নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দুঃখ ভরা পথচলা মোর, হাটছি দিবারাএ

রাফসান বড়ুয়া

আমি মানুষ তাই সকলেই ঠকায়

রাফসান বড়ুয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

মান্না দে 'কে নিয়ে কিছু কথা

০২ রা জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:১৩

প্রবোধ চন্দ্র দে ডাক নাম মান্না দে (জন্ম মে ১, ১৯১৯ ) ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ অজস্র ভাষায় গান গেয়ে চলেছেন ষাট বছরের বেশি সময় ধরে। বৈচিত্র্যের বিচারে তাঁকেই হিন্দি গানের ভুবনে সবর্কালের সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ সঙ্গীতবোদ্ধারা।



‘মান্না দে’ গায়ক হিসেবে আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সফল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও, হিন্দি এবং বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে অশেষ সুনাম কুড়িয়েছেন। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন। সঙ্গীত ভুবনে তার এ অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় অভিষিক্ত করে।



জীবনী:

বাবা - পূর্ণ চন্দ্র এবং মা - মহামায়া দে’র সন্তান মান্না দে ১ মে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের সংস্পর্শ ছাড়াও, পিতৃসম্বন্ধীয় সর্বকনিষ্ঠ কাকা সঙ্গীতাচার্য (সঙ্গীতে বিশেষভাবে দক্ষ শিক্ষক) কে.সি. দে (পূর্ণনাম: কৃষ্ণ চন্দ্র দে) তাকে খুব বেশী অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছেন। দে তার শৈশব পাঠ গ্রহণ করেছেন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি স্কটিশ গির্জা কলেজিয়েট স্কুল এবং স্কটিশ গির্জা কলেজে[১] স্নাতক শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি তার সহপাঠীদেরকে গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। তিনি তার কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং উস্তাদ দাবির খানের কাছ থেকে গানের শিক্ষা লাভ করেন। ঐ সময়ে মান্না দে আন্তঃকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা শ্রেণীবিভাগে প্রথম হয়েছিলেন।

প্রথম জীবন:

মান্না দে ১৯৪২ সালে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সাথে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) দেখতে আসেন। সেখানে শুরুতে তিনি কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র অধীনে সহকারী হিসেবে এবং তারপর শচীন দেব বর্মণ (এস.ডি. বর্মণ) এর অধীনে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি অন্যান্য স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন এবং তারপর স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ করতে শুরু করেন। ঐ সময় তিনি বিভিন্ন হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি উস্তাদ আমান আলি খান এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তামিল নেন।

প্রাথমিক পেশাগত জীবন:

‘তামান্না’ (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে‘র অভিষেক ঘটে। সুরাইয়া’র সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে গান এবং সুরকার ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। ঐ সময়ে গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 'মশাল' (১৯৫০) ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। এর গানের কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ গান গান। এরফলেই তিনি প্রতিষ্ঠিত ও পাকাপোক্ত করেন এবং জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান।



মান্না দে ভীমসেন জোসি’র সাথে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গান। এছাড়াও, তিনি কিশোর কুমারের সাথে আলাদা গোত্রের দ্বৈত গান হিসেবে ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহী তোরেঙ্গে (শোলে)’ এবং ‘এক চতুর নার (পদোসান)’ গান। এছাড়াও, মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কুমার)সহ আরো বেশকিছু গীতিকারের সাথে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মুঙ্গেশকারের সাথে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি (শঙ্খবেলা)’ গান করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ প্রায় ৩৫০০ গান গেয়েছেন মান্না দে।

পারিবারিক প্রেক্ষাপট:

কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা রয়েছে: শুরোমা (জন্মঃ ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে) এবং সুমিতা (জন্মঃ ২০ জুন ১৯৫৮ সালে) জন্মগ্রহণ করে। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের কালিয়ানগর শহরে বাস করছেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতায় বাস করেন। এখনও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে থাকেন।

আত্মজীবনী ও রবীন্দ্র ভারতী’র পদক্ষেপ:

২০০৫ সালে বাংলাভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ খ্যাতিমান আনন্দ প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজীতে ‘মেমরীজ কাম এলাইভ’, হিন্দীতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুদিত হয়েছে। মান্নাদের জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্নাদে সঙ্গীত একাডেমী মান্নাদে’র সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষন করছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা সঙ্গীত ভবনে মান্নাদে’র সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

সাফল্য এবং খ্যাতি:



সাল বিবরণ

১৯৬৯ হিন্দী চলচ্চিত্র মেরে হুজুর ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)

১৯৬৯ জাতীয় ছায়াছবি পূরস্কার Renaissance Sanskritik Parishadএর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ

১৯৭১ বাংলা চলচ্চিত্র নিশি পদ্মে ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)

১৯৭১ ভারত সরকার পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়।

১৯৮৫ মধ্য প্রদেশ সরকার লতা মঙ্গেশকার পদক প্রদান করে।

১৯৮৮ রেনেঁসা সাংস্কৃতিক পরিষদ, ঢাকা থেকে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে।

১৯৯০ মিঠুন ফ্যানস এসোসিয়েশনের তরফ থেকে শ্যামল মিত্র পুরস্কার।

১৯৯১ শ্রী ক্ষেত্র কলা প্রকাশিকা, পুরী থেকে সঙ্গীত স্বর্ণচূড় পুরস্কার প্রদান।

১৯৯৩ পি.সি চন্দ্র গ্রুপ ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে পি.সি. চন্দ্র পুরস্কার।

১৯৯৯ কমলা দেবী গ্রুপ কমলা দেবী রায় পুরস্কার প্রদান করে।

২০০১ ‍আনন্দবাজার গ্রুপ আনন্দলোক আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।

২০০২ বিশেষ জুরী বোর্ড কর্তৃক সঙ্গীতে অবদানের জন্য সারল্য যশোদাস পুরস্কার প্রদান করে।

২০০৩ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক আলাউদ্দিন খান পুরস্কারে ভূষিত।

২০০৪ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মাননা প্রদান।

২০০৪ কেরালা সরকার গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করে।

২০০৫ ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মবিভূষণ খেতাব প্রদান।

২০০৫ মহারাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক আজীবনকাল সম্মাননা প্রদান।

২০০৭ ভারত সরকার কর্তৃক দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।

২০০৭ ওড়িষ্যা সরকার “প্রথম অক্ষয়” পুরস্কার প্রদান।

২০০৮ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মান প্রদান।





তাকে নিয়ে গুজব :

আমি তো মানুষ, ও গুজব যেনো ছড়িয়ে গেলো, শুনে তো আমি ভীতই হবো!



