![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মজনু মজনু ...
স্যার মজনু নাই।
কে? করিম?
জে স্যার।
বাইরে কেন, ভিতরে আয়।
সন্তর্পণে মৃদু পায়ে ছইয়ের পর্দা সরিয়ে ভেতরে এলো করিম। বড় নৌকা, নাম বিলাসপুর, আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ একে চেনে ‘শিকদারের বজরা’ নামে। যত মানুষ যমুনার এই ঘাটে গোসল করতে আসে, সকলে একবার করে হলেও দোয়া করে যায় ‘আল্লা , শিকদাররে সহ নাও ডারে ডুবাইয়া দেও’। যদিও কারোর দোয়া এখন পর্যন্ত কবুল হয়নি,তবুও মানুষের অসীম ধৈর্য, কাজ হচ্ছে না জেনেও দিনের পর দিন একই দোয়া করে যায়।
মজনু গেছে কই?
গোডাউনে, মাল আনতে।
তোর কথার দম পাইনা কেন ? ঐসব নিয়া এহনো পইড়া আছোস নাকি ?
অল্প আলোয় এক ঝটকায় শিকদারের মুখের দিকে তাকায় করিম, কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। আলতো করে কোমরে হাত ছোঁয়ায়, ছোট চায়নিজ ছুরির স্পর্শ নেয়। ইচ্ছে হচ্ছে এখনি দৌড়ে যেয়ে ছোট ধারালো ছুরিটা দিয়ে ফেঁসিয়ে ফেঁসিয়ে গলার নলিটা দু টুকরা করে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়। ভুলভাল কিছু একটা করে বসলে নিজের আর বেঁচে থাকা হবে না। বজরার নয়জন মাল্লা একেকজন হায়েনার মতোন নিষ্ঠুর আর কুকুরের মতোন প্রভু ভক্ত। শিকদারের গায়ে সামান্য ফুলের টোকা পড়লেও এরা বাঘের মতোন ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কিরে কতা কস না ক্যান ? বোবা হইয়া গেলি নাকি ?
শিকদারের কথায় হুশ ফেরে করিমের।
না স্যার, ঐসব নিয়া পইড়া থাকলে চলবো নাকি, যা গেছে তা তো গেছেই।
এই তো পুলা মাইনসের মতোন কতা। ভুলিস না তুই শিকদারের লোক, একটা মাইয়া গেছে তো দশটা আইনা দিমু। যেইডারে ভাল্লাগবো খালি তুইলা আনবি, হের পর আমি তো আছিই। তোরা দুইডা আমার এক্কেবারে কাছের লোক, খুব ভালবাসি তোগো।
জে স্যার জানি।
মাইয়াডা যে তোর ধরা আছিল তা আগে জানলে তুলতাম না। আমি মনে কয় বেশী পেঁচাল পারতাছি, হাহা বেশী পেঁচাল পারতাছি হাহা... পেটে মাল পড়লে যা হয় আরকি। এহন যা , মজনু আইলে ভেতরে নিয়া আহিস। নতুন ওসি’ডা ঝামেলা করবার চাইতাছে। মজনুরে টেকা দিয়া পাঠামু , কাম হইলে হইলো না হইলে কেল্লাফতে।
মাইরা ফেলবেন লোকডারে? চোখ মুখ শক্ত করে তাকায় করিম।
তুই তো আর খোঁজ খবর রাহোস না, বহুত ঝামেলা করতাছে। উপরে কতা কইছি , সমস্যা নাই। এহন যা যা, কতা কইয়া নিশা ছুটাইয়া দিস না।
করিম বেড়িয়ে এলো। চারদিক নির্জন, ঘাটের আশেপাশে কেউ নেই। মাঝিমাল্লা সব বজরায়। চারপাশে ভালভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। ওপাশে দুবার রিং হতেই এক ব্যস্ত কন্ঠস্বর রিসিভ করলো।
হ্যালো কে?
করিম।
নতুন কোনো খবর আছে নাকি ?
মজনু যাইতাছে, টেকা নিয়া মিল হইয়া যান।
তুমি কী বলছো তা বুঝতে পারছো ?
আমি কী কইছি তা আপনে বুঝবার পারছেন ?
