![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যুক্তি ও বিজ্ঞানই পারে মানুষ , রাষ্ট্র ও সমাজকে পরিবর্তন করতে
১
শ্রীনগরের আলেক সাঁই একবার একটি নৌকা বানালেন। সুন্দরবন হতে তাঁর এক ভক্ত একবার তিনখানা সুন্দরী কাঠ এনে গুরুকে দিয়েছিলেন ভক্তি-উপহার হিসেবে। সেই কাঠ দিয়েই তিনি বন্ধু-সহচর জাহান ফকিরকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাটি বানালেন।
নৌকাটি খুব বড় নয়। বেশি হলে তিন জনের ঠাঁই মেলে এতে। কিন্তু এ নৌকায় দু’জনের বেশি যাত্রী উঠেনি কখনো। এ দু’জনের একজন আলেক সাঁই নিজে আর অন্যজন জাহান ফকির।
আলেক সাঁই ও জাহান ফকির দু’জন পরস্পরের বন্ধু। শুধু বন্ধু বলিলে ভুল হবে, খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। একে ছাড়া অন্যে অচল। তাঁদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয়। তবে পারিবারিক আভিজাত্যের দিক থেকে তাঁদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। অবশ্য আলেক সাঁই তাঁর পিতৃ-মাতৃপ্রদত্ত নাম নয়। নিজ প্রদত্ত নাম। তাঁর প্রকৃত নাম জানার এখন আর কোন প্রয়োজন নেই। কারণ ইহা এখন স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে। প্রকৃত নামের পরিবর্তে নিজ প্রদত্ত নামেই তিনি এখন সকলের নিকট সুপরিচিত।
আলেক সাঁইয়ের জন্ম শ্রীনগরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পরিবারের সকলেই উচ্চ শিক্ষিত এবং স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। আলেক সাঁইও তাঁর ভাইবোনদের মতো হতে পারতেন। দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাতৃভাষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পর তাঁর লোভ হল শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার। তিনি যে দেশের, যে সমাজের মানুষ, সে দেশে এবং সে সমাজে, শিক্ষকতা পেশা সম্মানিত পেশা হিসেবে সকলে খুব একটা স্বীকার করে না। কিন্তু তবুও তিনি এ পেশায় যুক্ত হবেন বলে মনস্থির করলেন। শিক্ষকতা পেশায় থেকেও তিনি অন্য দশজনের মতো হলেন না, বরং একেবারে ভিন্ন রকমের একজন হলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের কেবল বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষেই পাঠাদান করতেন না, শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তিনি তাদের পাঠদান করতেন। যখন তখন শিক্ষার্থীরা তাঁর নিকটে তাদের সমস্যা নিয়ে আসত। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে যতদূর সম্ভব শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান করে দিতেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের তিনি পকেটের অর্থ দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাবার সুগোগ করে দিতেন। কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে তার বাড়ি গিয়ে ঔষধ-পথ্য কিনে দিতেন। এমনকি রাত্রিবেলায়ও তিনি শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়া তাদের খোঁজ-খবর লইতেন। তাই অল্প দিনেই তিনি শিক্ষার্থীদের অতি প্রিয়ভাজন হয়ে উঠলেন। তিনি যেমন শিক্ষার্থীদের আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন, অকৃপণভাবে তাঁদের জ্ঞানের পথ বাতলিয়ে দিতেন, শিক্ষার্থীরাও তাঁকে অত্যন্ত আপনজন মনে করতে লাগল। কিন্তু কোন কোন এক অজ্ঞাত কারণে শিক্ষকতার মতো এমন মহান পেশাও তাঁর দীর্ঘ দিন ভালো লাগল না। তিনি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিলেন।
শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি তার অর্জিত সকল সম্পত্তি বিক্রি করে ইছামতি নদীর তীরে একটু জায়গা কিনলেন। এ জায়গায় তিনি তৈরি করলেন একটি বাড়ি। বাড়ি না বলিয়া ‘আখরা বাড়ি’ বলাই ভাল। বাড়িতে ছোট্ট একটি টিনের ঘর। ঘরের সামনে-পেছনে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা রয়েছে। একধারে কিছু গাছ-গাছালি। ফুলের গাছ, ফলের গাছ। এ জায়গায় জনবসতি খুব একটা নেই বলে তাঁর বাড়ির পেছনের দিকে অন্যের মালিকানাধীন বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। আর এক দিকে নদী। বর্ষাকালে নদীর পানি তাঁর ঘরের সীমানা ছুঁয়ে যায় আর শীতের সময়ে নদী শুকিয়ে সরু খালের মতো হয়ে যায়। তখন তার বাড়ি হতে নদী পর্যন্ত কিছুটা বাড়তি জায়গা পাওয়া যায়। ঘরের ভিতরে আসবাবপত্র বলতে খুব বেশি কিছু নাই। তবে ঘরে ঢুকে যা দেখে সকলের নয়ন জুড়ে যায় তা হল তাঁর সংগৃহীত রাশি রাশি বই-পুস্তক। অনেকগুলো শেলফে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়েছে। এ বাড়িতেই আলেক সাঁই অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন আরম্ভ করলেন।
অন্যদিকে, জাহান ফকিরের জন্ম একই এলাকার অতি হীন এক পরিবারে। হীন পরিবারে জন্ম হলেও বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। অনেক নাম করবে। তাই তারা অনেক আশা করে ছেলের নাম রাখলেন ‘শাহ্জাহান’। ‘শাহ্জাহান’ শব্দের অর্থ হল জাহানের বাদশাহ। পৃথিবীর বাদশাহ। শাহ্জাহান নামেই তিনি সকলের নিকট পরিচিত ছিলেন। আলেক সাঁইয়ের আনুকূল্যে আসিয়া তিনি নিজের নাম বদলাইলেন। নিজের নাম রাখলেন ‘জাহান ফকির’। জাহানের ফকির। গুরুর সংস্পর্শে পৃথিবীর বাদশাহ ফকির বনিয়া গেল।
আলেক সাঁই ও জাহান ফকির ভিন্ন পরিবেশে জন্মিলেও তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নানা কারণে তাদের সম্পর্ক এমন গভীর হয়েছে। প্রথম কারণ হল তাঁদের চিন্তার ঐব্য। এছাড়া তাদের মধ্যে চরিত্রগত অনেক মিলও রয়েছ। সবচাইতে বড় মিল হল তারা দু’জনই সংসারবিরাগী মানুষ। তাঁদের সংসার করা হয়ে উঠে নাই। আলেক সাঁইয়ের স্ত্রী-পুত্র তাঁর সাথে থাকে না। অন্যদিকে জাহান ফকির বিবাহ করে ছিলেন বটে কিন্তু দুই বৎসরের মধ্যেই স্ত্রী মারা যাওয়ায় দ্বিতীয়বার ওই পথে না যাইবার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চরিত্রের এমনি আরো নানান ঐক্যের কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্টতার মাত্রা বেড়ে গিয়াছে। তাঁরা পরষ্পর পরষ্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু বনে গিয়েছেন। বন্ধু হলেও জাহান ফকির সম্ভবত তাঁর পারিবারিক হীন অবস্থার কারণে আলেক সাঁইকে কিছুটা ভিন্ন চোখে দেখে থাকেন। তিনি আলেক সাঁইকে কেবল বন্ধু ভাবতে পারেন না। গুরু ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন। বন্ধু হলেও তাঁদের মধ্যে, এ কারণে একটা, গুরু-শিষ্য সম্পর্ক রয়েছে। আলেক সাঁইয়ের প্রতি তাঁর এক ধরনের বিন¤্র শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে ইহা জাহান ফকিরের মনের জড়তামাত্র। আলেক সাঁইয়ের মনে এমন কোন জড়তা নাই। তিনি জাহান ফকিরকে বন্ধু ও সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাই আকস্মাৎ দূর হতে এ আখড়া বাড়িতে কেউ আসলে বুঝতে পারবে না কে গুরু আর কে শিষ্য। তারা দু’জনেই ভক্তদের মাঝে সুর করে গান গেয়ে থাকেন। আলেক সাঁই যখন সুর করে গান ধরেন, জাহান ফকির তখন ঢোল বাজিয়ে তাল দিতে থাকেন। আবার জাহান ফকির যখন গান ধরেন, আলেক সাঁই তখন ঢোল বাজিয়ে তাল দিতে থাকেন।
