নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
একটা বেগুনি রঙের শর্ট পাঞ্জাবি পরেছে।বের হয়েই রিকশা খোঁজা শুরু করল। এক রিকশা না। কয়েকটা রিকশা দরকার। সবচেয়ে ভাল হয় রিকশা স্ট্যান্ড হলে।নাসিফ গিয়ে রিকশাচালকদের সামনে কতক্ষণ ঘুরাঘুরি করবে। যদি কয়েকজন বলে, " মামা কই যাবেন? "
তার মানে নাসিফকে দেখতে সুন্দর লাগছে। চেহারায় একটা সাহেবি ভাব আছে। স্মার্টনেস এর একটা ব্যাপার আছে।আর যদি কেউ না জিজ্ঞেস করে। মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। তার মানে চেহারায় পাগলা ভাব আছে। ফকিরা ভাব আছে। একে রিকশায় নিলে, ভাড়া না দিয়ে ভাগবে। না হয় জীবনেও রিকশায় চড়ে নায় টাইপ ভাব আছে। একদিন খুব শখ করে একটা লাল জামা পরে বের হল। লক্ষ্য ছিল রিকশা চালকরা হুমড়ি খেয়ে ডাক লাগাবে, মামা কই যাবেন?
না তা হল না। কেউ ডাকলই না। একজন ডাকল। তাও তুমি সম্বোধনে।
"কি যাবা নি?"
কি যে অবস্থা। লাল জামায় ষাঁড় আকৃষ্ট হয়। রিকশা না। সেদিন এই ধারণাটা জন্মেছে।
আজ কতক্ষণ ঘুরাঘুরির পর অনেক রিকশা চালকই ডাক দিল। তার মানে দেখতে একদম ঠিকঠাক। রিকশাতে চড়তে হবে না। হেঁটেই যাওয়া যাবে এইটুকু পথ।
ঐশী। ভালবাসার মানুষটা। কাল ভালবাসার এক বছর হচ্ছে। ভালবাসা সময় বুঝে হয় না। তবুও যেদিন দুজনের সায় আসে ভালবাসার ব্যাপারে সেই দিনটা ভালবাসা বার্ষিকী। কাল নাসিফ আর ঐশীর ভালবাসা বার্ষিকী। এক বছর। হুট করে চলে গেল। কাল তো মেয়েটাকে কিছু দিতে হয়। পছন্দ অপছন্দ নিয়ে প্রথম প্রথম খুব মাথা ঘামানো হত। কিছুদিন পর থেকে ভালবাসাময় কথা ছাড়া আর কিছুই হয় না। তাই সময় করে জিজ্ঞাসাও করা হয় না, " এই মেয়ে তুমি ভালবাসা বার্ষিকীতে কি পেলে খুশি? চকলেট না ফুস্কা? "
ধাৎ এসব কি ভালবাসা বার্ষিকীতে দিলে হয় ? ভাল কিছু দিতে হবে।ভাল কিছু কিনবার জন্য যাচ্ছে নাসিফ। ভাল মার্কেটে। বসুন্ধরা সিটিতে।
এক বছর আগের কথা।তার থেকে একটু আগে। এই এক বছর মাস খানেক হবে। একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায় নাসিফ।নিজের মেধা গুনে অনেক জনপ্রিয় শিক্ষক কোচিং সেন্টারটার।এডমিসন কোচিং। তাই ঠিক জনপ্রিয় শিক্ষক না। জনপ্রিয় ভাইয়া। নাসিফ ভাইয়ার ক্লাস মানে অন্য কিছু।কথা শুনতেই ভাল লাগে। পড়া মাথার ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। পড়া না বুঝুক। অনেকের লক্ষ্য নাসিফ ভাইকে দেখা। কিছুক্ষণ তার কথা শোনা। দেখতে আহামারি কিছু না। তবুও ভাল লাগে দেখতে, কথা শুনতে। ঐশীরও লাগে। সব ক্লাস সপ্তাহের মিস দিলেও নাসিফ ভাইয়ার ক্লাস কখনও না। কয়েকবার গিয়েছিল নাসিফ ভাইয়ার কাছে নাম্বার নেবার জন্য। কিন্তু ব্যাটা সারাক্ষণ মেয়ে নিয়েই থাকে। একটুও একা পাওয়া যায় না। যেন বাংলা সিনেমার ভিলেন। দুই বগলের নিচে দুই মেয়ে নিয়ে ঘুরে। কি অশ্লীল অবস্থা। অবশ্য ভাইয়ারও বা কি দোষ? সারাক্ষণ মেয়েরা ঘুর ঘুর করলে উনিও বা কি করবেন। নাহ, উনি না। উনি শুনতে যেন কেমন লাগে। ও বলব। বাহ কি আপন আপন লাগছে। ও অনেক ভাল ছেলে আমি জানি।ঐশী নাসিফকে দেখে আর ভাবে।
