নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
৭
- চাচা যেতে সময় লাগবে কত?
- আমি ভ্যান ঠিক করে দিব। ঘণ্টা তিনেক লাগতে পারে।
- তিন ঘণ্টা? এতো সময়?
- লাগবেই তো বাবা, অনেক দূরের পথ। আমি কি তোমার সাথে আসব?
- না চাচা আপনার আসতে হবে না। আপনি ঠিকানাটা আমাকে দিলেই হবে।
- না আমি আসি, একা একা চিনবে?
- চিনব চাচা, চাচী অসুস্থ। আপনার থাকা দরকার সাথে।
চাচা মনে হল একটু মন খারাপ করলেন তাকে না বলতে যাওয়াতে। মৃন্ময় চাচার হাত ধরে বলল, চাচা আপনি এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক করেছেন। এতোখানি এখনকার যুগে কেউ করে না।
চাচা কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।
- আচ্ছা আমি ভ্যান ঠিক করে আনি। তুমি বাসায় যাও। তোমাকে খবর পাঠাব।
স্নেহা মন খারাপ করে বসে আছে। মৃন্ময় পাশে বসে বলল, মন খারাপ করে বসে আছ কেন?
- আমার কেন যেন ভাল লাগছে না।
- কেন?
- তোমার যেতে হবে না। আমরা এখানে কয়েকদিন থাকি। তারপর চলে যাই। বাড়ি বিক্রি করার দরকার নাই।
- এখানে আসলাম, কাজটা শেষ করেই চলে আসব, রাত হবার আগেই। আর তোমার সারপ্রাইজ চলে আসবে।
- আমার সারপ্রাইজ লাগবে না। তোমার যেতে হবে না।
- আরে পাগলী মেয়ে, আমি বললাম তো চলে আসব, রাতের আগেই। চিন্তা কোরো না।
স্নেহা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নেড়ে সায় দিল। নৃ কে একবার কোলে নিল মৃন্ময়।
- মামনি, তোমাকে খুব মিস করব। চলে আসব দ্রুত। দুষ্টামি করবে না কেমন?
নৃ কিছু বলল না। চুপ করে মাথা নাড়ল। বশির স্যার এর সাথেও খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা মৃন্ময়।
- স্যার একটু খেয়াল রাখবেন। রাসেল থাকবে আশেপাশে। কোন সমস্যা হলে, ওনাকে ডাক দিয়েন।
বশির স্যার মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, আরে তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তো আছিই।
মৃন্ময়ও শুকনো হাসি দিয়ে সে হাসির সাথে তাল মিলালো।
রাসেল এসে বলল, ভাইজান আপনাকে যাইতে বলল। ভ্যান রেডি।
মৃন্ময় স্নেহার হাত ধরে আবার বলল, দ্রুত চলে আসব।
স্নেহার চোখ কেন যেন ভিজে আসছে। ভিজে আসার কোন কারণ নেই। তবুও আসছে। মৃন্ময় বেশি দূর যাচ্ছে না, তবুও। মৃন্ময় বেরিয়ে যাবে, তখনই স্নেহা পিছন থেকে ডাক দিল, মৃন্ময় ।
মৃন্ময় হাসি মুখে এসে বলল, কিছু বলবে?
স্নেহা একটু আশেপাশে তাকাল। মৃন্ময়ের একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল, একটু এদিকে আসো না।
মৃন্ময় স্নেহার সাথে সবার থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
- কী হয়েছে?
স্নেহা একটু ইতস্তত করে বলল, বাড়ির আশেপাশে কি রাসেল লোকটা থাকবেন?
- হ্যাঁ, কোন সমস্যা হলে ওনাকে ডাক দিও।
স্নেহা একটু মাথা নিচু করে বলল, ওনাকে না বলে দাও বাড়ির আশেপাশে থাকতে।
- কেন?
- আমার ঐ লোকটাকে পছন্দ না।
- কেন কী হয়েছে?
স্নেহা নিচের ঠোঁটে একটা কামড় দিয়ে বলল, আমি কাল রাতে আতরের ঘ্রাণ পেয়েছি। ঐ লোকটা যে আতর দেন, সেই আতরের ঘ্রাণ।
মৃন্ময় অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ স্নেহার দিকে। চোখের পলক না ফেলে শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল কিছুটা সময়। স্নেহা মাথা নিচু করা অবস্থায়ই বলল, আমি সত্যি কাল আতরের ঘ্রাণটা পেয়েছি। তুমি তাকে না করে দাও না।
মৃন্ময় বুঝতে পারছে না কথাটা বিশ্বাস করা উচিৎ কিনা। রাসেল লোকটা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন এক দৃষ্টিতে স্নেহা আর মৃন্ময়ের দিকে। এতো দূর থেকে শোনা যাচ্ছে না কথা সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তবুও চোখের ভাষা দেখে মনে হচ্ছে, বুঝে নিচ্ছেন অনেক কিছু। মৃন্ময় আস্তে করে স্নেহার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছা। মানা করে দিব।
মৃন্ময় বের হয়ে আসল বাড়িটা থেকে। আসার পথে বেশ সূক্ষ্ম চোখে দেখছিল রাসেলকে। রাসেল তাকাচ্ছিল না মৃন্ময়ের দিকে। নাক টেনে ঘ্রাণটা নেবার চেষ্টা করছে। আসলেই একটা ঘ্রাণ আসছে, বেশ পরিচিত একটা ঘ্রাণ।
একটা খোলা ভ্যান এসেছে। সে ভ্যানে পা ঝুলিয়ে দিব্বি চলে যাওয়া যাবে। ভ্যানে চড়ে মৃন্ময় এনায়েত চাচাকে ডেকে বলল, চাচা আর একটা উপকার করতে পারবেন?
