নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
বাহিরে ল্যাম্প পোস্টের নিচে সাদা গাড়িটা দেখতে কেমন হলুদ লাগছে। থেমে আছে অনেক সময় ধরে। বারান্দায় লাগানো বেলি ফুলের গাছে নতুন ফুল ধরেছে। বেলি ফুল নিতির অনেক প্রিয়। তাই বারান্দায় টবে, এই ফ্ল্যাট কেনার পর পরই লাগিয়েছে বেলি ফুলের গাছ রূপক। ফুল ছিঁড়ে আনতে গিয়ে গাছ থেকে, উঁকি দিয়ে ছয় তলার এই ফ্ল্যাট থেকে গাড়িটা দেখল রূপক। রূপকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। অস্থিরতা কাজ করছে ভিতরে। নিতি শুয়ে আছে বিছানায়। তাকিয়ে দেখছে রূপককে।
- এতো রাতে কী করছ বারান্দায়?
- আমাদের বেলি ফুলের গাছে ফুল এসেছে। তুমি কি খেয়াল করেছে?
বারান্দা থেকেই জবাব দিল রূপক।
- দেখেছি। এই রাতের বেলা তোমার বেলি ফুল দেখতে যাবার ইচ্ছা হল?
- না, বেলি ফুল তোমার পছন্দ। ভাবলাম একটা ফুল তোমাকে দেই।
- ফুল গাছেই সুন্দর লাগে। ছেঁড়ার দরকার নেই। তুমি আসো। ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব।
রূপক খানিক পরেই ফিরে এলো। বেলি ফুল হাতে নিয়ে। নিতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমার জন্য।
- ছিঁড়তে না করলাম।
- অনেক আগেই ছিঁড়ে ফেলেছি।
নিতি হাতে ফুলটা নিয়ে আলতো করে একটা হাসি দিল। রূপক পাশে শুয়ে যেতেই, বুকের উপর হাতটা রাখল। নিতির মাঝে মাঝেই মনে হয়, এই ছেলেটা অকারণেই এতোটা ভালবাসে নিতিকে। কখনও রাগ করে না, উঁচু গলায় কথা বলে না, নিতি রাগ দেখালেও চুপচাপ শুনে। নিতিকে অনেক বেশীই বুঝে ছেলেটা। নিতির মাঝে মাঝেই কারণ ছাড়া মন খারাপ হয়ে যায়। সে সময়টায় কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। রূপক তবু এটা বলে, ওটা বলে। নিতি যদি বলে, ভাল লাগছে না কথা বলতে।
রূপক চুপ করে কিছুক্ষণ থেকে বলে, আচ্ছা কথা বলতে হবে না, আমি জড়িয়ে ধরে থাকি তোমাকে, কেমন?
পিছন থেকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরে বসে থাকে রূপক। নিতির সে বাঁধন ছাড়াতে ইচ্ছা করে না। কীভাবে যেন মনটা একটু পরেই ভাল হয়ে যায়। রূপকের সাথে পরিচয়ের আট দিনের মাথায় বিয়ে। নিতি চাকরি করত যে অফিসে, সে অফিসেই এসে দায়িত্ব নেয় রূপক। কম্পানির বনানী শাখায় সব দায়িত্ব ছিল রূপকের। এরপর ধানমন্ডির প্রধান শাখার দায়িত্ব পড়ে রূপকের উপর। নিতির বেশ খোঁজ খবর নিত প্রথম থেকেই কেন যেন রূপক। অফিসের আরও অনেকে থাকার পরও নিতির প্রতি একটু বাড়তি মনোযোগ দিত। তিন দিনের দিন, অফিস শেষে নিতি যখন বের হয়। রাস্তা পাড় হবার সময়টায় পাশে এসে দাঁড়ায় রূপক। নিতি মুখ তুলে তাকাতেই রূপক ছোট একটা হাসি দিয়ে বলে, ভাল আছেন?
- জ্বি স্যার। আপনি ভাল আছেন?
- ভাল। বাসায় যাচ্ছেন?
- জ্বি।
- আপনার পড়াশুনা কী শেষ?