ইছামতি নদীর তীরের এ বাড়িতে আলেক সাঁই তাঁর বসতি শুরু করবার অল্প দিনের মধ্যেই ইহা মানুষের নিকট পরিচিতি লাভ । তাঁহাকে যারা পছন্দ করেন, ভালোবাসেন, তারা এখানে আসিতে শুরু করল। অনেকে তাঁর ভক্ত ও শিষ্য বনিয়া গেল। এবং দিনে দিনে তাঁর ভক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। ধীরে ধীরে ভক্তরা এ বাড়িটিকে আখড়াবাড়ি হিসেবে প্রচার করতে লাগল। এর ফল হিসেবে এ বাড়িতে মানুষের আনাগোনা আরো বেড়ে যেতে লাগল।
আলেক সাঁইয়ের ভক্তদের অধিকাংশই যুবক বয়সের। তবে মধ্য ও বৃদ্ধ বয়সী নারী-পুরুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তিনি তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। জীবন-জগৎ সম্পর্কে আলোচনা করেন। গুরু বলেন, শিষ্যরা শুনেন। মাঝে মাঝে গুরু-শিষ্যের আলোচনা চলে দীর্ঘক্ষণ ধরে। আলেক সাঁই স্বভাবে একজন সরল প্রকৃতির মানুষ। তিনি অত্যন্ত সহজ ও সরল ভাষায় কথা বলেন। জটিল বিষয়কেও তিনি এমন সহজ করে তোলেন যেন মনে হয় খুবই সাধারণ বিষয় নিয়া আলোচনা করছেন। আলোচনা শেষে বাউল গান চলে অনেক রাত পর্যন্ত। আধ্যাত্মিক বাউল গান। অধিকাংশ সময়েই চলে লালন ফকিরের গান। তবে মাঝে মাঝে হাসন রাজার গান কিংবা অন্যান্য গানও গীত হয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে আলোচনা ও গানের আসর এতো অধিক রাত্রি পর্যন্ত চলতে থাকে তখন ভক্তদের কেউ কেউ আখড়াবাড়িতেই রাত্রি যাপন করে থাকে।
জাহান ফকিরের বাড়ি ইছামতি নদীর পারেই, আলেক সাঁইয়ের আখড়া বাড়ি হতে খুব বেশি দূরে নয়। বাড়িতে তার খুব বেশি কাজ নাই। একটি পোষা কুকুর, দুটি বেড়াল আর কয়েকটি পাখি আছে। ওদের জন্যই রাত্রিতে জাহান ফকির আখড়াবাড়িতে খুব একটা রাত্রিযাপন করেন না। রাত্রি গভীর হলেও নিজ বাড়িতে চলে আসেন। সারা দিন তারা একত্রে থাকেন, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ান। বাউল তত্ত্ব নিয়া ঘন্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেন। একসঙ্গে আহার করেন। ভক্তদের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু রাত্রি হলে বাড়ি চলে যান। আবার পরের দিন সকাল-সকাল এসে পড়েন। এইই তার নিত্তদিনের কার্যসূচি। নৌকাটি বানানোর পর থেকে এইটিই তাদের নিত্যদিনের বাহন হল।
২
ভক্তের দেওয়া সুন্দরী কাঠ দিয়া আলেক সাঁই অনেক যতœ করে নৌকাটি বানাইলেন। জাহান ফকির নৌকার দুই পাশে সুন্দর করে নকশা এঁকে দিলেন। একেতো সুন্দরী কাঠ, তারপরে আবার জাহান ফকির ঘঁষিয়া ঘঁষিয়া তক্তাগুলোকে এমন মসৃন করলেন যে তা এখন কাঁচের মতো মসৃণ হয়ে উঠেছে। এই মসৃণ কাঠের উপর জাহান ফকিরের নিখুঁত নকশায় নৌকাটির সৌন্দর্য অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। নৌকাটি বানানো শেষ হলে, তাই, আলেক সাঁই দীর্ঘক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে জাহান ফকির বলল, ‘ইহার একটা নাম থাকা চাই, যুৎসই নাম।’
আলেক সাঁই, ‘কর্মই যদি মূখ্য হয় তবে নামে কি-বা আসে যায়? ’
জাহান ফকির, ‘নামই যদি বৃথা হবে তবে নামের এত বাহার কেন? আল্লা বলি, হরি বলি সবাই তো নামের কাঙাল।’
আলেক সাঁই, ‘বুঝলা ফকির? যা আমরা দেখি তা সবই আসল নয়। যার যা নাম তাও আসল নাম নয়।’
জাহান ফকির, ‘ঠিক বোঝা গেল না’।
আলেক সাঁই, ‘আসলে নাম নাই বস্তুতে, নাম নাই কর্মে, নাম নাই নামেও।’
জাহান ফকির, ‘তাইলে নাম কই?
আলেক সাঁই, ‘নাম হইল সম্পর্ক, সম্পর্কই নাম।’
জাহান ফকির, ‘আরো একটু সহজ করা দরকার।
আলেক সাঁই, ‘যেমন ধর নদীর নাম ইছামতি। ইছামতি কি? এর জল? না জলের ভেতরের জীবজন্তু? না জলের নীচের মাটি? নাকি এর দুই কূল? আজকে যেই জল কাল সেই জল কই? আজ যে জীবজন্তু কাল সেগুলো কই? আজকে যে মাটি কাল তা কই? আজ যে নদীর কূল কাল সেই কূল কই?’