ঐশীকে দাড়িয়ে নাসিফের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কয়েকদিন নাসিফ জিজ্ঞেস করেছে, " কিছু বলবে? "
ঐশী এত মেয়ের সামনে কিছু বলবে না। তাই মাথা নেড়ে বলে, না ভাইয়া।
নাসিফ মুখ ঘুরিয়ে আবার ব্যাস্ত।
নাসিফ ভাইয়া কোচিং এর বাইরে পড়াবে। ব্যাচ করে। দুর্বলদের জন্য। ঐশীও দুর্বল। পড়ালেখায় না। নাসিফের প্রতি। তাই ব্যাচে ভর্তি হল। নাম্বারটাও চেয়ে নিল। প্রতি রাতে নিয়ম করে একবার কল করে। কথা বলে না। সুন্দর করে কিছুক্ষণ ধমক দিয়ে নাসিফ রেখে দেয়। ছেলেটা রাগ করেও বকা দিতে পারে না। ধমকেরও ভালবাসায় পড়ে যায় ঐশী।ভালবাসার মানুষের সব ভাল লেগে যায়। ঐশীরও লাগছে। ভালবেসে ফেলেছে নাসিফকে?
বলেই দিবে তাহলে। এভাবে নিশ্বাস শুনালে জীবনেও ভালবাসা হবে না। অন্য কাউকে ভালবেসে নাসিফ ভাইয়া হারিয়ে যাবে।আর পাবে না।
পরদিন কল করল ঐশী।নাসিফ মোবাইল ধরে বলা শুরু করল। বকা। মিষ্টি বকা।সুন্দর ধমক।
- আপনি এতো বেহায়া কেন? আপনাকে প্রতিদিন এতো খারাপ কথা বলি। তাও কল করেন। আপনার কি লজ্জা শরম কম? আর বোবা মানুষ আপনি মোবাইল কেন চালান বুঝি না। আমার কথা কি আপনার গায়ে লাগে না?
- লাগে, তবে গায়ে না। বুকের ভিতর। আপনি এতো এমন কেন? বকাও দিতে পারেন না। আর আপনি এত বিরক্ত হলে আমার কল প্রতিদিন রিসিভ করেন কেন?
কণ্ঠ শুনে নাসিফেরও বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠল। এতো মিষ্টি কণ্ঠ খুব কমই শুনেছে জীবনে।মেয়েটা তো সামনাসামনি এত সুন্দর করে কথা বলে না। মোবাইল এ এতো ঢং করে ,আর মিষ্টি করে বলছে কেন?
- ঐশী? ঠিক তো?
ঐশী জিহ্বায় একটা কামড় দিল। ভাইয়া বুঝল কি করে? ওপাশ থেকে নাসিফ বলে যাচ্ছে, " আমার কেন যেন প্রথম থেকে মনে হচ্ছিল। এই কাজটা তুমিও করছ। আচ্ছা বল এখন কি ব্যাপার? "
ঐশীর বুকের উঠানামা বাড়ছে। নিশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। যতই ভয় হোক। আজ বলে দিবে ঐশী।
- ভাইয়া একটা কথা বলব।
- বল। এতো দিনের নীরবতা ভাঙো।
-আমি আপনাকে ভালবাসি। i love u.আমি অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারি না। সোজা করে বললাম। ভালবাসি আপনাকে।কেন ভালবাসি জিজ্ঞেস করবেন না।
এমন কথা শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নাসিফ। কি বলা উচিৎ। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। তাও বলে দিল- আমাকে ভালবাসার কিছু নেই।
- না থাকুক। আমি ভালবাসি। কি আছে না আছে সেটা আমি দেখব। আপনি বাসেন কিনা বলেন।
- হুম ঠিক আছে।
- কি ঠিক আছে?
