![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এবাররে একুশে বই মেলায় বেরিয়েছে ফয়জুল আলম বেলাল’র প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘স্মৃতির প্রতি প্রীতি’। প্রবন্ধগুলো স্মৃতিচারণমূলক। এতে পঁচিশটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,
নবীর দেশে মজনু বেশে
শাহজালাল’র (র.) নিশান উড়ে
অমর স্থাপত্য তাজমহলে
মাডাম তুসো এক রমণীর গল্প
বৃটিশ মিউজিয়ামঃ ওয়াল্ড কালচার
ঐতিহাসকি প্রাসাদ টাওয়ার অব লন্ডন
প্রথম ভ্রমন নুড়ি পাথরের জাফলং
অম্লান স্মৃতি ময়নামতি
বাড়ির পাশে হাসন রাজার রামপাশা
স্মৃতিতে প্রীতিতে শাহ্ আব্দুল করমি
দেশ দরদী বঙ্গবীর ওসমানী
বাঙ্গালীর নক্ষত্র পুরুষ দেওয়ান আজরফ
আমার আছে দিলওয়ার
স্মৃতির প্রতি প্রীতি
বৃটনে: রাক্ষুসী না মমতাময়ী
১৩৬ পৃষ্টার এ বইটি প্রকাশ করেছে নগর সাহত্যি ও প্রকাশনা সংস্থা এবং গ্রন্থরে প্রচ্ছদ করছেন নেছার আহমদ জামাল। মূল্য ১০০ টাকা। লেখক পরিচিতি অংশে কবি ও প্রবন্ধিক সৈয়দ মবনু লেখেছেন,ফয়জুল আলম বেলাল নব্বুই দশক থেকে লেখালেথি করছেন। জাতীয় দৈনিকে ১৯৯৪ সালে প্রথম ছাপা অক্ষরে কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে ‘ছুয়ে দিলেই বদলে যাব’ যৌথ কাব্যগ্রন্থে প্রথম লেখা গ্রন্থবদ্ধ হয়। ২০০০ সালে প্রকাশতি হয় তার একক ছড়াগ্রন্থ ‘পঙ্খিরাজে চাঁদরে দেশে। ২০০১ সালে ‘স্বপ্নের প্রেয়সী’ উপন্যাস প্রকাশতি হয়। ২০০৫ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বৃটেনের বৈরী বাতাস’। ২০০৮ সালে প্রকাশতি হয় ‘বৃটনেরে আকাশ মেঘে ঢাকা’ উপন্যাস।
তবে আর বৈরী বাতাস বা মেঘে ঢাকা আকাশ নয়। এই গ্রন্থে লেখকের কতগুলি মননশীল লেখা নিয়ে প্রকাশতি হয়েছে ‘স্মৃতির প্রতি প্রীতি’ গ্রন্থ। পাঠক খুঁজে পাবেন পঙ্খিরাজের সোয়ার কে পবিত্র ভূমি মক্কা নগরীতে প্রভূর আরধনায়। কখনো তাজমহলরে গায়ে হেলান দিয়ে কবিতার ছন্দ সৃষ্টিতে। কখনো বা নিজের শিকড়ের সন্ধানে র্পূব পুরুষের বসত ভাটিতে।
লেখকের জন্ম পূণ্যভূমি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার ইলামের গাঁও (ফকির বাড়ি)। জন্ম ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর। পিতা হাজী শাহ্ মোঃ মবশ্বির আলী ও মাতা মোছাঃ চন্দ্রবান বেগম। লেখক বাংলা একাডেমীর সদস্য ও কেন্দ্রীয় মুসলিশ সাহিত্য সংসদ সিলেটে’র জীবন সদস্য। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। এক সন্তানের জনক। শাহ্ মুসতাকিম আলম ছেলের নাম। এই গ্রন্থের সাফল্য কামনা করি।
নবীর দেশে মজনু বেশে
‘বক্ষে আমার কা’বার ছবি
চক্ষে মোহাম্মদ রাসুল।
শিরোপরি মোর খোদার আরশ
গাই তারি গান পথ-বেভুল’।
কাজী নজরুল ইসলামের এই সঙ্গিতটি হৃদয়ের তারে তারে নিত্য বাজে। আর সুদূর মক্কা মদিনার মুসাফির হতে ব্যাকুল হই! হারমাইন শরিফের জিয়ারত মুমিনের জীবনে সবচে’ বড় আকাংখা। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের উপরই হজ্জ্ব ফরজ। কুরআন শরিফে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর হজ্জ্ব সম্পাদন করা মানুষের উপর ফরজ, যার সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য আছে।’ পৃথিবীর মূল শহর হল মক্কা শরিফ। এই শহরে নবী শ্রেষ্ট হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উপর প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়। ইসলামের আলো এখান থেকেই প্রথম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মক্কা শরিফে ইবাদতের জন্য প্রতিষ্টিত বিশ্বের সর্বপ্রথম ঘর কাবাশরিফ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘নিশ্চয় মানব জাতির ইবাদতের জন্য তৈরী প্রথম ঘর হল এই মক্কার ঘর, যা নিখিল সৃষ্টির জন্য মঙ্গলময় ও পথনির্দেশক, তাতে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ রয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হল মাকামে ইব্রাহিম। যে সেথায় প্রবেশ করল সে নিরাপদ হল’। আল্লাহর পবিত্র গৃহ কাবা শরিফ ও রাসূল (সা.) স্মৃতিধন্য মদিনা শরিফ দেখার ইচ্ছা অন্তরে অহর্নিষ। একটি কবিতায় লেখেছিলাম,
প্রভূ প্রেমের স্বর্গ সুধা কখন পাব নিজ হাতে
ডাক আসবে হারমাইন শরিফের জিয়ারতে!
