নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
পানির ট্যাঙ্ক ভরে গেলে, উপচে পানি পড়ে। যেখানটায় পড়ে সেখানটা যেমন স্যাতস্যাতে থাকে, পা রাখতে একদম ইচ্ছে হয় না, ঠিক তেমন স্যাতস্যাতে একটা ভাব এখন মনের মধ্যে মনে হচ্ছে। এখন বেলা কত, জানে না ঠিক তিলক। মাথার বালিশের নিচেই মোবাইলটা। তবুও আলসেমি করে দেখা হচ্ছে না সময়। অবশ্য দেখেও লাভ নেই। সময় দেখার প্রয়োজন তিলকের নেই। দিনটা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু চোখ বুজতেই নানা দুঃস্বপ্ন দেখছে। আর জেগে উঠছে। কাল রাতে বিছানায় বসে বসে বিস্কুট আর চানাচুর খেয়েছিল। তার কিছু গুড়া নিচে পড়ে, পিঁপড়াদের জানিয়েছে আমন্ত্রণ। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে, পিঁপড়ারা তিলককে কামড়ে কামড়ে জানান দিচ্ছে, আমরা আপনার উপর অনেক খুশি। পিঁপড়ার কামড়ের সাথে দুঃস্বপ্নের কোন যোগসূত্র আছে কিনা কে জানে? হয়ত আছে। নাও থাকতে পারে। তবে, তিলক ভেবে পাচ্ছে না, আসলে দুঃস্বপ্ন নাকি, পিঁপড়ার কামড় কোন কারণে ঘুম ভাঙছে। এই মুহূর্তে কিছু ভাবতেও চাচ্ছে না তিলক। তিলক নিজেকে নিয়ে বড় অস্বস্তিতে ভুগছে। বার বার এমন হবার কারণ কি? তিলকের এবারও খুব কষ্ট লাগছে। ভেবেছিল তিলক, এবার আর লাগবে না কষ্ট। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি হল না। ঠিক সেই ক্লাস ফোরে মৌকে ভাললাগার পর যখন, ক্লাস সিক্সে উঠে মৌ চলে গেল। মনের কথাটা না শুনে। তখন যেমন কষ্ট লেগেছিল, তেমন কষ্ট। ক্লাস সিক্সে পড়া একটা ছেলে, ভালবাসা হারিয়ে কাঁদছিল, ব্যাপারটা কত অদ্ভুত। তিলক জানে ও আসলেই অদ্ভুত। মাঝে এক বছর চলে গেল। তখন ক্লাস সেভেন। লাস্ট বেঞ্চে বসা একটু নাদুস নুদুস মেয়েটার দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকত তিলক। মেয়েটাও ব্যাপারটা বুঝতে পারত। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে যেত। তিলকের চোখ ফিরিয়ে নেয়া উচিৎ ছিল, তিলক নিত না চোখ ফিরিয়ে। বরং মেয়েটাই এক সময় ফিরিয়ে নিত চোখ। মেয়েটাকে কিভাবে কিভাবে যেন ভালো লেগে গেল। বাম হাত দিয়ে চিঠি লিখেছিল, মেয়েটাকে দেবার জন্য। ডান হাতে লিখলে বুঝে ফেলবে সবাই, তাই বাম হাতে লেখা। চিঠি লিখে তা, ক্লাস শেষে, সাদিয়া মানে মেয়েটা যে বেঞ্চে বসে সেখানে রেখে দিল। পর দিন ক্লাসে এসে হই হুল্লোড়। সাদিয়াকে কে যেন প্রেম পত্র পাঠিয়েছে। যে পাঠিয়েছে তার নাম নেই। সেদিন সাদিয়া বার বার তিলকের দিকে তাকাচ্ছিল। বুঝে ফেলেছিল কিনা কে জানে। ভয়ে তিলক আর তাকায় নি। না তাকাতে তাকাতে একসময়য় হারিয়ে যায় ভালবাসা। ক্লাস নাইনে যখন, তখন তিলকের হুট করেই বান্ধবী হয়ে যায় কয়েকটা। তিলক ভালো গান গাইতে পারে, পারে সুন্দর ছবি আঁকতে, তার উপর ছাত্র ভালো। ক্লাসের অনেক মেয়েই তিলকের সাথে কথা বলে। করে বন্ধুর মত আচরণ। এর মধ্যে দুজন আবার একটু বেশীই মেশে। বার বার তিলকের মনে হয়, এই দুই মেয়েই তিলককে পছন্দ করে। সব সময় মেয়ে দুজনের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে মনে হত। তিলক সে যুদ্ধে মজা পেত, পেত প্রচণ্ড আনন্দ। একটা সময় পর তিলক খুব দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। বার বার মনে হয়, দুজনকেই ভালবাসে। সব ভাল লাগার সেই বয়সটায় মনে হচ্ছিল, দুজনকেই ভাল লাগে। দুজনের কেউ ক্লাসের কোন ছেলের সাথে কথা বললেই, রাগ লাগত খুব। হাতের কাছে যা পেত, ইচ্ছে করত ভেঙে ফেলতে। ইচ্ছে করত, যার সাথে কথা বলছে, তার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আসতে। তাই নিয়ে তিলক অভিমান করত। নিশির সাথেও, টুসির সাথেও। যে কথা বলত, অন্য ছেলের সাথে তার সাথেই। নিশির সাথে রাগ করে বলত না কথা, কখনও টুসির সাথে। নিশি, টুসিই রাগ ভাঙাতে আসত। নিশি মাঝে মাঝে জানতে চাইত, তিলক তুমি কি আমাকে ভালবাস?
তিলক চুপ করে থাকত, বলত না কিছু। বলা হত না। কিন্তু বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠত কথাটা শুনে।
টুসির বাসায় নিয়মিত যেত। ভালো ছাত্র। টুসি ক্লাসমেট। ছাত্রী খারাপ। টুসির মা বলতেন, তিলক মাঝে মাঝে মেয়েটাকে একটু পড়া দেখিয়ে দিয়ে যেও।
তিলক তাই করতে যেত। চেয়ার টেবিলে বসে পড়াত টুসিকে। টেবিলের নিচ দিয়ে পায়ে পা লাগলে, আস্তে করে সরিয়ে নিত। আর মাথা নিচু করে বুঝাতো পড়া। একদিন টুসির পায়ের সাথে পা লাগল। তিলক সরিয়ে নিল। টুসি একটু সরে এসে আবার তিলকের পা খুঁজে পায়ে পা ছোঁয়াল। টুসির মুখে মিটিমিটি হাসি। তিলক আবার সরিয়ে নেয়। টুসি এবার পা আরও বাড়িয়ে তিলকের পায়ের পাতার উপর, পা চেপে ধরে বলে, এবার কই যাবি?
তিলক হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। কিছু বলতে পারে না। কিন্তু মনে মনে ভালো লাগে। সত্যি খুব ভালো লাগে। এরপর থেকে নিয়মিত, পায়ে পা রেখে টেবিলের নিচ দিয়ে টুসিকে পড়া বুঝিয়ে দিত। একদিন বাসায় কেউ নেই। প্রচণ্ড বৃষ্টি। আর কয়েক দিন পর এস এস সি পরীক্ষা। তিলক বৃষ্টি ভিজে পড়া বুঝাতে আসে টুসিকে। টুসি সেদিন কেমন কেমন করে যেন তাকায়। পড়া বুঝতে চায় না। পায়ে পা আরও শক্ত করে চেপে ধরে। হাতের উপর হাত আলতো করে রাখে। তিলকের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ঠাণ্ডা টুসির হাতও। একটু আগে গোসল করেছে, খোলা ভেজা চুলে তাকিয়ে আছে তিলকের দিকে। ষোল বছর বয়সের মেয়েটাকে সেদিন সত্যি খুব অপরূপ লাগছিল। হঠাৎ করে টুসি হাতটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে বলেছিল, একটু ছুঁয়ে দে না।
তিলক চমকে উঠেছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে সেদিন ছুঁয়ে দেই নি টুসিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে হাত সরিয়ে এনেছিল। আমি আসি, বলে বৃষ্টির মধ্যে নেমে এসেছিল টুসির বাসা থেকে। সেদিন বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেই মনে হচ্ছিল, ফিরিয়ে দেয়া কি ঠিক হল, টুসিকে? হয়ত হয় নি। কিংবা হয়েছে। সেদিন বার বার মনে হচ্ছিল, টুসিকে প্রচণ্ড ভালবাসে। তবে আর কখনও হয় নি কথা টুসির সাথে। টুসিও বলে নি কথা। তিলককে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিত। স্কুল পাড় করার পর এক সাথেই বলতে গেলে হারিয়ে গেল, টুসি আর নিশি। টুসি হারাল ওভাবে, আর নিশির হারাবার ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। নিশি মাঝে মাঝেই দুষ্টামি করে তিলককে নানা কথা বলত, ছোট করে চিঠি লিখত, প্রায় দিন ফুল এনে দিত। তিলকের কখনও দেয়া হয় নি কিছু। এস এস সি পরীক্ষার অল্প কিছুদিন আগে, ভ্যালেন্টাইন ডে। সবাই ফুল কিনে প্রিয় মানুষের জন্য। তিলকের তখন প্রিয় মানুষ দুজন, নিশি আর টুসি। টুসির সাথে সম্পর্কে তখন টানা পোড়ন। ভেবে ঠিক করে ফুল কিনে দিবে নিশিকে। একটা গোলাপ, দুইটা বেলির মালা কিনে নিশির জন্য। লালের পাশে সাদাটা খুব সুন্দর লাগছিল সেদিন। ফুল হাতে নিয়ে ভাবে কি করে দেয়া যায় নিশিকে। তখন স্কুল বন্ধ। তিলকের একটা সাধারণ মোবাইল থাকলেও, নেই নিশির। নিশির বাবার মোবাইলে করা যাবে না কল। ভাবতে ভাবতে মনে হল, নিশির মত কাউকে রিকশায় দেখল তিলক। রিকশায় নিশি একা না। পাশে একটা ছেলে। বেশ সুঠাম দেহ। নিশির হাত ধরা। হাসছে নিশি, সাথে ছেলেটাও। তিলকের বুকের ভিতর সেদিনও খুব কষ্ট লাগছিল। লাগছিল প্রচণ্ড শূন্য বুকের ভিতর। হাতের সাদা বেলি ফুলের মালা, লাল টকটকে গোলাপ, সব অকারণেই লাগছিল খুব কালচে। খুব কুৎসিত। ফুল গুলো ধুলোতে ফেলে, পায়ের চটি জুতা দিয়ে পিষে ফেলেছিল সেদিন তিলক। সাথে সাথে পিষে ফেলেছিল, নিশির প্রতি বুকের ভিতর জমানো ভালবাসা গুলো। কিন্তু খুব করেও পারে নি পিষে ফেলতে, বুকের কোথাও লুকানো কষ্ট গুলো। তিলক এরপর আর বলে নি কথা অভিমান করে আর নিশির সাথে। নিশি কারণ জানতে চেয়ে, কয়েকবার কথা বলতে এসেছিল। তিলক বার বারই গিয়েছিল এড়িয়ে। সে সময়টাতেও খুব একা লাগছিল। লাগছিল প্রচণ্ড কষ্ট। মনে হচ্ছিল হারিয়ে গেছে সব। একসাথে টুসি, নিশিকে হারানোটা অনেকটা পাগলের মত করে দিয়েছিল তিলককে। তবুও বলে নি কথা, করেনি যোগাযোগ দুজনের একজনের সাথেও। কলেজ জীবনে আর কখনও দেখা হয় নি টুসি, নিশির সাথে। মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করাতে হয় নি বলা কথা। একটা সময় পাড় হয়ে যাবার পর মনে হচ্ছিল, আসলে দুজনের কাউকেই ভালবাসেনি তিলক। আসলে কখনই বাসে নি ভাল কাউকে। