![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“ আরেকটা যুদ্ধ চাই ”
( অন্ধকার কর্দমাক্ত কাঁচা মাটির রাস্তা।)
সূর্য অন্ধকার কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে এক পা একপা করে হাঁটছে। কাঁদার চপ-চপ শব্দ হচ্ছে। সূর্যের এক হাতে জুতা এক হাতে ব্যাগ।
আমু সাদা ফতুয়া সাদা লুঙ্গি পরা, হাতে বিদেশী রিচার্জেবল টর্চ লাইট। লুঙ্গি হাটুর উপরে কাছা দেওয়া।
আমু : কে..যায় ?
আমু কাঁদামাটির মধ্যে তেরছা করে টর্চের আলো ফেলে। এতে সূর্যের হাঁটু পর্যন্ত পা দেখা যায়। আর আলোতে কাঁদা চিক চিক করতে থাকে।
( আসেপাসে বর্ষার ব্যঙ্গ ডাকার আওয়াজ শোনা যায়।)
সূর্য : জ্বি ভাই আমি।
( সুর্য কোনরকমে জবাব দিয়ে নিজেকে কাত হয়ে পরে যাওয়া থেকে সামলে নেয়।)
( আমু তাৎক্ষনিক ভাবে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস কওে )
আমু : আমি কেডা-নাম নাই ?
( আমু টর্চ লাইটের লম্বা আলোটা একটু ঝাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে।)
সূর্য : আমি সূর্য। আমাকে আপনি চিনবেন না।
( আমু টর্চলাইটের আলোটা ধীরে ধীরে সূর্যের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিয়ে আসে। সূর্য হাতের জুতো দিয়ে আলো ঠেকাতে চেষ্টা করে।)
আমু : শহর থেইকা আসছেন মনে হইতাছে।
( সূর্য হেসে জবাবা দেয়। )
সূর্য : ঠিকই ধরেছেন-বাগবাড়ি যাবো, বাগবাড়ি যাবার রাস্তা এটানা ?
আমু : হ ,রাস্ততো ঠিকই আছে কিন্তু ঘটনা পিরস্থিতি কিছুই ঠিক নাই। যাইবেন কেমনে ?
সূর্য : রাস্তা যেহেতু ঠিক আছে তাহইলে অবশ্যই যাইতে পারুম।
( সূর্য এই বলে অনেক কষ্টে একটা পা টেনে উঠিয়ে আরেক পা সামনে ফেলে।)
( আমু টর্চ নিভিয়ে দেয়। এমন সময একটা শেয়াল ডেকে উঠে। )
আমু: বাগবাড়ি কাগো বাড়িতে যাইবেন ?
সূর্য : মাঝি বাড়ি।
আমু : ছলু মাঝি আপনের কি হয় ?
সূর্য : দাদা। দাদাতো গত বছড় ১১৪ বয়েসে মারা গেলোনা।
আমু : হ-হ, অনেক হায়াত পাইছিলো। আশে পাশে দশ গেরামে হের লগের কেউ ছিলোনা..৭০-বছড় বয়সে মুক্তি যুদ্ধ করছে।
সূর্য : হু, পাকিস্তান পিরোডে আর্মিতে ছিলেন দাদা। কিন্তু এক পাগলির পাল্লায় পইরা নাকি চাকরি ছাইরা দিছিলেন। একটু গোয়ার কিছিমের মানুষ ছিলেন মনে হয়।
আমু : তুমি কার পোলা ? শহীদের না রশিদের ?
সূর্য : শহীদের বড়ো ছেলে।
আমু : ও আইচ্ছা, আইচ্ছা চিনছি। পরিচয় দিলোতে চিনি। হোনো আমার বাড়ি ঐ যে তাল গাছের নিচে মাচাটা দেখতাছো ঐটা। তুমি ইচ্ছা করলে রাইতটা আমাগো বাড়িতে থাইকা কাইলকা দিনে বেলা যাইতে পারো। আমি নৌকা দিয়া তোমারে মাঝি বাড়ির খালপারে নামাইয়া দিয়ে আহুম নে।
সূর্য : নৌকা দিয়ে যাওয়া যায় !
আমু : নতুন জোয়ারের পানি আইছেতো, ছোট কোষা নৌকা দিয়া যাওন যায়। আমি গড়িব মানুষ তেমন কিছু খাওয়াইতে পারুম না। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।
সূর্য : আসলে এই প্রথম নিজে নিজে নিজের গ্রামের বাড়ি আসলাম তো কেমন কেমন যেন লাগতেছে।
আমু : নিজের গ্রামের বাড়ি আইতে হয় বাবা। এইটা হইলো শিকড়। শিকড়ের টান অবহেলা বা অস্বীকার করলে চলেনা বাবা। আহো এই পাস দিয়া আহো জুতাগুলান আমার হাতে দেও।
সূর্য : নানা আপনি বরং ব্যাগটা ধরলে ভালো হয়।
( ঠিক এই সময় ঝিঁ-ঁিঝ পোকার একটা তিব্র আওয়াজ শোনা যায় )
দৃশ্য-
সূর্য খুবভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পাসের কাঁচা রাস্তাটার পাসে এসে দাঁড়ায়। কাঁচা রাস্তার নিচে ঢালু একটা মাটির সিঁিড় নিচের দিকে নেমে গেছে। নতুন জোয়ারের পানি আর জাগায় জাগায় কাশবন দেখে সুর্য লোভ সামলাতে পারেনি। সে খুব সাবধানে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে আসে ।
ফুরফুরে সকালের ঠান্ডা হাওয়া এসে সূযের কানের পর্দায় দাপাদাপি আরম্ভ করে দিলো। সে অবাক বিস্ময়ে কাশফুল এর দোল খাওয়া দেখতে থাকে। দূরে কাশবনের সাদা আস্তরন দেখতে থাকে। আকাশে ভোরের পাখিদের কিচির মিচির করে দূরে চলে যাওয়া দেখে। ছোট ছোট ঢেউ এর মত নতুন জোয়ারের পানিতে পূবের সূর্যের আলো চিকচিক করতে দেখে-
এমন সময় হঠাৎ কে যেন সূর্যের কানে সুরসুরি দেয়। সূর্য পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে একটা কিশোরি মেয়ে আকাশি রং এর স্কুল ড্রেস পরা অবস্থায় একটা কাশ ফুলের ডগা ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কথা : আপনে কি কানে কম শোনেন ? রাস্তা থাইকা কয়টা ডাক দিছি আপনে শোনেন নাই ? বাপজান আপনেরে ডাকে।
সূর্য : ও। বাতাসের প্রবাহে শব্দ অন্য দিকে চলে গেছে হয়তো, শুনতে পাই নাই।
( মেয়েটি তার দক্ষ পায়ে খুব তাড়াতারি রাস্তা বেয়ে বাড়িতে ঢুকে যায়। সূর্য রাস্তায় উঠে আবারো সেই দূর প্রকৃতির দিকে ফিরে তাকায়। )
আমু : বাবা আজকে থাকো আমাদের সাথে। কালকে যাইয়ো, আমি নিয়া দিয়া আসুম নে..