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি, তাই হবে।
রাখি বলেই ফোনটা রেখে দিলো করিম। থানার নতুন ওসি, বেশ ভালো লোক। করিম এর আগে সৎ পুলিশ দেখেনি। থানায় এই প্রথম একজন এলো যে কিনা শিকদারের কাছে এখনো মাথা নীচু করেনি। যুদ্ধের ময়দানে জয়ের হাসি হাসতে হলে মাঝে মাঝে পিছিয়ে যেতে হয়, এর নাম পরাজয় নয়, এটা কৌশল। এই কৌশলেই শিকদারকে শেষ করতে হবে।
কীরে কার সাতে কতা কস ?
চমকে পিছনে ফিরে তাকায় করিম। মজনু।
তাসমিনার খালতো ভাই, একটুও না ঘাবরে মিথ্যাটা বললো করিম।
তুই ওহনো ওগো সাতে যোগাযোগ করোস ? খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মজনু।
যোগাযোগ করি না, কী মনে কইরা জানি ফোন দিছিলো।
দেখ করিম, তোরে সাফসাফ একটা কতা কইয়া দেই, স্যারের বিরুদ্ধে যাইস না, গেলে কিন্তু তোর সামনে বেকের আগে আমিই খাড়ামু।
কী সব উল্টাপাল্টা কতা কস, স্যার আমাগো মাও বাপ, হেই ছোটবেলা থেইকাই তারডা খাইতাছি তারডা পরতাছি, হের বিরুদ্ধে আমি যামু ! তুই কী পাগল ? খানিকটা আক্ষেভ ভরা কন্ঠে কথাটি বলল করিম।
কী জানি, তোর ভাবসাব তো সুবিদার মনে হয় না।
কী ভাবসাব দেখলি যে সুবিদার মনে হয় না ?
কিবা কিবা কইরা জানি চাইয়া থাকোস, কতাটতা কস না, কামটামেও আগের নাহাল থাকোস না। তোর তোলা মাল স্যারের বিশেষ পছন্দের, তুই নাকি উপর দেইখাই কইয়া দিবার পারোস কোনডায় স্যার মজা পাইবো।
এই কতা কেডায় কইলো ?
কেডায় আবার, স্যারই কইলো।
তুই কী খারাপ তুলোস ? বাইছা বাইছা তো ভালাডাই আইনাই দেস।
তা দেই , কিন্তু তোর কাম স্যার পছন্দ করে। আমার শহরে যাওন লাগবো, আইজকা তুই তোল।
তুলমুনি, এহন আয় ভিতরে যাই, স্যার দেহা করতে কইছে।
বজরায় মৃদু আলো, পাশে বসে থাকা মানুষের মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। সুরা পানের সময় শিকদারের চোখে আলো সহ্য হয় না। নেশা যত চড়তে থাকবে ভেতরে আলো তত কমতে থাকবে।
মজনু, কামডা ভালা কইরা করিস। প্রথমে টাকা সাধবি, নিলে ভালা না নিলে ওনেই ফালাইয়া দিয়া আইবি। নেশা জড়ানো গলায় বললেন হামিদ শিকদার।
জে স্যার।
সাতে পটকা দুইডারে নিয়া যাইস, ওগো হাত চালু আছে। তাছাড়া নতুন পুলাইপান, কিছু শেখান টেখান তো লাগবো।
জে স্যার।
যাহ... সকালে আইসা জানি ভালা খবর পাই।
মজনু চলে যাওয়ার পর করিমের দিকে ঘুরে তাকায় হামিদ শিকদার। আইজকা কঁচি কিছু আনিস, স্বাদ পাল্টান দরকার।
বয়স ? জিজ্ঞাসু চোখে করিম তাকায় শিকদারের দিকে।
কতো আর হইবো, বারো তেরো আনিস।
আইজকা আপনে মদ বেশি খাইতাছেন । শিকদারের হাতে থাকা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল করিম।
খাইতে দে, আইজকা আমার ঈশ্বর হইতে মন চাইতাছে। হাহা আমি ঈশ্বর আমি ঈশ্বর। আর এইডারে মদ বলতাছোস ক্যান ? বলবি সুরা। এক্কেবারে রাশিয়া থেইকা আনাইছি, কঠিন জিনিস। খাবি নাকি ?
তওবা তওবা, আপনের সামনে বইসা আমি খামু! পাপ হইবো না!
