নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পূবের স্বপ্ন ।। ছোট গল্প

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৭

পূবের স্বপ্ন
এক চীনা যুবতীর হৃদয় ভাঙা গল্প



হাসপাতালের বারান্দায় দাড়িয়ে ‘ঊ’ ।
ভেতরে প্রায় সবাই বিছানায় শুয়ে । কেউ ঘুমুচ্ছে,কেউ বা পুরনো পত্রিকা অথবা বই
পড়ছে । ‘ঊ’ এর সামনে বাগান,তা পেরিয়ে দূরে খোলামেলা লোহার গেট ।
‘উ’ বেশ টেনশন অনুভব করছে ।
আজ রোববার, থিয়ান- তার বাগদত্তা আজ তাকে খুব গুরুত্বপূর্ন খবর দেবে ।
গত হপ্তায় থিয়ান ,তার হবু স্ত্রী এবং প্রেমিকা ‘ঊ’ এর হাসপাতাল রিপোর্ট ও রক্তের নমুনা নিয়ে গেছে । থিয়ান একজন সামরিক কর্মকর্তা ।আর ঊ একটি সরকারী কোম্পানীতে ইংরেজী ভাষা অনুবাদক হিসাবে কাজ করছে। তারা দীর্ঘদিন প্রেম করেছে এবং গেল হেমন্তে ‘ঊ’ সরকারী বাড়ীতে একটি কক্ষ বরাদ্দ পাওয়ার পর উভয়েই সিদ্ধান্তে এলো আর পার্কের বেঞ্চে বসে প্রেম নয়,নয় সন্ধ্যার ঝোপঝাড়ে অসমাপ্ত সঙ্গম ।অবশেষে বাগদান এবং পুলিশ অফিসে গিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পূরন করেছে । ব্যাপারটা তাড়াতাড়িই হয় কিন্তু বাড়তি ঝামেলাটা হচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি ম্যারেজ অ্যাক্ট । সামরিক বাহিনীতেও উভয়কেই হেলথ স্ক্রিনিং করাতে হবে । ‘উ’ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছে বিয়ের আবেদন করার পরপরই । তাদের দুজনেরই তেমন কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিলনা যা কিনা প্রাক বিবাহ তদন্তে সমস্যা তৈরী করতে পারে ।
কিন্তু ‘উ’র জন্ডিস তাকে টেনে এনেছে এই হাসপাতালে ।
তার সাম্প্রতিক স্বাস্থ্যগত গোপন রিপোর্ট সামরিক হাসপাতালে গেছে । সেই থেকে ‘উ’র ঘুম নেই,খাবারে অরুচি,কারো সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে না । সন্ধ্যার আগেই ডিনার সেরে সবাই বাগানের চারদিক ঘুরে ঘুরে হাটে । পেছনের দালানগুলো থেকে অনেকেই আসে একমাত্র এই বাগান ঘুরে হাত পায়ের জড়তা কাটাতে ।
সবার গায়েই মেরুন রঙের ওভারকোট,মাথায় ঠান্ডা টুপি,পায়ে মোটা জুতা ।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলে সবাই একে একে ফিরে যায় যার যার রুমের বিছানায় । বাগানের ঝাউ গাছগুলো একাকী দাড়িয়ে সাইবেরিয়ান হাওয়ার কস্ঠ সয় সারারাত।

এটা জানুয়ারী মাস । বেইজিং এ এখন হাড়কাঁপানো শীত । ‘উ’ র মুখে তেল পানি লাগেনি গত কদিন , ঠোট মুখ ফেটে চৌচির । চুল পেকেছে আগেই,বয়স তো কম হল না । তার চোখে ক্লান্তি বাসা বেধেছে ,
‘উ’ অপেক্ষায় ।
থিয়ান এসে গেটের কাছে দাড়িয়ে উঁকি দিয়ে তাকালো ভিতরে বাগানের পাশের লম্বা বারান্দায় ।
ক্লান্ত ‘উ’ এলিয়ে পড়েছিল বিছানায় ।
দারোয়ান নির্বিকার ।
বারান্দায় কেউ দাড়িয়ে নেই যাকে দিয়ে ‘উ’ কে খবর দেওয়া যায় । থিয়ানের মাথায় পশমি মঙ্গোলীয় টুপি এবং শরীরে চাপানো সবুজ ভারী ওভার কোট । থিয়ান তার ওভার কোটের বোতাম ঢিলা করে দিলো ।
থিয়ানের সামরিক পোশাক দেখা যাচ্ছে ।
এবার দারোয়ান একটু সতর্ক নজর দিলো । বেরিয়ে এলো তার ছোট্ট ঘুমটি ঘর থেকে । শুধালো কার কাছে যাবে ? দারোয়ান হাক দিলো আগত ঝাড়ুদারকে ।বাড়ি যাবার প্রাক্কালে ঝাড়ুদার বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠে ‘উ’ কে ডাক দিলো । ঘুম ভাঙ্গা ‘উ’ উদ্ভ্রান্তের মতো দ্রুত গেটের দিকে এগুলো ।
পাইপের তৈরি হাল্কা বুক সমান গেট এর দুপাশে দুজন ।
‘উ’র চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা ।
:কেমন আছো ‘উ’ ?