- বল বাবা।
এনায়েত চাচার দিকে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একটা লোক আজ স্টেশনে রাখতে পারবেন? আমার এক আত্মীয় আসবে। স্নেহার বোন। স্নেহার মতই চেহারা। আসলে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে আসবে।
এনায়েত চাচা হাত ধরে মৃন্ময়ের টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, অবশ্যই রাখব। তুমি এজন্য টাকা দিচ্ছ কেন? বলেছি না তুমি মেহমান। নামটা বলে যাও, ঠিক মত নিয়ে আসবে বাড়িতে।
মৃন্ময় হাসি মুখে বলল, স্নিগ্ধা।
- আচ্ছা তুমি ফি আমানিল্লাহ বলে রওয়ানা দাও। এদিকে দেখছি আমি।
এনায়েত চাচা মৃন্ময়ের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, কোন সমস্যা হইলে এইটায় ফোন দিও। বাজারের আড়তের নাম্বার।
- ঠিক আছে চাচা।
ভ্যান চলতে লাগল। ভ্যানে মৃন্ময় এই প্রথম কোথাও যাতায়াত করছে। খারাপ লাগছে না। বরং বেশ ভালই লাগছে। আকাশে মেঘ জমেছে, কয়েক দিন থেকেই বৃষ্টি হবে হবে করছে। আজ বোধ হয় বৃষ্টি নেমেই যাবে। সাথে করে একটা ছাতা নিয়ে আসা জরুরী ছিল। বড় কাজে দিত। বলা যায় না, কখন এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। বৃষ্টি তো আর মানুষের ইচ্ছায় হয় না। মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই। কথাটা ভুল। মানুষ অনেক কিছুই পারে না। ইচ্ছা করলেই বৃষ্টি নামাতে পারে না, জ্যোৎস্না নামাতে পারে না, পারে না চাইলেই অনেক কিছু। সে অনেক কিছুর কিছু বাস্তব, কিছু অলীক।
সত্যি সত্যিই কিছুদূর যেতেই বৃষ্টি নামল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি না, ঝুম বৃষ্টি। শরীর ভিজে চুপচুপা এক নিমিষেই। তবুও ভ্যান থামছে না। চলেই যাচ্ছে। মৃন্ময় এতদূর পথে একটা কথাও বলে নি চালকের সাথে। বলেনি চালকও। মৃন্ময় এবার পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, ভাই আপনার কাছে পলিথিন হবে একটা? মোবাইলটা ভিজে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে।
লোকটা কোন উত্তর দিল না। ভ্যানটা থামিয়ে রাস্তার পাশে নিয়ে গেল। প্রকাণ্ড এক বট গাছ বাঁধাই করা পাশেই। লোকটা সে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। বেশ গম্ভীর গলায় বলল, এদিকে আইসা দাঁড়ান।
মৃন্ময়ও গিয়ে দাঁড়াল গাছটার নিচে। লোকটা কোমরের কাছের লুঙ্গির ভাঁজ থেকে একটা পলিথিন মৃন্ময়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, লন, মোবাইল রাখেন।
মৃন্ময় হাত বাড়িয়ে সে পলিথিন নিয়ে মোবাইলটা রেখে দিল সেখানে। স্নিগ্ধা মেসেজ করেছে। আসছে দুপুরের ট্রেনে। এই বৃষ্টির মধ্যে মেসেজের উত্তর লিখতে পারবে না, বট গাছের নিচে পানি কম পড়ছে বাহিরের দিকের চেয়ে, তবুও টুপ টুপ করে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর বৃষ্টির পানি। পকেটে রেখে দিল মৃন্ময় মোবাইলটা। পলিথিনে ঢুকিয়ে রাখল আরও দুইটা কাগজ, একটা এনায়েত চাচার দেয়া মোবাইল নাম্বার, অন্যটা মায়ের দেয়া একটা কাগজ। সে কাগজে লেখা, "মৃত্যুটা রহস্য জনক।"
মৃন্ময় সে কাগজের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মায়ের দেয়া কাগজটা কত যত্ন করে রেখে দিচ্ছে মৃন্ময়। মায়ের ধারণা, এই কাগজেই নাকি বাবাকে কে মেরেছে তাকে পাওয়া যাবে।
মৃন্ময়ের মনের মাঝেও কি এই ধারণা ঝেঁকে বসে আছে? নয়ত এই কাগজ নিজের কাছে জমিয়ে রাখার, যত্নে রাখার মত কিছু হয় নি, কিন্তু রাখছে ঠিক মৃন্ময়।
- বৃষ্টি মনে চায় থামবে না। আমাগো যাইতে হবে ম্যালা দূর। বৃষ্টিতে ভিজলে কি আপনার ঠাণ্ডা লাগবে?
আসলেই যেতে হবে অনেক দূর, আবার ফিরে আসতে হবে সন্ধ্যার আগে। এভাবে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। মৃন্ময় বলল, চলেন। ঠাণ্ডা লাগবে না।
মৃন্ময় আবার পা ঝুলিয়ে বসে গেল। চারপাশ অন্ধকার। একটু পর পর বিজলী চমকাচ্ছে, আর কিছু পরেই শোনা যাচ্ছে বজ্রপাতের শব্দ। আলো কত অদ্ভুত একটা জিনিস। আলোর চেয়ে দ্রুত পৃথিবীতে কোন জিনিস নেই। এর চেয়ে দ্রুত কিছু তৈরি করাও অসম্ভব। বৃষ্টি এক নাগাড়ে পড়েই যাচ্ছে। মৃন্ময়ের মনের মাঝে কেমন যেন একটা শূন্য ভাব এনে দিচ্ছে এ বৃষ্টি। চোখে মুখে পড়ে কেমন যেন হাহাকারের সুর হয়ে বেজে যাচ্ছে কানে। হুট করেই ভ্যানটা ব্রেক কষল।
বৃষ্টি হচ্ছে ক্লান্তিপুরেও। স্নেহার খুব ইচ্ছে করছে সে বৃষ্টিতে ভিজতে। বৃষ্টি মানুষের মাঝে নানা পরিবর্তন আনে। বৃষ্টি কারও মনে নিয়ে আসে খুব পবিত্র কোন চিন্তা, বাচ্চা সুলভ কোন বাসনা। কারও মনে খুব বিচ্ছিরী কোন কামনা।ইচ্ছা করলেও ভেজা হবে না স্নেহার। রান্না চুলায়। দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। খাবার এখনও কিছুই রান্না হয় নি। মৃন্ময় চলে যাবার পর থেকে নৃর মাঝে পাগালামি বড় বেড়েছে। যা পাচ্ছে সামনে তাই মুখে দিচ্ছে। মৃন্ময় চলে যাবার পরেই নৃ চলে যায় ঘরে। স্নেহা পিছন পিছন আসে। তবু ঘরে ঢুঁকে খুঁজে পায় না। এতো দ্রুত কোথায় গেল? ডাকে স্নেহা, নৃ, কোথায় তুমি মা?
