নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
কমলা খাবার পর, বিচিগুলো মুখের ভিতর নাড়ছে অনেকক্ষণ ধরে। সামির বুঝতে পারছে না বিচিগুলো কি করবে। কমলা দিয়েছে খেতে, কিন্তু বিচি ফেলার বাটি দেয় নি। রুমটা এতো ঝকঝকে চকচকে,আর এতো ধনী মানুষের রুম। ইচ্ছা করলেই, থু থু র সাথে মেঝেতে ফেলে দেয়া যায় না বিচিগুলো। ধনী মানুষের বাড়িতে আসলে, সব কিছু ভেবে চিন্তে করতে হয়। জুতা খুলে রুমের বাহিরে রেখে এসেছে। এমনকি মোজা থেকে যদি গন্ধ আসে, তাই তাও জুতার ভিতর। এসে চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে আছে, সোফার এক পাশে। সামনে একটা ছোট বাটির মত জিনিস। গায়ে নানা রকম ফুল আঁকা। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। এটা নিশ্চিত শো পিচ হবে। কমলার বিচি ফেলার জন্য এটা না। বিচি গুলো গিলে খেয়ে ফেলল সামির। সামনের বাটিতে আরও দুই টুকরা কমলা আছে। খেতে ইচ্ছা করছে, তবুও একটা ভদ্রতার ব্যাপার আছে। ভদ্রতার খাতিরে খেল না সামির। আসতে বলেছে বিকেল ৫ টায়। এখন বাজে ৬ টা ২০। সামির এসে পৌছায় এখানে, সাড়ে ৪ টায়। এসে গেটে দারোয়ানের কাছে, জবাব দিয়ে ওয়েটিং রুমে আসল। সেখানে ৫ টা পর্যন্ত বসে থাকার পর, জামান সাহেবের বাসায় ফোন দেয়া হল নিচ থেকে। সেখান থেকে যাবার নির্দেশ আসার পর, লিফটে করে জামান সাহেবের বাসায় আসল সামির। লিফটে চড়তে অন্য রকম ভাল লাগে। নিজেকে বড়লোক বড়লোক লাগে। তাই ৩ তলায়ও লিফটে করেই উঠল। এসে কলিং বেল টিপে, আবার মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা। দরজা খোলার নাম নেই। আরও দুই তিন বার বেল টিপে অপেক্ষা। কেউ আসে না খুলতে। টানা ৪ বারের মত বেল টিপার পর, এক মেয়ে দরজা খুলল। এই বাসার কাজের মেয়ে, দেখেই বলে দেয়া যায়। এসে সামিররে ঝাড়ি দিয়ে বলল, এতবার বেল টিপেন কেন? একবারেই শোনা যায়। সবাই পাগল হয়ে যায়। কেউ অপেক্ষা করতে চায় না। কাজ থাকে না আমার?
ধনী লোকের কাজের মেয়েরও অনেক দাম। তাই সামিররে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলল। সামির ভিতরে ঢুকতেই সোফা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এনে বসেন। আমি সাহেবরে ডাকতেছি।
সামির বসে থাকে। সোফার একেবারে কোণায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা একটা বাটিতে কিছু কমলার টুকরা, আর দুই পিচ মিষ্টি এনে বলে যায়, সাহেব আসতেছে। আপনারে বইতে কইছে।
সামির তখন থেকে বসে আসে। আসার খবর নেই। ধনী লোকের সময়ের অনেক দাম। সামিরের সময়ের দাম নেই। সামির চারপাশে দেখছে। এতো দামী দামী জিনিসে ঘর সাজানো যে, নিজেকে বড় বেমানান লাগছে এখানে। বেমানান লাগলেও এখানে খাপ খাওয়াতে হবে কিছুদিনের জন্য। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে এক লোক আসলেন। ইনিই জামান সাহেব হবেন। ডাক্তার মানুষ। বারডেমের কোন বিভাগের যেন প্রধান ডাক্তার তিনি। মাথার চুলের দুই একটায় পাক ধরেছে। এসে সামনে বসলেন সামিরের। মুখে একটু হাসি দিয়ে বললেন, তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম। আমার একটু জরুরী কাজ ছিল। তাই দেরী হয়ে গেল। বেশী সময় দিতে পারব না তোমাকে। যা কথা বলার দ্রুত শেষ করতে হবে।
সামিরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, নিজেই এক গাদা কথা বলে ফেললেন। সামির শুধু আস্তে করে বললেন, জ্বি।
- তুমি রফিক সাহেবকে চিন কি করে?