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে হয়ত পেয়েছিল সত্যিকারের ভালবাসা। যে ভালবাসায় দুজনেই জানে, বাসে ভাল দুজনকে। জানে আশেপাশের সবাই। তাকিয়ে থাকে ঈর্ষার চোখে। কলেজের সে সময়টায় বন্ধুত্ব থেকেই শুরু সম্পর্ক মিরার সাথে। তিলক ক্লাসের ফার্স্ট বয়। একটু যোগাযোগ রাখলে ভালোই সুবিধা পাবার কথা। সে সুবিধার আশায় হোক বা অন্য কারণে হোক, তা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় অন্য কোন সম্পর্কে। তিলকের সাথে ক্লাস শেষে প্রতিদিন যাওয়া হয় হেঁটে হেঁটে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত। বলা হয় অনেক কথা। নিজের কথা, মনের কথা, ভাল লাগার কথা, কিছু খারাপ লাগার কথা। বন্ধুত্বের অজুহাতে খাটানো হয় অধিকার। অধিকার খাটায় তিলকও। কখন খেলো, কখন ঘুমাল, কখন করল গোসল। কিংবা আদৌ করেছি কিনা। অধিকারের জায়গাটা আস্তে আস্তে আরও হয় শক্ত পোক্ত। তিলক বেশ বুঝতে পারে, মিরার প্রতি একটা দুর্বলতা কাজ করে। এই দুর্বলতার নাম যদি ভালবাসা হয়, তবে তাই। মাঝে মাঝে তিলক ঠিক মত কিছু না করলে, মিরা রাগ করে। রাগ করে না ঠিক। শুধু অভিমানে রাগের ভাব করে। বন্ধুত্বের অভিমান, একটা অধিকারের অভিমান। তখন সারাদিন মোবাইলের মেসেজে কথা হত দুজনের। অল্প টাকায় তখন কেনা যেত এস এম এস। কোনদিন ১০০ মেসেজ দেয়া হত, আসত ওপাশ থেকেও। আস্তে আস্তে তা ২০০, ৫০০ কখনও ১০০০ এ পৌঁছায়। এতো কি বলত জানে না দুজনের কেউ ই। তবুও একটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। একদিন তিলক অনেক সাহস করেই জানতে চাইল, মিরা, একটা কথা বলি?
- হ্যাঁ বল।
- রাগ করবে না তো?
- রাগ করব কেন?
- মানে, তুমি কি কাউকে ভালবাস?
তিলক জানত, একদমই নিশ্চিত ছিল, উত্তরটা হবে কাউকে না অথবা তিলক। মিরা বলল, হ্যাঁ বাসি।
- কাকে?
- আছে একজন।
- শুনি নামটা।
- না, ভয় করে।
- কিসের ভয়?
- যদি কিছু হারিয়ে যায়।
- কিছু হারাবে না। বল।
- তোমাকে। সত্যি বাসি ভাল তোমাকে। জানি তুমি বাস না, তবুও বাসি।
সেদিন তিলকের খুব ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল, পেয়ে গেছে অনেক দিনের চাওয়া কিছু। হুট করে বলে দিতে ইচ্ছা করছিল, আমিও বাসি ভাল তোমাকে। কিন্তু ওভাবে বলা যায় না। তাই একটু সামলে বলল, কি বল? ফাজলামি না, সিরিয়াসলি বল।
- আমি সিরিয়াস।
- কবে থেকে?
- কলেজের সেই প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু বলা হয় নি। তুমি আমাকে ভালবাসবে তিলক?
তিলক চুপ করে থাকে, ভেবে পায় না কি দিবে উত্তর। মাঝে মাঝেই নিজেকে নিয়ে বড় অস্বস্তিতে ভুগে তিলক। মনে হয় কাউকে ভালবাসলে, একটা সময় পর তা হারিয়ে যাবে। তিলক দেখতে আহামরি কিছু না। মিরা ভালবাসে হয়ত অন্য কোন কারণে। কিন্তু কেন যেন ভালবাসায় অন্য কোন কারণের চেয়ে, চোখের দেখায় ভাল লাগাটা প্রাধান্য পায় একটা সময় পর। মিরার বেলায়ও তাই হবে ভাবে তিলক। কিন্তু এভাবে ফিরিয়ে দেয়া যায় না, মিরাকে। মিরাকে যে বাসে না ভাল, তা না। আসলেই বাসে। একটু ভেবে চিন্তে উত্তর দেবার কথা বলে তিলক, বলে মিরাকেও আরও ভাবতে। মিরার সোজা সাপ্টা উত্তর, আমার ভাবার কিছু নেই। আমি ভেবে চিন্তেই তোমাকে ভালবাসি।
ঠিক দুই দিন পর, তিলক হ্যাঁ বলে মিরাকে। জীবনে প্রথম বারের মত, কোন ভাললাগার, ভালবাসার, প্রেম হয়ে ধরা দেয়া। সময় গুলো বড় দুরন্ত ছিল। সারারাত সারাদিন বলা হত কথা। চলা হত একসাথে রিকশায়, বসা হত রেস্টুরেন্টে, কাটানো হত অনেকটা সময় একসাথে। মিরার জীবন হয়ে উঠে তিলকময়। তিলকের ঠিক যেমন মিরাময়। এতো ভালবাসার কি ছিল, জানে না মিরা। কিন্তু মিরার মাঝে একটা মায়া মায়া ভাব ছিল, তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগত। তাই হয়ত বাসত ভাল তিলক। আর তিলকের বোকা বোকা চেহারার প্রেমে পড়তে পারে মিরা, পড়তে পারে সুন্দর করে গাওয়া গানের, কিংবা আঁকা কিছু ছবির। অথবা সুন্দর একটা মনের। ভালবাসার কারণ খুঁজতে মিরা যায় নি কোনদিন। ভালবেসে গেছে। একসাথে রিকশায় বসেও কখনও গায়ে গা ছোঁয়াতে চাইত না তিলক। একটু দূরে দূরে থাকত। ঠিক সে জন্যই হয়ত তিলককে একটু বেশীই কাছে চাইত মিরা। একদিন সন্ধ্যার দিকে রিকশা চড়ে হুড তুলে দেয় মিরা। হাতের ভিতর হাতটা দিয়ে চেপে ধরে শক্ত করে। প্রথম বারের মত হাত ধরা মিরার। এতো নরম হাত। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় তিলকের। বাহুর মধ্যে বাহু লুকাতে চায় মিরা। একটু কাছে এসে গুটিসুটি মেরে বুকের ভিতর মাথা রাখে তিলকের। একটা আঙুল ছোঁয়ায় নাকের ডগায়। তিলক সেই অদ্ভুত ভাললাগায় একটু হাসে। হেসেও ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যায় কেমন যেন। একটু একটু লাগে অস্বস্তি। তবুও ভালবাসে, ভাললাগে। একটু একটু শরীরের উষ্ণতার বিনিময় সেদিন ভাল লাগা দিয়েছিল অনেক। কখন যে ঘণ্টা খানেক পাড় হয়ে গেল, বুঝতেই পারে নি তিলক। সেই ঘণ্টা খানেকে লাগছিল, ভালবাসার গভীরতা বেড়ে গেছে হাজার গুণ। যে ভালবাসা কখনও হারাবার না। ভেবে পাওয়া যায় না, কোন কারণে এ ভালবাসা হারাবে। মিরা বলত সবসময় তিলকই মিরার জীবনে প্রথম ভালবাসা, তিলকও বলত একই কথা। যেখানে ভালবাসা হারাবার কোন সম্ভাবনা নেই, সেখানে ভালবাসার গভীরতা বাড়াটাই স্বাভাবিক। বেড়েও ছিল। একটা সময় কথার বিষয় বস্তু ছিল, বিয়ের পর দুজন কিভাবে কাটাবে। ছেলে হলে নাম কি হবে? হবে কি মেয়ে হলে? কতটা সময় দিবে কাজের বাইরে তিলক মিরাকে। মিরা জেনে নিত তিলকের পছন্দের খাবার গুলোর নাম। চেষ্টা করত শিখে নিতে সে সবের রান্না। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল কিভাবে বুঝতেই পারে নি দুজনের কেউ ই। সারাটা দিন সারাটা রাত মনে হত, শুধু ভাবনা জুড়ে, জুড়ে অস্তিত্ব শুধু তিলক মিরার বা মিরা তিলকের। তিলকের বাসায় মাঝে মাঝে আসত মিরা। পড়া বুঝে নিত। তিলকের বাবা মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, বন্ধু হিসেবে। মাঝে মাঝে বাসায় আসাটাকে কখনও অন্য ভাবে দেখেননি তিলকের বাবা মা। সেদিন প্রচণ্ড রোদ বাহিরে। গরমও পড়েছে বেশ। ক্লাস ছুটি হয়ে যায় অনেক আগেই। দুপুর তখন দুইটা কি আড়াইটা। মিরা আসে তিলকের সাথে তিলকদের বাসায়। বাবা বাসায় নেই। মা খেতে দেন দুজনকে দুপুর বেলা তাই। খাওয়া শেষে মা কোথায় যেন চলে গেলেন। তিলক আর মিরা বিছানাটার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসা। গরমে ঘামছে মিরা। উপরে ফ্যান ঘুরছে, তবুও ঘেমে কলেজ ইউনিফর্ম পিঠের সাথে লেগে আছে। মিরা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে তিলকের দিকে। তিলকের একটু কেমন যেন লাগে। কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে একটু কেমন লাগাটাই স্বাভাবিক। নীরবতার মাঝে একটু সরবতা আনতে তিলক জানতে চায়, গরম লাগছে বেশী?
