নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহর এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। এদিকটা আর আগের মত নাই। জনমানুষ বাড়ছে, চেনা অচেনা লোক বাড়ছে। বড় বড় কড়ই গাছ গুলি ঘ্যাচাঘ্যাচ কাটা পড়ছে। আধপাকা ঘর-টিনের চাল, মনোহারি দোকান, রিকশা-সাইকেল সারাইয়ের ঘর, রড-সিমেন্টের দোকান, কাঠ মিস্ত্রির দোকান এসব, সব উঠছে। বাণিজ্য বাতাস চারিধারে। বড় রাস্তা ধরে খানিক গেলে একটা ঢালু মেটে রাস্তা, খুব চওড়া নয় নেমে গেছে ঢালে তার পাশেই খোলা একটু, ঘাস উঠা একটা মাঠ মত আছে, তার পাশে দোতলা, হলদে ফিকে বাড়ি খানা। তার দেওয়াল ঘেষে গাড়ি সারাইয়ের গ্যারাজ।
তেল কালি ঝুল পোশাক পরে উঠতি বয়সের কিছু ছেলে বেশ খাটা খাটনি করে ওখানে। খটাখট, ঘ্যাচ ঘ্যাচ, গুঁই গুঁই শব্দের সাথে ফাটা স্পিকারে দিনমান গান বাজতেই থাকে। সোহরাব উস্তাদ না থাকলে হাল আমলের হিন্দি চটুল গান বিরতিহীন বাজে সেখানে। এটাই তাদের আনন্দ। আর দিনশেষে সব গুছিয়ে কালো কালো পোশাক গুলি পাল্টে যখন হল্লা করতে করতে বাজারে যায়, চা পুরি কি সিঙ্গারা খেতে, চোঙ্গা জিন্স পরে, তাতেও তাদের আনন্দ অঢেল। আরেকটা মজা, একটু বড় যারা, তাদের মাঝেই থাকে। দশটা সাড়ে দশটার দিকে যখন দল বেঁধে পিছের রাস্তা দিয়ে একগাদা মেয়ে স্কুলে যেতে থাকে, সেটা তাদের খুব আনন্দের সময়। কোন জন “জি করলা”, কোন জন “এফ প্রেমিও”, কোন জন “এ ফিফটিন এলিয়ন”! মেয়েদের দলে একটু বয়সে বড় শুকনা একটা মেয়ে যায় তার নাম তারা দিয়েছে “ডবল ই এইট্টি”! এই সব কোড নেমে তারা মেয়েদেরকে চেনে। একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে হাসি ঠাট্টা করে। “মাম্মা, এফ প্রেমিও ফুল্লি লোডেড; পুরাই পয়েন্টের গাড়ি মাম্মা, উইদিন দেখসিলি, স্কুলের খেলার দিন, সেই রকম মাম্মা”।
নিজেদের মনের ইচ্ছে গুলি মাঝে মাঝে এভাবে বের হয়ে আসে। নিজেরা গপ্প করে, আলামিন বলে এফ প্রেমিওর সাথে যদি কোনদিন কথা হয় সবাই কে মোগলাই খাওয়াবে সে। যে সিডিটা কিনে রেখেছে, মেয়েটিকে দেবার জন্য সেটা দিতে পারলে, মোগলাই এর সাথে কোকও থাকবে। আলামিন এদের মাঝে একটু হিরো মত, তার পড়াশোনাটাও একটু বেশী ক্লাস এইট অবধি, দেখতে শুনতেও একটু ভালো। কলার উঁচু করে টি শার্ট পরে, মাঝে মাঝে দেখা যায় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে, মেয়েদের স্কুল যাওয়ার সময়, সোহরাব উস্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু পিচ্চি সাদেক ঠিক দেখে, খুব হুঁসিয়ার ছেলে, উস্তাদের কান ভারী করে, “হ্যায় না উস্তাদ, আবার গেসে, জিন্সের একটা প্যান্ট না লাগায়া, চ্যাগায়া দাঁড়ায়া আসে, কাম ফালায়া, আমি যে কইসি কয়েন না”। গালাগাল করতে করতে সোহরাব, এ উদাস প্রেমিককে ধরে নিয়ে আসে। গাল দেয়; আদর করে বোঝায়; এরা স্কুলে পড়ে বড় ঘরের মেয়ে, খামোখা সে “বেচঈন” হচ্ছে। ছেলেটার প্রতি তার একটা দরদ কেন যেন আছে, কাজে কামে ভালো, ছ্যাঁছড়ামি নাই, দোষ খালি এই এক, “এফ প্রেমিও”। তারও বা দোষ কি! নিজের উঠতি বয়সের কথা মনে করে সে, কি না করত সেই সময়ে! “কই কই না গেসি আমরা? আজকালকার পোলাপাইন আর কি করে?!” মনে মনে নিজের অপকীর্তির সার্টিফিকেট নিজেই দেয়!
