নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যুক্তির নিরিখে খুঁজি সত্যের ঠিকানা

সফিক৭১

যুক্তি ও বিজ্ঞানই পারে মানুষ , রাষ্ট্র ও সমাজকে পরিবর্তন করতে

সফিক৭১ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মানুষের বহুমাত্রিকতায় বিজ্ঞান-দর্শনের সংক্ষিপ্ত বয়ান-দ্বিতীয় পর্ব

০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:৪৫

ইদানিং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানবাদীতা নামের একটি শব্দের প্রচলন লক্ষ করা যায়। ‘বিজ্ঞানবাদীতা’ বলতে আসলে কি বোঝানো হয় সমাজে তা স্পষ্ট নয়। বাংলাভাষায় কে বা কারা এই শব্দটির প্রচলন করেছে তাও স্পষ্ট নয়। তবে এই শব্দটির ব্যবহার দেখে এটা স্পষ্ট যে এটি বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানবলয়ের বাইরের ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক অসৎ উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত। অনেকটা ‘মৌলবাদী’ কিংবা ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের মতো। মৌলবাদী কিংবা সাম্প্রদায়িক বলে যাদের প্রচার করা হয়, তারা যেমন নিজেদের জন্য এই শব্দদুটির প্রচলন করেন নি, তেমনি বিজ্ঞানবাদী বলে যাদের প্রচার করা হয় তারাও বিজ্ঞানবাদীতা শব্দটির প্রচারক নয়।
বাংলাভাষায় এই শব্দটি সম্ভবত ইংরেজি Scientism এর অনুকরণে চালু হয়েছে। উইকিপিডিয়া বিশ্বকোষে বলা হয়েছে ‘Scientism is a belief in the universal applicability of the scientific method and approach,’। বাইরের থেকে দেখলে মনে হবে এই সংজ্ঞার মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই এর দূর্বলতা বোঝা যাবে। এখানে Scientism কে একটি বিশ্বাস বলে চালানো হয়েছে। উইকিপিডিয়ার এই সংজ্ঞাকে যদি গ্রহণ করা হয় বিজ্ঞানবাদীতা শুরুতেই বিজ্ঞানের বাইরের বিষয় হয়ে যায়। এমনকি এই সংজ্ঞা যদি বিজ্ঞানী কর্তৃক দেয়া হয় তবুও।
কারণ একজন বিজ্ঞানীর বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ভালোলাগা- মন্দলাগা, জাতীয়তা, ধর্ম-দর্শন একান্তই তার ব্যক্তিগত। একজন বিজ্ঞানী ব্যক্তিজীবনে কোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারেন। প্রচণ্ড ধার্মিক হতে পারেন। কিংবা হতে পারেন প্রচণ্ড কুসংস্কারচ্ছন্ন ব্যক্তিও। এ নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, বিজ্ঞানেরতো নয়ই।
পিথাগোরাসের কথা সকলেই জানেন। যিনি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন প্রচণ্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন একজন মানুষ। তার কুসংস্কার শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। মজার বিষয় হলো আমরা যখন পিথাগোরাসের কথা বলি তখন বিজ্ঞানী কিংবা গণিতবিদ পিথাগোরাসের কথাই বলি। কুসংস্কারাচ্ছন্ন পিথাগোরাসের কথা নয়। এতোবছর পরেও মানুষ তাঁর বিজ্ঞানচর্চাকেই গ্রহণ করেছে, কুসংস্কারচর্চাকে নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন নজির আরো অনেক রয়েছে। কাজেই বিজ্ঞানীর সংস্কার, ধর্ম, বর্ণ কিংবা জীবনাচার দিয়ে বিজ্ঞানকে মূল্যায়ন করতে গেলে অনেক সমেয়েই ভুল সিদ্ধান্তে পৌছতে হবে।