- উনি আমার বাবার পরিচিত। আমাদের এলাকায় থাকেন।
- ও আচ্ছা। রফিক সাহেব তাহলে তোমার কোন আত্মীয় না?
- জ্বি না।
- উনি তোমার কথা বলছেন। বললেন যে, অনেক ভাল ছাত্র তুমি। অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করছ। তোমার বাবা যেন কি করেন?
সামির মাথা নিচু অবস্থাই বলল, বাজারে একটা ছোট পান সিগারেটের দোকান আছে।
- পান সিগারেট? খুব খারাপ। এসব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বাবাকে সেই ছোট দোকানে অন্য কিছু ব্যাবসা করতে বলবে।
- আচ্ছা।
- দোকান থেকে তো মনে হয় ভাল উপার্জন হয়।
- জ্বি না।
- ওটা তোমরা বলবেই। যাই হোক। রফিক সাহেব বলেছিলেন, তোমার জন্য কিছু একটা করতে। রফিক সাহেব আমার অনেক ঘনিষ্ঠ মানুষ। বলেছিলেন দেখতে তোমার জন্য কোন টিউশনি বা অন্য কিছুর ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এখন আমি তো মুখের উপর তাকে না করে দিতে পারি না। তোমাকেও না করা যায় না। এখনকার সময়ে অপরিচিত মানুষকে কেউ টিউশনিও দিতে চায় না। তুমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছ, তাই না?
- জ্বি।
- ইন্টারের পড়া পড়াতে পারবে?
- জ্বি পারব।
- তাহলে, এক কাজ কর। আমার ছোট মেয়ে, ইন্টারে পড়ছে এখন। কলেজের স্যার দের কাছে কোচিং করছে। আলাদা করে আর লাগেনা , তবুও তোমার কিছু একটা হবার আগ পর্যন্ত, আমার মেয়েটাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে একটু দেখিয়ে দিয়ে যেও। বেশ?
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- টাকা কি ঠিক করে নিতে হবে তোমার সাথে?
- না। আমি পড়াই, আপনাদের ভাল লাগলে তারপর যা দেন।
- গুড। আচ্ছা তাহলে তুমি আমার মেয়ের সাথে কথা বল। ওর ভাল না লাগলে তো , বুঝই পড়ান একটু সমস্যা। বা তুমিও দেখো, যাকে পড়াবে সে কেমন ছাত্রী। আমি তোমাকে তাহলে রাতে কনফার্ম করব। তোমার মোবাইল আছে?