- আমিও বাসি।
ঐশী একটু অবাক হল। সন্দেহ হচ্ছে। এত সহজে রাজি হয়ে গেল কেন? ঐশী ঠিক করে রেখেছিল। আজ যতক্ষণ পর্যন্ত নাসিফ রাজি না হবে কতক্ষণ পর্যন্ত ভালবাসি বলতে থাকবে। আর এ কিনা বলার আগে রাজি হয়ে গেল। হুট করে মোবাইল কেটে দেয় ঐশী।
একটু পরেই মেসেজ, " জান্টুস আমার। তোমাকে অনেক ভালবাসি।"
মেসেজের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। কাকে মেসেজ পাঠিয়েছে এটা। একজনের সাথে প্রেম করে আবার নাসিফকে পটানোর চিন্তা। আবার মেসেজ, " নাসিফ, জান্টুস। কি হল তোমার? আমার না কথা বলতে লজ্জা করছে। রিপ্লাই দাও না।"
মেয়ে তো ভারী বেয়াদব। ভালবাসি বলে দিছে আর আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। কবে না জানি তুই তোকারি করে। আর জান্টুস। এসব কি ভাষা।
ভালবাসা শুরু সেই থেকে। জান্টুস ডাকতে ডাকতে এক বছর চলে গেল। মাঝে মাঝে অভিমান হলেই ঐশী তুই তোকারিতে চলে আসে। আর নাসিফ বলে, " ভালবাসতে তো তুমিই আসছিলা। আমি আসছিলাম?"
- আর তুই যে বলার আগে রাজি হয়ে গেছিস? সব ছেলে যে একরকম আমি জানি। মেয়েরা বললে আর ঠিক থাকতে পারে না।
- আমার তো তোমাকে আগে থেকে ভাল লাগত। তাই বলার সাথে সাথে রাজি হয়ে গেছি।
- থাক আর ভাব ধরিস না। তুই মেয়ে দেখলেই আড় চোখে তাকাস আমি তা জানি। ফাজিল।
সময়ে অসময়ে ঝগড়া, অকারনেই মিটে যায়। হারাবার ভয়ে ভালবাসা আঁকড়ে ধরে।
এক বছর নিমিষে কেটে গেছে।উপহার কি দিবে ভেবে পায় নি নাসিফ।পকেটের অবস্থা ভাল। মাসের প্রথম। কোচিং আর ব্যাচের টাকা পেয়েছে।যাক ভাল সময়ে প্রেম হয়েছে।মাসের প্রথমে। হাতে পকেটে টাকা থাকে। মাসের শেষে হলে বিপদ ছিল।গিফট কেনা সমস্যা হয়ে যেত। মাসের প্রথমে অনেক টাকা থাকে। বাসায় পাঠাতে পারে। বন্ধুদের নিয়ে পার্টি দিতে পারে।ইচ্ছা মত ঐশীকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট এ যেতে পারে।আর মাসের শেষে টানাটানি।
নাসিফ হেঁটে যাচ্ছে।বসুন্ধরা সিটিতে।রিকশাতে না হেঁটে। অনেক মানুষের ভিড়।রাস্তায় যাবার পথেই এক বাচ্চা ছেলেকে দেখল নাসিফ। বয়স বেশি না। ৫ কি ৬ হবে।অন্য সবার মত না। এখানে যারা আসে, বেশির ভাগই ঘুরতে কিংবা শপিং করতে।গাঁয়ে দামি অথবা সবচেয়ে ভাল পোশাক।এই বাচ্চা ঘুরতে বা শপিং করতে কোনটাই করতে আসে নি। গায়ে দামি পোশাক ও না।উপরে পোশাক আছে। নিচে নেই।একটা জামা পরা। তাও অনেক পুরাতন। আর নিচে কিছু নেই। কি অবস্থা। লজ্জা শরম মনে হয় একটু কম।নাসিফের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল," ভাই, সকাল থেকে কিছু খাই নায়।কিছু টাকা দেন না।"
নাসিফ পকেট থেকে একটা ১০ টাকার নোট বের করল। হাতে দিয়ে বলল, " ৫ টাকা ফেরত দে।"
- নাই তো।
- আচ্ছা, রাখ তাহলে। যাবার সময় তোর থেকে নিয়ে যাব।ভাংতি করে রাখবি।
