নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ নিশুতি

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৮

আকাশে চাঁদ উঠে নি আজ। চারপাশটা ছোপ বাধা কেমন একটা অন্ধকার হয়ে আছে। ফাঁকা মাঠের ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছে না। অতি পরিচিত পথ বলে অনায়াসে চলে যেতে পারছে কেতন। এ পথ বড় অপরিচিত বলে চলতে গিয়ে মাঠের মাঝের আগাছাতেও পা আটকে বার বার হোঁচট খাচ্ছে বিলু। একটু পর পর কেতনের হাত ধরে বলছে, ডর লাগে রে, কেতু।
- ডর লাগনের নাই কিছু। আমার লগে হাঁট।
মাঠের বাম পাশে জোড়া তাল গাছের পাড়ের ডোবাতে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। ডান পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর স্রোতের শব্দ সে ডাকের সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না।
- কেতু আমরা যাই কই?
- তোর এতো জাননের কাম নাই। কথা বেশি কস ক্যান?
জোড়া তাল গাছে পেত্নী থাকে, এই ভয় গ্রামের প্রায় সবাই পায়। ভয়টা আছে বিলুর মনেও। কথা বললে ভয়টা দূরে চলে যাবে। তাই কেতনের সাথে বার বার কথা বলছে। রাত এখন কত হবে? মাঝ রাত পেরিয়েছে অনেক আগে, সকাল হতেও দেরী অনেক। বিলু যখন ঘুমাচ্ছিল কেতন তখন কোথা থেকে এসে যেন ফিসফিসিয়ে জানালার কাছ থেকে বলছিল, ঐ বিলু, বিলু, উঠ। কাম আছে। আমার লগে যাওন লাগব।
বিলু ঘুম ঘুম চোখে আড়মোড়া ভেঙে বলেছিল, কই যামু?
সে প্রশ্নের উত্তর কেতন দেয় নি। বিলুও কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ চলে এসেছে কেতনের সাথে। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে খুব। পাশের ছেলেটা আসলেই কি কেতন? কেতন না হয়ে অন্য কেউ হতে পারে বা কেউ না। বিলু এমন অনেক শুনেছে, অমাবস্যার রাতে কাছের মানুষের বেশ ধরে ভূত প্রেত আসে, ধোঁকা দেয় মানুষ গুলোকে। কেতনও বিলুর কাছের মানুষ। সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সারাদিন একসাথে ঘুরে বেরায়, জাল টেনে মাছ ধরে, চৌকিদার বাড়ি থেকে চুরি করে ডাব খায়। বার তেরো বছর বয়সের ছেলে দুইটা সারাদিন একসাথেই থাকে। তবুও কেতনকে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না বিলু। বাবা, মা নেই কেতনের। একা অত বড় একটা বাড়িতে থাকে, কীভাবে কীভাবে নিজেই উপার্জন করে, খায়, চলে। সারাদিন কোন কাজই করতে দেখে না কেতনকে বিলু। তবুও কেতন যেমন খুশী চলতে পারে। আর বিলু বাবা মায়ের সংসারে থেকেও সব ইচ্ছার বেশীরভাগই অপূর্ণ রয়ে যায়। বিলুর কিছু কিছু ইচ্ছা পূরণ করে মাঝে মাঝে কেতন। বিলুর একবার ইচ্ছা হল, সিনেমা দেখতে যাবে থানা শহরের হলে। কেমন একটা লাগে বুঝতে চায়। কেতন একদিন সকাল বেলা বিলুকে বলে, জলদি কইরা সাইজা ল। বই দেখবার যামু।
হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সে কি অনুভূতি। দুজন মিলে সেদিন প্রথম বারের মত বিড়ি ফুঁকে পরীক্ষা করেছিল কেমন লাগে। কেতন কেমন অনায়াসে টানছিল। আর বিলু দুই টান দিয়েই বলেছিল, কেতন রে, মাথাডা কেমন ঘুরান্টি দিতাছে।
সেদিন কেতন বিলুকে নিয়ে হারেম চাচার বিরিয়ানিও খেয়েছিল। এই বিরিয়ানি পুরো এলাকায় বিখ্যাত। নানা জায়গা থেকে এসে মানুষ এই বিরিয়ানি খায়। বড় তৃপ্তি নিয়ে সেদিন বিলু বিরিয়ানি খেয়েছিল। কিন্তু বিরিয়ানি পেটে সয় নি। শাক ভাতই যে ভাল মানিয়ে নিয়েছে বিলু। সারাদিন দৌড়াতে হয়েছিল কাঁচা বাথরুমটাতে।
বিলু মাঝে মাঝে জানতে চায়, কেতু তুই এতো ট্যাকা পাস কোনথন?
কেতু বেশ গম্ভীর হয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে, মাথা থাকন লাগে রে। তোরেও একদিন শিখাই দিম।
কেতন এখনও শিখায় নি, কীভাবে এতো টাকা পাওয়া যায়।
বিলু আর একবার হোঁচট খায়। কেতন ধমক দিয়ে বলে, ক্যামনে চলস? দেইখা চলস না।
- আন্ধারে আমি দেখুম ক্যামনে? আমার চোখে কি বাত্তি লাগানি?
কেতন বলে না কিছু। কেতনের হাতের কোদালটা বিলুর হাতে দেয়।
"জিনিসটা ধর।"
বিলু হাত বাড়িয়ে কোদলাটা নেয়। কোদাল দিয়ে কি হবে কে জানে? কেতনের আজ বড় মায়ের কথা মনে পড়ছে। বাবা একবার শহরে কাজে যাবে বলে চলে গেল, আর ফিরে আসে নি। মায়ের সাথে থাকত কেতন। মা কীভাবে সংসার চালাত জানে না কেতন। তবে প্রায় রাতে মা বেরিয়ে যেত কেতনকে ঘুম পাড়িয়ে। প্রতি রাতে কেতনের যখন ঘুম ভাঙত, পাশে মাকে পেত না। বাহিরের নিঝুম পরিবেশে ঝিঁঝিঁ পোকা আর রাত জাগা পাখিদের ডাকটাও কেমন ভৌতিক লাগত। ভয় হত খুব কেতনের। সে ভয়ে মা পাশে থাকত না। একা একা কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে যেত। এক রাতে মাকে ডাকতে আসে তোঁতা মাতব্বর। তোঁতার ডাকে ঘুম ভাঙে কেতনরও। কিন্তু ঘাপটি মেরে থাকে। মা তোঁতাকে বলেন, আমি আইজা যাইবার পারুম না। শরীলডা ভালা না।