জাহান ফকির, ‘সবগুলা মিলাইতো এর নাম।
আলেক সাঁই, ‘না ফকির। এর কোনোটাই এর নাম নয়। সবগুলো মিলেও এর নাম নয়। বস্তুর মাঝে নাম নাই। আমরা এই নামে ডাকি তাইতো এর নাম ইছামতি।’ জাহান ফকির, ‘তাহলে নাম কি?’
আলেক সাঁই, ‘আকার আর নিরাকারের সম্পর্কই নাম।’
‘অতি উত্তম কথা।’ কথাটা জাহান ফকিরের মনে ধরল। মনে মনে বেশ কয়েকবার আওড়াইল কথাটি। ‘আকার আর নিরাকারের সম্পর্কই নাম।’ এর পর বলল, ‘তাহলে অবশ্যই এর একটা নাম দরকার।’
কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে আলেক সাঁই বলল, ‘তবে ইহার নাম হইল মন-পবনের নাও।’
জাহান ফকির উৎফুল্লচিত্তে বললেন, ‘বাহ! অতি উত্তম নাম হইয়াছে। নামটি আমার পছন্দ হয়েছে।’
তখন হইতে নৌকাটির নাম হইল ‘মন-পবনের নাও’।
জাহান ফকিরের অনুরোধে আলেক সাঁই নিজ হাতে নৌকার সামনের দিকের ডান পার্শ্বে ছোট্ট অক্ষরে খোদাই করে লিখে দিলেন মন-পবনের নাও। একই সাথে তিনি অত্যন্ত যতœ করে নৌকার দু’ধারে, বাহিরের দিকে, লালনের দু’টি বাণী খোদাই করে লিখে দিলেন। এই বাণীগুলো এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন পাশ দিয়ে কোন নৌকার আরোহীরা তা অতি সহজেই দেখতে পায়। নৌকাটির এক পাশের বাণী ছিল,
‘কোন্ নামে ডাকিলে তারে হৃদয়াকাশে উদয় হবে
আপনায় আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে।’
আর অপর পাশের বাণীটি ছিল,
‘যে ছুতোরের নৌকা গঠন, তারে যদি পেতাম এখন
লালন বলে মনের মতন, সারতাম নৌকা তার কাছে।’
আলেক সাঁই ও জাহান ফকির মন-পবনের নাওএ করে ইছামতি নদীতে বেড়াতে ভালোবাসেন। মেজাজ মর্জি ভালো থাকলে ইছামতি পার হয়ে কখনো তারা ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীতেও এসে পড়েন। এমনি করে বর্ষাকালেতো বটেই, এমনকি শুকনা মৌসুমেও, এ নৌকাটিই তাঁদের একমাত্র বাহনে পরিণত হল। এ নৌকায় চড়ে তারা তাঁদের জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়েছেন। অবস্থা এমন হল যে একদিন নৌকায় না চড়লে তাদের ভালো লাগে না। কোন কাজ না থাকিলেও তাঁরা নৌকায় চড়িয়া নদীর মাঝখানে ভেসে বেড়ান। তাদের মন ভালো থাকলেও তাঁরা নৌকায় বেড়ান, মন ভালো না থাকলেও তারা এতে চড়ে বসেন মন ভালো করবার জন্যে। এভাবে নৌকাটি তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল। ফলে নৌকাটির প্রতিও তাঁদের গভীর ভালোবাসা জন্মিল।
তাঁরা দু’জনই নৌকাটির পরিচর্যা করেন, তবে জাহান ফকির কিছুটা বেশি করেন। এর কারণও ছিল। গুরুভক্তি। গুরুর প্রতি জাহান ফকিরের অধিক ভক্তির কারণে প্রায়শই জাহান ফকির তাঁহাকে কোন কাজই করতে দেন না। তা নৌকার পরিচর্যাই হোক বা অন্য কোন কষ্টকর কাজ। একদিন আলেক সাঁই নৌকাটি পরিষ্কার রাখিবার নিমিত্তে জাহান ফকিরকে তাঁর একটি পুরোনা ফতুয়া দিলেন। ফতুয়াটিতে কম করে হলেও দশটি ছিদ্র হবে। কিন্তু জাহান ফকির এ পুরোনো ফতুয়াটিকে পরম যতেœ নিজের কাছে রাখিয়া দিলেন। আর তাঁর জামাটি নৌকা পরিষ্কারের কাজে লাগাইলেন। জাহান ফকির গুরুর এ পুরোনো ফতুয়াটিকে তাঁর প্রতি আশীর্বাদের চিহ্ন স্বরূপ রেখে দিয়েছেন।
