![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Some People Don't Understand The Way I'm, Some Get Hurt By The Way I Talk, But What Can I Do If Thats The Real Me, Sorry I'm Not Perfect But Definitely Not Fake...!
এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য যে- বিশ শতকের বাঙলা ও বাঙালির ইতিহাসের প্রধানতম ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু এ অর্জন এক অনন্য মহাকাব্য, যার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাসগুলো তৈরি করেছে বাঙালিরা এবঙ বাঙালির সাথে একাত্ম সুহৃদরা। ১৯৪৭ সালের দ্বি-জাতিতত্ত্বের পর বাঙালির জাতীয়তাবাদের আন্দোলন মোড় নেয়।
একথা মানতেই হবে যে- বিশ শতকের আন্দোলন সঙগ্রামে বাঙালির প্রধান নিয়ামক ছিলো ছাত্ররা এবঙ ছাত্ররাই। যদিও উনিশ শতকের গোড়া থেকেই আধুনিক বাঙালির যাত্রা শুরু, তথাপি উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ছাত্ররা একটি শক্তি হিসেবে বাঙলার সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস এবঙ বাঙালির মুক্তির ইতিহাস একই ধারায় বইতে থাকে। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ সুরে সুর মিলিয়ে ‘সাতকোটি বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবা না’ কণ্ঠের সাথে মিলিত হয়, তৈরি করে এক মহিমান্বিত এপিক।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত
পাকিস্তান জন্মের মাত্র তিন মাস পরে (ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে) তৎকালীন রাজধানী করাচীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের ভাষায় এই শিক্ষা সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো-
To create an elete that will determine the quality of new civilization. [১]
এতে পূর্ববাঙলা সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও আবদুল হামিদ যোগদান করেন। শিক্ষা সম্মেলনে উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সঙবাদ ৬ ডিসেম্বর ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যে তীব্র বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। বিক্ষোভের মাত্রা এমনই ছিলো যে, ঐদিনই দুপুর দুইটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমেডিয়েট কলেজ ও অন্যান্য কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক প্রতিবাদসভা করে। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তমদ্দুন মজলিশের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাঙস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠান প্রথমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে) সম্পাদক জনাব আবুল কাসেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, এ. কে. এম আহসান প্রমুখ এবঙ প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সঙসদের সহ-সভাপতি ফরিদ আহমদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটাই সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা।
সমাবেশের পর এক বিরাট শিক্ষার্থী মিছিল সচিবালয়ের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেখানে কৃষিমন্ত্রী মহাম্মদ আফজল শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তৃতা করেন এবঙ তাদের আন্দোলনে সমর্থন করেন। এরপর মিছিল প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী এবঙ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের বাসভবনেও গমন করে এবঙ বাঙলার প্রতি মৌখিক সমর্থন ও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত আশ্বাস আদায় করে। মিছিল ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকা অফিসের সামনেও বিক্ষোভ করে।
করাচীতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটির প্রতিই সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিলো। ফলে সম্মেলন শেষে কী কী সুপারিশ গৃহীত হলো তার দিকে শিক্ষার্থীদের খুব কমই আগ্রহ দেখা যায়। প্রকারান্তরে উক্ত সম্মেলনেই পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিক্রিয়াপন্থী করার প্রয়াসে ব্রিটিশ ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামো ঠিক রেখে তাকে তথাকথিত ইসলামিকরণের প্রয়াস চালানো হয়। সুপারিশসমূহ ছিলো নিম্নোক্ত ধাঁচের- [২]
১. সৌভ্রাতৃত্ববোধ, সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিফলন ঘটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামিকরণ করা হবে।
২. স্কুল-কলেজে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে
৩. স্কুলে উর্দূ বাধ্যতামূলক পড়ানো হবে
৪. প্রাথমিক শিক্ষাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করে তা ধীরে ধীরে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করা হবে
৫. মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে
৬. কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো হবে
ভাষাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত
ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায়- ভাষা প্রশ্নকে নিছক আন্দোলন সঙগ্রামের মধ্যে না রেখে তাকে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের মর্যাদায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরঙ শিক্ষার্থীরাই অধিকতর যোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। এ সম্পর্কে তৎকালীন ছাত্রনেতা মোহাম্মদ তোয়াহার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য-