পাপ হইবো ক্যান! কইলাম না আইজকা আমি ঈশ্বর, আমি তোরে অনুমতি দিতাছি, খা, আইজ রাইতে পাপ বইলা কিছু নাই।
এই বলে নিজের হাতের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় করিমের দিকে। অন্য কোনো দিন হলে কী হতো তা জানি না তবে আজ কিছু একটা ভর করেছে করিমের ওপর, নির্দ্বিধায় শিকদারের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নেয়। গরম পানীয়টুকো পুরোটাই গলায় ঠেলে দেয়। তারপর আরেক পেগ। দুই পেগ পেটে চালান দিয়ে উঠে দাঁড়ায় করিম। শরীরে ঝিমঝিম ভাব চলে এসেছে। ধীরে ধীরে শিকারির চোখ জাগছে। কিছু একটা চলছে ওর ভেতর, এত সামনে বসেও শিকদার তা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না। সেই সময় শিকদার যদি সত্যিই ঈশ্বরের ক্ষমতা পেয়ে করিমের মনের কথা পড়তে পারতো তবে বিলাসপুরের ইতিহাসে করিম নামটা চিরতরে মুছে যেতো। দুদিন পর হয়তো করিমকে সবাই ভুলে যেতো,যেমন সবাইকে যায়।
করিম কে উঠে দাঁড়াতে দেখে চোখ তুলে তাকায় শিকদার। এহনি যাস ? আর খাবি না ?
বেশি খাওন যাবো না, আগে কাম সাইরা নেই তার পর খামুনে।
কারে কারে নিয়া যাইবি ?
আপনে না কইলেন আইজকা আপনে ঈশ্বর, আমি তো আপনের গুলাম। ঈশ্বরের লাইগা একটা পাঁঠা তুলতে হের গুলামের কী মাইনসের দরকার আছে ?
কোনো দরকার নাই, তুই একাই যা, নিয়া আয় আমার হুরপরী।
ঈশ্বর কী হুরপরী চায় ! খানিকটা থমকে শিকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো করিম।
চাইলে চাইলো না চাইলে নাই, আমি চাই। যা ভাগ,আর দেরী করিস না।
হ যাইতাছি, যাওয়ার আগে আরেকটা কতা কইয়া যাই, সুরা খাইতে ঈশ্বরের গেলাস লাগে না, বোতল ঠাইলাই খায়।
কথাটি শুনে শিকদার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর সম্মোহিত মানুষের মতোন মাথা উঁচুনীচু করতে করতে বলল, হ ঠিক কতা, হক কতা, খাইলাম না গেলাসে, এই বলে হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। কার্পেট মোড়ানো বজরার পাটাতনে গ্লাস পড়ার সামান্য শব্দটুকোও হলো না। এই ঘরের শব্দ কখনো বাহিরে যায় না, বজরার মাঝিমাল্লা কেউ জানতেও পারলো না, এই ঘরে কী কথাবার্তা হলো। যদি তারা শুনতে পেতো তবে স্পষ্টই বুঝতে পারতো, কথাগুলো তাদের পরিচিত করিমের নয়, অসংগতি আছে।
আমি তাইলে যাই।
হ যা।
করিম আর দাঁড়ালো না। দ্রুত বেড়িয়ে এলো। যে করেই হোক মজনু ফেরার আগেই বজরা নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে। একবার যদি বজরা নদীতে ভাসে তখন আর কারো সাধ্য নাই সেখানে যাওয়ার। মজনুর মনে কোনো সন্দেহ না জাগলে সেখানে যাবে না। হাতে সময় নেই, যদিও মজনু এতো জলদি ফিরবে না, তারপরেও ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন নেই। পকেট থেকে ফোন বের করলো, শিকদারের ফোন। মদ খাওয়ার ফাঁকে পকেটে চালান করেছিলো। খুঁজে খুঁজে শারমিন শিকদারের নাম্বার বের করলো। হামিদ শিকদারের সাথে শারমিনের বিয়ে হয়েছিলো বছর বিশেক আগে। জেলার আরেক প্রভাবশালী সুলায়মান মিয়ার ছোট মেয়ে শারমিন। বিশ বছরের সংসার জীবনে পরীর মতোন সুন্দর মেয়ে এসেছে তাদের ঘরে, নাম জান্নাত। প্রবল প্রতাপশালী শিকদার, যার হৃদয় শুষ্ক মরুভূমির চেয়েও রুক্ষ, সাক্ষাৎ শয়তানের দোসর, যার ভয়ে গ্রামের কোনো মেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না, সেই শিকদার তার মেয়ের কাছে এলে একদম শিশুর মতোন হয়ে যায়। মেয়েকে বড় ভালবাসে সে।
