নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ বৃষ্টি শুন্যতা, বৃষ্টি পূর্ণতা

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ২:১৪

বাহিরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে খুব বাতাস। জানালা দিয়ে মুখের উপর এসে পড়ছে বৃষ্টির আঁচ। রাতের অন্ধকারে, বৃষ্টির ফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। তবে একটু পর পর বিজলির ঝলকে, বাহিরের ভিজে থাকা গাছ গুলোর সাথে, বৃষ্টির ঝরে যাওয়া চোখে পড়ছে। এলোমেলো ফোঁটা গুলোর ঝরে পড়া দেখা যাচ্ছে। এমন বৃষ্টি ঝরা রাতে ঘুমাতে অনেক ভাল লাগে। বিছানার ঠিক মাঝখানে ঘুমাচ্ছে লিরা। পাতলা কাপড় চোপড় শরীরে। কয়েকদিন ধরে খুব গরম, তাই। আর নাবিদ এসে জানালা ধরে বৃষ্টি দেখছে। চোখে মুখে লাগাচ্ছে, বৃষ্টির আঁচ। ফ্ল্যাট বাসা। ইট সিমেন্টের এই দালানে, বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। তবুও নাবিদের মনে হচ্ছে, কানের কাছে একটা শব্দ পাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। মনে হচ্ছে ছোট বেলার সেই ঘরটায় আছে। একটু বৃষ্টি হলেই মা ব্যাস্ত হয়ে যেতেন। পুরনো জং ধরা টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ছে। সেই পানি থামাবার কাজে। আর নাবিদ হাফ প্যান্ট বা কখনও লুঙ্গি পরে জানালার গ্রিলের ফাক দিয়ে, নাক বের করে দিত। বৃষ্টি দেখত। হাত বের করে বৃষ্টি ধরত। পাশের বাসার তিন মেয়েকে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে, কাদায় লাফালাফি করতে দেখত। তিন বোনকে বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় দেখতে ভালই লাগত। বুকের ভিতর কেমন যেন ধুপ ধুপ করত। মাঝে মাঝে মায়ের কাছে আবদার করত বৃষ্টিতে ভেজার। কখনও অনুমুতি মিলত, বেশীর ভাগ সময় মিলত না। ভিজে ভিজে পুরো এলাকা ঘুরত নাবিদ। কখনও দেখা যেত বাবা বৃষ্টিতে ভিজে, কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন। বৃষ্টির ভিতর ভিজে বাবাকে সবসময় নাবিদ কাঁঠাল আনতেই দেখেছে। আর কিছু কখনও না। এই ব্যাপারটার রহস্য এখনও জানে না নাবিদ। হয়ত বাবার বৃষ্টি দেখলেই উদাসী হয়ে, কাঁঠাল খেতে ইচ্ছে করত। নাবিদের ভালই লাগত। বৃষ্টির দিন বাবা, বড় কাঁঠাল আনতেন। আর বৃষ্টি ছাড়া অন্য দিন হলে, পিচ্চি পিচ্চি কাঁঠাল।

একটা বয়সে এসে বৃষ্টি দেখলেই ভিজতে মন চায়। বৃষ্টি ভিজে অন্য কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে। কলেজে উঠবার পর, নাবিদের বৃষ্টিতে না ভিজলে প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে যেত। ভেজা ইউনিফর্মে বাসায় যেতে বেশ লাগত। কলেজ ছুটির পর বৃষ্টি থাকলে তো কথাই নেই। বৃষ্টিতে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকত নাবিদ। পাশে এসে বীথি প্রায়ই বলত, তোমার কাছে ছাতা আছে?

-না।

- যাবে কিভাবে?

- দেখি বৃষ্টি থামে কিনা। নয়ত ভিজেই চলে যাব।

- আচ্ছা চল, তোমার সাথে যাই আজকে। দুজন ভিজতে ভিজতে যাব।



বীথির সাথে ভিজতে ভিজতে যেতে ভালই লাগত। অনেকে হিংসার চোখে তাকাত। তাদের পাশে ভিজে যাবার কোন সঙ্গী নেই তাই। মাঝে মধ্যে বীথি চোখ বন্ধ করে রাস্তার মধ্যে দাড়িয়ে থাকত। নাবিদ তাই দেখত। দেখে জিজ্ঞেস করত, কি কর?

