নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শৈত্যসুখ

১১ ই মে, ২০২১ দুপুর ১২:২৩



কার্ত্তিক এলেই মাজেদ উল হক কাজের মেয়েদের বলবেন ওরে তোরা লেপগুলো ছাদে রোদ্দুরে দে, একটু ঝরঝরে হোক । বেগম মাজেদ বলেন আর কিছুদিন বাদে হলেও ক্ষতি হতো না। এখন হটাৎ করেই বৃষ্টি নামে। মাজেদ সাহেব বললেন আবহাওয়া আমি খেয়াল করি, তুমি দুঃশ্চিন্তা করোনা তো।
মাজেদ দম্পতি গত ৪২ বছরের দাম্পত্য জীবনে ঝগড়াতো তো দুরের কথা জোরেও কথা বলেননি। অবসর নেবার পর ধীরে ধীরে মাজেদ সাহেব একাকী হয়ে গেছেন। সরকারের শীর্ষ চাকুরীর ব্যাপারটাই আলাদা। তার সাথের অনেকে ক্লাবে যান , ফুর্তি করেন। তিনি পানাহার করেন না তাই ওদিকে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তার গাড়ি নেই , কখনো ছিলনা ওই সরকারের দেওয়া গাড়ি ছাড়া। প্রায় সবাই আলিশান এলাকায় থাকে বলে তার সাথে দূরত্ব বেড়েছে । প্রতিদিন সকালে বাজারে যান মাজেদ সাহেব। কেনার চেয়ে চেয়ে দেখা আর বাজার দর জানাটা মুখ্য বিষয়।
নাতনীটা বড় হয়েছে এবং অন্যান্য বাড়তি বয়েসের মেয়েদের মত তারও ফেসবুক একাউণ্ট আছে।
নানা, তোমারতো সময় কাটেনা, এসো তোমায় বিজি করে দেই।
চারিদিকে আকথা কুকথা এই সাইট নিয়ে, পর্ণ নিয়ে।
নানা মাজেদ আগ্রহের সাথে বসে গেলেন। তার কম্পিউটার জ্ঞান অফিস বয়েসের শেষ দিকে কিন্তু টাইপ জ্ঞান চাকুরীর প্রথম থেকেই। সহজেই তার ফেসবুক একাউণ্ট খোলা শেষ। নাতনী বেশ কিছু বিদেশি পত্রিকা অ্যাড করে দিল , ফ্রেন্ড রিকু বা ফলো বন্ধ শুধু নাতনী তার বন্ধু আর নাতনীর হাজার বন্ধু তারও বন্ধু হয়ে গেল।
খুব কাজের জিনিস তো ! দুনিয়াময় ঘুরছেন আর পড়ছেন , ভিডিও ক্লিপ দেখছেন।
ভাল পথ যেমন আছে তেমনি খারাপ পথ আছে । বিষয়টা হচ্ছে বেছে নেওয়া। পৃথিবী এখন মাজেদের হাতের মুঠোয় ।
সকাল নয়টায় ঠিক ঠিক নেমে গেলেন এবং সোজা বাজারে।নতুন বানানো ফুটপাতে বাজার বসছে কিছুদিন ধরে , তাতে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্নতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাজা পালং দেখে দাম জানতে চাইলেন, বলল ২০ টাকা আটি ! কপালে চোখ উঠিয়ে বললেন’ এখনতো ঘাস খেতে হবে’। লোকটি তাচ্ছিল্য করে বলল ‘ তাই খান গিয়া’। ‘ কি , কি বললে’? ‘ঘাস খাইতে বলছি’। আঙ্গুল উচিয়ে মাজেদ বললেন বেরো ফুটপাত ছেড়ে।
উলটো বলল ‘ ফুটপাত কি আপনের বাপের কেনা’।
আশেপাশে ভিড় জমে গেছে।
কেউ কেউ থামাতে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
ফুটপাতের বাজারিদের দালাল থাকে, দালাল এগিয়ে এল।
মাজেদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে ,তিনি কলার ধরে ওই শাকওয়ালাকে বের করতে টানাটানি করতেই দালাল মাজেদকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল । মাজেদ পিঠ ঠেকিয়ে ফুটপাতে পড়ে গেলেন । ভেতরের বড় দোকানীরা এসে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করতেই তিনি বললেন পিঠটা গেছে , টানাটানি করোনা ,এভাবে তোলা যাবেনা, অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।ব্যাপার গুরুতর। ভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অ্যাম্বুলেন্স দেখা গেল । দৌড়ে কজন থামাল এবং যাওয়ার ব্যাবস্থা হল। বাসায় খবর পৌঁছানো মাত্র সবাই হাসপাতালে রওনা দিল। সাবেক সচিব তাই চেনা জানা আর খুব জলদি স্ক্যান করে জানা গেল তার আগের ফেটে যাওয়া ডিস্ক এবার পুরো নষ্ট হয়ে গেছে, ওটা সরে গেছে। মাজেদ অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার করছেন।
বড় সার্জনরা তার পূর্ব পরিচিত বন্ধু আর অপারেশন সুষ্ঠু হল। বোন সিমেন্ট দিয়ে ডিস্কের জায়গা পুরন হল। এবার তিনি প্রচণ্ড ব্যাথা থেকে মুক্তি পেলেন। এম পি , সচিবগন, আই জি দেখতে এলেন। পরদিন সকালে দালালের ধোলাই হল । দাত দুটো আর নাকটা গেল বেচারার। বাকি সব্জিওয়ালারা সেকি দৌড় । বাজারিরা এম পি সাহেবের কাছে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। এম পি বাজারের দাম ঠিক করে দিলেন, বললেন যার পোষাবে সে ব্যাবসা করবে যার পোষাবেনা , করবেনা । ফুটপাত বাজার মুক্ত হল। মাজেদ এম পিকে অনুরোধ করলেন ওদের পুলিশে না দিতে , তিনি নিজেও খুব অনুতপ্ত বোধ করলেন হটাত মাথা গরম করার জন্য। তবে ফুটপাত খালি চাইলেন। এরপর আই জি তদন্তে গেলে পুরো বাজার দোকানদার বিহীন হয়ে গেল। যদি গন ধরপাকড় হয়, জেনেছে তারা একজন সচিবকে ধাক্কা মেরেছে। এদিকে অতি শান্ত শোয়েব বাবার প্রতিশোধ নিল দুটো দাত ঘুষিতে ফেলে দিয়ে। মা তীব্র প্রতিবাদ , বোন গোপনে খুব খুশি-বলল বাপ মার খাবে আর ছেলে দাড়িয়ে মজা দেখবে, ঠিকই আছে। বড় ছেলে জায়েদ শান্ত থাকল । সবাই শোয়েবকে প্রতিজ্ঞা করাল সে আর এ রকম কাজ করবেনা।
ব্যাক বোন আক্রান্ত বাবাকে ফেলে দালালের দুটো দাত নিয়ে সেকি শোক, শোয়েব মনে মনে বলল সংসদে প্রস্তাব আনলে হয়।
৭ দিন হাসপাতালে বিশ্রাম ঠিকমত হয়নি আত্মীয়দের ভিড়ে। বাসায় উঠলেন হুইল চেয়ারে বসে। আপাতত সিঁড়ি ভাঙ্গা নিষেধ তবে সমতল জায়গায় হাটবেন স্বাভাবিক ভাবে, আরো অনেক নিয়ম।
দুটি ফ্লাট কিনেছিলেন ঢাকার এক কিনারে যাতে সবাই একসাথে থাকতে পারেন। বড় ছেলে, বউমা, পৌত্র ২জন , মেজো ছেলে কাতারে , মেজো বউমা ও এক পৌত্রী এবং মেয়ে ওই বাড়ির ৪তালায় ভাড়া থাকে তার একটি কন্যা ,সব মিলে মাজেদের আড্ডা । এক হাড়িতে রান্না , বড় টেবিলে দলেবলে খাওয়া দাওয়া। মাজেদ বলেন আমি মরে গেলে হাড়ি ভাগ করিস।