মিরা আস্তে করে শুধু মাথা নাড়ে। মাথা নেড়ে না জানায়। এরপর আবার নীরবতা। মিরা একটু কাছে সরে আসে তিলকের। তিলকের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে বলে, তিলক তুমি এতো ভাল কেন?
সামনাসামনি নিজের প্রশংসা শুনতে একটু অস্বস্তি বোধ হয়। তিলক সামলে বলে, তুমিও অনেক ভাল।
- আমি ভাল না। আমি খারাপ।
- কিভাবে?
- এই যে, তুমি কখনও নিজে থেকে আমার কাছে আসো না। আমিই যাই। নিজে থেকে হাত ধর না, আমিই ধরি।
- হাহা, একজনকে তো একটু এমন হতেই হবে। দুজন এক রকম হলে, এই ভাল লাগা গুলোর কোনটাই আমি পেতাম না।
- তোমার জায়গায় অন্য কোন ছেলে হলে অনেক কিছুই হয়ে যেত আমাদের মাঝে।
- কি হত?
- জানি না।
তিলক একটু হাসে শুধু। কিছু বলে না। মিরা তিলকের কোলের উপর শুয়ে পড়ে। শুয়ে বলে, ভালবাসবে না সবসময়?
- বাসব।
তিলকের হাত পা কাঁপছে। অনেক করে সে কাঁপন থামাতে চাচ্ছে পারছে না। মিরা উঠে সামনা সামনি দাঁড়ায় তিলকের। অনেকটা কাছে। মুখটা নিয়ে আসে মুখের কাছে। তিলক টের পায় মিরার নিঃশ্বাসের শব্দ। নিজে কি করবে ভেবে পায় না। হাত পা সব শক্ত হয়ে আসে। মিরা তিলককে জড়িয়ে ধরে। শক্ত করে, অনেক শক্ত করে। তিলক মিরার ভেজা পিঠে আলতো করে হাত রাখে শুধু। তাকিয়ে থাকে, দরজার দিকে। ভয়ে থাকে কখন চলে আসে মা। মিরা আরও শক্ত করে ধরে জড়িয়ে, যতটা শক্ত করে ধরলে, মাঝখানে কোন জায়গা থাকে না, ততটা শক্ত করে। জড়িয়ে ধরা থেকে সরে এসে তিলকের নাকের সাথে নাক মিশায় মিরা। তিলক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এ মিরা যেন অন্য কেউ। চোখে মুখে অন্য রকম একটা ভাব। তিলকের ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে মুখটা টেনে এনে, তিলকের ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তিলকের অদ্ভুত রকম অনুভূতি হয়। ইচ্ছে করে ঠোঁটের স্বাদ নিতে। মিরা তা চাইছে হয়ত। কিন্তু তিলক হঠাৎ করে মিরাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, বিছানায় বসে পড়ে। মিরা চমকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে, তিলকের দিকে। এ প্রত্যাখ্যান যেন মানতে পারছে না। তিলক বোকা বোকা চোখে কতক্ষণ এদিন ওদিক তাকিয়ে বলে, আমি ভেবেছিলাম আম্মু চলে আসছে।
মিরা ছোট করে শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কাঁধে ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিঃশব্দে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। তিলক আসে পিছনে পিছনে। তিলক একটার পর একটা কথা বলে যায়। মিরা বলে না কিছু। নিঃশব্দে এসে বাসে চড়ে চলে যায় বাসায়। তিলক দাড়িয়ে থাকে বাস স্ট্যান্ডে। তাকিয়ে শুধু দেখে। এরপর থেকে মিরা একটু একটু বদলে যায়। ভালবাসলেও বলে সবসময়, আমি অনেক খারাপ তিলক। তুমি অনেক ভাল। সেদিন আমি কেমন একটা কাজ করলাম।
- না সেখানে তোমার কোন দোষ ছিল না।
- আমিও ইচ্ছা করে করিনি। আমার কি হয়েছিল আমি জানি না। আমি সত্যি অনেক খারাপ তিলক।
একটু বদলে গিয়ে তিলকের বার বার মনে হয় সম্পর্ক ঠিক আগের মত চলছে না। যাচ্ছে না। মিরা আগের মত আর অত কথা বলে না। মিশে না। অনেক দিন বলার পরও বাসায় আসে না। একসাথে রিকশায় বসে না। বদলে যাওয়াটা মানতে পারে না তিলক। এই নিয়ে মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়। মিরাকে অনেক কথা শুনায়। মিরা চুপ করে শুনে। বলে না কিছু। এইচ এস সি পরীক্ষার মাস খানেক আগে, মিরা জানায়, মা ফোন নিয়ে যাচ্ছে। ফোনে যোগাযোগ হবে না আর। দেখা হবে তাও সম্ভব না। কলেজ তখন বন্ধ। তিলকের কষ্ট লাগে, লাগে রাগ। তবুও কিছু করার নেই। তিলক ভাবে একসময় আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক সে সময়টায়, ক্লাসের এক ক্লাসমেট শিপন, একটু বেশীই দেখা সাক্ষাত করে তিলকের সাথে। বিকাল বেলা দেখা করে। একসাথে ক্রিকেট খেলে। ফুচকার দোকানে বসে ফুচকা খায়। কয়েকদিনেই বেশ ভাল বন্ধুত্ব। শিপনের সাথে কলেজের প্রথম দিকে মিরারও বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু তিলকের সাথে সম্পর্ক হবার পর, একে একেই সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। শুধু তিলকের সাথেই কথা বলে, মেশে। শিপনকে বেশ ভাল ছেলে বলেই মনে হয় তিলকের। একদিন দুপুর বেলা, হুট করে তিলকের বাসায় চলে আসে শিপন। রাসায়নিক গণনার কোন অঙ্ক বুঝতে পারে না, তাই তিলকের কাছ থেকে বুঝতে আসে। তিলক বুঝিয়ে দেয় সুন্দর করে। বুঝানো শেষে বলে শিপন, চল ঘুরে আসি বাহির থেকে।
তিলকও রাজী। একটু ঘুরে ফিরে কিছু খাওয়া দাওয়া করে শিপন একটা সিগারেট কিনে। একটা ছ ফুটের ভাঙা দেয়ালের উপর বসে তিলকের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, সিগারেট খাবি?
- না আমি খাই না।
- হুম, খাস না কিন্তু। খারাপ জিনিস।
- তুই খাস কেন?
- এমনিই। তারপর কেমন চলছে প্রেম ভালবাসা?
তিলকের সাথে মিরার সম্পর্কের কথা ক্লাসের সবাই জানে। তিলক বলে, এই তো চলছে।
- কথা হয় নিয়মিত?
- না, ইদানীং বন্ধ।
- কেন?
- মিরার মোবাইল ওর আম্মু নিয়ে গেছে।
- হাহাহা।
- হাসিস কেন?
- এমনিতেই। তিলক, তুই যে বোকা জানিস?
- কেন?
- আমার মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়, তোর মত লেভেলের একটা ছেলে কি করে মিরাকে...? মিরা একটা মেয়ে হল? তুই ইচ্ছা করলেই অন্য ভাল মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারিস। তোর জন্য ক্লাসের অনেক মেয়েই পাগল।
- মানে? মিরার সমস্যা কোথায়?
- তুই কি বলতে চাস, মিরা অনেক ভাল?
- খারাপ কোন দিক দিয়ে?
- মিরা কি করে ভাল মেয়ে শুনি? ক্লাসের সবাই যেটা জানে, তুই ও জানিস ব্যাপারটা, তারপরও?
- কোন ব্যাপার?
- নাহ, কিছু না। তোকে বলে লাভ নাই।
- না বল তুই।
- জানা জিনিস বলার কি আছে?
- কিসের জানা জিনিস?
- আমার সাথে মিরার প্রেম ছিল।
- মানে?
- তুই জানতি না সিরিয়াসলি?