পবিত্র ভূমি একবার যদি দেখি নয়ন ভরে,
রিক্ত হৃদয়ে ব্যথা বেদনা যাবে মুহুর্তে ঝরে।
চোখে মুখে মাখব মদিনার ধূলি, পথের মাটি
নবীর কদমের পরশ যেথায় লেগেছে হাঁটি।
প্রভুর কাছে প্রত্যহ অন্তরের অন্তীম প্রার্থনা,
আমার যেন মৃত্যু হয়না, না দেখে মক্কা মদিনা।
আমার একান্ত বিশ্বাস এই তামান্না প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে। আশা-নিরাশার বালুচরে দীর্ঘদিন সাঁতার কাঁটি। আমি কি কখনো বাইতুল্লাহ ও রওজাশরিফ জিয়ারত করতে পারব! সেই অভাবনীয় সুযোগ আমার জীবনে কি আসবে! যতদিন যায় মনের এই বাসনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। হজ্জ্ব যাত্রীদের সাথে দেখা হলে বলি আমার জন্য দোয়া করবেন হারমাইন শরিফে যেন শীঘ্রই যেতে পারি! এক সময় নিজের সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করি। আমি আর কোনদিকে পা বাড়াবনা, যদি সুযোগ হয় মক্কা মদিনা যাব!
আমার সেই প্রার্থনা অবশেষে কবুল হয়। হারমাইন শরিফ জিয়ারতের সুযোগ হয় ২৭ এপ্রিল ২০০৬ সালে। হিথ্রো বিমান বন্দর থেকে কাতার এয়ারলাইন্সে যাত্রা শুরু করি। রাত সাড়ে নয়টার সময় ফ্লইট হয়। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আরাধনা, শ্রেষ্ঠ সাধনা সফলতার দোর গোড়ায় পৌঁছে। আনন্দের সীমা-পরিসীমা হারিয়ে ফেলি। খুশির আমেজে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ‘আয় কে যাবে সঙ্গে আমার নবীর দেশে আয়..’। এই সঙ্গিতটি ছোটবেলা থেকে আমার অন্তরের রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে আছে। আমি আনন্দ চিত্তে স্ব-রচিত একটি লেখা পড়ি
‘মরুর দেশে মজনু বেশে কে যাও মদিনায়,
এই অধমের সালাম দিও নবীজীর রওজায়....’।
ছয়ঘন্টা যাত্রা শেষে কাতারের রাজধানী দোহায় পৌঁছি। স্থানীয় সময় ছিল ভোর ছয়টা। আবার শুরু হয় প্রতীক্ষা। একেক করে আট ঘন্টা সেখানে অপেক্ষা করি। দোহা থেকে জিদ্দায় তিনটার সময় ফ্লাইট হয়। জেদ্দায় অবতরনের ঘন্টা খানিক পূর্বে প্লেনে এনাউন্স দেয়া হয় এহরাম বাঁধার জন্য। প্লেনের সিটে বসে এহরাম বাঁধি। আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। দু’টুকরো সাদা কাপড় পড়ি নিজ ইচ্ছায়। দুনিয়ার কাছে আমার যেন চাওয়া-পাওয়া এই দু’টুকরো সাদা কাপড়। আরো আপ্লুত হই ভেবে, একদিন অনিচ্ছায় পরিয়ে দেবে আত্মীয়-স্বজন। সেদিন আমার মাটির বাসর সাজানো হবে। পরম প্রিয়তমের সান্নিধ্যে চলে যাব।
মাগরিবের খানিক পূর্বে জেদ্দা এয়ারপোর্টে অবতরণ করি। এয়ারপোর্ট মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ি। আবার শুরু হয় জিদ্দা থেকে মক্কা যাওয়ার জন্য অপেক্ষা। প্রতীক্ষার প্রহর বড় দীর্ঘ! পূর্বে থেকে জানতাম মক্কার লোকেরা খানিকটা কর্কশ। তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ না হতে পারলেও ক্ষুব্ধ হইনি। এটা তাদের মজ্জাগত স্বভাব। বিলম্ব দেখে এক কর্মকর্তাকে বলি, কখন মক্কা শরিফ যাব? সে শুধু বলে ইনতেজার! যতবার বলি ততবার বলে, ইনতেজার। আর কতক্ষন ইনতেজার করতে হবে সে কিছুই বলেনা! আমার মক্কা শরিফ যাওয়ার ইনতেজার ধৈর্য্যরে চরম সীমায়। আমার কাছে সেই প্রবাদ মনে হচ্ছিল, ‘আল ইনতেজারু আসাদ্দু মিনাল মাউতে’। মাগরিবের নামাজের পরে এয়ারপোর্টে আমাদের এলাকার সিরাজ নামের এক সৌদি প্রবাসির সাথে দেখা হয়। তিনি এক আত্মীয়কে নিতে এসেছেন। তার সাথে ঘন্টাখানিক আলোচনা করি। সৌদি প্রবাসি আমার আত্মীয় জমির ভাইকে তিনি ফোনে আমার সাথে কথা বলতে দেন। জমির ভাই আমাকে বলেন, তুমি মক্কায় পৌছে ঠিকমত বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করো। আমি লন্ডনে ফোন করে বলব, তুমি নিরাপদে এসেছ। অবশেষে ঘন্টা দুয়েক পরে আমার অন্তরের লালন ভূমি মক্কার উদ্দেশ্যে মিনিবাসে রওয়ানা হই। মক্কায় প্রবেশের পূর্বে কুরআন শরিফের ডমির তোরন সাজানো। এই প্রবেশদ্বার কেবল মাত্র মুসলিমদের জন্য। এক সময় মিনিবাস থেকে বায়তুল্লাহ দৃষ্টিগোচর হয়। গেইটের টাওয়ারগুলো আলোকুজ্জ্বল ঝলমল করছে! রাত এগারোটার সময় লাগিজ নিয়ে মক্কার নির্ধারিত হোটেলে উঠি। হোটেলের এক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করি, এখান থেকে কাবা শরিফের দুরত্ব কতটুকু? সে বলে মাত্র তিন/ চার মিনিটের পথ। আপনি হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে যেতে পারবেন।
আমি বলি কাবা শরিফ জিয়ারতে আগে আর কিছুই খেতে পারবনা। হোটেলে ওযু করে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সারাদিনের জার্নির ক্লান্তি, রাতের অনিদ্রার দুর্বলতা মুহুর্তে ঝরে যায়। যত কাছে যাই তত বিস্মিত হই! আমি কি সত্যি কাবা’র আঙ্গিনায় এসে গেছি? কিং ফাহাদ গেইট দিয়ে হেরেম শরিফে প্রবেশ করতে থাকি। প্রভু প্রেমের অপার আনন্দে উদ্বেলিত দেহ মন। মসজিদের ভিতর দিয়ে কিছু অগ্রসর হলে কাবা শরিফ অস্পষ্ট দেখা যায়। কাবা'কে ঘিরে দল বেঁেধ মানুষ তাওয়াফ করছে। দুর থেকে মনে হচ্ছে টিভির পর্দায় এই দৃশ্য দেখছি। মসজিদের হারামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে স্পষ্ট ভাবে কাবাঘর দেখে থমকে দাঁড়াই। আনন্দে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। প্রভুর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রভুর দরবারে করজোড়ে মোনাজাত করি এবং কাবা শরিফের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করতে থাকি। ওমরাহ হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে কাবা শরিফে প্রভু প্রেমীদের মিছিলে শামিল হই। তাওয়াফ শুরু করি। সাতবার তাওয়াফ করে আবে জমজম পান করি। কবি চমৎকার ভাবে বলেছেন ‘কাবা শরিফের পাশে আবে জমজম, সেথায় খোদারই রহমত ঝরে হরদম’। মাকামে ইব্রাহিমের কাছে গিয়ে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ি। সাফা-মারওয়া সায়ি করার জন্য যাই। কুরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে ‘নিশ্চয় সাফা-মারওয়া আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন’।
