![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ সকাল থেকে আমার মন ভালো নাই । সকাল থেকে ঘুরছি হাটে ঘাটে মাঠে এখানে ওখানে একলা বিজনে । ভোর বেলা পাশের বাড়ির মহিলার নিত্যকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে জেগে বসি জানালার পাশে । কাল রাত আড়াইটা পর্যন্ত ছিলাম হাসপাতালে । রায়হানের শরীর প্রচন্ড খারাপ । এখনো বেঁচে আছে এটাই ওর কপাল ।
মানুষ তার নিজের জীবনকে কতটা ভালোবাসে তা রায়হানকে দেখলে বোঝা যায় । আজ সকালেও আমাকে বললো, পাশের বেডের সালাম মিয়ার মা মাদ্রাজের কোথায় নাকি কোন পীর আছে সেই সন্ধান দিয়েছে । সেই পীর চোখের নিমেষে ব্লাড ক্যান্সারও সারিয়ে দেয় । আমি তাকে ছাগল বলে গালি দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি । প্রতি দুই দিনে একদিন সে নিত্য নতুন টোটকা নিয়ে হাজির হয় । শিয়ালের লেজের দিকের গোস্ত থেকে শুরু করে শিবপুরের টিলা বাড়ির মাযারের মাটি - সব পরখ করা হয়ে গেছে ।
আমি জানিনা কেন একেকটা দিন এমন হয় । চমকে স্থির, চমকে অস্থির - মানুষের মনের ভাবগতিকের রকম সকম ভেবে ভেবে দিশা পাইনা । আজ থেকে বছর তিনেক আগে ঠিক এই দিনে এমন এক ভরা ফাল্গুনের দুপুরে আমার বাবা তলিয়ে গেছে পদ্মার অতল জলে । ঠিক কতোটা গভীর জলে বাবার এখন বসবাস তা জানি না । আমার বাবা, আমার আদরের বাবা, নদীর ধারে কোথাও পড়ে থাকা লাশ তার শকুনে খেয়েছে না কুকুরে খেয়েছে তা জানিনা । মাঝে মাঝে ভাবি এতে কি কিছু যায় আসে ?
আমার বাবার সাথে একই ট্রলারে ছিলো রায়হানের বাবা । মন্তাজপুরের বাজার থেকে তারা দুজন যখন একসাথে ফিরছিলো, তখন আমি বাসায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম রবীন্দ্রনাথ আর রায়হান দুবাইয়ের কোনো এক রেস্তোরায় খাবার পরিবেশন করছিলো জনৈক শেখের বেটাকে । দুদিন পরে রায়হানের বাবার লাশ খুজে পেয়েছি ধানুশার চরে ।
হাতের আঙুলে জ্বলজ্বল করছিলো নীল পাথরের আংটি । আমার বাবাকে খুজে পাইনি । একুশ দিন একটানা খুজেছি দিন রাত । পদ্মার খোলা চরে রাতের পর রাত কেটেছে আমার আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে । শোঁ শোঁ হাওয়ার মাঝে মিশে থাকা বাবার খোকা ডাক শুনতে পেতাম । মাকে বলেছিলাম বাবাকে না নিয়ে ফিরবো না । বাইশতম দিনে রায়হান এসে আমাকে নিয়ে গেল বাড়িতে । দেশে চলে এসেছে ও । আর ফিরে যাবে না । বউ বাচ্চা, বুড়ো মাকে আর অবিবাহিত বোন তিনজনকে দেখাশুনার জন্য বাড়িতে একজন পুরুষ মানুষ থাকা চাই ।
টাকা পয়সা সে ভালোই এনেছিল মরুর দেশ থেকে । নতুন ঘর উঠালো । গঞ্জে হুসেন মার্কেটে দোকান দিল কাপড়ের । ভুলতার হাট থেকে পাইকারি দরে মাল নিয়ে এসে গঞ্জে বিক্রি করত সে । লাভ ও ভালই হচ্ছিলো । গঞ্জে আরও দুটি দোকান কিনে ভাড়া দিয়ে দিলো ভালো দরে । সেনপাড়ার রহমতের ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলো মরিয়মের । মরিয়ম বোনদের মধ্যে বড় । সবাই বলতে লাগলো মরিয়মের বড় কপাল । রহমতের ভাই আব্দুস সালামের জমির ব্যবসার কাঁচা টাকা । সুখে থাকবে মেয়েটি । রায়হান ও বোনকে ঠকাবে না । দরাজ দিল রায়হানের ।
চৈত্রের কোন এক সাঁঝে যখন হাট ভাঙ্গা ব্যাপারিরা ফিরছিলো তখন তারা রায়হানকে সেবা সংঘের সামনে পড়ে থাকতে দেখে বাড়িতে দিয়ে গেল । রক্তবমি করেছিলো সে । গঞ্জের ডাক্তার তাকে শহরে ডাক্তার দেখাতে বললো । কিছু টেস্ট করার পরে ক্যান্সারের কথা বললো ডাক্তার । আমায় বললো রুগীকে দ্রুত ভর্তি করিয়ে দিতে ।