মন-পবনের নাও এখন ইছামতি নদীর একটি সর্বজন-পরিচিত বাহন হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে এর যাত্রীরাও সকলের আপনজন ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে গিয়েছে। গুরু-শিষ্য এ নৌকায় চড়িয়া ঘুরিয়া বেড়ান, কখনো একতারা বাজাইয়া বাউল গান গাইতে থাকেন। তাদের গান শুনে অনেকেই নৌকার গতি কমাইয়া দেয় যাতে একটু বেশি সময় ধরে গুরু-শিষ্যের গান শুনিতে পারা যায়। কখনো কখনো পাশের নৌকার আরোহীরা মন-পবনের নাও-এর দুই পার্শ্বের লালনের বাণীর মাহাত্মও জিজ্ঞাসা করে থাকেন। তখন গুরু বা শিষ্য কেউই তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে অন্য গান শুনাইয়া দেন। এতে যে বুঝিল, বুঝিল। যে না বুঝিল না-বুঝিল।
৩
এমনি করে দিন যেতে লাগল। আলেক সাঁইয়ের শরীরও কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়তে লাগল। একদিন গুরুর শরীর কিছুটা ভালো হলে, গুরুর ইচ্ছায় তারা, মন-পবনের নাও-এ করে নদীতে বেড়াতে বের হলেন। ভ্রমণ শেষে গুরু মনে করলেন নৌকাটি বুঝি কিছুটা দূর্বল হয়ে গিয়েছে। এ কারণে তিনি গলুইয়ের ডান পাশের একটি তক্তা পরিবর্তন করবার জন্য শিষ্যকে বললেন। গুরুর ইচ্ছায় মন-পবনের নাও-এর ডান দিকের একটি তক্তা বদল করে ভিন্ন একটি তক্তা লাগানো হল। শ্রীনগরে সুন্দরী কাঠ না পাওয়ায় এর পরিবর্তে চাম্বুল কাঠ লাগানো হল। চাম্বুল কাঠ পানিতে অনেক দিন টিকিয়া থাকে, এমনটা জেনেই জাহান ফকির নৌকাটিতে চাম্বুল কাঠ লাগাইলেন।
গুরুর যেকোন বিষয়ের প্রতিই জাহান ফকিরের আলাদা নজর, আলাদা ভক্তি। একে তো এ তক্তাটি গুরুর স্মৃতি-ধন্য, তারপরে আবার এতে মহাত্মা লালনের অমৃত বাণী খোদাই করা ছিল। তাই জাহান ফকিরের সাধ্য নাই এ তক্তাটি ফেলে দেয়। গুরু ও লালনভক্ত জাহান ফকির পুরোনো তক্তাটি পরম যতেœ নিজের কাছেই রেখে দিলেন এবং চাম্বুল কাঠের নতুন তক্তাটির উপরে লালনের বাণীটি পূর্বের মতোই খোদাই করে দিলেন। নৌকাটি সারিয়ে তোলাবার পরে বেশ কিছু দিন আবার তারা এতে করে বেড়াতে লাগলেন।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যে, গুরুর নির্দেশে, নৌকার বামপাশের তক্তাটিও মতো বদল করতে হল। জাহান ফকির আগের মতোই নৌকাটির তক্তা বদল করলেন এবং এর উপরেও লালনের বাণীটি লিখে দিলেন। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে নৌকার মাঝখানের তৃতীয় তক্তাটিও বদল করা হল। এ তক্তাটি বদল করবার সময়ে একটা ফ্যকড়া বেধে গেল। মাঝখানের সুন্দরী কাঠের সমান চওড়া কোন চাম্বুল কাঠ না পাওয়ায় দুইখানা তক্তা জোড়া দিয়ে মাঝখানে লাগানো হল। জাহান ফকির এমন দক্ষভাবে তক্তা দুটিতে জোড়া লাগাইয়াছে, দূর হতে কেন, অত্যন্ত কাছ থেকেও বুঝবার উপায় নেই। নৌকাটিকে আগের মতো চলনসই করা হল। এবার জাহান ফকির নৌকাটির সামনের দিকে ছোট্ট করে খোদাই করে নৌকাটির নাম লিখিয়া দিলেন। মন-পবনের নাও আগের মতোই ইছামতিতে চলতে লাগল।
গুরুর প্রতি অগাধ ভক্তিহেতু জাহান ফকির নৌকার পুরোনো তক্তাগুলোর সবকয়টিই নিজের ঘরে পরম যতেœ রেখে দিলেন। সপ্তাহে একবার তিনি এ তক্তাগুলো নিজের ব্যবহারের গামছা দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে থাকেন। এমন করে তিনি এ তক্তাগুলোর যতœ করে থাকেন যেন দেখে মনে হয় যেন তিনি গুরুকেই পর যতœসহকারে সেবা করছেন।
৪