শারমিনের ফোনে ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়ে শিকদার বাড়ির দিকে রওনা হয় করিম। ঘাট থেকে শিকদার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। একে তো গ্রাম, তার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাত, রাস্তায় মানুষজন নেই বললেই চলে। তার পরেও আজকের রাতটা বড় বেশি নির্জন বলে মনে হলো। শুনশান পথে একা যেতে যেতে করিম দ্বিতীয়বার ভেবে নিলো, যা করতে চলেছে তা কী আদৌ ঠিক নাকি ভুল ? এর পরিণতি কী হতে পারে ? পরিণতি, নাকি ঠিক না ভুল , কোনটা বেশি ভাবাচ্ছে ! নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল করিম। এতদিন যা যা করেছে কই কখনো তো তার ঠিক ভুলের হিসেব করেনি, তবে আজ কেনো এই কথা মাথায় আসছে ! তবে নিশ্চই পরিণতির কথাই ভাবছে। ভয়, করিম ভয় পাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য করিম নিজের আসল সত্তা কে আবিষ্কার করলো। তানিমা চলে যাওয়ার পর ভেবেছিলো সে জাগতিক সব ভয় ভীতির উর্দ্ধে চলে গিয়েছে, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ভাবনাটি ঠিক ছিলো না, সে ভয় পাচ্ছে, মৃত্যুর ভয়। বেঁচে থাকতে মানুষের এই ভয়টা যায় না, মৃত্যু ভয়টা নিয়েই সবসময় বেঁচে থাকতে হয়। করিম একটু দাঁড়ালো, চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো, চাঁদ দেখা যাচ্ছে, স্পষ্ট থালার মতোন গোল চাঁদ। ধীরে ধীরে বাম হাতটা উঠিয়ে ধরার চেষ্টা করলো ঠিক যেমনটা তানিমা করতো। চাঁদনী রাতে তানিমার সাথে দেখা হলেই চাঁদটাকে ধরে করিমের পকেটে পুরে দেয়ার ভান করে বলতো, এই নাও, আমার ভালবাসার একটা অংশ তোমার পকেটে দিয়ে দিলাম। সকাল হলে চাঁদটা হয়তোবা চলে যাবে কিন্তু তোমার পকেটে যা দিলাম তা যেনো সবসময় থাকে। এ কথার মানে করিম আগে বুঝতে না পারলেও আজ এই মুহূর্তে স্পষ্টই বুঝতে পারলো। তানিমা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো, শিকদারের অন্ধকার জগৎ থেকে করিম কে বের করে আনতে। যদিও বা এ নিয়ে সরাসরি মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেনি, তানিমার প্রবল ভালবাসার জোরে একটু একটু করে সে নিজেই শিকদারের বলয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো।
বেশ দূর থেকেই শিকদার বাড়ি দেখা যায়। উঁচু ফটক, ঝলমলে আলো, চারদিকে ষোলো ফুটের বিশাল বাউন্ডারি, বিদেশী হাউন্ড কুকুরের ফোঁসফোঁস শব্দ , সব মিলিয়ে এই বাড়ির মেজাজটাই আলাদা। শিকদার বাড়ির দরজা করিমের জন্য সবসময় খোলা। সদর দরজায় পাহারা থাকলেও কেউ করিমকে আটকানোর সাহস করলো না। সদর দরজা পেরিয়ে দোতলার পথে পা দেবে এমন সময় পেছন থেকে ডাক এলো,
করিম ভাই নাকি ! কী কামে ?
শিকদার বাড়ির প্রধান প্রহরি সাত্তার, লোকে সাত্তার ডাকু বলে ডাকে। বেশ মোটাসোটা, লাল চোখ, জাবর কাটার মতোন সারাদিন পান চিবিয়েই যাচ্ছে, দেখলেই ভয়ে গা শিউরে উঠে। শোনা যায় আগে নাকি সে দস্যু সর্দার ছিলো। হামিদ শিকদারের বাবার আমলে দস্যুগিরি বাদ দিয়ে এই বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে আসে। খুবই বিশ্বস্ত লোক। একে সবাই সামলে চলে, এমন কী করিম মজনু পর্যন্ত।
স্যার পাঠাইছে, জান্নাতরে নাকি আইজ বজরা দিয়া ঘুরাইব। বলল করিম।
কও কী মিয়া, স্যার আইজকা মাইয়া তুলবো না ? খানিকটা যেনো অবাক হলো সাত্তার ডাকু।
এহনো তো কিছু কইলো না। স্যার আইজকা ঐসবের মেজাজে নাই বইলাই তো মনে কয়।
সাত্তার ডাকু ঠিক বিশ্বাস না করতে পারলেও অবিশ্বাস করতে পারলো না। একে তো করিম নিজে এসেছে, তার মধ্যে জান্নাত বলে কথা। হামিদ শিকদার তার মেয়ের জন্য সব করতে পারে, এ কথা ছোট থেকে বড় সকলেই জানে।
থাকো সাত্তার ভাই, স্যার দেরী করতে না করছে। এই বলে সাত্তার ডাকুকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে দোতলায় উঠে গেলো। বরাবরের অভ্যাস মতোন সিঁড়ি চারপাঁচটা বাকি থাকতেই ভাবি ভাবি বলে ডাকতে ডাকতে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো করিম। দরজা খোলা, শারমিন এবং জান্নাত দুজনেই করিমের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।
কেমন আছেন ভাবি ?
