নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
অমর একুশে বইমেলা ২০১৫ তে প্রকাশিত আমার প্রথম উপন্যাস, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারঃ টুকরো ছায়া টুকরো মায়া।
১
খোলা বারান্দায় বেশ সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা। এতো ময়লা জমে আছে, ঠিক হাত রাখার মত না। দোতলার এই বারান্দা থেকে বাড়িটার সামনে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাশে চেয়ারে বসা মৃন্ময় । চায়ের কাপ হাতে । স্নেহা মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গাটা খুব একটা খারাপ না। কিন্তু লোক এতো কম এদিকে, বেশ ভয় ভয় লাগে । আর তুমি না কি। এই ময়লা চেয়ারে বসে বসে চা খাচ্ছ ।
মৃন্ময় চা এ আর একটা চুমুক দিয়ে, মুখ না তুলেই বলল, লোকজন আমাদের বাড়িটা ভয় পায় । ভুত প্রেত আছে বলে, গুঁজব রটিয়ে রেখেছে । আর চেয়ার আনার সময় চোখে চশমা ছিল না ।
মৃন্ময়ের চোখে মোটা গ্লাসের চশমা । চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না স্পষ্ট । এমনকি ২ হাত সামনেও না । বাড়িটাতে আসা অনেক বছর পর । মামা সেই ছোটবেলা এই বাড়ি থেকে নিয়ে গেলেন । শহরেই এরপর থেকে থাকা, বড় হওয়া । একটা বাড়ি এভাবে পড়ে থাকবে । তার চেয়ে বিক্রি করে দেয়া যায় কিনা, সেই মতলবে এসেছে মৃন্ময় । সাথে করে নিয়ে আসল বউ স্নেহাকে, মেয়ে নৃ কে । আর বউয়ের জোরাজোরিতে ঐ আধ পাগল লোকটাকে । লোকটাকে একদম পছন্দ না মৃন্ময়ের । কি যেন নাম ? নাম মনে করার কোন ইচ্ছা এখন মৃন্ময়ের নেই । লোকটাকে ছাড়া নাকি নৃ থাকতে পারবে না । স্নেহার কথায় মাঝে মাঝে মনে হয়, ঐ লোকটাই নৃর বাবা । আর মৃন্ময় পাশের বাড়ির প্রতিবেশী । মেয়েটাও হয়েছে তেমন, সারাদিন ঐ লোকটার সাথে থাকবে । লোকটা পাশে থাকলেই মুখ হাসি হাসি করে রাখবে । মৃন্ময়, স্নেহা সামনে গেলেই মুখ গোমড়া । মৃন্ময় চশমা খুলল । সব অস্পষ্ট ।
- নৃ কোথায় ?
- বশির স্যারের সাথে গেল ।
হ্যাঁ বশির । নাম মনে পড়েছে । গানের শিক্ষক স্নেহার । স্নেহা যে কেন এই লোকটাকে এতো পছন্দ করে, মাথায় আসে না ।
- বশির স্যারের সাথে গেল মানে ? কই গেল ?