- অনুভব করি।

- কি?

- গাধা, বৃষ্টি।

- ও আচ্ছা।



এমন এক বৃষ্টির দিন। বৃষ্টির বেগ অনেক বেশী। বাতাসের বেগ দেখে মনে হচ্ছে, সাইক্লোন টর্নেডো হচ্ছে। চারপাশ প্রচণ্ড অন্ধকার। একদম রাতের মত। বিকেল বেলা মনে হচ্ছিল, রাত হয়ে গিয়েছে। খুব বিজলি চমকাচ্ছে। গাছ গুলো একে বেঁকে যাচ্ছে। কোনটার ডাল পালা ভেঙ্গে পড়ছে। কোনটা উপড়ে পড়ছে। কলেজের কাউকে বৃষ্টি থামার আগে, বের হতে না করেছে স্যাররা। সবাই দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে, বৃষ্টি থামার। এমন সময় বীথি এসে বলে,চল না বৃষ্টিতে ভিজে যাই আমরা।

- মাথা খারাপ তোমার? এতো বৃষ্টির মধ্যে, আর বাহিরে অবস্থা দেখেছ? উড়িয়ে নিয়ে যাবে। বৃষ্টি কমুক একটু, তারপর।

- আরে না, চল না।কিছু হবে না।

- স্যাররা যে না করলেন।

- তারা দেখবেন নাকি? আমরা চলে যেতে পারছি চলে যাব।



বীথির জোরাজুরিতে রাজি হয় নাবিদ। অত বৃষ্টির মধ্যেও বের হয়ে আসে, বীথির সাথে। বার বার বিজলি চমকে ওঠা, আর বজ্রপাতের শব্দে বেশ ভয়ই লাগছিল নাবিদের। বাহিরে নাবিদ আর বীথি ছাড়া আর কেউ নেই। রাস্তায় একটা রিকশা পর্যন্ত নেই। বীথি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছিল মনে হয়। অন্য দিনের তুলনায়, আজ একটু বেশীই পাশ ঘেঁষে হাঁটছিল নাবিদের। নাবিদ একটু পর পর বলছিল, চল কোন গাছের নিচে যাই।

বীথি বার বার হেসে বলে, তুমি এতো ভীতু। আগে জানতাম না।

নাবিদ আর কিছু বলে না। হুট করে বীথি হাত ধরে ফেলে নাবিদের। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। নাবিদ অবাক চোখে তাকায় বীথির দিকে। এই বৃষ্টিতে ভিজে, চোখে মুখে অন্য কিছু খেলা করছিল বীথির। নাবিদের দুই হাত ধরে বলে, নাবিদ, আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি বুঝতে পার না? প্লিজ একটু জড়িয়ে ধরি তোমাকে?

নাবিদের হাত পা কাঁপে ভয়ে। কেউ যদি দেখে ফেলে এই অবস্থায়। বীথি আস্তে করে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত দুটো নাবিদের পিঠে রাখতেই, নাবিদ সরিয়ে দেয় বীথিকে।

