নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
আজ স্বপ্নদের সভা বসেছে। এখানে বাবার স্বপ্ন আছে, মায়ের স্বপ্ন আছে, আছে তাদের বখে যাওয়া বা খুব ভদ্র ছেলেটার স্বপ্ন, আছে কালো মেয়েটা, সবাই তাকিয়ে থাকা ফর্সা মেয়েটার স্বপ্ন, ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্রটার স্বপ্ন, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা ছেলেটার স্বপ্ন, ভর্তি যুদ্ধে ক্লান্ত কারও স্বপ্ন, প্রেমিকার স্বপ্ন, প্রেমিকের স্বপ্ন, অন্ধ সেজে ভিক্ষা করা লোকটার স্বপ্ন, এক হাত নিয়ে রিকশা চালানো মানুষটার স্বপ্ন থেকে শুরু করে দেশের প্রধান মন্ত্রীর স্বপ্ন। এই সভায় ঠিক হবে, কে কি স্বপ্ন দেখতে পারবে, কি পারবে না। কার জন্য কোন স্বপ্ন দেখার অনুমুতি আছে। কোন স্বপ্ন চাইলেও দেখা নিষেধ। আলোচনা হচ্ছে, স্বপ্নদের নানা রকম অভিযোগ নিয়ে। মোটা এক লোকের স্বপ্ন জানাল, আমি ইদানীং অলস। শেষ কবে যে সে স্বপ্ন দেখেছে। নাক ডাকে সারারাত, স্বপ্ন দেখবে কি করে? আমি চাই নাক ডাকার সাথেও, স্বপ্ন দেখার অনুমুতি মিলুক।
নাক ডাকা কেউ স্বপ্ন দেখতে পারবে না, এটা সভা থেকেই নির্ধারিত। এক প্রেমিকের স্বপ্ন বলল, আমাকে নিয়ে ছেলেটা খুব মিথ্যা বলে। দেখে কোথাকার কোন মেয়েকে স্বপ্নে, আর প্রেমিকাকে বলে, জানো জানো আজ তোমাকে দেখলাম স্বপ্নে। তুমি একটা লাল শাড়ি পরে বউ সেজে বসে ছিলে। তোমার পাশে আমি পাঞ্জাবী পরা, রুমাল নাকে।
স্বপ্নরা সব হেসে ফেলে। স্বপ্ন নিয়ে মিথ্যা অনেকেই বলে। সবাই সবার অভিযোগ জানাচ্ছে, কেউ চাইছে কোন কোন স্বপ্ন দেখতে পারার অনুমুতি। কেউ পোষণ করছে, ভবিষ্যতে ঘটে যাবে, এমন কিছু দেখতে পারার ইচ্ছা। সব স্বপ্নের ভিড়ে এক কোণায় বসে আছে, নাহিদ আর দিনার স্বপ্ন। নিজেদের মাঝে কি যেন বলছে, যেমন বসে আছে এখন নাহিদ আর দিনা জানালার পাশে। যে জানালা দিয়ে একটু একটু আঁচ এসে পড়ছে বৃষ্টির চোখে মুখে। অনুভব করছে দুজনে সে বৃষ্টির ফোঁটার ছোঁয়া। জানালার গ্রিলে মরচে ধরা, মরচে ধরা যেমন জানালার গায়ে। ঘরের ভিতরটা সাজানো গুছানো। কাঠের দরজাটার ঠিক পাশেই একটা টেবিল, সে টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া চলে। একটা শো কেস, একটা কাপড়ের আলনা, একটা ছোট খাটো ফ্রিজ, জানালার পাশ ঘেঁষেই একটা খাট। যে খাটে পা আসন গেড়ে বসে জানালা ধরে দেখছে বৃষ্টি। ঘরটার চাল টিনের, টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ শুনতে পাচ্ছে দুজনেই। টিনের চালের উপর থেকে নিচে পড়ে সে ফোঁটা গুলো মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মিশে মিশে তা বুদ বুদ তুলে কাদা হচ্ছে। দেখতে বড় সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই সুন্দরের মাঝেই নাহিদ দিনার দুজনেরই কিছু অপূর্ণতা আছে। দেখতে পাওয়া আর সে সুন্দর দেখতে বলতে পারা দুইটা একসাথে দুজনের কেউ ই পারছে না। একজন দেখতে পাচ্ছে, একজন শুনতে। একজন দেখে দেখে চুপ, অন্য জন শুনে শুনে নানা কিছু বলছে। নাহিদের চোখে কানামাছি খেলবার সময় যেমন শক্ত করে বেধে দেয়া হয়, কাপড়। তেমন কিছুই নেই। চোখে বাধা কাপড় মুখে গুজে দেয়াও নেই দিনার। তবুও হচ্ছে না সম্ভব। চোখে কাপড় বাধা ছাড়াই অনন্ত কানামাছি খেলছে