নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ তবুও ভালবাসা

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৪

নিশা এসে চুপ করে বাবার পিছনে দাঁড়িয়েছে। বাবা পত্রিকা পড়ছেন।চোখে চশমা পরে। তিনি দিনে একবার চোখে চশমা পরেন, এই পত্রিকা পড়বার সময়। এখন তাকে কিছু বলা যাবে না। বললেই রেগে মেগে শেষ। নিশার বাবা দেশ সম্পর্কে যতটা সচেতন। নিশার মনে হয় না দেশ যারা চালায় তারাও এতো সচেতন। পত্রিকা নিবেন, এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত পড়বেন, প্রথম পাতা শেষ করে তবেই দ্বিতীয় পাতায় যাবেন,খবরের বাকিটুকু মাঝের পাতায় থাকলেও তিনি পাতা উল্টাবেন না,যে পাতায় যে টুকু খবর থাকে তিনি তাই পড়েন। একটা একটা করে পাতা শেষ করবেন। এভাবে কেউ পত্রিকা পড়ে কিনা জানা নেই।পত্রিকা শেষ করে চা খাবেন এক কাপ।চা খেতে খেতে বলে যাবেন, এই হচ্ছে দেশে, ঐ হচ্ছে দেশে। দেশটা গেল। একেবারেই গেল।

নিশার পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তবু বাবাকে ডাকছে না। বাবাকে পরিবারের সবাই ভয় পায়। নিশাও পরিবারের কেউ। তাই ও ও বোধহয় একটু আধটু পায়। বাবা পত্রিকা শেষ না করেই মেয়ের দিকে তাকালেন।

- কিছু বলবে?

- না আব্বু, আপনি পত্রিকা পড়ে শেষ করেন। তারপর বলছি।

- আজ পত্রিকা পড়ে শান্তি পাচ্ছি না। কোমরে ব্যথা করছে। বল কি বলবে।





বাবা পত্রিকা নামিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। নিশা কিছুটা ইতস্তত করছে কথাটা বলতে। তবুও বলেই দিল,

- আব্বু আমার কিছু টাকার দরকার ছিল।

বাবা শান্ত চোখে বললেন, কি কারণে?

-জি আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন।ওকে একটা উপহার দিতে চাচ্ছিলাম।

-জন্মদিনে উপহার দিতেই হবে এমন কোন নিয়ম আছে? তোমাকে মোবাইল কিনে দেয়া হয়েছে। রাত ১২ টায় ঘুম থেকে উঠে, ১২ টা ১ মিনিটে ৫৮ পয়সা খরচ করে একটা মেসেজ দিবে তোমার বান্ধবীকে, শুভ জন্মদিন লিখে। ইচ্ছা করলে একটা কবিতাও দিয়ে দিতে পার সাথে।

-আমার অন্য সব বান্ধবীরা উপহার দিবে। তাছাড়া আমার গত জন্মদিনে যে উপহারটা পেয়েছি, তাও ও ই দিয়েছে।

- তুমি এতো বুঝ কেন? আমি কোন টাকা দিতে পারব না।তোমার অন্য বান্ধবীর বাবার টাকা আছে।তোমার বাবার নেই।আর 'ও' 'ই' করছ কেন? তোমার বান্ধবীর নাম নেই?

- আছে । তা আপনার জানতে হবে না।আর আপনি তো আমাকে কখনই টাকা দেন না। একটা মোবাইল কিনে দিছেন তাতেও কখনও ১০ টা টাকা রিচার্জ করে দেন না।

- মোবাইল এ টাকা দিয়ে তুমি কি করবে? কেউ কল দিলে রিসিভ করবে।এতোটুকুই যথেষ্ট ।আর তুমি ভারী বেয়াদব হয়ে গেছ। আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি ইদানীং মুখে মুখে তর্ক কর। নিজেকে কি খুব বড় মনে করছ? মাত্র কলেজ পাশ করেছ। চান্স তো পাও নি কোথাও। পাবে বলেও মনে হয় না। প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াবার মত টাকা তোমার বাবার নেই। তবুও আমার মনে হচ্ছে তাই করতে হবে। বিয়ের সম্বন্ধ আসছে, তুমি বিয়ে করতেও রাজি নও। তুমি চাও টা কি?

- আপনি এখন এসব বলা বন্ধ করবেন? এসব কথা প্রতিদিন আমি ১০ বার করে শুনি।আপনি পত্রিকা পড়েন। টাকা দিবেন না ভাল। এসব বলার দরকার নেই।