জানে সে ডাকের উত্তর দিবে না নৃ। তবুও ডাকে। ঘর থেকে সাড়া নেই কোন। স্নেহা খুঁজে বারান্দায়। সেখানেও নেই। পাশের ঘরটায়, ওখানেও নেই। হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে স্নেহা। আসছে যে ঘরটায় থাকে ও ঘরটা থেকেই। স্নেহা ঘরে ঢুকতেই সে হাসির শব্দ নেই। পুরো ঘরে আবার খুঁজে স্নেহা। নেই। অবশেষে তাকায় খাটের নিচে। নৃ সেখানেই বসে আছে। বসে বসে খাটের নিচ থেকে ময়লা তুলে তুলে মুখে নিচ্ছে। কি বিচ্ছিরী অবস্থা। স্নেহা টেনে বের করতে চায় নৃকে। নৃ জেদ করে, বের হয় না। অবশেষে বশির স্যার কে ডাকতে হয়। স্যার এসে বুঝিয়ে বের করে নিয়ে আসেন। বশির স্যারের কাছ থেকে দৌড়ে নিচতলায় নেমে তার ঘরে ঢুঁকে যায়। বশির স্যার, স্নেহা দুজনেই ছুটে আসে। নৃ বশির স্যারের ঘরে গিয়েই রঙ, তুলির রঙ খাওয়া শুরু করে দেয়। বশির স্যার ওসব রাখতে বলেন, রাখেনা নৃ। শুনে না বশির স্যারের কথা। আবার মুখে রঙ দেয়। এসব খাবার কোন জিনিস না, নৃ কেন যেন বুঝতে চায় না। বশির স্যার কোন মতে নৃর কাছ থেকে রঙ নিয়ে নেন। নিয়ে কোলে তুলে খাবার টেবিলের কাছে নিয়ে আসেন। পানি দিয়ে বলেন মুখ কুলি করতে। নৃ তাও করে না। করবে না নৃ। এরপর থেকে বশির স্যারের কোলেই আছে। এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি ঘুরছে বাড়ির মধ্যেই। আর এটা ওটা টান দিয়ে মুখের মধ্যে দিচ্ছে। এসব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল রান্না করতে। এত কিছুর মাঝেই কী করে মনের মাঝে বৃষ্টি ভেজার কথা আসল, বুঝল না স্নেহা। মানুষের মনের এতো অলিগলি। এক গলিতে দুঃখ থাকলে, অন্য গলিতে দেখা যায় সুখের উৎসব। তবুও সে অলিগলির কোন গলির গুরুত্ব বেশি, কোনটার কম বুঝতে পারে না মানুষ।
ভ্যানটা থেমেছিল যেখানে, ওখানে থামার কথা না। ভ্যান চালকের প্রস্রাব ধরেছে খুব। বৃষ্টির মধ্যে এক পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে গেল প্রস্রাব করতে। এখানটা বড় নীরব। অন্যসব জায়গার চেয়ে একটু বেশিই নীরব। গা ছমছমে একটা ভাব আছে এই দিনের বেলাতেও। অবশ্য আকাশের যে অবস্থা, দিনের বেলাতেও রাতের মত লাগছে। কেমন অন্ধকার একটা ভাব। একপাশে অনেক গভীর একটা জঙ্গল। আর অন্যপাশে খোলা মাঠ, সে মাঠের কোণায় একটা পুকুর। একা একা এমন জায়গায় হাঁটলে বুকের ভিতর ধক ধক করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। ভ্যান চালক প্রস্রাব সেরে উঠে দাঁড়িয়েই গান ধরল, আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইও না গো স্বজনী।
গানটার দুই লাইন বার তিনেক গেয়ে আবার ভ্যানের কাছে এসে চালাতে লাগল ভ্যানটা। মৃন্ময় পিছন থেকে জানতে চাইল, আর কতক্ষণ লাগবে ভাই?