নাহিদ গত দেড় বছর ধরে। আর মুখে কাপড় গোজার মত চুপ করে আছে দিনা সেই ছোট বেলা থেকেই। তবে এমন কিছুই ছিল না আগে। নাহিদ দেখতে পেত দিনাকে। শ্যাম বর্ণ মেয়েটার হাসিটাকে। বুঝতে পারত ইশারায় বলা সব গুলো কথা। কিন্তু চোখের সমস্যাটা দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে, এক সময় সব অন্ধকার হয়ে গেল। আর দেখতে পায় না, শ্যাম বর্ণ মিষ্টি মেয়েটাকে। গালে টোল পড়া হাসিটাকে। হাত নেড়ে ইশারায় বলা কথা গুলোও পারে না বুঝতে। লোকে ডাকে অন্ধ বলে, মেনে নাহিদ তা চুপ করে। দিনা কখনও বলতে পারেনি ভালবাসি নাহিদকে, অন্য সবার মত গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। তবে ইশারায় তা বুঝিয়ে দিতে পারত। একদম ছোট বেলা নাকি কিছু কিছু শব্দ করত দিনা, সেসবের কিছুই মনে নেই। তবে বুঝ হবার থেকে বুঝতে শিখে, সবার মাঝে একটা ক্ষমতা আছে, যা দিনার নেই। মুখ নেড়ে খাওয়া ছাড়াও আর একটা কাজ করা যায়, তা পারে না দিনা। দিনা শুনতে পায়, নাহিদ যখন বলে, দিনা বউ দিনা বউ। কিন্তু কিছুই কখন বলতে পারে না দিনা তার উত্তরে। অনেক দিন ইশারায় বুঝিয়েছে, তোমাকেও বাসি ভাল। তবে কখনও তা শব্দ হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পারে নি। তখন খুব আফসোস হত, মনে হত একবার যদি বলতে পারা যেত, তোমায় আমি ভালবাসি, ছেলেটা কেমন চমকে যেত। চমকে যাওয়া ছেলেটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে দিনার। সম্ভব হয় না তাও। দিনাকে বলে সবাই, বোবা। কথা না বলতে পারা মানুষ। যে শুধু শুনতে পায়, পারে না কিছু বলতে। তবুও ভালবাসে, নাহিদ বাসে, বাসে দিনা। জানে ভালবাসা চোখের না, মুখের না, ভালবাসা মনের। ভালবাসা তখন থাকে, যখন মুখে তুলে খাইয়ে দেয় মাছ বেছে বেছে নাহিদকে দিনা। ভালবাসা তখন থাকে যখন, হাতটা ধরে আলতো করে অনেক কিছু অনুভব করে নাহিদ। দুজন মিলে একটা মুদি দোকানে বসে। সে দোকানের টাকায় ভালই যায় চলে সংসার। দুজনের সংসার খারাপ নয়। দিনা বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবে, দেখতে দেখতেই কেটে গেল প্রায় এক বছর বিয়ের। একটা বোবা মেয়েকে কতটা ভালবাসে ছেলেটা। ভাবে নাহিদ, দৃষ্টি হারানোর পরও ভালবাসা এক বিন্দুও কমে যায় নি নাহিদের জন্য দিনার। দুজনের ছোট ঘরের ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন, একটা বাচ্চা হবে ফুটফুটে। সে পড়বে স্কুলে। লাল ব্যাগের ভিতর করে নিয়ে যাবে, দিনার রান্না করে দেয়া খাবার। বাবা মায়ের গালে এসে চুমু একে দিয়ে যাবে যখন তখন। নাহিদের মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, প্রথম দিককার কথা। বিকালে মাঠে যখন খেলত সবাই, নাহিদ চুপ করে তা দেখত। ঝাপসা চোখে। চোখের সমস্যার জন্য খেলতে পারত না, বা কেউ নিবেও না খেলায় তাই তো স্বাভাবিক। সেই ঝাপসা চোখেই, মাঠের ও পাশটায় একটা মেয়েকে দেখত। হাসি হাসি মুখে খেলা দেখত, সাথে থাকত একটা ছোট মেয়ে। বোন হবে। একবার তাকাত নাহিদ, দুইবার তাকাত নাহিদ। আস্তে আস্তে তাকাত বার বার। একটা সময় দুপুরের পর থেকেই বসে থাকত মাঠে। মেয়েটা আসবে কখন করত অপেক্ষা। অপেক্ষার সাথে মানুষের অনেক দিনের খারাপ সম্পর্ক। তাই অপেক্ষার সময় গুলোতে খুব অস্থির