নিশা বাবার সামনে থেকে চলে আসল। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছে নিশা। খুব একটা আয়না দেখে না নিশা। আয়না দেখলেই মনে হয়, ও দেখতে এমন তাই সবাই ওর সাথে এমন করে। মা দেখতে পারে না, বাবাও না। আত্মীয়স্বজনরাও না, বন্ধু বান্ধবীরাও না।কষ্ট হচ্ছে খুব। মানুষগুলো ঘুরে ফিরে অন্য মানুষের দুর্বলতা নিয়েই কথা বলে।এই যে নিশা কোথাও চান্স পাচ্ছে না, এতে নিশার নিজেরও খুব কষ্ট হয়।তবু বাবা মা দুজনেই দিনের মধ্যে ১০ বার এটা নিয়ে কথা বলবে। কষ্ট দিবে। আবার আয়নার দিকে তাকাল। কত কুৎসিত দেখতে নিশা। কত কালো, মোটা,খাটো। স্কুলে থাকতে সহপাঠীরা পিছন থেকে ওকে মুটি ডাকত।ও শুনত, কিন্তু না শোনার ভান করে চলে আসত। কষ্ট লাগত তখন। কলেজে ছেলেরা ওর নাম দিয়েছিল ড্রাম। কি বিচ্ছিরি নাম। তাও মুখ বুজে সইত নিশা। ঘরে এসে কাঁদত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।কিছু হলেই একজন অন্যজনকে বলত, দেখ, নিশার সাথে প্রেম করিয়ে দিব কিন্তু। যেন এটা কত ভয়ংকর একটা জিনিস। আর নিশা কত বিচ্ছিরি একটা মেয়ে। যাকে নিয়ে ফাজলামি করা যায়, পিছনে খারাপ কথা বলা যায়, প্রেম করা যায় না।একবার কে যেন ক্লাসের এক ছেলে জাহিদকে, নিশার নাম করে একটা প্রেম পত্র লিখেছিল। জাহিদ সেই প্রেমপত্র নিয়ে নিশার সামনে এসে বলেছিল, এই শরীর নিয়ে প্রেম করার শখ। আয়না দেখো কখনও। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে তো আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। এই নাও তোমার প্রেম পত্র। চরিত্র ঠিক কর। শরীরের এই সাইজ কিভাবে হয় আমরা জানি।





নিশা চুপ করে কথাগুলো শুনে। কতগুলো বাজে কথা বলল জাহিদ। বিনা কারণেই। সবাই ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে। কেউ পছন্দ করে না। শুধু একজন ছাড়া।রিমন।নিশাকে ভালবাসে।কেন যেন মনে হয় এই একটা মানুষই শুধু নিশাকে পছন্দ করে। দেখা হলে কষ্ট দেয় না। দুঃখের কথা বলে মন খারাপ করে দেয় না।কোন দুর্বলতা টেনে এনে মুখ গোমড়া বানিয়ে দেয় না।ভাল লাগা কাজ করে, যে টুকু সময় কাছে থাকে, যে টুকু সময় কথা বলে।সবার সাথে যা হয়, রিমনের বেলায় হয় তার উল্টা। সবাই বলে নিশা এমন নিশা অমন, কুৎসিত পচা, এই পারে না, ঐ করেনা। আর রিমন সবসময় ভাল কথা বলে।নিশাই বরং বলে তখন, ও তো এমন, কেন ওকে ভালবাসে? ভালবাসার কি আছে?

রিমন চট করে বলে দেয়, সব সৌন্দর্য সবাই দেখে না।

একটা মানুষ কি করে এতো ভাল হতে পারে ,নিশা জানে না।রিমনের ভিতর কোন খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্র ভাল,দেখতে ভাল, ভদ্র, মন ভাল। আর নিশার ভিতর হাজারটা খুঁত।রিমন ইচ্ছা করলেই অনেক সুন্দরী মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারে।এই কথা যখন নিশা বলে, রিমন চোখ বন্ধ করে আস্তে করে নিশার হাত ধরে।

- অনুভব করতে হয় এভাবে। আমি এখন তোমার পবিত্র মনটার ভিতর আছি। যেখানে এক বিন্দু অসুন্দরের আঁচও নেই।ভালবাসা তো মনের ব্যাপার, সাদা চামড়ায় সৌন্দর্য থাকে না।সাদা চামড়া চোখ জুড়ায়। কিন্তু আমার তো মন জুড়াতে হবে।এই দেখো চোখ বুজে আছি,এখন কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মন থেকে ঠিকই অনুভব করতে পারছি। এই যে চোখ মেললাম। এখন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখনও মন থেকে অনুভব করার ব্যাপারটা আছে। বুঝতে পারছ? তাহলে বল, আমার কোনটা বেশি দরকার? সাদা চামড়ায় চোখ জুড়ানো ,নাকি মন জুড়ানো?





নিশা কিছু বলে না। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিমনের দিকে।রিমন হাতটা আরও একটু শক্ত করে ধরে। মুখে চোখে অন্যরকম একটা ভাব ফুটিয়ে বলে, কখনই বুঝবে না কতটা ভালবাসি? আরে, একটু বুঝলে কি হয়? এই বেচারা যে তোমার জন্য পাগল হয়ে আছে তা কি চোখে পরে না?চশমা পরি আমি, তুমি কেন দেখো না?এই নিশা।





নিশা তাও চুপ। রিমনকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে ভাল লাগছে। বুকের ভিতর কেমন যেন হিম শীতল অনুভব হচ্ছে।সেই শীতলতায় কষ্ট নেই, আছে এক রাশ সুখের অনুভুতি। যেই সুখ হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখা যায়। গায়ে মাখিয়ে চুপচাপ ভাল থাকা যায়।নিশা রিমনের কপালের সাথে কপাল লাগাল।নিশার নিশ্বাস আর রিমনের নিশ্বাস কথা বলছে জড়াজড়ি করে। নিশা আস্তে করে বলে,কতদিন ভালবাসবে?





রিমন নিশার হাতটা বুকের উপর নিয়ে বলল, বুকটা বুঝলে অকারণেই ওঠানামা করে। এই অকারণ কাজটা যতদিন চলবে ততদিন ভালবাসব।





এই ভালবাসা বাসতে নিশার ভয় হয়।অকারণেই ভয় হয়। কেন যেন অন্য কোন মেয়েকেই রিমনের আশেপাশে সহ্য করতে পারে না। মনে মনে ভাবে, এই বুঝি হারিয়ে গেল।রিমন এসে সব কথা নিশাকে বলে। সারাদিন কি করল না করল। সেদিন বলল, আজ আমাদের ল্যাব এর গ্রুপ করে দিল।

- কোন মেয়ে আছে?

- হ্যাঁ একজন।

- তুমি মেয়েদের গ্রুপে গেলে কেন?