কি আর বয়স এদের! ছবিতে যেমন দেখে, নায়করা সব শেষে নায়িকা কে পেয়ে যায়; দারিদ্র, অন্যায়, অবিচার সব বাঁধা টপকে। ঘরে রোগা ভোগা মা, নেশারু সিএনজি চালক বাবা, বিয়ে না হওয়া বোন, যতই পিছু টানুক, মন তো! লাগাম কি পড়ানো যায়?! আর বার দুয়েকের দুরু দুরু চোখাচোখি সবার চোখের আড়ালে, একটু হঠাৎ হাঁটার গতি কমে যাওয়া, খানিক আশা যেন জাগায় আলামিনের মনে, বয়সটাই তো এমন। নিখাদ ভালবাসা চাওয়া পাওয়ার হিসাব কষে না কখন।
দল বেঁধে সারি সারি সবুজ টিয়ে পাখির মত কলকল করে মেয়েরা যখন যায়, আলামিনের কাছে সব যেন ঝাপসা হয়ে আসে। সবুজ ঘোরে দেখে শুধু একজনকেই, যেন রাজহাঁসের মত, যেন নিউ শেইপ এফ প্রেমিও ওর মত, সব থেকে আলাদা, নিঃশব্দ “ইঞ্জিলের” মত ভেসে যায় রাস্তায়। “সাইলেন্সারে” নেই কোন কালো ধোঁয়ার বাঁধা, “সকেট জাম্পারে” নেই কোন শ্রেণী বিভেদের ধাক্কা!
সেদিন মেঘ ছিল খুব, সকাল বেলার আকাশকে যেন মনে হচ্ছে সন্ধ্যের মত, ফাঁকা ফাঁকা পথ ঘাট, ঝড় বাদলের ভয়ে লোকেরা বের হচ্ছে না। এর মাঝেই মেয়েরা যাচ্ছে, দল আজ তত ভারি নয়, অনেকেই “রেইনি ডে”-এর ছুটিটা নিয়ে নিবে বলে বাসা থেকে বের হয়নি। রাজহংসী সবার আগে, ঝাপসা হয়ে যায় আলামিনের চরাচর। এর মাঝে বিশাল শব্দে কোথাও বাজ পড়ে, আর মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি, এক একটা ফোঁটা যেন করমচার মত বড়। মেয়েরা ব্যাগ মাথায় দৌড়ে গ্যরেজের ঝাঁপ এর নিচে এসে দাঁড়ায়। আলামিন যেন কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকে। এত কাছে! এত কাছে!! সে যেন ঘ্রাণ পায়, তেলের, পাউডারের, বয়সন্ধির, জীবনের!
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। পিচ্চি সাদেকের কনুই এর খোঁচা খেয়ে বুঝি হুঁশে ফিরে। দৌড়ে পাশের কাঠ মিস্ত্রির দোকান থেকে কাঁচা কাঠের চেয়ার নিয়ে আসে, হাত দিয়ে পানি মুছে, অস্ফুট স্বরে তাকে বসতে বলে। কি করবে না করবে বুঝতে পারে না সে। মেয়েটিও ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্য মেয়েরা হাসতে থাকে। আলামিন বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে ফের। একবার ভাবে দৌড়ে ভিতরের ড্রয়ার থেকে সিডিটা এনে দেয়, আবার এই নাটকটা করতে ভয় হয়, বুকটা এমন ধর ফর করছে, মনে হয় যেন সবাই শুনতে পাচ্ছে। কি লজ্জা! কি লজ্জা!!