আমার ধারনা ছিল সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয় স্বাভাবিক পাহাড়ের মত হবে। সেখানে যাওয়ার সময় হাতে করে জুতা নিয়ে যাই। পাহাড়দ্বয়ে সায়ি করতে জুতার প্রয়োজন হবে। নগ্ন পায়ে হাঁটা আমার পক্ষে কষ্টকর। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে দেখি পাহাড়ের কোন অবস্থান নেই। একপাশে শুধু একটু পাহাড়ের মত পাথরের উচুঁনিচু ঢিবি। অপর প্রান্ত খানিকটা উচুঁ। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পাঁচ/ ছয় মিনিটের দূরত্ব। উপরে ছাদ, উভয় দিকে দেয়াল এবং তাতে
পবিত্র কাবা শরিফের সামনে ২৯ এপ্রিল ২০০৬
এয়ারকন্ডিশন লাগানো। সমতল ভুমি মোজাহিক পাতরে আচ্ছাদিত। ফলে অযথা ক্লান্তি-ক্লেশের কোন সম্ভবনা নেই। সেখানে সাতবার প্রদক্ষিণ করে চুল কাটার রেওয়াজটা পূর্ণ করি। এভাবে ওমরার কাজ সম্পন্ন হয়।
রাত একটার দিকে খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে যাই। ঘন্টা খানিক বিশ্রাম করে আবার রাত তিনটায় বায়তুল্লাহ চলে আসি। সারাদিনের তপ্ত সূর্যরশ্মি রাতের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। কাবা শরিফের আকাশে শান্তির সুশীতল সমীরণ ছড়িয়ে আছে। পবিত্র কুরআন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে তেলাওয়াত শুরু করি। সামনে খানায়ে কাবা এবং হাতে কুরআন শরিফ। কিছু সময় তেলাওয়াত করি এবং দৃষ্টি উত্তোলন করে কাবা শরিফ দেখি! একপর্যায়ে তেলাওয়াত করি সূরা বাকারার ১২৭-২৮ আয়াতদ্বয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন ইব্রাহিম ও ঈসমাইল (আ কাবা গৃহের ভিত্তি স্থাপন করেন, তারা বলেন, হে প্রভূ! আমাদের এ কাজ কবুল করুন, নিশ্চয় তুমি সর্বস্রোতা, সর্বজ্ঞাতা! হে প্রভূ আমাদের তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশধরদের তোমার অনুগত উম্মত বানাও! আমাদের ইবাদত পদ্ধতি শিক্ষা দান কর এবং তওবা কবুল কর! নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী, দয়ালু।’
আমার অন্তর চোখে ভেসে উঠে যেন, তাঁরা কিছুক্ষণ আগে কাবাগৃহ তৈরী করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছেন। আর আমিও নৈপথ্যে থেকে আমিন বলছি! প্রভূর কাছে চাওয়া পাওয়ার আর কিছু থাকে না। প্রভূর কৃতজ্ঞতা প্রকাশে পরম প্রশান্তি আসে। বিশ্বের আল্লাহ-প্রেমিক মানুষের কাবাঘর প্রদক্ষিণের অপূর্ব দৃশ্যে নয়ন জুড়ে যায়! তাকবিরে তাকবিরে উর্ধ্বগগন বিদরিত হয়; লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক; ইন্নালহামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা-শারিকা লাকা। ( আমি উপস্থিত হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত, আমি উপস্থিত তোমার কোন অংশীদার নাই, আমি উপস্থিত, নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা ও সম্পদরাজি তোমার এবং একচ্ছত্র আদিপত্যও, তোমার কোন অংশীদার নাই।) ফজরের আজানান্তে বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অপূর্ব নির্দশনে দাঁড়াই।
মুসলিম উম্মার একান্ত প্রিয় কণ্ঠস্বর আব্দুর রহমান আল সুদাইসীর কণ্ঠে জীবন্ত কুরআনের বাণী। এ যেন কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছে! এত সুমধুর তেলাওয়াত পূর্বে কখনো শুনিনি। প্রভূ যেন বান্দার একেবারে সন্নিকটে। বান্দার মনে কোন অভাব অভিযোগ নেই। প্রভূর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠে। বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কাবা শরিফের তাওয়াফ জীবনের শ্রেষ্ঠঅর্জন, প্রেম ও ভালোবাসা! কাবার আঙ্গিনার পাশে ইব্রাহিম খলিল রোডে ফেরদৌস হোটেলে অবস্থান করি। ফজরের নামাজের পরে রুমে ঘুমাই। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে জানালার কাপড় সরিয়ে গা শিউরে উঠি। রোডের অপর পাশে উচু পাহাড়। অর্ধেক পাহাড় কেটে মার্কেট তৈরি হয়েছে। অবশিষ্ট পাহাড়ের মাটি ও কালো পাথর বেরিয়ে মাথার উপর খাড়া। রাতের বেলা দৃষ্ঠিগোচর হয়নি। দিনের আলোয় দেখে মনে হয়েছে কালো ভূতুড়ে পাহাড় কখন উপরে পড়ে যাবে! আমি ভয়ে সাথে সাথে জানালার কাপড় টানি। এভাবে প্রথমদিন অতিবাহিত হয়।
দ্বিতীয়দিন সন্ধ্যা পর আবার ওমরা হজ্জ্ব শুরু করি। কারণ দিনে প্রচন্ড গরমের জন্য ঠিকমত চোখ খুলা সম্ভব ছিলনা। প্রথমে একটি বাসে আয়শা মসজিদে যাই। সেখানে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে ওমরা হজ্জ্বের নিয়্যাত করে এহরাম বেঁধে কাবা ঘরে এসে তাওয়াফ শুরু করি। প্রথমবার প্রদক্ষিণ করে দেখি সারিবন্ধ হয়ে মানুষ হাজরে আসওয়াদে চুমু দিচ্ছে। আমি দ্রুত লাইনে ঢুকে পড়ি। পনের/ বিশ মিনিট পরে হাজরে আসওয়াদে চুমু দেই। এভাবে একবার প্রদক্ষিণ করি আর লাইনে দাঁড়াই। একেক করে তিনবার হাজরে আসওয়াদে চুমু দেই। নিজের হাত, মুখ, কপাল হাজরে আসওয়াদের সাথে লাগাই। মনে পরম তৃপ্তি আসে, আমি আনন্দে অশ্র“ সিক্ত হই!