ভালাই আছি, আইজ কাল আর তোমার দেহা পাইনা, থাকো কই ?
নানা কামে ছুডাছুটি করি, আগের নাহাল আর সময় পাই না।
সময় ঠিকি হয়,তয় তুমি ইচ্ছা কইরাই আহো না।
করিম কিছু বলে না, মাথা নীচু করে করে থাকে। শারমিনের চোখে এমন একটা কিছু আছে যে ওদিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলা যায় না।
মাথা নীচা করলা কেন ? তানিমার কথা ভুলবার পারো নাই ?
করিম কথা বলে না, চুপ করে থাকে। পুরো শিকদার বংশের মধ্যে দুজন মানুষ আছে যাদের সবসময় আপন মনে হয়, কাছে এলে মন ভালো হয়ে যায়, তাঁদের একজন শারমিন আরেকজন জান্নাত। গোবরে পদ্মফুল হয় এই প্রবাদটা জানে করিম, কিন্তু আস্ত গোবর সমুদ্রে দুটো পদ্মফুল কী করে এসে গেলো তা ভেবে কূলকিনারা পায় না।
আপনের কতা তো স্যার শুনে, বাঁধা দিবার পারেন না ?
আমি কহনো বাঁধা দেই না বইলাই আমার কতা শুনে, বউগো কতা শুনবো এমন রক্ত শিকদারগো শইলে নাই।
আমি যাই ভাবি দেরী হইয়া যাইতাছে। আসো আম্মা আমার হাত ধরো বলে জান্নাতের হাত ধরে বেরিয়ে এলো করিম। খানিক পরে মাথার উপর চাঁদ উঠবে। নিশুতি পাখির ঘুম ভাঙ্গবে. এলোমেলো বাতাস দোলা দিয়ে যাবে শিকদার বাড়ির পরিত্যাক্ত দোলনাটায়। বহু দূরে দুটো পেঁচা ডেকে উঠবে, একদল শেয়াল পথ আগলে বসে থাকবে, জ্যোৎ¯œার গন্ধে বুনো ফুল নেচে উঠবে, গান গাইবে , কিন্তু ভোর হতে না হতেই সব ঢেকে যাবে বিচ্ছেদের করুণ সুরে।
৩
বজরা ভাসাইলো কহন ?
চমকে উঠে করিম। মজনুর এমন বিড়ালের মতোন চলাচল ওর একদম অপছন্দ। এ নিয়ে কতবার বলেছে ওকে, কাজ হয়নি। চুপিচুপি বেড়ালের মতোন এসে সবাইকে চমকে দিতেই যেনো ভালবাসে।
কাম হইলো? জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো করিম।
হ, ওসিডা একেবারে মুরগীর ডিম। দুইবারের জায়গায় তিনবার না করবার পারে নাই। দূরে থাইকা বহুত ফাল পারতাছিলো, এহন গেছি আর তো মুখ খুললো না। হাহাহা, হালা ভদ্দরলোকের বাচ্চা।
করিম কিছু বলে না, নীরবে তাকিয়ে থাকে আত্মতৃপ্তিতে ভরা মজনুর মুখটার দিকে। যেনো সেখানে মজনুর নয়, নিজের মুখটাই দেখতে পাচ্ছে। এইতো কিছুদিন আগেও এমন তৃপ্তির হাসি ওর মুখে সবসময় লেগে থাকতো। শিকদারের জন্য কিছু করার সুখ ওকে তিলে তিলে গিলে নিচ্ছিলো যেমনটা সূর্য অন্ধকারকে নেয়।
যাইগগা ভালাই অইলো, খবরডা শুইনা স্যার খুশি হইবো। এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো করিম।
তুই মনে কয় খুশি হসনাই ? বলল মজনু।
খুশি হমু না কেন ?