আড় চোখে, আলামিন কে দেখে সে। দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরা বই এর মলাটে লেখা নাম “শায়লা”, পড়ে নেয় আলামিন! এটুকুই যেন অনেক। শায়লা নিঃশব্দে বসে চেয়ারে, বৃষ্টির জোড় আরও বাড়ে। মেয়েরা চিন্তিত হয়ে কথা বার্তা বলতে থাকে স্কুলে ফিরবে নাকি বাসায় ফিরবে এ নিয়ে। শায়লা নিসচুপ বসে থাকে। আলামিন নিসচুপ দাঁড়িয়ে থাকে। পিছনে ঝাপসা আলো, মবিল-পেট্রলের গন্ধ, খোলা এঞ্জিন, ভাঙ্গা গাড়ী, সারি সারি সারাই করবার যন্ত্র, সব যেন আবছায়া হয়ে ঝুলে থাকে, দূর কোথাও থেকে যেন গান ভেসে আসে, “সুন রাহা হ্যা না তু, রো রাহা হু মেঁ, সুন রাহা হ্যা না তু, কিউ রো রাহা হু মেঁ”, খুব প্রিয় গান আলামিনের, এখন মনে হচ্ছে গানটা বুঝি ওর কথাই বলছে, কেন যেন বুকের ভিতর অভিমানের এক অদ্ভুত কান্না জমে জমে মেঘ হয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে করে যেন হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দেয় শায়লাকে, একবার শুধু হাতটা যদি সে ধরতে পারত, মিষ্টি কোমল হাত খানা, ঈষৎ ভেজা, উষ্ণ, শুধু এতটুকুই! খুব ইচ্ছা হয় পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটা ছবি তুলে, ভয় হয় পাছে তাকে খারাপ ছেলে ভাবে। বৃষ্টির ফোঁটা যেন তার অস্ফুট কান্না হয়েই ঝরছে, না পারে বলতে কিছু, না পারে কিছু করতে। ভাবে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে, হু হু করে কাঁদে কেউ তাহলে চোখের পানি আর দেখতে পারবে না। দূরে ছিল সেই ভালো ছিল, কেন আজ বৃষ্টির মাঝে এখানে আসতে গেল!
ফাজিল সাদেক হাতে সিডি নিয়ে এসে দাঁড়ায়, শায়লার চেয়ার এর পিছে। মুখে মিচকা হাসি, চোখের ইশারায় কিছু যেন বলছে। আলামিন গরম চোখে ইশারায় ওকে কেটে পড়তে বলছে, কে শোনে কার কথা। এদিকে বৃষ্টি প্রায় ধরে এসছে, মেয়েরা যাবো যাবো করছে, শায়লা উঠে দাঁড়ায়, সাদেক হাত বাড়িয়ে সিডিটা দিয়ে শায়লার কনুইতে খোঁচা দেয়। সায়লা ফিরে তাকায়, “ভাই এ দিসে” বলে সাদেক সিডিটা বাড়িয়ে দেয়। আলামিন কে অবাক করে, সাদেক কে অবাক করে শায়লা টুক করে সিডিটা নিয়ে বই গুলোর ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়, যেন সাথের মেয়েরা না দেখে। সাদেকের দুষ্টু বুদ্ধি আলামিনকে “মাইন কা চিপায়” ফেলার মাঠে মারা যায়। মেয়েরা সামনের দিকে হাঁটা দেয় একে একে, শায়লা থাকে সব শেষে। যেতে যেতে ঘুরে তাকায়, চোখে কালি তোলা কাজল, কোমল শ্যামলা একটা মুখ, গজ দাঁতের একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দেয় আলামিনের দিকে, তার চোখে যেন অচেনা কোন ভাষা খেলা করে উঠে। আলামিন যেন উড়ে যায় ভেসে যায়!