- কি করছ এসব? আমি তোমার বন্ধু। তুমিও আমার ভাল বন্ধু। এসব হয় না, আমাদের মধ্যে।



বীথি নিশ্চুপ চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ নাবিদের দিকে। প্রচণ্ড অপমানে, চোখে জল চলে আসে। নাবিদের পাশে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটবার সময়, বীথি নিঃশব্দে কাঁদছিল। বলে নি কিছু নাবিদ। কিছু বলার নেই। এই নীরবতা আর ভাঙ্গে নি। কলেজের বাকিটা সময় আর কোনদিন নাবিদের সাথে, কথা বলে নি বীথি। শুধু বৃষ্টি হলে, একবার নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকত নাবিদের দিকে। এইটুকই। কিশোরী বয়সের সেই প্রেমের দাগ কাঁটাতে, কতটা সময় লেগেছিল বীথির জানেনা নাবিদ। তবে ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়, বীথির বিয়ে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে নাবিদ যখন যায়। একটু নির্জন কোণে ডেকে নাবিদকে চুপিচুপি বলে বীথি, এটা নাও। একটা ছাতা। আমি দিলাম। বৃষ্টির দিনে ব্যবহার করবে। আর আমাকে মনে পড়বে। একটা অনুরোধ, অন্য কোন মেয়ের সাথে ভিজো না বৃষ্টিতে। আমার মত প্রেমে পড়ে যাবে। আর নাবিদ, আমি তোমাকে এখনও ভালবাসি। তবে তোমার সাথে আর কখনও কথা হবে না। এই শেষ।



নাবিদ ছাতাটা হাতে নিয়ে, বিয়ের অনুষ্ঠানের পুরোটা ঘুরেছে। খাওয়া দাওয়া করেছে। অনেকেই বলেছে, কি ব্যাপার ছাতা কেন হাতে, এই দিনে? বৃষ্টি তো নেই। রাতের বেলা রোদেরও ভয় নেই।

নাবিদ একটু মুচকি হাসি ছাড়া আর কিছু বলে নি। সত্যি সেই শেষ কথা, বীথির সাথে। আর কখনও কথা হয় নি। ভার্সিটির বছর গুলোতে বৃষ্টিতে ভেজা হত না। কেন যেন ছাতা মাথায়, হাঁটত। আর বৃষ্টি দেখলেই ক্লাসে না গিয়ে, কাথা মুড়ি দিয়ে, ঘুম দিত। অবশ্য মাঝে মধ্যে উদাসী হয়ে, ছাতা মাথায় ঢাকার রাস্তার রাস্তার বের হত। হাঁটত আর মানুষ দেখত। যে যেভাবে পারে, বৃষ্টি থেকে বাচাচ্ছে নিজেকে। কেউ কেউ চায়ের দোকানে ভিড় করে চা খাচ্ছে, গরম হবার জন্য। কেউ কাজটা সারছে, রিকশায় হুড তুলে, ভালবাসার মানুষকে জড়িয়ে।



প্রথম কাউকে ভাললাগা, বুকের ভিতরের অনুভূতি এলোমেলো হয়ে যাওয়া, এমন এক বৃষ্টির দিনেই। ভাললাগা মানে ভালবাসা না। ভালবাসা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় নি। ভার্সিটির ক্লাস শেষে, বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে ছিল। ছাতা হাতে থাকলেও কেন যেন, নামতে ইচ্ছা করছিল না বৃষ্টিতে। কোথা থেকে এক মেয়ে ভিজে টিজে এসে বলল, নাবিদকে, তোমার ছাতাটা দিয়ে একটু হেল্প করতে পারবে? আমাকে একটু ভার্সিটি পর্যন্ত দিয়ে আসবে?

এই মেয়েকে ভার্সিটিতে আগেও অনেক বার দেখেছে নাবিদ। শ্যামলা করে। কিন্তু চেহারার দিকে তাকালে, মুখ ফেরাতে সময় লাগে। শ্যামলা ভাবটাই যেন রূপ অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। নাবিদ মাথা নেড়ে বলল, যাবে।

- থ্যাঙ্কু। একটু চল না। আমাকে দিয়ে আসবে। আমার একটা এক্সট্রা ক্লাস আছে আজ।



নাবিদ ছাতা ফুটিয়ে বৃষ্টির ভিতর, মেয়েটার সাথে এক ছাতার নিচে যায়। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি সুভাস আসছিল শরীর থেকে। নাবিদ ভিজে যাচ্ছিল পুরো , মেয়েটাকে জায়গা দিতে গিয়ে। তবুও ভাল লাগছিল। গায়ের সাথে গায়ের ছোঁয়ায় অন্যরকম লাগছিল। কেন যেন তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছিল, মেয়েটার মুখের দিকে। ভাললাগা ভাললাগা একটা ভাব আসছিল মনের মধ্যে। ক্লাসের সামনে দিয়ে আসার পর, মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, তুমি তো একদম ভিজে গেলে। আমার জন্য অনেক কষ্ট করলে, অন্য একদিন এসো, একসাথে ক্যান্টিনে কফি খাব।