কিছু না বলে জামার পকেটে টাকা রেখে দিল। প্যান্ট নাই তাই পকেটেও নাই। নাসিফ ঢুকে গেল বসুন্ধরায়। এখনও ঠিক করতে পারেনি। কি দেয়া যায়? ভাল কোন ড্রেস। পারফিউম।দেয়া যাবে যা দেয়ার।ঘুরছে আর জামা কাপড় দেখছে নাসিফ। মেয়েদের না। ছেলেদের জামা কাপড়। শার্ট, টি শার্ট, পাঞ্জাবি। প্যান্ট, জিন্স। জিন্সের দিকে তাকিয়ে আছে নাসিফ। পায়ের কাছে, হাঁটুর কাছে ছেড়া।এখনকার ফ্যাশন। মনে মনে একটু হাসল। হঠাৎ করেই মাথায় বাহিরের ঐ প্যান্ট ছাড়া ছেলের কথা আসল। কেন আসল জানে না। জিন্সটার দিকে আর একবার তাকাল। বুকের ভিতর কেমন যেন করছে। মাথার ভিতর সরু একটা ব্যথা অনুভব করছে। পিছনের অনেক কথা অনেক স্মৃতি মাথার ভিতর নানা দিক থেকে ঢুকছে। স্মৃতিগুলো এই নাসিফের না। এই দামী পাঞ্জাবি পরা নাসিফের না। এই স্মৃতি ক্লাস ফোরে পড়া নাসিফের। ভাঙা টিনের ঘরে থাকা নাসিফের।তিন বেলা না ২ বেলা খাওয়া নাসিফের।পকেটে টাকা থাকা নাসিফের না। টাকা পয়সা ছাড়া নাসিফের। ছেড়া পকেটের নাসিফের।
বাবা মায়ের অনেক ইচ্ছা ছেলেকে নিয়ে। পড়ালেখা করাবে। বাবার মত রোদের মধ্যে ঘাম ঝরিয়ে যেন কাজ করতে না হয়। এসিতে বসে থাকতে পারে।এই স্বপ্ন থেকেই ছেলেকে ভর্তি করল এলাকার সবচেয়ে ভাল স্কুলে।নাসিফের বাবা দালান বানানোর মিস্ত্রির সহযোগী।লেভার বলে সবাই। দিনে ৭০ টাকা বিল পায়।তাতে চলে কোনমতে। কোনমতে চললেও ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানো যায় না।তাই একটু ধার দেনা করতেই হয়। ছেলের পড়ালেখা বন্ধ করা যাবে না।প্রতি বছর প্রথম মাসে স্কুলে অনেক গুলো টাকা দিতে হয়। নাসিফের পরিবারের অবস্থা ভাল না। তাই টাকার অর্ধেক দিতে হয়। তবুও অনেক টাকা।এতো টাকা যোগার করতে ধার করতেই হয়।নাসিফের সাথে যারা পড়ে সবাই অনেক ভাল পরিবারের ছেলে।সবার বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল।নাসিফ অত ছোট বয়সে অত কিছু বুঝে না।সহপাঠী মানে বন্ধু। সবার সাথেই মিশে বন্ধু হিসেবে।কিন্তু সবাই একটু একটু দূরে থাকে নাসিফের থেকে। নাসিফ ঠিকই বুঝে ব্যপারটা। নাসিফকে প্রতিদিন বাসা থেকে ২ টাকা করে দেয়। স্কুলে এসে সামনের দোকান থেকে একটা বাটার বন খায়। সাথের বন্ধুরা অনেক দামি খাবার খায়। কিন্তু নাসিফের কখনও তা খেতে ইচ্ছা করে না। কেন করেনা জানে না। বাবা মাত্র ২ টাকা করে দেয় স্কুলে আসার সময় ।তা নিয়েও মন খারাপ হয় না।তবে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মিথ্যা বলতে হয় নাসিফের। নাসিফের মিথ্যা বলতে ভাল লাগে না। সেদিন বাবা ঘরে ছিল।সাথে নাসিফ। মা ঘরে ছিল না।বাবা আজ কাজে যায় নি। শরীরটা একটু অসুস্থ।মাসের প্রথম দিক।ঘরের বাহির থেকে কেউ একজন ডাকছে।
" নাসির মিয়া, ঘরে আছ? ও নাসির মিয়া।"
মাসের প্রথমে এমন অনেকেই আসে। ধার করা টাকা ফেরত নেবার জন্য। নাসিফ বাবার মুখের দিকে তাকাল। কোন এক ভয়ে বাবার মুখ কুঁকড়ে গেছে। অসুস্থ শরীরের মুখটা আরও শুকনা লাগছে।নাসির মিয়া, নাসিফের বাবা। নাসিফকে কোলের কাছে এনে বলল,
" বাবা, আজ একটু মিথ্যা বল। বলবি আব্বু ঘরে নাই। বাহিরে কাজে গেছে। পারবি না? "