পিসিতে বসেন চমৎকার বিদেশী একটা চেয়ারে যা আগে দেখেননি, মনে হচ্ছে এটা কোমর ভাঙ্গা লোকেদের জন্য বানানো হয়েছে। হাটেন এপাশ থেকে ওপাশে । বেগম মাজেদ ওরফে জোহরা ভীষণ ব্যাস্ত দুজন কাজের লোক নিয়ে।মাজেদ পিচ্চিদের নিয়ে বসেন খেতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রন করেন আরও কজন।
জীবনটা মধুর মনে হয় এই নাতি পুতিদের বুকে নিয়ে।এম বি এ শেষ করেই বড়টি ব্যাবসায় নেমেছিল এবং সফল বটে । বাবার নির্দেশ মানেনি বরং বলেছিল দেশে উৎপাদনশীল অনেক খাত আছে যাতে সফল হব আমি। মেজটা কাতারে এনার্জি বিষয়ক প্রকৌশলী । ভালই করছে , বছরে একবার দেশে আসে। ছোটটা ১০টায় ঘুম থেকে ওঠে। জামাই সরকারি কর্মকর্তা । মেয়ে একটি নামি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। আঘাতের বদৌলতে ছোটটি এখন ভোরেই উঠে বাবাকে ডাক্তারের নির্দেশ মোতাবেক বিছানা থেকে ওঠায় । টয়লেটের বাইরে দাড়িয়ে ও খবরের কাগজ পড়ে। বাবার শরীরের নিন্মাংশ সাফসুতোর সেই করে। গোসল করানো এবং আবার বিছানায় শোয়ানো । এসব কিছুকাল চলবে তারপর মাজেদ নিজেই আস্তে ধীরে এসব করতে পারবে। একজন মেসেজ দিতে আসে বিশেষ করে কোমর থেকে নিচের আঙ্গুল পর্যন্ত । একটি জরুরী কলিং বেল শোয়েবের রুমে ।
একটা ইলেকট্রিক মোটর চালিত ওয়াকিং মেশিন এসেছে। তাতে মাজেদ ধীরে দুবেলা হাঁটেন । আস্তে ধীরে সবাই তাতে হাঁটছে এবং দৌড়াচ্ছে । শোয়েব বাজারে যায় এবং না চাইতেই শাক পাতা হাতে চলে আসে । গম্ভীর হয়ে টাকা দেয় ।সব্জিওয়ালাদের কুর্নিশ ভঙ্গিটি তার বেশ মজা লাগে। মনে মনে বলে মাইরের উপর ওষুধ নেই, সব শালা সোজা ।
মাজেদ এখন অনেক ভাল এবং নিজেই প্রায় সব করতে পারেন ।
মাঘ শুরু । ঢাকাতেও কিছুটা টের পাওয়া যায়। ভোরের কুয়াশা ঢাকাকেও আচ্ছন্ন করে তখন মাজেদ মন খারাপ করেন টাঙ্গুয়ার হাওরে তাহিরপুরে তাদের গ্রামের বাড়ির কথা ভেবে। জন্মস্থান, শৈশব থেকে কৈশোর গ্রামে তারপর ময়মনসিংহে কলেজ করে ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন।
পুরো হাওরটা যখন ঘন কুয়াশায় ভরে থাকে তখন মনে হয় প্লেনে মেঘের মধ্যে আছে বসে । স্ত্রীকে রাতে ফিস ফিস করে মনের ইচ্ছা জানায়। জোহরা বলেন দেখ ডাক্তার কি বলে তারপর যাও। মেসেজ করা ছেলেটি বলল স্যারের কোমর থেকে পায়ের স্নায়ু বেশ সবল এখন , শুধু কুঁজো হওয়া আর ভারি জিনিস তোলা আজীবন নিষিদ্ধ।
জোহরার মনে শান্তি ভর করে।
শোয়েবকে নিয়ে জায়েদের মাইক্রোবাসে রওনা করলেন ভোরে ।
তাহিরপুরের উপরে পাকা রাস্তা হয়েছে আগেই। আগে তাদের যাতায়াত হত নৌকায় । সচিব হলে মন্ত্রিকে ধরে এই রাস্তার ব্যাবস্থা হল।
মাঝপথে নেমে হাঁটাহাঁটি আর চা খেলেন।
দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলেন।