- অর্ধেক আইছি। আরও বাকি অর্ধেক।
- ও।
আর কোন কথা হল না। বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেজা কাপড়ে ঠাণ্ডা লাগছে একটু একটু মৃন্ময়ের। কাল রাতেই কত গরম লাগল, আর এখন ঠাণ্ডা। প্রকৃতির কী আজব নিয়ম। আকাশে যেমন মেঘ গুমোট বেঁধে আছে, মনে হয় আবার নামবে বৃষ্টি। পথ এখনও অনেক বাকি। কাজ শেষ করে দ্রুত বাড়িতে যেতে হবে। স্নেহা বড় ভয় পাবে একা।
৮
রাদিব স্নিগ্ধার মেডিকেল কলেজেই পড়ত। দুই বছরের সিনিয়র। বেশ চুপচাপ রকম ছেলেটার গল্প প্রায়ই করতেন একজন টিচার। রেহমান স্যার। ভাল ছাত্র না হলে মেডিকেলে চান্স পায় না কেউ এটাই স্বাভাবিক। সে ভাল ছাত্র গুলোর মাঝে কেউ কেউ খুব ভাল ফলাফল করে, কেউ কেউ জঘন্য মেডিকেল কলেজে এসে। রাদিব খুব ভাল ফলাফল করা ছাত্র ছিল না। তবুও রেহমান স্যার বলতেন, রাদিবের মত হও।
ব্যাপারটায় কোন রহস্য নেই। রাদিব জানত, অনেক কিছু জানত। একটা ডিগ্রিধারী ডাক্তারের চেয়েও বেশি জানত। এটাও রেহমান স্যারের কথা। একটা ডাক্তারের এমবিবিএস পাশের পর, একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে হতে হয় বিশেষজ্ঞ। কিন্তু রাদিব সেই ছাত্র অবস্থা থেকেই, সব রোগের ব্যাপারেই বিশেষজ্ঞ। রাদিবের মত এতো সহজ করে ভাবতে সবাই পারে না। কলেজ থেকে বলে দেয়া বই কী পরিমাণ পড়ত বা মুখস্থ করত সেটা ব্যাপার না। ব্যাপারটা হল, সব কিছু সম্পর্কে জানাটা অবাক করা। রেহমান স্যার হয়ত একটু বাড়িয়েই বলতেন, বা সবটাই সত্যি। রাদিবের ব্যাপারে গল্প শুনতে শুনতে স্নিগ্ধার একদিন মনে হল, পরিচিত হলে কেমন হয়?
রাদিবের সাথে পরিচয়টা হুট করেই। নানা বিষয়ে নানা সময়ে নানা কিছু জিজ্ঞেস করত রাদিবের কাছে। রাদিব বেশ গম্ভীর গলায় বলত, আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? আমি এতো পড়াশুনা করি না।
তবু স্নিগ্ধা ঘুরে ফিরে বার বার রাদিবের কাছেই যেত। বানিয়ে বানিয়ে নানা জনের নানা সমস্যা বলত।
- জানেন ভাইয়া আমার পাশের বাসার এক মহিলার উপর ভূতের আঁচড় আছে।
- ডাক্তার হয়ে ভূত ভূত করছ?
- আরে হ্যাঁ ভাইয়া। মহিলার উপর ভূতের আঁচড় পড়লেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়, এতো শক্তি শরীরে চলে আসে, টেনেও সে হাত পা সোজা করা যায় না। এক ওঝা নিয়ে আসা হয়েছিল। আপনি শুনেছেন না, ভূতে আগুন ভয় পায়? এই মহিলার সামনেও আগুন ধরলে সেই চিৎকার করে উঠে। এই মহিলার উপর মাঝে মাঝেই গোসল খানায়ও ভূতের আঁচড় পড়ে।
- উদ্ভট কথা বলছ কেন? ঐ মহিলার এপিলেপসি রোগ আছে, মানে মৃগী রুগী, খিঁচুনিও বলতে পারো। তাই শরীর শক্ত হয়ে যায়, আগুন পানি দেখলে ভয় পান। খিঁচুনির চিকিৎসা নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধা। নানা কথা বলতে বলতে একটা সময় বুঝতে পারে রাদিবের প্রতি ভালবাসার একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে, কিংবা তৈরি হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। সরাসরিই একদিন বলে দেয়া স্নিগ্ধা রাদিবকে ভালবাসার কথা। রাদিব স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলে, ভূতুড়ে জিনিস বলে পৃথিবীতে কিছু থাকলে সেটা হল, কাছাকাছি বয়সের একটা ছেলে একটা মেয়ের বা একটা মেয়ে একটা ছেলের প্রেমে পড়া। এই জিনিসের কোন অস্তিত্ব নাই, স্থায়িত্ব নাই। এই আছে, এই অদৃশ্য। যাও পড়াশুনা কর ভাল করে। মাঝে মাঝে সমস্যার কথা বল, সেই সম্পর্কটাই ভাল।
স্নিগ্ধার দারুণ অপমানিত হবার কথা, হয় নি স্নিগ্ধা। কেন যেন কষ্টও পায় নি। কিন্তু রাদিবের সাথে যোগাযোগ একটু কম করা শুরু করল। রাদিব পাশ করে বের হয়ে যাবার পর থেকে সাক্ষাতও হয় না। অনেক দিন পর পর ফোনে করে স্নিগ্ধা, তাও ব্যস্ত। এখানে যায়, ওখানে যায়। একদিন শোনা গেল দিনাজপুর, অন্যদিন কক্সবাজার, অন্য দিন কি একটা জায়গার নাম বলবে যে জায়গার নাম জীবনেও শুনে নি স্নিগ্ধা। যেন বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হয়েছে। মহা ব্যস্ত মানুষ। এই মহা ব্যস্ত মানুষটা যে, ক্লান্তিপুর আসার ব্যাপারে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে ভাবতে পারে নি স্নিগ্ধা। ট্রেনে উঠেই কল করে রাদিবকে। এতদিন পর কথা, কিছু কুশলাদির পর স্নিগ্ধা বলে, আপনাকে যদি একটা জায়গায় আসতে বলি, আসবেন?
- কোথায়?
- ক্লান্তিপুর।
-এটা কোথায়?
- আমি ঠিকানা বলব, আপনি আসবেন।
- কেন?
- আপনি আমি দুজন মিলে সংসার করব। বাচ্চা কাচ্চা ফুটাব।
- উদ্ভট কথা বলছ আবার।
- হিহি এমনি বললাম। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি, আপনার একটু সাহায্য করতে হবে।
- কী সমস্যা? আর আমি কী করে সাহায্য করব?