- আচ্ছা।



মিষ্টি হাসি দিয়ে মেয়েটা চলে যায়। তবে চোখের ভিতর কেন যেন হাসিটা লেগে থাকে নাবিদের। সেদিন চোখ বন্ধ করলেই নাবিদ সেই হাসিটা দেখে। অপেক্ষা করে পরের দিনের। আবার মেয়েটাকে দেখার।মনে মনে ঠিক করে নেয়, বলার জন্য অনেক কথা। পরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে, দেখা হয়ে যায় ঠিক সেই মেয়েটার সাথে। মেয়েটা আবার সেই মিষ্টি হাসি হেসে বলে, বাহ, দেখা হয়ে গেল। চল কফি খাই।



কফি খেতে খেতে মেয়েটা জিজ্ঞেস করে নাবিদকে, কেমন আছ?

- ভাল। তুমি?

- এইতো চলছে।



বলে মেয়েটা একটু চোখ মুখে একটা অন্য রকম ভাব এনে বলে, তুমি তো ফোর্থ সেমিস্টার তাই না?

- হ্যাঁ। তুমি?

- আমি সিক্সথ সেমিস্টারে।



নাবিদ মাথা নিচু করে ফেলে। সামনে থাকা গরম কফি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে, পানির মত।

- সরি আপু। আমি ভাবছিলাম......। তাই তুমি করে বলে ফেলেছি।

- আরে ঠিক আছে, ব্যাপার না। তুমি আমাকে তুমি করেই বলত পার। তা নাম কি?

- নাবিদ, আপু।

- আমি ইশা।



হুট করেই মনের মধ্যের সব কিছু ভেঙ্গে যায়। ভাবনা গুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। শুন্য শুন্য একটা ভাব আসে মনের ভিতর। ভাললাগা মানুষটাকে ভাললাগার কথা বলা হয় না। সমাজের নিয়মে আঁটকে যায়, মনের ভাললাগা। দূরে বহুদূরে সেই ভাললাগা তাড়িয়ে দিয়ে, বেশ ভালই সময় কাঁটায় ইশা আপুর সাথে। ইশা বেশ বন্ধু সুলভ। মাঝে মধ্যে নাবিদকে ফোন দিয়ে বলে, আজ তোর সময় হবে? পিঠা উৎসব হচ্ছে রমনা পার্কে। আমার সাথে যাবি।

বা কোন দিন বলেন, চলে আয় তো টি এস সি তে। তোকে ছাড়া ভাল লাগছে না।

কিংবা কোনদিন, গায়ে চিমটি কেটে বলতেন, কিরে কোনদিন কি তোর প্রেম হবে না? কোন মেয়েই জুটে না কপালে তোর?

নাবিদ তখন শুনিয়ে দেয়, বীথির গল্প। সাথে আরও কয়েকটা মন গড়া কাহিনী। যে কাহিনীর সব মেয়েই নাবিদের জন্য পাগল ছিল। কিন্তু নাবিদ ভাল ছেলে, তাই পাত্তা দেয় নি। সে কাহিনী শুনে ইশা আপু হাসে। আর ইশা আপুকে হাঁসতে দেখলেই, নাবিদের বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠে। বার বার মনে হয়, কেন ভাগ্য এতো খারাপ? একটা বছর আগে ভার্সিটিতে ভর্তি হলে কি হত? বা বাবা মা এক বছর আগে স্কুলে ভর্তি করালে কিইবা হত?

