নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্তহীন অপেক্ষা.।.।.।.।.।

সজীব রায়

সজীব রায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবি শামসুর রাহমানের মা.........

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:৪৯

মা’র চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চদ্বীপ ভাসে?
চোখে বেনে বউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি
শঙ্কিত আভাসে আঁকা-ভাবি
রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে
এখনো কি স্বপ্ন বোনে ঊন’নাভ চাঁদ
নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরী ফাঁদ।

একটি কিশোরীর কথা বলছি। বয়স বার কি তের হবে। পায়ে মল, কোমরে বিছা, নাকে নোলক, না হোক সোনা কিংবা রূপার, সেগুলো অলংকার তো বটে। বাংলাদেশের কিশোরীরা এখনো এসব পরে, এক্কা দোক্কা খেলে, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কানামাছি, ধুলোর চাল, ইটের মাংস, কাঁঠাল পাতার টাকা, বাঁশপাতার চুড়ি, সোনালী ফুলের হলুদে নোলক, শাপলা ফুলের মালা, কোমরের বিছা ইত্যাদি বানিয়ে কিশোরীরা পরে। আনন্দেই দিন কাটতে থাকে তাদের। কিন্তু এ আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ঘটক এসে সব এলোমেলো করে দেয়। কিশোরীর ছোট্ট মন কিছুতেই যেতে চায় না অচেনা পরিবেশে। তবু যেতে হয়। বাঁধা পড়ে সে। কানামাছি, এক্কা দোক্কা, বাঁশপাতার চুড়ি, পুকুরে শাপলা তোলা হয় না তার। যথেষ্ট বয়সের ব্যবধানে স্বামীর সাথে দূরত্ব থেকেই যায়। কিশোরী বধূ একা হয়ে যায়। এভাবেই সময় গড়ায়। একদিনের চঞ্চল কিশোরী জননী হয়। সংসারের যাবতীয় কাজ, সন্তানদের দেখা শোনা, স্বামীর সেবা সব করতেই সময় ফুরিয়ে যায়। পরিপাটি চুল বেঁধে, মুখে ক্রীম কিংবা পাউডার মেখে কোথাও বেড়াতে যাওয়া তাদের হয় না। পিকনিক কিংবা স্বামীর সাথে শপিং এমনকি ছোটবেলার বান্ধবীর সাথে দেখা করা, কোন কিছুই হয় না তাদের।

রাজধানীর দশ বর্গমাইল বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ষোলআনা গ্রাম (এর পরেই ধান ক্ষেত, খাল, সবুজ বৃক্ষরাজি দেখা যায়)। এই দেশের অধিকাংশ অভিভাবকের মন ও সমাজ প্রকৃতি এখনো পাল্টায়নি। কিশোর বয়সে মেয়ে বিয়ে দে’য়া এখনো পবিত্র কাজ হিসেবে বিবেচ্য। অথচ সংসারী হবার আগে জীবনের রস, সমাজ, প্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন জরুরি।

বিশ্ব সাহিত্যে মায়ের উপস্থিতি উজ্জ্বল এবং সুদৃঢ় পার্ল ‘এস বাক ও ম্যাক্সিম গোর্কীয় ‘মা’ উৎকৃষ্ট প্রমাণ। শামসুর রাহমানের চয়নকৃত শব্দের কম্পোজ ‘মা বিষয়ক কবিতাগুলোও উল্লেখের আকাঙক্ষা ও প্রচণ্ডতা রাখে। শামসুর রাহমান যখন একজন মায়ের কথা বলেন তখন তা একের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, লক্ষ মায়ের কবিতা হয়ে উঠে। তিনি দুঃখ বিলাসী কবি নন, ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসেন না’। তাঁর ‘আমার মাকে’ কবিতাটি খুব প্রাঞ্জল এবং অকৃত্রিম। কবিতার লাইন থেকে কষ্ট বেদনা গলে গলে পড়ে। এটা সত্যি, আমাদের দেশের মায়েরা কষ্ট সহিষ্ণু। তাদের আনন্দ আহ্লাদ থাকতে নেই, ঘর সংসার করতেই সমস্ত জীবন যৌবন বিলিয়ে দেয়াটাই যেন নিয়ম, ব্যাপারটা যেন এরকমঃ বাবার বাড়ির কুয়া থেকে শ্বশুর বাড়ির কুয়ায় যেন তাকে ফেলে দেয়া।

নম্র নদী বয়ে যায় আপন গতিতে, সামনে চর পড়লে বেঁকে এগিয়ে যায় শান্ত স্নিগ্ধ, কিন্তু ভিতরে কিছুটা রুক্ষও বটে, তেমনি সকাল থেকে ঘুমাতে যাবার আগে পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় মাকে। যেন অন্য কিছুতে তার মোটেও আগ্রহ নেই। শামসুর রাহমানের কবিতাটি শুরু এভাবে ঃ

মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে
ছায়াবৃতা আপন সংসারে।

এর পরের লাইনগুলো কবি রচনা করেছেন প্রবল সেন্টিমেন্টকে কেন্দ্র করে। মা মাতৃভূমির তুল্য, এই সেন্টিমেন্ট, তবে উপস্থাপন ভিন্ন, স্বকীয় ভঙ্গিমায়, লাইনগুলো এরকম ঃ...। তাকে চিনে
নিতে পারি সহজেই যখন নিভৃত অনুভবে বারবার
একটি ভাস্বর নদী, ফুলের বাগান, মাঠ আর
শস্যক্ষেত, দূরের পাহাড়
গলে গিয়ে একই স্রোতে বয়ে যায়, সীমা
মুছে যায় চরাচরে ঃ স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা
অনন্য উপমা তার।
ভূভাগের সমস্ত উপমা উল্লেখ করার পরও কবি লোভ সামলাতে পারলেন না। সরাসরি এবং অতিরিক্ত আবেগে লিখে ফেললেন ‘স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা অনন্য উপমা তার। ‘দরকার ছিল না এই বাক্যের। এখানে ঋণাত্মক ও ধনাত্মক দুটো দিকই এসে যায়। তবে যেহেতু মায়ের প্রতি কবি অনুরক্ত ও মোলায়েম সে কারণে মাকে সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে অতিরিক্তকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন নি। তবে স্বদেশের চেহারাও এই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। কবিতার পরের লাইনগুলো এরকম ঃ
... কে যেন চকিতে চেনা স্বরে
বলে শুনি, পাল্কি চ’ড়ে, বেনারসী পরে
যেদিন এলেন তিনি আমাদের ঘরে
চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধরে-
তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে,
সোনার কলসে আর সাঁঝ নানা দিঘির গহনে।
শুধু কবি কেন, যে কোন মানুষ দুপুরে সূর্য দেখে পেছনে ফিরে তাকাতে পারেন, এটা বাস্তবিক কিন্তু কবির বেলায় একটু এগিয়ে যাওয়াটাও বাস্তবিক, তিনি চলতিকে টেনে ফ্লাশব্যাকে এভাবেই মায়ের দৃষ্টিকে নিজের মধ্যে টান মেরে নিজেই দেখতে থাকেন অতীত। জনান্তিকে বলে রাখি, কে যেন চকিতে চেনা স্বরে বলে শুনি’- এই কথা পাশ থেকে অন্য কেউ বলতে পারে, তবে কবি নিজেও তা ভেবে নিতে পারেন অন্যের উপর ভর করে, এটাও আমরা ধরে নিতে পারি।
কবি জন্ম নেবার পর থেকেই মাকে দেখেছেন। এই দেখায় পূর্ণতা পায় না কবির তৃতীয় নয়ন। দ্বিধান্বিত দৃষ্টি কেঁপে কেঁপে উঠে। শৈশবের কোন স্মৃতি মা’র মনে আছে? ক্রৌঞ্চ দ্বীপ, যেখানে শৈশব ছুটোছুটি করে, সেই দৃশ্য কি এখনো মা’র চোখে ভাসে? ছেলেবেলার সঙ্গী সাথী? যাদের সাথে বহু বছর ধরে দেখা নেই, কবি মাকে প্রথম থেকে দেখছেন সংসারের ঘানি টানতে। উনুনের ধোঁয়ায় রান্না আর কান্না মা’র জীবনের প্রধান বিষয়। এই মা একদিন স্বপ্ন দেখেছেন, রান্না আর কান্নার মাঝে এখনো কি স্বপ্ন বুনেন? নাকি সবই ভেলকিবাজি? কোন এক ইহুদী মহিলা বলেছিলেন, স্বপ্নই যদি দেখতে হয়, তবে এমন স্বপ্ন দেখবো যা কখনো বাস্তবায়িত হবে না। মা কি সেই মহিলার কথা জানেন? কবি মগ্ন থাকেন, মায়ের স্বপ্ন কতদূর বাস্তবায়িত হবে এবং ভাবেন তার শৈশব কৈশোর
মা’র চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চদ্বীপ ভাসে?
চোখে বেনে বউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি
শঙ্কিত আভাসে আঁকা-ভাবি
রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে
এখনো কি স্বপ্ন বোনে ঊন’নাভ চাঁদ
নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরী ফাঁদ।