হ্যাঁ, চলতি মাসে আট তারিখে বুকের ইনফেকশান হওয়ার পর চুরানব্বই বছর বয়সী এই কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পীকে ব্যাঙ্গালুরু হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়া হয়েছিলো। তখন থেকেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে একটা গুজব ছড়াতে থাকে।



ডাক্তাররা আপাতত ঐ গুজব নাকচ করে দিয়েছেন।





তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়...



বয়সের কাছে সবাইকে হার মানতে হয়, হবেও। তবে আরও একটু বেশি দিন বাঁচা হলে ক্ষতি তো নেই। এক পলকের এই মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে তো আপনি আমি কেউই যেতে চাইবো না!



তাই যত ঝড়ই আসুক, আমরা চাইবো, মান্না দে আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠুন!



খুব জানতে ইচ্ছে করে...



মান্না দে আজ হয়তো তাঁর জীবন সায়ান্নে! তবুও আমরা সর্বান্তকরণে কামনা করবো, তিনি যেন সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসেন। আমাদের হাজারো হাসি কান্নার বানীকে সূর দেয়া কণ্ঠশিল্পী যেন আমাদের সাথে আরও কিছু দিন এই পৃথিবীর আলো বাতাস ভাগ করে নেন!



এই কামনাই আমাদের থাকবে!



জনপ্রিয় গান : (ডাউনলোড লিঙ্ক সহ)

আজ আবার সেই পথে দেখা

এই ক্ষণটুকু কেন এত ভাল লাগে

এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি





আমায় আকাশ বললো

Click This Link

না না যেওনা ও শেষ পাতা গো

Click This Link

যে ক'দিন আকাশজুড়ে

Click This Link

কাল কিছুতেই ঘুম এলোনা

Click This Link

মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়

Click This Link

সোনার এ দিনগুলি

Click This Link

যে ভালবাসায় ভোলায় মোরে

Click This Link

আমি আজ আকাশের মত একেলা

Click This Link

এই জীবনের বেশীটাই দুঃখ

Click This Link

এতভালবেসে তবু মিটলোনা সাধ

Click This Link

সোনাতে কলংক ধরেনা

Click This Link

সোনালী রং মেখে পাখীরা যায় নীড়ে

Click This Link

যদি প্রশ্ন করি

Click This Link

এই সেই ঘর,সেই দরজা

Click This Link

শুধু তোমার ভালবাসা পেয়ে

Click This Link

যে সমাধি বেদীটার ঠিক ওপরে

Click This Link

আজ শরতের কাশের বনে

Click This Link

এই আছি বেশ

Click This Link

অনেক কথা বলেও তবু

Click This Link

মনে পড়ে সেই দিনটি

Click This Link

যদি এখনো আমাকে শুধু ভাল লাগে

Click This Link

দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি

Click This Link

তুমি চিঠি লিখে ভুলে গেলে

Click This Link

তুমি চলতে ফিরতে গুনগুন

Click This Link

শুনতে শুনতে অনেক মিথ্যে

Click This Link

ভাব করে কি সুখ পাওয়া যায়

Click This Link



একটি সাক্ষাৎকার ও মজার কিছু কথা :

আধুনিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঢাকায় তাঁর এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন উৎপল শুভ্র

উৎপল শুভ্রঃ প্রথম প্রশ্নটা গান নিয়ে নয়, আপনার বয়স নিয়ে। এই যে প্রায় ৯০ বছর বয়সেও আপনি দেশে-বিদেশে ঘুরে গান গেয়ে যাচ্ছেন। কীভাবে পারেন, বলুন তো!

মান্না দেঃ গান আমার একটা প্যাশন। গানই আমার জীবন। এ কারণেই হয়তো পারি। এই বয়সেও গান করতে পারার পেছনে আর একটা ব্যাপারও হয়তো আছে। আমি স্পোর্টসম্যান ছিলাম। কুস্তিটুস্তি করে নামও করেছিলাম। সেই জন্য আমার শরীরটার বাঁধুনি শুরু থেকেই একটু শক্ত ছিল। আমার বাবাকেও কৃতিত্ব দেব এ জন্য। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, শরীর ভালো রাখতে হলে শরীরের যত্ন করতে হবে। যতটুকু খাওয়া দরকার, ততটুকু খাবে। সময়মতো খাবে, সময়মতো শোবে, সময়মতো এক্সারসাইজ করবে, সময়মতো কাজ করবে। জীবনের এই ডিসিপ্লিনটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে। এ কারণেই আমি ৯০ বছর বয়সেও গান করতে পারছি। এখনো প্রতিদিন সকালে আমি দু ঘণ্টা রেয়াজ করি। রেয়াজ করতে না পারলে মনে হয় দিনটাই খারাপ গেল। এখনো কানটাকে সব সময় ভীষণ টিউন করে রাখি যে, কে ভালো গাইছে এবং তাদের কাছে কিছু শেখার আছে কি না! আমি বিশ্বাস করি, যত দিন শেখা যায়, শেখা উচিত। আমি এখনো শিখছি।

শুভ্রঃ এখনো শিখছেন! তা কত বছর হলো এই ‘শিক্ষাজীবন’?