:ভালো ।
খুব দ্রুত জবাব ।নিস্পলক তাকিয়ে থিয়ানের মুখে ‘উ’ । থিয়ানের চোখ কিছুক্ষন ‘উ’ এর চোখে রাখা ছিল ।
‘উ’ প্রায় ঘাড় বাঁকিয়ে সামনে ঝুঁকে স্থির নেত্রে থিয়ানের মুখ আর চোখের না বলা ভাষা উদ্ধার করার চেষ্টা করছে । থিয়ান মুখটা ঘুরিয়ে পাশে রাখা ইটের স্তূপে তাকিয়ে থাকলো ।
‘উ’ ফিস ফিস করে বলল –
:থিয়ান ! বলো , বলো শেষতক কি হলো ??
থিয়ান চুপ , তার সোয়া ছ’ফুটি লম্বা শরীরের শক্ত চোয়ালের মুখটি আজ বড় বেসামাল,মলিন ।
‘উ’এর বুঝতে বাকী রইলনা থিয়ানের নিরবতার রহস্য ।
:থিয়ান,আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করছি ,উত্তর দাও, আমার রিপোর্ট কি গ্রহন করেনি তারা ?
নিশ্চুপ থিয়ান ,আনত মাথা , দৃস্টি মাটিতে নিবদ্ধ ।
‘উ’এর দুহাত গেটের পাইপে শক্ত করে ধরা ।
:কি হলো থিয়ান , একটা কিছু বলো ,আমার তো আর সইছে না !
থিয়ান তার হাতের মোটা গ্লাভস খুলে ‘উ’এর হাতটা চেপে ধরল , তাকাল তার প্রাণপ্রিয় হবু স্ত্রী দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ‘উ’এর দিকে।
‘উ’এর এবার বুঝতে বাকী রইলনা থিয়ান কি বলবে !
থিয়ানের হাতের উষ্ণতা এড়িয়ে ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল হাত, মাথাটা ঝুঁকিয়ে ডান বাহুর উপর রেখে চোখের পানি ঠেকাল । ‘উ’এর বুক ফেটে চিৎকার বেরিয়ে আসছে। বা হাতে মুখ চেপে দৌড়াতে শুরু করল বারান্দার দিকে । ইতিমধ্যে বারান্দায় দাঁড়ানো অন্যান্য রোগীরা কথাবার্তা বন্ধ করে দেখছিল ‘উ’এর অস্বাভাবিক গতিময় দৌড় ।
‘উ’ সটান বিছানায় মুখ গুঁজে হু হু করে খুলে দিলো তার এতদিনের আশা, ভালবাসা, স্বপ্নমালার সকল ধারামুখ । রুমের চারজন রোগীর তিনজন ,আশেপাশের কজন যাদের সঙ্গে তার গত এক মাসে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে , এগিয়ে এলো ‘উ’এর পাশে । এদেরই একজন তার এই কাহিনী জানত ।
বাওলি সবাইকে ঠেলে মুখটা জোর করে তুলে ধরল ‘উ’র ।
:কি হয়েছে ? উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর বাওলির ।
‘উ’র কণ্ঠস্বর প্রায় রুদ্ধ তারপরও বলল –
:হবেনা বাওলি, থিয়ানের ঘরে আমার যাওয়া হবেনা ।
বাওলি বেরিয়ে গেটের দিকে তাকাল , থিয়ান দাড়িয়ে উদ্বিগ্ন চোখে।
পায়ে পায়ে গেটে পৌছুল । দুজনের মুখ হাসি বিহীন ।
:‘উ’ যা বলল তাকি সত্যি?