প্রথম দিন হাজরে আসওয়াদের কাছে মানুষের প্রচন্ড ভীড় ও ধাক্কা-ধাক্কি দেখে নিজেকে অসহায় মনে হয়। কিভাবে ভীড়ের মধ্যে যাব এবং কাকে ধাক্কা দেব! মন থেকে হাজরে আসওয়াদ চুমু দেয়ার আশা নিরাশায় পরিণত হয়। কিন্তু আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে নিরাশায় আলো জ্বলে উঠে। পরেরদিন হঠাৎ করে ঘন্টা দুয়েকের জন্য সারিবদ্ধ ভাবে চুমু দেয়া শুরু হয়। আমি সেই অভাবনীয় সুযোগ তিনবার গ্রহণ করি। হাজরে আসওয়াদে চুমুর স্থান অনেকটা ঢালু গর্তের মত হয়ে গেছে। কাবা শরিফের গিলাপে বারবার ধরে প্রভুর কাছে অতীত ভবিষ্যতের গোনাহ থেকে ক্ষমা চাই। বর্তমানের মত পবিত্র চিত্তে অনাগত দিনগুলো অতিবাহিত করার তৌফিক কামনা করি। গিলাপের সুগন্ধে আরো বিমোহিত হই। এক সময় আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে চৌদ্দ শত বছর পূর্বের খাজা আব্দুল মুত্তালিবের বাড়ি। যে বাড়িতে মাতা আমিনার গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন বিশ্বমানবতার মূর্ত প্রতীক নবীদের শিরোমনি হযরত মুহাম্মদ (সা। এই খুশিতে বিশ্ব ভ্রহ্মান্ড আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। আকাশে-বাতাসে জ্বিন-ইনসান ফেরেস্তা মারহাবা বলে খোশ আমদেদ জানায়। আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই আনন্দের বাঁধ ভেঙ্গেঁ গেয়ে উঠেন, ‘দেখ আমেনা মায়ের কোলে,/ দোলে শিশু ইসলাম দোলে,/ কচি মুখে শাহাদাতের/ বাণী সে শুনায়...।’
কাবা শরিফের পাশে বসে অন্তমিল সাজাই ‘প্রাণ প্রিয় স্থান’ নিম্নের কবিতায়;
আজ নিজের ইচ্ছায় পরিধান করি সফেদ বসন,
একদিন অনিচ্ছায় পরিয়ে দেবে আত্মীয় স্বজন!
প্রভূর কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই জানা
তাঁর শেখানো শ্বাশত ভাষায় তাই জানাই প্রার্থনা,
সমস প্রশংসা প্রভূর, তাঁর সমকক্ষ নেই ভূবনে
এই প্রার্থনা করছি দাঁড়িয়ে খানায়ে কাবার সামনে।
মুমিনের হৃদপিন্ডে মৃত্যু অবধি বারবার বাসনা
কাবা শরিফ দেখার এই সাধ কখনো মিটবেনা!
নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়নি, এই কি বায়তুল্লাহ?
প্রতিনিয়ত নামাজে দাঁড়াই যেদিকে করে ক্বিবলাহ্!
যে ছবি জন্ম-জন্মান্তর থেকে আমার অন্তরে গাঁথা
যেদিকে ভক্তি ও ভালোবাসায় নিত্য নত করি মাথা!
হাজরে আসওয়াদে চুম্বন জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়
কাবার গিলাপে ধরে ক্রন্দনে জুড়ায় তপ্ত হৃদয়।
প্রথম দর্শনে আনন্দে দু’চোখে নামে অশ্র“ প্লাবন
খোদার অবারিত রহমত অহরহ হচ্ছে বর্ষণ!