মান্না দেঃ ষাট বছর। ষাট বছরই আমার সংগীতজীবন। লেখাপড়া ভালোভাবেই করেছিলাম। তবে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর সিঙ্গার হওয়াটাকেই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নিই। কারণ ছিল হয়তো এটাই যে, কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন আমার কাকা। কাকা বিয়েটিয়ে করেননি, নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছিলেন আমাদের। কাকার দৌলতে ভারতবর্ষের সেরা সেরা গাইয়ে-বাজিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন, পারফর্ম করতেন। বাড়িতে বসেই আমরা তাই ভারতবিখ্যাত সব শিল্পীর গান শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা আমি শুনতে শুনতে নিজেই শিখেছিলাম। পড়াশোনা শেষ করার পর কাকা আমাকে শেখাতে শুরু করলেন। শিক্ষক হিসেবে কাকা ছিলেন খুব কড়া। কাকা কখনো দুটো মেডেল আর একটা কাপ পাওয়ার জন্য গান শেখাতেন না, কাকার তত্ত্বাবধানে শুরু করার পর আমি কাকার ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের কাছে গান শিখলাম। এরপর কাকার হাত ধরে বোম্বেতে যাওয়ার পর ওখানে কাকা আমাকে বড় বড় ওস্তাদের কাছে দিয়ে দিলেন, এর পাশাপাশি ফিল্মেও কাজ করতে লাগলাম। ভেতর থেকে একটা তাড়না ছিল, আমাকে সর্বভারতীয় গাইয়ে হতেই হবে। আমি শুধু বাংলা গান করতে চাই না, ভারতবর্ষে যত রকম গানবাজনা আছে আমি তা করতে চাই। আর বোম্বে ছিল এমন এক জায়গা, যেখানকার মূলমন্ত্র হলোঃ সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। নিজেই নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম।

শুভ্রঃআপনার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে শুনেছি, আপনি নাকি এখনো নিজের সব কাজ নিজেই করেন। বাজার করা, কাপড়চোপড় কাচা পর্যন্ত···।

মান্না দেঃ হ্যাঁ, আমি আমার নিজের কাজ নিজেই করতে ভালোবাসি। আমি খুব সেলফ-সাফিশিয়েন্ট। আমি আতিশয্যে বিশ্বাস করি না। আর্টিস্ট হয়েছি তাতে কী, আমি খুবই প্র্যাকটিক্যাল লোক। আমি জানি, নিয়মিত রেয়াজ না করলে আমি ভালো করে গাইতে পারব না। আমি তাই রেয়াজ করি। জানি, না শিখলে আমি এগোতে পারব না। আমি শিখি। কম খেলে শরীর ভালো থাকবে। আমি কম খাই। সব মিলিয়ে আমি খুবই ডিসিপ্লিনড মানুষ।

শুভ্রঃ জীবনে কিছু যা পাওয়া সম্ভব, নাম-খ্যাতি, মানুষের ভালোবাসা···সবই তো আপনি পেয়েছেন। এর মধ্যে নিজে সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে করেন কোনটিকে?

মান্না দেঃ আমার জীবনে সক্কলের চাইতে বড় পাওয়া আমার স্ত্রী। ও কেরালার মালাবারের মেয়ে। উচ্চশিক্ষিত, বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি ভাষায় এমএতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ওকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে যা বোঝায়, তা-ই হয়েছিল আমার। এরপর আমরা একে অন্যকে জানলাম, বিয়ে করলাম। এই ৫৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সব সময়ই ওকে আমার সঙ্গী হিসেবে যেমন সেরা মনে হয়েছে, তেমনি বন্ধু হিসেবেও সেরা, যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করার জন্য সেরা। ও শুধু আমার স্ত্রী-ই নয়; আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমার সবচেয়ে বড় সমালোচকও।

শুভ্রঃ এটা তো পুরো জীবনের পাওয়া। শুধু সংগীত জীবনটা যদি আলাদা করে নিই, তাহলে সবচেয়ে বড় পাওয়া মানেন কোনটিকে?

মান্না দেঃ সেই চাওয়া-পাওয়ার তো আর শেষ নেই। আমি যা হতে চেয়েছিলাম, সেই সর্বভারতীয় টপ সিঙ্গার হতে গেলে গোটাকতক জিনিস দরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি কোন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি প্রতিনিধিত্ব করছি বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের যে গানবাজনা-রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদের গান, বাউল, ভাটিয়ালি-এগুলো তো সর্বভারতীয় হয় না। আমার সমসাময়িক যাঁরা ছিলেন-মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে-সবারই এমন একটা পরিমণ্ডলে জন্ম হয়েছিল, যেখানে সর্বভারতীয় গানবাজনা হতো। ওঁরা সেখানেই জন্মেছিলেন বলে ওঁদের একটা অ্যাডভান্টেজ ছিল। একটা বাঙালির ওঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা খুব মুশকিল ছিল। তা সত্ত্বেও আমি সহজে হার মেনে নিইনি, ভালো ভালো ওস্তাদের কাছে শিখেছি। এ কারণেই আমি একটু অন্যভাবেও গাইতে চেয়েছি। আমার যে গায়কি, তাতে সব সময়ই একটা ক্লাসিক্যাল বেজ থাকত। বাংলা গানেও আমি এসব ইন্ট্রোডিউস করেছি। সুখের কথা, আমার বাঙালি শ্রোতারা সেটি দু হাত ভরে গ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষাতে আমি যত শক্তই গান করি, সে গানগুলো পপুলার হতো ও লোকে গ্রহণ করত। তবে এটা হিন্দি ফিল্ডে হয়নি। কারণ হিন্দি ফিল্ডে আই ওয়াজ অ্যান আউটসাইডার। একজন বাঙালি, যে হিন্দি বা উর্দু গান গাইছে। সেখানে যাদের এটি নিজেদের ভাষা, তারা অনেকটাই এগিয়ে ছিল। যেমন রফি ছিলেন পাঞ্জাবি, হিন্দি-উর্দু ওঁর স্বাভাবিকভাবেই আসত। আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম। কারণ রফির মতো গাইয়ে ভারতবর্ষে হয়নি। আমি বলছি লাইট মিউজিকের কথা···এতে রফির মতো সিঙ্গার হয়নি। আমি তাই মেনে নিয়েছিলাম, রফির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলে আমি হয়তো কিছুটা এগোতে পারব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারব না।