সূর্য : না না কাকা। আজকেই যাবো। আপনার নাকি নৌকা আছে ? নতুন বর্ষার পানি ভালোই লাগবে চলেন।
আমু : নেও নাস্তা খাও। শহরের মানুষ ! কি দিয়া জানি নাস্তা খাও, আমার মা মরা মাইয়া কোনদিন সকালে খায় আবার কোনদিন আমার সাথে রাগ কইরা না খাইয়াই স্কুলে দৌড় দেয়। কথা একটা হাসের ডিম পোছ কইরা নিয়ায়।
কথা : দেরি হইবো আব্বা, চুলা নিবভা গেছে। একটু পরে খাইতে কও।
( আমু একটা ডিম ভাজি আর একটা প্রিজে কিছু চিনি আর বড় বড় সাদা রুটি সূর্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে)
আমু : নেও বাবা এগুলা দিয়া শুরু করো।
সূর্য : এতো সকালে তাড়াহুড়া করার কি দরকার ছিলো।
আমু : এই জন্যইতো কইলাম বাবা আইজকা থাইক্কা যাও
সূর্য : আরেক দিন আইসা থাকুম নে। আপনিও আমার সাথে খান।
আমু : আমি সকাল বেলা র্কিছু খাইতে পারিনা। মাঝে মাঝে একটুকরা পান ছিড়া মুখে দেই, দুপুরে আবার এক ভোল বাত না হইলে পেট বরেনা। ছোট বেলার অভ্যাস। গেরামের পোলাপাইন গেরামে বড় হইছিতো।
সূর্য : আপনিও নেন আমার সাথে খান নাইলে আমি কিন্তু খামুনা।
( সূর্য গ্রামের ভাষায় কথা বললেও শহরের যে আন্তরিক মাধুর্য আছে সেটা সে ঠিকই ধরে রেখে কথা গুলো বলে।)
আমু : আইচ্ছা তুমি যখন বলতাছো তখন নিতাছি, এই-এই নিলাম খাও খাও।
আমু : যুদ্ধের সময় এইহান দিয়া কতো লাস যে ভাইসা আইছে গেছে হিসাব ছারা। ভয়ের কিছু নাই নৌকা ডুববোনা। আরাম কনরা বহো। আর এহেনে পানি অল্প। সাঁতার জানো নি বাবা ?
সূর্য : আমার নাম সূর্য।
( একটু থেমে )
ছোট বেলা একবার আমি সাঁতার র্শিখতে গিয়ে মরতে গেছিলাম
(একটু থেমে)
: চাচা আপনি যুদ্ধ করছেন ?
( আমু লগি দিয়ে জোড়ে একটা ঠেলা মেরে বসে পরে।)
আমু : না। সত্যি কথা দোষের কিছুনা। আমার বয়স তখন -২০-২১ হইবো। পুরা জোয়ান তাগড়া পোলা। রক্ত টসবগ টসবগ করে এমন অবস্থা। কিন্তু..
সূর্য : এই গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারীরা হানা দিতোনা ?
আমু : কি কয় ! পাক সেনারা হানা দিতো না আবার ! বড়ি ঘড় সব জ্বালাইয়া ছাঁই কইরা ফালাইছিলো। আমরা প্রায় সময় কঢ়ুরিপানার মইধ্যে নাক ভাষাইয়া ডুইব্বা থাকতাম-আর আল্লা আল্লা করতাম। মরনের ডর যে কি জিনিস বাবা !
সূর্য : মুক্তি যোদ্ধারা কহনোই মৃত্যুকে ভয় পাইতোনা।
আমু : এইডা ঠিক কারন হেরা জানতো এমনেও মরন হেমনেও মরন তাইলে যুদ্ধ কনরাই মরি।
সূর্য : হু, মারো নয়তো মরো।
আমু : ঐ যে মাঝি বাড়ি। যুদ্ধের সময় তোমাগো মাঝি বাড়িইতো দুইবার আগুন দিয়া পোরাইলো।
( সূর্য পানিতে হাত ডুবিয়ে একটা ফুটন্ত শাপলা ফুল টেনে তুলে বলে )
সূর্য : তাই ?
আমু : যুদ্ধের পর আকালের বছড় তোমার দাদা ছলু মাঝি আসে পাসের দশ গেরামের মাইনসের লাইগা বহুত কিছু করছে-বহুত কিছু।
সূর্য : এই এলাকায় রাজাকার আছিলোনা ?
( আমু লগি মারতে গিয়ে পিছলে যায়। তাচ্ছিল্লের সুরে হেসে বলে )
আমু : এইডা কোন কতা কইলা বাবা। মির্জাফরের দেশে দালাল আলবদর চোর রাজাকার না থাইক্বা পারে ! রাজাকার ভরা আছিলো। সারারাইত ওরা শিয়ালের মতো গেরামছে গেরাম চুইষা বেরাইতো। দেশটা স্বাধীন হইয়া কি লাভ হইলো বলো ? কোন লাভ অয় নাই- একটুও লাভ অয় নাই, আরো লছ্--লছ্ ।
( নৌকা এসে মাঝিবাড়ির কোণায় ঠেকে। আমু লগি মেরে নৌকা ঠেলে ধরে রাখে। সূর্য ১০০ টাকার একটা নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলে )
সূর্য: চাচাজান কিছু মনে করবেন না আমি আপনের পোলার মতোই। এইটা রাখেন মেয়েটা কষ্ট করে ডিম ভেজে খাওয়াইছে ওরে একজোড়া চুড়ি কিনে দিয়েন। আর এই ৫০ টাকা দিয়ে আপনি চা খাবেন, খালি পেটে পান খাবেন না কিন্তু।
( সহজ সরল আমু বোকার মতো ঘাড় কাত করে মাথা নেড়ে দাঁত বের করে বোকার মতো হাসতে চেষ্টা করে। সূর্য চোখের আড়াল হলে আমু কোষা নৌকা ঘুড়িয়ে গান ধরে..মাঝি বাইয়া যাওরে অকূল দরিয়ার মাঝে তোমার ভাঙ্গা নাও রে মাঝি )
সুর্য বর্ষিতে আটা দিয়ে পানিতে ফেলে। সূর্যের জ্যেঠা খালি গায়ে পুকুরের অপর প্রান্ত ধরে ঘুড়ে এদিকে আসতে থাকে। হাতে একটা দা আর একটা নারিকেলের লম্বা ডাল মাটি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিয়ে আসে।
( এমন সময় একটা কাঠ ঠোকরা ঠক ঠক করে শব্দ করে উঠে।)
রশিদ জ্যেঠা : বাপ ধন তোমার জ্যেঠি তোমার লাইগা ক্ষুদের ভাত রানছে, খাইয়া আইসো।
সূর্য : নারিকেলের ডাইল দিয়া কি করবেন জ্যেঠা ?