- না। মিরার কারও সাথে প্রেম ছিল না। তুই ওর বন্ধু ছিলি।
- হাহাহা, ভাল বলছিস। অবশ্য, প্রেম ভাঙার পর, সব সম্পর্কই বন্ধুত্ব বলে সবাই। সেটা ব্যাপার না।
- শিপন, উল্টা পাল্টা কথা বলিস না।
- আচ্ছা দাঁড়া তোকে একটা জিনিস দেখাই।
তিলক নাকের নিচের ঘাম মুছে শিপনের দিকে তাকায়। শিপন ওর মোবাইল বের করে কিছু মেসেজ দেখায়। মেসেজ গুলো মিরার দেয়া। একটা মেসেজে লেখা, বাসায় আসবা কখন, আজ আম্মু নেই।
অন্যটায় লেখা, সময় গুলো বেশ ভাল কাটল।
অন্যটা, জানু, ঘুম আসছে না তোমাকে ছাড়া। একটু পাশে শুবে।
তিলকের মাথা ঝিম ঝিম করছে। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে একদম। হাতে পায়ে কোন শক্তি পাচ্ছে না। বিষণ্ণ চোখে শিপনের দিকে তাকাল। শিপন বলল, তোকে মেসেজ গুলো দেখাতাম না। তুই বিশ্বাস করলি না, তাই...। আর দেখ আমি মিরাকে কল দেই, কল ধরবে।
শিপন মিরাকে কল দিল। সত্যি সত্যি মিরা ধরল। কথাও বলল। তিলকের রাগ লাগছে খুব। শিপনের সাথে কথা বলছে, আর তিলককে বলল, মোবাইল মা নিয়ে গেছে। শিপন ফোন রেখে তিলককে বলল, দেখলি? আর মিরা আমাকে দেখাবার জন্য তোর সাথে প্রেম করেছিল। ভাবছে তোদের প্রেম দেখে আমি হিংসা করব, জ্বলব। আসলে কিছুই হয় নি। আমার খারাপ টারাপ লাগে নি। ওর মতন মেয়ে কত আসে। আর ওসব মেয়ে একবার ব্যবহারের পর আর দাম থাকে নাকি। যেদিন বাসায় গেলাম, সেদিনই তো সব শেষ করা। আর ভাবিস না শুধু আমার সাথে করছে, অনেকের সাথেই। এলাকায় তো মিরা নামকরা। তোর ভালোর জন্য বলছি, এই সম্পর্কটা বাদ দে। মেয়েটা ভাল না। আগেই বলতে চাইছিলাম, কিন্তু বলা হয় নি। কিন্তু এখন ভাবলাম, তোর ক্ষতি হবে, তাই।
তিলক সেদিন নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল সে দেয়ালটার উপর। ভাঙা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, তিলকের মনের চেয়ে ভাঙা দেয়ালটার অবস্থা আরও ভাল। শিপন বলে যায়, জানি ভুলতে একটু সময় লাগবে তোর। তবুও সামনাসামনি গিয়ে যা মনে আসবে বলবি মিরাকে, দেখবি সব ঠিক। তোর সাথে মিথ্যে অভিনয় করল, তোকে ঠকাল, আর তুই ছেড়ে দিবি? জীবনেও না। মিরার দেয়া কোন কিছু থাকলে, মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে আসবি। কাল ও জাকির স্যার এর সাথে পড়তে আসবে বিকালে, তখন দেখা করবি। তিলক চুপ করেই থাকে, বলতে পারে না কিছু। মানতে পারে না। এমন হবার কথা না। মিরাকে এমন ভাবে নি কখনও তিলক। তবুও এমন হল। ঠিক যা অসম্ভব তাই হল। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে, লাগছে প্রচণ্ড অবাঞ্ছিত কিছু। চিৎকার করে ইচ্ছা করছে কাঁদতে। কিন্তু চাইলেই সবাই কাঁদতে পারে না, চিৎকার করে। পরদিন ঠিক দাড়িয়ে থাকে জাকির স্যার যেখানে পড়ান তার সামনে। মিরা বের হয় পড়া শেষ হলে। তিলককে দেখে, জিজ্ঞেস করে, তুমি এখানে?
- কেন আশা কর নি? অন্য কারও সাথে দেখা করার কথা?
- কি বল?
- বুঝতে পারো নি কি বলছি? ঘরের মধ্যে কাউকে নিয়ে সব করতে পারো, আর বাহিরে করতে সমস্যা কি?
- মানে?
তিলক এরপর মুখে যা আসে, তাই বলে। শিপনের সাথে যা যা করেছে, তা নিয়ে কথা শুনায়, কথা শুনায় আরও কারও সাথে কিছু করেছে তা নিয়ে। কথা শুনায় মোবাইল চালু থাকার পরও মা নিয়ে গেছে বলার ব্যাপার নিয়ে। কথা শুনায়, মিথ্যে অভিনয় করার জন্য তিলকের সাথে। তিলক বলে, পৃথিবীতে আরও ছেলে ছিল। তুই তোর মত একটা ছেলে দেখে, তার সাথে এসব করতি। তোর মত চরিত্র যাদের তাদের সাথে করতি। আমি কেন?
মিরা অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু তিলকের এই ভিন্ন চেহারার দিকে। ভিন্ন কথা গুলো শুনে যায়। তিলক শেষ মুহূর্তে বলে, পৃথিবীতে যদি কাউকে সবচেয়ে বেশী অপছন্দ করে, সে মিরা। কিছু নোংরা কথাও বলে তিলক। যে সব কথা আগে কখনই মুখ থেকে করে নি উচ্চারণ। আজ মিরাকেও বলল সেসব কথা। মিরার সামনে থেকে রাগে চলে আসল, তিলক। আসার আগে, মিরার দেয়া সব উপহার গুলো ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে আসল। পা দিয়ে পাড়িয়ে ভেঙে ফেলে দিয়ে আসল। মিরা সেদিন কিছুই বলে নি। বলার কিছু ছিল না। তিলকের বড় হালকা লাগছিল, কথা গুলো শুনিয়ে মিরাকে। সবচেয়ে ভালবাসার মানুষটাকে হারাবার ব্যথাটা একটু হলেও কম লাগছিল।বার বার মন থেকে বলছিল, একটা বাজে মেয়ের জন্য কেন কষ্ট পাবে? তবুও রাতের বেলা ঘুমাতে গেলে কষ্ট হয়, স্মৃতি গুলো ঘিরে ধরে। কষ্ট গুলো বুকের উপর করে দাপাদাপি। দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বুজলেই বার বার মিরার মুখটা ভেসে উঠে সামনে। অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়ে। বয়সটা প্রচণ্ড আবেগের। তাই প্রতি রাতেই কাঁদে তিলক। মাঝে মাঝেই মিরাকে কল করতে ইচ্ছা করে। কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু হয় না তেমনটা। হয়ে উঠে না। যে ভালবাসা হারবার কথা ছিল না, সে ভালবাসাই হারিয়ে গেল। মাঝে মাঝেই তিলকের মনে হয়, না ভালবাসা হারায় নি। হারিয়ে গেছে ভালবাসার মানুষটা। মিরার কষ্ট কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল অনেক। কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা মানুষটাও একটা মেয়ে। নিতি। নিতির সাথে পরিচয় ফেসবুকে। এইচ এস সি পরীক্ষার পর ফেসবুকে কিছুটা সময় দেয়া তিলকের। লক্ষ্য ছিল ওটাই কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। তাহলেই পারবে ভুলতে মিরাকে। মিরাকে ভুলতে চায়, সত্যি চায় ভুলতে। সে সময়টায় নিতির সাথে অনেক কথা হত ফেসবুকে। নিতির কোন ছবি দেয়া ছিল না ফেসবুকে। হতে পারত ফেক আইডি। তবুও বলত কথা নিতির সাথে। হাই হ্যালো থেকে শুরু করে, সব কথাই ভাগ করা হত। একটা সময় পর, ভাল বন্ধু, অনেক ভাল বন্ধু মনে হয় নিতিকে। নিতি বলে নিজের সব কথা, বলে তিলকও। স্ট্যাটাসে কমেন্টে কথা হত, কথা হত ইনবক্সে। একটা মানুষকে সামনাসামনি না দেখেও, মুখের কথা না শুনেও যে অনেকটা কাছের কেউ ভাবা যায়, বুঝতে পেরেছিল তিলক নিতিকে দিয়েই। নিতি এমন একটা বন্ধু ছিল, যার সাথে শয়তানি ফাজলামি করা যায়। বলা যায় অনেক কিছু। করা যায় ভাগ মনের সব কিছু। ভাললাগা যায়, ভালবাসি বলা যায়। কিন্তু মনের মাঝে কখনও খারাপ চিন্তা আসে না। আসে না প্রেম করবার ভাবনা। ছেলে মেয়ের সাধারণ সম্পর্ক যে দিকে যায়, সেদিকে কখনও নিতি তিলকের সম্পর্ক যায় নি। নিতি যদিও ভালবাসি বলত তিলককে। তিলকও বলত উত্তরে, তবে সে ভালবাসা ছিল, বন্ধুত্বের। নিতিকে হুট করেই খুব আপন কেউ লাগে। তিলককেও লাগে নিতির। নিতি এক সময় সময় করে নিজের ছবি দেখায়, তিলককে। দেখতেও সুন্দর মেয়েটা। নিতি বলে, তুই আসলেই ভাল অনেক। আর দশটা ছেলে, ইনবক্সে দুই দিন কথা বলেই, ছবি দেখতে চায়। প্রেমের অফার করে বসে, নাম্বার চায়। আর তুই কখনই তেমন করিস নি। তুই আলাদা সবার চেয়ে।
তিলকের সে কথা শুনতে ভাল লাগে। নিতির প্রতি ভাল লাগার জায়গাটা অনেক গাঢ় হয়। জীবনে প্রেম ভালবাসাই যে সব না, প্রেম ভালবাসা হারান যে জীবনকে করে দিতে পারে না ব্যর্থ। একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে তার চেয়েও অনেক বেশী দামী, নিতির সাথে পরিচয় না হলে হয়ত জানতেই পারত না। নিতি তিলককে ডাকত গাধু। গাধা থেকে গাধু। মাঝে মাঝে তিলককে ছোট করে তিলু। নিতিকে মাঝে মাঝে তিলক ডাকত, বান্দরনি। সে ডাকে, ভালবাসা ছিল। একদিন নিতি বলে, তিলু তুই কাউকে ভালবাসিস?
- হ্যাঁ বাসি।
- কাকে?
- তোকে।
- আরে আমাকে তো বাসিস জানি। প্রেমিকা হিসেবে?