- এই সামনে । বাহিরে নাকি ঘুরিয়ে দেখাবেন ।
- আরে, তিনি কিছু চিনেন এখানকার ? মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে ? এমনিতেই এই জায়গা এতো ভাল না । আশেপাশে নানা ঘটনা ঘটে । আমাদের শত্রুর অভাব নেই ।
আসলেই খুব নিশ্চুপ চারপাশ । লোকজনের আনাগোনা একদম নেই এদিক দিয়ে । গ্রাম ক্লান্তিপুর, আসলেই এই জায়গায় ক্লান্ত রূপ । গ্রামের লোকজনের এই বাড়িটার প্রতি খুব ভয় । অনেক বেশি । হাটে যাবার একমাত্র সোজা রাস্তা এই বাড়ির সামনে দিয়ে হলেও, কেউ এখান দিয়ে যায় না । এ রাস্তায় মানুষের চলাচলের অভাবে আগাছা, বুনো গাছে ভরে গেছে । ঘুরে ফিরে কোথা থেকে কোথা থেকে যেন গ্রামের লোকজন যাওয়া আসা করে । শুধু শুধু এমন করার কোন মানে নেই । শুধু শুধু করছেও না । বেশ আগে থেকেই এই বাড়ির কিছু লোক রহস্যজনক ভাবে মারা যাচ্ছে । মারা যাচ্ছে না ঠিক, হারিয়ে যাচ্ছে । গুম হয়ে যাচ্ছে । হারিয়ে যাবার ব্যাপারটাও অদ্ভুত। হারিয়ে যাবার পর, ঠিক সিঁড়ির গোঁড়ার কাছে একটা চিরকুট পাওয়া যায়। সে চিরকুটে লেখা," মৃত্যুটা রহস্য জনক।"এমন লেখা চিরকুট পেলে, অন্তত আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না । লোকে বলে এই বাড়িতে ভুত আছে । দিনের বেলায়ও ভুতের চলাচল । ভুতের আড্ডাখানা এটা । দোতলা বাড়িটা তাই অনেক বছর ধরেই পড়ে আছে এভাবে । শেষ মারা যান এখানে, মৃন্ময়ের বাবা, চাচা একসাথে । মারা যান কিনা জানেনা । হুট করেই একদিন পাওয়া যায় না তাদের । সিঁড়ির কাছে সে চিরকুট । তার পরদিন মামা এসে নিয়ে চলে যান, নিজের বোন আর ভাগ্নেকে নিজের বাসায় । নিয়ে যাবার সময় বলেন, এসব জানলে আগে কখনই তোকে এখানে বিয়ে দিতাম না । কি ভয়ংকর অবস্থা ।
মা কাঁদেন সে সময়, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদেন । সেই ঘটনার দিন, মা ছিলেন না বাড়িতে । মৃন্ময়কে নিয়ে গিয়েছিলেন, বোনের শ্বশুর বাড়ি । সেখানে খবর যায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, মৃন্ময়ের বাবা চাচা কাউকেই । মা পাগলের মত ছুটতে ছুটতে চলে আসেন মৃন্ময়কে নিয়ে । পাগলের মত বাড়িটায় এ ঘরে ও ঘরে দৌড়াদৌড়ি করেন । চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে মৃন্ময়ের বাবাকে খুঁজেন। ছাদে গিয়ে এদিক ওদিক দেখেন । মৃন্ময়ের সে দৃশ্য স্পষ্ট মনে আছে । মৃন্ময়ের সেদিন বাবা, চাচার জন্য যতটা না খারাপ লাগছিল, তার চেয়ে বেশী খারাপ লাগছিল মায়ের জন্য । বড় বেশী খারাপ ।মামা নিয়ে যাবার সময় মা কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, আমি যাব না এ বাড়ি থেকে । আমার স্বামীর বাড়ি থেকে ।
মামা ধমক দিয়ে বলেন, একদম ফ্যাত ফ্যাত করে কাঁদবি না । যাবি না তো মরবি এখানে বসে ? লোকে বলে বাড়িটা ভাল না, তাও এখানেই থাকতে হবে ।
সেই চলে যাওয়া। মৃন্ময়ের বয়স তখন কত ? এই ১০ এর মত । তবুও ঠিক মনে আছে, মামার হাত ধরে চলে যাবার সময় শেষ বার বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল মৃন্ময় । বড় মায়া লাগছিল বাড়িটাকে ছেড়ে যেতে। সে মায়া ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। শহরে মামার বড় বাড়িতে থাকত। মামা বিয়ে বিয়ে করেননি। ছিল না মামাত ভাই বোন। মনে হত সবসময় নিজের বাড়িই। যে মায়া ছিল এ দো তলা বাড়ির জন্য। সে মায়া ভালবাসা সব গেঁথে গেছে এখন ঐ মামার বাড়িটার জন্য। মামা মারা গেলেন এক বর্ষায়। মৃন্ময় তখন কলেজে পা দিয়েছে মাত্র। অসুস্থ ছিলেন বহুদিন ধরেই। সেদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে তিনি ডাকেন মৃন্ময়কে, মৃন্ময়ের মা কে। মামা মৃন্ময়ের হাত ধরে বলেন, বাবা, তুই আমার ছেলে। তোকে ছেড়ে চলে যেতে বড় কষ্ট লাগবে রে।
মৃন্ময়ের হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এসব রাখ। এখন কাজে লাগবে না, লাগবে ভবিষ্যতে।
সে কাগজ গুলো কিসের ছিল জানত না মৃন্ময়। পরে জেনেছে, মামার জমি জমার কাগজ, দলিল করে দিয়ে যাওয়া মৃন্ময়কে। মামা মৃন্ময়ের মা কে ডেকে বলেন, রেবা, তুই তো মেয়ে। তবুও আমার ছোট একটা ব্যবসা দেখে রাখতে পারবি না?
