলা কাজল, পায়ে মাখে কাজল রেখা আলতা, ছিট কাপড়ের পিরন দিয়ে পরে কুঁচি দেয়া শাড়ী, শহরের মেয়েদের যেমন দেখে। হাতে ঝিরিঝিরি রেশমি চুড়ি। তারপর অপেক্ষা, কখন চিনি কলে রাত আটটার ভোঁ দিবে, আর সে আসবে, হাতে আনাজ পাতি খুব কদাচ পোনা মাছ!জীবন মন্দ নয় তেমন। জানা থাকলে অল্প অনুপানেও হয় সুখের সঞ্জীবনী সুরা।
নাসুর বড় শখ ছিল একটা বড় আয়নার হাত বাকসোর, ড্রয়ারে তার কাঁকই চুরি কি কাজল লিবিস্টিক থাকবে, আর আয়নাটা বেশ বড় সর হবে। সে জানে সুরুয পালার বাঁশে ফুটো করে টাকা জমায় আয়না কিনার জন্য, নাসুর বড় ভাললাগে, বড় ভালো। শখ বলতে তো ঐ মাসে দুই মাসে, এক আধটা “বই দেহা” সেটা হয় না, টাকা পয়সার টানাটানি হয়ত নাই কিন্তু ছবি দেখে টাকা উড়ানরও উপায় নেই, এমন দু’চারটা বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস রয়ে যায় নাসুর গভীর গোপনে, সে প্রশ্রয় দেয় না, বরং সুখের ছোট ছোট চুমকি দিয়ে সাজাতে চায় জীবনের কিংখাব।
চলছিলো বেশ। এর মাঝে হঠাৎ একটা রাহুর মত, অশুভ শ্বাপদের মত, মোমেদ আলীর আগ্রাসন। বলা নেই কওয়া নেই একদিন বাজারে হুট করে সু নাসুরুযরে আড়ালে টানে, একথা সেকথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে বসলো “সুরুয তুই নাসুরে তালাক দে, আমার লগে নিহা দে, দুই চার দশ হাজার টাকা লাগে লইস আমারতে”। সুরুয খামোশ কি বলবে, ওর মন অবশ্য আগেই কু ডাকছিল, ব্যাটা বদ, নিসচুই কোন কুমতলব আছে, নয় আড়ালে আবডালে হঠাৎ কিসের অত কথা। “ দ্যাখ, যেই মাছ যেই জলাৎ বাচে, হেই জলাৎ দে, ইলিশ মাছ কি আর দীঘিৎ বাচে, ক তুই ক! নাসু, নাসিমনরে কি তোর ঘরে মানায়?!” পিচ করে একদলা থুথু ফেলে সুরুযের পায়ের কাছে, সুরুয চমকে তাকায়। মোমেদ আলী মেম্বরের তেল কলপ দেয়া পুরুষ চেহারা, আধখোলা জামার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় রোমশ বুক, হাতে ছয় ব্যাটারির টর্চ। নিজের সাথে মেলায় কি আছে আমার! নাসুরে তো আমি কিছুই দিতে পারি না। অক্ষম আক্রোশে, অভিমানে চোখ ফেঁটে জল আসে, কিছুই বলে না মোমেদরে।অপমানে নিজেই জ্বলে, দুর্বল পুরুষ বলে নিজেকে ধিক্কার দেয়, কিছুই করতে পারে না নিরবে সরে আসে। ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে যেতে শুনে, মেম্বর বলছে “ভাইব্বা দ্যাখ, নগদা নগদি কিসু ভালাই পাইবে কইলাম”।
আহ জাহান্নামে যা! তোর কুষ্ঠ হউক, ভেদ বমি কইরা তুই মর, আভাগির পো, অক্ষম অভিশাপে কার কি বা আসে যায়, হঠাৎ তার পৃথিবীটা দুলে উঠে, ভাঙ্গনের শব্দ তার কানে বড় বেশী স্পষ্ট বাজে।“কি হইলো সূর্যালী ভাই?” কানার অবুঝ প্রশ্ন, সে বুঝে সূর্যালীর কিছু একটা হয়েছে, “চুপ থাক কানার ঘরের কানা”, কানা অবাক চোখে তাকায়, সূর্যালী একা বাড়ীর দিকে হাঁটা দেয়।
“কি হইসে আপনের তহন থেইক্কা দেহি মুহ রাও নাই, জব বন্দ ক্যারে?” নাসু দেখে সূর্যালীর গম্ভীর মুখ, ওর কেমন একটা ভয় হয়, “কুক পক্ষীডা, বুহের ভিত্রে ডাইক্কা উডে”। “নাসু, নাসুরে ল আমরা দূরে কুন জাইগা, দূর কুনু জাগাৎ, কেউ নাই, খালি আমি তুই আর সোহাগী।“ নাসু পরিবেশটা একটু হালকা করতে বলে, “ কানা, হাইদু কানা কই থাকবু?””হ কানারেও লোয়া লোয়াম।“