- জ্বি স্যার। এ বছরই অনার্স শেষ করলাম।
- আচ্ছা আচ্ছা। আসলে সরাসরি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, আপনি কী মনে করেন বুঝতে পারছি না।
নিতি একটু চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রূপকের দিকে। রূপক নিতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাচ্ছিলাম। সেটা অবশ্যই, যদি আপনার পছন্দের কেউ না থাকে। আর আমাকে যদি খুব বেশী অপছন্দ না হয়।
নিতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রূপকের দিকে কথাটা শুনে। রূপক তাকায় নি নিতির দিকে। এতো সাহস করে সোজা সাপ্টা বিয়ের কথা বলে দিয়েই বোধহয় লজ্জায় কুঁচকে গেছে রূপক। রূপকের সেই লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে কেন যেন সেদিন খুব ভাল লাগছিল।
বাসায় বিয়ের প্রস্তাব গেল। কম জানা একটা মানুষের সাথে হুট করেই বিয়ে হয়ে গেল নিতির। রূপককে জানত কম, বুঝত কম, এতো দ্রুত ভালবাসাও জন্মায়ই। তবুও কেন যেন একটা টান অনুভব করত রূপকের প্রতি। এই টানেই হয়ত খুব দ্রুত বিয়ের পর ভালবাসাটা তর তর করে বেড়েছে। কিংবা রূপক অল্প সময়েই অনেক বেশী ভালবাসাতে সম্পর্কটা এতো দ্রুত এতো স্বাভাবিক হয়েছিল। রূপক কেন এতো ভালবাসত জানে না নিতি। তবে কারণটা বেশ ভাল করেই জানা রূপকের। নিতি রূপকের প্রথম ভালবাসা না। ছয় বছর কম সময় নয়। ছয় বছরের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল লিয়ার সাথে। প্রথম দিকটায় এতোটা বোঝাপড়া ছিল সে সম্পর্কে ভুলেও মনে হয় নি, ভেঙে যাবে সম্পর্ক, কখনও হয় নি মনে আদৌ ভেঙে যাওয়া সম্ভব লিয়া আর রূপকের ভালবাসার সম্পর্কটা। ভার্সিটিতে পা দেবার পর পরিচয়, এরপর ভালবাসা। সে ভালবাসা বিরামহীন ভাবে এতোটা বছর চলে এসেছে। লিয়ার অনেক কিছুই খারাপ লাগত রূপকের। কিন্তু বলত না কখনও কিছু। শুধু মাঝে মাঝে বলত, লিয়া তুমি এভাবে চললে আমাদের সম্পর্কটা টিকবে না।
লিয়া রাগ দেখিয়ে বলত, সম্পর্ক টিকবে না মানে কী? তুমি আমার সাথে থাকতে চাচ্ছ না আর?
- আমি তেমন কিছুই বলছি না। তোমার কি মনে হয় না, তুমি যা করছ তা ঠিক না?
- কোন কাজটা তোমার বেঠিক লাগে?
রূপক ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বেঠিক লাগে অনেক কিছু, তবুও সঠিক ভেবেই মনকে বুঝায়, সব ঠিক আছে। আমি যে মানুষটাকে ভালবাসি এতো, সে মানুষটাও তেমন বাসে। লিয়ার ছেলে বন্ধুদের কখনই ভাল লাগত না রূপকের। বেশী বড়লোকের মেয়ে, বন্ধু বান্ধব এমনিতেই বেশী ছিল। সে বন্ধু গুলোকেই অসহ্য লাগত রূপকের। সপ্তাহে একদিন বরাদ্ধ থাকত লিয়ার সে বন্ধুদের জন্য। সে দিনটা রূপকের সাথে মোটামুটি যোগাযোগ বন্ধ। সে দিনটা বড় গুমোট একটা অস্বস্তিতে কাটত রূপকের। যদি কখনও মুখ ফসকে বলে দিত, তোমার এতো ছেলে বন্ধু আমার ভাল লাগে না লিয়া।