সন্ধ্যায় সাদেক দুইটা মোগলাই খায় কোক সমেত। আর আলামিনের রাত কাটে নির্ঘুম। আর শায়লার সিডি প্লেয়ারে অনেক রাত পর্যন্ত গান বাজতে থাকে, “সুন রাহা হ্যা না তু, রো রাহা হু মেঁ, সুন রাহা হ্যা না তু, কিউ রো রাহা হু মেঁ”। একই আকাশের নিচে আজ দুই নির্ঘুম তরুণ প্রাণ জেগে, জগতের কুটিল জটিল হিসেব নিকেশের অনেক ঊর্ধ্বে তাদের এই ভাললাগার রাত্রিটুকু। তারা জেগে থাকে নির্ঘুম!
সজল কমিশনারের ছেলে নয়ন বাইক চেপে ভুং ভাং চলে, এরটা মারে তারটা লুটে, খিস্তি খেউর মুখের ভাষা তার। কলেজে যায় হিপ পকেটে খাতা একটা নিয়ে। এস এস সি কিভাবে তিন বারে পার হয়েছে এলাকায় সে এক সরস গপ্প হয়ে আছে, শেষ বার কোন গ্রামের স্কুলে গিয়ে ফাঁড়া পার করেছে,“উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা”। মুখের উপর বলবার সাহস কেউ করে না, নয়নের নামে মামলা থাকলেও পুলিশের খাতায় পলাতক নয়ন। এই সময়ে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা মুখের উপর কথা বলবার, বিচারহীন সমাজে তারাই মাথা হয়ে চেপে আছে।
সেই নয়ন দিন দুয়েক পর সন্ধ্যায় গ্যারেজে হাজির। “ ওই আলামিন কে?” হাঁক শুনে সবাই ফিরে তাকায়। সোহরাব উস্তাদ চেয়ার নিয়ে আসে, “আরে নয়ন বস? বন ভাই। ঠান্ডা আনি?!” বলে বেতি-ব্যস্ত হয়ে যায়। আলামিন এগিয়ে আসে। নয়ন বুঝে নেয় আলামিন কে। চেয়ারে বসতে বসতে আঙ্গুলে ইশারা করে কাছে ডাকে, আলামিন কাছে আসে। “ তুই ই আলামিন! হুন শায়লা তোগো ভাবী, অয়রা স্কুলে যাওয়েনের সম জ্যান আর ভ্যবলার মত দাঁড়ায়া থাকার না দেহি, আর যদি হুনি সিডি ক্যাসেট দিস, কোন লীলা খেলা করস, তাইলে কইল আমি জানি না তোগো কি করুম”। কেউ কথা বলে না, নয়ন যাওয়ার সময় পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে যায় সাদেক কে। সবাই চুপ, সোহরাব উস্তাদও চুপ!
এর পর থেকে মেয়েরা যখন স্কুলে যায় এই পথে নয়ন, নয়ত তার চ্যালা প্যালারা ভুঁ ভাঁ করে বাইকে টহল দিতে থাকে। উস্তাদের নিষেধ, আলামিন আর রাস্তার ধারে যায় না, কিন্তু গ্যারেজের সামনের দিকে এসে কাজ করতে থাকে, দূর থেকে দেখে। শায়লা বুঝি আহত চোখে বলে এত দূরে কেন?! দূর থেকেই আলামিন সে ভাষা পড়ে নেয়। মাঝে মাঝে নয়ন মেয়েদের দলের সাথে সাথে ধীর গতিতে বাইক চালিয়ে যেতে থাকে, মেয়ে গুলো ভয়ে জড়সর হয়ে দলা পাকিয়ে পথ চলে, শায়লা দলের ভিতর দিকে চলে যায়। বখা ছেলে গুলো মজা পায়। তারা ভেবে নেয় তাদের লুটেরা ভাব ভঙ্গী তাদের বাইকের চকমকানি, বুঝি মেয়েদের ভালো লাগে, মেয়েরা বুঝি শক্তিমত্তার কাছে উজার করে দিবে নিজেদের। হাজার বছরের মেইল শোভেনিজম এ শিক্ষাই তাদের দিয়ে এসেছে, এর বাইরে তারা ভাবতেই পারে না। এই যেন পৌরুষ! নারী কে সম্মান করবার সৌন্দর্য তাদের কাছে দুর্বলতা মাত্র! তারা ধরেই নেয় শায়লা কে চাইলে শায়লা, মালা কে চাইলে মালা, পাওয়া খুব সহজ, আর না হলে মোবাইলে ভিডিও কর, হেনস্তা কর, জোড় করে উঠিয়ে নাও। শেষ! খেলা ফাইনাল!! ওরা বুঝেই না জোড় করে কেড়ে নেয়া যায় কিন্তু জয় করা যায় না, না মন, না ভালোবাসা। শরীর শুধু শরীররেই থাকে তা কখন মনের মত আকাশ স্পর্শ করে না, মন কে ছাড়া, ভালোবাসার অতলান্তিক জলের স্পর্শ পায় না কখন শরীর। ওরা এতই গাড়ল এদের ভালোবাসা মাত্র এই সাড়ে তিন হাতে মধ্যেই আটকে থাকে। তাই ভালোবাসাবাসি তাদের শেষ হতে সময় লাগে না বিশেষ!