রশিদ জ্যেঠা : গত মাসে তোমার বাপে গাড়ি নিয়া আইছিলো। তহন পুস্কুনিতে জ্বাল ফালাইছিলাম। কিছু তেলাপিয়া মাগুর আর সৈল মাছ দিয়া দিছিলাম, খাইছিলা ?
সূর্য : সৈল মাছের ভর্তা আদা দিয়া আম্মা বানাইছিলো, খাইয়া খুবই মজা পাইছিলাম।
রশিদ জ্যেঠা : মাছ ধরছো একটাও ?
( এমন সময় সূর্য একটা পুঁটি মাছ উঠায়। সূর্যের জ্যেঠাকে পাস কাটিয়ে বেটে খাটো আরেকটি লোক এই পথ ধরেই আসতে থাকে। সূর্যের জ্যেঠার সাথে একটু দাাঁড়িয়েই সূর্যের বরাবর এসে দাঁড়ায়। লোকটি পাঞ্জাবী টুপি পরা, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি।)
বেটে লোকটি : কেডাগো তুমি ?
সূর্য : আমি শহীদ মাঝির ছেলে ।
বেটেলোক : নাম কি ?
সূর্য : সূর্য।
বেটে লোক : আমারে চিনো ?
( সূর্য ফ্যেল ফ্যেল করে ছিপ পাতে তাকিয়ে থাকে )
বেটেলোক : চিনবা কেমনে ? চিনার কথাওনা আমি তোমারে ছোডো দেখছি। এহনতো মাসাল্লা বাপের মতো বেডা হইয়া গেছো। আমি তোমার ফুপা হই। তোমাগো বাসা ঢাকা উত্তরা না ?
( সূর্য মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় )
বেটে লোক : তোমার আব্বা আম্মায় কেমুন আছে-বালো আছে নি ?
সূর্য : জ্বী-আল্লার রহমতে ভালোই
বেটে লোক : একলাই আইছো বাবাজি ?
সূর্য : জ্বি ফুপা এই প্রথম।
বেটেলোক : পূর্বপুরুষের বিটা মাটি অমূল্য সম্পদ। তোমার আব্বারতো পেরাই আহে। এলাকার মস্জিদ এর কাজে গত বছর পেরায় ২০০ বস্তা ছিমেন্ট হেয় একলাই দিছে। কিছু ইটা লাগবো বলছে আবার আইলে দিবো।
সূর্য : ও আচ্ছা।
( এমন সময় দূরের মস্জিদে আজান পরে। শুনে বেটে লোকটি ঘড়ির টাইম দেখে বলে)
মোয়াজ্জেম ফুপা : আজান দেওনের সময় অইয়া গেছে। আমি এই মসইজদে ৩০ বছড় যাবৎ মুয়াজ্জিন। মসজিদে আইসো নামাজ পড়তে।
সূর্য : জ্বি ফুপা আসুম নে
মোয়াজ্জেম ফুপা : আজান দেওনের সময় যাইতাছে গা গেলাম বাবাজি।
স্থান : বাড়ির উঠান
কাল : সন্ধ্যা বেলা।
( সূর্য পাটি বিছিয়ে বাড়ির উঠানে বসে আছে। তিন-চারটা ছেলে মেয়ে একজন আরেকজনকে ধরাধরি খেলছে আর চিৎকার-চ্যেচামেচি করছে। বড়ির ভেতর থেকে সুর্যের জ্যেঠাতো ভাই বৌ কথা ধমকে উঠে।)
কথা : এই তোরা পড়তে বসছনা ? সারাদিন হৈ-চৈ চিল্লাচিল্লি। এই নীলা তোরা যার যার ঘড়ে যা।
( একটা দুইটা জোনাকী পোকা টিপটিপ করে উঠনে জ্বলতে দেখা যায়)
সূর্যের জ্যেঠাতো ভাই মতির বৌ এক হাতে একটা কুপি আর হাত পাখা নিয়ে এসে তাড়াহুরা করে সুর্যের হাতে দিয়ে বলে-
মতির বৌ কথা : আম-কাঁঠাল পাকনের গড়ম পরছে ! বৃষ্টি হইছে তার পরেও গড়ম কমেনা, গড়ম আরো বারছে।
সূর্য : রাত্রে কি খাওয়াইবেন ভাবি ?
কথা : আফনের ভাইয়েরে গরুর মাংষ আনতে বলছিলাম। হেই কোন বেলা গেছে এখনো আসলোনা। আসলে কহন পাকামু আল্লাই জানে..!
( সুর্য হেসে বলে )
সূর্য : আমি সব কিছু খাইতে পারি ভাবি। গরুর মাংষতো সব সময়ই খাই, ভর্তা ভাজিটাজি হইলে ভালো হয়। এই যেমন ধরেন লাল মড়িচের ভর্তা, চাষনি অথবা ধনিয়াপাতার ভর্তা, চুকা পাতার ভর্তা।
কথা ভাবি : আইচ্ছা। ডাটা শাক ভাজি, চান্দা শুটকি ভর্তা আর আপনের পুঁটি মাছ ডেউয়া দিয়া টক ঝোল পাক কইরা রাখছি, আফনের ভাই এর অপেক্ষা করতেছি..।
( এই বলে মতির বৌ তাড়াহুরা করে কুপি নিয়ে চলে যায়। এমন সময় মতি হুন্ডা নিয়ে ভট ভট করতে করতে উঠানে এসে ঢোকে। পিচ্চি বাচ্চাগুলো দৌড়ে হুন্ডার আলোর সামনে দাঁড়িয়ে লাফালাফি করতে থাকে-মতি বিরক্ত হয়ে ধমক দিলে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালিয়ে যায়।)
সূর্য : মতি ভাই আসছেন ?