লিয়া স্বভাব সুলভ রাগ দেখিয়ে বলত, রূপক, তুমি এমন আচরণ করছ কেন? আমার বন্ধুদের মেনে নিয়েই তুমি আমার সাথে সম্পর্ক করেছ। এখন কেন খারাপ লাগছে? আর তুমিও যদি এমন কর আমার করার কিছু নেই।
রূপক মেনে নেয়, চুপ করেই মেনে নেয় সেসব কিছু। মন থেকেই চাইত লিয়ার সাথে সম্পর্কটা না ভেঙে যাক। এই বিষয় গুলো নিয়ে খারাপ লাগা আনতে চাইত না ভিতরে রূপক। বুঝত ব্যাপার গুলো বাচ্চা সুলভ কিছু। তবুও কেন যেন খারাপ লাগা চলে আসত। সম্পর্কের প্রথম দিকটায় লিয়ার কোন বন্ধুকেই বিরক্ত লাগত না রূপকের। কিন্তু শেষ দিকে এসে নাবিদ নামের ফটোগ্রাফার বন্ধুটার সাথে মেলামেশা কেন যেন মানতে পারত না। হুটহাট এখানে ওখানে চলে যেত ছবি তুলতে। নাবিদের ভাল একটা ক্যামেরা আছে, সে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলবার জন্য, একজন নিয়মিত সুন্দরী মডেল দরকার। নাবিদের মডেল ছিল লিয়া। রোদ উঠলে ছবি তুলতে হবে, মেঘ করলে ছবি তুলতে হবে, বৃষ্টি নামলে তুলতে হবে ছবি, শিশিরে ঘাস ভিজে গেলে তুলতে হবে ছবি, জ্যোৎস্না থাকলে তুলতে হবে ছবি। একদমই সহ্য সীমার বাহিরে ছিল ব্যাপার গুলো রূপকের। তবুও মেনে নিত। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার তাগিদে।
কিন্তু সব কিছুই হুট করে ওলট পালট হয়ে যায়। নাবিদ কিছু ছবি পাঠায় ইনবক্সে রূপকের, পাঠিয়ে বলে, আশা করি এই ছবি গুলো আপনি দেখেন নি লিয়ার।
লিয়ার এ ধরণের ছবি নাবিদের কাছ থেকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না রূপক। হঠাৎ করেই মাথাটা বড় ঝিম ধরে যায়, বড় কষ্ট লাগে বুকের বাম পাশটায়। ছয় বছরের চেনা জানা মানুষটাকে হঠাৎ করেই খুব অচেনা লাগে, খুব আপন মানুষটাকে খুব পর মনে হয়। এরপর আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। বিশ্বাস বড় অদ্ভুত একটা জিনিস, বিশ্বাস দুটি মানুষকে যেমন অদ্ভুত ভাবে আপন করে দিতে পারে, অবিশ্বাস তেমনি খুব বিশ্বাসের মানুষটাকেও হুট করেই অনেক বেশী পর করেও দিতে পারে। রূপক সে ছবি গুলো পাঠায় লিয়াকে, পাঠিয়ে ছোট করে একটা মেসেজ দেয়, আশা করি এরপর অন্তত তোমার আর আমার মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকা যায় না। সম্ভব না। আর কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না, ঠিক আছে?
লিয়ার সাথে সেই সম্পর্ক ভেঙে গেল, ছয় বছরের ভালবাসার সম্পর্ক। কষ্ট হচ্ছিল যদিও খুব রূপকের। তবুও চেষ্টা করত কাটিয়ে উঠবার। পারত না। বার বার ঘুরে ফিরে, লিয়ার ছবিটা ভেসে উঠত চোখে।
সে সময়টায় পরিচয় নিতির সাথে। নিতির মাঝে কেমন যেন লিয়ার একটা ছায়া পেত রূপক। প্রথমবার দেখে নিতিকে দেখে লিয়া ভেবে ভুল করেছিল রূপক। প্রথম দিন কথা বলতে বলতেই জানতে চেয়েছিল, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, কিছু মনে না করলে?
- জ্বি স্যার বলেন।
- আপনি কি লিয়া নামে কাউকে চিনেন? মানে আপনার বোন বা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে লিয়া নামে কেউ আছে?