- আপনি পারবেন। আমার বোনের মেয়েটা মারাত্মক অসুস্থ। ওর ভিতর নানা রকম সমস্যা আছে। আপনাকে দরকার।
- তুমি নিজেই একজন ডাক্তার।
- আমি এখনও পুরোপুরি হই নি। আর আমি বই মুখস্থ করা ডাক্তার। নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেবার মত কিছু না।
- আচ্ছা আসব, আমাকে ঠিকানাটা মেসেজ করে দিও। কীভাবে যাব জানাইও।
বলেই কেটে দেয় রাদিব। ট্রেন চলছে, ট্রেনের জানালা খুলে সেখান দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাস ধরতে চাচ্ছে স্নিগ্ধা। বাতাস ধরা যায় না, শুধু ছোঁয়া যায়। ছুঁয়ে দেখা আর ধরে রাখার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। সব মানুষও সবাইকে ধরে রাখতে পারে না। শুধু সময়ের হিসাবে কখনও আলতো করে ছুঁয়ে দেখতে পারে।
সোহরাব উদ্দিন বেশ অতিথি সুলভ মানুষ। মৃন্ময়ের সাথে প্রথম থেকেই বেশ হাসি খুশি হয়ে কথা বলছেন, বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছেন। এখানে আসতেই বিকাল হয়ে গেল। ফিরে যেতে নিশ্চিত রাত। সোহরাব সাহেব মৃন্ময়ের জন্য বিশাল আয়োজন করেছেন খানা পিনার। তিনি আসার পর থেকে কমপক্ষে দশ বার বলেছেন, আপনি কিন্তু আজ থেকে যাবেন রাতে।
প্রতিবারই মৃন্ময় বলেছে, না না আমার দ্রুত ফিরে যেতে হবে। আমরা বাড়িটার ব্যাপারে কথা বলতে বসি চলেন।
সোহরাব উদ্দিন বাড়ির ব্যাপারে কোন কথাই বললেন না, তিনি বার বার এড়িয়ে গিয়ে বলছেন, এই ব্যাপারে আমরা রাতে কথা বললেই পারব। আপনি খাওয়া দাওয়া করেন, বিশ্রাম নেন।
কিন্তু মৃন্ময় কোনভাবেই রাজী নয়। ও দ্রুত কাজ শেষ করে চলে যেতে পারলেই বাঁচে। মৃন্ময়ের জোরাজুরিতে সোহরাব উদ্দিন বাধ্য হলেন বাড়ির ব্যাপারে কথায় বসতে। বাড়ির দাম ঠিক করলেন। মৃন্ময়কে বললেন, আপনি যা বলবেন তাই পাবেন।
- এটা তো পুরনো বাড়ি। আমি যা চাব তাই দিবেন কেন?
- আমার বাড়িটা দরকার তাই। সেটা যত দামই হোক।
- কী দরকার?
- বাড়িটা পছন্দ হয়েছে তাই।
মৃন্ময় হাসল একটু। বাড়ির দাম ঠিকঠাক হলে, সোহরাব উদ্দিন বলেন, দাম তাহলে ওটাই। আমি টাকা পয়সা ঠিক করে দু তিনের মধ্যে চলে যাব আপনার ওখানে। আমি এদিকে কাগজ পাতিও ঠিক করে রাখব। আপনার কাছ থেকে সেদিন শুধু সাইন নিয়ে নিলেই হবে।
- আচ্ছা। আপনি ব্যবস্থা করেন। আমার দ্রুত যেতে হবে। একটা কাজ আছে জরুরী বাসায়।
মৃন্ময়ের কেন যেন বড় অস্থির লাগছে। মনের ভিতর খচখচ করছে। এ অস্থিরতা কেন বুঝতে পারছে না। সোহরাব উদ্দিন অনেক করে থাকার কথা বলার পরও চলে আসল মৃন্ময়। ভ্যানে উঠে বসল। বসেই বলল, ভাই ভ্যান চালান।
ভ্যান চালক চুপচাপ একটু দাঁড়িয়ে রইল। মৃন্ময় তার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বলবেন?
- জ্বে ভাই।
- বলেন।
- আপনার মোবাইলে কি ট্যাকা আছে? একজনের সাথে কথা কইতাম।
- হ্যাঁ আছে। কার সাথে কথা বলবেন?
- না মানে, একটা মেয়ের সাথে। দুই মিনিট কইলেই হবে। অনেক দিন কই না। মাইয়ার ফোন আছে, আমার নাই। তাই মাঝে মাঝে বাজার থিকা দেই। কিন্তু ট্যাকা যায় অনেক।
মৃন্ময় মোবাইলটা এগিয়ে দিল লোকটার দিকে। মোবাইলটা নিয়ে লুঙ্গীর গিটের কাছ থেকে একটা কাগজ বের করে নাম্বার তুলে কথা বলল একটু দূরে গিয়ে। একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার স্যাপার আছে। লোকটার কথা বলা দুই মিনিট হবার আগেই শেষ হয়ে গেল। হাসি মুখে এসে ফিরিয়ে দিল মোবাইলটা। ফিরিয়ে দিয়েই ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দিয়ে চালাতে শুরু করল ভ্যান। আসার বেলায় যেমন দ্রুত আসল, যাবার বেলা তেমন দ্রুত চালাচ্ছে না। বেশ ধীরে সুস্থে। যেন খুব সময় নিয়ে যেতে চাচ্ছে। আকাশে মেঘের কারণে দেখা যাচ্ছে না, সূর্য ঠিক কোথায় আছে। তবে ডুবি ডুবি করছে তা সময় দেখেই বলে দেয়া যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। যাওয়া দরকার দ্রুত। অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ের। একবার বলল মৃন্ময়, ভাই একটু দ্রুত চালান, যেভাবে চালাচ্ছেন ফিরতে সারারাত পার হয়ে যাবে।