- জ্বি।
- বাহ, মোবাইলও আছে দেখি। আচ্ছা নাম্বার দিয়ে দাও। আমি না হয় তোমার আন্টি তোমার সাথে কথা বলে জানাবে।
সামির চুপ করে একটা কাগজে নাম্বার লিখে দিল। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। মনের ভিতর মনে হচ্ছে, প্রতিটা কথা অনেক খোঁচা দিয়ে বলছেন লোকটা। একটু নিচু শ্রেণির সাথে এদের কথাবার্তার ধরণই হয়ত এমন। কিন্তু শিক্ষিত হিসেবে, একটু সম্মান পাচ্ছে সামির। জামান সাহেব, নাম্বারটা নিয়ে বললেন, টাকা নিয়ে চিন্তা কর না। আজ ১৩ তারিখ তো। পুরো মাসের টাকাই পাবে। ভাল করে পড়িও। মাঝে মাঝে আমি বা তোমার আন্টি কেউ থাকব না বাসায়। তখন আসলে আমাদের আগে কল করে জানাবে, তারপর পড়ান শুরু করবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- বসো তাহলে তুমি। ছাত্রীর সাথে কথা বল। আমার কাজ আছে একটা। আমি আসি।
জামান সাহেব চলে গেলেন। যাবার আগে হ্যান্ডশেক করলেন সামিরের সাথে। আবার বসে থাকা একা একা। চারপাশের দেয়ালে চোখ বুলিয়ে দেখল, নানা বিদেশী পেইন্টিং। একেকটার দাম যে অনেক বেশী বেশ বোঝা যায়। সামির একবার ছবির হাটে, দেশী শিল্পীদের আঁকা পেইন্টিংগুলোর দাম দেখেই আঁতকে উঠেছিল। দেড় লাখ, দুই লাখ এমন দাম। এতো টাকা কোনদিন চোখে দেখেনি সামির। দেখবে কিনা কোনদিন তাও জানে না। ছাত্রী আসবে কখন ঠিক নেই। সামনে বড় মনিটরের এল ই ডি টিভি। বিরক্তিকর সময় কাটাবার জন্য টেলিভিশন দেখা যায়। তবে তা ভাল হবে বলে মনে হয় না। টিউটর পড়াতে এসে টেলিভিশন খুলে নাচ গান দেখছে, তা খুব একটা ভাল দেখায় না। তার চেয়ে চুপচাপ বসে থাকা ভাল। খানিক পরে কাজের মেয়ে এসে বলে, আপনাকে ডাকে আপায়।
সামির উঠে দাঁড়াল। কাজের মেয়ের পিছনে যাবার সময় কমলা দুইটা মুখে পুরে, বিচি সহ খেয়ে ফেলল। কাজের মেয়েটার পিছন পিছন একটা ঘরে ঢুকল। ঘরটার ভিতর ঢুকতেই অন্য রকম একটা সুবাস আসল নাকে। অনেক মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণটা অনেক পরিচিত সামিরের। আগেও পেয়েছে, খুব কাছে থেকে, বুঝতে পারছে সামির। একটু স্মৃতি হাতড়ে বের করে ফেলল। মিতুর ঘর থেকেও এমন একটা ঘ্রাণ পেত। ঘ্রাণটা অন্য কিছুর না। অনেক গুলো ফুলের। গোলাপ, শিউলি, বেলি, রজনীগন্ধা সব গুলোর মিশেল হলে যেমন হয়, এমন হয় তেমন একটা ঘ্রাণ। মিতুর অনেক সখ ছিল, ঘর ফুলে ফুলে সাজিয়ে রাখা। প্রতিদিন ঘরের ফুল পাল্টে নতুন ফুল নিয়ে আসত। কলেজে পড়বার সময় মিতু, বাবার কিনে দেয়া গাড়িতে করে ড্রাইভার কলেজে নিয়ে যেত। আবার কলেজ থেকে নিয়ে আসত। বাকিটা সময় ঘরের মধ্যে থাকা। কোথাও কখনও বের হত না। মাঝে মধ্যে জানালা ধরে সামনের পার্কে খেলতে থাকা ছেলেগুলোকে দেখত, কিংবা হাতে হাত রাখা প্রেমিক প্রেমিকা। কলেজ থেকে ফেরবার সময়, গাড়ি থেকে