সেদিন বিকালে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ভেবে পাচ্ছিলাম না ওকে কিভাবে কথাটা জানাবো । সেদিন বাড়ি আসার পথে যখন ওকে কথাটা জানালাম, ও শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো । তারপর বললো , "তোর কি মনে হয় আমি মারা যাবো এতো সহজে ? এতো সহজ না " । আমি এলোমেলো কথা বলে ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম । ও নির্বিকার হয়ে রইলো । আমরা বাড়ি ফিরে এলাম ।
পরদিন সকালে ও ময়লা কালো একটি ব্যাগে কিছু জামা কাপড় নিয়ে আমার বাড়িতে এসে আমায় ডেকে বললো, " চল, আমারে হাসপাতালে ভর্তি করায়ে দিয়ে আসবি । ভালো চিকিৎসায় সব রোগই ভালো হয়" ।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ভালো লাগলো । ওর চোখে একটু ও ভয় নেই । মনে হচ্ছিলো আজ হয়তো ও কোন বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হতে যাবে ।
শহরের নামকরা হাসপাতালে ভর্তি করালাম ওকে । প্রচুর ব্যয়বহুল বলে আমি এখানে ওকে ভর্তি করাতে নিমরাজি ছিলাম কিন্তু ওর ধমকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম । ও বললো, "টাকা নিয়ে তুই ভাবিস কেনো? টাকা কি তোর যাবে নাকি আমার ? কবরে কি টাকা লাগবে রে বলদ ?" ।
প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ডাক্তার ওর অপারেশন করালো । অপারেশনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেলো । ও আমাকে ডেকে বললো, "গঞ্জের দোকানটা বেচে দে । " বেচে দিলাম । ও কে বাড়ি নিয়ে আসলাম । আসার সময় আমাকে বললো, "কিরে বেটা বলেছিলাম না ? এতো সহজ না ! " আমি বললাম, তাই তো ।
তবে ব্যাপারটা এতো সহজ না হলেও তেমন কঠিনও ছিলো না । মাসখানিকের মধ্যে ওর শরীর আরো খারাপ হলো । যন্ত্রণায় ছটফট করতো । হাসপাতালে নিয়ে গেলাম । ডাক্তার আরো খারাপ সংবাদ শুনালেন। ওর ভিতরের ক্যান্সারের দাঁনা ছড়িয়ে গেছে চারপাশে । ডাক্তার জবাব দিয়ে দিলেন । ও আমায় ডেকে বললো, "বাংলাদেশের চিকিৎসা ভালো না । তুই আমায় ভারতে নিয়া চল । দোকান টা বেচে দে । আর বাড়ির সামনের জায়গাটা বেচে দে । মরে গেলে জায়গা জমি দিয়ে কি করবো ?" আমি বললাম, "মরিয়মের, শামিমা আর জয়গুনের বিয়ে দিবি কিভাবে ? আর তোর বউ ছেলেমেয়ের জন্য ও তো কিছুই থাকবে না ।"
ও বললো, "মরে গেলে বিয়ে দিবো কিভাবে, এইটা বুঝস না বলদা ? হায়াৎ মউত রিজিক সব আল্লাহ্র হাতে । আল্লাহ্ ভরসা ।" আমিও আল্লাহ্ ভরসা বলে বিক্রি করে দিলাম দোকান আর জমি শরীফ মিয়ার কাছে । দালালের হাত ধরে বর্ডার পার হয়ে পৌঁছে গেলাম কলকাতা । আমি, রায়হান আর মরিয়ম । সেখানের ডাক্তার আমাদেরকে আশা দিলেন । রায়হান বললো, "কিরে বলেছিলাম না?" আমি তাইতো বলে ওর কথায় সায় দিলাম । আরেকটা অপারেশনের প্রায় মাসখানেক পরে ওর শরীরে পঁচন ধরে গেল । মাঝে মাঝেই ওর পাশে বসে মাংস পঁচা গন্ধ পেতাম । মরিয়ম সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো । প্রায় প্রতিদিন ই রায়হান আমাকে আর মরিয়মকে বলতো, "শরীরটা আজকে আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে রে । মনে হচ্ছে ফুটবল খেলে আসি গড়ের মাঠ থেকে । হা হা হা । " আমি মলিন মুখে ওর কথায় সায় দিলাম । শেষে একদিন ডাক্তার রাধানাথ বাবু আমায় ডেকে বললেন, "আজাদ সাহেব, ওনাকে দেশে নিয়ে যান । শেষ কটা দিন পরিবারের সাথে কাটালে ওনার ভালো লাগবে । " আমি ঘাড় নেড়ে চলে আসলাম । মরিয়মকে জানালে মরিয়ম ওকে বললো, "দাদাভাই, দেশে চলো । তোমার শরীরটা তো এখন ভালোই মনে হচ্ছে । বাকি যেটুকু, তা না হয় দেশেই সারিয়ে নেবে ।"