- ট্যাকা বাড়াই দিমু। চল।
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথা। সবটাই শুনে কেতন। মা বেরিয়ে যায় তোঁতা মাতব্বরের সাথে। সেই রাতের পর আর ফিরে আসে নি মা। মাকে খুঁজে বেরায় পায় না। তোঁতা মাতব্বর পুরোপুরি অস্বীকার করে সে রাতে গিয়েছিল কেতনদের বাড়িতে। মাতব্বরের লোকের কাছে মারও খেয়েছিল কেতন এসব বলাতে। মা গত হয়েছেন অনেক বছর। এতো বছর পরে আজ আবার বুকের ভিতর কেমন যেন হু হু করছে। কিছু হারানোর শূন্যতা কখনই পূর্ণতা পায় না। পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব না। বিলু আবার বলে, কেতুরে ডর লাগে তো।
বাঁশ ঝাড়ের এ পাশটা আরও গা ছমছমে, ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে বিলুকে হাত ধরে নিয়ে যায় কেতন। কেতন আর বিলু বাঁশ ঝাড়টার মধ্যে যেতেই, কিছু একটা দৌড়ে চলে গেল। ভয়ে ওরে বাবারে বলে চিৎকার করে উঠল বিলু। কেতন "চুপ কর" বলে থামতে বলল বিলুকে। বাঁশঝাড় পেরিয়ে যেতেই উঁচু মাটির স্তুপের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল বিলু। মাটির স্তুপের আকার আকৃতি দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠে কেতনকে বলল, আমরা কই আইলাম রে কেতু?
- থাম না। ট্যাকা ক্যামনে পায় জানতে চাইছিলি না? ট্যাকা নিতে আইছি। মাটি খুঁড়লেই ট্যাকা এইখানে।
বিলু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, এইডা তো মনে হয় কবরস্থান।
- হু।
- কি হু?
- কবরস্থান। চুপ থাক তুই। কোদালটা দে আমারে।
বিলু বুঝতে পারে না কি করতে যাচ্ছে কেতন। কিন্তু কেতন জানে কি করতে যাচ্ছে ও। গ্রাম ছেড়ে মাইল তিনেক পরের এই কবরস্থানে গরীব মানুষ গুলোর লাশ কবর দেয়া হয়। এখানে কার কবর দেয়া হল, কার হল না, সে খবর কেউ রাখে না। কবরে শয়ান মানুষটাকেও কেউ কখনও দেখতে আসে না। কেতনের সাথে শহরের এক লোকের আলাপ হয়েছে। এই সব কবর খুঁড়ে যে সব কঙ্কাল পাওয়া যাবে, সেসবের নাকি অনেক দাম। শহরে যারা ডাক্তারি পড়ে, তাদের কাছে নাকি এসব অনেক দামে বিক্রি করা যায়। ঐ লোককে কঙ্কাল যোগাড় করে দিতে পারলে ভাল অঙ্কের টাকা পাবে কেতন। তাই কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বের করতে এসেছে। এতো টাকা কেতন একা খরচ করতে পারবে না, তাই সাথে করে নিয়ে এসেছে বিলুকে। কিন্তু বিলু কোন কাজের না। ভয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। কেতনই কোদাল দিয়ে মাটি সরিয়ে যাচ্ছে। কঙ্কাল বের করতে হলে আরও মাটি খুঁড়তে হবে। অনেকটা গর্ত খোঁড়া হলে বুঝতে পারে কাজ হয়ে গেছে। বিলুকে ডাক দেয় কেতন। বিলু কোন সাড়া দেয় না। কেতন মাটি সরিয়ে কঙ্কাল বের করে। কবর থেকে তুলে নিয়ে আসে। কিন্তু কঙ্কালটা তুলে নিয়ে আসার পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগছে। হাত পা কপাল সব ঘামছে। মৃদু বাতাসে বাঁশ ঝাড়ের পাতারা নড়ে উঠে হালকা একটা বাতাস শরীর ছুঁয়ে গেলেও ঘেমে যাওয়াটা কমছে না। কেতন একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনছে। শব্দটা স্পষ্ট হতেই বুঝতে পারল, "কেমন আছিস রে বাবা।" কথাটা।
কেতন কঙ্কালটা থেকে ছিটকে দূরে সরে আসল। বিলু দৌড়ে এসে কেতনকে ধরে।
- কি হইছে রে?
কেতন আমতা আমতা গলায় বলল, মা।
- কি কস? কই? কি?
- এইডা আমার মায়ের কবর।
বিলু কি বলবে বুঝতে পারে না। অস্বস্তি আর দ্বিধার একটা সুরে বলে, কি কস?
- হ, আমি জানি এইডা আমার মা। এইডা আমার মায়ের কঙ্কাল। আমার মা ডা এইখানে এতদিন ঘুমাই ছিল।
বিলু শক্ত করে চেপে ধরে কেতনকে। কেতন কেঁদে উঠে চিৎকার করে, মা, ও মা। ও মা রে।
বিলু কেতনকে আরও জোরে চেপে বলে, চল আমরা যাই গা কেতু। আমাগো ট্যাকা লাগব না।
কেতন বিলুকে সরিয়ে এগিয়ে আসে কঙ্কালটার দিকে। কঙ্কালটা কবরে আবার শুইয়ে দিয়ে মাটি দিয়ে দেয় উপরে। কবরটা মাটি দিয়ে ভরে তার উপর মাথা চেপে বসে থাকে। কঙ্কাল দেখে একটা মানুষকে চিনে ফেলা সম্ভব নয়। তবুও হৃদয়ের কিছু ব্যাপার থাকে, আপন জিনিসের প্রতি ভালবাসা থাকে। কেতন সে ভালবাসায় মায়ের সাথে কথা বলছে আর কাঁদছে। সে কান্নার জল কবরটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। মায়ের সাথে অনেক কথা বাকী। বুকের ভিতরের চিনচিনে ব্যথাটা বাড়ছে। মায়ের কোলে শুয়ে পড়লেই তা চলে যাবে। কোথায় যেন হারিয়ে যাবে। কেতন বলছে, মা রে একটু কোলের ভিতর নে না।
বিলু নিঃশব্দে কেতনের পায়ের কাছটায় বসে আছে। বসে বসে ভাবছে, আজ রাতে মায়ের কোলে গিয়ে শুয়ে থাকবে। কেতনকে সাথে নিয়ে বলবে, মা তোমার আর এখখান পোলা হইলে কি বেশি রাগ করবা?