লাগত। বিকেল বেলা মেয়েটা আসলেই একটু হাসি ফুটে উঠত মুখে নাহিদের। চোখ যত ঝাপসা হতে থাকে, একটু কাছ থেকে দেখার জন্য তত পাশে গিয়ে দাঁড়াত নাহিদ। বার বার দেখাটা কখন যেন সারাটাক্ষণ দেখায় রূপ নিয়েছে বুঝতে পারে নি নাহিদ। তবে বুঝতে পারত মেয়েটা, ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, লাগত বড় অস্বস্তি। এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকে? একদিন ছোট বোনটাকে পাঠায় ছেলেটার কাছে, জেনে আসতে বলে, কেন থাকে তাকিয়ে।
ছোট বোনটা এসে নাহিদকে কড়া কড়া গলায় বলে, এই যে আপনি আমার আপুর দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন সবসময়।
নাহিদ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, খেলার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে, আরে কই? কখন?
- মিথ্যা বলেন কেন? মিথ্যা বললে কিন্তু মুখ বাঁকা হয়ে যাবে।
নাহিদ একটু হাসে, হেসে আবার অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকায় না আর মেয়েটার দিকে। মেয়েটাই দিনা। দিনার যে খারাপ লাগে তা না। ছেলেটা কেমন চোরের মত, তাকাত আগে, এখন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, লাগে না খারাপ। শ্যামলা রঙের মেয়েটা, নাহিদ দেখবে সেই জন্যেই কেন যেন মুখে একটু পাউডার মেখে আসত। একটু পাউডার মাখলে দিনাকে খারাপ লাগে না। বরং চেহারাটা একটু উজ্জ্বলই লাগে। চুল গুলো আসত, সুন্দর করে বেণী করে। একটা মানুষ সবসময় দেখছে, যেন তেন ভাবে গিয়ে দাড়িয়ে থাকলে কেমন দেখায় না? এসবের কোন মানে নেই হয়ত, তবুও করে দিনা। নাহিদও যেমন জানে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে এসবের কোন মানে নেই। নাহিদ বুঝতে পারে, দেখতে দেখতে মেয়েটার জন্য বুকের ভিতর কিছু একটা কাজ করে। সে কিছু একটা কি? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বার বার সব এলোমেলো লাগে, মাথার ভিতর সব ওলটপালট লাগে। ছোট বোনটা যেদিন বলে যায় তাকিয়ে থাকে কেন? নাহিদ ভাবে হয়ত মেয়েটা করেছে রাগ। তাই পরদিন আর তাকায় না। অনেক করে ইচ্ছা করলেও না। দিনা সেদিন লাল ওড়না, লাল জামার সাথে মিলিয়ে পরে আসে লাল টিপ। সে টিপও দেখে না নাহিদ। বুকের ভিতরে কোথাও একটা অস্থিরতা কাজ করে দিনার। কপালটা ঘামে দরদর করে। লাল টিপের পাশ দিয়ে সে ঘাম ঝরে। পাউডার মাখা মুখটা ঘামে জবজবে হয়ে যায়। মনে মনে বলে দিনা, একটু তাকাও। তবুও তাকায় না নাহিদ। সেদিন দিনা চলে আসে বাসায় সন্ধ্যা হবার আগেই। ঘরের দরজা আটকিয়ে কেন যেন কাঁদে। সব কান্নার হয়ত কারণ থাকে না। মনটার উপর খুব রাগ লাগে। মনটা এমন কেন? কারণ ছাড়া একজনের জন্য এমন করবে কেন? কে সে? তবুও তার জন্য কাঁদবে কেন? টিপটা খুলে ফেলে দেয় দিনা, পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে মুখে মাখা পাউডার। নাহিদেরও লাগে খুব কষ্ট সেদিন। সে কষ্টের কথা কাউকে বলা যায় না। কিন্তু কাউকে না বলে থাকলে, তা না বলাই রয়ে যাবে। রাতের বেলা, বড় একটা কাগজ বের করে ভাবে মনের সব কথা লিখে দিবে দিনাকে। সে বড় কাগজে কলম ছোঁয়াতেই সব এলোমেলো। কিছু আসে না মাথায়। শেষ পর্যন্ত শুধু এক কোণায় লিখতে পারে, ভালবাসি। বাসবে ভাল?