তাকে স্বাগত জানাতে শ’ খানেক লোক হাজির। মেঝ ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। পাচ বছর পরে গ্রামে এসেছেন , পৌত্র নাতি নাতনিদের অনেককেই দেখেন নি বা বড় হয়ে গেছে। তাদের আদর করে সবার সাথে হাত মেলালেন। হেটেই দুদিকের গাছ গাছড়ার মাঝের রাস্তা দিয়ে সামনের উঠোনে দাঁড়ালেন । প্রথমেই তার মাটির ঘর। উচু মাটির পোতা আর গোটা উঠোনে গোবরের লেপ দেওয়ায় চকচক করছে। তার টিনের চালে লাউ গাছ তরতর করে বেড়েছে। মাটির সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলেন বাঁশের রেলিং ধরে। বারান্দায় মাজেদের বাবার স্মৃতিময় ইজি চেয়ারখানা রাখা।বড়ভাই আগেই চলে গেছে অনন্ত যাত্রায়। তার ছেলে দুটো বিয়ে থা করে বাবার মাছের ব্যাবসায়ে ভীষণ ব্যাস্ত থাকে। ঘরটি একসময় বাড়ির সামনের দহলিজ ঘর ছিল এখন মাজেদের মাটির ঘর। মাটির দেওয়াল। উপরে টিন। ঘরে দুদিকে দুটো পালং , মাটির দেওয়ালে একটা দরজা বসেছে , উৎসুক হয়ে দেখলেন একটা টয়লেট আর তাতে হাই কমোড , হেসে ফেললেন। কলও বসেছে , পেছনে হাসিমুখ মেঝ ভাই বললেন উপরে ট্যাংকি আর পানি তোলার মটরও আছে ।
দুপুরে মাজেদ চার রকম মাছ আর সারছাড়া শীতের সব্জি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছেন।
ভর সন্ধ্যায় বিশ্রাম থেকে উঠলেন। উঠোন ভর্তি লোক। চেয়ার অনেক, তাতে মানুষ ভর্তি , অনেকেই দাড়িয়ে, ওপরে শামিয়ানা টাঙ্গানো। মাজেদ হাসলেন। বড় লাইট দিয়ে রাতের আড্ডা হবে। এর মধ্যেই সুনামগঞ্জের ডি সি আর থানার ও সি এলেন। চা দেওয়া হল বড় একটা কেটলি থেকে ঢেলে ঢেলে প্লাস্টিকের কাপে। বাইরের অনেকেই চা শেষ করে কাপটি সযত্নে চাদরের নিচে রেখে দিল।খাটি দুধের সাথে নতুন গুড় দিয়ে জ্বালানো চা যে কি অমৃত স্বাদ তা যে না খেয়েছে তাকে বোঝানো যাবেনা। ডি সি তার অনেক জুনিয়র কর্মকর্তা ছিল ।তাদের জানাশোনা খুব ভাল ছিল। খবর নিল শরীরের । ও সি মেঝ ভাইকে বলল টহল এদিকে থাকবে , আপনাদের খবর নেবে। ওরা আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল।
শীত জেকে ধরেছে মাজেদকে । তিনি মোটা জ্যাকেট , তার ওপরে কাশ্মিরি শাল, মাথায় উলের মাঙ্কি ক্যাপ, পায়ে উলের মোটা মোজা । তাতেও শীত মানছে না। আবার চা খেলেন শরীর গরম করার জন্য।কৈশোর আর যৌবনের সেই ড্যাম কেয়ার মাঘের শীত আর নেই। পড়ন্ত বয়েসে কুচকে যাওয়া চামড়ায় মাঘ জেকে ধরেছে।যেন বলছে ‘পাঁচটি বছর অপেক্ষায় থেকেছি – আসিসনি কেন’? বড় অভিমানী কণ্ঠ , ভালবাসায় ভরা। যাক তার মাটি আর খড় মেশানো দেওয়াল ঘরের ভেতর খুব গরম থাকে।মালসায় তুষের আগুন ঘরকে গরম রাখে দারুন।