নেমে মাঝে শুধু ফুল কিনে নিত। দোকানে যতরকম ফুল থাকে সব রকম। সেই ফুলের মাঝে সাজানো ঘরে, একটা মেয়ে একা একা সারাদিন কাটাত। কখনও পড়ার বই হাতে, কখনও গল্পের বই। বাহিরের মানুষ গুলোর সাথে ছিল না খুব একটা পরিচয়। পরিবারের বাবা মা, দাদী এই গণ্ডি কোনদিন পাড় হতে পারেনি। হয়ত কখনও পাড় হতে চায় নি। ছোট্ট ঐ পৃথিবীতে, হঠাৎ করেই এসেছিল সামির। সামিরের বাবা আর মিতুর বাবা খালাতো ভাই হয়। সে হিসেবে সম্পর্ক ভাল। মাঝে মধ্যেই বলে, সামিরের বাবাকে বাসায় আসতে। যান না কখনও। তবে একদিন পাঠিয়ে দেন ছেলেকে। কলেজ বন্ধ সেই ফাঁকে। আজ যে অস্বস্তিতে ভুগছে, ঠিক একই অস্বস্তিতে ভুগছিল সেদিন সামির। এতো ধনী মানুষের বাসার সেই প্রথম যাওয়া। নিজেকে খুব অবাঞ্ছিত লাগছিল সে বাসায়। হুট করে চোখ পড়েছিল মিতুর দিকে। সামির বসে বসে গল্প করছিল, মিতুর দাদীর সাথে। আর সামনে একটু পর পর ঘুরছিল মিতু। একটা টি শার্ট পরে। না চাইলেও চোখ চলে যাচ্ছিল বার বার মিতুর দিকে। একটু ঘুরঘুর করে এসে, মিতু বলে, তুমি সামির না?
সামির চমকে যাবার মত হয়ে বলে, হ্যাঁ।
- আমার সাথে আসো। দাদু আমি ওকে নিয়ে যাই।
সামির জানে না এই মেয়ে কে। মিতুকে চিনেনা সামির। সামিরকে ঠিক চিনে মিতু। হয়ত বাবা মা বলেছে, আজ আসবে সামির নামে কেউ। মিতুর সাথে মিতুর ঘরে ঢুকে এই ঘ্রাণটাই পেয়েছিল। ঘরে ঢুকে মিতু বলে, আমাকে চিন?
- না তো।
- আমি মিতু। আমি কিন্তু তোমাকে চিনি।
- ও আচ্ছা।
- ও আচ্ছা কি? এটা আমার ঘর।
ঘরে চোখ বুলিয়ে সামির দেখে নানা ফুলে সাজানো ঘরটা। অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলদানীতে সাজানো তাজা তাজা সব ফুল। মিতু বলে যাচ্ছে, আমি প্রতিদিন ফুল পাল্টাই। এখানেই থাকি সারাদিন এই ফুলের মাঝখানে। অনেক ভাল না , বল?
- হ্যাঁ।
অপরিচিত একটা মেয়ে, অনেক পরিচিত কারও মত কথা বলছে। সামির একটু অবাক হয়েই দেখছে।
- তুমি না অনেক গাধা। আমাকে এখনও চিনতে পার নি? আচ্ছা দাড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।
মিতু ওর সাজানো বুকসেলফ থেকে, একটা এ্যালবাম বের করল। ছবির এ্যালবাম। ছবি পাল্টে পাল্টে একটা ছবি দেখাল। একটা ছেলে, একটা মেয়ে পাশাপাশি দাড়িয়ে। দুজনই বাচ্চা। ছেলেটা বর সাজা, মেয়েটা বউ। ছেলে বাচ্চাটাকে সামির চিনে। ছেলেটা সামির নিজেই। কিন্তু এটা কার সাথে ছবি তুলেছে, ঐ বাচ্চা বয়সে। মিতু বলে যাচ্ছে- এই যে দেখো। এই গুটুগুটু বাচ্চাটা তুমি। আর পাশে পুটুপুটু মেয়েটা আমি। কি কিউট।
সামির হেসে দিল। মিতু বলল, ওমা হাসছ কেন?
- আপনার কথা শুনে।
- আপনি মানে? এই তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? আমি তোমার চেয়ে আট মাসের ছোট।
- ও আচ্ছা।
- তুমি কি ও আচ্ছা ছাড়া, আর কিছু বলতে পার না?