- আমি কি গেলাম? রোল নাম্বার অনুসারে পরে গেছে।

- তুমি কি ওর সাথে কথা বলছ?

- এক সাথে গ্রুপে কাজ করব, একটু আধটু তো কথা বলতেই হবে। তবে পড়ালেখার কথা বলব। এমনি অন্য কোন কথা বলব না। বুঝতে পেরেছ? এতো চিন্তা করতে হবে না।





তাও নিশার চিন্তা হয়। প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে, ঐ মেয়ের সাথে কথা বলছ?

কোনদিন রিমন বলে ,না বলি নি। কোনদিন বলে, হ্যাঁ কাজ করার সময় আমাকে একটা কিছু জিজ্ঞেস করল তার উত্তর দিলাম।

নিশার তাতেই মন খারাপ। জানে রিমন অনেক ভাল ছেলে। অমন কিছু করবে না যাতে নিশা কষ্ট পায়। তবুও নিশার কষ্ট লাগে। কষ্টটা হয়ত নিজের অবস্থার কারণেই। নিজেকে নিয়ে খুব হতাশায় ভোগার কারণেই। কারও কাছ থেকে ভালবাসা না পাবার কারণেই ভাবে, হয়ত রিমন হারিয়ে যাবে। এটা মনের ভুল। নিশা নিজেকে খুব অসুন্দর ভাবে। অবচেতন মনে ভাবে ওকে ভালবাসার কিছু নেই। এই ভাবনা থেকেই রিমনকে হারাবার ভয় আরও ঝেঁকে বসে মনে। কিন্তু জানে রিমন হারাবার না। রিমন নিশার ভালবাসা মনের ভালবাসা, মোহের ভালবাসা না। মোহের ভালবাসা হারিয়ে যায়। মনের ভালবাসা না।

কাল এই ভালবাসার মানুষটার জন্মদিন। খুব দামি কিছু দেবার সাধ্য নিশার নেই। তবুও কিছু একটা তো দিতে হবে।তাই বাবার কাছে টাকা চাইল। মিথ্যা বলল, বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে।প্রেম করে শুনলে বাবা ঘর থেকে বের করে দিবে। তবে একা না, অন্য যেন কোন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে।রিমন তো এখনই বিয়ে করতে পারবে না। ওর পড়ালেখা শেষ হবে তারপর।বাবাকে কে বুঝাবে?বাবা টাকাটা দিল না। বাবার উপর খুব রাগ হচ্ছে।অনেক বলাবলির পর একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিল। তাও কখনও টাকা রিচার্জ করে দেয় না। বাসা থেকে তিনদিন বের হয় নিশা।কোচিং এর তিনদিন।এই তিনদিন ১০ টাকা করে দেয় নিশাকে। লেগুনা করে যাওয়া আর আসার জন্য। যাবার সময় লেগুনায় যায় নিশা আর আসবার সময় রিমনের সাথে।বাসা থেকে একটু আগে থাকতে নামিয়ে দিয়ে যায় রিকশা থেকে রিমন। সপ্তাহে সঞ্চয় ১৫ টাকা।তা মোবাইলে রিচার্জ করে নিশা। কত হিসেব করে চলতে হয়। একটা গিফট কিনবে সেই টাকাও নেই। জমানো টাকাও না। জমাবার উপায় নেই। কি করবে তাহলে? রিমনকে জন্মদিনে কিছুই দিবে না?ভাবতেই কান্না পাচ্ছে নিশার। এতো এমন কেন ওর পরিবারটা?





বাহিরে চেঁচামেচির শব্দে নিশার ভাবনায় ছেদ ঘটল।কি হল আবার? চোখ মুছে রুম থেকে বের হয়ে আসল। নিশার ছোট ভাই নাবিল, চোখে মুখে ভয় ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত পিছনে লুকানো।মা চিৎকার করছেন।বাবা পত্রিকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।চোখ লাল করে তাকিয়ে আছেন নাবিলের দিকে। মা একটু একটু পর পর বাবাকে বলছেন, আপনি বসেন, আমি ওকে দেখতেছি।

বাবার রাগ কমেনি। পত্রিকা রেখে এসে নাবিলের ঘাড়ে ধরলেন।গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় মারলেন কয়েকটা।একটা গালেও পড়ল। নাবিল চিৎকার করে কাঁদছে, আর আনব না আব্বু। ও আম্মু আর আনব না এগুলা।

নিশা ছুটে গিয়ে নাবিলকে বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল।বাবাকে অনেকটা ধাক্কা মারার মত করে দূরে সরিয়ে দিল।

বাবা বললেন, তোমাকে একদিন বলছি না, নাবিলকে মারার সময় তুমি আসবে না এদিকে?

নিশাও গলা উঁচু করে বলল, আপনি ওকে মারবেন কেন? এতটুকু ছেলে।

- মারব না মানে? তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার কাজ করতে হবে? জিজ্ঞেস কর সে কি করছে?





নিশা নাবিলকে জিজ্ঞেস করল, কি করছিস তুই?

গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এইটা কিনছি।





নাবিল পিছন থেকে হাত সামনে আনল।ছোট একটা খেলনা পিস্তল।

- তুই টাকা পাইছিস কই?