চেয়ারে সামনের দিকে বসা তার বন্ধুরা শুধু আছে, বাকিদের অনেকেই চলে গেছে। বাড়ির সবাই অন্য কিছু গ্রামবাসীর সাথে ওদিকটায় আগুন পোহাচ্ছে। তাদের মাঝেও শুকনো পাতা , ডাল পালা জ্বলছে, বেশ আরাম নিচ্ছে সবাই।
আলাপে আলাপে লীগ দল চলে এল। তুমুল চলছে । উত্তেজনায় কেউ কেউ চাদর খুলে দাড়িয়ে পড়েছে । ঝগড়া দেশী রাজনীতির রন্ধ্রে মিশে গেছে। উপভোগরত মাজেদ চুপ করে বসে থাকা মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞাসা করলেন কিরে জামাত তুই মাঠে নামোস না ক্যান, জমতাছেনা ক্যান জানি !! গম্ভীর উত্তর এলো ‘ জাতীয় পার্টি নাইতো তাই নামতাসি না’। হো হো উচ্চ হাসিতে গাছে বসা রাতের পাখিগুলো ঝটপট ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল।
রাতের বিছানায় নরম মোটা বিদেশী কম্বল পেলেন। শোয়েব যেন একটা বস্তায় ঢুকে শুয়ে আছে। এই একদা তিনদিক খোলা দহলিজটির দেয়াল তার নির্দেশেই মাটির ব্লক দিয়ে তৈরি হয়েছে কেননা তিনি এলে অনেকে দেখা করতে আসে। বাকি বাড়ীগুলো পেছনে পর পর সাজানো । মেজভাই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সবার উপদেশ কানে না নিয়ে গ্রামেই দোতলা বাড়ি করেছেন ফ্লাট না কিনে। ছোট ভাই হবিগঞ্জে বাড়ি করেছে , কালে ভদ্রে আসে। শেষ মাথায় বড় ভাইয়ের পাকা দেয়াল উপরে টিন দেয়া বাড়ি। চার পাশ দিয়েই বড় বড় গাছের ঘন বাগান। গাছ কাটা নিষেধ আগাছা ছাড়া।ঢাকা থেকে গাছের চারা পাঠিয়ে দিতেন আর আগেতো গাছ ছিলই। কি গাছ নেই তাদের বাগানে !
সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুঝলেন বাইরে ঘন কুয়াশা। হ্যা অদ্ভুতরকম কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে আছে। কেউ নেই আশেপাশে,একটু গলা খাকারি দিয়েআবৃত্তি করলেন
“একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবেনা কেউ খুজে আর , জানি;
হৃদয়ের পথচলা শেষ হল সেই দিন- গিয়েছে সে শান্ত হিম ঘরে,------।
পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলেন, তার পৌত্রী, হাসি মুখে মাটির বাসনে ঢাকা কিছু নিয়ে সলজ্জ দাড়িয়ে । দিদি, এটা কি এনেছ? রসের পিঠা ,দাদাভাই। এখানে বইসা খাবা না বারান্দায় দিমু। একজন কিষাণ চেয়ার নিয়ে দাড়িয়ে। এখানেই খাব। আহা, রসে ভেজানো পিঠে ফুলে আছে , নারকেল আর গুড়ের অমৃত , নিশ্চয়ই বড় ভাবীর হাতে বানানো। দাদা পৌত্রী মিলে পিঠে খেলেন যা দিয়েছিল সবটুকু, চেটে পুটে ।