পরদিন বিকেলে, পাশে গিয়ে দাঁড়ায় দিনার নাহিদ। জামার হাতার উল্টো দিক দিয়ে কপাল আর মুখের ঘাম মুছে বার বার। ছোট বোনটা বলে, আপনার এখানে কি?
মাথার চুলগুলো একটু ঠিক করে প্যান্টের পকেটের কোণা থেকে ভাঁজ করে বড় কাগজটা বের করে মেয়েটার হাতে দিয়ে বলে, তোমার আপুকে দাও।
বলেই হন হন করে চলে আসে, সামনে থেকে। পিছন ফিরে তাকায় না। ছোট বোনটার হাত থেকে খপ করে কাগজটা নিয়ে রেখে দেয় নিজের কাছে। ছোট বোনটা জানতে চায়, কি এটা আপু?
দিনা শুধু ইশারায় চুপ করতে বলে।
একা একা রাতের বেলা কাগজটা খুলে দিনা, অনেক কিছু হয়ত লেখা। কিন্তু তা হয় না। শুধু এক কোণায় তিন চারটা শব্দ। সে তিন চারটা শব্দই যেন বুকের ভিতর প্রচণ্ড ঝড় বইয়ে দেয়। যেন এই শব্দ গুলোই আশা করছিল, সাথে আরও অনেক কিছু। তা পেয়েও দিনার কষ্ট লাগছে। হঠাৎ করেই নিজের অস্বাভাবিক ব্যাপারটা মনে করে। ছেলেটা জানে না, দিনা কথা বলতে পারে না। জানলে আর ভালবাসতে চাইবে না। চোখের কয়েক ফোঁটা জল পড়ে সে কাগজের গায়ে। বার বার নিজের উপর খুব অভিমান হয়, কেন দিনা সবার মত না?
দিনা কথা বলতে পারে না ,তা জানায়, একটা কাগজে করে লিখে। সরে আসেনা নাহিদ। তবুও ভালবাসে। কথা বলায় বা না বলায় কি যায় আসে। দিনা ভাবত, হয়ত এতটা ভাল হয় না মানুষ, আবেগ ফুরিয়ে গেলে অন্য রকম হয়ে যাবে। কিন্তু অন্য রকম হয় না নাহিদ। ভালবাসে, ভালবাসার কথা বলে। ইশারায় সে ভালবাসায় সাড়া দেয় দিনা। এর মাঝেই হুট করে চোখের সমস্যা বেড়ে যায়। ডাক্তার দেখায় কাজ হয় না। এক সময় চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায়। দিনার তাতে আপত্তি থাকে না ভালবাসতে, যে মানুষটা কথা বলতে পারে না দিনা তাও ভালবাসে, সে মানুষটা যদি নাইবা দেখতে পায়, তাতে ভালবাসা কমে যাবার নেই কিছু। পরিবারের সম্মতিতেই হয় বিয়ে। বিয়ের পরেও সেই ভালবাসা হারিয়ে যায় নি। সেই আগের মত আছে, বা আগের চেয়ে বেশী।
তবুও কিছু শূন্যতা থাকে। এতো ভালবাসার ভিড়েও, নাহিদের খুব দেখতে ইচ্ছা করে দিনাকে, দিনার ইচ্ছা করে ভালবাসি বলতে। হয় না তা সম্ভব। মাঝে মাঝে শুধু কাঁধে মাথা রেখে, নীরবে কাঁদে দিনা। চোখের জল ছুঁয়ে নাহিদ বলে, কাঁদে না পাগলী মেয়ে।
নাহিদেরও চোখ ভিজে আসে, দেখতে পায় দিনা, কিন্তু বলতে পারে না, তুমি কাঁদবে কেন তাহলে?
শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বুকের গভীরে কষ্ট গুলোর বিনিময় করে, ভাগাভাগি করে জড়িয়ে ধরে। চোখের জলের কথা গুলো বলে মনে মনে। দিনা বৃষ্টি দেখতে দেখতেই হিসেব করে, আগামী কাল এক বছর হচ্ছে বিয়ের। জানে কিনা নাহিদ কে জানে? দিনার খুব ইচ্ছা করে, একটু কথা বলে চমকে দিতে এই দিনে। নাহিদও চায় সেদিন শুধু একবার দেখতে দিনার সে হাসি হাসি মুখটা। সে আশা পূরণ হয় না। হবার না।
স্বপ্নদের সভায় হঠাৎ রাসেল নামের এক ছেলের এক স্বপ্ন বলে উঠল, আমি আগেও একবার বলেছি, স্বপ্নে অশ্লীলতার হার বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। ছিঃ ছিঃ কি সব দেখে ছেলেটা। জামা কাপড় কিছু নাই। ভাবতেই লজ্জা লাগে। স্বপ্নে অশ্লীলতা নিষিদ্ধ করার দাবী করি আমি। ঐ ছেলের লজ্জা না থাকুক, আমার তো আছেই।
ব্যাপারটা চিন্তায় আছে স্বপ্নের নির্ধারকদের, তবে এটা বাস্তবায়নে সময় লাগবে আরও। নাহিদ দিনার স্বপ্ন পাশাপাশি বসেই বলল, আমাদের কিছু বলার ছিল। আসলে একটা আবদার ছিল।
- কি আবদার?
- না মানে, নাহিদ আর দিনার আগামী কাল বিবাহ বার্ষিকী। এক বছর হচ্ছে। দুজনেই সত্যি ভালবাসে খুব দুজনকে। এই বিবাহবার্ষিকীতে আমরা তাদের কিছু উপহার দিতে চাই।
- কি ধরণের উপহার?
- নাহিদের অনেক ইচ্ছা, দিনার হাসি মুখটা দেখার আবার। দিনার অনেক দিনের ইচ্ছা, একবার শুধু নাহিদকে ভালবাসি বলার। বাস্তবে তা সম্ভব না। আমরা চাই, স্বপ্নে তা সম্ভব হোক, এখন নিয়মিত স্বপ্নে, দিনাকে দেখুক নাহিদ, কথা বলুক নাহিদের সাথে দিনা।
- এ কি করে সম্ভব? অন্ধ মানুষ স্বপ্নে কিছু দেখতে পারবে না তাই তো স্বাভাবিক। আর বোবা মানুষ বলতে পারবে না।
- সেটা তো অন্যদের ক্ষেত্রে। যারা শুনতে পায় না, ফলে বলতে পারে না। তারা স্বপ্নে কিছু না বলতে পারাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিনা শুনতে পায়, শুধু বলতে পারে না। স্বপ্নে এটা হতেই পারে। আর জন্মান্ধ যারা, কখনও দেখেনি কিছু, তারাই মাত্র স্বপ্নে কিছু দেখে না। তাদের ঘ্রাণ, স্পর্শ, অনুভূতি এসবের স্বপ্ন থাকে। নাহিদ জন্মান্ধ না। ও দেখতে পেত আগে, দিনাকে ও আগেও দেখেছে, তাই অপরিচিত কাউকে না। দেখা কিছুই দেখতেই পারে।
সবাই একটু চিন্তিত মুখে তাকাল, দিনা আর নাহিদের স্বপ্নের দিকে। যুক্তি গুলো ঠিক আছে। তবুও একদিনের মধ্যে এটা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন কাজ। চাইলেই তো আর একটা কিছু স্বপ্নে দেখা যায় না, দেখানো যায় না। অনেক কাজের ব্যাপার স্যাপার। নাহিদ দিনার স্বপ্নের আবদার, এটা পূরণ করতেই হবে। তারা আর কখনও চাইবে না কিছু।
আজ বিবাহবার্ষিকী দুজনের। মুখে পাউডার মেখেছে দিনা। জানে দেখতে পারবে না নাহিদ তাও। কপালে পরেছে একটা লাল টিপ। সে টিপ হাতের আঙুল দিয়ে ছুইয়ে দেখাল নাহিদকে। নাহিদ ভুলে যায় নি এই দিনটার কথা। যেমন মনে রেখেছে দিনা। এখন ঘুমাবার প্রস্তুতি চলছে। ঘুমিয়ে যাবেও, শেষ বারের মত, দুজনেরই একটা করে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। একটু দেখতে পাওয়ার একটু কথা বলতে পারার না পাওয়ায়।
- বাহ তোমাকে আজ লাল টিপে তো তোমাকে বেশ লাগছে।
- তাই?