- ভাইজান, আপনি এসব নিয়ে এতো লাগলেন কেন? আপনার শরীর খারাপ। একটু বিশ্রাম নেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মামা ঠিকই বিশ্রাম নেন। কিন্তু ঠিক হয় না কিছুই। সব বেঠিক করে মামা চলে যান সেদিন। ঝুম বৃষ্টির এক সকাল বেলা।
- বশির স্যার তো সাথে আছেই এতো চিন্তার কিছু হয় নি।
স্নেহার কথায় মৃন্ময় ঝাপসা চোখে তাকায়। স্নেহার সাথে এই বশির লোকটাকে নিয়ে তর্ক করা বৃথা। স্নেহা যে কোন ভাবেই হোক, বুঝাবার চেষ্টা করবে বশির লোকটার সাথে নৃ খুবই ভাল থাকবে, থাকবে নিরাপদ। একবার বলা নেই কওয়া নেই লোকটা নৃ কে নিয়ে চলে গেলেন চিড়িয়াখানায়। বাঘ, ভাল্লুক, বান্দর দেখাবার জন্য। বাচ্চা একটা মেয়ে। বয়স তখন ৫। এসব দেখে ভয় পাবে না কি করবে। সেসব চিন্তা স্নেহার মাঝে নেই। অফিস থেকে মৃন্ময় যখন ফোন দিয়ে জানতে চায়, আমার নৃ মামনি কি করে?
স্নেহা বেশ স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়, চিড়িয়াখানায় গেছে, বশির স্যারের সাথে।
মৃন্ময় তা নিয়ে রাগারাগি করে, কোন লাভ হয় না। স্নেহার যুক্তি, ছোট মেয়ে বাঘ, ভাল্লুক, বান্দর দেখে দেখে সেসবের ইংলিশ শিখবে, বাস্তব জ্ঞান অর্জন করবে।
এরপরের ব্যাপারটা আরও মারাত্মক। নৃকে নিয়ে একদিন বশির লোকটা তার বাড়িতে চলে যান। নারায়ণগঞ্জ তার বাড়ি। সেখানে একদিন নৃ থাকবে। লোকটার মা নাকি রান্না করে খাওয়াবে নৃকে একদিন। স্নেহা সেদিনও নির্বিকার। একটা মা কি করে এতোটা নির্ভার থাকে, মেয়েকে দূরে পাঠিয়ে বুঝতে পারে না মৃন্ময়। তাই এই বিষয় গুলো নিয়ে তর্ক করা ছেড়ে দিয়েছে মৃন্ময়। তবুও মাঝে মাঝে মাথা বড় গরম হয়ে যায়। তখন দু একটা কথা বললেই, রাগ করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে স্নেহা। মেয়েরা রাগ করে দুটি কাজ বেশী করে, হয় বাপের বাড়ি চলে যায়, না হয় খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। প্রথমটা দেখা যায়, বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে, আর দ্বিতীয়টা অবিবাহিত। স্নেহার বিয়ে হয়ে যাবার পরও দ্বিতীয় দলের। রাগ করে খাওয়া বন্ধ। সাথে রান্নাও। নৃর কোন কষ্ট হয় না, না খেয়ে যত কষ্ট মৃন্ময়ের। নৃ দেখা গেল, রান্না না হলেই বেশী খুশি। রান্না না হলে মনের খুশিতে সাবান খেতে পারে, দেয়াল আঁচড়ে লোহা দিয়ে সে রঙ খেতে পারে, খেতে পারে টেবিলের উপর থেকে উঠে যাওয়া কাঠের অংশ।
- আজ কি রান্না করব ? খেতে হবে না দুপুরে আমাদের ?