নাসু হাসে, সূরুয দেখে কুপির আলোতে নাসুর ছাই দিয়ে মাজা সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠে, চোখে কালি তোলা কাজল কেমন লেপ্টে লেপ্টে আছে, ওর মনটা হাহাকার করে উঠে। হায় আল্লাহ্, নাসুরে ছাড়া ক্যামনে বাচাম! সহসা সূর্যালী উঠে আসে নাসুকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে। এমন বাঁধনে যদি বেঁধে রাখা যেত! হায় এ জীবনে কোন মোমেদই নাসুরে কেড়ে নিতে পারত না, নাসু অবাক ভালবাসায় আপ্লূত হয়, চোখের কাজল দু গাল বেয়ে নামে, ভাবা আহা আমার পাগ্লাডা অত ভালা ক্যারে? সোহাগে আদরে ভালোবাসার প্রেষণায় ভেসে যায় সব। প্রতিটি স্পন্দনে, মন্থনে যেন সূর্যালী ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে থাকে মোমেদ আলীকে। দূরে কোথায় একটি কুক পাখি ডাকে, সূর্যালী আরও নিবিড় করে চেপে ধরে নাসুকে, মিশিয়ে দিতে চায় বুকের “পাঁজরার হাড্ডির লগে”, লুকিয়ে ফেলতে চায় “পরাণের কোন গহীনে”, ভালোবাসার অবগুণ্ঠনে ঢেকে আড়াল করে দিতে চায়, সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে, যেন এই অমঙ্গল এতটুকু তারে স্পর্শ না করে।
(৩)
তারপর ঘটনা যেন হঠাৎই খুব দ্রুত ঘটে।
কারুরি বুঝিবা হাত ছিল না কোন। সুরুযের ভালোবাসা না পারে আগলে রাখতে নাসুরে, না পারে মোমেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে তীব্র ক্রোধে ঘৃণায় পুড়িয়ে দিতে মোমেদের, চুল দাড়ি নখ। কিছু বুঝে উঠতে পারে না, “জিন্দা একটা লাশ যেন কুনু আমি” অসহায় ভাবনা তাকে মিশিয়ে দিতে থাকে ধুলোর সাথে, পথের কাঁকড়ের সাথে।
সূর্যালী বাড়ীতে ছিল না, সন্ধ্যা সবে হল, নাসু চুলায় জ্বাল ধরাচ্ছিল, এমন সময় মোমেদ আসে, সাথে জব্বার, খুইন্না লাল চোখ, এক গ্রাম লোকের সামনে ওরা তুলে নিয়ে যায় নাসুরে। মুখে হাত চাপা দিয়ে তার আর্ত চিৎকার থামানর চেষ্টাটুকুও করে না, কারই যেন পরোয়া করে না। নাসুর কান্না কীরা কসম, আল্লাহ্ নবী, পীর ফকির কারো দোহাই তাদের থামাতে পারে না।
সালিস বসে, চেয়ারম্যান বলে, “সূর্যালী তালাক দে, নাসু না পাক, পর পুরুষের ঘরে রইসে, ওরে লয়া ক্যামনে ঘর করবি?” বুক ফেটে যায়, চোখ জ্বালা করে, কে জানে লজ্জা না শোকে না সুরুযের দুঃখে, বুকের “কুড়া পক্ষীডা, উথাল পাথাল করে” নাসিমন পাথরের মত বসে থাকে। জানে রঙ্গের বর্ষা আর রাঙ্গাবে না তাকে, হয়ত অনেক বৈভব হবে, হবে হয়ত “বই দেহা” ইচ্ছামত। হয়ত বাঁধবে চুল বড় কোন বাঁধানো আরশিতে, যেখানে তার ছায়ায় শুধু দেখা যাবে সে তো নয় সে, শুধু খানিক ধোঁয়াশা ছায়া। কিন্তু কে এমন বলবে “নাসিমন, সোনা আমার, তোরে ক্যারে যে অত ভালা পাই” তারপর বুক ভরে বাস নিবে তার। সহসা নাসিমনের সোহাগীর কথা মনে পড়ে, “আহারে দুই দিন ধইরা কি খাইতাসে না খাইতাসে, কই নানে বানে ঘুরতাসে ব্যান”। আহ্ চোখে পানি আসে ক্যান, বাইষশা কালের ঢলের মতন!