- এ কি তুমি কথা বলতে পারো?
- কেন পারব না? এই যে বলছি শুনছ না?
- হ্যাঁ শুনছি তো। বল।
- ভালবাসি।
-আমিও বাসি। তুমি এই প্রথম আমাকে ভালবাসি বললে।
- আগেও বলেছি। মনে মনে। ভালবাসলে মনের খবরও রাখতে হয় বুঝলে?
- বুঝলাম। আজ তোমাকে মন ভরে দেখব।
- আর আমি তোমাকে ভালবাসি বলব।
চারপাশে সুনসান নীরবতা। ঘুমিয়ে আছে, হয়ত আশেপাশের সব গুলো মানুষ। শুধু জেগে আছে নাহিদ, আর দিনা। একজন দেখছে প্রাণ ভরে, আর একজন বলে যাচ্ছে চিৎকার করে ভালবাসি। এ ভালবাসার দৃশ্য দেখে হাসছে, দিনা আর নাহিদের স্বপ্ন। যাক শেষ পর্যন্ত পূরণ হল আশাটা। পূর্ণতায় আর একটু পূর্ণতা যোগ হল দুজনের ভালবাসায়। কিছু স্বপ্ন ভেঙে না যাক, চায় সবাই। যেমন চাইবে স্বপ্ন ভাঙার ঠিক আগে নাহিদ আর দিনা। হয়ত, চমকে যাবে ঘুম ভেঙে নাহিদ। একটু হেসে চমকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকবে নাহিদের দিকে দিনা। আবার স্বপ্নের হবে অপেক্ষা, যে স্বপ্নে দিনা বলবে ভালবাসি, আর নাহিদ দেখবে শ্যাম বর্ণ মেয়েটার মিষ্টি হাসি।
যখন বুকের মাঝে ভালবাসা দাপাদাপি করে, তখন অনেক বড় খুঁতও হাওয়ায় হারিয়ে যায়। আর যখন ভালবাসা হীনতায় ভালবাসা বিষিয়ে উঠে, তখন খুব ছোট কোন ভুলও বড় খুঁত হয়ে ধরা দেয়। কেউ থাকতে পারে, নাহিদ দিনার মত, কেউ পারে না। কারও সে সাধ্য আছে, কারও থাকার পরও অসাধ্য ভেবে যায়। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, তা বুদ বুদ বানিয়ে কাদা হয়ে যাচ্ছে। কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না, কেউ দেখছে না। দেখতে না পাওয়া আর না দেখা এক না। তেমনি বলতে না পারা, আর না বলাও এক না। যখন ভালবাসা মনের টানে হয় তখন মেনে নেয়াই যায়, না হয় তোমার অপূর্ণতার পূর্ণতা হব আমি। শান্ত হাসি হতে পারি ঠোঁটে, মিষ্টি দৃষ্টি হতে পারি চোখে, ভালবাসি বলা হতে পারি মুখে।
০৯ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:২২
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৯
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ভালো লাগলো ভ্রাতা +
শুভেচ্ছা