মৃন্ময় চশমা চোখে দিয়ে, চায়ের কাপটা রেখে ময়লা জমে থাকা রেলিং এর উপর বলল, সব ব্যবস্থা এনায়েত চাচা করবেন। তিনি আমাদের আসার খবর পেয়ে, বাড়িটা পরিষ্কার করে রেখেছেন। রান্না ঘর, গোসল খানা সব। চিন্তা করতে হবে না। তুমি রান্না করতে না চাইলে, তার বউ এসে রান্না করে দিয়ে যাবেন। বাজারও তিনি করে নিয়ে আসবেন।
- না না, তার বউ কেন রান্না করবেন? গ্রামের মানুষের রান্না আমি খেতে পারব না। কেমন না কেমন রাধে কে জানে। আমিই রান্না করব।
- গ্রামের মানুষদের রান্না শহরের মানুষদের চেয়ে ভালই হয়।
- তবুও আমিই রাঁধব।
- আচ্ছা রাঁধবে। আমি একটু বাহিরে যাব। দেখি তোমার বশির স্যার মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গেল।
স্নেহা হালকা করে মাথা নাড়ল। এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ জানালো না।
স্নেহার বাড়িটা খুব একটা খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, বাড়িটা না বিক্রি করে এখানে সারাজীবন থেকে গেলে খারাপ হয় না। কোলাহল নেই কোন। তাছাড়া শাশুড়ি মা সবসময় এ বাড়িটার গল্প করতেন। কত সুন্দর সে গল্প গুলো। গল্প করত মৃন্ময়ও। তবে সে গল্প খুব একটা ভাল না। শুনলে মনে হয়, যেন বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলছে। এ বাড়ি থেকে হুট করে মানুষ উধাও হয়ে যায়। উধাও হয়ে গিয়েছিল, মৃন্ময়ের দাদা, এরপর বড় চাচা, তারপর মৃন্ময়ের বাবা, ছোট চাচা একসাথে। স্নেহা সিঁড়ি দিয়ে নামল নিচ তলায়। নেমেই চমকে উঠল। চমকে উঠবার কথাই। লুঙ্গী পরা গায়ে এক লোক নিচ তলায় দাঁড়িয়ে আছে।
- এই কে আপনি?
স্নেহার প্রশ্নে, লোকটা বেশ গম্ভীর গলায় বলল, আমি রাসেল। ভাইজান আমারে পাঠাইছে।
- ভাইজান কে?
- এনায়েত ভাইজান। উনি জিগাইছেন, আপনারা দুপুরে কি খাইবেন? বাজার এই জায়গায় কি দিয়া যাইবে, নাকি আপনারা খালুর বাসায় যাইবেন?
- না বাজার এখানে দিয়ে যান। আমরা রান্না করে নিব।
- আচ্ছা। আর জিগাইছে, চা বানানির সব কিছু রাইখা গেছিল, আপনারা চা খাইছেন কিনা।
- হ্যাঁ আমরা চা খেয়েছি।
- আচ্ছা, আমি আসি।
লোকটা পিছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। স্নেহা ডাক দিয়ে বলল, এই যে শুনেন।
আবার ঘুরে এসে লোকটা বলল, জ্বে বলেন।
- আচ্ছা, এ বাড়িটা নাকি ভয় পায় সবাই?
- হ পায় তো। এই বাড়িত ভুত আছে। দিন রাইত সারাক্ষণ থাকে।
স্নেহা ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর শ্বাস নেবার সময় একটু নাক কুচকালো।
- আপনি গায়ে কি দিয়েছেন?