এবার বাড়ির ভিতরের অংশে সবার সাথে দেখাশোনার পর্ব । ভাবী , ভ্রাতুস্পুত্র – পৌত্রী ও পোতা-পুতনী সব মিলে জমজমাট অবস্থা। বড় ভাবী মাজেদের থেকে বড় কিন্তু বেশ আছেন । ছেলেরা ভোরেই হাওরে যায় মাছের নিকাশ করতে। আজ তারা কাকার সাথে দুপুরে খাবে। কুয়াশা কেটেছে বেশ। বাগানে ঢুকলেন গাছপালার অবস্থা দেখতে। মাজেদের পিছনে নাতি পোতাদের বিশাল মিছিল। পাতাগুলো এখনও শিশিরে ভেজা। বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করলেন এই গাছটার নাম বলতো । সবচে ছোটটি আগে ভাগেই বলে উঠলো এই গাছের নাম ট্রি , হো হো হাসিতে বাগান মুখরিত। বাগানে দাড়িয়েই গাছের গল্প বললেন। এবার গরুর গোয়াল, ১৬ টি গরু, এড়ে ৪ টি আর গাভী ১২ টি। এদের দুধ তিনি খাচ্ছেন ও পরিবারের সবার খেতে হয় বাধ্যতামুলকভাবে। সবচে পুরনো গাভীটি তাকে দেখে উচু গলায় হাম্বা করে উঠলো। হাত বুলিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। গরুগুলো মশারির নিচে থাকে। গায়ে পুরু চট দিয়ে বানানো পোশাক।
দুপুরে লম্বা খাওয়া ভাইপোদের সাথে, কথাবার্তা , নতুন পদ্ধতি ইত্যাদি । এরা সবাই গ্রাজুয়েট । চাকুরীর আশা না করে বাবার মাছের ব্যাবসায় নেমে পড়ল । ওরাই ভাল আছে অন্তত কেরানীর জীবন থেকে।
সবাই মিলে হাওর দেখতে গেল। হাওরের পাড়ে তেমন ঠাণ্ডা নেই। এই হচ্ছে মাজেদের অনেক স্মৃতিময় টাঙ্গুয়ার হাওর। পাখি আর হাসে ভর্তি । কত বাঁশের মাচা করা হয়েছে পাখি বসার জন্য । সাইবেরিয়া থেকে এই পাখিরা উড়তে থাকে । মঙ্গোলিয়া , চীন, তিব্বত হয়ে বাংলাদেশে। আবার ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে শুরু হবে ফিরতি যাত্রা। মাজেদ বলছিলেন তার পিচ্চি সঙ্গীদের। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে দাদাভাইয়ের কথা। মেঘালয়ের হিমালয় পাহাড়ের অংশ দিয়ে এই পানি গড়িয়ে এই হাওরে পড়ে। ছোট ছোট নৌকায় চড়ে বসলেন সবাই। পানি খুব টলটলে এবং স্বচ্ছ । তীক্ষ্ণ নজরে আবিস্কার করলেন মহাশোল মাছ নৌকার নিচ দিয়ে ঘুরছে। কিছু নতুন জাতের পাখি আবিস্কার করলেন। তিনি একসময় পাখি ধরা নিষিদ্ধে সরকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তারপরও চুরি করে সিলেটে বিক্রি হয়।
খুব ইচ্ছে করছিল পানিতে নেমে গোসল করতে, কিন্তু পানি ছুতেই শরীর কেপে উঠলো। সন্ধ্যা নামতেই শহুরে শরীরে মাঘের কাপন ধরল। সবাই মিলে ফেরত এলেন। মোবাইলে বড় ভাবীকে বলেছিলেন গরম চায়ের কথা। ছোটবেলায় যেমনটি চুলার পাশে বসে শীত নিবারন করতেন আজ ঠিক তেমন করে চেয়ারে বসে আগুন আর চা উপভোগ করতে লাগলেন। হা হা করে বড়ভাবী এগিয়ে এলেন । মাজেদ বললেন মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, পিচ্চিগুলো দাদা ভাইয়ের সাথেই চুলার কাছে বসে পিঠা খেতে লাগলো ।
এরই মধ্যে শোয়েব ও তার বড় ভাইরা মিলে ব্যাটারি ট্যাক্সি করে নানা সাইজের সোয়েটার , উলের টুপি, চাদর , মোজা , হাতের গ্লাভস নিয়ে এলো। সবাই পেল ও প্রতিবেশীদের দেওয়া হল। ওদের অল্প কাপড়ে শীত নিবারনের প্রচেষ্টায় মাজেদ কষ্ট পাচ্ছিলেন। এসবের খরচা কাতারের মেজপুত্র দিচ্ছে। টেলিফোনে শুনেই বাবাকে বলল তুমি ব্যাবস্থা কর আমি টাকা পাঠাচ্ছি।