- আম্মু প্রতিদিন টিফিনে টাকা দেয়। আমি খাই না। জমিয়ে রাখি। তা দিয়ে কিনছি। আর কিনব না আপু সত্যি কথা। আর কিছু কিনব না।





নিশার বাবা আবার চিৎকার করে উঠল, সে কি গুন্ডা মাস্তান যে পিস্তল কিনছে?সারদিন কতগুলা বদমাইশ পোলাপানের সাথে খেলাধুলা করে এই অবস্থা তার। আজ থেকে যদি বাইরে গেছিস তুই, তোর পা ভেঙ্গে ফেলব।সারাদিন পড়বি।পরীক্ষায় তো মার্কস পাস না, খেলার বেলায় ওস্তাদ। সারাদিন খেলে ,তখন তার সমস্যা হয় না। সন্ধ্যার পর পড়তে বসলেই তার মাথা ব্যথা করে, পা ব্যথা করে। শয়তান ছেলে।

- আপনি চিল্লাচ্ছেন কেন? ও ওর টাকা দিয়ে আনছে। খেতে দিছেন, তা জমিয়ে ও আনছে। এতে ওকে মারার কি আছে?

- হ্যাঁ, ওর টাকা। ও কি টাকা ইনকাম করে? তোমরা তিনজন তো শুধু আছ খাওয়ার চিন্তায়। খাবে আর মোটা হবে। একটা টাকা উপার্জনের উপায় তো কারও জানা নেই।





নিশা মার দিকে তাকাল। মা চুপ করে আছেন। শাড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছেন।এই মহিলা এমনই।কিছুই বলবেন না কখনও, শুধু কাঁদবেন।

নিশা বাবার সাথে তর্ক চালিয়েই যাচ্ছে

- তাও ,ও টাকাটা খেয়ে ফেলতে পারত। তা না করে একটা খেলনা কিনছে। তাতে হইছে টা কি?

- এহ খেলনা কিনছে।সে টাকা জমাইছে ভাল। তা দিয়ে খাতা কলম কিনতে পারত। কাজে লাগত। বা আমারে দিয়ে বলত, যান আব্বা বাজার করে নিয়ে আসেন। না পিস্তল কিনছে। হারামজাদা, পিস্তল কিনছে। পিস্তল দিয়া কি করবি তুই? কারে মারবি? আমাকে একটা গুলি কইরা মাইরা ফেলা। শান্তি পাই।তোদের টানতে আর ভাল লাগে না।

- আমাদের জন্য কত যে কি করেন দেখি।নাবিলকে কখনও একটা খেলনা কিনে দেন নায়। নিজে একটা কিনে আনছে টাকা জমিয়ে তাও ধরে মারতেছেন।আম্মাকে একটা ভাল কাপড় কিনে দেন নায়। আমি এতো বড় একটা মেয়ে, কোনদিন ভাল একটা কিছু কিনে দেন নায়।কোনদিন এক্সট্রা টাকা দেন নায়। খালি তিনবেলা খাওয়াতে পারেন আমাদের।





মা এবার ছুটে আসলেন। নিশাকে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, খুব বড় হইছিস? বাবার মুখে মুখে কথা বলিস। ঘরে যা। যা।

নিশা ঘরে চলে গেল। বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটা কত কথা বলল। একটুও ভয় পায় না।

মা নাবিলকে ধরে আর একটা চড় দিল। বলল, যা খেলনা ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আয়।

নাবিল খেলনা পিস্তলটা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। ক্লাস ফোরে পড়ে নাবিল। এই বয়সে বাচ্চাদের খেলনার শখ হয় ই। কত শখ করে একটা খেলনা কিনে আনল।ধরতে গেলে জীবনের প্রথম ভাল খেলনা।খাবারের টাকা জমিয়ে কেনা খেলনা।কত দুপুর না খেয়ে কাটিয়েছে এই খেলনা কেনার জন্য। বন্ধুদের খেতে দেখেছে, তবু আস্তে করে টাকাটা জমিয়ে রেখে দিয়েছে। একটা খেলনা পিস্তল কিনবে তাই।অভাবে মানুষের শখ আহ্লাদ হারিয়ে যায়। কোথায় হারায় জানা নেই। একটা সময় এসে কোন শখ হয় না, কোন বাসনা আসে না। একটাই চিন্তা। ৩ বেলা খাব। থাকব।ঘুমাব। ব্যাস।

নাবিলকে দোকানদার কিছুতেই পিস্তল ফেরত নিয়ে টাকা দিবে না।বিক্রি করা জিনিস এরা ফেরত নেয় না। নাবিল অনেক করে অনুরোধ করছে তাও নিচ্ছে না। গালের চড়ের দাগ দেখিয়ে বলল এই পিস্তলের জন্য ওকে বাসায় মারছে। টাকা না নিয়ে গেলে মেরে ফেলবে। তাও দোকানদার ফেরত দিবে না।হঠাৎ ই নাবিল একটা কাজ করে ফেলল। দোকানে ঢুকে দোকানদারের পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল, আঙ্কেল টাকাটা দেন না। টাকা না নিলে আব্বু মেরে ফেলবে। আমি কথা দিলাম পরে কিনা নিব পিস্তল। আঙ্কেল আপনার পা ধরতেছি আঙ্কেল। পিস্তলটা ফেরত নেন।

দোকানদার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নাবিলকে তুলে বলল, আচ্ছা টাকা দিতেছি। তবে এমন আর করবা না ভবিষ্যতে। বাসায় না জানিয়ে কিছু কিনবে না।আর পুরা টাকা ফেরত পাবে না। নাও ৪০ টাকা। যাও এখন।

নাবিল কিছুক্ষণ ১০ টাকার জন্য কান্নাকাটি করল। লাভ হল না।দোকানদার দিল না।তাই ৪০ টাকা নিয়েই ঘরে চলে আসল। এসে সোজা বোনের ঘরে। নিশার কোলের ভিতর ঢুকে বলল, আপু আমাকে ১০ টা টাকা ধার দিবে?টিফিনের টাকা জমিয়ে ফেরত দিয়ে দিব। দোকানদার ৪০ টাকা দিছে। বাকি ১০ টাকা দেয় না। আব্বু আবার অনেক মারবে ৫০ টাকা না দিতে পারলে।

নিশা পার্সটা খুলল।১০ টাকাই আছে। ছোট ভাইটার হাতে টাকাটা দিল। ভাই অনেক সস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়ল। গালে চড়ের দাগ এখনও আছে। নাবিল ফর্সা। তাই গালে দাগটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। টাকাটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল নাবিল। আবার ফিরে আসল। আপুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপু মানুষ গরীব হয় কেন?