সে সময়টায় মিরার মুখটা আর একবার ভেসে উঠে চোখের সামনে। তিলক ভুলতে চায় মিরাকে। জবাব দেয়, না, বাসি না। তুই বাসিস?
- হুম।
- কাকে?
- সোহেল নামে একটা ছেলেকে। যদিও তোর মত এতো ভাল না। খালি সন্দেহ করে সব কিছু নিয়ে। তোর কথাও বলি নি ওকে।
এরপর সোহেল নামের ছেলেটার কিছু ছবি দেখায় নিতি। কিভাবে ভালবাসা হল, তা বলে। বন্ধুর ভালবাসার কথা শুনে, খুশি হবার কথা তিলকের। কিন্তু তিলকের কেন যেন, রাগ লাগে খুব। নিতির সাথে প্রেম করবে এই ভাবনা কখনও মনে আসে নি। তবুও নিতি কারও সাথে প্রেম করে শুনে, বুকের ভিতর কষ্ট লাগে। কষ্ট লাগার কারণটা হয়ত, গভীর কিছু। মনটা চায় না, বন্ধুটা অন্য কাউকে প্রাধান্য দিক বেশী, তিলকের চেয়ে। কিংবা অজানা কোন কারণ। তবুও হাসি মুখে ভাল ভাল বলে যায় তিলক। নিতির সাথেও বেশী দিন যোগাযোগ থাকে না। সোহেল ছেলেটা নিতির পাসওয়ার্ড নিয়ে নিতির আইডিতে ঢুকে। নিতি আর এখন রিপ্লাই দেয় না, তিলকের মেসেজের। তিলক মেসেজ দিলেই ডিলেট করে দেয়। একদিন রিপ্লাই দেয়, দোস্ত, তুই আমাকে মেসেজ দিস না প্লিজ। সোহেল আমার আইডিতে ঢুকে। দেখলে রাগ করবে। মিস ইউ দোস্ত।
তিলক আর দেয়া না মেসেজ। আবার মনে হয় একা হয়ে গেছে,অনেক। একা লাগলেই মিরার কথা মনে পড়ে। অনেক করেও তিলক মিরার স্মৃতি গুলো মুছতে পারে না। মিরা নাম্বার পরিবর্তন করে নি। তিলক তাই মনে হলেই মিরাকে একটা করে মেসেজ দেয়। সে মেসেজে লেখা থাকে, সরি, আমাকে কি মাফ করা যায় না?
কোন উত্তর আসে না সে মেসেজের। তিলক তবুও আশায় থাকে হয়ত একদিন উত্তর আসবে। অবশ্য এমন আশাও ঠিক না। একটা মেয়েকে অকারণে অত গুলো কথা বলছিল। মেয়েটা এতো সহজে তা ভুলে যাবে না। ভুলবার কথা না। মিরার সাথে সেইদিনের পর আর কথা হয় নি, যেদিন মিরার সামনে উপহার গুলো ভেঙে খারাপ কথা গুলো বলে চলে এসেছিল। মিরাও আর বলে নি কথা। তখন এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ। শেষ পরীক্ষার দিন মিরা তিলকের জন্য অপেক্ষা করে পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে। তিলক আসলে, বলে, কিছু কথা বলার ছিল।
তিলক চোখ মুখ শক্ত করে বলে, বল।
- আমার কথা মাঝে কোন কথা বলবে না।
- হুম।
- তুমি তোমার বন্ধুদের আসলে অনেক বিশ্বাস কর। ভাল এটা। কিন্তু যাকে ভালবাসতে, তার প্রতি এতো ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে কিভাবে ছিলে ভেবে পাই না। তোমার এক বন্ধু আমার নামে এক গাদা কথা বলল, আর তুমি তা বিশ্বাস করে আমাকে এসে কথা শুনিয়ে গেলে সেদিন। অবশ্য ভালোই করেছিলে, না করলে এমন হয়ত আমি জানতেই পারতাম না, তুমি আমাকে কখনও ভালই বাস নি। হ্যাঁ দোষ আমার নেই তা না। আমি খারাপ সেটাও আমি জানি। কিন্তু খারাপ হয়েও কখনও তোমার খারাপ চাই নি। পরীক্ষা চলে আসছিল। এর মাঝে এতো হারে আমাদের কথা হলে, তোমার আমার কারও পরীক্ষাই ভাল হত না। তার উপর একদিন শিপনই আমাকে ডেকে বলেছিল, আমার সাথে প্রেম করে নাকি তোমার পড়াশুনা নষ্ট হয়ে গেছে। কথাটা আমার লাগে খুব। তাই সিদ্ধান্ত নেই, পরীক্ষা শেষ হবার আগ পর্যন্ত তোমার সাথে কথা বলব না। আমি তোমাকে বললে, তুমি সেটা মানতে না। তাই মোবাইল আমি আম্মুকে দিয়ে দেই। তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। ভেবেছিলাম, পরীক্ষা শেষ হলে আবার নতুন করে সব শুরু করব। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হল না, তুমি তার আগেই......।
- কিন্তু দেখো...
- আমার কথা শেষ হয় নি। সেদিন তুমি বলেছ আমি শুনেছি। আজ আমি বলি একটু? তুমি আমাকে কতটা খারাপ মেয়ে ভাব, ভাবতেই আমার অবাক লাগছিল সেদিন। আমার শিপনের সাথে প্রেম ছিল, ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল এই কথাটা পর্যন্ত বলছ। ছিঃ। আরও কারও সাথে ছিল, তাও বলছ তুমি।
মিরা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বড় করে, আবার বলতে শুরু করে, হ্যাঁ শিপনের সাথে কলেজের প্রথম দিকে বন্ধুত্ব ছিল। শিপনদের গ্রাম আমাদের গ্রামের পাশেই, সে হিসেবে আব্বু আম্মুর সাথে পরিচয় আছে। শিপনকেও আগে থেকে চিনি। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় ওর আব্বু আম্মু সহ আসত, এটাও ঠিক আছে। সেটা পাশাপাশি গ্রামে থাকার অজুহাতে। একটা নতুন জায়গায়, পরিচিত কাউকে পেলে তার সাথে বন্ধুত্ব হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। হয়েছিলও তাই। শিপন এসে কথা বলত, আমিও বলতাম। তাই বলে কখনও তা ভালবাসার দিকে যায় নি। অসম্ভব ছিল তা। আমার জীবনে তুমিই প্রথম ছিলে। মেসেজ গুলোর কথা বলি। একদিন শিপন আমার মোবাইল নিল। নিয়ে বলল, আমি তো প্রেম করি না। ধর এইটা আমার প্রেমিকার নাম্বার, তাহলে কেমন মেসেজ দিত দেখ। বলে শিপন সেই মেসেজ গুলো দিল আমার মোবাইল থেকে। আমি সেদিন অনেক রাগারাগি করেছি, শিপনের সাথে। শিপন বলেছে, ডিলেট করে দিয়েছে মেসেজ। আসলে দেয় নি। আমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আর সেই মিথ্যা তোমাকে করিয়েছে বিশ্বাস। তোমার সাথে সম্পর্ক হবার পর, আমি কোন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব রাখি নি। এমনকি কথা পর্যন্ত বলিনি। আমার মনে হয়েছে, তোমাকে ঠকানো হবে, তা ভেবে। কিন্তু, কিভাবে কি হয়ে গেল। সেদিন শিপন কল করল মোবাইল আম্মুর কাছেই ছিল, আম্মু শিপনের নাম দেখে আমার কাছে দিল। তাই কথা হয়েছে। আম্মুর সামনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হয়েছে সুন্দর করে কথা। আর তুমি ভেবেছ আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি। অনেক গুলো ছেলের সাথে সম্পর্ক করে, তোমার কাছে গিয়েছি। তোমাকে ছেড়ে আবার অন্য কাউকে ধরেছি। যাই হোক, ভাবতে পারো যা ইচ্ছা। আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না। বন্ধুর কথাই বিশ্বাস কর। আমি তো খারাপ মেয়ে, খারাপ মেয়েকে ভুলে থেকো। ভাল থেকো। ভাল মেয়ে আসুক তোমার জীবনে। আমি কখনও ফিরে আসছি না তোমার জীবনে।