গ্যারেজে এসে যতই আওয়াজ দিক নয়ন, শায়লার পাত্তা না পেয়ে খানিক অপমানিত বোধ করতে থাকে আজকাল। শায়লা কে বাইকে করে স্কুলে পৌঁছে দেবার প্রস্তাব, ক্যামেরা-মোবাইল কিনে দেবার প্রলোভন কিছুতেই কাজ না হওয়ায় সে আজকাল বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। খামোখাই ছেলে পেলেদের নিয়ে গ্যারেজের সামনে শো-ডাউন করে, যেন সব কিছুর মূলে আলামিন। আলামিন না দেখার ভান করে নীরবে কাজ করতে থাকে। মন তার খালি কু-ডাকে, কোথায় যেন একটা মেঘ জমতে থাকে। তার বড় ভয় হয়। মাথায় রুমাল বেঁধে জুম্মার সময় দু’আ করে তার এফ প্রেমিওর যেন কোন বিপদ না হয়। মসজিদে মমবাতি মানত করে। আর কি বা সে করতে পারে? সোহরাব উস্তাদ সাফ বলে দিয়েছে, কোন ঝামেলা হলে “সিধা চাকরী নট”। সাদেক চোর চোর মুখ করে কাজ করে কেউ ওর সাথে কথা বলে না।
রবিবার ছিল সেদিন, সব যেমন চলে তেমন চলছিলো, মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলের পথে, কলা বেনী কি পনি টেইল চুলে, যেন এক ঝাঁক টিয়া, দূর থেকে আলামিন দেখে। এমন সময় সে টিয়ার ঝাঁকে কাকেদের মত, শকুনদের মত, নয়নরা হামলে পড়ে। নয়নরা আসে তিনটা বাইকে করে, এসে মেয়েদের পথ আগলে বাইক গুলো স্ট্যান্ড এর উপর দাঁড় করায়। মেয়েরা ভয়ে ঘন হয়ে দাঁড়ায়, ডাবল ই এইট্টি একটু বড়, সে এগিয়ে এসে কিছু বলে, নয়ন ঠেলে ওকে সরিয়ে শায়লার সামনে দাঁড়ায়, ডান হাতের মুঠিতে ধরা স্মার্ট ফোন উঁচিয়ে উঁচিয়ে কি যেন বলতে থাকে ধমকের সুরে, আলামিন দূর থেকে দেখে, বাঁকা হয়ে এঞ্জিনের কাজ করছিল, আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, হাতে উনিশ নাম্বার ঢালি নিয়ে ঘুরে দেখতে থাকে কি হচ্ছে। অবাক চোখে দেখে, নয়ন ডান হাত উচিয়ে কিছু বলতে বলতে বাম হাত দিয়ে শায়লার দুই গাল চিপে ধরে।
কি যেন হয় আলামিনের সে সব ভুলে যায়, দৌড়ে আগে বারে, তার এফ প্রেমিও, এফ প্রেমিওর রাজহাঁসের মত হোয়াইট পার্ল বডিতে একটা দাগও লাগতে দিবে না কিছুতেই! সে উনিশ নাম্বার ঢালি উঁচু করে দৃশ্যের দিকে ছুটে যেতে থাকে, কে কোথায়, কত জন আছে কিচ্ছু সে হিসাব করে না, সে শধু দেখে আহত এক জোড়া ভয়ার্ত চোখ। তার ছুটে আশা দেখে নয়ন শায়লা কে ছেড়ে দেয়, আলামিনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, তার চ্যালা প্যালা গুলো পথ আগলে দাঁড়ায় আলামিনের। তাদের মুখে খিস্তি খেউরের তুবড়ি ছোটে। আলামিন কাছে আসতেই তারা জাপটে ধরে তাকে, আলামিন বুঝে যায় এ এক অসম লড়াই, হাতের রিং স্প্যানারটা ছুঁড়ে মারে নয়নের দিকে, নয়ন সরে যাবার সময় পায় না, কপাল টা কেটে যায়, রক্তের একটা ধরা নিচে নেমে আসে। নয়ন যেন পশু হয়ে যায়, “হালা তোর মায়েরে বাপ” বলে ঘুষি চালাতে