- জ্বে আঁতর মাখছি।
- এতো বিচ্ছিরী গন্ধ। আচ্ছা যান আপনি ।
- সাবধানে থাইকেন। ভুত আছে এই বাড়িতে।
স্নেহা কিছু বলল না, নাকটা ওড়নার কোণা দিয়ে চেপে ধরে উপরে চলে গেল। চলে গেল লোকটাও বাহিরে। স্নেহা বিছানায় শুয়ে পড়ল। বড় ক্লান্ত লাগছে। হুট করেই মনে হল, নিচ তলায় কাঁচ ভাঙার কোন শব্দ হল।
২
মেয়েটাকে নিয়ে বড় চিন্তায় আছে মৃন্ময়। বাবা হিসেবে কখনও আদর করতে পারে না। কখনও কোলে আসে না। কাছে গেলেই শক্ত হয়ে বসে থাকে। চোখ উল্টে তাকায়। সে দৃশ্য হঠাৎ করে কেউ দেখলে ভয় পেয়ে যাবেই। ভয় পেতে বাধ্য। কিন্তু সেসবে ভয় না মৃন্ময়ের। ভয় অন্য কোথাও। মেয়েটা খেতে চায় না কিছু। খেতে চায় না ঠিক না, খায় না। খুব ভাল কোন তরকারী সামনে এলে দিলেও, নাক মুখ উঁচু করে বসে থাকবে। খাবে না। এই মেয়ের প্রিয় খাবার দেয়ালের রঙ। একটা লোহার টুকরা নিয়ে, দেয়ালে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রঙ তুলবে আর খাবে। ছোট বেলা সাবান খেত। বাচ্চা মানুষ খেতেই পারে, তখন ব্যাপারটা আমলে নেয় নি মৃন্ময়। ঠিক ওভাবে ভেবেও দেখে নি স্নেহা। স্নেহা বলত, বাচ্চা মেয়ে ও কিছু না। বাচ্চা কালে আমি নিজেও নাকি, ইয়ে করে নিজেই খেয়ে ফেলতাম। একটু বড় হয়ে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হয়ে যায় নি তা। এখন নৃর বয়স ১০। এখন ব্যাপারটা আরও মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। সাবান ছেড়ে নৃ খাওয়া শুরু করেছে, কাঠ, রঙ, মাটি, লোহার মরিচা, পেন্সিল, রাবার, জামার বোতাম। যা পায় সামনে তাই খায়। তবে খাবার জিনিস খাবে না। এতো করেও মানাতে পারে নি নৃকে। বশির লোকটার কথা শুধু শুনে নৃ। তাকে দিয়েও কাজ হয় নি। গলায় কি একটা তাবিজ না কি বেঁধে দিয়ে লোকটা বলেছিল, ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হয় নি তা এখনও। বরং নৃর মাঝে এরপর থেকে পাগলামি আরও বেড়েছে। যতটা সময় বশির লোকটা সামনে থাকে, নৃ খিলখিল করে হাসে। হাসে যখন বশির লোকটা না থাকে তখনও। কার সাথে যেন একা একা কথা বলে। মৃন্ময় মাঝে মাঝে দরজার কাছে কান দিয়ে শুনতে চেষ্টা করে কি বলছে। কিন্তু খুব আশ্চর্য। মৃন্ময় দরজায় কান রাখতেই নৃ কথা বন্ধ করে দেয়। দরজা খুলে উঁকি দিতেই দেখা যায়, নৃ চোখ উল্টে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মৃন্ময় যখন কাছে গিয়ে জানতে চায়, মামনি, কার সাথে কথা বলছিলে?
নৃ সে কথার কোন উত্তর দেয় না। মুখ আরও গোমড়া করে তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। যেন ঠিক জানালার কাছেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, সে মানা করছে নৃকে কথা বলতে। মৃন্ময়, মেয়ের হাসি খুশি মুখটা দেখার জন্য হলেও, ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়।
- মৃন্ময়, যাচ্ছ কোথাও?
নৃকে কোলে নিয়ে, বশির স্যার এগিয়ে আসলেন মৃন্ময়ের দিকে।
- না, এমনি বের হলাম। আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?
- তেমন কোথাও না, নৃকে চারপাশ ঘুরিয়ে দেখালাম। খুব সুন্দর জায়গা।
- চারপাশে জঙ্গল। এখানে সুন্দরের কি আছে?