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সাথ সাথেই ভাষার প্রশ্নটি উচ্চারিত হয়। .. ..ভাষা সম্পর্কে আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ তেমন চিন্তা করতেন না। .. .. বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে- এটা কোনোদিন কারো মাথায় ঢোকেনি। বুদ্ধিজীবী মহলে খানিকটা এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা হত, তবে এটাকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিবর্তিত করে ঢাকার ছাত্রসমাজ [৩]
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন করাচীতে শুরু হয়। অধিবেশনে পূর্ব বাঙলার অন্যতম প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা বিষয়ে একটি সঙশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি ছিলো, উর্দূ-ইঙরেজীর সঙ্গে বাঙলাকেও গণ-পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হোক। ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সঙশোধনী প্রস্তাবটির ওপর আলোচনা শুরু হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন-
পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য। [৪]
গণপরিষদে এই প্রস্তাব তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে এবঙ অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল মুসলমান সদস্য প্রস্তাবের বিরোধীতা ও নিন্দা করেন। অন্যদিকে যে কয়জন হিন্দু সদস্য পরিষদের সভ্য ছিলেন তাঁরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন করেন। বিষয়টা শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতায় পৌঁছেই শেষ হয়নি, পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন সদম্ভে ঘোষণা করে বলেন যে-
পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দূকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। [৫]
কিন্তু গণপরিষদে কঙগ্রেস দলের সম্পাদক রাজকুমার চক্রবর্তী সঙশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন যে-
উর্দূ পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছু সংখ্যক মানুষের ভাষা।.. ..বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্যে কোন চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলারও স্বীকৃতি। [৬]
গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদস্যরা বাঙলাকে পরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার খবর ঢাকায় এসে পৌঁছলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যদের এই আচরণের বিরুদ্ধে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এ বিষয়কে উপলক্ষ করে একটি প্রত্যক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে পূর্ববাঙলার সাঙস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন-
ক. কামরুদ্দিন আহমদ
খ. রণেশ দাশগুপ্ত
গ. অজিতগুহ (প্রগতিশীল লেখক সংঘ)
ঘ. আবুল কাসেম (তমদ্দুন মজলিশ)
ঙ. নঈমুদ্দীন আহমদ
চ. তফাজ্জল আলী (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ)
ছ. মোহাম্মদ তোয়াহা (গণতান্ত্রিক যুবলীগ)
জ. শহীদুল্লাহ কায়সার (ছাত্র ফেডারেশন)
ঝ. সরদার ফজলুল করিম
ঞ. তাজউদ্দীন আহমদ
এ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ। এই সভায় ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠু ও সাঙগঠনিক রূপ দেবার জন্যে ‘রাষ্ট্রভাষা সঙগ্রাম পরিষদ’ [৭] নামে সর্বদলীয় একটি সঙগঠন গঠিত হয়। কমিটির আহবায়ক মনোনীত হন জনাব শামসুল আলম। কমিটিতে প্রত্যেক সঙগঠন থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি নেয়া হলেও তমদ্দুন মজলিশের আবুল কাসেম সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন তুলে প্রগতিশীল লেখক সংঘের প্রতিনিধি (আসলে কমিউনিস্ট প্রভাবিত বলে) অজিতগুহকে কমিটিতে রাখার বিরোধিতা করেন এবঙ সফলও হন। রাষ্ট্রভাষা সঙগ্রাম পরিষদ ঐদিন এক প্রস্তাবে সারা পূর্ব বাঙলায় ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিয়ে বেগবান করা হয়, যদিও লিখিত অঙশে তার খুব সামান্যই ধরা পড়েছে। পরবর্তী পর্বে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রে ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিকতা সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে।
তথ্যসূত্র
[১] Fazlur Rahman, New Education in Making New Pakistan (cassell and Co. Ltd. London, 1953) p. 7
[২] Pakistan. Ministry of the Interior (Education Division, Proceedings of the Pakistan Educational Conference held at Karachi from 27th Nov to 1st Dec. 1947) p. 38-39
[৩] একুশে সংকলন, ১৯৮১: স্মৃতিচারণ, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৮৭
[৪], [৫] নওবেলাল, ৪ মার্চ, ১৯৪৮
[৬] আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮
[৭] এর পূর্বে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসেই আরেকবার প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিলো। এটা গঠিত হয়েছিলো তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঞা তার আহবায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
©somewhere in net ltd.