বিশ্ব মুসলিমের মিলন কেন্দ্র প্রাণ প্রিয় এই স্থান,
লাব্বাইকা বলে আকাশ বাতাস মুখরিত শ্লোগান।
প্রভূ প্রেমীদের মিছিল পদক্ষিণে হৃদয় কম্পমান
ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হয় আবে জমজম যখন করি পান।
কাবার সামনে তেলাওয়াত করি পবিত্র কুরআন
প্রভূ ও বান্দার মধ্যে নিবিড় প্রেমের অবস্থান।
তৃতীয় দিন রাতে এশার নামাজ ও ওমরা করে হোটেলে ফিরি। হোটেলের রিসিপসনে দেখি চুনু চাচা (চুনু মিয়া) ও তার এক সহকর্মী আমার অপেক্ষায়। আগের দিন তাকে ফোন করে আমার আগমন ও অবস্থানের কথা বলেছি। তিনি দীর্ঘদিন থেকে জিদ্দায় অবস্থিত আল-বিলাদ হোটেলে চাকুরীরত। আমাকে দেখে বলেন, কয়েক ঘন্টা থেকে অপেক্ষা করছি। তাদের নিয়ে রুমে যাই। চাচা বলেন, এহরাম পরিবর্তন করো, বাইরে যাব! আমি তাদের সাথে সেখানে বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাই। সৌদি আরবে অধিকাংশ বাঙ্গালী রেস্টুরেন্ট চট্রগ্রামবাসীদের। যেভাবে ইংলেন্ডে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট সিলেটিদের। চাচা শপ থেকে কিছু জিনিসপত্র ক্রয় করে তার বাড়ির জন্য দেন। তাদের সাথে ঘন্টা দুয়েক অতিবাহিত করি। চাচার সাথে এরপূর্বে ২০০১ সালে ১৭ ফেব্র“য়ারী ভোরে ঢাকা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে দেখা হয়েছিল। তিনি সৌদি আরব থেকে এসেছেন, ১০টার ফ্লাইটে সিলেট যাবেন। আমি প্রথম লন্ডন আসব। কাকতালীয় ভাবে এয়ারফোর্টে দেখা। ঘন্টা খানিক আলোচনা করি।
মক্কা থেকে আসার আগের দিন জিদ্দায় আমার আত্মীয় জমির ভাইকে দেখতে যাই। মক্কা থেকে একটি টেক্রিতে উঠি। আমার সাথে আরেক আরাবিয়ান বৃদ্ধ লোক। তিনি মক্কা তাওয়াফে এসেছিলেন। এশার নামাজ পড়ে ঘরে যাচ্ছেন। কিন্তু জিদ্দায় গিয়ে রাতের জন্য নিজের ঘর চিনছেননা। ড্রাইবার একবার একদিকে নিয়ে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ বলেন না অন্যদিকে। এদিক সেদিক কয়েকবার করে ড্রাইবার বিরক্ত হয়ে কয়েকটি এলাকার নাম বলেন। একপর্যায়ে বলেন, ঐটি শাহরে বিন লাদেন। আমার চোখে ভেসে উঠেন ওসামা বিন লাদেন। যাকে ধ্বংশ করার জন্য ইয়াংকি সরকার আধাজল খেয়ে দুনিয়া তছনছ করে দিচ্ছে। খোদ সৌদি সরকারও তার নাম মুছে ফেলার জন্য দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। অথচ তার নামের শহরে হাজার হাজার মানুষ বাস করছে। প্রতিদিন তার নাম নিচ্ছে লাদেনের শহর বলে। বৃদ্ধলোক গন্তব্য খুঁজে পান। আমাকেও ড্রাইবার গন্তব্যে পৌছে দেন। সেখানে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা হয়। তারা একত্রে বাস করেন। তাদের সাথে একরাত অবস্থান করি। কেউ কেউ তাদের প্রবাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা বলেন। মানুষকে খুব খাটায়, একেবারে দাসের মত। মালিক কর্মচারীর সম্পর্ক, যা প্রত্যেক বিবেকমান মানুষের হৃদয়ে ব্যথা দেবে। টাকা হয়েছে কিন্তু মনুষ্যত্ব বাড়েনি। পারিশ্রমিক নিয়ে টালবাহানা করে। এমন কি দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। অথচ রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে মজুরি পরিশোধ করিও!’
পরের দিন সকালে জিদ্দা থেকে আবার মক্কায় আসি। জোহরের নামাজ খানায়ে কাবায় আদায় করে তাওয়াফ করি। কাবার গিলাফে ধরে বিদায়ি দোয়া করি। মন চায় না কা’বার গিলাফ ছেড়ে আসি। দুপুরের খাবার খেয়ে তিনটার কোচে মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। কাবা শরিফ থেকে চলে এলেও মন পড়ে আছে কাবার আঙ্গিনায়, মসজিদে হারামে, মোকামে ইব্রাহিমে, কাবার হাতিমে, সাফা-মারওয়ায় । মক্কা শরিফ থেকে ছয় ঘন্টায় বাসে মদিনায় যাই। পথে শুধু মরুভূমি দেখি। লোকালয় নেই বললে চলে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ইব্রাহিম নামের এক মদিনার লোক আমাকে নির্ধানিত হোটেলে পৌঁছে দেয়। রাত সাড়ে দশটায় পরম প্রিয়তমের রওজাশরিফের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে হোটেল থেকে বের হই। কিন্তু এসে দেখি বাবুস সালাম বন্ধ হয়ে গেছে। এই গেট দিয়ে রাসুল (সা.) এর রওজা শরিফ জিয়ারতে প্রবেশ করতে হয়। বাহির থেকে পাক মদিনার সবুজ মিনার দেখে মনে কিছুটা তৃপ্তি আসে। রওজাশরিফের আঙ্গিনায় খোলা আকাশের নিচে এশার নামাজ আদায় করি। বিস্তৃর্ণ আঙ্গিনায় হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে। কেউ কেউ বসে গল্প করছে। টাওয়ারগুলোর আলোয় ফ্লোর ঝকঝক করছে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। এমন পরিবেশ কোথাও নেই। তাইতো প্রতিদিন পতঙ্গ পালের মত রাসুল প্রেমিকেরা দলে দলে রওজাশরিফ জিয়ারতে আসেন।