এদিকে আলেক সাঁইয়ের আখড়া বাড়িতে ভক্তদের আনাগোনা বাড়তেই লাগল। গুরু-শিষ্যদের মিলন মেলায় শ্রীনগরের শ্রী আরো বেড়ে যেতে লাগল। শারীরিক দূর্বলতাহেতু আলেক সাঁই এখন আর আগের মতো দীর্ঘক্ষণ ধরে ভক্তদের মধ্যে উপদেশবাণী প্রচার করতে পারেন না, আলোচনা করেন না। তিনি কেবল শুরুটা করেন। বাকীটা সম্পন্ন করতে হয় জাহান ফকিরকেই। গুরু পাশে বসে জাহান ফকিরের বাণী মনোযোগের সাথে শুনে থাকেন। প্রথম প্রথম জাহান ফকির কিছুটা ইতস্তত হয়ে পড়তেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছেন। এখন তিনিও গুরুর মতোই দীর্ঘক্ষণ ভক্তদের মাঝে উপদেশ বাণী প্রচার করতে পারেন, আলোচনা করে থাকেন।
আলেক সাঁই এ আখড়া বাড়ি তৈরি করে প্রথম যেদিন এখানে উঠেছিলেন সে দিনটা ছিল মাঘ মাসের আট তারিখ। ওই দিনটাকে স্মরণে রাখবার জন্য প্রতি বছর একই তারিখ উৎসবের মতো, বেশ বড় করে, অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর এ তারিখে প্রায় সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। রাত্রি শুরু হবার সাথে সাথে বাউল গানের আয়োজন শুরু হয়। সারারাত ধরে চলে এ আয়োজন। এ অনুষ্ঠানে দূর-দূরান্ত হতে লোকের আগমন ঘটে।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও মাঘ মাসের আট তারিখ আলেক সাঁইয়ের আখড়া বাড়িতে বড় আসর-আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। আশা করা যায় এবারও, অন্যান্য বারের মতোই, দূর দূরান্ত হতে অনেক লোক সমাগম হবে। আসরকে সুন্দর করবার জন্য জাহান ফকিরের দিনরাত পরিশ্রমের শেষ নাই। এদিকে গুরুর শরীর আর আগের মতো ভাল নাই। ফলে প্রস্তুতির সকল কাজ তাহাকে প্রায় একাই করতে হয়। দিনের পরিশ্রম সমাপ্ত হলে গুরু-শিষ্য মন-পবনের নাও-এ চড়িয়া নদীতে কিছুক্ষণ পরিভ্রমণ করে আখড়ায় ফিরিয়া আসেন। গুরুকে আখড়ায় ফিরাইয়া দিয়ে জাহান ফকির নিজের বাড়িতে চলিয়া যান। এ ভ্রমণে অধিকাংশ সময়ে শিষ্যই গান গাইয়া গুরুকে শোনাইয়া থাকেন। গুরুও শিষ্যের কণ্ঠে গান শুনে আরামবোধ করেন।
মাঘ মাসের সাত তারিখ। বাৎসরিক আয়োজনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে গুরু-শিষ্য নৌকাযোগে অল্প সময়ের জন্য নদীতে বের হলেন। তখন বেলা চারটার মতো হবে। শীতের দিন। তাই এ সময়েই সূর্য অনেকটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। গুরুকে কিছুটা বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। শিষ্য তাকে ঘরে বসেই বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু গুরুর আগ্রহেই মন-পবনের নাও নিয়া বের হতে হল। শিষ্য নৌকা বাইতে লাগল, আর গুরু নৌকার পাটাতনে শুইয়া আকাশের পানে অপলক তাকিয়ে থাকলেন। নৌকা বাইতে বাইতে শিষ্য গুরুকে পরের দিনের আয়োজন নিয়া তার পরিকল্পনার কথা বলে চলিল। গুরু কোন উত্তর না দিয়ে কেবল সম্মতিসূচক হুঁ হুঁ করতে লাগল। এভাবে অনেকক্ষণ চলল। বেশ কিছুক্ষণ পরে গুরু শিষ্যকে একটা গান ধরিতে অনুরোধ করলেন। গুরুর আদেশ পেয়ে শিষ্য মনের সুখে গান ধরল। লালন ফকিরের গান।
‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার নেওগো সুপথে/তোমার দয়া বিনে চরণ সাধি কী মতে ---’