- পারি।
- তবে বল না কেন? তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ।
- না তো।
সামিরকে ধরে ধরে পুরো ঘরের, সব একে একে দেখাল মিতু। নিজের প্রিয় বই গুলো, নিজের আঁকা ছবি, টেবিলের উপর, বিছানার উপর সাজানো পুতুল গুলো। এমনকি নিজের ঈদের জন্য কেনা কয়েক সেট জামা কাপড়। এমন বাচ্চা মেয়ের মতন আচরণ দেখে, সত্যি অবাক সামির। মনে হচ্ছে, কত বছর ধরে চিনে সামিরকে। সামির একটা ছেলে এটা হয়ত মাথায়ই নেই মিতুর। অনেক কাছের বন্ধুর মত, অল্প সময়ের মধ্যে হুরহুর করে সব বলে দিল। তিন চার দিনের মধ্যে মনে হচ্ছিল, দূরত্ব অনেক কমে গেছে দুজনের। সামির যা একটু দূরত্ব রেখে চলত, মিতু তত আপন ভেবে সব বলে যেত। সামির এই কয়েকদিন কথা বলে বুঝতে পারত। একটা বন্ধু ছাড়া, কাছের মানুষ ছাড়া মেয়ে, হঠাৎ করে যেন অনেক কাছের কেউ পেয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, কখনও ছেলেদের না মেশা একটা মেয়ে, কি রকম আচরণ করতে হয় ছেলেদের সাথে, কতটা দূরত্ব রাখতে হয় তার কিছুই জানে না। সামিরকে বলে মিতু, তোমার কোন মেয়ে বন্ধু আছে?
- না।
- আমারও কোন ছেলে বন্ধু নেই। আমি কোন ছেলের সাথে কথাও বলি না। গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজ, মোবাইল নেই, ফেসবুক চালাই না। সারাদিন এই ঘরে থাকি। আমার ভাল লাগে না অন্য মানুষকে। তোমাকে ভাল লাগে।
- হাহা।
- তুমি অনেক কম কথা বল।
- হুম।
- কাল তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
- কি?
- এখন বলব না।
পরদিন বিকেল বেলা। সোফায় বসে টিভি দেখছিল সামির। মিতুর মা, আর দাদীর সাথে। মিতু এসে বলল, আম্মু, সামিরকে তোমার কোন দরকার আছে?
- না। কেন?
- তাহলে ওর সাথে আমি গল্প করব, আমার রুমে।
- আচ্ছা যা। এটা বলার কি আছে?
সামিরকে ঘরে বসিয়ে মিতু বলে, তুমি একটু বস। আমি আসছি একটু পর। দেখাব।
সামির অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর, মিতু আসে ঘরে। একটা লাল শাড়ি পরে। রক্তের মত লাল শাড়ি। খোপায় বেলি ফুলের মালা। লালের সাথে সাদা বেশ লাগছিল। মিতু এসে সামনে দাড়ায় সামিরের। এ যেন এক অন্য রকম মিতু। টি শার্ট পরা মিতু আজ শাড়ি পরেছে। সত্যি অসাধারণ লাগছে দেখতে। দেখেই বুকের ভিতর, কেমন যেন করে উঠল সামিরের। মনে হল একটা মেয়ে, কত নিখুঁত হতে পারে। একটা মেয়ে কতটা পবিত্র হতে পারে। একটা মেয়ে কতটা ভাল হলে, তার ব্যাপারে বলা যায়, এর মধ্যে কোন খুঁত নেই। সত্যি কোন খুঁত নেই। সামির মুখ ফসকে বলে দেয়, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে।
মিতু লাজুক মুখে তাকায় সামিরের দিকে। একটু থেমে বলে, তোমাকে একটা গান শুনাই?
- আচ্ছা।
- আমি কিন্তু অনেক ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারি।
- তাই?
- হুম। শুনাই তোমাকে?