স্বামীর হাত ধরে মা যেদিন ঘরে এসেছেন সেদিন, ছেড়ে আসা পিতামাতা আত্মীয় স্বজনের জন্য মন কেঁদেছিল, নতুন যে জীবন শুরু হলো তা মাথা পেতে নিলেন। পরবর্তী সমস্ত জীবন সুখময়, সুন্দর ও নকশী কাঁথার মত শিল্পীত হোক, স্বামী সন্তান নিয়ে সংগতিপূর্ণ কেটে যাক প্রহর, এই স্বপ্ন, এই বাসনার ঊন’নাভ চাঁদ তিনি বুকে এঁকেছেন। সে কারণেই তিনি নিজের সমস্ত শখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে রোদে পুড়েছেন, জলে ভিজেছেন। কবি বলেছেন ঃ

চেয়েছে বুকের সূক্ষ্ম সোনালী সুতোয় চিরদিন
সমস্ত জীবন হোক নকশীকাঁথা ঃ সে ইচ্ছার ঋণ
শুধে দিতে বুঝি হতে হয়
গাছের মতই রৌদ্র জলে মৃন্ময়, তন্ময়।

গাছ প্রচণ্ড রোদে ছায়া দেয়, আবার বিক্ষুব্ধ ঝড়ে সহ্য করে সমস্ত প্রতিকূলতা কবি মাকে তেমনভাবে উপমিত করেছেন। বাংলাদেশের লক্ষ মা সংসারের টানা-পোড়নে জর্জরিত, স্বামী সন্তানকে খাইয়ে নিজে লবণমাখা ভাতের ফেন খেয়েছেন, এখনো খাচ্ছেন, কখনো সেটুকুও জোটে না এবং সংসারের সমস্ত কষ্ট তিনি একাই ধারণ করেন। আমাদের মায়েরা নিশ্চুপ উদ্ভিদ। এত কিছুর পরও মা পাখিদের মত গভীর মমতায় সন্তানদের খাবার তুলে দেন। প্রচণ্ড গরমে তালের পাখা হাতে রাখেন।

মাকে দেখি। আজো দেখি কি এক মমতায়
পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায়
দু’বেলা আবেগ ভরে দেখি তসরী গুণে
সন্ধ্যার মিনারে
সত্তার কিনারে
ঐ দুরায়নী আজানের ধ্বনি শুনে
আর সুবে-সাদেকের তীব্র শুভ্রতার নির্মেঘ আনন্দে শোকে
আজীবন সমর্পিতা কোরানের শ্লোকে।

এবং নিজের জন্য নয়, সন্তান ও স্বামীর কল্যাণ, সচ্ছলতার আবেদন করেন নিয়মিত আল্লাহর কাছে। কিন্তু মায়ের চির বিশ্বাস, আল্লাহ মুখ ফিরে তাকান না মোটেও। সংসারে স্বর্গ সুখ নেমে আসে না। অতিরিক্ত কষ্টসহিষ্ণু মাকে দেখে কবি কখনো কখনো অবাক হন, এতদিন কাছে আছেন অথচ মাকে কবির অচেনা মনে হয়, কি ধৈর্যশীল এবং রহস্যময় এই মহিলা, কোন প্রতিবাদ নেই, বিরক্তি নেই। ব্যপ্ত জীবনে কবি মাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখে আসছেন, এত কাছে থেকেও কবির মনে সংশয় জাগে ঃ

আমি কি সঠিক জানি ভদ্রমহিলাকে
আমি যার একান্ত বিস্তার অন্তরে শুভ্রলোকে-
চিনি তাকে?

এই কথায় কবিতার সমস্ত জমিনজুড়ে বাংলাদেশের লক্ষ মায়ের বেদনার্ত ধ্বনিচিত্র আঁকা হয়ে যায়। তবে এই কবিতাটি একটি মায়ের পূর্ণ আকাঙক্ষাকে ধরতে সমর্থ হয়নি। আমার জানা মতে কবি শামসুর রাহমান পাঁচটি মা বিষয়ক কবিতা লিখেছেন এবং এই পাঁচটি কবিতার অন্যান্য অনুষঙ্গ জোড়া দিলে মা চরিত্রের প্রিজমচ্ছটা ফুটে উঠবে।

এই কবিতার শেষে ‘এনভয়’ এর মত দু’টো লাইন জুড়ে দিয়েছেন কবি। যার ব্যপ্তি দু’লাইনকে ছাড়িয়ে গেছে বহুদূর। গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে লাইন দু’টো। মা তার সন্তানকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। প্রাপ্ত বয়স্ক এই সন্তানের চলাফেরা, গাম্ভীর্য, বায়নাহীন ও ভারী কথাবার্তা শুনে মাও মাঝে মাঝে সংশয়ে লোলেন ঃ

আমার অস্তিত্ব পটে ঃ ‘কে এই অচেনা ভদ্রলোক......
লিখেছেনঃ রাজা সহিদুল আসলাম...দৈনিক আজাদী পত্রিকা তে......

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.