নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবিউল হাসান (২২০১৯৮)

রবিউল হাসান (২২০১৯৮) › বিস্তারিত পোস্টঃ

কৃষ্ণ প্রতিপদের রাত

৩১ শে মে, ২০১৮ দুপুর ২:১১

১,
আগে মুবিন ভাত চাইলে রেণুর মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করত। যতো দ্রুত সম্ভব সে লোকটার সব আবদার মেটাবার চেষ্টা করতো। লোকটা সারাদিন খেটেখুটে খিদে নিয়ে বাড়ি ফিরবে এই ভেবে রেণু আগে থেকেই বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে জগ ভর্তি পানি রাখত। জগের পাশে রাখা পিতলের গ্লাস স্বর্ণের মতো চিকচিক করতো। লবণও বেশ আয়োজন করে রাখতো একটা ছোট বাটিতে। মুবিনের লবণ না হলেই নয়। প্রতি লোকমা ভাত মুখে নেওয়ার আগে সে বাটি থেকে আঙুলের ডগায় লবণ লাগিয়ে ভাতের সাথে মেখে নিবে। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে এমন কিন্তু না। বরং লবণ বেশি হওয়ায় তরকারি তিতকুটে হয়ে গেছে, কেউই মুখে নিতে পারছে না তখনো সে নির্বিকার ভঙ্গিতে আঙুলের ডগায় লবণ লাগিয়ে ভাত মেখে নিবে। মুবিন তাঁর মায়ের মুখ থেকে শুনেছে তাঁর দাদা আতর আলীরও এমন লবণ খাওয়ার অভ্যাস ছিল। তাঁর দাদা বলতেন, খাওনের সময় পরথম লোকমায় নুন খাওয়া বড়ই নেকের কাম। এর থেইকা হাজার রকমের ব্যামার দূরে থাকে।
-ভাত বাড়া কি হইলো?
মুবিনের কথায় রেণুর ধ্যান ভাঙলো। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, একটু সবুর করো, দিতাছি।
- আইচ্ছা।
অন্যদিনের মতো রেণুর আজ ভাত বাড়ায় উৎসাহ নেই। বারবার এটা-ওটা হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছে।
শেষপর্যন্ত রেণু ভাত বেড়ে মুবিনকে খেতে আসার জন্য ডাক দিল। মুবিন খেতে বসলে ঘটলো বিপত্তি। সকালে ধান কাটার সময় বেখেয়ালে হাতের মধ্যমাঙ্গুলি অনেকটা কেটে ফেলেছে। এখন কাটা স্থানে তরকারি লাগতেই একধরণের জ্বালা-পোড়ায় মৃদু ভাবে আর্তনাদ করে উঠলো সে। তরকারির ঝোল না যেন আঙুল ফুঁড়ে সুচ ঢুকছে।
মুবিনের আর্তনাদ শুনে রেণু বলল, কী হইল! দেখি; দেখি।
মুবিন বলল, ও কিছু না। ধান কাটার সময় কাচির আগা লাইগা সামান্য একটু কাইটা গেছে।
-এমন বেখেয়ালি হইলে কী আর চলে? দাও আমিই খাওয়াইয়া দিতাছি।
কথাটা বলে রেণু মুবিনের সামনে থেকে প্লেটটা নিয়ে ভাত মেখে মুবিনের মুখে তুলে দিতে লাগলো। মুবিন ভাত মুখে না নিয়ে মুচকি হেসে রেণুকে লবণের বাটির দিকে ইশারা করল। রেণু একটু রেগে গিয়ে বলল, হ, তোমার তো আবার না হলেই নয়। কবে দেখবা শইলের সব রক্ত পানি হইয়া গেছে।
মুবিন কিছু বলছে না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বোকা হাসি হাসছে। রেণু মুবিনকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে এ নিয়ে মুবিনের একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। এতো বড় একটা দামড়া ছেলেকে মুখে তুলে খাওয়াতে হচ্ছে বলে মনে হয় তাঁর এই আড়ষ্টতা। মুবিন ভাত খাচ্ছে আর এটা সেটা নিয়ে টুকটাক কথা বলছে। কথার মধ্যে হঠাৎ রেণু বলল, তোমার না গেলে হয় না?