তিলক কথাগুলো শুনে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। মিরাকে বলতে চায় কিছু। কিন্তু মিরা শুনে না। চলে যায় সেদিন। তিলক এরপর অনেকবার সরি বলে মেসেজ দেয়। কল করে উত্তর দেয় নি মিরা। কখনই না। একটা অপরাধ বোধে খুব কষ্ট হয় তিলকের। মিরাকে ফিরে পেতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছে করে ফিরে যেতে সেই ঝগড়ার দিনটায়। আবার সব ঠিক ঠাক করে নিতে। কিন্তু হয় না সম্ভব। সব কিছু যে সম্ভব হবার না তাই। রাতের নীরবতায় অনুশোচনায় ভুগে তিলক, ব্যথার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে খুঁজে একটু আশ্রয় ভাল থাকার। ভাল থাকার সে পথটা একটু হলেও সহজ করে দিয়েছিল নিতি। কিন্তু যে সময়টায় নিতিও ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের জীবন নিয়ে, তখন আবার একাকীত্বে বিষণ্ণ মনে বার বার মিরার কথাই ভেসে আসছিল। নিজেকে বড় তুচ্ছ, অবাঞ্ছিত লাগছিল। বার বারই মনে হচ্ছিল, ঠিক আসলে কারও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে থাকার যোগ্যতা তিলকের নেই। মিরা অভিমান ধরে থাকে, কখনও তিলকের সাথে আর কথা বলে না। এই ভাঙা মনেও একটা জেদ কাজ করে, ভাল একটা জায়গায় ভর্তি হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে গিয়ে কেউ একাকীত্বে ভুগে না তিলকের তাই ধারণা। সেই জেদ খুব করে ধরে রাখতে পারে তা না। পড়ালেখার বড় ক্ষতি হয়, তবুও শেষ পর্যন্ত ভর্তি হয় ঢাকার মধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতো বড় ক্যাম্পাস পেয়ে ভাললাগার মাত্রাটা ছিল অনেক। যদিও মন মত বিষয়ে ভর্তি হতে পারে নি। তবুও ভাল বিশ্ববিদ্যালয়। ভার্সিটির জীবনটা অন্যরকম। সত্যি অন্যরকম। তবে সে অন্য রকমের সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না তিলক। মুখচোরা স্বভাবের হওয়াতে, নিজে থেকে কারও সাথে কথা বলা হয় না। ক্লাসে ছেলে মেয়ে প্রায় সমান সমান। ছেলে গুলো প্রথম থেকেই ব্যস্ত অনেক, মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করাতে। হয়েও যায় বন্ধুত্ব তাদের। তিলক শুধু চুপ করে ঘুম ঘুম চোখে ক্লাসে আসে, শেষ বেঞ্চে বসে কয়েকটা ক্লাস করে, আবার চুপ করে চলে যায় হলে। মাঝে মাঝে বন্ধুরা নিজেদের বন্ধু বৃত্তের সাথে ছবি তুলে দেখায়। সেখানে ছেলে থাকে, থাকে মেয়ে। সেসব দেখেও তিলকের খারাপ লাগে। ক্লাসের কোন মেয়ের সাথে কথা হয় না, ওভাবে কথা হয় না কোন ছেলের সাথেও। কেমন যেন একটা প্রাণহীন জীবন পাড় করে তিলক। কলেজের দিন গুলোতে, স্কুলের দিন গুলোতে মেয়েরা নিজেরা এসে কথা বলত, এখানে তেমন হয় না। এখানে মেয়েদের পিছনে ছেলেরা ঘুরে কথা বলার জন্য, যেসব ছেলে কথা বলে না তাদের দিকে তাকাবার সময় ওদের নেই। তিলকের অবশ্য ভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর আগে কয়েকটা মেয়ের সাথে ফেসবুকে কথা হত। অনেক কথাই হত। বলত দোস্ত দোস্ত করে, বলত তুই তুই। করা হত পরিকল্পনা সারাদিন ঘুরবে দুজন, খাবে আইসক্রিম, বসবে ফুচকার দোকানে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যাবে বিভিন্ন জায়গায়। সেসব সেই নীল সাদার নিজস্ব আবদ্ধ গণ্ডিতেই পড়ে থাকে। বের হয়ে দেখা দেয় না বাস্তবে। সেই মেয়েরা ঠিক ঘুরে বেড়ায় অন্য ছেলেদের সাথে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যায় বিভিন্ন জায়গায়, আইসক্রিম খেয়ে তা মাখামাখি করে। তিলক তা চেয়ে চেয়ে দেখে। ক্লাসে কোনদিন নিজ থেকে তাদের সাথে কথা বলতে যায় নি। কথা বলতে আসে নি তারাও। তিলকের তখন সেই ইনবক্সে আবদ্ধ ক্লাসমেট বান্ধবীদের অন্যদের সাথে ছবি দেখেও রাগ হত। গা জ্বলত। কারণ জানে না তিলক। এদের সাথেও তো ভালবাসার কোন ব্যাপার স্যাপার নেই। তবুও খারাপ লাগে। একদিন এক বন্ধুর গিটার বাজিয়ে ক্লাসের সামনের মাঠে বসে গান গায় তিলক। অনেকেই মুগ্ধ হয়ে শুনে সে গান। চারপাশে বসে ক্লাসের অনেকেই গান শেষে হাত তালি দেয়। বেশ ভাল গান গায় কিন্তু ওরা এই ব্যাপারটা জানতই না, তাই বলে আফসোস করে। গান গাওয়া শেষে একটা মেয়ে এসে বসে তিলকের পাশে। তিলকের ক্লাসের সেটা জানে তিলক। নাম জানে না। মেয়েটাই জানতে চায়, তোর নাম কিরে?
- তিলক।
- ভালই গান গাস দেখি।
তিলক লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে। মেয়েটা বলে, ক্লাসে তোকে অত দেখি না।
- সবসময় আসি না। ভাল লাগে না ক্লাস করতে।
- তা ভাল বলছিস। এতো বোরিং পড়াশুনা। তুই কি আগে থেকেই গান গাস নাকি?
- হুম।
- মাঝে মাঝে শুনাস ঠিক আছে? আমার আবার গান অনেক পছন্দ।
- আচ্ছা শুনাব।
মেয়েটা সেদিন চলে যায়। তিলক সাহস করে নামটাও শুনতে পারে না। কেমন একটা অবস্থা। এর পরদিন মেয়েটা আবার আসে, খালি গলায় শুনতে চায় গান। বিনিময়ে খাওয়াবে কফি। তিলক গান শুনায়। কফির সাথে সিঙ্গারাও ছিল। বেশ কয়েকদিনেই অনেক কথা হয় মেয়েটার সাথে। নামটাও জেনে নিয়েছে এর মধ্যে, মিতুল। মিতুলের সাথে ক্লাস বাদ দিয়ে প্রায় গল্প করা হয়। ক্লাস করতে ভাল লাগে না তিলকের, লাগে না ভাল মিতুলেরও। দুই ফাঁকিবাজে দারুণ আড্ডা হয়। বন্ধুত্বটা একটু একটু করেই বাড়তে থাকে। ক্লাসের ছেলেরা তিলকের মত না। সব মেয়ের সাথেই ভাল সম্পর্ক। সেদিন তিলক মিতুল বসে খাচ্ছে নুডুলস ক্যাফেটেরিয়ায়। এর মধ্যে কোথা থেকে তামিম এসে বসল, মিতুলের পাশে। গায়ে গা ঘেঁষে। খেতে চায় নুডুলস। মিতুল চামচ দিলে তা দিয়ে খাবে না, খাইয়ে দিতে হবে মিতুলকে। মিতুল চামচে তুলে খাইয়ে দেয়। তিলক হাতের মুঠোয় নিজের চামচটা শক্ত করে চেপে ধরে। তামিম তবুও খুশি না, এখন খাইয়ে দিতে চায় মিতুলকে। মিতুল হাঁ করতেই মুখে মাখিয়ে দেয় নুডুলস তামিম। মিতুল ঠুনকো রাগে তামিমের টি শার্ট ধরে টান দেয়, দেয় পিঠে কয়েকটা কিল। সেসবে তামিম ব্যথা পায় না। ভাল লাগে। তিলক চামচটা আরও শক্ত করে ধরে ধরে টেবিলের উপর পুরো শক্তি দিয়ে গেঁথে ফেলে। মিতুলের সেদিকে খেয়াল নেই। তিলকের রাগে শরীর কাঁপে। তিলক এমন কেন বুঝতে পারে না। যা চায় তার সবটুকুই নিজের করে চায়। এক ফোঁটা অন্য কারও হাতে দেখলেই রাগ হয়। মিতুলের তামিমের সাথে এসব দেখেও রাগ হচ্ছে। তিলক আস্তে করে বিলটা দিয়ে সরে আসে সেখান থেকে। মাথার ভিতর ঝিম ঝিম করে কেমন যেন। তিলক বুঝতে পারে, মিতুলের আশেপাশেও কাউকে সহ্য করতে পারে না। আর ছেলে গুলোও কেমন। এই যে তামিম, এ কে কখনও কোন ছেলের সাথে ভাল করে কথা বলতে দেখেছে বলে মনে হয় না। সারাদিন মেয়েদের পিছনে পিছনে থাকবে, এমন একটা ভাব যেন মেয়েরা শুধু ওর সাথে আড্ডা দিতেই ভার্সিটিতে আসে। যখন তখন যার তার গায়ে হাত দিবে, মেয়েরা রাগ দেখালেও লজ্জা নেই। তিলককে না পেয়ে মিতুল পুরো ভার্সিটি খুঁজে অনেক। কল করে নাম্বার বন্ধ। রাতে যখন কথা হয়, তখন তিলকের কাছে জানতে চায়, সারাদিন কই ছিলি?
- কেন? এখন আমাকে কি দরকার? তামিমের সাথেই থাক।
- মানে?
-মানে আর কি? আমার সাথে কথা বলার চেয়ে তোর তামিমের সাথে মারামারি করাটা ভাল লাগে না?
- বুঝলাম না ঠিক।
- বুঝতে হবে না। আমি ওখানে ছিলাম ঠিক আছে। কি কি করছিস দেখছি আমি।
- হ্যাঁ তো কি হইছে? তামিমও ফ্রেন্ড আমার।
- ভাল। যাও ফ্রেন্ডের সাথে ওসব কর। আমার কাছে কি?
- তুই এভাবে রি এক্ট করছিস কেন?