- জঙ্গল তাতে কি? প্রাকৃতিক প্রতিটা জিনিসই সুন্দর। তোমার বাড়ির পিছনটায় একটা পুকুরও আছে দেখলাম। বেশ বড়। ঘাট আছে, যদিও তা শ্যাওলা ধরা। আমরা সে ঘাটে বসে বসে গল্প করলাম।
মৃন্ময় খুব একটা বিরক্তি ফুটিয়ে মুখে বলল, আমি জানি। আমার ছেলেবেলা এখানেই কেটেছে।
- ওহ তাই নাকি?
- হ্যাঁ, আর আপনার এটা জানার কথা। আমার তো মনে হয় না স্নেহা আপনার কাছে বলে না এমন কোন কথা আছে।
- মৃন্ময় তুমি কি আমার উপর কোন কারণে রেগে আছ?
- আপনার উপর কেন রাগ করব? আমার রাগ নেই। আমি কারও উপর রাগ করতে পারি না।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একবার হাঁটতে লাগল মৃন্ময়। কোথায় যাচ্ছে জানে না। এলোমেলো হাঁটাহাঁটি। মৃন্ময়ের রাগ লাগছে খুব। রাগ লাগার কারণ নেই কোন। বশির স্যারকে দেখলেই মৃন্ময়ের কারণ ছাড়া রাগ লাগে। এখনও লাগছে। তাই এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করে, সে রাগ চাচ্ছে কমাতে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটাহাঁটি রাগ কমিয়ে দেয়। প্রতিটা উদ্দেশ্যহীন কাজেরই একটা করে উদ্দেশ্য ঠিক একটা সময় পর বেড়িয়ে আসে। উদ্দেশ্য ছাড়া হাঁটাহাঁটি যেমন খানিক পর কমিয়ে দিবে, মৃন্ময়ের রাগ। এটাই উদ্দেশ্য ।
মা একবার হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একটু সুস্থ হয়েই তার প্রথম কথা তিনি ছেলেকে বিয়ে করাবেন। মৃন্ময়ের কাছে জানতে চান, ওর পছন্দ আছে কিনা। মৃন্ময়ের পছন্দের নেই কেউ জানিয়ে দেয়। মা নিজের পছন্দে নিয়ে আসেন স্নেহাকে বউ করে। পছন্দ হয় মৃন্ময়েরও। বউকে নিয়ে আসবে নিজের বাড়িতে, বিয়ে করে। ঠিক তখন কোথা থেকে বউ এসে বলে, এই যে শুনেন, বশির যাতে বাসায় না যায়।
মৃন্ময় হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নতুন বউ কি বলে এসব? কিসের বশির? আর একটু আগেই দেখল লাল টুকটুকে শাড়ি পরা, আর এতো দ্রুত লেহেঙ্গা। বউ কাছে এসে বলে, আমি স্নেহা না, দুলাভাই। আমি স্নিগ্ধা। আপনার বউয়ের ছোট বোন। দেখতে একরকম , যদিও পার্থক্য আছে। কিন্তু সবাই ধরতে পারে না। আপনি কয়দিন গেলেই ধরতে পারবেন। আর শুনেন। ঐ টাক মাথার বশির যাতে আপনার বাসায় না যায়। স্নেহা কিন্তু খুব জোরাজোরি করবে, শয়তানটাকে বাসায় নেবার। কোন ভাবেই আপনি সম্মতি দিবেন না। মনে থাকবে?
মৃন্ময় সেদিন জানত না, বশির কে। কিন্তু মৃন্ময় খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, স্নেহা বাসর রাতেই ওর বশির স্যার এর গল্প শুরু করল। ছোটবেলা থেকে গান শেখায়। কত ভাল মানুষ। মৃন্ময় গান পারে কিনা। গান না পারলে বশির স্যারের কাছ থেকে শিখে নিতে। বাসর রাতে অন্য পুরুষের গল্প, কোন পুরুষেরই ভাল লাগার কথা না। লাগছিল না মৃন্ময়েরও। তবুও শুনতে হয়েছিল। নতুন বউয়ের উপর রাগ করতে বা মুখের উপর তোমার কথা শুনতে ভাল লাগছে না বলতে বড় বাঁধছিল। স্নেহার জোরাজুরিতে সে রাতে মৃন্ময়ের শোনাতে হয়েছিল গান। বেসুরো গলায় মৃন্ময় গেয়েছিল, মধু মালতি ডাকে আয়...।
স্নেহা সে গান শুনে, বিরক্তি এনে বলে, ইশ, তুমি একটা ছেলে মানুষ হয়ে কিসব মেয়েদের গান গাও?