নিশার এর উত্তর জানা নেই। আসলেই কেন হয় গরীব মানুষ? নিশা নাবিলকে কিছু বলল না। নাবিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। বাবার কাছে গিয়ে বাবার হাতে টাকাটা দিয়ে বলল, আব্বু টাকাটা রাখো। কিছু বাজার করে এনো।

বাবা কাঁপা হাতে টাকাটা নিলেন। নাবিল মাথা নিচু করে চলে গেল। বাবা টাকাটা পকেটে রেখে দিলেন। আসলেই কত সহজে ছেলেটার জমানো টাকা নিয়ে নিলেন বাবা। একটুও মনে হল না, ছেলেটার না খেয়ে জমানো টাকা। কিন্তু তিনি এমন ছিলেন না। অভাব মানুষের অনেক কিছু বদলে দেয়।অভাব মানুষকে ভাল আচরণ করতে ভুলিয়ে দেয়।যখন মাথায় চিন্তা থাকে আজ কিভাবে চলবে দিন। কি খাবে না খাবে। তখন ভিতর থেকে ভাল আচরণ আসে না।নিশার বাবারও তাই আসছে না।এতো এমন ছিল না পরিবারের অবস্থা।বিদ্যুৎ অফিসে কাজ করত নিশার বাবা। হঠাৎ করেই শরীর অসুস্থ হয়ে গেল। কাজ করতে পারেন না আর।হাঁটতে কষ্ট হয়, চলতে কষ্ট হয়, পরিশ্রম করতে কষ্ট হয়।কাজটা ছেড়ে দিলেন। এখন ডিম বিক্রি করেন। প্রতি সন্ধ্যায় বাসার সামনে সেদ্ধ ডিম নিয়ে বসেন। সাথে এক লোক থাকে, যে কিনা ডিম ছিলে বিক্রি করে। আর নিশার বাবা পাশে বসে থাকেন। যা উপার্জন হয় প্রতিদিন, তাকে ৩ ভাগ করে ১ ভাগ দিতে হয় ঐ লোকটাকে। বাকি টাকা বাবার। এই টাকা থেকে কিছু টাকা রেখে দিতে হয় পরের দিনের ডিম কিনবার জন্য।আর যে টাকা থাকে তাতে ঠিকভাবে চলে না সংসার।সংসারের এই অবস্থা থাকলে কারও ই মন মেজাজ ভাল থাকবার কথা না।তার উপর মেয়েটা কোথাও চান্স পাচ্ছে না। কয়েকটা ভর্তি পরীক্ষা দিল। মনে হয় প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করাতে হবে। এতো টাকা পাবে কই?গ্রামে কিছু জমি আছে। একজনের সাথে কথা হয়েছে। জমিটা বিক্রি করে দিবেন। যত যাই হোক, মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করা যাবে না।বাবা ভাবছেন, তার যেমন মন মেজাজ খারাপ হচ্ছে সংসারের অবস্থা নিয়ে। সংসারের অন্য কারও তা হওয়াটা স্বাভাবিক।অন্য কেউ দেখাচ্ছে না, নিশা দেখাচ্ছে।তিনিও বা কেমন বাবা, মেয়েটা বড় হয়েছে। এখন ওর কিছু সাধ আহ্লাদ হতেই পারে। কিন্তু তিনি তার কিছুই পূরণ করতে পারছেন না।ছোট ছেলেটাকেও একটা খেলনা কিনে দেননি কখনও। বউটাকেও কিছু দেননি। বাবা হিসেবে ব্যর্থ, স্বামী হিসেবেও, মনে মনে ভাবছেন। মেয়েটার সাথে সকাল থেকে খারাপ ব্যাবহার করছেন, রাগারাগি করছেন। এখন খুব খারাপ লাগছে।

নিশা ঘরে বিছানার উপর বসে আছে।বাবা দরজার কাছে এসে বললেন, আচ্ছা ঘরে কি আসা যাবে?

নিশা দেখল, বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।মন খারাপ করে বলল, আমি কি জানি?

- না, আসলে একটা কথা ছিল।

- আসেন না কেন?

বাবা ঘরে ঢুকলেন। এদিক ওদিক তাকালেন।

- তোমার ঘরে অনেক দিন আসা হয় না।তুমি তো অনেক সুন্দর সাজিয়ে রাখছ ঘরটা। তোমার অপদার্থ ভাইটাকে মাঝে মাঝে এনে দেখিও। তার পড়ার টেবিলে গেলে দেখা যায় মাকড়সার বাসা, তেলাপোকার গু। কি অবস্থা। পড়ালেখা করা ছেলের পড়ার টেবিল অমন হয়?

- কিছু বলবেন বাবা?

- কিছু বলার জন্যই আসতে হবে শুধু? তোমার ঘরে কি এমনি মাঝে মাঝে আসা যাবে না?