- কি করব তাহলে? আমি তো আর তোর মত না, খারাপ লাগলেই আর একটা একটা মেয়ের সাথে গিয়ে হাতাহাতি করব। তুই যেমন ছেলেদের সাথে করিস।
- তিলক একদম বাজে কথা বলবি না। আর আমি বুঝতে পারছি না, তুই এমন করছিস কেন? তুই আমার বয়ফ্রেন্ড না, ফ্রেন্ড, ঠিক আছে? আমি কার সাথে কি করব, সেটা আশা করি আমি ভাল জানি।
তিলক সে কথা শুনে চুপ হয়ে যায়। আস্তে করে কেটে দেয় কলটা। আসলেই ভাবে হয়ত যতটা অধিকার দেখাতে যাচ্ছে, তিলকের আসলে ততটা অধিকার নেই মিতুলের প্রতি। তিলক নিঃশব্দে অনুভব করে নিজের বুকের বাম পাশটায় একটু একটু ব্যথা করছে। এরপর থেকে মিতুলের সাথেও কথা বলে না। দেখা হলেও এড়িয়ে যায়। মিতুল কারও সাথে কথা বললে, মাঝে মাঝে খারাপ লাগত। কিন্তু কয়েকদিনেই সে খারাপ লাগা চলে যায়। সে সময়টায়ও মিরার কথা ভাবে। যোগাযোগের চেষ্টা করে মিরার সাথে। মিরা সাড়া দেয় না। মিরা কোথায় পড়ছে জানে না তিলক। হয়ত যেখানে পড়ছে সেখানে অনেক বন্ধু হয়েছে মিরার। হয়ত হয়েছে ভালবাসার মানুষও। তিলকের সাথের সময় গুলো ভুলে গেছে। ভুলে গেছে সব কিছু। তিলকের জীবনে মিতুলের পরও বন্ধু হয়ে এসেছিল, অন্তরা। এসেছিল তানিয়া। সে দুজনের সাথেও এক সময় সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কারণ সেটাই। অধিকার খাটাতে যায় সবসময়। আসলে চায় না তিলক ছাড়া আর কেউ ওভাবে থাকুক, তিলকের মত ওদের জীবনে। কিন্তু মানুষ গুলো একা থাকে না, সব ছেড়ে তিলককে কখনই কেউ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় নি। তিলকের সব সময় মনে হত, তিলক আসলে কারও জীবনেই সব কিছু না। একটা বহু নির্বাচনী প্রশ্নের চারটা অপশনের একটা। একটা শুধুই অপশন। যে অপশন সঠিক উত্তর না। ভুল উত্তর। তিলক কখনই চায় নি কারও জীবনে হয়ে থাকতে এমন। চেয়েছে সবসময় কারও সব কিছু হতে। মিরা ছাড়া আর কারও জীবনে তেমন ছিল না। আর একজনের জীবনে এই গতকাল তিলক সব কিছু হবার সুযোগ পেয়েছিল। যে মেয়েটাকে পড়ায় বাসায় গিয়ে, রিমা নাম। রিমা কাল, ভাইয়া অঙ্কটা একটু করে দেন না।
বলে খাতাটা যখন বাড়িয়ে দেয়, দেখে খাতার ভিতর লেখা। আমার মেসেজটার উত্তর কই?
তিলক ভেবে পায় না কিসের মেসেজ। মোবাইলটা হাতে নেয়, তখনই রিমা একটা মেসেজ করে, ভালবাসি। আমার সব কিছু হবে?
তিলক তাড়াতাড়ি মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে, বের করে টিস্যু। কপালে জমা ঘাম মুছে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আসি আজ, বাড়ির কাজ গুলো করে রেখো।
সেই সময় থেকে মাথার ভিতর রিমার কথা ঘুরছে। বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে। ভালবাসার কথা বলছে। ফিরিয়ে দেয়াটা কেমন লাগে? ফিরিয়ে দিলে টিউশনিটাও হারাতে পারে। তাছাড়া রিমাকে খারাপ লাগে তা না। যে কোন ছেলের স্বপ্নে কল্পনা করা ভালবাসার মানুষটার ছবি, রিমার মতই হবে। তেমন দেখতে। কিন্তু রিমার ছবিটা কল্পনায় আনতে গিয়ে বারবার মিরার ছবি ভেসে উঠছিল। সারারাত ঘুম আসে নি। বারবার ভাবছে কি করবে? ভাবতে গিয়ে কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। মিরার ভালবাসা নাকি রিমা, এই দ্বিধায় বুকের উপর অনেক বড় ওজন লাগছে। তাই সিদ্ধান্ত নিল আজ সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবে। ঘুমালে চিন্তা মুক্তি ঘটে। তবে পানির ট্যাঙ্ক ভরে গেলে, উপচে পানি পড়ে। যেখানটায় পড়ে সেখানটা যেমন স্যাতস্যাতে থাকে, পা রাখতে একদম ইচ্ছে হয় না, ঠিক তেমন স্যাতস্যাতে একটা ভাব এখন মনের মধ্যে মনে হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে, কেন হচ্ছে জানে না। ঘুমাতে চেয়েও পারছে না। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করল। সময় ১২ টা ৪। দুপুর বেলা। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। নয়ত এখন গা পুড়িয়ে দেবার মত রোদ থাকত। তিলক বৃষ্টির মাঝেই বেড়িয়ে গেল। আজ রিমার কলেজ বন্ধ। বাসায় থাকবে। তিলকের কোন ছাতা নেই। মোবাইলটা পেচিয়ে নিল একটা পলিথিন কাগজে। পেচিয়ে হাঁটতে লাগলো বৃষ্টির মধ্যেই। একটু পর পর বিজলি চমকাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো অনেক বড় না, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রিমাদের বাসার কলিং বেল চাপতেই, রিমা এসে দরজা খুলল। মেয়েটা একদম লাল টকটকে একটা ফতুয়া আর লং স্কার্ট পড়া। রিমাকে দেখেই বুকের ভিতর কেমন করে উঠল। রিমা একটু মিষ্টি হেসে বলল, ইশ ভাইয়া একটা ছাতা নিয়ে আসবেন না? ভিজে কি অবস্থা দেখছেন? ঠাণ্ডা লাগবে না?
তিলক কিছু বলে না। তিলকের ভেজা নিয়ে রিমার অনেক ব্যস্ততা। তিলক ধীর পায়ে দরজা দিয়ে ভিতরে গেল। রিমা দৌড়ে একটা তোয়ালে এনে দিল তিলকের মাথা মুছবার জন্য। রিমার চোখে মুখে ব্যস্ততার ছাপ, তাড়াতাড়ি মুছে নেন তো। আমি এমন কেন?
সেই ব্যস্ততা এমন যেন আর একটু ভেজা থাকলেই তিলকের অনেক বড় কোন অসুখ হবে। তিলক তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে, রিমার ঘরে গিয়ে বসল। রিমা বসল তিলকের সামনের চেয়ারে।
- আর এমন করবেন না। একটা ছাতার কতই বা দাম? এখন যদি অসুখ হয়ে যায়?
অভিযোগের সুরে বলে রিমা। তিলক তাকিয়ে থাকে রিমার দিকে। কোন কথার উত্তর দেয় না। তিলক ব্যস্ত নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। রিমা বলে, কফি করে দিব ভাইয়া? ভাল লাগবে।
তিলক জামার হাতাটা একটু ঠিক করে বলল, তোমার আম্মু কোথায়?
- আম্মু তো পাশের ঘরে।
- একটু ডাক দাও তো।
- আম্মু টাকা দিছে আপনার। আমার কাছে আছে।
- না অন্য ব্যাপারে একটু কথা আছে।
-আচ্ছা ডাকছি।
রিমার মা তিলকের সামনে। তিলক কথা বলে যাচ্ছে। রিমা দাড়িয়ে শুনছে দরজার ফ্রেম ধরে।
- আন্টি, রিমার সিলেবাস তো শেষ। রিভিশনও হয়েছে মোটামুটি। আর পরীক্ষা তো চলে আসছে প্রায়। আর ২০ দিনের মত আছে। তাছাড়া আমার একটু সমস্যা হয়ে গেছে, ভার্সিটিতে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আমিও আসলে ওভাবে সময় দিতে পারব না। এখন নিজে নিজে পড়লেই পারবে। আর কোন সমস্যা হলে আমি তো আছিই। রিমার সাথেও আমার কথা হয়েছে। এখন ওর একা একাই পড়া ভাল।
তিলকের কথার অর্থ তিলক আর পড়াবে না রিমাকে। রিমার সাথে কথা হয়েছে শুনে রিমার মা একবার শুধু তাকালেন রিমার দিকে। তিলকের হাতে টাকাটা দিলেন। তিলক আর আসবে না। রিমা হাত দিয়ে শক্ত করে দরজার ফ্রেমটা ধরে দাড়িয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করছে। যে কোন সময় পড়ে যাবে। মা তাকাতেই মুখ লুকাল অন্য দিকে। তিলক চলে যাবার আগে, রিমা দরজা বন্ধ করতে আসল। তিলক দরজার বাহিরে যেতেই বলল রিমা, ভাইয়া একটু শুনবেন?
- বল রিমা।
- আমি সরি।
- ঠিক আছে, ব্যাপার না।
- একটা কথা বলি?
-বল।
- কিছু মনে করবেন না তো?
- না।
- একটা জিনিস চাইব আপনার কাছে।
- কি?
- দিবেন কিন্তু।
- আচ্ছা বল।
- আপনাকে একটু ছুঁতে ইচ্ছা করছে। একটু হাতটা ধরি?
তিলক কোমল চোখে তাকাল রিমার দিকে। রিমা হাতটা ছুঁয়ে দেবার আশায় পিপাসার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তিলক শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে নেমে আসল সিঁড়ি বেয়ে। রিমা সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইল। রিমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারে নি তিলক। রিমাকেও ছেড়ে চলে আসছে। আজ কেন যেন কষ্ট হচ্ছে না তিলকের, কিন্তু বুকের ভিতর মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে রিমার। বুকের কষ্ট চোখের জল হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। যে জল মুছে দিতে তিলক আসবে না জানে রিমা। তবুও জল ঝরাচ্ছে।
তিলক বৃষ্টির মাঝে এখনও হাঁটছে। দেখছে বৃষ্টির ফোঁটার মাটিতে পড়ে গুড়ো হয়ে যাওয়া। নিজের মনের মাঝের অনেক দিনের প্রশ্নের একটা উত্তর পেল তিলক। ভালবাসা। সত্যিকারের ভালবাসা। মিরা আর রিমার মাঝে একটা খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে, তিলক ভালবেসেছিল শুধু মিরাকেই, আর কাউকে না। আর যাদের প্রতি যা ছিল, সেটা একটা সাময়িক পরিচিতির খারাপ লাগা। নিজের জায়গা করে নেবার শুধু একটা টান। একটু ভাললাগা থেকে একটা অধিকার খাটাবার চেষ্টা। একটা চায়ের দোকানে বসে পলিথিন থেকে মোবাইলটা বের করে, চায়ের কাপের ধোঁয়ার সাথে চুমুক দিয়ে, মিরার নাম্বারে কল করল, জানে ধরবে না মিরা তবুও। প্রথম বার ধরল না। কিন্তু অবাক করে দিয়ে তিলককে, দ্বিতীয়বার কল ধরল মিরা। তিলক মোবাইলটা কানে চেপে ধরে বসে আছে। বলে না কিছু। ওপাশ থেকে মিরাই বলল, আজ তোমার কথা মনে পড়ছিল কেন যেন।
তিলক চুপ করে শুনে। কথাটা শুনে, বুকের ভিতর ধক করে উঠল। চায়ের দোকানে বিল দিয়ে নেমে আসল রাস্তায়। টুপটাপ বৃষ্টি হচ্ছে। কানের সাথের মোবাইলের উপর পলিথিনটা দিয়ে, তিলক শুনে যায়।
- ভেবেছিলাম ধরব না কল। কিন্তু কি মনে করে যেন ধরলাম। আমার তোমার কথা মনে পড়ে তিলক, কিন্তু এতো কখনও পড়ে নি।
তিলক এবার শান্ত গলায় বলল, মিরা আমরা কি আগের মত হতে পারি না?
