![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হাওয়ায় ভাসা ভাবনাগুলো লেখা-বলা হয়ে উঠে না। যতটুকু ধরা দেয়া, তা কেবলি আবছা অন্ধকারের মতো...
মিশরের আন্নানার লেখায় প্রাচীনতম আখ্যানের আবছা ছায়ার খোঁজ মেলে। খ্রিস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে আন্নানার আখ্যানে ছোটগল্পের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। আরব্য রজনীর হাজার এক রাত্রির গল্পতো এখনো মানুষের মুখে মুখে। এরপরে পৃথিবীর চার প্রান্তে চারজন সমমনস্ক আধুনিক মানুষ গি দ্যা মোপাসা, এডগার এ্যালান পো, আন্তন চেকভ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে জীবনের খণ্ডচিত্রগুলো ছোটগল্পরূপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।
বাংলা ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে জন্মলাভ করে। সেই ছোটগল্প সময়ের পরিক্রমায় তার উপস্থাপন ও ভাষা ভঙ্গিও ব্যাপক বাঁক বদল ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে জন্ম নেয়া এই বাংলা ছোটগল্পের বিকাশ আরো অনেক গল্পকারের হাতেই পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। বাংলা ছোটগল্প যাদের হাতে বিকশিত হয়েছে জগদীশ গুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বনফুল, আল মাহমুদ, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আহমেদ, শহীদুল জহির, সৈয়দ শামসুল হক, কায়েস আহমেদ, জাকির তালুকদার হয়ে বর্তমান সময়ে তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন রিপনচন্দ্র মল্লিক।
বাংলা সাহিত্যের এই সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিকের গল্পগ্রন্থ ‘কাঠপরানের দ্রোহ’। এই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প পাঠের এক অনন্য সংযোজন। এই গ্রন্থের গল্পে-আমাদের মাটিতে প্রোথিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আনন্দ-বেদনা-দ্রোহের বোধ নিবিড় মমতায় আঁকছেন তরুণ গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিক। অন্তরে অনুরণিত নানা মাত্রিক অনুভবগুলি সরল বাক্য বিন্যাসে রূপ নেয় তার গল্পে। গল্পকে এগিয়ে নেবার সহজাত ক্ষমতা এ লেখকের বেশ প্রবল। এ কারণেই গল্পের চরিত্ররা প্রাণ পায় এবং একই সাথে কোনো গল্পের যাত্রায় চলমান হাহাকার পাঠককে নিমজ্জিত করে নীল বেদনায়। অতঃপর বুকের ভেতর গুমরে ফিরে একরাশ মায়াবি দীর্ঘশ্বাস। যেন প্রতিটি গল্পের সময়কাল ও চরিত্রগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন পাঠ শেষে প্রতিটি গল্পই প্রত্যেক পাঠককে যেন মনে করিয়ে দেয় এক একটি উপন্যাসের স্বাদ। এ যেন বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসভিত্তিক ছোটগল্পের এক অনন্য উপস্থাপনা।
একবিংশ শতকে মুক্তিযুদ্ধের পুনর্নির্মাণ ও রিপনচন্দ্র মল্লিকের গল্প মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে চার দশক। এই চার দশকে প্রজন্মের যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি পরিবর্তন এসেছে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার, চিন্তার এবং রাজনীতির। এবং অবধারিত ভাবে এসব রসদের উপর ভিত্তি করে রচিত সাহিত্যের ধারাও বদলে গেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যে সব সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার বৈশিষ্ট্য একবিংশ শতকের কোন গল্পকারের মধ্যে বজায় থাকবে না, তাই স্বাভাবিক। কারণ যারা মুক্তিযুদ্ধকে স্বচক্ষে দেখেছেন, তাদের বর্ণনাধর্মী গল্প নতুন প্রজন্মের কোন গল্পকারের স্থানে এসে পরিবর্তিত হবে ভিন্নরূপে। গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিকের বর্ণনায় এসেছে একাত্তরের উত্তরাধিকার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন না করে মুক্তিযুদ্ধের চলমান চিন্তাধারা নিয়ে নতুন প্রজন্ম ভাববে। ফলে এই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের গল্প হবে মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করে রচিত। রিপনচন্দ্র মল্লিকের ‘কাঠপরানের দ্রোহ’ গল্পগ্রন্থে তারই সফল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই।
