নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। যন্ত্র বসিয়ে সুন্দরবনে ছাড়া ৫ কুমির কোথায়, তাদের জীবন নিয়ে কী জানা গেল

২৮ শে আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১১:১৩



জুলিয়েট, মধু, পুটিয়া, জোংড়া ও হাড়বাড়িয়া। পাঁচটি কুমিরের নাম। তাদের কারও জন্ম সুন্দরবনের খালে, কেউ এসেছে লোকালয় থেকে উদ্ধার হয়ে, কেউ বন্দিজীবন কাটিয়েছে বছরের পর বছর। গবেষকেরা এই পাঁচ কুমিরকে বেছে নিয়ে পিঠে বেঁধেছিলেন আধুনিক স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার। উদ্দেশ্য ছিল, অচেনা সুন্দরবনের ভেতরে কুমিরেরা কীভাবে জীবন কাটায়, তা জানা।

২০২৪ সালের মার্চে শুরু হয়েছিল এই অভিযাত্রা। করমজল প্রজননকেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল জুলিয়েটকে। একসময় অনেক ডিম দিলেও শেষ কয়েক বছর আর বংশবিস্তার করেনি। তাই গবেষকেরা ভেবেছিলেন, মুক্তজীবনে ফিরলে হয়তো আবার নতুন গল্প শুরু হবে।

মধু নামের কুমিরটিকে আনা হয়েছিল যশোরের সাগরদাঁড়ি এলাকা থেকে। বন্দিদশার পর সুন্দরবনের নদীতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। পুটিয়া নামের কুমিরটি করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রেই জন্মেছিল। খাঁচার ঘেরাটোপে বড় হচ্ছিল সে। পরে সুন্দরবনের নদীতে ছাড়া হয় তাকে।

শরীয়তপুর থেকে উদ্ধার হওয়া জোংড়া ছিল সবচেয়ে অস্থির ও ভ্রমণপিপাসু। সুন্দরবনে ছাড়ার পর মুহূর্তেই হারিয়ে গেল এক নদী থেকে আরেক নদীতে। আর হাড়বাড়িয়া নামের কুমিরটি ছিল সুন্দরবনেরই সন্তান, যে নিজের জায়গা ছেড়ে যেতে চায়নি।প্রথম দিনগুলোয় স্যাটেলাইটের প্রতিটি সিগন্যাল যেন একেকটা গল্প বলত। সিগন্যাল প্রতিদিন জানান দিচ্ছিল, কোন কুমির কোথায় আছে, দিনে কতটা এলাকাজুড়ে ঘুরছে, আবার ফিরে আসছে কোন খালে। কুমির নিয়ে এই গবেষণা দলের সদস্য খুলনা বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের স্মার্ট ডেটাকো-অর্ডিনেটর মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা বসে থাকতাম মানচিত্রের সামনে, একেকটা বিন্দু এগোত, থামত, আবার ঘুরে যেত। মনে হতো, যেন আমরা কুমিরদের জীবনছন্দ শুনছি।’

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার সচল থাকা অবস্থায় জুলিয়েট ৭১ দিনে অতিক্রম করে ১৪৫ কিলোমিটার, মধু ১২৭ দিনে ১৭০ কিলোমিটার আর পুটিয়া ৮৩ দিনে ২০৪ কিলোমিটার। হাড়বাড়িয়া শান্ত স্বভাবের, একই খালের মধ্যে থেকে ৫২ দিনে চলেছে মাত্র ৫১ কিলোমিটার। তবে অভিযাত্রী হিসেবে আলোচনায় এসেছে জোংড়া, যার ট্রান্সমিটার ৬৪ দিন সচল ছিল। সুন্দরবনের জোংড়া খালের মুখে ছাড়া ওই কুমির বাগেরহাট, পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জের নদ-নদী ঘুরে আবার ফিরে এসেছে নিজ নিবাসে। মোট ৪৭৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে জোংড়া গবেষকদের বিস্মিত করেছে।

