![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হাওয়ায় ভাসা ভাবনাগুলো লেখা-বলা হয়ে উঠে না। যতটুকু ধরা দেয়া, তা কেবলি আবছা অন্ধকারের মতো...
ইট-পাথরের দেয়ালে বন্দি। বেশ গুমোট গরম আর এলোমেলো ভাবনাগুলো অস্তিরতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। চারতলা ভবনের নিচ তলায় থাকে সোনালীর বড় আপুসহ চার জন। সবাই শিক্ষার্থী। অবশ্যই সবাইকে শিক্ষার্থী বলা কিছুটা ভুলও হবে, আবার সঠিক হবে।
সোনালীর বড় আপু প্রায় বছরখানের হলো জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাকোত্তোর শেষ করেছে। তবে চাকুরীর জন্যে কিছুটা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না থাকলেও চাকুরী জন্যে পড়াশোনা তো করছেই। সোনালী এখনো অধ্যায়নরত। অন্যদের অবস্থা একই। ঢাকার আজিমপুরে লাল-সাদা রংয়ের দালানে থাকে।
ইদানিং শহরটাকে বেশ জঞ্জালময় মনে হচ্ছে। আগের মতো মায়া আর চঞ্চলতা ছুঁয়ে যায় না। শুধু কালচে পড়া মোবিলের গন্ধ আর বারুদের শব্দে আচমকিয়ে উঠে। আকাশে সন্ধ্যার তারা জেগে উঠতেই কেমন জানি নিঃশব্দতা গ্রাস করে পুরো শহরকে। নিঃসঙ্গ আর একা একা রাত পাহারা দিতে হয়। শূন্যতা আর পাওয়ার বেদনায় কাতরাতে থাকে পাখিরাও।
মায়াপরী। ডাক নাম না। তবে ইমরুল আবির নামে কেউ একজন এই নামে তাকে ডাকে। যদিও পুরো নাম সামিনা শরীফ বিভু। সোনালীর বড় আপু সে। সাত বছর আগ থেকে ঢাকাতে থাকে। থাকে মানে থাকতে হয়। অর্নাসে ভর্তির পর থেকে আর গ্রামের বাড়ী নারকেলবাড়ি থাকা হয়নি। এই ধর্মীয় উৎসব আর বড় কোন ছুটি ছাড়া গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া হয়ে উঠেনি। মায়াপরীর ছোট ভাই আমান আর সোনালীর জন্যে প্রচন্ড ভালোবাসা। অন্য বোনেরও প্রচুর ভালোবাসা আর আদর পেয়েছে। বাবা-মা আর আমান গ্রামে থাকে। অনেক দিন তাদের সাথে দেখা হয় না। মনের ভিতর শুকনো বেদন ক্রমেই ভারী হতে থাকে। কিন্তু কি ই-বা করবে। এখন তাকে কিছু করতে হবে। চাকুরির জন্যে বিভিন্ন জায়গাতে ধরনাও দিচ্ছে। কিন্তু এখনো পাচ্ছে না। বেশ অসহ্য যন্ত্রণায় কাটছে। দিনের আলোতে এদিকে-সেদিকে একটু আধটু ঘোরাফেরা আর চাকুরীর জন্যে দৌড়া-দৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আগে এমনটি হয়নি। সকাল নয়টার মধ্যে ক্লাসের জন্যে রাস্তায় নেমে যাওয়া। বিকেল চারটার ফিরে আসা। আবার বের হওয়া সন্ধ্যা এমনকি রাতে বাসায় ফেরা। কিন্তু কোথায় তখন তো এতো ক্লান্ত আসেনি। মাথাও ঝিমঝিম করেনি। চোখের কোনায় ক্লান্তির ভাজ এটে যায়নি। তা হলে কি মায়াপরীর শক্তি কমে আসছে ? না কি মনোবল কমতে শুরু করেছে। রাতের আঁধার গাঢ় হলেই ঘুম চলে যায় তার। ঘুম আসে না। ছটফট করে পুরো শরীর। যন্ত্রণায় পেশিগুলো থরথর করে কাপে। এরকম কেন? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। আবার উত্তরটা সহজেই চোখের সামনে ভেসে উঠে। এই উত্তর পাওয়া, না পাওয়ার বেড়জালে বড়ই অস্তিরতা পেয়ে বসে মায়াপরীর। কিছুতেই সেখান থেকে বের হতে পারে না।
দশ বছর তাকে এরকম করেছে। যখন গ্রাম বাড়ীর আঙ্গিনার পাশে চালতা গাছ আর তার ফুল দিয়ে খেলনায় মেতে উঠতো, তখন কি সুখেই ছিল মায়াপরী। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে অনেকগুলো চালতা ফুল ফুটেছে। বাহারী ফুল। দেখতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। যেই ভাবনা, সেই কাজ। বড় একটি বাঁশের সহায়তায় গাছে উঠে ফুলগুলো ছিড়ে নিয়ে আসে। মালা তৈরি করে। চুলের খোপায় ভরে রাখে। দৌড় দিয়ে পুকুর পাড়ে যায়। সেখানেও হিজল ফুলের সমারোহ। একগাদা ফুল তুলে বসে বসে মালা তৈরি। খাওয়া-গোসলের সময় নেই। শুধুই মালা তৈরি আর সেগুলো চুলে বেঁধে রাখা। কতই সুখ ছিল মায়াপরীর। পুরো গ্রামে কালো মায়াবি চোখ আর আদর ভরা মুখখানি নিয়ে ঘুড়ে বেড়াত। চোখের পলকেই সবার নজর কাড়তো।
সেই গ্রাম এখনো গ্রামই আছে। শুধু নেই মায়াপরী। সাদা বাতি আর ফ্যানের শব্দে যাদুর শহরের বন্দি থাকতে হচ্ছে। রাতের আলোতে চারিদিক যখন ব্যস্ত, তখন মায়াপরীর রাজ্যে নামে শূন্যতা। বিভোর করে স্মৃতির কাতরায়। দুঃখবোধ আর কষ্ট চাপিয়ে দেয় বহুগুন। এমনটি অন্যদের ক্ষেত্রে খুব একটা হয় না। কিন্তু মায়াপরীর হচ্ছে। এক একটি রাত তার জীবনকে বড়ই ক্লান্ত করে তুলছে। এরকম তো নাও হতে পারতো। অন্য দশটা মেয়ের মতো একটি সুন্দর ছেলে দেখে ঝুলে পড়তে। কিন্তু সে পারছে না। কেন ? কেন সে আবার দশ বছর আগের বিভু হতে পারছে না। কেন চালতা ফুল দিয়ে মালা তৈরি করতে পারছে না। এরকম শত শত কেন তার জীবনকে আরো বেশি হাফিয়ে তুলছে।
একটি চাকুরী তার খুবই প্রয়োজন। সোনালী আমান বাবা-মার জন্যে ওর ভীষণ দরদ। তাদের একটু সুখের জন্যে তার যত ভাবনা। কিন্তু চাকুর পেলেই কি মায়াপরীর দুঃখবোধ কমে আসবে? সহজ দৃষ্টি হয় তো মনে হবে, হ্যা মিটে যাবে। সবাই এমনটি মনে করে। তবে মায়াপরির রাজ্যে সেই চালতা ফুল তাড়িয়ে বেড়ায়। স্মৃতির দোলচালে বেদনায় কাতরাতে থাকে। খুঁজে পায় না কোন-ই সমাধান।
©somewhere in net ltd.