ভ্যান চালক কিছু বলল না। চুপচাপ আগের মত চালাতে লাগল। আবার বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। মৃন্ময় এমন কখনই দেখেনি। এমন বৃষ্টি হয় আষাঢ় শ্রাবণ মাসে। সারাদিন রাত টুপটাপ টুপটাপ ঝরতে থাকে। বছরের প্রথম বৃষ্টি সারাদিন ধরে হয় না। একবার একটু হয়েই তারপর রোদ কিংবা পরিষ্কার আকাশ। কিছুদূর যেতেই অন্ধকার হয়ে গেল সব। দেখা যাচ্ছে না কিছু। তার মধ্যেই ভ্যান চালক চালিয়ে যাচ্ছে। কি করে চালাচ্ছে কে জানে? মৃন্ময় মোবাইলের লাইট ধরল যেন সামনে দেখা যায় সব স্পষ্ট। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। ভ্যানটা হুট করেই থেমে গেল। মৃন্ময় চারদিকে লাইট ধরল। সে জায়গাটাই, যে জায়গাটায় আসার সময়ও থেমেছিল। একপাশে বন, অন্যপাশে খোলা মাঠ। এখন আরও বেশি গা ছমছমে লাগছে। ভ্যাণ চালক আবার নেমে গেল। মৃন্ময় লাইট ধরল সেদিকে। সোজা নেমে চলে গেল পুকুর পাড়ে। আবার বসেছে প্রস্রাব করতে। মৃন্ময়ের কেন যেন ভয় কাজ করছে ভিতরে। মৃন্ময় এতো ভয় পাওয়া মানুষ না, তবুও। ভয়টা কীসের? জানে না মৃন্ময়। লোকটা প্রস্রাব করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার একই গান ধরল, আমি কূলহারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইও না গো স্বজনী।
মৃন্ময় যেন একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখছে। একটা দৃশ্য হালকা আলোতে, অন্যটা অন্ধকারে। কিন্তু মনে হল এ দৃশ্যে আরও কিছু ব্যতিক্রম আছে। ঠিক পিছনে মৃন্ময়ের, মনে হল কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মৃন্ময় লাইট সেদিকে ধরতেই চমকে উঠল। কিছু বুঝে উঠবার আগেই, কেউ একজন মৃন্ময়ের হাতে বেশ জোরে আঘাত করল। মোবাইলটা দূরে ছিটকে পড়ে গেল। চারপাশ একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে কাদার উপর পড়ে জ্বলছে মোবাইলের লাইট। মৃন্ময়ের ভয় করছে খুব। ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল মৃন্ময়। নামতেই সেই কেউ একজন ভ্যানের উপর সজোরে কিছু দিয়ে আঘাত করল। মৃন্ময়ের সরে যাওয়াটা টের পায়নি হয়ত সে, ভ্যানের উপর থাকলেই ঠিক মাথার মাঝ বরাবর আঘাতটা পড়ত। একটু একটু যা দেখা যাচ্ছে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা এগিয়ে আসছে মৃন্ময়ের দিকে। হাতে করে কিছু একটা নিয়ে। মৃন্ময় এই অন্ধকারে কোথায় পালাবে? কোথায় দৌড়ে যাবে? তবু এলোমেলো হয়ে এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগল। খোলা মাঠ ধরে। পুকুরের পাশ দিয়ে। পুকুর পাড়ে কি এখনও ভ্যান চালকটা আছে? নাকি চলে গেছে? নাকি ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে? সারাদিনের বৃষ্টিতে মাঠে অনেক কাদা জমে আছে। দৌড়াতে গিয়ে সে কাদায় পা আটকে যাচ্ছে। কিছু একটার সাথে পা বেধে পড়ে গেল মৃন্ময়। লোকটা একটু পিছনেই। অন্ধকারে আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে মৃন্ময়ের দিকে আসছে। মৃন্ময় চিৎকার করতে চাচ্ছে। কিন্তু এখানে চিৎকার করাও বৃথা, আশেপাশে কেউ নেই। থাকবার কথাও না। মৃন্ময়ের চিৎকারের আগেই কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, আআআআ বলে। লোকটা ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে, যে লোকটা আসছিল মৃন্ময়ের পিছন পিছন। লোকটা অবিরাম চিৎকার করে যাচ্ছে। মৃন্ময় চশমা দিয়েও স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তবু বুঝতে পারছে, কেউ একজন লোকটাকে পিছন থেকে আঘাত করে ফেলে দিয়ে, একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে। খানিক পরে লোকটার চিৎকার আর শোনা গেল না। এখন অন্য একটা আবছায়া এগিয়ে আসছে এদিকে। কিছুটা দূর এসে আবার ফিরে যাচ্ছে। মৃন্ময় ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল। সামনে এগিয়ে গেল, দূরে সরে যাচ্ছে আবছায়ার মানুষটা। পুকুর পাড়ে গিয়ে থামল একবার। মৃন্ময় দাঁড়ান একটু দূরেই। একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারে, পুকুর পাড়েই লুকিয়ে ছিল ভ্যান চালক। তাকে তুলে মৃন্ময়ের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে লোকটা চলে গেল। ভ্যান চালক মৃন্ময়ের দিকে এসে বলল, চলেন তাড়াতাড়ি।
যে লোকটা বাঁচাল মৃন্ময়কে, সে চলে গেল আস্তে আস্তে, ঢুঁকে গেল রাস্তার পাশের জঙ্গলটার ভিতরে। মৃন্ময় কিছুটা সময় নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু ভাববার সময় পেল না। অনুভূতি শূন্য হয়ে হাঁটতে লাগল ভ্যান চালকটার সাথে। কাদা থেকে মোবাইলটা তুলে পা ঝুলিয়ে বসল ভ্যানে। কত দ্রুত কী সব ঘটে গেল। মাঠের মাঝে পড়ে আছে অপরিচিত এক মানুষের অসাড় দেহ, যে অকারণেই এসে আঘাত করেছিল মৃন্ময়কে। আবার কেউ একজন এসে উদ্ধারও করল সেখান থেকে। সেই কেউ একজন কোথায় যেন চলে গেল। তবে মৃন্ময় একটা ঘ্রাণ পেয়েছে, সে ঘ্রাণটা বড় পরিচিত। একই ঘ্রাণ আগেও পেয়েছে অনেক বার।
ভ্যান চালক ভ্যানটা চালাতে শুরু করল, এবার বেশ দ্রুত। মৃন্ময়ের সাথে কোন কথা বলছে না। যেন খুব স্বাভাবিক সব, কিছুই হয় নি এতোটা সময়। মৃন্ময়ও কিছু বলতে চাচ্ছে না। শুধু একবার জানতে চাইল, ভাই, লোকটা কে ছিল যে আপনাকে পুকুর পাড় থেকে তুলে আনল?