গান শেষ হল। কিন্তু গুরু কোন মন্তব্য করল না। এমনটি কখনো ঘটে নাই। শিষ্য কোন গান গাইলে গুরু এর অন্তর্নিহীত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে অনেক কথা বলে থাকেন। গুরুর মুখের এ সকল কথা শিষ্যের নিকট অমৃতের মতো মনে হয়। কিন্তু আজ শিষ্যের গান শেষ হলে গুরু কিছু বলিল না দেখে শিষ্যের মন কিছুটা খারাপ হল। পরেই ভাবিল, হয়তো গুরু ঘুমাইয়া পরিয়াছেন। সন্ধ্যা হয় হয়, এ কারণে দূর হতে মুখম-ল দেখে স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যেতেছে না। গুরুকে আর বিরক্ত না করে শিষ্য নৌকা বাইতে বাইতে আখড়াবাড়ির ঘাটে আসিয়া থামিল। নৌক যখন ঘাটে থামিল শিষ্য গুরুর নিকটে আসিয়া দেখিল তাঁর নিস্তেজ শরীরখানা কেবল পড়িয়া আছে মন-পবনের নাও-এর পাটাতনের উপর। তাঁর শরীর ঠা-া হয়ে গিয়েছে। শিষ্যের আর কিছু বুঝিতে বাকি থাকিল না।
৫
এ ঘটনা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই শ্রীনগরে রাষ্ট্র হয়ে গেল। রাত্রির মধ্যেই গুরুর দেহ আখড়ার বাড়ির সীমানার মধ্যে সমাধিস্ত করা হল। গুরুর মৃত্যুর খবর যারা শুনল, আর যারা শুনল না, পরের দিন বাৎসরিক আসরে এমন অনেকেই আসল। আগের বৎসরগুলোর তুলনায় এবার অনেক বেশি মানুষের আগমন ঘটল। গুরুর দেহত্যাগের খবর শুনে তার আত্মীয়-স্বজনরাও আসল কয়েকজন। গুরুর দুই ভাই এবং আরো কয়েকজন নিকটাত্মীয়ও আসল। তাঁর দুঃসম্পর্কের এক ভাইও আসিল। তার নাম আনিস। আনিস এসে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বিলাপ শুরু করে দিল। এর আগে এ আসরে তাহাকে খুব একটা দেখা যায় নাই। হয়তো দুই-একবার এসেছে, কিন্তু কারো নজরে পড়ে নাই। এবার সে-ই অনেকটা গায়ে মানে না আপনি মোড়লের মতো আসরের কেন্দ্রে এসে পড়ল। আসরের সকল দায়িত্ব নিজেই নিয়া নিল। নিজেই নিজেকে গুরুর উত্তরসূরী বলে জাহির করতে লাগল। শিষ্যদের গুরুদক্ষিণা নিজের পকেটস্ত করল। কীভাবে আসর চলিবে, কী কী হবে, কী হবে না তার সবই নির্দেশ দিতে লাগল। জাহান ফকির কিংবা গুরুর অন্য কোন প্রিয়ভাজন কাউকেই কোন কথা জিজ্ঞাসা করল না। বাৎসরিক আসরের জন্য নির্ধারিত বাউলদের অনেককে গান গাইতে অনুমতি না দিয়ে আনিস তার পছন্দের শিল্পীদের দিয়ে গান পরিবেশন করাইল। জাহান ফকির সবকিছু মুখ বুজিয়া সহ্য করল। গুরুর কয়েকজন শিষ্য জাহান ফকিরের কাছে গিয়া এর প্রতিকার চাইল। আবার কয়েকজন আনিসের সাথেও তাল মিলাইল। জাহান ফকির কিছুই বলল না, কিছু করলও না। আরো কয়েকজন সঙ্গীসাথী নিয়া আসরের পরিশ্রমপূর্ণ সকল কার্যক্রম নিরবে সম্পন্ন করল। সারা রাত ধরে চলিল আসরের গান। গান শুরু হবার অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক ভক্ত-শিষ্যরা চলিয়া যেতে লাগল। জাহান ফকিরেরও ইচ্ছা ছিল চলে যাবে। কিন্তু পারল না। কোন এক অজানা বন্ধনের টানে থেকে গেল।
পরের দিন সকালে জাহান ফকির নিজের বাড়িতে চলে আসল। তার সাথে কয়েকজন গুরুভক্তও আসল। দীর্ঘক্ষণ তারা কেউ কোন কথা বলিল না। কেবল নিরবে সময় পার করতে লাগল। জাহান ফকির নীরবতা ভেঙে সকলকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কোন কথা না বলে সকলেই চলে গেল। পরের দিন যথারীতি জাহান ফকির সকাল বেলায় গুরুর আখড়ায় এসে হাজির হল। তার আগেই আরো কয়েকজন এসে হাজির হল। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আনিসের পাশাপাশি বসে তার কথা শুনছিল। আনিস তাদের সাথে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা বলে যাচ্ছিল। যারা আনিসকে পছন্দ করল না, তারা একটু দূরে মাটিতে বসে থাকল। জাহান ফকির আসলে তারা তার নিকটে এসে বসল। কিন্তু জাহান ফকির কিছুই বলল না। দূর হতে কেবল আনিসের কথাগুলো শুনতে লাগল।