- যাবে।

- আসলে মা, আমি অনেক খারাপ , তাই না? তোমাদের সবার সাথে রাগারাগি করি। ঠিক মত খেয়ালও রাখতে পারি না তোমাদের। আমি কি এমন ছিলাম বল? সংসারের এই অবস্থা, কি করে মাথা ঠিক থাকে বল? আমি তোমাদের অনেক ভালবাসি। সত্যি অনেক। তোমরা শুধু আমাদের রাগ দেখ। আমি এতো খারাপ।





বাবা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন।চোখ মুখ বলে দিচ্ছে বুকের ভিতর কতটা কষ্ট হচ্ছে। নিশারও কষ্ট হচ্ছে বাবার কথাগুলো শুনে।তাই তো, বাবা ইচ্ছা করে এমন করছেন না।যেই মানুষটার মনে সারাদিন সংসার কিভাবে চলবে সেই চিন্তা, তার মেজাজ ভাল থাকবার কথা না। আর নিশাও তো অনেক খারাপ ব্যাবহার করল বাবার সাথে।একদম ঠিক না। বাবা মা কিছু বলতেই পারে। তাই বলে এমন করবে ও। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিশার খুব কষ্ট হচ্ছে।বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,আপনি এভাবে বলছেন কেন?আব্বু আমাকে মাফ করে দেন। আমার আপনার সাথে অমন করে কথা বলা উচিৎ হয় নি। আমাকে মাফ করে দিন আব্বু।





নিশার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। বাবা মেয়ের গালের পানি মুছে বললেন, পাগলি মেয়ে আমার। কাঁদে না।





বাবা পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করলেন। ৫০ টাকা। নাবিলের দেয়া ৫০ টাকা।নিশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাও মা।কাল না তোমার বান্ধবীর জন্মদিন। এটা দিয়ে কিছু কিনে দিও। আমার কাছে আর টাকা নেই।

নিশা বাবার হাত ধরে বলল, না আব্বু, টাকা লাগবে না। আপনি এটা বরং নাবিলকে দিন।ও অনেক কষ্ট করে জমিয়েছিল টাকাটা।ও অনেক কষ্ট পাইছে। আপনি এক কাজ করেন, নাবিলকে নিয়ে গিয়ে পিস্তলটা কিনে নিয়ে আসুন। ছোট ছেলে। এতো আশা করে একটা খেলনা কিনল।

- ভাল বলেছ তো। আচ্ছা আমি ওকে নিয়ে বাজারে যাই। কিন্তু তোমার বান্ধবীর জন্মদিন?

- লাগবে না বাবা।





বাবা রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর নিশা দেখল বাবার হাত ধরে নাবিল যাচ্ছে। মুখটা হাসি হাসি। বাবার মুখেও হাসি। অনেকদিন পর বাবাকে হাসতে দেখছে নিশা। মাকেও দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হাসছেন না। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। কি আজব। এতে কাঁদার কি আছে? সবাই কত আনন্দে আছে।মা ও হয়ত আনন্দেই কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে হাসতে ভুলে গেছেন হয়ত। তাই আনন্দেও কাঁদছেন। নিশারও খুব ভাল লাগছে। অনেকদিন পর ঘরে একটা সুখ সুখ ভাব এসেছে।এই সুখ সারাজীবন থাকুক। মাঝে মাঝে খুব অল্প কিছু, অল্প সুখ, অল্প হাসি অনেক বড় মনে হয়।অনেক শান্তি দেয়।







সকাল বেলা একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে নিশা।আজ রিমনের জন্মদিন। সকালেই গোসল করে মায়ের ঘরে গেল।

- মা আমাকে একটা শাড়ি দিবে?

- কি করবি?

- শাড়ি দিয়ে মানুষ কি করে? পরব।

- শাড়ি পরে কই যাবি? আজ না তোর কোচিং আছে। কোচিং এ শাড়ি পরে যাবি? কি বলিস এসব?





বাবা বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় বললেন, আহা, তুমি এতো কথা বলছ কেন? মেয়েটা একদিন শাড়ি পরতে চাচ্ছে। দাও তো।একটু সুন্দর দেখে দিও। আমি তো বুঝি না কোন শাড়ি সুন্দর, কোনটা অসুন্দর।

মা একটা শাড়ি দিলেন।হালকা সবুজ রঙের।মেয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বাবাও হাসলেন।

শাড়ি পরে ঘর থেকে বের হয়েছে নিশা। আজও ১০ টাকা দিয়েছেন মা। যাওয়া আসবার জন্য। খুব আনন্দ হচ্ছে নিশার। আজ প্রথম শাড়ি পরে দেখা করবে রিমনের সাথে। একটু একটু লজ্জাও করছে। নিশ্চয় দেখতে খুব পচা লাগছে ওকে।ওকে কখনই দেখতে সুন্দর লাগে না। আর নিশার একটু খারাপ লাগার অনুভূতি হচ্ছে রিমনকে কোন উপহার দিতে পারবে না জন্মদিনে তাই।কোচিং এ যাবার আগে একবার দেখা হয় রিমনের সাথে, কোচিং শেষে একবার। লেগুনায় উঠার আগে একবার কল করে রিমনকে।বলে যে লেগুনায় চড়েছে। মাঝে একবার কথা হয় লেগুনার ভিতরে থাকতে।আর নেমে হয় দেখা।আজও রিমন অপেক্ষা করছে নিশার কলের। আজ একটু বেশিই দেরী করছে।কিছুক্ষণ পরে কল করল নিশা, এই শোন, আমি লেগুনায় চড়তেছি। আর আজ মাঝখানে কথা বলব না। একজন পরিচিত মানুষ আছে লেগুনায়।

- আচ্ছা ঠিক আছে। দেখে শুনে এস।

- হুম, আসব তো। লেগুনার ভিতর আমি দেখে শুনে আসব? ড্রাইভারকে বল, যেন দেখে শুনে চালায়।

- ওহ, কি যে বলনা তুমি। আসো এখন।

- হুম, আসতেছি।রাখি।





নিশা কল কেটে দিল। রিমন দাঁড়িয়ে রয়েছে লেগুনা স্ট্যান্ডে।কাল রাতে ঠিক ১২ টায় ফোন দিয়েছিল নিশা। কল করে শুভ জন্মদিন বলল। রিমনও তাই আশা করেছিল।ভাললাগার অনেকখানি ছুঁয়ে গেছে হৃদয় ,অতটুকু শুভ জন্মদিন শুনাতে। এতো ভালবাসা নিশার প্রতি, তাও নিশা বুঝে না। প্রতিদিন বলে, আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো?