- আচ্ছা।
মিতু চোখ বন্ধ করে গেয়ে যাচ্ছে। লাল শাড়ি পরে।
" ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি, কে আমারে?
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা, দিন যে আমার কাটে না রে ॥
বুঝি গো, রাত পোহালো,
বুঝি ওই ,রবির আলো,
আভাসে, দেখা দিল গগন-পারে--
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ, পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥ "
মিতু চোখ বুজে গাইতে গাইতে, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। হঠাৎ করে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। সামির কি বলবে ভেবে পায় না। আস্তে করে বলে, এই মিতু, কাঁদো কেন? কি হইছে?
- তুমি বুঝবে না, একদম না।
- বল কি হইছে?
- বলব না তোমাকে।
- কেন?
- বললে তুমি কিছুই করতে পারবে না।
- আরে বল তো। কেঁদো না।
- সামির, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।
সামির চুপ হয়ে যায় একদম চুপ। বলে না কিছু। এই কথাটা শোনার জন্য কোনভাবে প্রস্তুত ছিল না। মিতু সামিরের হাত ধরে বলল, আমার হবে না তুমি?
সামিরের ইন্দ্রিয়গুলো বড় অকার্যকর লাগছিল। শুধু ঘরের মিষ্টি সুবাসটা পাচ্ছিল। আজও সেই সুবাসটা পাচ্ছে। নতুন ছাত্রীর ঘর থেকে। একটা চেয়ারে বসে আছে সামির। তার ঠিক সামনের চেয়ারে ছাত্রীটা। নাম জ্যোতি। মিতুর মত টি শার্ট পরা। মাথা নিচু করে পড়া বুঝাচ্ছে সামির। মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। কেন যেন তাকাচ্ছে না। সেদিনের পড়া শেষ হলে, জ্যোতি বলে, স্যার আপনি মেয়েদের দেখতে লজ্জা পান?
- না। কেন?
- আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন না তো। তাই জানতে চাইলাম।
- ওওও। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
- হ্যাঁ করেন স্যার।
- তোমার ঘরে কি ফুল আছে নাকি?
- না। আমার রুমের সাথেই আপুর রুম। দুজনের রুমে এই দরজা দিয়েই যেতে হয়। আপুর রুমে ফুল। আপু ফুল পছন্দ করে অনেক। প্রতিদিন ফুল পাল্টায় ঘরের। আপুর রুম থেকেই আমার রুমে ঘ্রাণ আসছে।
- ও আচ্ছা। আসি তাহলে আমি আজ। পড়া ভাল খারাপের উপর আগামীকাল আসা নির্ভর করছে। কেমন পড়ালাম আব্বু আম্মুকে বল।
- আপনার পড়া ভাল লেগেছে।
- আমাকে না। আব্বু আম্মুকে বল।
- আচ্ছা স্যার।
সামির চলে আসে ঘর থেকে। বুকের ভিতর কষ্ট কষ্ট লাগছে কেন যেন? পিছনের কিছুই ভাবতে চায় না সামির। লিফটে চড়ল না। হেঁটে হেঁটে নামল তিন তলা হতে। নেমে হাঁটছে রাস্তায়। সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেছে। একটু আধটু অন্ধকার। সেই অন্ধকার তাড়াচ্ছে রাস্তার পাশে জ্বলতে থাকা, সোডিয়াম বাতিগুলো। ফোনের রিংটোন শুনে, ধরল ফোনটা সামির। মা কল করেছে।
- হ্যালো আম্মু।
- হ্যাঁ, ভাল আছিস বাবা?
- হ্যাঁ ভাল।
- তোর রফিক কাকা যে যেতে বলছিলেন, এক জায়গায় গেছিলি?
- হ্যাঁ।
- কি বলল। একটা টিউশনি হবে মনে হয়।
- যাক বাঁচা গেল। কত করে দিবে?
- ঠিক করি নাই।
- ঠিক করে নিবি না?