এ কারণেই বললাম, আমি মেনে নিই। যেমন কিশোর কুমার, ও যদিও বাঙালি, গাঙ্গুলী পদবি, তবে ওর জন্ম মধ্যপ্রদেশে। সেখানে ওদের কথাবার্তা চলত হিন্দিতে। ওই একটা অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেল সে। তার পর ছিল কিশোরের ওই গলা। অদ্ভুত রকমের একটা গলা ভগবান তাকে দিয়েছিলেন। অত বিউটিফুল ভয়েস খুব কম এসেছে।

কিশোর, রফি, বাংলা গানে হেমন্ত-ওঁদের যে ঈশ্বরদত্ত অপূর্ব গলা ছিল, আমি তা পাইনি। আমার গলার মধ্যে অত আকর্ষণীয় কিছু ছিল না। কিশোরের গলা শুনলেই যেমন মনে হতো, ‘হোয়াট আ ভয়েস!’ হেমন্তবাবুর অত মিষ্টি ভয়েস; আর রফি-ওর গায়কি, গান করার ঢং, ওটা ছিল দারুণ। এ কারণেই নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য আমাকে ক্লাসিকের দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল। ভারতবর্ষে যে ক্লাসিক্যাল গানবাজনা, সেটি ভালোভাবে রপ্ত করে আমি ওদের সঙ্গে কমপিট করতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর যা দেখলাম, আমার জন্য মিউজিক ডিরেক্টররা যে গান তৈরি করতেন, সে গান আমিই গাইতাম, অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়ানো যেত না।

শুভ্রঃ যেকোনো শিল্পীর জন্য নিজের ভাষার গান দিয়ে শুরু করাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি বাংলা গান করলেন অনেক পরে, বোম্বেতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। এটা কেন?

মান্না দেঃ আমার প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করার ঘটনাটা খুব মজার। আমি আর লতা অমর ভূপালী বলে একটা ছবির গান করছিলাম। ওই ছবিতে আমি আর লতা যখন গান রেকর্ড করছি, লতা আমাকে বলল, ‘মান্নাদা, আমি বাংলা গানের রেকর্ড বের করতে চাই।’ লতার জন্য গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা দুটি গান আমি সুর করে লতাকে শেখালাম। এরপর রেকর্ডিংয়ের জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু জানি না কেন, লতা গাইতে পারল না অথবা গাইল না। তো আমি গেয়ে দিলাম ওই দুটি গান-’কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’। ওই দুটি গান শুরুতে তেমন সাড়া না ফেললেও পরে দারুণ হিট হলো। এটাই বাংলা গানে আমার প্রথম পদার্পণ। ওই দুটি গান ভালো চলার পর এইচএমভি আমাকে বলল, প্রত্যেক বছর পুজোয় রেকর্ডিং করতে হবে। আর তখন আমি যে গানেরই সুর করি, দেখি তা হিট হয়ে যায়। আমি ভেবে দেখলাম, আমার সুর করার ধারাটা গতানুগতিক যেটা চলছিল তার চেয়ে আলাদা এবং সেটিই পাবলিক খুব পছন্দ করছে। আমি সর্বভারতীয় একটা টাচ দিয়ে সুর করতাম। লোকেও দেখল, আরে, এর সুরটা বা গায়কিটা তো আলাদা।

এই যে অন্য রকম একটা দিক যোগ করা, এটা আমি জেনে-বুঝেই করেছিলাম। কারণ হেমন্তবাবুর অমন সুন্দর গলা, ভাষাটা এমন সুন্দর বলেন তিনি এবং মিষ্টি মিষ্টি গান করেন, আমি দেখলাম, এই ধারায় আমি তার সঙ্গে কমপিট করতে পারব না। আমাকে যেটা করতে হবে, সর্বভারতীয় সাংগীতিক রূপটাকে এনে গানটাকে পরের ধাপে নিয়ে নিতে হবে। সেটি করেই আমি সফল হলাম।

শুভ্রঃ আমার প্রশ্ন ছিল, শুরুটা কি নিজের ভাষার গান দিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল না?

মান্না দেঃ না, আমি কখনোই বাংলা গানের শিল্পী হতে চাইনি। আমার মনে আছে, শচীন কর্তা (শচীন দেব বর্মণ) আসতেন কাকার কাছে গান শিখতে। উনি বহুদিন কাকার কাছে গান শিখেছেন। শচীন কর্তার গান শুনে ভালো লাগত, কেমন অন্য রকম গান করেন। কথার উচ্চারণগুলো নাকে নাকে। আমার খুব পছন্দ হতো। ওগুলো নকল করে করে আমি কলেজে গাইতাম, ‘তুঁমি যে গিঁয়াছ বঁকুল বিঁছানো পঁথে, নিঁশীথে যাঁইও ফুঁলবনে’। তবে তখন আমার সর্বভারতীয় শিল্পী হওয়ার লক্ষ্য। কাকা সবকিছু গাইতেন-ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, গজল, নাত, কীর্তন। আমাদেরও কাকা সেভাবেই তৈরি করেছিলেন যে, একটা ধ্রুপদ গাইতে হলে ধ্রুপদ গাইতে হবে তোমাকে। খেয়াল গাইতে হলে খেয়াল গাইতে হবে। বাংলা মডার্ন গাইতে হলে গাইতে হবে।

শুভ্রঃ আপনার সমসাময়িক বা আগে-পরে বাংলা গানের যেসব শিল্পী ছিলেন, যেমন সতীনাথ···

মান্না দেঃ না, না, না, সতীনাথ···এঁদের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। এঁদের গানের ব্যাপারেও না। এঁরা পপুলার আর্টিস্ট ছিলেন, পপুলার থাকতে দিন। তবে গান করার যে জায়গাটা, সেখান থেকে আমি এঁদের মোটেই পছন্দ করি না। আমি পছন্দ করতাম হেমন্তবাবুর গান। এত সাদাসিধে গান করতেন আর এমন মিষ্টি গান···যেন লোকেদের কাছে আস্তে করে গানটা তুলে দিতেন তিনি আর লোকেরাও দু হাত বাড়িয়ে তা লুফে নিত।

শুভ্রঃ হিন্দি-বাংলা সব মিলিয়ে আপনার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী কে?