আনিসের পরিকল্পনাগুলোর সার-সংক্ষেপ হল গুরুর আখড়াবাড়িতে একটি মাজার করা হবে। বলাই বাহুল্য মাজারের প্রধান হবে আনিস নিজেই। দ্বিতীয়ত, গুরুর নৌকাখানা বিক্রী করে একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ক্রয় করা হবে। তাকে ঘিরে যারা বসে ছিল তারা সকলেই আনিসের কথাগুলো মেনে নিল। তবে দু’একজন গুরুর নৌকাখানা বিক্রী না করবার পরামর্শ দিল। কী ভাবিয়া আনিস নৌকাখানা বিক্রীর সিদ্ধান্ত হতে পিছাইয়া আসল। নৌকাখানা বিক্রীর পরিবর্তে সিদ্ধান্ত হল মাজারের পাশে উহা উঠিয়ে রাখা হবে দর্শনার্থীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
সব কিছু খুব দ্রুতই ঘটে গেল। আনিস আখড়াবাড়ির সকলকিছু অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের দখলে নিয়া গেল। অভিমানে গুরুর প্রিয় শিষ্যদের সকলেই আখড়াবাড়িতে আসা বন্ধ করে দিল। জাহান ফকিরও আসা বন্ধ করে দিল। দিনের অধিকাংশ সময়ই এখন সে নিজের বাড়ীতে অবস্থান করে। তার কাছে রক্ষিত গুরুর পুরোনো ফতোয়াটির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকাইয়া থাকে। গুরুর স্মৃতি বিজড়িত পুরোনো তক্তাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পরমযতেœ এগুলো পরিষ্কার করতে থাকে, আর নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে।
৬
একদিন জাহান ফকির কী-না-কী ভাবিয়া মন-পবনের নাওএর সুন্দরী তক্তাগুলো দিয়ে আবার নৌকা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তক্তাগুলো পুরোনো ছিল কিন্তু একেবারে নষ্ট হয়ে যায় নাই। তার যতেœ মনে হল এগুলো আবার নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। তিনি পুরোনো তক্তাগুলো দিয়ে ঠিক আগের মতোই একটি নৌকা বানাল। নৌকার গায়ে আগের মতোই রং করা হল। আলেক সাঁইয়ের নিজের হাতে লেখা নৌকার দুইপার্শ্বের লালন ফকিরের অমৃত বাণী দুটিও আগের মতোই সকলের দৃষ্টি কাড়তে লাগল। গুরুর লেখা নৌকাটির নাম মন-পবনের নাও উজ্জ্বল ও দৃশ্যমান হয়ে উঠল। নৌকাটি পরিপূর্ণরূপে তৈরি করবার পর জাহান ফকির তার প্রিয় একজন সঙ্গীকে নিয়ে ইছামতি নদীতে ভ্রমণ করতে বের হল। সঙ্গী নৌকার হাল ধরল। আর জাহান ফকির লালনের গান ধরল।
‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন।/কেবা জাগে কেবা ঘুমায় কে কারে দেখায় স্বপন---’
এমনি করে প্রত্যহ জাহান ফকির এ নৌকাখানা নিয়ে নদীতে ভ্রমণে বের হয়ে থাকেন। ভ্রমণ শেষে গাঁয়ের গামছা দিয়ে নিজ হাতে নৌকাখানা পরমযতেœ ধুঁয়ে-মুছে খুঁটির সাথে বেঁধে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, আর কী যেন ভাবেন। যাবার কালে, যেইখানটায় গুরুর হাতের লেখা মন-পবনের নাও রয়েছে সেখানে চুম্বন করে আত্ম-সুখ লাভ করেন। নদীর পরিচিত যাত্রীদের অনেকে, মন-পবনের নাও নদীতে ভাসতে দেখে, মনে করতে লাগল জাহান ফকির গুরুর উত্তরাধিকার পেয়েছে। অন্যদিকে আনিসের অনুসারীরা আলেক সাঁইয়ের আখড়া বাড়ির আঙিনায় রাখা নৌকাটিকে আসল নৌকা ভাবিয়া উহাতে দর্শনী প্রদান করতে লাগল।
২| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:৪৯
সফিক৭১ বলেছেন: বড় গল্প বলা চলে।
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৭:৫৩
চাঁদগাজী বলেছেন:
উপন্যাস?