- জ্বি না স্যার।
- আচ্ছা আচ্ছা।
তবুও নিতির মাঝে লিয়ার অদ্ভুত একটা অবয়ব পেত রূপক। লিয়ার মত হাসি, লিয়ার মত তাকানোর ধরণ, লিয়ার মত কথা বলার ভঙ্গিমা। লিয়ার যে ছবিটা চোখে লেগে আছে রূপকের, গেঁথে আছে মনে, তারই যেন প্রতিচ্ছবি দেখত প্রতিনিয়ত নিতির মাঝে রূপক। তাই কারণে অকারণে বার বার অফিসে এসে নিতির খোঁজ নিত, কথা বলত, সুবিধা অসুবিধা জানতে চাইত। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয়, লিয়ার হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট নিতিই পারবে দূর করতে, দরকার বড় বেশী নিতিকে দরকার। লিয়ার প্রতিচ্ছবি ছিল বলেই হয়ত এতো দ্রুত এতোটা ভালবাসা এসে গিয়েছিল নিতির প্রতি। নিতির সাথে বিয়ের পর থেকেই কেন যেন নিজেকে বড় পরিপূর্ণ, বড় পরিপক্ক, বড় বাচ্চা সুলভ আচরণহীন মনে হয় নিজেকে। যে সন্দেহ গুলো দানা বাঁধত লিয়াকে ঘিরে, কখনও তার বিন্দু মাত্রও আসে নি নিতিকে নিয়ে। অবিশ্বাস জিনিসটা কেন যেন যায় না নিতির জন্য। বিয়ের বয়স ছয় মাস পেরিয়েছে, এর মধ্যে লিয়ার শূন্যতা একবারও অনুভব করে নি রূপক। নিতিকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে, বড় বেশী বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে রূপকের। নিতি কখনও যদি বলে, আমি বাহিরে যাব আজ একটু আসতে দেরী হবে। রূপক কখনও জানতে চায় না, কোথায় যাচ্ছ? অবিশ্বাস আসে না। এইতো পাঁচ দিন আগে রূপকের কাছে বলল, তুমি আমাকে কোনভাবে ৫০ হাজার টাকা যোগাড় করে দিতে পারবে?
এতো টাকার কথা শুনে একটু অবাক হলেও, রূপক জানতে চায় নি, কী করবে টাকা দিয়ে। ব্যাঙ্ক থেকে তুলে পরদিন নিতির হাতে তুলে দিয়েছিল রূপক। কিছু নিয়েই কখনও দুজনের মাঝে হয় নি, মনমালিন্য। শুধু একদিন নিতি বলেছিল, আচ্ছা তুমি আমার কাছে প্রথম দিন জানতে চেয়েছিলে, লিয়া নামে আমি কাউকে চিনি কিনা, কেন বলতো?
রূপক একবার ভেবেছিল মিথ্যে বলবে। কিন্তু ইচ্ছে করছিল না, মিথ্যে বলতে নিতির সাথে। পিছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, আচ্ছা বলব। কিন্তু রাগ করতে পারবে না, ঠিক আছে?
- আচ্ছা করব না।
- আমার লিয়া নামে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল।
কথাটা শুনে নিতি চুপ হয়ে গিয়েছিল। কেমন শূন্য দৃষ্টি নিয়ে রূপকের দিকে তাকিয়েছিল। রূপক বলতে থাকে, আসলে, মেয়েটা...।
নিতি মুখটা চেপে ধরে রূপকের।
"আর কিছু বলতে হবে না। আমার তোমার মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনতে ভাল লাগে না।"
- আমি তোমাকে ভালবাসি, নিতি।
- আমি জানি।
নিতি এরপর জানতেও চায় নি, লিয়ার ব্যাপারে কিছু কখনও। কীভাবে প্রেম হল, কীভাবে ভাঙল, সম্পর্ক এগিয়েছিল কতদূর। সেদিনটা একটু মনমরা থেকে, পরদিন থেকেই স্বাভাবিক ছিল নিতি।
পাশে ঘুমাচ্ছে নিতি। রূপকের বুকের উপর একটা হাত রেখে। রূপক আস্তে করে হাতটা সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঘুমিয়ে থাকা নিতির গালে আলতো করে একটা চুমো দিয়ে, বারান্দায় গিয়ে আবার দাঁড়াল। গাড়িটা এখনও থেমে আছে বাড়িটার সামনে, ল্যাম্পপোস্টের নিচে। সাদা গাড়িটা হলুদ লাগছে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে। বুকের ভিতর আবার চিন চিন করে একটা ব্যথা করছে। বিছানায় শুয়ে থাকা নিতির দিকে তাকাল রূপক। সত্যি নিতিকে বড় ভালবাসে রূপক। লিয়ার চেয়েও বেশী। অনেক বেশী।
লিয়া আবার ফিরে আসুক এ মিষ্টি ভালবাসার মাঝে একদম চায় না রূপক। একদমই না।
গত সপ্তাহে শুক্রবারটায় দুপুরের ভাত খাবার সময়, নিতি ভাত মুখে তুলতে তুলতে রূপককে বলল, আমাদের নিচ তলায় ফ্ল্যাটটাও বিক্রি হয়ে গেছে।
এটা বলার মত কোন কথা না, তবুও নিতি বলল। এই বাড়িটায় অনেক ফ্ল্যাট। কবে কোন ফ্ল্যাট বিক্রি হল, তা জানার কথা নিতির না। নিতি বলে যায়, আমাদের নিচ তলাটা নিয়েছে একটা মেয়ে। জানো এতো বড় ফ্ল্যাট, একাই থাকে। ওর বাবা নাকি ওকে এটা গিফট করেছে।
রূপক ভাত মুখে দিয়েই, তাকায় নিতির দিকে।
- তুমি জানো কী করে এসব?