মান্না দেঃ মোহাম্মদ রফি আর লতা মুঙ্গেশকর। আমি তো বলব, গানের জগতে মোহাম্মদ রফির থেকে বেটার সিঙ্গার হয়নি। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, লতার মতো আর্টিস্ট আর জন্মাবে না। লতা মুঙ্গেশকর যেভাবে গান করে গেছেন, তাতে তিনি নিজেই একটা ইনস্টিটিউশন। ‘কীভাবে ভালো গাইতে হয়’-বাকি সিঙ্গারদের একটা গাইডলাইনও দিয়ে গেছেন লতা। লতার আগে কত গাইয়ে ছিলেন···জোহরাবাই আম্বেলেওয়ালি, আমিন ভাই কর্নাটকি, পারুল ঘোষ, নূরজাহান, শামসাদ বেগম, গীতা দত্ত···লতা আসার পর সবাই হারিয়ে গেলেন। লতার মতো গাইয়ে···আহ্‌ হা হা···ওই যে বললাম, লতা হচ্ছেন গানের একটা টোটাল ইনস্টিটিউশন। আমার যেটা মনে হয়, শিখে কেউ লতা মুঙ্গেশকর হতে পারে না। এটা ভগবানের অদ্ভুত রকম একটা আশীর্বাদ তার ওপরে। নইলে কী করে একটা মারাঠি মেয়ে এভাবে গান করতে পারে!

শুভ্রঃআপনি যতই সর্বভারতীয় শিল্পী হয়ে থাকুন, হিন্দি-মারাঠি-গুজরাতি গান গেয়ে থাকুন না কেন, বাংলাদেশে কিন্তু আমরা আপনাকে বাংলা গান দিয়েই চিনি। তার চেয়ে বেশি চিনি রোমান্টিক গান দিয়ে। আমাদের কয়েক প্রজন্মের তারুণ্য-যৌবন তো মান্না দেময়। প্রেমে পড়লেও মান্না দে, প্রেমে ব্যর্থ হলেও···। গানগুলোকেও অনেকে আপনার কথা বলেই ধরে নেয়। আপনি হয়তো গাইছেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’, লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, এই ‘ও’টা কে? অথচ গানটা তো আপনি লেখেননি!

মান্না দেঃ খুব সত্যি কথা। সব সময় এটাই হয়। একটা গান গাইলে ‘কিয়া গানা গায়া মান্না দে’। আরে, মান্না দে কিয়া গায়া? গানটা যদি কেউ না লিখত, যদি ওইভাবে সুর না হতো, তো মান্না দে কী গাইত!

আমার ওসব গানের জন্য আমি কৃতিত্ব দিই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ও যেভাবে গান লিখেছে···’এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান। এ শুধু তোমায় কাছে পাওয়ার ছল ভরা গান।’ যখন এইভাবে কথা লেখা হয়, তখন সেটিতে সুর করতে বসলে তা বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে। আমি এই গানটার সুর করেছি একটু ক্লাসিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড রেখে। এটাই আমার গানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। সব গানের পেছনে একটু ক্লাসিক্যাল কিছু থাকবেই।

শুভ্রঃ আমরা যেমন আপনার অনেক গানই গুনগুন করি, আপনি নিজে সবচেয়ে বেশি গুনগুন করেন কোন গান?

মান্না দেঃ রবীন্দ্রসংগীত। শুধুই রবীন্দ্রসংগীত।



শুভ্রঃ আপনার আত্মজীবনীতে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যা লিখেছেন, সেটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ওই ‘গেল গেল’ রব তোলার সংকীর্ণতা না থাকলে এটি আরও বেশি গণমানুষের গান হতে পারত।

মান্না দেঃ খুব সত্যি কথা। ওরা এই যে রবীন্দ্রসংগীতকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ধরে রেখেছেন না, ধরে রেখে খুব অন্যায় করেছেন। আরে বাবা, এটা কেমন নিয়ম যে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে ও রকম গলা চেপে চেপে গাইতে হবে। কেন? বাংলা ভাষায় লেখা গান, আমরা লেখাপড়া শিখেছি, গানবাজনা শিখেছি, নোটেশন পড়তে পারি, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে অসাধারণ সুন্দর সুর করেছিলেন, সেভাবে গাইতে পারি। তাহলে এভাবেই গাইতে হবে নিয়ম কেন? ‘স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হলো।’ (প্রচলিত রাবীন্দ্রিক ঢঙে গেয়ে) এটা এইভাবে গাইতে হবে কেন? ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে, বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে।’ এটা কেন···(গলা চেপে গেয়ে) ওই যে ঝড়ের···আরে ননসেন্স···ঝড় কি ওইভাবে আসে? (গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে) আহ্‌ হা···বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে···কী···কী লিখেছেন! রবীন্দ্রনাথের কল্পনার পাখায় উড়ে যাওয়ার যে ক্ষমতা আর সেটিকে তিনি যেভাবে কথা আর সুরের মেলবন্ধন দিয়ে ব্যক্ত করেছেন···আমি এমন জিনিয়াস আর দেখিনি। আমি এত লোকের গান শুনেছি, এত গানবাজনা শুনেছি, গান নিয়ে এত লেখাপড়া করেছি, রবীন্দ্রনাথের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে এমন কারও দেখা আমি পাইনি।

কী গানের কথা! কী করে লিখে গেছেন প্রেমের গান ওই রকম-’তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে, আমায় শুধু ক্ষণেক তরে আজি।’ আহ্‌ হা, আহা, কী কথা! ‘হাতে আমার যা কিছু কাজ আছে, আমি সাঙ্গ করব পরে।’ আহ্‌ হা, কী কথা-আমি ভীষণ ইমোশনাল হয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের গানের কথা উঠলে। আমি বাড়িতে বসে সব সময় রবীন্দ্রসংগীত গাই। আমার বউকে শেখাই, দুজন একসঙ্গে গাই।