- কম দিবে না, জানি।
- আজ কি আসবি বাসায়?
- না। এখন আসব কি করে?
- কাল বন্ধ না?
- হ্যাঁ।
- চলে আয় তাহলে। তোর জন্য মাছ রান্না করব। আব্বু মাছ এনেছে। তোর ছোট বোন ইলিশ মাছ খেতে চায়। বাজারে পাওয়া যায় না, ইলিশ। ৪-৫ দিন আগে থেকেই যে দাম। কেনার মত না। তাই এমনি মাছ এনেছে।
- ওওও ভাল। সুমিকে ভাল করে রান্না করে খাইয়ে দিও। রাখি এখন।
রেখে দেয় সামির। মা বোধহয় খুশি হয়েছে অনেক। অনেক দিন থেকেই বলছে, একটা টিউশনি পাস কিনা দেখ।
সামির বুঝত টাকা পাঠাতে কষ্ট হয় বাসা থেকে। এখন হয়ত একটু একটু কমবে সেই কষ্ট। নিজের টাকাটা নিজে যোগাড় করতে পারলে। একটু সুখ, একটু তৃপ্তি পাওয়া যাবে। সামিরের মত যারা, তাদের জীবনের সুখ দুঃখগুলোর হিসেব কত চটজলদি হয়ে যায়, চাওয়া গুলো ছোট। পাওয়া গেলে সুখ, না পাওয়া গেলে কষ্ট। এই জীবনে প্রেম ভালবাসা থাকতে পারে না। এসব জটিল জিনিস। জটিলতা জীবনে আনতে নেই। মিতুর মত অত ধনী মেয়ে ভালবাসা তো কখনই নয়। একটু মোহে পড়ে হুট করে ভালবাসি বলে দিতেই পারে। তাই বলে সেই ভালবাসা আঁকড়ে রাখার সাধ্য সামিরের নেই। এই কথাগুলোই সেদিন বুঝিয়েছিল মিতু কে। লাল শাড়ি পরে যখন, হাত ধরেছিল। সামির আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে বলেছিল, মিতু তোমার আমার এসব হয় না। আমাকে ভালবাসার কিছু নেই। আমি তোমার যোগ্য না। তুমি কখনও কোন ছেলের সাথে মিশ নি। হুট করে আমার সাথে মিশে একটা মোহ তৈরি হয়েছে। এই মোহ থাকবে না। বাহিরের অন্য কারও সাথে মিশলেই চলে যাবে।
- মোহ না সামির। আমি তোমাকে ভালবাসি।
- আমি বাসি না। বাসা সম্ভব না। বাস্তবতা এতো সহজ নয়। মোহ এক জিনিস। বাস্তবতা এক জিনিস।
- আমার ভালবাসা বাস্তব।
- তবুও সম্ভব না। আমি তোমাকে ভালবাসতে পারব না।
- প্লিজ, সামির।
- আমিও প্লিজ বলছি।
- আমাকে ভালবাসবে না?