থিয়ান এবার প্রথমবার মুখ খুলল
: ওর হেপাটাইটিস টা সংক্রামক ধরনের ,তাই সামরিক কর্তৃপক্ষ এ বিয়ের ছাড়পত্র দেয়নি ।
বাওলি থিয়ানকে নিয়ে ভিতরে এলো ।
আস্তে আস্তে এ বিল্ডিং সে বিল্ডিং করে পুরো হাসপাতাল এলাকায় এই নির্মম খবরটা পৌঁছে গেল । বারান্দার নিচে বড় গাছটির নিচে দাড়িয়ে থিয়ান , আশেপাশে উৎস্যুক বালিকা , মহিলা ও নার্সরা ।
‘উ’ কিছুতেই বেরুবেনা ।
খাবার দেয়া হয়ে গেছে , চারিদিক একেবারে ফাঁকা । থিয়ান ঠায় গাছটার নিচে দাড়িয়ে । ‘উ’ তার দুঃখ ধারাকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করে এগিয়ে গেল গাছের নিচে ।
:‘উ’ ডাক দিলো থিয়ান !
‘উ’ নিশ্চুপ মাটির দিকে তাকিয়ে
:আমি ভাবতেও পারিনি এমনটি হবে আমাদের জীবনে, বলে চলল থিয়ান ।
আমি চাকরীটা ছেড়ে দেবো !
:না না না কক্ষনো নয় , তোমার ক্যারিয়ার মধ্য পর্যায়ের আর যদি ওরা তোমায় না ছাড়ে , বরঞ্চ তোমায় বেইজিং হতে দূরে পাঠিয়ে দেবে। ‘উ’ বলতে লাগলো- আমি চাই তুমি সুস্থ একজন কাউকে বেছে নাও ।
:আর তুমি ? থিয়ান অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করল !
:আমি? ‘উ’ কষ্টের হাসি হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল -আমার তো কারো সাথে যেতে হলে এই রোগ ধরা পড়বে ,তারচে একাকি জীবন কাটানোর চেষ্টা করব, জীবনে যে দুঃখ লেখা ছিল সেই দুঃখকেই আমায় বয়ে বেড়াতে হবে যতদিন বেচে থাকবো ।
:তারপরও আমি তোমায় দেখতে আসব- থিয়ান বলতে লাগলো-তোমার আমার সম্পর্ক অটুট থাকবে,বিয়ে না হয় নাই ই করলাম, একসাথে জীবন কাটানোর সুযোগ তো আছে ! থিয়ান কোমল কণ্ঠে বলল ।
‘উ’ প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকিয়ে তার অসম্মতি জ্ঞাপন করল ।
থিয়ান ও নাছোড়বান্দা ।
সারাটি চত্বরে ওরা দুজন মাত্র !
সবাই যার যার রুমে বসে হাসপাতালের খাবার খাচ্ছে ।
:‘উ’, তোমার খাবার সময় চলে যাচ্ছে !
:যাকনা, এরকম কাছেতো তোমায় আর কক্ষনো পাব না, একটু দাঁড়াই । ব্যাগ্র ‘উ’এর কণ্ঠস্বর !
:হাসপাতাল কবে ছাড়বে ?
:ডাক্তাররা কিছু বলেনি তবে আরও দুহপ্তা থাকতে হবে মনে হয় ।
:বের হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করো ।
:না থিয়ান, আমার মনে হয় তোমার উজ্জ্বল জীবনে আমি নিস্প্রভ তারা হয়ে রইবনা।তুমি আর আমার সাথে যোগাযোগ করোনা, প্লীজ , আমার অনুরোধটা রেখো ।
ওরা গেটের দিকে এগুলো।
‘উ’ দাড়িয়ে গেটের পাইপ ধরে , থিয়ান আস্তে ধীরে ছায়া নেমে আসা গাঢ় সন্ধ্যায় সামনের লাল বিল্ডিং এর কোনে গিয়ে ফিরে তাকাল,তারপর হাত নেড়ে বায়ে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
‘উ’ পলকহীন তাকিয়ে রইল থিয়ানের গমন পথে, ওখানে এখন শুধু অন্ধকার । ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.