- আমি তো একটা গানই পারি।
- তো এটা অন্তত সুর করে গাও। কেমন গান এটা? বশির স্যার কত মিষ্টি করে গান করেন।
মৃন্ময়ের সে কথার উত্তরে বলার মত ছিল না কিছু। তিন কি চারদিন না যেতেই, স্নেহা মাকে বলে খুব আয়োজন করে রান্না করে। উপলক্ষ মেহমান আসবে। মেহমানের জন্য রান্না। মৃন্ময়কে কাজে যেতে দেয় না স্নেহা সেদিন। মৃন্ময় জানতে চায়, আসবে টা কে?
- আরে আসবে একজন। এটা একটা সারপ্রাইজ তোমার জন্য।
দুপুর বেলা মেহমান আসে। হাতে তবলা আর মাথায় টাক দেখেই বুঝে যায় এই সেই বশির স্যার। খুব বিরক্তি নিয়ে খাওয়া দাওয়া করে মৃন্ময়, বশির স্যার এর সঙ্গে। খাওয়া দাওয়া শেষে তিনি তবলা বাজিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনান। সে সঙ্গীত শুনে মৃন্ময়ের বিরক্তি আরও বেড়ে যায়, কিন্তু পছন্দ করেন মা, পছন্দ করার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল স্নেহা। এরপর থেকে নিয়মিত আসে বশির স্যার। গান শুনিয়ে যায় মাকে। মা আবার অসুস্থ হয়ে যান তার কিছুদিন পরেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বারবার কিছু একটা দেখান, আঙ্গুল দিয়ে। আর বলেন, ঐ লোকটাই মারছে রে মৃন্ময় তোর বাবারে। ঐ দেখ দেখ ঘ্রাণ আসতেছে। আমি জানি। ঐ যা তুই যা।
মৃন্ময় মার কাছে হাত ধরে বসে থাকে। মা বলেন, বাড়িটায় থাকে রে মৃন্ময় লোকটা। ঐ লোকটা রে।
মৃন্ময় বুঝতে পারেন মায়ের কোন সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার দেখায়, কাজ হয় না। কোন সমস্যা ধরা পরে না। মা মাঝে মাঝে একা থাকলেই ফিসফিসিয়ে কথা বলেন। মৃন্ময় একদিন শুধু শুনেছে, মা বলছে রাতের বেলা কারও সাথে, তুই এনে দে না লোকটারে। তুই তো পারিস।
মৃন্ময় দরজায় উঁকি দিতেই কথা বন্ধ। ঠিক যেমন কথা বন্ধ করে দেয় নৃ। তার কয়েকদিন পরেই মা মারা যান। মারা যাবার সময় মা খুব হাসছিলেন, কেন যেন হাসছিলেন। পাগলের মত বলছিলেন, তুই তো পারলি না। কেন পারলি না? না পারলি। আমি চলে যাই, আমি তার কাছে চলে যাই।
মা মারা যাবার পর বেশ অনেক দিন দেখা পাওয়া যায় না বশির স্যার এর। স্নেহার পেটে তখন নৃ, তেমন একদিন সন্ধ্যার পর বশির স্যার এসে হাজির।
- শুনলাম তোর বাচ্চা হচ্ছে?
- হ্যাঁ স্যার।
মৃন্ময় অবাক হয়ে বশির স্যার এর কাছে জানতে চায়, আপনি জানলেন কি করে?
- জেনে গেলাম।
- জেনে গেলাম মানে কি? কিভাবে জানলেন ?