মতি : হরে ভাই। গরুর মাংষ আনতে চাইছিলাম, পাইলামনা। ইলিশ মাছ নিয়া আসলাম। ঢাকতো সব কিছু পাওয়া যায়। গ্রামে সপ্তায় ২-দিন হাট বসে। হাটের দিন সব পাওয়া যায়।
সূর্য : বাজারে আপনের কিসের দোকান ভাই ?
মতি : লাইব্রেরী আর ফোন এর। নীলার মা কই ধরো, গরুর মাংষ হাটবার ছাড়া পাওয়া যাইবোনা। আমাগো এহেনে তো আর ফিরিজ নাই যে রাইখ্যা রাইখ্যা খাইতে পারুম।
( মতি বাজারের ব্যেগটা বৌ এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাটিতে বসতে বসতে বলে- )
মতি : দাদা-দাদির কবর দেখছিলা ?
সূর্য : হ, ভাই দেখলাম। একসাথে খুব সুন্দর কইরা বাঁধাইছে দেখলাম।
মতি : হ-তোমার আব্বায় মানে শহীদ কাকায়ই সব টেকা পয়সা খড়চ কইরা বান্দাইছে। আগাছাগুলি সময় কইরা পরিষ্কার করন দরকার। সময় করতে পারতাছিনা। সারাদিন দোকান নিয়া ব্যস্ত থাকতে হয় আবার ভিলেজ পলিটিক্র না করলেও চলেনা।
সূর্য : আমাদের এহেনে এহনো বিদ্যুৎ আসলোনা কেন ভাইজান ?
মতি : আর কইয়োনা ভাই।
( মতি একটা দির্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে।)
মতি : আমি একলা আর কতো করমু কও। তোমারা দু একজন গেরামে থাকতা তাইলে আমগো উপরে ছড়ি ঘুরানের কেউ থাকতোনা। সব যার যার চিন্তায় টাউনে পইরা থাকে কারে কি কমু কও। গেলো বছড় শহীদ কাকায় সরকারি লোকজন দিয়া ম্যেপটেপ করাইয়া নিলো। আমি খাটাখাটনি করলাম পয়সা দিলাম কিন্তু আসল কামের কাম কিছুই হইলোনা। মুখের কতায় কি আর চিড়া ভিজে..সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠে ?
( একটু থেমে )
হেই যুদ্ধের পর থাইকা শুনতাছি কারেন্ট দিবো কারেন্ট দিব্ োকই, কোন খাবড় নাই। এই দল গেলে ঐ দলেরে দোষে ঐ দল আইলে এই দলেরে দোষে। এমনেই দেশটা রশাতলে যাইতেছে। কারো প্রতি কারোর কোন সিম্পেথি নাই। পাটা পুতায় ঘষাঘষি মড়িচের জান শেষ।
সূর্য : আমাগো ছলু দাদায়তো মুক্তি যুদ্ধকরছিলো তাইনা মতি ভাই ?
( মতি গলার সাউন্ড বারিয়ে সুর করে বলে )
মতি : হ। পাকিস্তান আমলে যা ছিলো এহনো তাই। তহনো অর্থ সম্পদ ব্যাংক শিল্প কারখানা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলো, পূর্ব পাকিস্তান ছিলো এই সবের যোগান দাতা আর এহনো দেশ স্বাধীন হওনের পর জনগন একই কষ্ট করতাছে। হেগো ভাগ্য উন্নয়নের কোন উন্নয়নের সম্ভবনাও দেহিনা। পুরা দেশটারে একটা জ্বেলখানার কয়েদখানার মতো বানাইয়া ফেলাইছে। ৬৯% কৃষক যেই দেশে দিন রাইত খাইট্টা মরতাছে তাদের কথা কউনের কোন লোক আইজ পর্যন্ত সংসদ পর্যন্ত যাইতে পারলোনা। কি একটা অবস্থা !
সূর্য : আমাদের গ্রামের চ্যেয়ারমেন কে ?
মতি : চ্যেয়ারম্যেন মেম্বার দিয়া কি অইবো ? এরাতো সব সুবিধাবাদী। বর্তমান চ্যেয়ার মেন আমাগো মাঝি বংষেরই। আমাগো ভাই হয়। আর মেম্বার নামে..আস্ত একটা চাটুকারী। যার মাথায় তেল আছে তার মাথায় তেল দিবার ছোটে। নিজের বিচার বুদ্ধি বলে কিছু নাই।
সূর্য : আপনিওতো নির্বাচন করতে পারেন।
মতি : কইগো আমাগো কিছু নাস্তা পানি দেও, খালি মুখে বইসা থাকলে ভালো লাগে ?
মতির বৌ : আনতাছি-বহেন আর একটু।
মতি : আমারে কয়েকজন এই কথাটা বলছে, এই যে তুমি এহন যেই কথাডা বললা। চিন্তার বিষয় ! ভালো কিছু করতে গেলে গুলি খাইয়া করতে হইবো। এই চিন্তাডা মাথায় রাখতে হয় বোঝলা ? ভিলেজ পলিটিক্র ভালোর ভালো আবার খারাপের হদ্দ।
( মতির বৌ শরবত আর ফুল পিঠা নিয়ে আসে।)
মতি : নেও-নেও। ফুল পিঠা খাওতো নাকি ?
একটু শক্ত কিন্তু এইটা সব দেশেই চলে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বলা চলে। তা তুমি কয়েক দিন থকবাতো নাকি চইলা যাবা ?