এহ, ভালবাসা ফাজলামি নাকি? আজ একজনকে ভালবাসলাম, কাল তাকে ভুলে অন্য জনকে।আর নিশাকে তো রিমন মন থেকে ভালবাসে। মন থেকে বাসা ভালবাসা এতো সহজে হারায় না। ভালবাসার মানুষ দূরে গেলেও বুকের কোণে লুকিয়ে থাকে ভালবাসা।মনের ভালবাসা মরে না।কিসব মরামরির চিন্তা করছে রিমন।আজ ওর জন্মদিন। তার চেয়ে কিছু জন্মাজন্মির চিন্তা হোক। নিশাকে বিয়ে করলে বাচ্চা কাচ্চা তো হবেই। মেয়ে হলে নাম হবে রিনি। রিমনের রি আর নিশার নি। আর ছেলে হলে শান। নিশার শেষের শা আর রিমনের শেষের ন। বাহ কি সুন্দর। নিশার মত সুন্দর। আজ নিশা মেয়েটাকে বলতে হবে ওর কি কি রিমনের ভাল লাগে। অপূর্ব এক জোড়া চোখ আছে নিশার। যে চোখের দিকে তাকিয়ে সারাজীবন কাঁটিয়ে দেয়া যায়। খাওয়া দাওয়ারও চিন্তা করতে হবে না। সুন্দর দেখে পেট ভরে যাবে। আর চেহারার মধ্যে একটা মায়া আছে। কেমন মায়া মায়া চেহারা যেন। কৃষ্ণমায়া।আর ওর মত ভাল মেয়ে পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। সবার এতো সুন্দর মন থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা রিমন নিশাকে ভালবাসে। ভালবাসা কিছু দেখে হয় না, কিছু বুঝে হয় না, ভালবাসা হয়ে যায়, অকারণেই হয়ে যায়। রিমনের ভালবাসাও হয়ে গেছে।ভালবাসার গভীরে চলে গেছে। এই গভীরতা থেকে উঠে আসা অসম্ভব।তাই ভালবেসে যাচ্ছে নিশাকে।

কি ব্যাপার?এতক্ষণ হয়ে গেল, এখনও আসবার খবর নেই নিশার। লেগুনা এখনও আসছে না কেন?হঠাৎ করেই স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করা লোকজনের কথায় কান গেল রিমনের।

"আহারে, শুনলাম একজন মারাও গেছে। একটা মেয়ে। লেগুনার অন্য একটা মেয়ের অবস্থাও নাকি ভাল না। বাকিরা প্রায় সবাই চরম ব্যথা পাইছে।"

একটু ভাল করে কথায় কান দিল। এখানে আসবার সময় নাকি একটা লেগুনা এক্সিডেন্ট করেছে।হঠাৎ করেই রিমনের বুকের ভিতর ধক করে উঠল।হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। চোখে কেমন সব ঘোলা ঘোলা দেখছে। এখানে যে লেগুনা আসবে তাতে তো নিশাও আছে। নিশার নাম্বারে কল করল। বন্ধ।বুকের ভিতরের ব্যথা বাড়ছে।দৌড় দিল রিমন, কোথায় এক্সিডেন্ট করেছে দেখার জন্য। কতদূর যেতেই দেখল অনেক মানুষের ভিড়।ভিড় ঠেলে ঢুকল। লেগুনাটা ভচকে গেছে, চ্যাপ্টা হয়ে আছে। এ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে, যারা আহত তাদের নিয়ে যাবার জন্য।দৌড়ে গিয়ে সবার মুখ দেখছে রিমন।এই মুখগুলোর ভিড়ে অবচেতন মনেই নিশার মুখ খুঁজছে।কিন্তু পাচ্ছে না।বুকের কষ্ট চোখে অনেক তাড়া দিচ্ছে।টপ টপ করে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে। চ্যাপ্টা লেগুনার মধ্যে উকি দিয়ে মানুষ খুঁজছে,নিশার মুখ খুঁজছে।ওখানেও নেই।একজনকে জিজ্ঞেস করল যে মেয়েটা মারা গেছে সে কই?

লোকজন বলল, মেয়েটাকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে। মেয়েটা দেখতে কেমন বলাতে, লোকজন বলল, বয়স কম করে, শাড়ি পরা।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল রিমন।কাল রাতেই বলেছে আজ শাড়ি পরে দেখা করবে নিশা।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে রিমনের। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তবুও বুকের কষ্ট কমছে না।নিশাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

হঠাৎ পিছন থেকে খুব পরিচিত কারও ডাক শুনল রিমন।

" রিমন, এই রিমন। ওখানে কি কর?"