বিজ্ঞান কোনো ধর্ম নয়, বিজ্ঞান কোনো বিশ্বাসও নয়। বিজ্ঞান একটি পদ্ধতির নাম। বিজ্ঞান একটি প্রক্রিয়ার নাম। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আল মুতী বলেছেন, ‘বিজ্ঞানকে দেখা যেতে পারে নানাভাবে। কখনো একে দেখা হয়ে থাকে মানুষের আয়ত্ত জ্ঞানের সমাহার হিসেবে, কখনো অনুসন্ধানের পদ্ধতি হিসেবে, কখনো উৎপাদন-প্রক্রিযা উন্নয়নের উপায় হিসেবে, কখনো প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও অনুভূতি সৃষ্টির এক শক্তিমান মাধ্যম হিসেবে। তবু আবার এসব কিছু মিলিয়ে বিজ্ঞান এক ও অখণ্ড। বিজ্ঞান জন্ম দেয় নতুন উৎপাদন পদ্ধতির, নতুন নতুন শক্তির উৎসের, নতুন নতুন প্রয়োজনীয় বস্তুর- এসবই সত্য। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে দেয় এক বস্তুনিষ্ঠ বিশ্বদৃষ্টি, বিশ্বের রহস্য অনুসন্ধানের এক সুসংবদ্ধ পদ্ধতি।’
এই পদ্ধতির ব্যবহার কমবেশি সমাজের প্রতিটি মানুষই করে থাকে। অন্ধকারে মানুষকে আলো জ্বালাতে হয়। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য গরম পোষাক পড়তে হয়। বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজতে হয়। মানুষকে প্রতিদিন দাঁত মাজতে হয়। পাকু করলে শুচু দিতে হয়। এসব মানুষ নিজে থেকেই করে। কারণ এর সাথে তার ভালো থাকার সম্পর্ক, সুস্থ্য থাকার সম্পর্ক, নিরাপদ থাকার সম্পর্ক রয়েছে।
দাঁত মাজার কথাই ধরা যাক। সুস্থ্য দাঁতের জন্য প্রত্যহ দাঁত মাজা আবশ্যক। কেউ যদি দাঁত মাজবেন না বলে গোঁ ধরে বসে থাকেন তাহলে তাঁর দাঁত নষ্ট হবে। কেউ যেহেতু তা চাইবেন না, কাজেই কেউ গোঁ ধরে বসেও থাকবে না।
কিন্তু কে কি দিয়ে দাত মাজবে তা নির্ভর করবে তার কাছে দাঁত মাজার কি উপকরণ রয়েছে তার উপর। কেউ হয়তো ব্রাশ-পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজ, কেউ মাজবে নিমের ডাল দিয়ে, কেউ খেজুরের ডাল দিয়ে, কেউবা জয়তুনের ডাল দিয়ে, কেউ আবার আমপাতা দিয়ে, কেউবা কয়লা বা ছাই দিয়ে। কিন্তু দাঁত মাজতেই হবে।
প্রশ্ন হতে পারে কীভাবে দাঁত মাজা হবে? দাঁত মাজার হয়তো সুনির্দিষ্ট গ্রামার থাকতে পারে। দেখা যাবে আনুভূমিক না মেজে উলম্বভাবে দাঁত মাজা হলে তা দাঁতের জন্য অধিক মঙ্গলজনক।
বিজ্ঞানীরা এই তথ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বের করতে পারে। কেউ যদি একে বিজ্ঞানের আবিষ্কার বলে গোস্বা করে গ্রহণ না করে তবে তার দাঁতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কেউ হয়তো বলবে এই আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োজন নেই, মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তা বের করতে পারে। তাঁদের এই কথার সাথেও বিজ্ঞান একমত। কারণ মানুষের অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞান বাইরের বিষয় বলে মনে করে না। বিজ্ঞানকে যারা অপছন্দ করেন, কিংবা বিজ্ঞানের কথা বলে যাদের গাত্রদাহ হয় তারাও চুপি চুপি এইভাবেই দাঁত মাজবেন। কারণ নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।
তবে মানুষ নামের এই প্রাণিগুলো যেহেতু বহুমাত্রিক। সেইহেতু মানুষ কোনো জ্ঞানকে আবার হীনস্বার্থেও ব্যবহার করতে পারে, এমনকি বিজ্ঞানের জ্ঞানকেও।