ইশা আপুকে ভাললাগার কথা বলা হয় নি কোনদিন। ইশা আপুরও বিয়ে হয়ে যায় এক বছর পরেই। পাশ করার সাথে সাথে। নাবিদকে দাওয়াত দেয়, কিন্তু নাবিদ যায় না। নাবিদের কেন যেন সেদিন খুব কষ্ট হয়। বুকের ভিতর খুব ব্যথা করে। দরজা বন্ধ করে, কাঁদে নাবিদ। মেয়ে মানুষের মত, ফ্যাত ফ্যাত করে কাঁদে। একটা বয়সে বড় মেয়ের প্রতি কোথা থেকে এই ভালবাসা এসেছিল, জানে না নাবিদ। ইশা আপুর বিয়ের দিন, বৃষ্টি থাকে। সেই বৃষ্টি দেখে, আরও বেশী মনে পড়ে ইশা আপুর কথা। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে, খিল খিল করে হাসছে ইশা আপু। চোখের সামনে বার বার তা ভেসে উঠে। সন্ধ্যার পর ফোন দেয় ইশা আপু। কেঁদে ভাঙা গলায়, ফোন ধরে নাবিদ। ওপাশ থেকে ইশা আপু বলে, তুই আসলি না কেন এখনও? আর কতক্ষণ লাগবে?

- আপু আমি অসুস্থ। আসতে পারব না।

- তুই মইরা গেলেও তোর আসতে হবে। তুই না আসলে আমি বিয়ে করব না।



ইশা আপুর জেদে, বৃষ্টিতে ভিজে যায় বিয়ের অনুষ্ঠানে নাবিদ। নাবিদকে পাশে বসিয়ে রাখে ইশা। নানা জনে জিজ্ঞেস করে , এ কে?

ইশা উত্তর দেয়, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমার ছোট ভাই, আমার বন্ধু।

নাবিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইশা আপুর দিকে। অন্য রকম একটা শ্রদ্ধা , সম্মান জন্মেছিল সেদিন ইশা আপুর প্রতি। সেদিন নাবিদ জেনেছিল, বুঝেছিল, প্রেমিক প্রেমিকা ছাড়াও, ভালবাসার আরও অনেক সম্পর্ক হতে পারে। বিশ্বাসের আরও সম্পর্ক থাকতে পারে। ইশা আপু চলে যাবার আগে শ্বশুর বাড়ি, নাবিদের হাত ধরে বলে, কাঁদছিলি কেন পাগল? আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি? তোর সাথে আড্ডা চলবে। তোর জন্য আমার শ্বশুর বাড়ি সবসময় ফ্রি। চলে আসবি, আড্ডা দিব, চানাচুর খাবি, পকেটে করে নিয়েও যাবি।

নাবিদ হেসে দেয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত, নিয়মিত যায় ইশা আপুর শ্বশুর বাড়ি। ইশা আপুর হাসবেন্ডের সাথেও ভাল সম্পর্ক। এখন একই অফিসে জব করছে দুজন, নাবিদ আর ইশা আপুর হাসবেন্ড।



আর এক বর্ষা, জীবনের সবচেয়ে খারাপ খবরটা নিয়ে এসেছিল। পাশ করে বের হয়ে মাত্র, চাকরিতে ঢুকেছে তখন নাবিদ। এক বিকেলে, এমন বৃষ্টি ঝরা বিকেলে, মা ফোন দিয়ে নাবিদকে বলে কেঁদে কেঁদে, নাবিদ বাবা, বাসায় আয়।

- কি হইছে আম্মু?

- বাসায় আয় তুই। তোর আব্বুর অবস্থা ভাল না।



বাবা কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হুট হাট শরীর খারাপ করত। আম্মু প্রায় দিনই বলতেন। এবার খারাপ কিছু হয় নি তো? অনিশ্চয়তায় ভাবনায়, বাসায় চলে যায় নাবিদ। বাসের জানালার গ্লাসে বৃষ্টির ঝরে পড়ার সাথে সাথে, বাবার মুখটা বার বার দেখছিল নাবিদ। পথ যেন শেষ হতে চাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টি গুলো পথে স্পিড ব্রেকারের মত দাড়িয়ে আছে। বাসের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। নাবিদ যখন বাসায় যায়, ঘরে ঢুকে দেখে, অনেক লোক। বুকের ভিতর ধক করে উঠে। মায়ের সামনে যেতেই মা জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন। বুঝতে বাকি রয় না। বাবা নেই আর। মায়ের চোখের জল ঝরতেই থাকে। নাবিদের চোখ যেন শুকিয়ে গেছে। বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কাঁদতে পারছে না। চোখ দিয়ে জল বের হচ্ছে না। বাবাকে কবর দেবার পর, সেদিন রাতে একা একা কবরের পাশে যায় নাবিদ। বৃষ্টি হচ্ছে তখনও। বাবার কবরের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন করে উঠে বুকের ভিতর। বাবাকে ডেকে বলে, বাবা, অনেক বৃষ্টি হচ্ছে, একটা বড় কাঁঠাল নিয়ে আসো না।