- মনের টান থাকলে ঠিকই জানা যায় ।
এরপর থেকে আবার নিয়মিত আসতেন বশির স্যার । বাসার বাহিরে যে টুকু সময়, থাকত মৃন্ময়, বড় অস্বস্তি লাগত । মনের মাঝে খচ খচ করত, বশির লোকটা এসে ঠিক বসে আছে বাসায় ।
একদিন মৃন্ময় বলেই ফেলে স্নেহাকে, তোমার সাথে ঐ লোকটার সম্পর্কটা কি আমি বুঝি না । তাকে তুমি এ বাড়িতে আসতে না করে দিবে । আমার তাকে পছন্দ না ।
- এসব কি ধরণের কথা ? তিনি আমার স্যার । তার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকবে ? ছিঃ, তুমি এতো নিচু মনের কেন ? একটা বয়স্ক লোককে নিয়ে আমাকে এসব বলতে খারাপ লাগে না ?
স্নেহা তখন অন্তঃসত্ত্বা । মৃন্ময় অনেক কষ্টে রাগ সামলে বলে, আচ্ছা, সরি । ভুল হয়ে গেছে । তুমি উত্তেজিত হইও না ।
এরপর থেকে আর কখনও বাসায় আসা নিয়ে বলে নি কিছু মৃন্ময় । তবুও সহ্য হত না লোকটাকে । এমনকি মেয়েটা হবার পর, মেয়েটার নাম পর্যন্ত রেখে দেয়, বশির স্যার । স্নেহা বলে, আচ্ছা আমাদের মেয়ের নাম নৃ হলে কেমন হয় ? তোমার নাম মৃন্ময়, মেয়ের নাম নৃ । তোমার নামের সাথে মিল । আবার স্নেহার ন ও আছে ।
- হ্যাঁ বেশ ভাল হয় । তোমার যা পছন্দ ।
- হ্যাঁ আসলেই সুন্দর নাম কিন্তু । বশির স্যার রেখে দিলেন নাম ।
মৃন্ময় সে কথায় তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময় স্নেহার দিকে । এখানেও বশির স্যার । মৃন্ময় বারবার খুঁজতে থাকে, বশির নামটার সাথে নৃ নামের কোন মিল আছে কিনা । তেমন কোন মিল পাওয়া যায় না ।
- বাবা, ডাব নিয়ে আসলাম তোমাদের জন্য।
এনায়েত চাচা হাতে চারটা ডাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে আছে পাশে লুঙ্গী পরে বাজারের ঝুড়ি নিয়ে রাসেল।
- ভাল আছেন চাচা? আপনি তো অনেক কষ্ট করছেন আমাদের জন্য।
- কি যে বল বাবা? কিসের কষ্ট? গ্রামের ছেলে এতদিন পর গ্রামে আসছ, কিছুই তো করতে পারছি না। তোমার চাচী একটু অসুস্থ, তাই ঠিক মত খোঁজ খবর নিতে পারছি না।
- না চাচা, ঠিক আছে। যা করছেন তাই অনেক।
- তুমি কি বাড়ির দিকে যাবে?
- এদিকে একটু ঘুরে দেখি, আপনি বউ মার সাথে দেখা করে আসেন। নৃ ও বাসায় গেল একটু আগে।
- নৃ কি বুড়িটার নাম?
- জ্বি চাচা।
এনায়েত চাচা ডাব নিয়ে আর রাসেল বাজারের ব্যাগ নিয়ে এনায়েত চাচার পিছনে পিছনে যাচ্ছে। মৃন্ময় হাঁটতে লাগল উল্টো দিকে। খুব রোদ আকাশে, ঝলসে দেবার মত। মৃন্ময় সে রোদের মাঝেই এলোমেলো হাঁটছে। এই মাঠেই ছোটবেলা খেলে বেড়িয়েছে। এখন আর চাইলেও সে সময়ে ফিরে যাওয়া যায় না। মানুষ চাইলেই সব পায় না। পাবার কথা না। মানুষ যা চায় তাই পেয়ে গেলে, জীবনটা বড় অর্থহীন মনে হয়।
(পরবর্তী পর্ব আগামী কাল)
- রিয়াদুল রিয়াদ
©somewhere in net ltd.