- আরে মেয়েটা কাল এসেছিল, আমাদের বাসায়। আমার সাথে অনেক গল্প করল। দরজায় এসে নক করল, আমি তো প্রথমে দরজা খুলতেই চাই নি। ভাবলাম কে না কে। পরে বলল, নিচ তলার।
- আচ্ছা আচ্ছা।
- সবচেয়ে মজার বিষয় কি জানো?
- কী?
- মেয়েটার নাম লিয়া। এই লিয়া আবার তোমার লিয়া না তো? হিহি।
ভাত খাবার মাঝে থেমে গেল রূপক। কাশি দিল কয়েকটা। নিতি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও পানি খাও।
রূপক ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিল। রূপকের চোখে মুখে একটা অন্য রকম ভাব, আর নিতির মুখটা হাসি হাসি। রূপকও একটু স্বাভাবিক হতে বলল, আরে কী বল না তুমি। লিয়া নামে মেয়ে কী পৃথিবীতে একটাই? আর ভাল হল তো, তোমার সাথে মাঝে মাঝে এসে গল্প করবে মেয়েটা। আমি অফিসে থাকলে তো একাই থাকো বাসায়।
নিতি হেসে দেয়, হাসে রূপকও। রূপকের সে হাসিটা সত্যি ছিল না, জোর করে হাসা। মনের মধ্যে খচ খচ করে, কানের কাছে বার বার লিয়া নামটা বাজতে থাকে। যে আশঙ্কা করেছিল রূপক, যে কথাটা কথার ছলে বলেছিল নিতি। সে কথাটাই সত্যি। নিতি যেদিন লিয়ার কথা বলে তার পরদিন অফিস করে বাড়ি ফেরার পথে, পাঁচ তলার বারান্দার দিকে একবার তাকায়। লিয়াই ছিল সেটা। ভীষণ অস্বস্তি হয় লিয়াকে দেখে, দর দর করে ঘামে রূপকের কপাল। লিফট বেয়ে উঠবার সময় কাঁপা কাঁপা হাতে লিফটে ৫ এ চাপ দেয় রূপক। কেন দেয় জানে না। কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে লিয়ার। ফিরে আসতে যাবে তখনই দরজাটা খুলে যায়। লিয়া একটা স্মিত হাসি দিয়ে মাথাটা বের করে বলে, ভিতরে আসবে?
রূপক পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছতে মুছতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। পিছন ফিরে তাকায় না। শুধু অনুভব করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখনও লিয়া। তাকিয়ে দেখছে রূপককে। রূপক ফিরে যেতে চায় না অতীতে। বর্তমান নিয়েই টেনে নিয়ে যেতে চায় ভবিষ্যতে। তবুও এ কয়েকদিনে খুব দ্রুত অনেকবার সে অতীত এসে সামনে দাঁড়ায়। যে অতীত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছে ছয় মাস আগেই।
তার পরদিনও অফিসে যাবার পথে গাড়ি থেকে নামতেই লিয়া এসে হাজির। রূপকের সামনে এসে বলে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে?