শুভ্রঃ আর কী লেখেননি! ‘আমরা দুজন’ শুনেই যেমন মনে হলো, ‘আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা রচিব না ধরণীতে।’ আমার এক বন্ধু প্রেমে পড়ল, মেয়ে পাত্তা দেয় না। ও আমাকে বলল, তোর রবীন্দ্রনাথ নাকি সবকিছু নিয়েই গান লিখেছেন! এই পরিস্থিতির কী গান? আমি বললাম, তাও আছে-’ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে, কেন সে দেখা দিল। মধু অধরের মধুর হাসি, প্রাণে কেন বরষিল।’

মান্না দেঃ একদম সত্যি কথা। এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যাতে রবীন্দ্রনাথ তার ছোঁয়া দেননি। আমার তো রবীন্দ্রনাথের সব গানই মুখস্থ। ওই যে একটা গান···’কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে, তখন তুমি ছিলে না গো ছিলে না, তখন তুমি ছিলে না মোর সনে। যে কথাটি বলব তোমায় বলে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে।’ আবার দেখুন-’সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে···যখন তুমি আছ আমার সনে।’

মাই গড! হাউ কুড হি সে দিস্‌! হাউ কুড হি সে দিস্‌! ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশি নায়ে/তাহারি রাগিণী লাগিল গায়ে।’ কীভাবে বলেছেন উনি! আর কেমন সুর করেছেন! যেন ওই কথার জন্য অন্য কোনো সুর হলে হতোই না।

একটা ঘটনা বলি। একবার বোম্বের খুব বড় একজন মিউজিক ডিরেক্টর আমাকে বললেন, ‘আরে মান্নাদা, টেগোর সাব কা গানে মে অ্যাই রোনা-ধোনা বনধ্‌ নেহি হোতা হ্যায়? এ ক্যায়সা লাগা আপ কো?’ আমি বললাম, ‘রোনা-ধোনা···কিস্‌কা গানা শোনা আপনে?’ উনি বললেন, ‘এসব যো গাতা হ্যায় টেগোর সংস্‌’। সবাই তো আসলে ওভাবেই গান করে, ন্যাকার মতো ক্যা-ও-ও করে। আমি উনাকে বললাম, ঠিক আছে, আমি আপনাকে একদিন টেগোরস্‌ সং শোনাব, তবে দু ঘণ্টা সময় করতে হবে। ‘দো ঘণ্টা?’ আমি বললাম, ‘আরে, দুই ঘণ্টায়ও কি টেগোরস্‌ সংস্‌ হয়!’

একদিন বসে তাঁকে শুনিয়েওছিলাম। ওঁর মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বেরোয়নি। তারপর বললেন, ‘এ কী জিনিস বাঙালি পেয়েছে!’ রবীন্দ্রসংগীতের শুধু কি কথা? সুর, রাগরাগিণী, তাল-লয়···কীভাবে যে রবীন্দ্রনাথ ওসব করেছেন!

শুভ্রঃ আপনার গাওয়া বাংলা গান থেকে যদি প্রিয় দশটা গান বেছে নিতে বলি!

মান্না দেঃ এ তো মহা মুশকিল। গান হচ্ছে আমার বাচ্চার মতো। আমি এত ভালোবেসে গানে সুর করেছি। নিজেও ভাবতে পারিনি যে, সেসব গান এত হিট করবে। ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, এরই মাঝে প্রেম তবু গড়ে খেলাঘর।’ গৌরী (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) বলল, ‘মান্নাদা, এই দুটো লাইন লিখেছি, শুনুন না একটু’। আমি বললাম, কী লাইন? ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়, তারই মাঝে প্রেম তবু গড়ে খেলাঘর।’ বহুত আচ্ছা ভাই। গৌরী বলল, ‘তাহলে সুর করুন।’ তখন কেমন গান হতো জানেন তো···’পূর্ণিমার চাঁদ আনে জোছনা গানে, নীড় কুমুদীর গানে সেই বারতা।’ সে সময় এই গান বিরাট ব্যাপার! তবে এটা হচ্ছে টিপিক্যাল কমার্শিয়াল গান। আমাকে এখন এই গান করতে বললে আমি গাই না। আমি বলি, এ তো বাচ্চাদের গান। হ্যাঁ, আমার তেমন গান যদি শুনতে চান, তাহলে শুনুন, আমার নিজেরই সুর করা, ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা, কাজল মেঘের ভাবনায় বাদলের এই রাত ঘিরেছে ব্যথায়।’ সুর করার সময় আমি একেবারে গানের কথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম। এমন গান শুনতে চান, শোনাতে পারি। কিন্তু ওই যে টিপিক্যাল কমার্শিয়াল গান, ওসব তো রেকর্ড বিক্রি করার জন্য।

শুভ্রঃ তার পরও আপনার প্রিয় কয়েকটা গান বেছে নেওয়া কি সম্ভব? আমার পছন্দগুলো বলে সাহায্য করব নাকি-’আমি নিরালায় বসে’, ‘চাঁদের আলোয় নিভিয়েছিলাম’, ‘ললিতা গো···’

মান্না দেঃ ‘ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল্‌ না।’ এই গানটা কিন্তু টিপিক্যাল বাংলা গান নয়। ওই গানটার একটা ইতিহাস আছে। আমি কাকার কাছে শিখেছিলাম একটা ঠুমরি-’শ্যাম ঘুংঘট কে পট খোলো।’ ‘পট খোলো’র মধ্যে যে একটা লচক্‌ না, পুলক ধরেছিল এটাকে। ও বলল, ‘দাদা, এই সুরটার মধ্যে একটা কিছু আছে।’ আমি বললাম, কী আছে? পুলক বলল, ‘ওই যে কী রকম একটা ঘুং ঘটপট খোলো।’ আমি বললাম, ঘটপট না, ঘুংঘট কে পট খোলো, মানে ঘোমটাটা খোলো। সুরটাতে ‘খোলো’র ওপর যে একটা ঝটকা, ওটা নিয়েই ও লিখে ফেলল, ‘ওকে আজ চলে যেতে বল্‌ না···অন্য ঘাটে চল্‌ না’! ‘ঘুংঘট কে পট খোলো’র সঙ্গে মিলিয়ে ‘বল্‌ না, চল্‌ না’!