থাকে আলামিনের নাকে মুখে পেটে বুকে, তার চ্যালারা ধরে রাখে তাকে, তবু আলামিন হাত পা ছুঁড়তে থাকে, থু থু ছিটাতে থাকে নয়নের মুখে। লোকজন জড় হয়ে গেছে, হাতে হাতে মোবাইলে ভিডিও হচ্ছে, কেউ এগিয়ে আসছে না, অসহায় ছেলেটাকে বাঁচাতে। উদ্ভ্রান্তের মত সোহরাব উস্তাদ ছুটে আসে, হাতে পায়ে ধরে, দুয়েকটা চর চাপাটি খেয়ে আলামিন কে গ্যারেজে নিয়ে আসে, মারের চোটে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, ঘাড়টা ল্যাক প্যাক করছে।
মেয়েরা ভয়ে আগেই যে যার বাসায় চলে গেছে। ঘটনা এখন আর মামুলি ভালো লাগালাগি নয়, রক্তারক্তি হয়ে গেছে! শায়লা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে মাকে জড়িয়ে, এক জোড়া চোখ রাজ্যের মায়া নিয়ে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলো, সে চোখ সে ভুলতে পারেনা, সে কাঁদতে থাকে আকুল হয়ে। এভাবেই কেউ কেউ হেরেও জিতে যায় কখন, কেউ বুঝে কেউ বুঝে না।
রাতে আর বাসায় যায় না, গ্যারেজের বেঞ্চিতেই শুয়ে থাকে আলামিন। গভীর রাতে গ্যারেজের ঝাঁপে খচ মচ শব্দে উঠে আসে সে, ঝাঁপটা একটু ফাঁক করে দেখে একটা দশ বারো বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে, হালকা আলোতে বুঝে শায়লার ছোট ভাই সবুজ। আলামিন বেরিয়ে আসে,সবুজ কাগজে মোড়া একটা কিছু এগিয়ে দেয় তার দিকে। “আপা দিসে, কেউ যেন না জানে“ বলে আর দাঁড়ায় না, অন্ধকারে দৌড়ে চলে যায়। ঝাঁপ বন্ধ করে বেঞ্চে এসে বসে আলামিন, টাঙ্কস্টেন বাল্বের ম্লান হলদে আলোয় রুল টানা খাতার কাগজের মোড়কটা খুলে, রাজ্যের কষ্ট নিয়ে দেখে তার দেয়া সিডিটা। প্লাস্টিকের কভারটা স্কচ টেইপ দিয়ে আটকানো, প্রত্যাক্ষান এর আশঙ্কায় তার চোখে জল জমতে থাকে, নখ দিয়ে স্কচ টেইপটা খুলে সে, ভিতরে সিডিটা নেই, একটা কাগজে লেখা, “ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো”! কয়েকটা শুকনো গোলাপের পাপড়ি সিডির খাপটা থেকে আলগা হয়ে ঝরে পড়ে। দূরে কোথাও কেউ গান শুনছে আর আকুল হয়ে কাঁদছে, আলামিন শুনতে পায়, “সুন রাহা হ্যা না তু, রো রাহা হু মেঁ, সুন রাহা হ্যা না তু, কিউ রো রাহা হু মেঁ”। আলামিনের কান্না গুলো আর বুঝি কেউ না শুনে থাকছে না, এ কথা ভেবে ফাটা ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে ওর।
পরিভাষাঃ জি করলা, এফ প্রেমিও, এ ফিফটিন, ডবল ই এইট্টিঃ টোয়টা গাড়ীর বিভিন্ন মডেল। ইঞ্জিলঃ এঞ্জিন, সাইল্যান্সারঃ গাড়ীর এক্সস্ট, সকেট জাম্পারঃ শক এবজর্ববার, উনিশ নাম্বার ঢালিঃ উনিশ নাম্বার রিং স্প্যানার।
২৭ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:৩১
রবাহূত বলেছেন: Why? Can you pls explain, that will help me to over come your "birokti".
২| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:০৭
সাাজ্জাাদ বলেছেন: আপনার লিখার হাত খুবই ভালো।
প্রতিদিন কতো অপরিনত প্রেম এভাবে ঝরে যায়।
কিন্তু প্রেম কভু তার মিথ্যে ছিল না .মিথ্যে ছিল না।
২৭ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:৩২
রবাহূত বলেছেন: Thank you Bhai.
৩| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৪:১৬
জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: খুব সুন্দর উপস্থাপন। ভালো লেগেছে।
(রাজীব নুর ভাই সম্ভবত না পড়েই মন্তব্য করেছেন। পড়লে এভাবে বলবার কথা নয়।)
৪| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৪:২০
রাজীব নুর বলেছেন: আমি পড়েই মন্তব্য করি।
আচ্ছা, সন্ধ্যার পর আরেকবার পড়ে মন্তব্য করবো।
৫| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৩
জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: "রাজীব নুর বলেছেন: আমি পড়েই মন্তব্য করি।
আচ্ছা, সন্ধ্যার পর আরেকবার পড়ে মন্তব্য করবো। " - এজন্যই আপনাকে ভালো লাগে এবং শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হই। ব্লগে এমন অনেক ব্লগার আছেন, যাদের এভাবে বললে ক্ষেপে যেতেন। এবং পনেরো গুষ্ঠি উদ্ধার করতেন
শুভকামনা। ভালো থাকবেন।
২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৭
রবাহূত বলেছেন: এটা কটন ক্যান্ডি না যে সবাই খুশী হবে, কারো ভালো নাও লাগতে পারে, আর পাব্লিক্লি লেখলে অন্যদের সমালোচনা শুনতেই হবে, তাহলেই না এগুনো যাবে, কিন্তু এক্টা বাক্যে কিছু একটা বলে দিলে কিছু বোঝা যায় না! তাই আমিও জানতে চাচ্ছিলাম, লেখার কোন জিনিষটা বিরক্তিকর! জুনায়েদ আপনাকে ধন্যবাদ, ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম!
৬| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৫:০১
জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: কটন ক্যান্ডিও আসলে সবার ভালো লাগে না। ভাবনা;, ভালোলাগা, মন্দলাগার ফিলিং আলাদা আলাদা হতেই পারে।
রাজীব নুর ভাই'র মন্তব্য পড়ে মনে হয়েছিলো তিনি পুরুটা পড়েননি, তাই তিনাকে ম্যানসন করেছিলাম।
"বিরক্তিকর"। এবং "খুব বেশি বিরক্তিকর" - বাক্য দুটোর অর্থ নিশ্চয়ই এক নয়।
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
৭| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৩
রাজীব নুর বলেছেন: কাণ্ডজ্ঞান ও মাত্রাজ্ঞান---
এই দুই-ই আসল জ্ঞান।
আদতে কাণ্ডজ্ঞানটাই মাত্রাজ্ঞান।
০১ লা আগস্ট, ২০১৯ সকাল ৯:৫১
রবাহূত বলেছেন: এখন পর্যন্ত কেন বিরক্তিকর তার কারণ খুঁজে পেলাম না?
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৯:৫৯
রাজীব নুর বলেছেন: খুব বেশি বিরক্তকর।