নাসিফ মাথা নেড়ে বলল পারবে। বাবা তড়িঘড়ি করে অসুস্থ শরীর নিয়েই খাটের নিচে ঢুকে গেল,কাঁথা গায়ে দিয়েই।নাসিফ হা করে তাকিয়ে তা দেখছে। যদি ঘরে চলে আসে পাওনাদার। সেই ভয়ে খাটের নিচে লুকাচ্ছে নাসির মিয়া।নাসিফ আবারও শুনল বাবাকে ডাকছে বাহির থেকে। বের হয়ে পাওনাদারকে বলল,
" আঙ্কেল, আব্বু তো ঘরে নাই। কাজে গেছে।"
- ব্যাটা। টাকা নেয়ার সময় মনে থাকে না। তোমার আব্বু আসলে বলবে আমি আসছিলাম।
- আচ্ছা।
লোকটা বির বির করে কি বলতে বলতে যেন চলে গেল। ঘরে যাবার পর নাসিফ দেখল, বাবা এখনও খাটের নিচে। সুখ কষ্টের অনুভুতি খুব একটা আসে নি তখনও। বয়স তো অত বেশি না নাসিফের। এই বয়সে শুধু খাবারের জন্য কষ্ট হয়। খেলনার জন্য কষ্ট হয়। এসব দেখে না। তবুও মনে হচ্ছে হঠাৎ করে নাসিফ অনেক বড় হয়ে গেছে। খাটের নিচে বাবার গুটিসুটি মারা কাঁথার উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল নাসিফ। শব্দ করে কাঁদছে। বাবাও নীরবে কাঁদছে। বাবা বলল, " আব্বুকে পচা কথা বলছে তাই খারাপ লাগতেছে?"
নাসিফ কিছু বলে না। নীরবে কাঁদে। একটু পর বলে, " আব্বু ,আমি পড়াশুনা করব না আর। আমিও কাজ করব। আমার খুব কষ্ট হয়।"
বুকের উপর হাত রেখে বলে,
" এখানে খুব ব্যথা করে। তোমাকে কেউ কিছু বললে। "
- আরে পাগল ছেলে। কাঁদে না। তুই অনেক বড় হবি। তখন আর কেউ পচা কথা বলবে না। আর কষ্ট থাকবে না।পড়ালেখা করে বড় হবি তুই।
- আব্বু, আমি বড় হলে আর তোমার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে হবে না।
এবার বাবা চুপ করে থাকে। বুকের সাথে অনেক শক্ত করে চেপে ধরে নাসিফকে।
অসুস্থ শরীর নিয়েই সেদিন কাজে যায় বাবা।বাসায় ফিরে আসে খোঁড়াতে খোঁড়াতে। পায়ে ইট পরে ৩ টা নখ থেতলে গেছে।কাজ করা বন্ধ।২ মাসের মত কাজ করতে পারে না বাবা। এই মাস খানেক অনেক কষ্টে কাটে। অনেক বেশি কষ্টে। মা নাসিফের এক বন্ধু হাসিবের বাসায় সকালে যায় একবার। বিকালে যায় একবার। হাসিবের মা নাসিফকে অনেক পছন্দ করে। মা ঐ বাসাতেই টুকটাক কাজ করে দিয়ে আসে। বিনিময়ে খাবার নিয়ে আসে।মাঝে মাঝে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে নাসিফ। বাবা এই শরীর নিয়েই কাজে যেতে চায়। নাসিফ যেতে দেয় না। এখন আর আব্বু ২ টাকা করে দিতে পারে না। তবু কষ্ট হয় না নাসিফের। কষ্ট লাগে সেদিন। নাসিফের এক সহপাঠীর জন্মদিন।সবাইকে দাওয়াত দেয় লুকিয়ে লুকিয়ে। নাসিফকে দেয় না। নাসিফকে এসে আর একজন বলে,
" জনি তোকে দাওয়াত দেয় নায় কেন জানিস? তুই ওর জন্মদিনে কিছু দিতে পারবি না তাই।"
ক্লাস ফোরে পড়া বাচ্চাদের মধ্যে এসব আসার কথা না। তবুও আসছে।অহংকার আসছে। কারও প্রতি তাচ্ছিল্য আসছে। নাসিফ সেদিনও ঘরে গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁদে। কষ্টে কাঁদে। বন্ধুর জন্মদিনে কিছু দিতে পারবে না তাই দাওয়াত দেয় নি। তাই কাঁদে।
বেশ কয়েকদিন ধরেই শার্ট ইন করে স্কুলে যেতে পারে না নাসিফ। প্রতিদিন স্কুলে কান ধরে দাড়িয়ে থাকে। স্যার বলে শার্ট ইন কর না কেন?