আল্লাহ পূরাও বাসনা, দয়া করে দেখাও নিয়া সোনার মদিনা। মসজিদে নববী’র দরজা, চৌকাট, প্যান, কার্নিস সবকিছু সোনালী রঙ্গের। আমার সম্মুখে সেই সোনার মদিনা। রাতে দীর্ঘক্ষণ বৈদ্যুতিক আলোয় মদিনা শরিফ দেখি। রাসুল (সা.)কে বুকে ধারণ করে মদিনা গৌরান্বিত। মুসলমানদের কাছে বায়তুল্লাহ পরে শ্রেষ্ঠতম স্থান বলে গণ্য। মদিনার নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করে রাত একটা হয়ে যায়। হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই। আবার তাহাজ্জুদের সময় মসজিদে নববীতে ফিরে আসি। এই মসজিদের মেহরাবে দাঁড়িয়ে মহানবী (সা.) নামাজে ইমামতি করতেন। মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘আমার রওজা থেকে মিম্বর পর্যন্ত রিয়াদুল জান্নাহ।’ বেহেস্তের বাগানে কুরআন তেলাওয়াত করি এবং নফল নামাজ পড়ি। মনে পরম তৃপ্তি আসে। রাসুল (সা.) এর রওজা শরিফের পাশে কুরআন তেলাওয়াত করি। তাহাজ্জুদের নামাজের পর ফজরের আজান হয়। এত সুললিত কণ্ঠে নামাজের প্রতি আহ্বান আর কখনো শুনিনি। মনের মিনারে যেন হযরত বিলাল (রা.) সুমিষ্ঠ সুরে আজান দেন। যে আজানে আকাশে ফেরেস্তারা নামাজ পড়তেন।
ফজরের নামাজান্তে আমার সবচে’ আকাংখিত নবীজীর রওজাশরিফ জিয়ারতে যাই। প্রিয়তমের সান্নিধ্য লাভ করে আনন্দে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এতদিন শুধু কল্পনায় সালাত ও সালাম নবীজির রওজায় পাঠাই। আজ আমার চোখের সামনে সেই প্রিয়তমের রওজাশরিফ। আনন্দে মনে হচ্ছে আমি মকসুদে মঞ্জিলে পৌঁছে গেছি। নেই কোন হতাশা। আশার আলোয় প্রাপ্তির পূর্ণতায় মনের কিনারা কানায় কানায় ভরে উঠেছে। পৃথবীতে জন্ম নেয়ার পর নিজেকে এত সুখী আর কখনো মনে হয়নি। রওজাশরিফের সামনে দাঁড়িয়ে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি। নবীজীর রওজাশরিফের পাশে শায়িত আছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর হযরত আবুবকর (রা.)। তাঁর হাত ধরে ইসলাম হয়েছে স¤প্রসারিত। ইসলামের জন্য আবুবকর (রা.) অবদান অপরিশোধ্য।
নবীজীর রওজাশরিফের পাশে ৩ মে ২০০৬
তাঁর পাশে শায়িত আখেরি নবীর দক্ষিণ বাহু হযরত ওমর (রা.)। তাঁদের প্রতিও অন্তরের
অর্ন্তনিহিত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
রওজাশরিফের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে ‘সবুজে শিল্পিত মিনার’ শিরোনামের নিম্নের কবিতাটি লেখি;
আমি আর কোথাও যাবনা পেয়েছি জীবনের ঠিকানা
চোখের সামনে হাজার স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র মদিনা,
বেহেস্তের বাগানে বসে প্রভূর কাছে একান্তে প্রার্থনা
আমাকে ক্ষমা না করে এখান থেকে বের করোনা।
জীবনে যত চাওয়া-পাওয়া ছিল সব হয়েছে চুরমার
মদিনার ভালোবাসা আমার অন্তরে শুধু অনির্বার।
সবুজে শিল্পিত মিনার দেখে জুড়াই এই রিক্ত প্রাণ
বিশ্বের শান্তিকামী মানুশের দলে দলে যোগদান,
সবার মুখে শ্লোগান ওগো নবীজি কোলে নাও টানি
অকুল অন্ধকার সাগরে ভাসে আমার ভাঙ্গা তরণী।
রিয়াদুল জান্নায় বসে প্রার্থনা করি প্রভূর দরবারে
ক্ষণিকের মোহ-মায়া যেন তাড়া করতে না পারে!
মসজিদে নববীতে কাটাই শ্রেষ্ঠ সময় আরাধনায়
বারবার সালাম জানাই প্রিয় নবীর পাক রওজায়।
প্রিয়তম বন্ধু আবু বকর ডান পাশে আছেন শায়িত
যার হাত ধরে ইসলাম দিগন্তে হয়েছে প্রসারিত।
অপর পাশে তাঁর প্রিয় দক্ষিণ বাহু হযরত ওমর
অর্ধ পৃথিবী শাসন করেন খেজুর পাতার ছিল ঘর,
প্রভূর কাছে প্রার্থনা একজন ওমর দাও আবার
যাঁর তাকবিরে কেঁপে উঠবে যত যুদ্ধবাজ দুনিয়ার।
মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে জান্নাতুল বাক্বি অবস্থিত। রাসূল (সা এরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন এখান থেকে আল্লাহ তায়ালা সত্তর হাজার লোক উঠাবেন। তারা বিনা হিসাবে বেহেস্তে প্রবেশ করবেন। ‘জান্নাতুল বাক্বিতে দশ হাজার সাহাবায়ে ক্বেরামের কবর আছে। রওজাশরিফ জিয়ারত করে সেখান যাই। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় হেঁটে বেহেস্তবাসীদের জিয়ারত করি। মদিনায় অবস্থান করে একটি সত্য আমার কাছে বিকশিত হয়। মদিনার লোকেরা আরবদের মধ্যে বিনয়ী। তাঁদের বদান্যতায় ইসলাম ও মুসলমান বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। মদিনা হয়েছিল ইসলামের রাজধানী। মদিনাবাসী আজো সেই ঐহিত্য আকঁড়ে আছে। তাঁরা ইসলাম ও মানবতার সেবায় অগ্রগণ্য।
আমার চোখে-মুখে মাখি মদিনার ধূলি মাটি,
প্রিয়তম নবীর পরশ যেথায় লেগেছে হাঁটি।
পবিত্র ভূমি প্রথম দেখে আনন্দে হৃদয় ভরে,
মনের সব ব্যথা- বেদনা মুহুর্তে যায় ঝরে।
শাহ্জালাল’র (র.) নিশানা উড়ে
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে পীর-আওলিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। খোলাফায়ে রাশেদীনের পরে সত্যিকারের ইসলামী রাজ্য হারিয়ে গেলেও যুগে যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে অনেকে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শাহাদাত বরণ করেছেন। ইসলামপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের সোনালী যুগ নিঃশ্বেষ হয়নি। আবার পৃথিবীতে অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী নিশান উড়বে। হযরত শাহ্জালাল (র.) ছিলেন এমনি প্রত্যয়ে প্রত্যয়শীল। তিনি স্বীয় মাতৃভূমি ইয়ামেন ছেড়ে দিল্লী এসেছিলেন। সেখান থেকে সময় সুযোগে ইসলামী শাসন কায়েম করতে সিলেটে আগমন করেন। কেবল আধ্যাতিœকতা নিয়েই নয়, তখনকার দিনের অত্যাধুনিক অস্ত্র তলোয়ার ও ঢাল সঙ্গে এনেছিলেন। তাঁর ৩৬০ অনুসারীদের হাতেও ঢাল-তরবারী ছিল। গৌড় গোবিন্দের সকল প্রচেষ্টা তাঁর সামনে ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি বিনা রক্তপাতে সিলেট জয় করেন।