রাতে কম্বলের নিচে শুয়ে শোয়েবের বড় মোবাইলে খবর দেখলেন। দেশ বিদেশের খবর দেখা তার অবসর জীবনের অংশ হয়ে গেছে। প্রতি রাতেই স্কাইপিতে কথা হয় ঢাকায়, ওরা মানে ঢাকার পিচ্চি গ্রুপ লাইনে দাড়িয়ে কথা বলে। এখানে অজগর সাপ আর বাঘ এবং ভালুক আছে কিনা তা নিশ্চিত করে। মাজেদ বলেন এখানে বন্দুক আছে, ওরা বলে বন্দুকগুলো র্যাাবের বন্দুকের মত কিনা !
পরদিন কাছেই ৫ কিলো দূরে শ্বশুরবাড়ি। ২০ কেজি মিষ্টি আর ঢাকা থেকে জোহরার দেওয়া গিফট নিয়ে পৌঁছুলেন । উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং দুপুরে চীনা হাসের অসাধারন স্বাদের মাংস দিয়ে সেমাই পিঠা। পেট পুরেই খেলেন। বিকালে চা নাস্তা খেয়ে ফেরত এলেন সামনের বছরে জোহরাকে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
রাতে আঁধারে কম্বলের উষ্ণ আবরনে শুয়ে মাজেদ স্মৃতিচারণ করছিলেন সবচে কাছের বাড়ির তার সমবয়সী সায়মার কথা। কি প্রেম দুজনের , চিঠিতে, কারন প্রেম একটি নিষিদ্ধ বিষয় ছিল তখন। এক দুবার রাতের আঁধারে বাগানে মিলিত হতেন দুজনে। সায়মার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে চলে গেল ঘর-সংসার করতে। সায়মা কোথায় আছে তিনি জানেন না। আচ্ছা সায়মা কি তাকে মনে রেখেছে?? হাসেন একা একা। সায়মার কঠিন বাহুবেষ্টনী আর চুলের নারকেল তেলের গন্ধ অনুভুতি এখনও এই অর্ধশতাব্দী বাদে পান তিনি। হটাত জোহরার ঝামটা মাখা মুখখানি ভেসে উঠতেই মাজেদ দ্রুত চ্যানেল বদলে জি বাংলা থেকে বি টি ভিতে চলে এলেন।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস তার চিরকালের। ভোরের আলোহীন কুয়াশাচ্ছন্ন বাইরের দৃশ্যটা ভিতরে শুয়ে টের পান। সুনসান চারিদিকে কিছু পাখির ডাক আর শিশির পতনের টুপটাপ আওয়াজ শুনে বুঝলেন বৃষ্টি হতে পারে। ঠাণ্ডা বেশ চড়া । প্রতিদিন ভোরের পিঠা একটু নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। শীতকাল বেশি প্রিয় মাজেদের। চাকুরি জীবনে শীতেই ছুটি উপভোগ করতেন সপরিবারে এই বাড়িতে । হিমালয় থেকে ধেয়ে আসা কনকনে শীত শরীরে কাপন ধরালেও মনকে উষ্ণ রাখত।
দুপুরে গায়কদল এলো শাহ আব্দুল করিমের আস্তানা থেকে। করিম মারা গেছেন কবছর হল। শীতে তাদের ডাক পড়ে পুরো সিলেট জুড়ে । করিম বেচে থাকতে ফাল্গুন মাসে কালনি নদীর পাড়ে দিরাই গ্রামে উৎসব হত । দলের প্রবীন নবীন গায়ক বাদকদের সাথে স্মৃতিচারন করলেন অনেক। সজ্জন করিমের জন্য যতটুকু সাধ্য মাজেদ করেছেন। গান শুরু হল। আহা মন ভরে গেল । ঢাকাতে করিমকে বাউল বানিয়ে ছেড়েছে আর ব্যান্ড গায়করা করিমের গান গাইছে নিজেদের নাম করে। ছিঃ , কি লজ্জা!