নাসিফ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না।
প্যান্টটা পিছন থেকে ছিঁড়ে গেছে অনেক খানি। আম্মু তালি লাগিয়ে দিছে। ইন করলে তালি দেখা যাবে। সবাই হাসাহাসি করবে। আব্বু অসুস্থ। এখন নতুন প্যান্ট শার্ট কিনে দিতে পারবে না। নাসিফ অনেক বুঝে এখন। অনেক বেশি। আজ সকালেও তালি দিয়ে দিয়েছে আম্মু আর একটু প্যান্টে। অল্প একটু ছিঁড়ে গেছিল।
ক্লাসে কান ধরে দাড়িয়ে আছে।স্যার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, " তুমি প্যান্ট ইন কর না কেন?"
নাসিফ চুপ।
" কথা কানে যায় না? প্যান্ট ইন কর এখন।"
নাসিফ তাও চুপ।
স্যার খুব রাগি। নাসিফের গালে একটা ঠাস করে চড় মেরে বলে,
"প্যান্ট ইন কর।"
নাসিফ গালে হাত দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলে,
" স্যার আমার প্যান্ট ছেড়া পিছন দিয়ে।"
ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠে। যেন কত মজার কথা বলেছে নাসিফ।স্যার সবাইকে ধমক দিয়ে থামিয়ে নাসিফকে বসিয়ে দেয়। আর বলে, " হেড স্যারের থেকে অনুমুতি নিয়ে এস। "
নাসিফ বসে যায়। গালে হাত দিয়ে থাকে।
ক্লাস শেষে সবাই কি যেন পরামর্শ করছে। নাসিফকে বাদ দিয়ে। কিছুক্ষণ পর নাসিফকে ডাকে সবাই।একজন বলে, " নাসিফ তুই চোখ বন্ধ কর। একটা জিনিস দেখাবো তোকে। "
নাসিফ সরল মনে চোখ বন্ধ করে। একটু বোকাই নাসিফ।ও চোখ বন্ধ করার পর। সবাই ওর জামা উচু করে প্যান্ট দেখে। তালি দেয়া প্যান্ট। দেখে হাসে। হো হো করে হাসে। সবাই হাসে। শুধু নাসিফ মুখ গোমড়া করে থাকে। ক্লাস ফোরের সহপাঠীদের কাছে এটা ছিল মজার জিনিস। নাসিফ সেদিনও বাসায় গিয়ে কেঁদেছে।আব্বু আম্মুকে কিছু বলেনি। সহপাঠীরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। স্যার মেরেছে।পায়ের কাছে খুব ব্যথা।মোজা ছিঁড়ে গেছে। খালি জুতা পরতে কষ্ট হয়। তবুও বলে না কিছু। বললেই বাবা অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে চলে যাবে।সেদিন রাতে আব্বু আম্মুর মাঝে শোয় নাসিফ, আব্বু আম্মুকে বলে। দু জনের গায়ে দুটা হাত দিয়ে ঘুমায়। ঘুমাবার আগে কাঁদে। চোখ বেয়ে পানি কানের পাশ দিয়ে পরে যায়। বাবা মা বুঝে নাসিফ কাঁদছে। কিছু বলে না। দু পাশ থেকে দুজন জড়িয়ে ধরে। নাসিফের অনেক শান্তি লাগে তখন। কিছু স্পর্শে অনেক সুখ। কিছু না পাওয়ার মধ্যেও ভালবাসা পাওয়া যায়।সুখ শুধু বিলাসিতায় না।ভালবাসায় শুধু বিলাসিতা থাকে না। ভাঙা ঘরের মধ্যেও থাকে। বাবাকে কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য, একটা বাচ্চা ছেলের অনেক কিছু বুঝে যাওয়াতে থাকে। মায়ের হাতের তালি দেয়া প্যান্টেও থাকে। কিছু নীরব জল কান ঘেঁষে ঝরে পড়তে পারে। তবুও কিছু মায়ার হাত যে জল মুছে দেবার জন্য থাকে। আঁকড়ে ধরার জন্য থাকে। ভালবাসার জন্য থাকে। কষ্ট সারাজীবন দানা বেঁধে বসে থাকে না। কষ্টের অবসান হয়। ভালবাসা অন্তহীন। কষ্ট অন্তহীন না।
বসুন্ধারায় ছেড়া প্যান্ট দেখে মাথার ভিতর ঝিম ঝিম করে এই স্মৃতিগুলোই ঢুকছে। সাথে মনে পড়ছে ঐ প্যান্ট ছাড়া ছেলেটার কথা। এক দৌড়ে বাহিরে চলে আসল নাসিফ। ছেলেটাকে খুব দরকার। খুব করে খুঁজছে ছেলেটাকে। অবশেষে পাওয়া গেল। নাসিফকে দেখে দৌড়ে পালাচ্ছিল। নাসিফ ধরতেই বলল, " ভাই , ভাংতি নাই। ১০ টাকা রাইখা দেই আমি?"