যেমন সমাজে যদি এমন ধারণা বজায় রাখা হয় যে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য। তাই কয়লা দিয়ে দাঁত মাজাই সকলের জন্য করণীয়। অন্যথায় দণ্ডণীয়। কিংবা ধরা যাক সমাজের যিনি নেতা আছেন তাঁর পছন্দ আমপাতা দিয়ে দাঁত মাজা। তাই হুকুম জারি হলো সকলের আমপাতা দিয়েই দাঁত মাজতে হবে। কিংবা ধরা যাক এক দেশে নিম গাছ আছে, অন্য দেশে খেজুর গাছ । এখন যদি খেজুর গাছের দেশ থেকে এই নির্দেশ দেওয়া হয় যে নিম পাতা দিয়ে দাঁত মাজা যাবে না। এবং নিম পাতার দেশ থেকে অনুরূপ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়েও দেয়া যেতে পারে। কিংবা ধরা যাক প্রচার করা হলো পেপসোডেন্ট কিংবা সেনসোডাইন টুথপেস্ট দিয়েই দাঁত মাজলে দাঁত পরিষ্কার হবে। অন্যথায় হবেনা। বলাই বাহুল এমন তথ্য প্রচারে নানান পক্ষের নানান উদ্দেশ্যে নিহিত থাকে এবং এমন অবস্থায় সমাজের নানা শ্রেণির মধ্যে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, মুনাফালোভীদের হাতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন ক্ষেত্রে সকলেই বিজ্ঞানকে ব্যবহারও করতে পারে।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কি বিজ্ঞান হবে?
সমাজের এমন অস্থিরতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো গোষ্ঠি যদি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ‘দাঁত মাজাকে নিয়েই যত বিপত্তি। কাজেই দাঁত মাজাই বন্ধ করে দিতে হবে। এবং দাঁত মাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এই প্রসঙ্গে তারা হয়তো অন্য প্রাণিকে উদাহরণ হিসেবে আনতে পারে। কুকুর বেড়াল দাঁত মাজেনা, গরু, মহিষ দাঁত মাজে না। তাতে কি তারা বেঁচে নেই। তারা বেঁচে থাকেনা?’ তাদের এমন অদ্ভুত খোঁড়া যুক্তিতে কিছু লোক বিশ্বাসীও হতে পারেন। তারা দাঁত মাজা বন্ধ করে দিতে পারেন। প্রশ্ন হলো তাতে কার দাঁতে গন্ধ বাড়বে? এবং এর জন্য বিজ্ঞানকে দায়ী করাইবা কতটুকু ওয়াইজ হবে?
মানুষের বহুমাত্রিকতা একদিকে যেমন তার শক্তির আধার, অন্যদিকে তা দূর্বলতার ক্ষেত্রও বটে। মানুষ যখন কোনো নতুন তথ্য ও জ্ঞান আবিষ্কার করে তখন তা তার শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই শক্তি সম্মিলিত মানুষেরই শক্তি। আবার মানুষ যখন সংকীর্ণতার বশবর্তী হয়, হীন স্বার্থ, লোভ, লালসা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তখন মানুষের শক্তি কমে যায়। মানুষে আর পশুতে তখন কোনো বিভেদ থাকে না। বরং মানুষ তখন পশুর চেয়েও হীন হয়ে যায়।
কাজেই ‘অভিজ্ঞতার ব্যবহার, পর্যবেক্ষন করে সিদ্ধান্ত নেয়া, কারণ অনুসন্ধান ইত্যাদি কর্মগুলো নিতান্ত ‘নাদান’ লোকও করে বলে চালিয়ে দেয়ার মধ্যে কিছু অসত্য সুপ্ত থাকে। তা হলো, মানুষের লোভ, লালসা, হীন স্বার্থ, সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেয়া। এবং এই প্রশ্রয় দেয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মানুষকে এবং মানুষের শক্তিকে অপমান করার হীন উদ্দেশ্য নিহীত থাকে।
একটা কথা মনে রাখা খুবই জরুরি, তাহলো মানুষই বিজ্ঞানের আবিষ্কারক। আগে মানুষ তারপরে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের জন্য কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রির আবশ্যকতা নেই। মানুষ হওয়াই যথেষ্ট।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.