ছোটবেলা মক্তবে সহপাঠিদের কাছে প্রথম শুনি শাহ্জালাল’র (র.) মাজারের বড় বড় গজার মাছের কথা। পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে পানিতে হাত দিলে গজার চলে আসে। ভেবে অবাক হই! কি আশ্চর্য স্থান! সৌভাগ্যক্রমে মক্তবে শুনার কয়েক সপ্তাহ পরে সিলেট শহরে আব্বার সাথে ১৯৮২ যাওয়ার সুযোগ হয়। আমি ও আমার বড় ভাই আব্বার সাথে শাহ্জালালের (র.) দরগা জিয়ারতে যাই। পুকুরের সেই মাছ দেখে শুনা গল্পের সাথে যথেষ্ট সদৃশ্য পাই। তবে পুকুরের এক চতুর্থাংশে শুধু গজার মাছ এবং বাকী তৃতীয়াংশ কচুরিপানা ছিল। ভক্তরা ছোট ছোট মাছ ক্রয় করে গজার মাছকে খেতে দেয়। আমরাও তাই করি। কেউ কেউ বলেন গজার মাছ সবার খাবার খায়না। যাদের ভাগ্য ভালো তাদের খাবার খায়!
আব্বার সাথে মাজারে উঠার সিঁড়ির কাছে যেতে-ই কর্তব্যরত এক ব্যক্তি বলেন, হাফপ্যান্ট পড়ে উপরে যাওয়া নিষেধ। তিনি আমাদের নিচে রেখে জিয়ারতে চলে যান। আক্ষেপ করি হাফ প্যান্ট না পড়ে যদি লুঙ্গি পড়ে আসতাম তাহলে সুযোগ হাতছাড়া হত না। সোনার মাগুর দেখতে মাজারের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে যাই। মানুষ কুয়ার দেয়ালে (ইদারা) আঘাত করে মাদারি বলে ডাকে। কেউ বলছে ঐ দেখা যা”্ছ।ে আবার কেউ বলে সোনার কই মাগুর কই? সেখানে যেতে পেরেই নিজেকে তৃপ্ত মনে করি। দেখা না দেখার কোন ধারধারিনি! আব্বা দরগার সামনের দোকান থেকে শিরনি ক্রয় করেন। এক প্যাকেট মাজারে অবস্থানকারী ভিক্ষুকদের (আহলে মাজার) বন্টন করার জন্য এক ব্যক্তির হাতে দেন। অন্য প্যাকেট বাড়ি নিয়ে আসেন। মাজারের শিরনি বলে সবাই খেয়ে তৃপ্তবোধ করেন। শাহ্জালাল (র.) সম্পর্কে এসব প্রাথমিক ধারণা। তিনি কোথায় থেকে কেন এসেছেন? কিংবা তাঁর মাজার কেন্দ্রিক প্রতিবছর ওরশ হয়, সে সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না। ১৯৮৭ সালে জুলাই মাসে আমাদের ঘরে প্রথম টি,ভি ক্রয় করে আনা হয়। সন্ধ্যার পরে শহিদ চাচা ও শফিক নানা টি,ভি নিয়ে আসেন। আমরা ভাই-বোন টি’ভি ঘিরে দাঁড়াই। খানিক পরে অন করা হয়। তখন আটটার সংবাদ ছিল। সংবাদে হযরত শাহ্জালালের (র.) ওরশের উপর প্রতিবেদন দেখানো হয়। হাজার হাজার মানুষের ভীড়, দোকান পাঠের পসরা। বাউল-মাস্তানাদের ছড়ি হাতে গেরুয়া গায়ে গান পরিবেশন দেখি। শফিক নানা বলেন, শাহ্জালালের (র.) ওরশ। টি’ভি আনা সার্থক ও মূল্য উসুল হয়েছে।
হজরত শাহ্জালাল’র (র.) মাজারে উঠার সিঁড়ির সামনে
শাহ্জালাল’র (র.) ওরশ দেখা ও তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ তখন থেকে জন্মে। অডিও ক্যাসেট ও বইয়ের মাধ্যমে জানার সুযোগ পাই। কিন্তু দরগার ওরশ বাস্তবে দেখার সময় ও সাহস কোনটি অনুকুলে আসেনি। ১২ মে ১৯৯৩ বুধবারে দুপুরে হঠাৎ বিশ্বনাথ থেকে সিলেট ওরশ দেখার জন্য রওয়ানা হই। সিলেট চৌহাট্টা থেকে মানুষের ঢল দেখি! রাস্তার দু’পাশে রকমারি দোকান-পাঠ সারিসারি। আনন্দ উদ্দীপনায় দরগায় যাওয়ার মূল ফটক অতিক্রম করি। মাজারের নিচে দক্ষিণ পাশে ব্যাঙের ছাতার মত তাঁবু দেখি। কোন কোন তাঁবুতে তুমুল বাদ্যে সুরে বেসুরে গান চলছে। কোন তাঁবুতে কেউ কেউ গাজা টানছে। আবার কেউ কেউ ঝিমুচ্ছে ঘুমে কিংবা নেশায়। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে ভয় এসে যায়। আমার কাছে মনে হয় যে কোন সময় এখানে আল্লাহর গজব আসতে পারে! যত সম্ভব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যাই। এতদিনের ওরশ দেখার আনন্দ ক্ষণিকের মধ্যে মলিন হয়ে যায়।
১৯৯৫ সাল থেকে কয়েক বছর দরগার পাশ্ববর্তী রাজারগলি অবস্থান করি। ঐ কয়েক বছরে দরগা সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় জানার সুযোগ হয়। প্রতি বৃহস্পতিবারে সপ্তাহিক ওরশ থাকে। রাতে দরগার উত্তর পাশে গানের আসর বসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ বৃহস্পতি বারে আসে। কেউ কেউ জিয়ারত ও শিরনি বিতরণ করে পাশ্ববর্তী হোটেলসমূহে অবস্থান করেন। আবার কেউ কেউ মাজার আঙ্গিনায় রাত যাপন করেন। ভক্তদের প্রবল ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত মাগরিব ও এশার নামাজের সময় তাদের সাথে মিশে যেতাম। তাদের কার্যকলাপ উপভোগ করতাম। পুকুর পাড়ে ভক্তরা আলাপ প্রসঙ্গে বলেন, এই পুকুরে কোন তলদেশ নেই। কেউ কোনদিন খুঁজে পাবেনা। ভক্তদের এমন বিশ্বাসের বিপক্ষে কথা বলার সাহস ছিল না। কিন্তু ১৯৯৭ সালে পুকুরটি পুনঃখননের জন্য সেচ করা হয়। পুকুরের পানিতে গজার মাছ মরে যাচ্ছিল। মাছগুলি মুফতি বাড়ির একটি পুকুরে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেও মাছগুলি ভেসে বেড়াতে দেখেছি। ভক্তদের মনে হয়তো শক্ত আঘাত লেগেছে, যারা এতদিন বলেছেন পুকুরের কোন তলদেশ নেই!