বাঁশ ঝাড়ের মৃদু বাতাসে নড়া পাতার আওয়াজ, নদীর স্রোতের নিঃশব্দ শব্দের সাথে মিশে কানে আসছে। একটা শান্তি শান্তি হাওয়া হয়ে বইছে। আজ এখানে সুখ দুঃখের দিন লিপি, রাতের আঁধারে লেখা হচ্ছে। সে সুখ দুঃখ অনুভব হয়ে, হ্রদয়ের গভীরে রবে। কেউ টের পাবে না, জানবে না। কিছু একান্ত মানুষ গুলোর মত, কিছু সুখ দুঃখ সত্যি বড় একান্ত। এই সুখ রোদের আলোয় যেমন পাওয়া যায়, নিশুতি অমাবস্যার আঁধারেও ধরা দেয়।

- রিয়াদুল রিয়াদ

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১১

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন:
একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে প্রকাশিত হয়েছে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস একা আলো বাঁকা বিষাদ। পাওয়া যাচ্ছে "বর্ষা দুপুর" প্রকাশনীতে। স্টল নং- ৫৬৩-৫৬৪

বইমেলার বাহিরে নেয়া যাবে কুরিয়ারের মাধ্যমে।
কুরিয়ার

২| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১৬

আমি তুমি আমরা বলেছেন: শেষে এসে ভেবেছিলাম হয়ত কোন ভৌতিক গল্প পাব।তবে এই সমাপ্তিটাও ভাল লাগল।

কিন্তু কেন কেতনের মা কেন খুন হল- সে ব্যাপারে কোন ইংগিত পাওয়া গেল না।

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:২৪

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ, :)
কিছু আবছায়া থাকুক না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.