বলেই কাঁদতে থাকে নাবিদ। বৃষ্টির সাথে যেন পাল্লা দিয়ে জল ঝরাচ্ছে নাবিদ। দরজার দিকে তাকিয়ে বার বার নাবিদ ভাবছে, বাবা আবার তেমন বৃষ্টিতে ভিজে, বড় একটা কাঁঠাল নিয়ে ঘরে ঢুকবেন। বাবা আসেন না। তবুও কবরের সামনে দাড়িয়ে নাবিদের মনে হয়, বাবা পাশে দাড়িয়ে আছেন।বলছেন, বোকা ছেলে, কাঁদিস কেন? সবাই কি সারাজীবন বাঁচে রে?

নাবিদ কাদার ভিতর বসে বসে কাঁদে। বাবার জন্য কিছু করার আগেই বাবা হারিয়ে গেল। বাবা বাবা বলে অনেকক্ষণ চিৎকার করে নাবিদ। বাবা শুনতে পারেন না হয়ত, নয়ত শুনেও সুযোগ দিচ্ছেন, একটু কেঁদে হালকা হবার।



সেই বর্ষা জীবনের সবচেয়ে খারাপ বর্ষা হয়ে থাকে। বৃষ্টি হলেই নাবিদের মনে হত, বাবা এই বুঝি বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে এসে ঢুকবেন। কাঁধে বড় কাঁঠাল নিয়ে। কেন যেন এরপর থেকে কাঁঠাল খাওয়া ছেড়ে দেয় নাবিদ। কাঁঠাল দেখেলেই বাবার কথা প্রচণ্ড মনে পড়ত। কান্না পেত। মাকে নিয়ে আসতে চায় নাবিদ, নিজের কাছে ঢাকায়। মা আসেন না। ওখানেই থাকেন।

এদিকে চাকরিতে ভাল করতে থাকে নাবিদ। বেতন ভাল পায়। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ধানমন্ডিতে একটা ফ্ল্যাটও কিনে নেয়। মাকে নিয়ে আসতে চায়। মা বলেন, বিয়ে কর। বউ নিয়ে থাকবি। বউ আসলে ঘরে তখন আসব।

মা মেয়ে দেখতে শুরু করেন। নাবিদের পছন্দের কেউ নেই। মায়ের পছন্দেই বিয়ে হয়। লিরা, বউ এর নাম নাবিদের। এখন বিছানার মাঝখানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। বেশ ভাল একটা মেয়ে। শান্ত, ভদ্র। নাবিদকে ভয় পাবার কিছু নেই, তবুও প্রথম প্রথম অনেক ভয় পেত। সেই ভয় এখন কেটে গেছে। আগে নাবিদকে জড়িয়ে ধরতেও ভয় পেত। এখন হুটহাট নিজে থেকেই জড়িয়ে ধরে। আপনি আপনি করে বলত আগে, এখন তুমি তুমি বলে। সারাদিন সংসারের কাজ, মায়ের সাথে গল্প, আর দুই বউ শাশুড়ি মিলে সন্ধ্যার পর টেলিভিশন দেখা। মাঝে মাঝে নাবিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, দুই বউ শাশুড়ি মার্কেটে যায়। শুধু দুজনের জন্য কেনাকাটা। সেই কেনাকাটায় নাবিদের জন্য থাকে না কিছু। নাবিদকে কিছু কিনতে হলে, নিজেই যেতে হয়। তারপরও বাসায় এসে শুনতে হয় , এসব কি এনেছ? তোমার পছন্দ এতো খারাপ? গোলাপি পাঞ্জাবি পরে কেউ?