পুলক ওয়াজ গ্রেট। ও এত সুন্দর সুন্দর গানের কথা আমাকে দিয়েছে। এই যে ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’ গানটা। আমি গান গাইতে সিন্ধ্রি নামে একটা জায়গায় গেলাম, ও-ও সঙ্গে গেল। যেখানে আমরা ছিলাম, সেখানে সামনের বাড়িতে একটা মেয়েকে দেখে এই গানটা লিখে ফেলল। আমি ও পুলক ছাদে বসে চা-টা খাচ্ছিলাম, এর মধ্যে ওই মেয়েকে দেখে পুলক লিখে ফেলল, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো, অমনি করে ফিরে তাকাল, দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই। আমি তো মানুষ।’ এই যে ডাউন টু আর্থ কথাটা···’আমি তো মানুষ, আমি তো মুগ্ধ হবই’···আমি ওইভাবেই সুরটা করলাম। পুলক আমাকে বারবার বলেছিল, ‘মান্নাদা, কীভাবে সুর করলেন?’ আমি বলেছিলাম, ‘আপনি যেভাবে লিখেছেন আমি ওইভাবেই সুর করেছি।’ গানের কথা আমার হৃদয়ের তারে টোকা না দিলে আমি সুর করিনি।

কথা আর সুরে সামঞ্জস্যটা তো তখনই হয়···(গেয়ে শোনালেন) রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি···আমার কাছে অনেকে এসে গান শিখতে চায়। কী শিখবে? বলে, আপনার ওই গানটা। আমি বলি, ওটা কি তুমি শিখতে পারবে? চাইলেই এভাবে (গেয়ে উঠে) ‘রিমঝিম-রিমঝিম’ বলতে পারবে? ওই যে ‘বর্ষা তুমি ঝোরো না গো এমন জোরে, কাছে সে আসবে বল কেমন করে···রিমঝিম ঝিম ঝিম’···এই রিমঝিম ঝিম ঝিম কথাটা তুমি এভাবে কেমন করে বলবে? তুমি তো পারবে না। যাও, ভালো কোনো ওস্তাদের কাছে গিয়ে সারেগামা, সুর-তাল-লয় এসব শেখো। এসব রপ্ত করে বছর পাঁচেক পর এসো। তখন গান শেখাব।

শুভ্রঃ কী বলছেন? এখন তো ফাস্ট ফুডের যুগ। এত শেখার সময় আছে নাকি কারও? পাঁচ বছরে তো দশটা ক্যাসেট বের করে ফেলা যায়!

মান্না দেঃ ঠিকই বলেছেন। সত্যি, গানবাজনার স্তরটা খুব নেমে গেছে। অত্যন্ত নিচে চলে গেছে। আমি এখনো গান করছি। সারা পৃথিবীতে গান করছি। যারা ভালো গান শুনতে চায়, তারা আসে। একটু বয়স্করাই আসে। ইয়াংরা তো একদমই শুনতে চায় না। ওরা কী সব ব্যান্ড শুনছে, র‌্যাপ শুনছে। রাবিশ!

শুভ্রঃ অবসরে গল্প-উপন্যাস পড়েন?

মান্না দেঃ তা তো পড়িই। আমি ক্লাসিক বেশি পড়ি। ইংরেজিই বেশি। বাংলা তেমন পড়ি না।

শুভ্রঃ প্রিয় লেখক কে?

মান্না দেঃ সমারসেট মম। এখন আসলে পৃথিবীটা এমন হয়েছে, সব সময়ই কিছু না কিছু হচ্ছে। এসব জানতে আমি খুব জার্নাল পড়ি। নিয়মিত ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন পড়ি।

শুভ্রঃ অনেক বছরই তো আপনার বেঙ্গালুরুতে নিবাস, তাই না?

মান্না দেঃ হ্যাঁ, বেঙ্গালুরুতে অনেক বছরই হয়ে গেল।

শুভ্রঃ রেয়াজ দিয়েই তো দিন শুরু হয় বললেন। এর বাইরে প্রোগ্রাম-ট্রোগ্রাম না থাকলে আপনার ডেইলি রুটিনটা কী?

মান্না দেঃ কী আর করব! টিভিটুভি দেখি। আজকাল অবশ্য যেসব অসভ্য জিনিস দেখায়, ওসব দেখতে ভালো লাগে না। স্পোর্টস দেখতে খুব ভালো লাগে। স্পোর্টসটা আমি সব সময় খুব ফলো করি। টেনিস, ক্রিকেট, ফুটবল···মূলত এই তিনটাই। আজকাল আবার ব্যাডমিন্টনে ভারতের মেয়েরা খুব ভালো খেলছে। ছোটবেলা থেকেই স্পোর্টস আমার খুব প্রিয়। আমার বাবা খুব নামকরা ফুটবলার ছিলেন। গান আর স্পোর্টস-এই দুটোই আমার জীবন।



সূত্রঃ প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০০৯



কোনো দিন কফি হাউসে যাইনি – মান্না দে----



কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’-স্মৃতিজাগানিয়া এই গানেই বাঙালি চেনে উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মান্না দে’কে। কিন্তু যেই কফি হাউস নিয়ে এই গান সেখানেই নাকি জীবনে কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর।



প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন মান্না দে। তিনি বলেন, ‘কফি হাউস আমার বাড়ির খুব কাছেই ছিল। কিন্তু যে কেউ জানলে অবাক হবে, আমি আজ পর্যন্ত কোনো দিন কফি হাউসে যাইনি। তবে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কফি হাউসের যে ছবিটা গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার গীতিকবিতায় তুলে ধরেছেন, সেটা এক কথায় অসাধারণ। আর তার ওপর নচিকেতার ছেলে খোকা সুন্দর সুর করেছেন। আমি তো কেবল তাঁদের বানানো জিনিসটাই শ্রোতার কাছে তুলে ধরেছি। সব কৃতিত্ব গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের।’



ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে গান গাইতে তিন দিনের জন্য ঢাকায় এসেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে। গতকাল বুধবার প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন গুণী এই শিল্পী।