- আমার তোমার সাথে কোন কথা নেই।
- আমার সাথে তোমার ছয় বছরের সম্পর্ক ছিল। এখন কয়েক মিনিট তোমার কাছ থেকে পাওয়া আমার অধিকার।
- আমার জীবনে তোমার অধিকার বলতে কিছু নেই। প্লিজ, ঝামেলা বাধিও না কোন। আমি নিতিকে অনেক ভালবাসি। ওকে নিয়ে আমি ভাল থাকতে চাই।
- এই ভালবাসাটা তো আমাকেও বাসতে।
রূপক লিয়ার কোন কথা শুনে না। হন হন করে অফিসে ঢুকে যায়। রূপকের মাঝের অস্থিরতা টের পায় নিতি। বারবার জানতে চায়, তোমার কি শরীর খারাপ? কিছু নিয়ে চিন্তিত? অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে?
রূপক নিতির মুখের দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে বলে, আমি ঠিক আছি নিতি।
পরদিনও বিকাল বেলা অফিস ফেরার পথে লিয়া এসে কথা বলে রূপকের সাথে।
- আমি তোমাকে মেসেজ দিয়ে বললাম, আমরা যেখানটায় দেখা করি সেখানে আসো। আসলে না কেন?
- তোমার সাথে দেখা করার নেই কিছু লিয়া। আর আমার মোবাইলে কোন মেসেজ আসে নি। তুমি তোমার মত থাকো, আমাকে আমার মত থাকতে দাও। নয়ত খারাপ হবে কিন্তু।
পাশ কাটিয়ে চলে যায় রূপক। বড় যন্ত্রণা হয় বুকের ভিতর। এই যন্ত্রণা ভাল লাগে না রূপকের। ভয় হয়, নিতিকে না এসে উলট পালট কিছু বলে। নিতি মেয়েটাকে নিয়ে ভাল থাকতে চায় রূপক।
গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ লেগে আসছে রূপকের। ঘুম পাচ্ছে। আর একবার গাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে, বিছানায় এসে শক্ত করে ঘুমিয়ে থাকা নিতিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল রূপক।
খুব ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল রূপকের। তখনও সূর্য উঠে নি। ঘুম ভাল হয় নি চিন্তায়। নিতিকে সরিয়ে উঠে বারান্দায় দাঁড়াল আবার। বেলি ফুল ফুটে আছে গাছটায়। বারান্দা থেকে নিচে তাকাল। এখনও ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। অতটা আলো হয় নি পথ ঘাট। সাদা গাড়িটা নেই ওখানে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রূপক। কিন্তু যে জায়গাটায় গাড়িটা ছিল, সে জায়গাটায় সাদা টি শার্ট পরা একটা মেয়ে পড়ে আছে। সাদা টি শার্টটা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হলুদ লাগছে। এই মেয়েটা রূপকের পরিচিত। বড় পরিচিত।
পিছন থেকে একটা নরম হাত রূপকের কাঁধের উপর স্পর্শ করল। চমকে ঘুরে তাকাল রূপক। নিতি দাঁড়িয়ে পিছনে।
- কী হয়েছে রূপক? এতো ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে গেলে।
রূপক মুখে কিছু না বলে, হাত দিয়ে নিচে রাস্তায় ইশারা করল। নিতি সেদিকে উঁকি দিয়ে বলল, কে যেন পড়ে আছে। তুমি আসো তো, ওসব ঝামেলায় যেতে হবে না।
রূপককে টেনে নিয়ে আসল বিছানায়।
- এতো দ্রুত উঠতে হবে না।
বলে রূপকের পাশে শুয়ে পড়ল নিতি। রূপকের মাথার ভিতর ঘুর পাক খাচ্ছে, মেয়েটা ওভাবে পড়ে আছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে?
নিতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপকের দিকে। রূপক যা ভাবছে তার উত্তর জানে নিতি। ভাল করেই জানে। ওখানে পড়ে আছে লিয়া। জীবিত লিয়া না, লিয়ার লাশ। ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে, জীবিত রাখার জন্য না। এই লিয়াকেই যে ভালবাসত রূপক তাও জানে নিতি। রূপক প্রতিটা দিন অফিস যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হবার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে নিতি। লিয়া এখানে আসার পর থেকে, প্রতিটা দিন রূপকের গাড়ির পিছন পিছন বের হতে দেখেছে লিয়ার গাড়ি। লিয়ার গাড়ি চিনে নিতি। একদিন অফিস শেষে বাসার সামনে কথাও বলতে দেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেদিন মোবাইল রেখে যখন রূপক গোসলে গিয়েছিল, একটা মেসেজ আসে রূপকের মোবাইলে। নিতি মেসেজটা ওপেন করতেই দেখে, " আমরা যে জায়গাটায় দেখা করতাম সবসময়, সেখানে আসবা আজ। তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। না আসলে, তুমি ভাবতেও পারবে না কি হবে? আমি কিন্তু প্রতিদিন তোমার বাসায় যাই। নিতির সাথে কথা বলি। -লিয়া।"
সাথে সাথেই মেসেজটা ডিলিট করে দেয় নিতি। দেখতে পায় না রূপক। জানেও না কিছু। জেনে যায় অনেক কিছু নিতি। রূপক বেরিয়ে আসতেই গোসল করে, নিতি তাকিয়ে থাকে রূপকের দিকে। দৌড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
"তুমি আমার শুধু রূপক। আমি ভালবাসি তোমাকে।"
রূপক বুঝতে পারে না, কেন বলছে নিতি এসব। রূপকের দিকে তাকিয়ে মনে মনেই বলে নিতি, তোমার ভাগ আমি কাউকে দিব না। কাউকেই না। এক বিন্দু পরিমাণও না।
লিয়াকে খুন করবার জন্য টাকাটা নেয় রূপকের কাছ থেকে। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে যোগাড় করে টাকার বিনিময়ে খুন করা খুনী। লিয়া প্রতি রাতে নাইট ক্লাব থেকে রাত করে বাড়ি ফিরে, সে সময়টায় থাকে না কেউ আশেপাশে। গাড়ি করে লোক অপেক্ষা করে বাড়িটার সামনেই। লিয়া গাড়ি নিয়ে আসতেই, আগেই পথে আগলে ধরে। সুন সান নীরবতায় খুন করে চলে যায়।
নিতির ভালবাসার সবটা নিতির করে দিয়ে যায়।
নিতি রূপকের বুকে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলে, ভালবাসি রূপক।
রূপক মৃদু স্বরে বলে, ভালবাসি নিতি।
- ভালবাসি কথাটার অর্থ জানো?
- কী?
- ভালবাসি যখন কাউকে বলছ মন থেকে, মানে সে বাসি হয়ে গেলেও তাকে তোমার ভাল লাগতে হবে। সারা জীবন ভাল লাগতে হবে। আমাকে তুমি ভালবাস। এই ভালবাসাটা সারাজীবন বাসতে হবে। আমি আমার ভালবাসার ভাগ কাউকে দিব না। এর জন্য আমি যা খুশী করব।
রূপক তাকিয়ে থাকে শান্ত দৃষ্টিতে নিতির দিকে। নিতির চোখে মুখে ভিন্ন রকম এক রক্তিম ভাব। এই দৃষ্টির সাথে পরিচিত নয় রূপক। তবে সে দৃষ্টি যত ভয়ংকরই হোক, সে দৃষ্টিতে আগলে রাখার, ধরে রাখা, ভালবাসা শুধু নিজের করে রাখার স্পৃহা আছে, খুব কাছে, খুব বেশী গভীরে, নিজের ভালবাসা লুকিয়ে রেখে দেবার বাসনা আছে।
সূর্য উঁকি দিচ্ছে আকাশে। তার আলো এসে পড়ছে সাদা বেলি ফুলের উপর। এসে পড়ছে সাদা টি শার্ট পরা মেয়েটার উপর। আর এদিকটায় সে আলো থেকেও দূরে অনেক দূরে শুধু নিজের করে রাখার চেষ্টায় ব্যাকুল নিতি রূপককে।
ভগ্নাংশের ভাগ বাদ দিয়ে পুরোটাই আমার, করার ভালবাসায় বিভোর দুটো হাত, দুটো চোখ, একটা অ ভগ্নাংশ মন। যার পুরোটাই শুধু একজনের।
অ ভগ্নাংশ
- শেষ রাতের আঁধার (রিয়াদুল রিয়াদ)
০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৩১
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৫১
সাব্বির ০০৭ বলেছেন: দারুণ হয়েছে। প্লাস।