- তুমি আমাকে এখনও ভালবাস?
- হ্যাঁ।
ওপাশ থেকে মিরার একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল।
- আমিও বাসি। জানি ভুলতে পারব না কখনও। কিন্তু আমি তোমার কাছে ফিরে যেতে পারব না তিলক। এই যে ভালবাসার টান এখন, এটা আবার নতুন করে ভালবাসায় জড়ালে থাকবে না। তুমি আমাকে সন্দেহ কর।
- আমি করি না। আমি তোমাকে ভালবাসি মিরা।
- জানি। তবুও সম্ভব না। তিলক সব কিছু সম্ভব না। আমার বিয়ে হয়ে যাবে। বাবা মা পাত্র ঠিক করেছে। সব ঠিক ঠাক। আমি পাস করে বেরোলেই বিয়ে।
- ও ও ও।
তিলকের এ ছাড়া আর বলার নেই কিছু। এতদিন পর অধিকার খাটানো যায় না। মিরা বলে, আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসতাম, তোমাকে শিপন যা বলেছিল সবটাই মিথ্যে।
- আমি জানি।
- আমি মন থেকে ভালবাসতাম তোমাকে। আমি জানি আমার বিয়ে হয়ে গেলে, তুমি অনেক কষ্ট পাবে। জানো, আমিও অনেক কষ্ট পাব তোমার বিয়ে হয়ে গেলে। কিন্তু কিছু কষ্টে ভালবাসা থাকা ভাল। তোমার সাথের সময় গুলো, আমি ভুলতে পারব না। ভুলতে পারবে না তুমিও। তবুও তিলক ভুলে থাকার অভিনয় ঠিকই করতে হবে। আমি যেমন করলাম এতোটা বছর। আচ্ছা, তুমি আমাকে আর কল দিও না। কথা বললে, মায়া বেড়ে যাবে। আমার আবার তোমার কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে হবে। কিন্তু আমি তা চাই না। ভালবাসা এভাবেই ভাল থাকবে। আবার নতুন করে শুরু করা হয়ত সম্ভব না।
মিরা রেখে দেয়। তিলক তবুও কানের কাছে ধরে রাখে। অনেক কথা বলার ছিল। কিছুই বলা হয় না। আজ আবার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই কষ্ট আলাদা। সবার জন্য কষ্ট আর মিরার জন্য কষ্ট এক না। সবার জন্য মনের টান, মিরার জন্য এক না। এই কষ্টের মাঝেও সুখ এই টুকু, যাকে মন থেকে ভালবেসেছিল। সত্যিকারের ভালবাসে, সেও বাসে ভাল মন থেকে। যখন বিচ্ছিরি স্যাতস্যাতে মনের কোণে কেউ থাকতে চায় না, তখনও সে মনের সবটা জুড়ে থাকে। বৃষ্টির সাথে, বাতাসের সাথে, গাছের পাতার সাথে সে ভালবাসার কথা যায়। বলা যায়, ভালবাসি সত্যি আমি কাউকে। মনের অনেক জটিলতার ভিড়ে, একজনের জন্য আলাদা একটা জায়গা আছে। কখনও পাব বা পাব না। কখনও হবে কথা বা হবে না। কখনও ঠোঁটে ছোঁয়ার পূর্ণতা পাবে বা পাবে না। সেসবের হিসাবে এসব হয় না। সব প্রাপ্তির ঊর্ধ্বে, হিসাবের ঊর্ধ্বে, কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে কিছু থাকে। সেটার নাম ভালবাসা না। নাম সত্যিকারের ভালবাসা।
মানুষের মনের জটিলতা অনেক বেশী। যেখানে একটু সায় পায়, সেখানেই ছুট দেয়। জীবনে চলতে চলতে ভাললাগার ব্যাপারটা একবার আসে তা না। ভালবাসার ব্যাপারটা একবার আসে তাও না। কারও জন্য কষ্ট পাবার ব্যাপারটা একবার আসে তাও না। মনের কোণে টান গুলো, বুকের ভিতরের আবেগ গুলোও নানা সময়ে নানা জনের জন্য করে দাপাদাপি। কেউ স্বীকার করে, কেউ লুকিয়ে রাখে তা। কিন্তু মনের মাঝের একটা আলাদা জায়গা কারও জন্য থাকে। সেটা ভালবাসা, ভাললাগা, আবেগ , অনুভূতির আলাদা একটা জায়গা। সত্যিকারের ভালবাসা সেটা। সত্যিকারের ভালবাসাটা খুঁজে পেতে সময় লাগে, বুঝতে সময় লাগে, জানতে সময় লাগে। দিন শেষে চোখ বুজলে, কষ্টে যার জন্য চোখের দু পাশ বেয়ে জল ঝরে, সব চিন্তার আড়ালে একটা অদৃশ্য কেউ এর চিন্তা আসে। সেই সত্যিকারের ভালবাসার মানুষ। মানুষের জীবনে ভালবাসা বার বার আসতেই পারে, তবে সত্যিকারের ভালবাসা একবারই। চুপচাপ নীরব কেউ, যখন তখন যার তার সাথে মেশা কেউ, কিংবা যাকে দেখে তাকেই ভাললাগা কেউ, অথবা কখনও কারও জন্য আবেগ না আসা কেউ, সবার জীবনেই তেমন কেউ আসে। বৃষ্টি দেখে, অনেকের কথাই মনে পড়ে, সবার সাথে কখনও ভেজা হয় না। গুমোট অন্ধকারে সবাই সান্ত্বনা দেয়, পাশে সবাই থাকে না। বহু আমি র ভাগ হয়ে যাওয়া থেকে, এক তুমিটাকে খুঁজে বের করতে হয়।
৩১ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১:১১
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। এতো বড় গল্প পড়ার জন্য।
২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৫৬
মাহমুদ০০৭ বলেছেন: মানুষের মনের জটিলতা অনেক বেশী। যেখানে একটু সায় পায়, সেখানেই ছুট দেয়। জীবনে চলতে চলতে ভাললাগার ব্যাপারটা একবার আসে তা না। ভালবাসার ব্যাপারটা একবার আসে তাও না। কারও জন্য কষ্ট পাবার ব্যাপারটা একবার আসে তাও না। মনের কোণে টান গুলো, বুকের ভিতরের আবেগ গুলোও নানা সময়ে নানা জনের জন্য করে দাপাদাপি। কেউ স্বীকার করে, কেউ লুকিয়ে রাখে তা। কিন্তু মনের মাঝের একটা আলাদা জায়গা কারও জন্য থাকে। সেটা ভালবাসা, ভাললাগা, আবেগ , অনুভূতির আলাদা একটা জায়গা। সত্যিকারের ভালবাসা সেটা। সত্যিকারের ভালবাসাটা খুঁজে পেতে সময় লাগে, বুঝতে সময় লাগে, জানতে সময় লাগে। দিন শেষে চোখ বুজলে, কষ্টে যার জন্য চোখের দু পাশ বেয়ে জল ঝরে, সব চিন্তার আড়ালে একটা অদৃশ্য কেউ এর চিন্তা আসে। সেই সত্যিকারের ভালবাসার মানুষ। মানুষের জীবনে ভালবাসা বার বার আসতেই পারে, তবে সত্যিকারের ভালবাসা একবারই। চুপচাপ নীরব কেউ, যখন তখন যার তার সাথে মেশা কেউ, কিংবা যাকে দেখে তাকেই ভাললাগা কেউ, অথবা কখনও কারও জন্য আবেগ না আসা কেউ, সবার জীবনেই তেমন কেউ আসে। বৃষ্টি দেখে, অনেকের কথাই মনে পড়ে, সবার সাথে কখনও ভেজা হয় না। গুমোট অন্ধকারে সবাই সান্ত্বনা দেয়, পাশে সবাই থাকে না। বহু আমি র ভাগ হয়ে যাওয়া থেকে, এক তুমিটাকে খুঁজে বের করতে হয়।
অসাধারণ !
আপনার কিছু কিছু বাক্য পড়লে মনে হয় , আপনি হৃদয় দিয়ে লিখেন ।
লিখা চালিয়ে যাবার অনুরোধ রইল ।
ভাল থাকবেন প্রিয় রিয়াদ ভাই ।
গল্পটা আবার পড়ার ইচ্ছে আছে ।
তখন আবার কিছু বলে যাব ।
১৪ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:০০
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: লিখে যাচ্ছি ভাইয়া। লেখাটা আমার ভালবাসা। এই ভালবাসার প্রতি টান কখনই হারাবে না। শুধু দিনে দিনে বদলে আরও শক্তপোক্ত হবে।
দোয়া করবেন।
৩| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৬
শুকনোপাতা০০৭ বলেছেন: বহু আমি র ভাগ হয়ে যাওয়া থেকে, এক তুমিটাকে খুঁজে বের করতে হয়।
খুব খুব খুব ভালো লাগল... আপনার প্রায় সব লেখাই পড়ার চেষ্টা করি, চমৎকার লিখেন।
১৪ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:০৬
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ভাল লাগল শুনে। আপনার লেখাও চোখে পড়লেই পড়ি।
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৩৮
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: +++++++++++++++ বিশাল পোস্ট ।
মাঝের প্যারাগুলো আরও ছোট ছোট ভাগে দিলে ভালো হত ।
ভালো থাকবেন