ভ্যান চালক বেশ গম্ভীর ভাবে বলল, জানি না। শুধু বলল তাড়াতাড়ি ভ্যান নিয়ে চলে যা।
-ওওও।
মৃন্ময় বুঝতে চাচ্ছে, কিংবা কিছুটা বুঝতে পারছে, অথবা সবটাই ঘোলাটে। মোবাইলের লাইটটা ধরে এনায়েত চাচার নাম্বারটা বের করে কল করল মৃন্ময়। একটু সময় রিং হবার পরেই ধরল কেউ একজন। এনায়েত চাচাকে চাইতেই বলল, মহাজন মাত্র বাড়িতে গেল।
মৃন্ময় একটু চুপ থেকে আবার জানতে চাইল, রাসেল আছে?
- রাসেল কে?
- কেউ না।
বলে রেখে দিল মৃন্ময়। মাথার ভিতর জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আবার বৃষ্টি শুরু হল, মোবাইলটা ঢুকিয়ে রাখল মৃন্ময়। পলিথিনের মধ্যে। রাত কত এখন? মোবাইল বের করে সময় দেখতে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টির জল চোখে মুখে পড়ছে, পড়ছে চশমার উপর। অন্ধকারে চালিয়ে যাচ্ছে ভ্যান চালকটা। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না মৃন্ময়।
মৃন্ময়ের আসার কথা সন্ধ্যার একটু পরেই। এখনও আসল না। নৃ আজ সারাদিন বড় জ্বালিয়েছে। এটা খায়, ওটা খায়, কি যে অবস্থা। দৌড়ে গিয়ে কোথাও একা একা কথা বলে। বশির স্যার সামলে নিয়েছেন সব। এই লোকটা না থাকলে সত্যি বড় বিপদে পড়তে হত মেয়েটাকে নিয়ে। বশির স্যার খাইয়ে দিলেন ভাত। খেয়েই ঘুমিয়ে গেল নৃ। আজ বড় দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমাচ্ছে বশির স্যারের ঘরেই। আবার বৃষ্টি নেমেছে। হিম হিম একটা বাতাস বইছে। স্নেহা বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টির ফোঁটা মুখে মাখছে। শরীরটা জুরিয়ে যাচ্ছে। দুপুরের সে ইচ্ছেটা মনের ভিতর থেকে যায় নি এখনও। খুব ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। বৃষ্টির মাঝে কী যেন একটা আছে, কাউকে কাছে ডাকলে একবার কখনই না করা যায় না। স্নেহাও না করতে পারল না। এই বাড়ির ছাদে কখনও যাওয়া হয় নি আসার পর থেকে। ছাদে ওঠার জন্য একটা লোহার মই দেয়া আছে, বারান্দার ঠিক পাশেই। ইচ্ছা করলেই সে মই বেয়ে উপরে চলে যাওয়া যায়। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, ক্রমাগত বাড়ছে। ওড়নাটা রেখে চেয়ারের উপর, স্নেহা পা রাখল মই এ। বেয়ে বেয়ে উঠে গেল ছাদে। বিশাল ছাদ। পাশে রেলিং দেয়া অনেক উঁচু। ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়াল। শরীরে পড়ছে একের পর এক বৃষ্টির ফোঁটা। আয়োজন করে ভেজার কিছু নিয়ম আছে। হাত দু দিকে মেলে স্নেহা তাকাল আকাশের দিকে। এটা ভেজার একটা নিয়ম। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা কাপড় লেপ্টে যাচ্ছে স্নেহার পুরো শরীরের সাথে। মৃন্ময় এখন পাশে থাকলে ভাল হত, খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরত। বুকের সাথে মিশিয়ে রাখত। ভাল লাগছে খুব স্নেহার। মনে হচ্ছে বৃষ্টির সাথে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে হৃদয়ের মধ্যের সব দুঃখ গুলো, কষ্ট গুলো, চিন্তা আর বেদনা গুলো। স্নেহা বাচ্চা মেয়ের মত লাফাতে লাগল বৃষ্টির মধ্যে। সত্যি অনেক দিন পর ভেজা। বৃষ্টির ফোঁটার পতনের শব্দ আসছে কানে। এ শব্দটা মন বড় উদাস করে দেয়। শব্দ কানে আসল মনে হল আরও একটা। এ শব্দ বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ নয়। কারও কাশির শব্দ। পুরুষালী গলার কাশির শব্দ। স্নেহা ছাদের চারপাশে তাকাল। ছাদে কেউ নেই। মইয়ের দিকটা থেকে আবার একটা শব্দ ভেসে আসল। মনে হল কেউ নেমে যাচ্ছে মই বেয়ে। স্নেহা দৌড়ে মইয়ের কাছে গেল। মইয়ের কাছে কেউ নেই। স্নেহার মনের মাঝে ভয় ভালভাবে ঢুঁকে গেছে। যখন তখন অদ্ভুত শব্দ শুনে। আজ স্নেহা বাড়ির প্রধান দরজা লাগিয়েই রেখেছে ভাল করে সন্ধ্যা বেলা। কেউ ইচ্ছা করলেই বাইরে থেকে ভিতরে আসতে পারবে না। বৃষ্টিতে ভিজতে আর মন চাচ্ছে না। স্নেহা নেমে গেল ছাদ থেকে মই বেয়ে। ওড়নাটা চেয়ার থেকে নিচে পড়ে আছে। বাতাসে পড়ে গিয়েছে মনে হয়। ওড়নাটা নিয়ে ঘরে চলে গেল স্নেহা। যাবার সময় নিচ তলায় বশির স্যারের ঘরের দিকে তাকাল। ভিতর থেকে আটকে দেয়া। নিশ্চয়ই ছবি আঁকছেন। স্নেহা