গান চলছে ‘ কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু----, কোন মিস্তিরি নাও বানাইল--, তুমি সুজন কাণ্ডারি---‘। আসর জমজমাট। বিকালে চা খাওয়ার পর আবার শুরু। মানুষে সয়লাব উঠোন। চাদর কম্বলে ঢাকা দর্শক মুগ্ধ হয়ে শুনছে । রাত ১১ টায় আসর শেষ। রাতে করিমের দলের সাথে খেলেন একসাথে। ওদের শোয়ার আয়োজন ছোট ভাইয়ের খালি ঘরে।
ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মাজেদের ঘরে সেই মালসায় তুষের আগুন, ঘর গরম হয়ে আছে। গরম ডাল কাচা মরিচের স্বাদে শরীরটাকে গরম রেখেছে, আরামই লাগছে।
প্রতিদিন সকালে তারই একদা লাগানো গাছের ফুল পাচ্ছেন হাতের মধ্যে । গাঁদা ফুলে বাড়ি ভর্তি। শিউলি তো অসাধারন সাথে জুই,জবা, গোলাপ -----।
গ্রামে এলেন-মাঘী পূর্ণিমা মিস করবেন?
সন্ধ্যায় বড় নাও সাজিয়ে শুধু বড়রা গেলেন । হাওরের মাঝ বরাবর অবস্থান নিলেন । কুয়াশা কম । চাঁদ উঠলো এবং আস্তে ধীরে ওপরে উঠতেই কুয়াশার আবরনে রংধনুর বৃত্ত চাঁদকে ঘিরে রইল। চাঁদ অত পরিস্কার নয়। তবুও একটা আলাদা মজা আছে এই দৃশ্যে । রাতে ঘাটে নাও ভিড়ল । মাজেদের মনটা ফুরফুরে।
আজ ফেরার দিন। খুব ভোরে প্রস্তুতি নিলেন । রাতে ঢাকা থেকে আসা গাড়িতে মাছ, পিঠার হাড়ি, শীতের সব্জি উঠলো। সবাই মাজেদকে বিদায় জানাতে এসেছে সেদিনের দেওয়া নতুন কাপড় পরে। আবার বিদায় সম্ভাষণ । ছোট পৌত্রকে বললেন সব গাছের নাম মুখস্থ করবে , আমি আবার এসে শুনব।
গাড়িতে উঠতে উঠতে মাজেদের চোখে পানি এসে গেল। আর কি দেখা হবে এদের সাথে, এই বৃক্ষমালার সাথে। বাচ্চারা গাড়ির পিছনে দৌড়াচ্ছে । গাছের পাতার শিশিরবিন্দু তার চোখের পানির মত চকচক করছে। তার হাতে একগাদা নানা রকমের ফুল, পৌত্র-পুত্রীরা দিয়েছে।
গাড়ি বড় রাস্তায় উঠলো।
হাল্কা কুয়াশা কেটে গাড়ি ঢাকার পথে।

প্রথম প্রকাশ ৫ মে ২০১৬ , নক্ষত্র ব্লগ ।। সর্বস্বত্ব লেখক শাহ আজিজ

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৫৬

চাঁদগাজী বলেছেন:




একসাথে অনেক বিষয়

১১ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৬

শাহ আজিজ বলেছেন: গল্প তো , বিষয় তো একাধিক থাকতে পাড়ে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.