সূর্য : আসলে ভাই গেরামে থাকা উচিৎ। কিন্তু..যাই হোক, আছি কিছুদিন। থাকি। দেখি কেমন লাগে।
মতি : হ, থাকো। নিজের ইচ্ছায় না থাকলে কেউ জোর কনরা রাখতে পারবোনা। একটু কষ্ট হইবো। তবে যে কয়দিনই বেরাইবা খোলা আকাশ মুক্ত বাতাস আর প্রকৃতির গুনে জীবনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠবো দেখবা। যে পক্ষি নিজের ইচ্ছায় আসে তারে কি বাইন্দা রাখন যায়, যায় না।
স্থান: মস্জিদ
কাল :
সূর্য মস্জিদে এসে বসে থাকে। সামনে রাখা নামাজের সময় সূচি দেখে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাচ্ছে অথচ ওর কথিত ফোপা মোয়জ্জিন সাহেবের আজান দেবার কোন খবড় নেই। আসেপাসের মস্জিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। সূর্য মাইক্রোফোন অন করে আজান দেওয়া শুরু করে দেয়। আজান শেষ এমন সময় মোয়াজ্জিম ফোপা তাড়াহুরা করে কোত্থেকে এসে মাইক্রোফোন ষ্টার্ট দিতে যায়, সূর্য পাস থেকে বলে উঠে
সূর্য : ফুপা আজান হয়ে গেছে।
( মোয়াজ্জিন ফোপা তার অভ্যাসজনিত হাসি মাখা মুখে চমকে উঠার ভান করে বলে )
মুয়াজ্জিন ফুপা : আজান হয়ে গেছে ? কে দিছে আজান ?
সূর্য : আমি। ১৫-মিনিট লেট, এজন্য অপেক্ষা করতে-করতে আমিই দিয়ে দিলাম।
মোয়জ্জেম ফুপা : ভালো করছো বাবা-ভালো করছো। তোমাগো মস্জিদ তোমরা আজান দিবানাতো কে দিবো, বালো হইছে। আমি একটু ঐ পাড়ায় গেছিলাম-রাস্তায় প্যেক এইল্লাইগা ঘুইরা আইতে দেরি হইছে। বহো আমি জানালাগুলান খুইল্লা আহি।
সুর্য : আচ্ছা।
( ইতমধ্যে মুসল্লিরা একে একে আসা শুরু করেছে। সূর্য এক ফাকে উঠে এক কোণায় এসে বসে। এক সময় হুজুর নামাজের জন্য কাতার সোজা করতে বলে। মোয়াজ্জেম ফোপা এসে সূর্যের একটা হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দেয় )
মোয়জ্জেম ফুপা : কই তুমি বাবা, তোমারে খুঁজতাছি। সামনের কাতারে দাঁড়াইবা, পিছনে গেছো কেন ?
( এর পর উচ্চ স্বরে সবাইকে শুনিয়ে বলে উঠে )
মোয়াজ্জেম: এই হইতেছে শহীদ ভাইছাপের পোলা। শহড় থাইকা আইছে। তুমি আমার পাসে দাঁড়াইবা। তোমারাতো সব সময় আহোনা-তোমাগোওতো একটা সন্মান আছে, অবদান আছে তাইনা।
সূর্য : না-না ফুপা কি যে বলেন। এক জায়গায় দাঁড়ালেই হইলো; একই কথা।
মোয়াজ্জেম ফুপা : একামত দেন একজনে। আমার পাসে দাঁড়াও।
সূর্য : আচ্ছা দাঁড়ান।
( নামাজ আদায় শেষ হলে কয়েকজন এসে সূর্যের সাথে হাত বারিয়ে মুছাফা করে পরিচিত হয়ে নেয়। শেষে ইমাম সাহেব পরিচিত হয়ে বলেন-)
ইমাম : আমি এখানে আছি ১০-বছড়। আর আপনের ফুপাতো অনেক বছড় প্রায় ২৭-২৮ বছড় তাইনা রব ভাই।
মোয়াজ্জেম ফুপা : হ..তাতো হইবোই। বসেননা হুজুর, কই যান ?
ইমাম : বাবা আপনে বসেন। আফনের বাবা শহীদ সাহেব খুব-খুব-খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। সারা বছরই উনি আমাদের হেল্প করেন। এছাাড়াও ওনি আসলে গেরামে যেই মানুষ ওনারে দেখতে আসে চ্যেয়ারমেন মেম্বর আসলেও এতা মানুষ হইতে দেহিনা। ওনার কথা আর হাসির কারনে সবাই ওনারে পছন্দ করে বালোবাসে। টেকা পয়সাতো বাবা কম বেশি সবারই থাহে কিন্তু মনটা হইলো আসল। মানুষ মন দেইখা মানুষের কাছে ভীরে, পয়সা দেইখ্যা না।
সূর্য : হুজুর কি কোথাও যাবেন নাকি ?
হুজুর : হ, বাবা ছ্ট্টো একটু কাজ আছিলো, না করলেই না, মনে কিছু নিওনা বাবা।
সুর্য : না না কিযে বলেন বুজুর্গ। কাজ থাকতেই পারে। কাজের কোন বিকল্প নাই।
ইমাম : আসি বাবা হ্যা-আসছালামুইলাইকুম। আল্লাা চাহেতো আবার দেখা হইবো। আছেন না বাবাজি ?