সিলেটের মাটি ইসলামের ঘাঁটি থাকবে চিরকাল, এই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন হজরত শাহ্জালাল (র.)। তাঁর পাক কদমের বরকতে বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট, ইসলামের বিজয় নিশান উড়েছিল। সাতশত বছর পরেও দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত মুরিদান এখানে আসেন। প্রতিদিন তাদের পদচারণায় মুখরিত থাকে সিলেটের বিভিন্ন জনপদ। তারা মাজারে এসে মহান ওলির সাহায্য নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। মাজারের সংরক্ষিত কক্ষে শাহজালাল’র (র.) ব্যবহৃত বস্ত্র, খড়ম, তলোয়ার, সাজানো রয়েছে। এসব ভক্তরা অশ্র“ সজল চোখে দেখেন। মাজার প্রাঙ্গণে পুকুরে বৃহৎ আকৃতির গজার মাছ আছে। এগুলো হযরত শাহজালাল’র (র.) রেখে যাওয়া মাছের বংশধর। তাই আগত ভক্ত আশেকানরা গজার মাছকে খাবার বিলিয়ে দেয়। এসব মাছ কেউ খায় না বরং মরে গেলে মাটিতে পুতে রাখা হয়। তবে মাছের সংখ্যা ক্রমাগত ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। গজার মাছ সম্পর্কে দু’টি তথ্য দু’টি বইয়ে পেয়েছি। প্রথমটি: হযরত শাহজালাল’র (র.) সফর সঙ্গী গাজী শাহ বিকেলে সুরমা নদীতে বড়শি ফেলে গজার মাছ ধরে আনতেন। একদিন শাহজালাল (র.) নদীতে ওযু করতে গেলে মাছেরা তাঁকে অভিযোগ করে। তিনি বলেন, তোমরা বড়শির আদার না খেলে পারো! মাছেরা বলে, আমরা সারাদিনের উপোস থাকি। ক্ষিধের জ্বালায় বড়শি খেয়ে ফেলি। আর একেক করে ধরে নিয়ে খান। তিনি বলেন তোমরা একত্রে এসো ! তোমাদের নিয়ে পুকুরে রাখব! আর কেউ খেতে পারবেনা।
দ্বিতীয় মত হল; হযরত শাহজালাল (র.) হুজরার কাছে পুকুরে ওযু করতেন। একদা দেখেন গজার মাছের কিছু পোনা খেলা করছে। মরুর দুলালের দেখে খুব মায়া লাগে। তিনি সঙ্গীদের বলেন, এগুলো কেউ খাবেনা। ঐ মাছের বংশধর বর্তমান গজার মাছ। কোনটি সত্য বলার উপায় নাই। ওলিদের কারামত বলে কথা। ওলিদের কারামত সত্য। দ্বিতীয় মতটি অধিক গ্রহণ যোগ্য হবে মনে হচ্ছে। মাজারের পশ্চিম পাশে একটি কূপ (ইদারা) রয়েছে। এ
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:১৪
চারুপাঠ বলেছেন: ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
২| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:০২
শাহ সোহেল বলেছেন: স্মৃতির প্রতি প্রীতি
গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি।
সত্যিই স্মৃতিগুলো আমাদের মনে আসন করে আছে।
কখনো প্রকাশ করা যায়
কখনো যায়না।
লেখক করতে পেরেছেন।
পান্ডুলিপি আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিল।
বই আকারে পড়তে পারলে অনেক ভালো লাগবে।
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:১৭
চারুপাঠ বলেছেন: আপনার শুভ কামনার জন্য ধন্যবাদ।
৩| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:০৯
জয়নাল আবেদীন বলেছেন: অভিনন্দন যদিও পড়া হয়নি। উল্লেখযোগ্য সূচিপত্র দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেক বিষয়ের অবতারনা হয়েছে। যা পাঠক হিসেবে পড়তে ভালো লাগবে।
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:১৭
চারুপাঠ বলেছেন: সাধুবাদ জানাই পড়ার জন্য।
৪| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:২০
ফয়জুল আলম বেলাল বলেছেন: নিজের ঢোল আরা কি বাজাব! চারুপাঠ সহ সবাইকে ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৫৫
মুহিব ইরম বলেছেন: স্মৃতির প্রতি প্রীতি
গ্রন্থের প্রতি আমারও প্রীতি রইল।
সাফল্য কামনা করি।