মান্না দে’র বয়স এখন ৮৯ বছর। কিন্তু গান শুনলে যে কারও মনে হবে এখনো তরুণ। কণ্ঠে এই তারুণ্য ধরে রাখার রহস্যটা কী? মান্না দে’র উত্তর, ‘এটা স্বতন্ত্র উপস্থাপন, স্বতন্ত্র মনোভাবের বিষয়। আমি একটি সাধারণ গৃহস্থঘরের ছেলে। সেভাবেই মানুষ হয়েছি, লেখাপড়া করেছি, সেভাবেই জীবনকে দেখতে ও চলতে শিখেছি। তবে এটা ঠিক, কারও মধ্যে যদি প্রতিভা থাকে, তবে সে কিছু হতে পারবে। আমার কাকা আমার ভেতর হয়তো সে রকম প্রতিভা দেখেছিলেন। তিনিই আমাকে টেনে এনে একদিন বলেছিলেন, ‘গান শেখো।’ গানের জগতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিই আমাকে রাস্তা দেখিয়েছিলেন। সে জন্য হয়তো আজও গাইছি।’



মান্না দে জানান, তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন অন্ধ। সব সময় তাঁর সঙ্গে একজনকে থাকতে হতো। এ কারণেই কাকার সঙ্গে কলকাতা থেকে মুম্বাই যাওয়া। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ছিলেন।

মান্না দে বলেন, ‘কাকাই ছিলেন আমার সংগীত ভুবনের পথপ্রদর্শক। তিনি শিখিয়েছেন কী করে গান করতে হয়, সুর বাঁধতে হয়। ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মতো করেই আমি জীবনটাকে দেখতে শিখেছিলাম। কাকা সব সময় বলতেন, কান দুটো খোলা রাখবি। ভালো-মন্দ দুটোই শুনবি। তা না হলে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবি না।’



মান্না দে’র ভালোবাসার গানে ভালোবাসা যেন উপচে পড়ে। আবার বিরহের গান শুনে শ্রোতাও বিরহকাতর হয়ে যান। এই প্রজ্নের শিল্পীরা কীভাবে কৌশলটা রপ্ত করতে পারবেন? মান্না দে’র উত্তর, ‘কাউকে অযাচিত জ্ঞান দিতে আমি পছন্দ করি না। তবে এটুকু বলব, যাঁরাই গান করবেন, তাঁরা যদি গানটাকে বুঝে করেন, তবেই একটা ফল পাবেন। মানে গানের ভাষার মধ্যে কবি কী বলতে চেয়েছেন, কীভাবে সুর করা হয়েছে, কেমন গায়কি দিয়ে গাইলে সেটা একটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তবে আমি এখনো বিশ্বাস করি, সারেগামাপাধানিসা কিংবা ধাগেনাতি নাগেধিনা, ধাগিনা নাতিনা-এগুলো ভালো করে না জানলে ভালো করে গান করা যায় না।’ তিনি বলে চলেন, ‘আর বলব, রবীন্দ্রনাথের গান। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের সব গান স্বরলিপিসহ আছে। আমি বাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত করি। আমি তো বলব, ও রকম সুর পৃথিবীতে কেউ করতে পারবে না। গানের কথা ও সুরের এত আত্মীয়তা! গাইতে বসলেই অবাক হই।’



মান্নার প্রতিটি গানই যেন একেকটি গল্প। ‘সে আমার ছোট বোন’, কিংবা ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’, ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ’ কিংবা ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’-যে গানের কথাই আসুক শ্রোতার মনে একটা ছবি ভেসে ওঠে। তাঁর ৬০ শতাংশ গানেরই গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকেই বলেন, মান্না আর পুলক হরিহর আত্মা। এ ব্যাপারে মান্নার মন্তব্য, ‘পুলক খুবই জমিদার বংশের ছেলে। সাহিত্যে এমএ করেছিলেন। আমার মতো তাঁরও বড় গুণ ছিল দেখে শেখার। কোনো কিছু দেখলে সেটা পর্যবেক্ষণ করে গান লেখার উপকরণ ঠিকই বের করে ফেলতেন তিনি। যেকোনো আঙ্গিকের গান লেখার ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর লেখা প্রথম গান আমি করি ‘আমার যদি না থাকে সুর’। আর শেষ গান করি ‘যখন এমন হয়, জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা, ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই, রেলের লাইনে মাথা রাখি’।



বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মানে ভাষার মাস। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে মান্নার নিজস্ব অনুভূতি-‘বাংলাদেশকে আমি ভালো করে চিনিনি। তবে শুনেছি, এখানকার শ্রোতারা কলকাতার বাংলা গান খুব শোনে, সেটাকে আমি খুব তারিফ করি। তা ছাড়া বাংলাদেশে বাউল, ঠুমরি, খেয়াল, কীর্তন, ভাটিয়ালি-কী নেই! এই গানগুলো যখন শুনি বা করতে বসি, তখন আমার মনে হয়, এই গান-বাজনার জগৎ দুটো এক হয়ে গেলে ভালো হয় না!’



এই দীর্ঘ জীবনের সেরা প্রাপ্তি কী? অট্টহাসিতে মান্না দে’র জবাব, ‘আমার স্ত্রী’।



মান্না দে’র স্ত্রী সুলোচনা। তাঁদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সুরমা ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন। ছোট মেয়ে সুমিতা। স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে বাস করছেন এই শিল্পী।



সূত্রঃ প্রথম আলো।



কপি পেস্ট সংকলন। ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:৪৮

এহসান সাবির বলেছেন: চমৎকার পোস্ট।

২| ১২ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১:৫৩

রাফসান বড়ুয়া বলেছেন: এই দীর্ঘ জীবনের সেরা প্রাপ্তি কী? অট্টহাসিতে মান্না দে’র জবাব, ‘আমার স্ত্রী’।


উনি যে হারিয়ে গেছেন সেটা কিন্তু বলিনি কোথাও।
ভালো থাকুন সবাই হাসি আর কান্নায়
সময় পেলে হারিয়ে যান মান্নায়

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.