সুর্য : অ্যা..হ্যা, আছি। সমস্যা নাই।
( মোয়াজ্জেম ফুপা পাঁচ-ছয়জন যুবক ছেলে পেলে নিয়ে সূর্যকে ঘিরে বসে )
মোয়াজ্জেম ফুপা : এরা হইতাছে এই গেরামেরই সন্তান। কেউ কলেজে পরে কেউ মাদ্রাসায় আবার কেউ বেকার।
সূর্য : ও আচ্ছা।
( সূর্য সবার সাথে মুছাফা করে নামগুলো জেনে নেয়।)
প্রথম যুবক হীমেল : এর আগে আপনারে দেখি নাই।
দ্বিতীয় যুবক : আপনের ফাদার শহীদ কাকারে ছোটবেলা থেইকা চিনি।
তৃতীয় কিশোর : এই মস্জিদে অনেক টেকা দিছে হেয়।
সূর্য : আসলে আব্বা যে এত ঘন-ঘন গ্রামে আসে এইটা আমি জানতাম কিন্তু কেন আসেন, কি করেন কিছুই জানতাম না। আসার পর অনেক কিছুই জনতে পারলাম।
চতুর্থ যুবক : আফনের চেহারার সাথে আফনের বাপের চেহারার অনেক মিল আছে।
( সূর্য এবং মোয়াজ্জেম ফুপা একসাথে হেসে উঠে।)
মোয়াজ্জেম ফুপা : মিল থকবোনা। বাপ কা বেটা। মাঝি বাড়ির সবারই দেখবা নাক তীরের মত খাড়া-চোক্কা।
( সূর্য তার একটা হাত ফোপার লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরা উরুতে রেখে বলে )
সূর্য : ফোপা চলেন সবাইকে নিয়ে চা খাই। এদিকে টোন দোকান আছেনা ? আসলে এতগুলো ভায়ের সাথে পরিচিত হয়ে আমার খুব আনন্দ লাগতাছে। খুব ভালো লাগতাছে।
( একটু থেমে)
: শহড়ে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। যে যার মত চলে। কারো জন্য কোন মায়া মহব্বত টান নাই। এক মা আর সন্তানের মধ্যে ছোট বেলা কিছুডা দেখা যায়।
( একটু থেমে)
: গ্রামের মানুষগুলো খোলা মনের আর সরল প্রকৃতির বলেই আজও গ্রাম গ্রাম আর শহড় শহড়। যেখানে মানুষের মাথা মানুষে খায়। ধর্মে যে জিনিসটা আছে যে ভ্রাত্বিত্ববোধ; এই জিনিসটা আপন সহোদোর ভায়ের মইধ্যেই খুইজ্জা পাওন যায়না আর পরতো পরই। পাসের ঘড়ে পাসের ফ্লাটে কে অসুস্থ কে মরাগেলো তার কোন খবড় থাকেনা। বাপ ছেলের সাথে, স্বামী স্ত্রীর সাথে মাসের পর মাস কথা বন্ধ থাকে কথা হয়না।
তৃতীয় কিশোর : গেরামের ভাষা বুঝতে বা কতা কইতে কষ্ট হয়না আপনের ?
সুর্য হেসে বলে:-
সুর্য : একটু হয়। শহড়ে জন্ম। শহড়ে বড় হয়েছি। আঞ্চলিক টান তো সবখানেই আছে। তবে আমি মোটামুটি গেরামের ভাষা কইতে পারি এবং গেরামের মানুষের সাথে সহজে মেশার জন্য আমার মনে হয় এইটাই সবচে সহজ পদ্ধতি, তাইনা।
( সবাই একসাথে হেসে ফেলে জবাব দেয় হ, হ।)
সূর্য : তবে কিছু কিছু শব্দ বুঝতে কষ্ট হয়। শুনলেও বুঝিনা, কারণ আসলে পূর্ব পরিচিত না তবে আনুষঙ্গিক দিক বিচার করে বের করে ফেলতে পারি যেমন ঃ- ততী মানে হাঁস, আতাইল মানে ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে যে চিকন মাটির রাস্তার মত থাকে, এরকম।
( ওরা সবাই এক অপরের দিকে চোখাচোখি করে একটু বিরবির করে কি যেন বলে মুচকি হেসে নেয়। সূর্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একহাতে বেটে খাটো মোয়জ্জেম সাহেব কে টেনে তুলে বলে)
সূর্য : ফুপাজান চলেন সন্ধ্যা হয়ে যাইতেছে একটু দোকানটা চিনে আসি..।
( সবাই একসাথে উঠে মাথা থেকে টুপি খুলে ছেন্ডেল পায় দিয়ে ডানপাসের গাছগাছালি রাস্তা ধরে গ্রামের ভেতরের দিকে চায়ের টোন দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে দেয়।)
----------------------------------------
স্থান :বাজারের রমজানের চায়ের দেকান
মতি হুন্ডা থেকে নেমে দুইকাপ আদা চায়ের অর্ডার দেয়।
মতি : এই রমজান। দুইকাপ স্পেশাল আদা চা দে-মেহমান আছে।
রমজান : মেহমান কেডা ?
মতি : পরে কইতাছি-আগে চা দে বেটা !
রমজান : চ্যেতেন কেন ? দিতাছিতো।
( দোকানের বেঞ্চে আরো ৪-৫ জন ভদ্রলোক বসে গল্প করছিলেন। )
মতি : আরে মাষ্টার সাব, স্লামালাইকুম। কেমন আছেন আপনি ?
মাষ্টার সাহেব ঃ আরে মতি মাঝি যে-আমিতো খেয়ালই করি নাই। কেমন আছো তুমি ?
মতি : আপনেদের দোয়ায় ভালোই। স্যার আপনি ভালো আছেন স্যার ?
প্রফেসার : জ্বি বাবাজি ভালো। তোমার না লাইব্রেরী আছে ?
মতি : জ্বি জ্বি স্যার।
প্রফেসার : কেমন চলে লাইব্রেরী ?
মতি : কোন রকম স্যার। নিজেই শহড় থাইকা বই পুস্তক আনি আরকি। গেরামের স্কুল ছাত্র-ছাত্রিদের মুখের দিকে তাকাইলে আর বেশি লাভা করতে পারিনা স্যার। চিন্তা করি তবু ওরা শিক্ষিত হয়ে উঠক। বেরে উঠুক। গ্রামের মান সন্মান বারাক..স্যার শনেছি আপনি নাকি রিটায়েড করেছেন ?
প্রফেসার : হু, আর কতো বাবা ? বয়সতো কম হইলোনা। এহন যে কয়দিন বাঁচি গ্রামের আবহাওয়াতেই বঁচতে চাই।
রমজন : এই নেন চা-
মতি : স্যার, মাষ্টার সাব চা খাইছেন আপনারা ?