রিমন মুখ ঘুরিয়ে চাইল।শাড়ি পরা একটা মেয়ে। নিশার মত লাগছে মেয়েটাকে। অবচেতন মনের ভাবনায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে।নিশার এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা না।রক্ত মাখা হাত দিয়ে চোখটা একটু মুছল।নিশাই তো ওটা।সবুজ রঙের শাড়ি পরা।উঠে গিয়ে কিছু বলা কওয়া নেই, নিশাকে জড়িয়ে ধরল এতো মানুষের মাঝে।জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।পিঠের কাছে হাতের রক্ত লেগে যাচ্ছে।একটা ছেলে কাঁদছে একটা মেয়েকে জড়িয়ে, ব্যাপারটা খুব একটা স্বাভাবিক না। তাই সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। নিশা রিমনকে ছাড়িয়ে বলল, এখান থেকে চল। লোকজন তাকিয়ে আছে।





পার্কের বেঞ্চটায় রিমন বসে আছে। আর নিশা সামনে দাঁড়িয়ে। মাঝে অল্প একটু ব্যবধান। রিমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নিশা।

- এখন একটু ভাল লাগছে?

- হ্যাঁ।

-এই, এতো ভালবাসতে হয়?

- হয়। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না নিশা।আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাচ্ছি। জ্ঞানশুন্য হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।





নিশার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, আমাকে ছেড়ে যাবে না তো কখনও?

- পাগল তুমি? এতদিন আমি এই কথা বলতাম। আজ তুমি?যাব না যাব না।ভালবাসি অনেক।

- সবুজ শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগছে।





লাজুক মুখে নিশা রিমনের দিকে তাকাল।কি একটা ঘটনা ঘটে গেল। আসলে যা হয় ভালোর জন্যই হয়।আজ নিশা লেগুনায় চড়েনি। হেঁটে এসেছে।রিমন ব্যাপারটা না বুঝুক এটা চাচ্ছিল নিশা। তাই হেঁটে হেঁটে মাঝ পথে এসে কল করেছিল রিমনকে। বলেছে লেগুনায় চড়ছে।আর মাঝে কল করতে মানা করেছে কারণ কথা বললেই রিমন বুঝে যাবে নিশা লেগুনায় না।তাও যদি কল করে, তাই মোবাইল অফ করে রেখেছিল।আজ রিমনের জন্মদিন, কিছু না দিলে হয়?কিন্তু হাতে টাকা নেই।লেগুনায় না চড়লে হাতে ১০ টাকা থাকবে। আর এই ১০ টাকা দিয়ে ২ টা গোলাপ কিনেছে। গোলাপ কিনে আসবার সময় রাস্তার পাশে অনেক মানুষের ভিড় দেখে নিশা যায়।গিয়ে দেখল,রিমন ওখানে কি যেন খুঁজছে পাগলের মত। পরে রিমনের থেকে জানল একটা লেগুনা এক্সিডেন্ট করেছে।

নিশার হাত এখনও রিমন ধরে রেখেছে। হাতটা ছাড়িয়ে নিশা ব্যাগ থেকে ২ টা গোলাপ বের করল।রিমনকে দিয়ে বলল,

- শুভ জন্মদিন। আসলে বুঝই তো, পরিবারের কি অবস্থা।বাবার হাতে টাকা নেই। আর আমার কাছেও জমানো টাকা নেই। তাই এর থেকে বেশি কিছু দিতে পারলাম না, সরি জান।





রিমন নিশার হাত থেকে গোলাপ ২ টা নিয়ে একটু হাসি দিয়ে বলল, এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। এতো সুন্দর উপহার দিলে,ভালবাসা দিলে ,আর সবচেয়ে বড় কথা, সবচেয়ে বড় উপহার হিসেবে তোমাকে পেলাম। নতুন করে পেলাম। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।নতুন করে তোমাকে পেলাম। এর চেয়ে বড়, এর চেয়ে দামী উপহার আর আছে? আর পেয়েছি যখন, সারাজীবন পাশে থাকতে হবে। আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।





নিশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে, খুশিতে। এতো ভালবাসার খুশিতে।বাবা কাল টাকাটা দিলে হয়ত আজ লেগুনা এক্সিডেন্টে মারা যেতে হত নয়ত হাত পা ভেঙ্গে বসে থাকত। আমরা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কষ্ট পাই, দুঃখ পাই সেই সময়টাতে। আসলে একটু ধৈর্য ধরলেই খুঁজে পাওয়া যায়, আসলে সব কষ্টের আড়ালে সুখ আছে। সব খারাপ কিছুর আড়ালে ভাল কিছু আছে।খুঁজে নিলেই পাওয়া যায়।

রিমন নিশার হাতটা আবার শক্ত করে ধরল।মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশা একটু জড়িয়ে ধরি তোমাকে?

- ধর।





রিমন নিশাকে জড়িয়ে ধরল।নিশার গাল বেয়ে পানি পড়ছে।এতো ভালবাসা হাতের কাছে পেয়ে।এই ভালবাসায় আস্থা আছে। এই ভালবাসায় বিশ্বাস আছে। নিশা জানে, যত যাই হোক ওর বাবা মা যেমন নিশাকে কখনও ছেড়ে যাবে না।কাল থেকে এই ভালবাসা খুঁজে পেয়েছে।বাবা মায়ের ভালবাসা।ঠিক তেমনি রিমনও কখনও ছেড়ে যাবে না নিশাকে।নিশা জানে, বিশ্বাস করে।অবিশ্বাসে ভালবাসা হারিয়ে যায়।বিশ্বাসে ভালবাসা গভীর হয়,সব হারালে তবুও ভালবাসা থাকে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:১৩

অপ্রচলিত বলেছেন: দারুণ লিখেছেন। শুভ কামনা রইল।

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৬

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ। দোয়া করবেন। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.