আমরা চলে এলাম । ও বুঝতে পেরেছিলো আমরা ওকে সত্য বলি নি । একদিন হঠাৎ কিছু না বলে একটা চিঠি রেখে চলে গেলো কাউকে কিছু না জানিয়ে ।
প্রিয় আজাদ,
কাপড়ের দোকানটা বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে গেলাম শহরে । তোরা তো আমার চিকিৎসা করাবি না । আমার চিকিৎসা আমাকেই করাতে হবে । আমাদের বাড়ির দিকে খেয়াল রাখিস ।
রায়হান ।
চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে মলিন চোখে আমার দিকে তাকালো রেবেকা, রায়হানের বউ। আমায় বললো, "তিনটি ননদ, দুটি ছেলেমেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো বলতে পারেন ? ফসলি জমি গেছে, গঞ্জের দোকান গেছে । আমাদের দিন চলবে কিভাবে বলতে পারেন ? ঘরের চুলা কিভাবে জ্বলছে তা তো শুধু আমি জানি।" আমি তাইতো তাইতো বলে সায় দিয়ে চলে এলাম বাড়িতে । সেদিন সারারাত জেগে ছিলাম । আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে হল । কিভাবে আমরা বড় হয়ে গেলাম এতো সহজে, ঝরা পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে সময়।
দুদিন পরে আরেকটা চিঠি আসলো আমার ঠিকানায়। একটি হাসপাতালের ঠিকানা দেয়া সেখানে। আমায় বললো চলে আসতে গোপনে। ভালো সংবাদ আছে। আমি সেদিনই রওয়ানা দিয়ে চলে এলাম শহরে। ওর সাথে দেখা হলো । ওর শরীর আরো খারাপ হয়েছে । শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে গেছে এই সাত দিনেই । হাসিমুখে বললাম, "কিরে, এখন কেমন লাগছে?"
"ভালো লাগছে রে । এখানকার ডাক্তার টা ভালো । দেখেই মনে হলো, উনি পারবেন । তাই ভর্তি হয়ে গেলাম । ডাক্তার বলেছে আমি এতো তাড়াতাড়ি মরবো না । কিসব যন্ত্রপাতি দিয়ে আমাকে রেডিওথেরাপি দিতাছে । তোরে বলছিলাম না? "
নার্স ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ও আমাকে কাছে যেতে বললো । আমাকে ওর বাড়ির দলিল দেখিয়ে বললো, "এটা নিয়ে এসেছি । বিক্রি করে দেব । যতদিন বাঁচা যায় বাঁচবো । আমি মরবো না, মরবো কেনো ? জীবনে অনেক কষ্ট করেছি ভালোভাবে বাঁচার জন্য । এখন টাকার অভাবে মারা যাব নাকি ? আমার জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত আমি বাঁচতে চাই, যতটুকু সম্ভব । আমি মরবো না । আমায় বা্ঁচা আজাদ । " ঢুকরে কে্ঁদে উঠলো ও । আমার বুকটা হু হু করে উঠলো । আমার বন্ধু, আমার ভাই, তোর কি বাঁচার আকুলতা । হে আল্লাহ্, আর কি কোনো উপায় নেই ।
হাসপাতালের ছাদে উঠে একটা সিগারেট ধরালাম । সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । একঝাক কবুতর কিছুক্ষণ আকাশে ঘুরে ঘুরে নেমে এল সাদা বাড়িটার ছাদে । চোখ ঝাপঁসা হয়ে আসছে । নিচে নেমে ওকে বললাম, চল একটা সিগারেট খাওয়াই তোকে । ওর চোখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠলো ।
রেলিংয়ের উপর বসে বসে আমরা সিগারেট টানলাম। ও পুরোটা সিগারেট টেনেছিলো । শেষে আকাশের সদ্য উঠা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো, "জীবন কি সুন্দর !" আমি আর দেরী করলাম না । একটা ছোট্ট ধাক্কা দিলাম ওকে । মনে হলো ক্ষনিকের জন্য ও অবিশ্বাস ভরা চোখে আমার দিকে তাকালো । পরক্ষনেই কি দেখলাম, একটু হাসলো কি ও ? অবুঝ সন্তানের দিকে তাকিয়ে মা যেমন হাসি দেয়, তেমন কিছু ?
©somewhere in net ltd.