মাষ্টার সাহেব: মতি তুমি খাও। আমরা এই মাত্র চা খাইলাম। তেমার সাথে এইটা কে ? ওনারে তো চিনতে পারলাম না।
মতি : ও আমার শহীদ চাচার ছেলে। শহড়ে বড় হইছে। হঠাৎ কি মনে কইরা আইলো, কইলো কয়দিন গেরামে বেরাইবো।
মাস্টার সাহেব : ও আচ্ছা-আচ্ছা, ভালোতো।
প্রফেসার : গ্রামে থকলেওতো কিছু একটা করা দরকার। সেটা নিয়েই আলাপ করতে ছিলাম মাস্টার সাহেবের সাথে। কি করা যায় ? নিজের জন্ম স্থানের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য বলেতো কিছু একটা আছে। সাধ আছে বুঝলে বাবা সাদ্ধে কূলাতে চায়না এই হলো সমস্যা।
( সূর্য চায়ের কাপটা রেখে মাষ্টার এবং প্রফেসারের সাথে করমর্দন করে।)
মাষ্টার সাহেব : তা তোমার আব্বা কেমন আছেন ? অনেকদিন দেখিনা। একবার দেখছিলাম বাছ স্ট্যান্ডে। গড়ির ভেতর থাইকা গলা বাইর কনরা হাত নাইরা আমারে ডাকতাছিলো।
সূর্য : জ্বি-ওনি ভালো আছেন। তবে ইদানীং হার্ট চেকআপ করানের পর একটু প্রবলেম দেখা দিছে। ডাক্তার বলছে মাদ্রাজ গিয়ে প্রেছমেকার বসাতে হবে।
মাস্টার সাহেব : কই আমিতো দেখলাম সুস্থ হাসিখুশি মানুষ একটা।
সূর্য : মানুষের রোগ বালাই হায়াত মৌওতের কথা কেউ কি আর ঠিক করে বলতে পারে চাচাজান।
প্রফেসার : হ্যা হ্যা ঠিকই বলেছো তুমি। আমরা সবাই কলের পুতুল। এক সময় যুবক বয়সে এই শীতলক্ষা নদী আমি রাতের অন্ধকারে পার হইতে পারতাম। আর এখন সন্ধ্যার পর চোখে দেখিনা। সবই অস্থায়ী। এক সময় আমরা কেউ ছিলাম না এটা যেমন সত্যি; এক সময় আমরা কেউ থাকবোনা এটাও সত্যি। বালুচড়ে তাসের ঘড়-সংসার আমাদের !
সূর্য : যুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন আংকেল ?
( সূর্যের আচমকা এই প্রশ্নে সবাই কেমন অবাক হয়ে চোখাচোখি করতে থাকে। )
প্রফেস্যার : আমাকে বলছো বাবা ?
( সূর্য চিকন হাসিতে একটা আদার টুকরা জিহব্বার আগায় ঠেকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।)
প্রফেসার : আমিতো তখন ভারতে-ইন্ডিয়ায়। তখন দেশে একটা পত্রিকাতে মাঝে-মাঝে শখের বসে কিছু লিখে পাঠাতাম এই আরকি। পাশাপাশি একটা প্রাইমারী স্কুলে জব করতাম।
( একটু থেমে)
: তো পরবর্তিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটা হাই স্কুলে ইংরেজী পরাবার দায়িত্ব নেই। তার দশ বছড় পর সরকারী কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাই। ব্যাস্ ,এই আমার কর্ম জীবন। গন্ডগোলের সময় ভাড়তেও কিছু পত্রিকায় আমার লেখা আর্টিকেল ছাপা হয়েছিলো অবশ্য।
সূর্য : তাহলে আপনিতো জীবন্ত দলিল। অনেক কিছু চাক্ষুস দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাইনা ?
প্রফেসর : হ্যা তা বলতে পারো বাবা।
সূর্য : আচ্ছা আংকেল বলেনতো বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এটা কখনো আপনারা মানে আপনাকে বলছিনা-সে সময়ের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক মহল যারাই ছিলেন তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন ?
প্রফেসর : সত্যি কথা বলতে কি আমরা অনেকেই তখন ভাবতে পারতামনা যে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন হবে। স্বীকার করতে দোষ নেই আমরা একটা দো-টানার মধ্যে পরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। আমার সাথে অনেকেই ছদ্ম নামে বিভিন্ন কড়া-কড়া লেখা প্রকাশ করতো কিন্তু; আমি এ কাজটা কখনোই করতে পারি নাই। নূন্যতম মূল্যবোধ আমার ভেতরে কাজ করতো। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো জান বাঁচানোটাই তথন প্রথম এবং প্রধান সমস্যা হয়ে পরেছিলো কারণ জান বাঁচান ফরজ।
সূর্য : এজন্যই বলা হয় বুদ্ধিজীবিরা সুবিধাবাদি-সুবিধাভোগী। এতোবড় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে অথচ কবি সাহিত্যিক শিক্ষক সাংবাদিক এরা কেউ টের পেলোনা ! কেউ কোথাও মুখে অথবা লিখে এমনকি একটা ছবি একেও প্রকাশ করতে পারলেন না যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হতে যাচ্ছে। এদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে তার অবস্থান তৈরী করতে যাচ্ছে। ভাবতে অবক লাগে। তার মানে কি দাঁড়ায় ? মানেটা হলো যে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিন্তা করার মতো চিন্তন শক্তি আমাদের পূর্ব বাংলায় ছিলোইনা তাইনা ? ব্যাপারটা কি দাঁড়ায় ? এ-রকমনা ব্যাপারটা ?