সাথে মা ও যোগ দেন, ও এমনই। ছোট বেলা থেকেই, কি কি যে পছন্দ করে। বউটাকে তো সাথে করে নিয়ে যেতে পারিস।

মাঝে মাঝে খেতে বসে পরীক্ষা নেয়, কোন রান্না কে করেছে? মায়ের কাছ থেকে নতুন রান্না করা শিখেছে লিরা। নাবিদকে প্লেটে মুরগী তুলে দিয়ে বলে, বলতো এটা কে রান্না করেছে?

- মা।

- হয় নাই। এটা আমি রান্না করছি।

- বলতো এই মাছের ডিমের পেয়াজ ভুনা কে করেছে?

- তুমি?

- না হয় নি। এটা মা রান্না করেছেন। এটা আমি এখনও শিখিনি রান্না করা।



এই পরীক্ষায় ফেল করলে লিরা অনেক খুশি হয়। হেসে বলে, তুমি বোকা অনেক।

লিরার মুখে বোকা শুনতে, ভালই লাগে। মাঝে মধ্যে শুয়ে থাকলে পাশাপাশি লিরা বলে, আমরা কি আজকে সারারাত, না ঘুমিয়ে গল্প করতে পারি না?

- অবশ্যই পারি।

- তোমার কি তাহলে অফিসে কাজ করতে, কাল খুব সমস্যা হবে?

- না একদম না।

- তবে চল আমরা আজকে, সারারাত গল্প করি।



সারারাত গল্প চলে না। তার আগেই লিরা ঘুমিয়ে যায়। লিরার বড় বড় পুতুল লাগে ঘুমানোর সময়। বুকের ভিতর নিয়ে ঘুমায়। এতো বড় মেয়ে, তাও। লিরাকে অনেক পুতুল কিনে দিয়েছে নাবিদ। একেক দিন একেকটা বুকের সাথে জড়িয়ে ঘুমায়। মাঝে মধ্যে নাবিদ, রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, লিরার বুক থেকে পুতুল সরিয়ে, নিজের মাথা রেখে দেয়। লিরা সকালে উঠে বলে, এই এই, আমার পুতুলের জায়গায় তোমার মাথা কেন?

- কি যেন!! আমি তো জানিনা।

- মিথ্যুক, আমি জানি এটা তোমার কাজ।



নাবিদ হাসে। লিরা নাবিদের মাথার চুল ধরে, টান দিয়ে বলে, আর এমন করবে না।

এমন নানা মিষ্টি ভালবাসা, অভিমান, খুনসুটিতে, মা আর লিরাকে নিয়ে জীবন চলছে। বেশ ভালই চলছে। তবুও বৃষ্টি হলেই, নাবিদের বড় একা লাগে। বুকের ভিতর একটা শুন্যতা অনুভব করে। সেই শুন্যতা কিসে কাটে জানেনা নাবিদ। মাঝে মধ্যে মনে হয়, বৃষ্টির রাতে সারারাত লিরার সাথে গল্প করতে। কিন্তু লিরা বৃষ্টি হলেই ঘুমিয়ে যায়, পুতুল বুকের ভিতরে জড়িয়ে। এতো পূর্ণতার মাঝেও কিছু একটা শুন্যতা রয়ে যায়। তাইতো বৃষ্টি হলেই, জানালার কাছে চলে আসে নাবিদ। স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। এখনও যেমন দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারে নাবিদ। নাবিদ কাঁধে একটা শীতল নরম হাতের স্পর্শ পায়। লিরা ঘুম থেকে উঠেছে। নাবিদের পাশে দাড়িয়ে বলল, কি হয়েছে তোমার? ঘুমাও নি?

- কিছু না। বৃষ্টি হলে আমার ঘুম আসে না।

- গত কয়েকদিনই কি জাগছ?

- হুম।

- আমাকে ডাকলে না কেন?

- তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই।

- তাই ডাকবে না? আমি তোমার বউ, সব কিছু সঙ্গী।

-হুম।

- কি হইছে, আমাকে বল।

- বৃষ্টি হলে আমার খুব একা লাগে। খুব শুন্য মনে হয় বুকের ভিতর।

- কেন?