মুবিন ভাত চাবাতে চাবাতে বলল, কী যে কউ! এখন না গেলে হইবো? দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। শালার বেটাদের একটা উচিত শিক্ষা দেওন লাগবো। গতকাল মাষ্টার সাব কইলেন, ঢাকায় নাকি নয়টা ছেলেরে গুলি কইরা মারছে। এরপরও কি বইসা থাকন যায়?
-হুঁ।
- ভাল কথা মনে করছ। কমান্ডার সাব খবর পাঠাইছেন। রাইতের মধ্যে চইলা যাইতে হইব। আর শোনো, যাওনের সময় বাজানরে কইয়া যাইমু তোমারে আইয়া নিয়া যাইতে।
রেণু এ কথায় একটু মন খারাপ করলো। ঐ বাড়িতে রেণু যেতে নারাজ। সৎ মায়ের জ্বালা আর কতক্ষণ মুখ বুজে সহ্য করা যায়?
মুবিন লক্ষ করলো রেণুর মুখ কেমন যেন অন্ধকার হয়েগেছে। ভয়ে নাকি দুশ্চিন্তায় সেটা মুবিন বুঝতে পারছে না। তবে এমন ভিন্ন রূপে রেণুকে দেখতে ভালই লাগে। রেণুকে মুবিন যেদিন প্রথম দেখে সেদিনও ঠিক এমনভাবে একটা গুমট ভাব ছিল তাঁর চেহারায়। তাদের বিয়ের প্রায় সাত মাস হয়েছে। গেল ভাদ্র মাসের ২১ তারিখ বিয়ে হয়েছে তাদের। মুবিন তো ভেবেই নিয়েছিল রেণুর সাথে তাঁর বিয়ে হবে না। রেণুর চাচা আসমত মিয়া ভাতিজির দেনমোহর ত্রিশ হাজার টাকা চেয়ে বসলেন। তিনি তার কথায় অটুট। এদিকে মুবিনের বড় মামাও এ নিয়ে বেশ তর্ক ঝামেলা করেছেন। শেষপর্যন্ত পঁচিশ হাজার টাকায় ধার্য করা হলো।
২.
মধ্যরাতে মুবিন সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত। যাওয়ার আগে সে রেণুকে বলল, ভয় পাইয়ো না। দেখবা একদিন দেশ ঠিকই স্বাধীন হইবো। শালার বেটারা চিনে না বাঙ্গালী কি জিনিস।
রেণু কোন কথা বলছে না। অসহায় ভঙ্গিতে মুবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুবিন আবার বলল, এই সময় বাপ-মায়ের দোয়া খুব কাজে দেয়। আমার তো আর বাপ-মা নাই তাই তুমিই দোয়া কইরো।
রেণুর চোখ ছলছল করছে। সে বলল, শোন, বাজানরে খবর দিতে হইব না। আমি একলাই থাকতে পারুম।
মুবিন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। সে কোন কথা না বলে একটু এগিয়ে এসে রেণুর কপালে চুমু খেলো। লজ্জায় রেণু তার মাথা নুইয়ে ফেললো। মুবিন আর কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় পা রাখতেই রেণু বলল, একটু খাড়াও।
কথাটা বলে সে তড়িঘড়ি করে মাটির একটা পাতিল থেকে বেশ কিছু লবন একটা পলিতিনে ভরে দিল। রেণুর এমন কাণ্ড দেখে মুবিন না হেসে পারল না। রেণুর দেওয়া লবন মুবিন তার পোটলার মধ্যে রেখে হাটা শুরু করলো। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খুব সম্ভবত আকাশে আজ কৃষ্ণ প্রতিপদের চাঁদ। এজন্যই হয়তো এতো অন্ধকার। আজ সবে কৃষ্ণপক্ষ শুরু সেই সাথে রেণুর অপেক্ষার প্রহর গুণাও।
৩.
আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়। পুরো গ্রামে অদ্ভুত ধরণের নীরবতা বিরাজ করছে। শোনা যাচ্ছে গ্রামের সব মানুষ শেওড়া তলার বনে অবস্থান নিয়েছে। আবার কিছু কিছু নদীর ঐপারের হাওড় ঘেঁষা এলাকাগুলোতেও গিয়ে উঠেছে। উঠবেই বা না কেন? এখন যা অবস্থা শুরু হয়েছে এতে যে কেউ গ্রাম ছাড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। গত বৃহস্পতিবার কী পাষণ্ড ভাবেই না রঞ্জিত বাবুর পুরো পরিবারকে গুলি করে মারলো মিলিটারিরা। এর পরদিন দুপুরের দিকে গ্রামের প্রায় এগার জন বৃদ্ধকে নামিয়ে দিয়েছে নদীতে। এপার থেকে ওপারে কী অত্যাচার করেই না সাঁতার কাটিয়েছিল তাদের দিয়ে। এর মধ্যে দুই জন তো পানিতেই মারা গেল। বাকি নয়জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে কী নির্মম ভাবে....
কথাগুলো ভাবতেও রেণুর গাঁ শিউরে উঠে। এদিকে মুবিনেরও কোন খবর নেই। এর মধ্যে দুইবার রেণুর বাবা তাকে নিতে এসেছিলেন। কিন্তু সে সাফ মানা করে দিয়েছে। দ্বিতীয়বার রেণুর বাবা একটু বেশি জোর খাটিয়েছেন। একপ্রকার রেগে গিয়ে সেদিন বলেছেন, মা-বাপের সব কথা কী আর ধরতে আছে?
-মা-বাপের কথা হইলে ধরতাম না। উনি কী আর আমার মা? আমার মা হইলে আমারে এমন জ্বালাইতো না।
রেণুর বাবা একপ্রকার অপমান নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন। এরপর আর আসেননি। এদিকে চালের ঘটের চালও ফুরিয় আসছে। খরচাপাতিও তেমন নেই। রেণু এ নিয়ে বেশ চিন্তিত। রেণু হঠাৎ শুনতে পেল বেশ কয়েকজন মানুষের বুটের ধুম-ধাম আওয়াজ। আবছা অন্ধকারে সে বারান্দা থেকে দেখলে তার বাড়ির দিকেই কয়েকজন মানুষ হেটে আসছে। তাদের কাউকেই চেনা যাচ্ছে না। অজানা শঙ্কায় রেণুর বুক হঠাৎ ধুক করে কেঁপে উঠলো। লোকগুলো ক্রমেই তার বাড়ির দিকে আসছে। সে পাশে রাখা লণ্ঠন হাতে উঠোনে নামলো। প্রায় দশ থেকে বারোজন মিলিটারি তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সাথে জামাল মাতুব্বরও। তাদের দেখে রেণুর ভয়ে জমে যাওয়ার অবস্থা । জামাল মাতুব্বর রেণুকে জিজ্ঞেস করলো, মুবিন কই?
রেণু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে। রেণু কিছু বলছে না দেখে জামাল মাতুব্বর আবার বলল, কথা কানে যায় না?
রেণু আমতাআমতা করে বলল, উনি জবেদপুর। কামে গেছেন।
-খানকির ব্যাটি মিছা কথা কওনের জায়গা পাও না? মনে করলা আমরা খবর রাখি না।
রেণু আরো বেশি ভয় পেতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে সে এখনি দাঁড়ানো থেকে পড়ে যাবে। সে একমনে আল্লাকে স্মরণ করতে লাগলো। জামাল মাতুব্বর মিলেটারিদের উদ্দেশ্য করে বলল, সাব উসকা পতি মুক্তি হ্যায়।
সঙ্গে সঙ্গে দু'জন মিলিটারি রেণুর দিকে বন্দুক তাক করে পরপর গুলি করলো। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই রেণু মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার সবকিছু কেমন যেন অন্ধকার লাগছে। গভীর অন্ধকার।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৫:১২

কাওসার চৌধুরী বলেছেন: ব্লগে স্বাগতম। শুভ কামনা আপনার জন্য।

৩১ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩০

রবিউল হাসান (২২০১৯৮) বলেছেন: ভালোবাসা জানবেন। ♥

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.