( রমজানের হোটেলে মনে হয় কিছুক্ষন আগে একটা বজ্রপাত হলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই মাথা নিচু হয়ে শুনছে। সূর্য শুধু শব্দ করে চায়ের কাপে একটা চুমুক দেয়। শব্দ করে চায়ের কাপটা টেবিলে রাখে।)
সূূর্য : মাফ করবেন-আপনাদের কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো আমি বলিনি। আমি যুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু বিকৃত ইতহাস কখনোই প্রহনযোগ্য হতে পারেনা। বললে অনেক কথা বলা যায়। স্বধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা যে কতোটা কঠিন-কতোটা কঠিন তা এখন বাঙ্গালী জাতী সর্বপরি বাংলাদেশীরা পলে-পলে অনুভব করছে। সবাই মুখ বুজে সহ্য করছে। এতো রক্তের বিনিময়েও তারা স্বাধীনভাবে কিছু বলতে পারছেনা। কোন কিছু করতে পারছেনা। এর জন্য দায়ী কে ? এর জন্য দায়ী কারা ? বলতে পারেন ? আপনারা সবজান্তা সমসের। জানলেও বলার শক্তিটুকু আজ আপনাদের কণ্ঠনালীতে নেই। আপনারা তখন ছিলেন গাড়ি-বাড়ি করার ধান্দায়। প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক থেকে রাতারাতি প্রিন্সিপল হয়ে গেলেন। আর ও দিকে বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা অনাহারে অর্ধাহারে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রোগে শোকে অসুখে ভুগে মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি হয়ে স্টেনগান চালিয়ে যাচ্ছিলো।
-: কাদের টাকায় আজকের উচ্চবিত্ত পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজি পতিরা গর্ব করে ? সে সময় পাকিস্তানের ২২-জন পুঁজি পতির মধ্যে মাত্র একজন ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের আর বাকি ২১-জন ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের। তাহলে আজকের এই কতো শত পুঁজিপতি ধনী মাহাপূরুষেরা কোথা থেকে আবিষ্কার হলো ? কেউ বলতে পারেন ? বলতে পারবেননা। “ আরেকটা যুদ্ধ প্রয়োজন ”। সত্যিকার অর্থে যারা এখনো অসহায় তাদের জন্য হলেও জাতী স্বধীনতা রক্ষার দাবিতে আরেকবার যুদ্ধে নামতে চায়। সে ভোরের সূর্য উঠতে আর বেশি দেরি নাই। সেই সুর্য আমরা সবাই দেখতে চাই।
( আসে পাশের লোকজন আস্তে-আস্তে রমজানের হোটেলের চারপাস ঘিড়ে দাঁড়িয়ে পরেছে।)
সুর্য : ছাত্র, কৃষক, দিনমুজুর, কুলি, নাপিত, মুচি, হকার যদি সবাই তাদের ন্যায্য দাবি অধিকার বুঝতে পারে, কৌশলে সুবিধা আদায় করতে পারে; সরকারের কাছে নিজেদের সমস্যা সঠিকভাবে, গঠনমূলক ভাবে উপস্থাপন করতে পারে তবে, তাহলে জাতী যে স্বপ্ন দেখে দেশকে শত্র“র ছোঁবল থেকে মুক্ত করেছিলো সেই শান্তির বাংলাদেশ গঠনে দলমত নির্বিশেষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু’ভাবেই নিজেদের অবস্থা-অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে বলে আমি এবং আমরা যারা স্বাধীন উত্তর জন্মেছি তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আল্লার উপরে ছেড়ে দিলে কোন কিছুই হবেনা। ধান লাগলেন আপনারা আর বুলবুলিতে খেয়ে চলে গেলো এটাতো হতে পারেনা। এটাকি হতে দেওয়া যায় ? কি বলেন আপনারা ?
( বাইরে যারা দাঁড়িয়ে সূর্যের কথাগুলো শুছিলো তাদের দিকে তাকিয়ে সূর্য প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।)
দু’চারজন আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে মৃদু স্বওে জবাব দেয় ঠিকই বলছেন। এাটা ঠিক না। আবার কেউ কেউ একে অপরের সাথে চোখা চোখি কওে কিছু বুঝার বা বোঝাবার চেষ্টা করছে।
মতি মাঝি সূর্যকে একগ্লাস পানি ঢেলে দেয়। সূর্য অর্ধেক খেয়ে গ্লাসটা আলতো কওে টেবিলে রাখে যেন শব্দ না হয়। এর পর হাত দুটো সমান কওে টেবিলের উপর রেখে মুখে বলে-
সূর্য : আজকে এ পর্যন্তই, যদি কোন কথা ভুল বা অন্যায় বলে থাকি বা কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকি তাহলে বলতে পারেন।
( ভীরের মধ্যে থেকে কে একজন আগুন্তক বলে উঠলো)
আগুন্তক : না-না আপনে যা বলছেন ঠিকই আছে।
আরেকজন বলে ফেললো-
: সত্যকতা সবাই কইতে ডরায়।
তৃতীয় অন্য এক ছেলে বলে ফেললো
: আপনের কতা গুলান স্টেনগানের মতোন, শইল্যের পশম খাড়ায়ে যায়গা।
সূর্য টেবিলের ফাক থেকে বেরিয়ে এসে কিশোর বয়সের ছেলেটির থুতনী ধওে কৌতুক ছলে হেসে জিজ্ঞেস করে
সূর্য : তুমি স্টেনগান চিনো ?
( সবাই সমস্বওে এক সাথে হেসে উঠে। সূর্য মতি মাঝিকে নিয়ে ভীড় ঠেলে রাস্তায় বেরিয়ে আসে।)
---------------------------------------------
মতি : আজকে থেকে তুমি এই ঘড়ে থাকবা। এই ঘড়ে দাদা থাকতো দক্ষিণ পাসের এই দড়জাটা সব সময় খোলার দরকার নাই, মাঝে মাঝে খুলে দিবা। ঘড়ে আলো-বাতাসের দরকার আছে। জানলাগুলি খুইল্যা রাখলে সমস্যা নাই। দাদা মরার আগে প্রায় ৫-বছড় এই জানালার দিকে তাকায়ে ছিলেন। কিছু জিজ্ঞেস করলে কইতেন গাছের পাতা দেহি, বৃষ্টি দেহি।
সূর্য : ঘড়টা মনে হয় অনেকদিন বন্ধ ছিলো তাইনা ভাই ?
মতির বৌ : কেমন একটা সে্যঁতস্যেতে গন্ধ !
মতি : এই টেবিলটা তোর আব্বায়ও ব্যবহার করছে, আমিও করছি। নিলার মা..টেবিলটা পরিষ্কার কইরা একটা চাঁদড় বিছায়া দেও।
মতির বৌ : ঘড়টা ঝাড়ু দিয়া বিছানাটা ঠিক কইরা দিবা। আমি আইজকা ঢাকা যামু। কিছু বই কিনতে হইবো। আরো কিছু দরকারও আছে।
সূর্য : আজকেই যাইবেন ?
মতি : হু।
( মতি দক্ষিণ দিকের কাঠের দড়জাটা খুলে দেয়। )
মতির বৌ : থাকবা না আইসা পরবা ?
মতি : ঠিক নাই।
সুর্য : একাই যাবেন ভাই ?
মতি : হু কেন ? তোর কোন দরকার আছে ? দরকার থাকলে কইয়া ফালা।
সুর্য : আমার কিছু কাপড় আর কিছু বই আনার দরকার আছিলো ভাই।
মতি : আগে বলবিনা। বইকি কিন্না আনতে হইবো না বাসা থাইকা ?
সূর্য : বই কিনতে হইবো। আমি লিষ্ট কইরা টাকা দিয়া দিতাছি। সবগুলা বইই খুব পপুলার। কিন্তু দাম দরের সময় একটু সচেতন থকতে হইবো এই আরকি।
মতি : কি বই এগুলা ? বই এর দাম নিয়া টেনশন করার কিছু নাই। আমার অভিজ্ঞতা আছে। ঠকাইতে পা
©somewhere in net ltd.