- জানিনা।

- আচ্ছা। চল ভিজবে বৃষ্টিতে?

- এই রাতে?

- হ্যাঁ।

- লোকে কি বলবে?

- লোকের কথায় কি আসে যায়? আমার অনেক দিনের ইচ্ছা, বরটার সাথে বৃষ্টিতে ভিজব।

- আচ্ছা চল।

- দাড়াও, ড্রেসটা চেঞ্জ করে নেই।



লিরা কাপড় পাল্টে একটা সবুজ শাড়ি পরেছে। নাবিদকেও জোর করে পরিয়ে দিয়েছে, নাবিদের কিনে আনা গোলাপি পাঞ্জাবিটা। আজ দেখতে ভালই লাগছে নাবিদকে। নাবিদ চুপচাপ দেখছে লিরাকে, বৃষ্টিতে ভিজতে যাবার কত আয়োজন। এতো আয়োজন করে কখনও ভিজেনি বৃষ্টিতে। নাবিদের হাত ধরে, চুপিচুপি চলে যায় ছাদে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে দুজন। লিরার মাঝে যেন অন্য রকম প্রাণ। নাবিদেরও ভাল লাগছে খুব। সব কিছুর বিশেষ কিছু থাকে। আজ বৃষ্টিতে ভেজার, বিশেষ কিছু উপভোগ করছে নাবিদ। জীবনের শ্রেষ্ঠ বৃষ্টিতে ভেজাটা উপভোগ করছে। লিরা বাচ্চা মেয়ের মত, বৃষ্টির পানি ধরতে চাচ্ছে, আর একটু পর পর নাবিদের হাত ধরে ঘুরছে। যেন কতদিনের জমানো বাসনা পূরণ হয়েছে। নাবিদের কাছে এসে লিরা কাঁধে হাত রাখল। চোখের দিকে তাকাল। নাবিদও তাকিয়ে লিরার চোখের দিকে। লিরা বলল, একটু ভালবাসবে?



নাবিদ অপলকে দেখছে লিরাকে। লিরা কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরল নাবিদকে। শক্ত করে, অনেক শক্ত। নাবিদও লিরাকে বুকের সাথে জাপটে ধরে থাকল। এতো দিনের বুকের ভিতরের শুন্যতা পূরণ হয়েছে। এতদিনের অপূর্ণতার অপেক্ষার পালা শেষে পূর্ণতা পেয়েছে। নাবিদ লিরার ভালবাসায়, আজ বৃষ্টি অন্য রঙে ঝরছে। নাবিদও জীবনের শ্রেষ্ঠ বৃষ্টি ভেজা উপভোগ করছে। আর লিরা অনেক দিনের জমানো ইচ্ছায়, নাবিদকে কাছে টেনে নিচ্ছে, অনেক কাছে। এই আঁধারে কেউ মানা করতে আসবে না। মেঘ গুলোর বৃষ্টি শরীর জুড়ে ভালবাসার মায়া বাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।



সময় গুলো বইতে থাকে, সময়ের মত। সময় গুলো প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির কিছু দিয়ে, নিয়ে বয়ে চলে। কখনও কিছু সময় সুখ দিয়ে যায়, কিছু সময় দুঃখ। কিছু মুহূর্ত প্রাপ্তির, কিছু অপ্রাপ্তির। তবুও সময়ে সময়ে অপ্রাপ্তিগুলো হারিয়ে যায়। বৃষ্টির জলের মত, বয়ে চলে। কিছু সুখ হয়ে, শরীর ভিজিয়ে দিয়ে যায়। কিছু দুঃখ হয়ে, বৃষ্টির সাথে, চোখের নোনা জলে মিশে যায়। কিছু ভালবাসা দেয়, শুধুই ভালবাসা। এক বর্ষা কাঁদালে, সব বর্ষায় সেই অপূর্ণতা থাকে না।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ২:০২

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


মাঝে কিছুটা ঝুলে গেলেও শেষটায় সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন। +

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:১৫

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.