কিন্তু একদিন থেমে গেল প্রযুক্তি। ট্রান্সমিটার আর কাজ করল না, সিগন্যাল হারিয়ে গেল। কুমিরগুলো কোথায় আছে এখন, কেউ জানে না। গবেষণা দলের প্রধান আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার এ বি এম সরোয়ার আলম দীপু বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম হয়তো ৬০ থেকে ৭০ দিনের মতো তথ্যই হাতে আসবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কয়েকটি কুমির থেকে পেয়েছি এক শ দিনের বেশি তথ্য। তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেলেও সেই তথ্য আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ।’গবেষণায় নেতৃত্ব দেয় আইইউসিএনের বাংলাদেশ টিম, সহযোগিতায় ছিল জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিআইজেড)। অংশ নেন অস্ট্রেলিয়ার কুমির গবেষক সামারাভিরা ও পল বেরি। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন খুলনার বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও গাজীপুরের ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টারের কর্মকর্তারা।

২০২৪ সালের ১৩ মার্চ সুন্দরবনের ভদ্রা খালে জুলিয়েট ও মধু নামে দুটি কুমিরের পিঠে স্যাটেলাইট লাগিয়ে ছাড়া হয়। পরের দিন ১৪ মার্চ হাড়বাড়িয়া খালে ছাড়া হয় একটি কুমির আর ১৫ মার্চ জোংড়া নামে কুমিরটি ছেড়ে দেওয়া হয় জোংড়া খালে। দীর্ঘ ১০ মাস বিরতির পর চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি পুটিয়া নামের কুমিরটি ছাড়া হয় চরপুটিয়া খালে।

গবেষকেরা বলেন, কুমিরের শরীরে বসানো স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারগুলো সুন্দরবনের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করে যুক্তরাষ্ট্রে বানানো হয়েছিল। ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্রের ক্ষুদ্র অ্যানটেনা সরাসরি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং প্রতি ঘণ্টায় লোকেশন আপডেট দেয়। কুমিরের মাথার ওপরের আঁশে ছোট ছিদ্র করে ট্যাগটি বসানো হয়। দুই গ্রামেরও কম ওজনের এই হালকা চিপ কুমিরের কোনো ক্ষতি করে না বলে দাবি খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদের।

গবেষণা দলের সদস্য মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৯ এপ্রিল পুটিয়ার শেষ তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। আগে অন্য চারটি কুমিরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এখন কেউ জানে না জুলিয়েট কোথায়, মধু কোন নদীতে, পুটিয়ার কী অবস্থা বা জোংড়া কোথায় গেছে। হাড়বাড়িয়া নিশ্চিন্তে খালেই আছে কি না, সেটাও অজানা। তবু এই অভিযান আমাদের খুলে দিয়েছে কুমিরের জীবনের অদেখা জানালা। এই পাঁচ কুমির শিখিয়েছে সুন্দরবনের জীবন একঘেয়ে নয়, প্রতিটি কুমিরের আলাদা গল্প আছে। হারিয়ে গেলেও তাদের কাহিনি রয়ে গেছে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে লোনাপানির কুমির কেবল সুন্দরবনে দেখা যায়। ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে এই প্রজাতির কুমিরের সংখ্যা ১৫০ থেকে ২১০টির মধ্যে, তবে বংশবিস্তার কমছে। আইইউসিএন লোনা পানির কুমিরকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য ২০০০ সালে সুন্দরবনের করমজলে সরকারিভাবে কুমির প্রজননকেন্দ্র স্থাপিত হয়, যেখানে বর্তমানে ৯২টি কুমির আছে।

করমজল প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, ‘আমরা কুমিরের জন্ম, ডিম দেওয়া, বাচ্চা ফুটানো, খাদ্যাভ্যাস ও আয়ু সম্পর্কে জানতাম, কিন্তু চলাফেরার তথ্য ছিল না। স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপনের মাধ্যমে তা আমরা জানতে পেরেছি।’

বন অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, ‘আমরা মূলত এই গবেষণার মাধ্যমে সুন্দরবনে কুমিরের আচরণ ও বসবাসের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করেছি। এর আগে বিভিন্ন প্রাণীতে স্যাটেলাইট স্থাপন করা হলেও লবণপানির কুমিরের ক্ষেত্রে এটাই প্রথম। ট্রান্সমিটার সচল অবস্থায় পাঁচ কুমির প্রায় ১ হাজার ৪৩ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রম করেছে। যদিও লবণাক্ততার কারণে সিগন্যাল এখন বিচ্ছিন্ন, তবু ধারণার চেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যতে বিলুপ্তপ্রায় কুমির সংরক্ষণে সহায়ক হবে।’

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.