নাসিফ হাত ধরে বলল, " তোর টাকা ফেরত দিতে হবে না।এই মার্কেটের ভিতরে গেছিস কখনও?"
- না, ঢুকবার দেয় না।
- আমার সাথে চল।
নাসিফ প্যান্ট ছাড়া ছেলেটাকে নিয়ে ঢুকে বসুন্ধারা সিটিতে।গার্ড প্রথমে প্যান্ট ছাড়া ছেলেকে ঢুকতে না দিলেও। পরে নাসিফের জোরাজুরিতে ছেলেটাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ছেলেটা নাসিফের হাত ধরে আছে।স্বপ্নের মত লাগছে সব। নাসিফ বলেছে, যা পছন্দ হবে বলবি।কিনে দিব।
সবাই অবাক হয়ে দেখছে। দামি পাঞ্জাবি পরা এক ছেলের সাথে প্যান্ট ছাড়া এক ছেলে হাঁটছে।নাসিফ চায় না ওর মত কাউকে নিয়ে বন্ধুরা হাসুক, ছেড়া প্যান্টের জন্য।আর প্যান্ট ছাড়া ছেলেটা চোখের সামনে স্বপ্ন দেখছে। যে স্বপ্ন ইচ্ছা করলেই ছুঁয়ে দেখা যায়। নাসিফ দেখছে ওর স্মৃতি। যে স্মৃতিতে কষ্টের সাথে সুখ আছে।বাবা মার কথা খুব মনে পড়ছে। নাসিফ কিছুটা হলেও পেরেছে। বাবাকে এখন আর খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে হয় না।মায়ের অন্যের বাসায় কাজ করে খাবার আনতে হয় না। নাসিফেরও ছেড়া মোজায় পায়ে কষ্ট পেতে হয় না। বন্ধুরা ছেড়া প্যান্ট দেখে হাসে না।আজই বাসায় যাবে নাসিফ। বাবা মায়ের মাঝে শুয়ে কাঁদবে। চোখ বেয়ে পানি কান ঘেঁষে পরে যাবে। আর বাবা মা সেই আগের মত দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে।ভালবাসি বলবে বাবা মাকে।
কাল নাসিফ আর ঐশীর ভালবাসার এক বছর হচ্ছে। কিছু তো দিতে হয় মেয়েটাকে। কি দিবে? বাবা মায়ের কাছে গিয়ে একসাথে ৩ জনকে ভালবাসি বলবে।মন থেকে ভালবাসার চেয়ে বড় উপহার আর কিছু নেই। বিলাসিতায় শুধু ভালবাসা না। ভালবাসা মনের ব্যাপার।কিছু দেখে তা হয় না।প্রেমিকার মিষ্টি কথায় ভালবাসা আছে। বাবা মায়ের হাতের ছোঁয়ায় ভালবাসা আছে। হুট করে কান ঘেঁষে পানি পরে যাওয়ায় ভালবাসা হারায় না। একটা কষ্টের রাতের শেষ সুখের সকাল আসবেই।শুধু নাসিফের বাবা মার মত কাউকে পাশে থাকতে হয়।
©somewhere in net ltd.