সুরুয গোঁজ হয়ে বসে থাকে, কিছু বলে না। নাসিমন অভিমানে ভাবে, কিছু বলে না কেন সুরুয? সে কি একটা মানুষ না “ইন্দুর”, একটা কথাও কি বলবার নেই তার। নাসুর রাগ হয় না মায়া হয়, ঐ রুখু সুখু চুল, তিন চার দিনের না কাটা খড়খড়ে দাড়ি, কেমন করে অসহায় বসে আছে! নাসুর বুকটা মুচড়ে উঠে সে জানে তো কি নরম একটা মানুষ এই সুরুয! আহ্ চোখে পানি আসে ক্যান, বাইষশা কালের ঢলের মতন! অত ক্যারে কষ্ট, অত কিয়ের কষ্ট!!
এদিকে সুরুজের চোখে ভাসে মোমেদের মুখ, তার শেষ ক’টি কথা, “সালিসে কিসু করসস কি মরসস, নাসুর লাশ পড়ব কইল নাইল্যা ক্ষেত, হ্যাল কুত্তারে দিয়া খাওয়াম, হারমজাদা কথাডা কইল ভুলিস না।“
“হু”! চিৎকার দিয়ে উঠে সুরুয, “তালাক দিলাম, আমি তালাক দিলাম, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক”! হঠাৎ সুরুযের কি যেন হয়, এই অত লোক, অত হট্ট গোল, কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়, সব কিছু বড় অর্থহীন মনে হয়। কি যেন কি হয় সব ভ্লে, সব ছেড়ে ছুঁড়ে, এক ছুট লাগায়, সবাই অবাক চোখে দেখে সুরুয মাঠ পাথারে দৌড়ায় আর দৌড়ায়, কানাও ছুটে পিছে। নাসিমন দেখে, নাসু দেখে, দূরে যেতে থাকে, মিলিয়ে যেতে থাকে, ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে কানাও ছুটে কে জানে কেন? কেউ কিছু বলবার নেই। শুধু নাসিমনের বুক চিড়ে একটা বাউড়ি বাতাসের মত দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। হায় মোমেদ তোরা শুধু অভিশাপই কুড়ালি, না পেলি মন, না পেলি ভালোবাসা। ভালোবাসা রয়ে যায়, রয়েই যায়, বুকের গোপন কোন শিকেয় তোলা, অমন বুক জোড়া ছায়াময় ভালোবাসা রয়েই যায় সুরুযদের জন্য আমৃত্যু!
১৯৯৯ ইং
[ব্যাডাইন = ব্যাটা ছেলে, হাত বাক্স = আয়না সহ কাঠের একটি আসবাব ড্রয়ারসহ, কাঁকই = চিরুনী, হাগ-হুটকি= শাক-শুঁটকি,
নাইল্যা ক্ষেত= পাট ক্ষেত, হ্যাল কুত্তা = শিয়াল কুকুর, কুড়া পক্ষি= পানকৌড়ী, দেউড়ী= সীমানার বেড়া, বাঁশের পালা = ঘরে যে বাঁশ ব্যবহার করা হয় কলামের মত, আবুদুব= বাচ্চা কাচ্চা, খ্যাপাইতু = খ্যাপাত বা যন্ত্রণা করত, কইত্তে = কোথা থেকে,
জুডাইসে= জুটিয়েছে, শিলুক= শ্লোক, ছড়া বিশেষ, পেট পুড়সে = মন খারাপ হয়েছে ]
১৬ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৪৯
রবাহূত বলেছেন: Kishoregonj
২| ১৬ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৫৮
নূর-ই-হাফসা বলেছেন: কি নিদারুণ কষ্টের মুহূর্তের বর্ননা দিলেন গল্পে। এক কথায় অসাধারন ।
মুগ্ধ হয়ে পড়েছি, মনে বিষাদের ছায়া পড়েছে । ক্ষমতার দাপটে সত্যিকারের ভালোবাসা গুলোর বুঝি এভাবেই পতন হয় ।
সুখ যে কোথায় নিহত তা কারোও জানা নেই ।
১৭ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১:০৩
রবাহূত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, খুব উৎসাহ পেলাম!
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:২৮
জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: আঞ্চলিক ভাষায় গল্প। ভালো লেগেছে।
কোন অঞ্চলের ভাষা?