ঘরে ঢুঁকে দরজাটা একটু চাপিয়ে আলনা থেকে কাপড় নামাল। ঘরটায় একটা লাইট জ্বলছে, আজকে ফ্যান চালাতে হচ্ছে না। তাছাড়া ফ্যানে চার্জ নেই। এনায়েত চাচা আজ এদিকে আসেন নি, ফ্যান বদলে দেবার জন্য লোকও পাঠান নি। বিছানার পাশে টেবিলের উপর পানির দুইটা কাঁচের গ্লাস আর কাঁচের জগ। স্নেহা সেই টেবিলের পাশে বিছানার উপর শুকনো কাপড় গুলো রাখল। নিজের ভেজা কাপড় একে একে সব খুলে ফেলল। শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিল শরীর। শুকনো কাপড় শরীরে পরবে পরবে ঠিক তখন ঠাস করে দরজাটা খুলে গেল। বশির স্যার। এতো দ্রুত সব কিছু ঘটল স্নেহা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, স্যার হুট করে এসে জড়িয়ে ধরল স্নেহাকে, কোন কথা না বলেই। স্নেহা কাপড় দিয়ে নিজের শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে আর বলছে, স্যার আপনি এসব কী করছেন? স্যার আমি স্নেহা।
- আমি জানি তুই স্নেহা। কী করছি দেখতেই পারছিস। এই সুযোগ আমি হাত ছাড়া করতে চাই না।
- স্যার প্লিজ ছাড়েন আমাকে। স্যার আমি স্নেহা আপনার ছাত্রী।
স্নেহার বিশ্বাস হচ্ছে না, বশির স্যার এসে স্নেহার সাথে এসব করছেন। স্নেহার কাপড়টা টান দিয়ে সরিয়ে দিলেন বশির স্যার। বশির স্যারের চোখে মুখে অন্য রকম ছাপ। স্নেহা শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে বশির স্যারকে সরাতে। স্যার আরও শক্তি দিয়ে শরীরের সাথে শরীর মিলাচ্ছন, শরীরের যে জায়গা গুলোতে অধিকার শুধু মৃন্ময়ের সে জায়গা গুলোতে হাত দিচ্ছেন, সে জায়গা গুলোতে অধিকার খাটাবার চেষ্টা করছেন। স্নেহা কেঁদে কেঁদে বলে ফেলল, স্যার আপনাকে আমি সম্মান করি, সত্যি অনেক সম্মান করি, প্লিজ স্যার এমন করবেন না।
বশির স্যার বেশ হিংস্র হয়ে আছেন, তিনি শুনবেন না স্নেহার কথা। স্নেহাকে বিছানার উপর ফেলে দিয়েছেন। নিজেও স্নেহার উপর। তিনি বলে যাচ্ছেন, আমার এতদিনের সাধনা, তাও তোকে বাগে আনতে পারিনি। আমি ঠিক পেরেছি, সাধনার সফলতা পেয়েছি তোর শাশুড়িকে দিয়ে, পেয়েছি তোর মেয়ে নৃকে দিয়ে। কিন্তু তুই আমাকে সম্মান করিস ঠিক আছে, কিন্তু অনেক করেও তোকে বাধ মানাতে পারি নি। আমি হারতে রাজী না। তোর চুল নিয়ে, নখ দিয়ে, কাপড়ের টুকরা দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি। তোর কিছু হয় নি। মাঝখান থেকে কষ্ট পেয়েছি আমি। তোকে দেখে দেখে সারাক্ষণ জ্বলে পুড়ে মরেছি। আমি হারব না, যা আমি সাধনায় পাই নি, তা জোর করে আদায় করব।
স্নেহা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মুখ চেপে ধরলেন বশির স্যার। পশুর মত কামড় বসিয়ে দিলেন বুকের উপর। আর্তনাদ করে উঠল স্নেহা। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, খুব বৃষ্টি। সত্যি বৃষ্টি কারও মনে নিয়ে আসে, খুব পবিত্র কোন চিন্তা, বাচ্চা সুলভ কোন বাসনা। কারও মনে খুব বিচ্ছিরী কোন কামনা। স্নেহা ছাড়িয়ে উঠবে, যেভাবেই হোক নিজের সম্ভ্রম এই পশুটার কাছ থেকে রক্ষা করবে। এবার ঠিক পারল স্নেহা, বশির স্যারকে ছিটকে সরিয়ে দিতে। দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হতে যাবে, বশির স্যার দরজাটা লাগিয়ে দিলেন তার আগেই। স্নেহা অসহায়ের মত করুণ চোখে তাকাল বশির স্যারের দিকে। কারও প্রতি বিশ্বাস হুট ভেঙে যাবার মত কষ্টের বিষয় পৃথিবীতে খুব কমই আছে। বশির স্যার তাকালেন হিংস্র কামনা নিয়ে। স্নেহা একবার তাকাল জানালার দিকে, আর একবার বিছানার পাশের টেবিলটার দিকে। নাকে একটা ঘ্রাণ আসছে। আতরের ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে ঘ্রাণটা ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বশির স্যার আর স্নেহার দিকে।
- - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার )
(পরবর্তী পর্ব আগামী কাল )
০৬ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:২৭
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: কাল পাবেন
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৭
সামিউল ইসলাম বাবু বলেছেন: অপেক্ষাই রইলাম