- না।
- আচ্ছা। যাও তুমি।
সামির চুপ করে ঘর থেকে চলে আসে। মিতু সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দেয়। সেদিন আর খুলে না। মা অনেক বার ডাকে, দাদী অনেক বার ডাকে। বারবার মিতু বলে, আমাকে জ্বালাতন করবে না। তার পরদিন মিতুকে না বলেই ভোর বেলা চলে আসে সামির। আর কখনও দেখা হয় নি মিতুর সাথে। মাঝে শুধু একদিন কথা হয়েছে। মিতু আমেরিকা চলে যাবার সময়। কেন যাচ্ছে জানেনা সামির। এয়ারপোর্ট থেকে কল করে সামিরকে। বলে, সামির আমি চলে যাচ্ছি। আর কখনও আসব না। দেখাও হবে না। কথাও এই শেষ। তুমি বলেছিলে মোহ, আমার ভালবাসা মোহ। আমি তোমার কথা মত অনেক ছেলের সাথে মিশেছি। আমি এতোটা খারাপ হয়েছি বলার মত না। তবুও আমি তোমাকে ভালবাসি, এখনও ভালবাসি। সেদিন হাত সরিয়ে বলেছিলে, তুমি আমার যোগ্য না। আজ আমি বলছি, আমি তোমার যোগ্য না। তাই চলে যাচ্ছি। আর আসব না। ভালবাসি তোমাকে অনেক।
আর কথা হয় নি কোনদিন মিতুর সাথে। ইচ্ছেও করে না। অন্য কাউকে ভালবাসার চিন্তাও মাথায় আসে না।
আজ ১৩ তারিখ। ১৩ এপ্রিল। কাল ১৪ এপ্রিল। পহেলা বৈশাখ। পুরো শহর নানা রঙে সাজছে। রঙিন সাজে। কাল হাসবে সবাই, ঘুরবে সবাই। এই আয়োজন যাদের জন্য তারা মাতবে উৎসবে। ভালবাসার মানুষটার হাত ধরে ঘুরবে অনেকে। সামিরের কেউ নেই। সামির হয়ত সকাল দুপুর বিকেল ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবে। অনেক সুখী একটা ভাব আসছে। একটা টিউশনি হয়ত পেয়েই গেল। এই জীবনে মিতুর মত কেউ থাকতে পারে না। মিতুর ঘরে অভাব নেই, মিতুর সামিরের মত মাথা নিচু করে, লোকের কাছে সাহায্যের জন্য যেতে হয় না। প্রতিদিন মায়ের মুখের শুষ্ক কথা শুনতে হয় না। শুন্য মানিব্যাগে ঘুরতে হয় না। মিতুর ফুল কেনার টাকায় সামিরের জীবন, বেশ ভালভাবেই চলে যায়। সামিরের পাঞ্জাবি কিনতে হয় না, পহেলা বৈশাখে। মিতুর প্রতি উৎসবে পোশাকের ভাণ্ডার জমে যায়। এতো অমিলে ভালবাসা হয় না। হারিয়ে যায়, একসময়। মানিয়ে চলা হয়ত এতো সহজ নয়। সামিরের সুখ ওখানে, যখন মা বলে, যাক বাঁচা গেল, টিউশনিটা পেলি।
সোডিয়াম বাতির নিচে হাঁটছে সামির। একটু একটু মেঘ আকাশে। এই মেঘ কাল বৈশাখী হবে না। উড়ে উড়ে হারিয়ে যাবে। দূরে কোথাও চলে যাবে। দৃষ্টির বাইরে। কালবৈশাখী হতে, ঘন কালো মেঘ লাগে। ঝড় বাতাস লাগে। এই ছোট ছোট মেঘে তা হয় না। এই ছোট মেঘ গুলো সামিরের ছোট ছোট সুখের মত। ছোট ছোট দুঃখের মত। কালবৈশাখী হবার সাধ্য এ মেঘের নেই। তেমনি মিতুর হাত ধরে চলার সাধ্য সামিরের নেই। সামিরের সাধ্য শুধু, নানা ফুলের সুবাসে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো।
১৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ২:৫০
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া। ভাল লাগে এমন ছোট বড় ভুল ত্রুটি গুলো ধরিয়ে দিলে
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৪৯
মামুন রশিদ বলেছেন: গল্পটা অনেক ভালো লেগেছে । ছাত্রীর রুমের যাওয়ার সময় ফুলের সুভাস তাকে মিতুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে । এটা খুবই স্বাভাবিক, আর ফ্ল্যাশব্যাকে মিতুর কথা তার মনে আসতেই পারে । কিন্তু মিতুর অংশটা আরো একটু ছোট করে আনলে গল্পের গতিটা ঠিক থাকত । আর মিতুর সাথে তার গভীর সম্পর্কের ব্যাপারটা পাঠকের বুঝতে তেমন সমস্যা হতো না ।