বিজ্ঞানও বলে ক্রস বিবাহ বা অন্তঃবিবাহ বংশবৃদ্ধির জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানের কথা বাদই না হয় দিলাম, সাহিত্য নিয়ে যেহেতু কথা বলছি সেহেতু সম্পর্কের জটিলতা, জীবনের গতিধারা, আর মন নিয়েই ভাবতে হবে।
সমকালীন সময়ে চলে আসছে অন্তঃবিবাহের ধারা। এই বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় উন্নত না হয়ে বিপরীত পরিণতিতো ঘটতে পারে। ‘কাঠপরানের দ্রোহ’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘জ্যোৎস্নার ঘরে কান্নার স্বর’ গল্পের মিলির বাবা-মায়ের সংসারে ঘটেছে এমনটি। এটিই তো আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্তঃবিবাহ বা সমগোত্রীয় বা ক্রস বিবাহের ফল। বিবাহের এমন ব্যবস্থা সব সময় সুফল নিয়ে আসবে এমন নয়। তাই মিলির মা চরিত্রটি এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার শিকার যে, তিনি মেয়ে মিলিকে একদিন বলেন, ‘তোর বাবাকে তো আমি বিয়ে করতে চাইনি। তোর বাবা আমার ১৮ বছরের বড়। তোর নানা আর দাদাই তো আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।’ প্রত্যেকটি অভিশপ্ত প্রথার ভ্রমের দেওয়াল ভাঙার অস্ত্র লেখকের কলম আর বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এই গল্পে মা’কে শেষ পর্যন্ত অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিক। যা গল্পটি পাঠেই পরিচয় পাওয়া যায়।
আবার এসময়ের পরতে পরতে নষ্ট রাজনীতির মায়ায় যখন সমস্ত বাতাস কলুষিত, তখন সে সকল নষ্ট আচঁড় গ্রামীণ জীবনেও পঁচন তৈরী করছে। আর সুস্পষ্টতই এ লেখকের অবস্থান সেই কলুষতাময় আচার-উপাচারের বিপক্ষে। এই গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘কাঠপরানের দ্রোহ’। গ্রন্থটির নামগল্প। গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিক তার এ গল্পটিও শব্দ গাঁথুনিতে এক ভিন্ন জগতে নিয়ে গেছেন পাঠককে। গল্পে সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সমসাময়িক বাস্তবতার নিরিখে তার এ গল্পের প্লট রচিত হয়েছে। শুধু শব্দের গাঁথুনিই নয়, ঘটনার বাস্তবতা গল্পে চরিত্রগুলোকে আরো বেগবান ও মূর্ত করে তুলেছে। গল্পের মধ্যে লেখক পাঠককে কখন যে এক চরম সত্য সন্ধানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তা পাঠক হয়তো টেরই পাননি। এমন করে নয়, বলতে হবে যে গল্প বলার সুকৌশলী রিপনচন্দ্র মল্লিক পাঠককে বুঝে ওঠার আগেই নিয়ে গেছেন তার মূল গল্পের জমিনে। গল্পটি এন্টি বাংলাদেশবাদী চেতনার সহিংস আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক দ্রোহের উচ্চারণ। গল্পকার রিপনচন্দ্র মল্লিক ‘কাঠপরানের দ্রোহ’ গল্পে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
গ্রন্থের ‘সুখনগরে’ গল্পটি বেশ বড় গল্প। প্রায় দুই ফর্মার আয়তনের এই গল্পটি পড়লে যে কারো মনে হবে এটি একটি সার্থক উপন্যাসই হয়ে উঠেছে। পরিশেষে বলতে হয়, গল্পলেখক রিপনচন্দ্র মল্লিকের ‘কাঠপরানের দ্রোহ’ গ্রন্থের শহর জুড়ে বিষাদের বৃষ্টি, মা টাকি এবং একটি ঢোড়া সাপের গল্প, নীলজমিন, ফসলের ফলসহ ১১ টি গল্পই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজিক জীবনের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি ও চরিত্রের আখ্যানের মধ্য দিয়ে মূলত যাপিত সময়ের রেখাচিত্রই তুলে ধরেছেন।
গল্পগুলো ছোটগল্প হলেও প্রতিটি গল্পই পাঠ শেষে মনে হয় যেন একটি উপন্যাস পড়লাম। তবে তার গল্প তৈরীর একটি অন্যতম উপাদান মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের ইতিহাস ও ইতিবৃত্ত নির্মাণ।
সুতরাং সচেতনভাবেই বলা যায়, রিপনচন্দ্র মল্লিক মানবতার মাটিতে জীবন ঘনিষ্ঠ একজন কথাশিল্পী। বইটি পড়ে যেকোনো আগ্রহী পাঠক উপরোক্ত আলোচনার সাথে মত ও দ্বিমত পোষণ করতে পারবেন।
সূত্র: কাঠপরানের দ্রোহ : রিপনচন্দ্র মল্লিক।
লেখক: সাংবাদিক ও কবি।
©somewhere in net ltd.