কী জানি, তা জানি না। তোর ভাবগতিক তো সুবিধার লাগে না। তানিমারে ভুলবার পারোস নাই ?
চমকায় না করিম, আজ আর কোনো চমক ওকে চমকাতে পারবে না। আজ রাত সব কিছু উজার করে দেয়ার। তানিমার ব্যাপারে এর আগে মজনুর সাথে কথা বলেনি করিম। আজ বলবে। সকালের প্রথম সূর্য ওর ভাগ্য নির্ধারন করবে। ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার আগেই সব জেনে নিতে হবে।
তানিমারে তুই নিয়া গেছিলি তাই না ? কথাটা বেশ শান্ত গলায় বলল করিম।
চমকে ঘুরে তাকায় মজনু, করিমের এই স্বর ওর পরিচিত নয়। নদীর পাড়ের রাতের হাওয়া বেশ ঠান্ডা তবুও হঠাৎ যেনো মজনুর কপাল বেয়ে দু ফোঁটা ঘাম নেমে এলো। মজনু জানতো একদিন না একদিন ওকে করিমের সামনে দাঁড়াতেই হবে কিন্তু সে সময়টা যে আজ রাতেই হবে তা ভাবতে পারেনি। সব কথা গোছনোই ছিলো কিন্তু হঠাৎ করিমের প্রশ্নে সব এলোমেলো হয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো মজনু।
কীরে কতা কস না কেন ? চুপ মাইরা গেলি যে ? ঝাঁঝাঁলো গলায় বলল করিম।
গুছিয়ে রাখা কথা গুলো মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন বাধ্য হয়েই হাল ছেড়ে দিতে হলো।
হ আমিই নিয়া গেছিলাম, কিন্তু দেখ করিম এনে আমার কুনো হাত নাই। স্যার যা কইছে আমি তাই করছি।
তার মানে স্যার সবি জানতো ?
স্যারের হুকুম ছাড়া তোর মালে হাত লাগায় এবা সাহস আছে কার ?
করিম কিছু বলে না, নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলো নদীর পানিতে পরে ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। ছোট ছোট ঢেউ গুলো যেনো জ্যোৎ¯œা বয়ে এনে পারে আছরে পড়ছে। করিম মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এই ঘাটের ঠিক উল্টো পাশে যেদিকটায় মূল যমুনার শাখা নদী চলে গিয়েছে, সেখানে বটগাছের নীচে ওদের প্রিয় জায়গা ছিলো। বটের ছায়াতেই তানিমাকে ভালবাসার কথা বলেছিলো করিম। এইতো সেদিনের কথা বলেই তো মনে হচ্ছে, অনেকদিন ঘুরেও যখন তানিমা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না ,করিম যখন এক প্রকার হাল ছেড়েই দিয়েছিলো তখন হঠাৎ একদিন বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে তানিমা বলেছিলো, আপনে এহন পাঁচ মিনিটের মদ্যো যদি আমারে ফুল আইনা দিবার পারেন তাইলে আমি রাজি হইবার পারি আর না পারলে আর জীবনেও আমার পিছনে আইবেন না। আপনের সময় শুরু হইলো এহন থেইকা।
তানিমার এমন কথা ছিলো একদম অপ্রত্যাশিত। কিছুক্ষণ সময় লাগে সবকিছু বুঝে নিতে। ঘোর লাগা ভাব শেষ হতেই বড্ড বেশী অসহায় বোধ করে করিম। এমন জায়গায় ফুল পাবে কোথায় ! পরাজিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ এদিকওদিক তাকায়। নাহ্ এ জীবনে আর তানিমার ভালবাসা পাওয়া হলো না, একথা ভেবে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিতে যাবে এমন সময় চোখে পরে নদীর ওপারের একটি গাছের দিকে। ভর বর্ষা, গাছ ভর্তি কদম ফুল, নদীতে খর¯্রােত। নদীর পাগলা স্রোত উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পরে করিম। যে করেই হোক ওপারে পৌছাতেই হবে, ফুল আনতেই হবে। সেদিনই প্রথম ভালবাসার প্রবল সুখ পেয়েছিলো করিম। কদম ফুল নিয়ে যখন এপারে এসে পৌছায় ততক্ষণে বিশ পঁচিশ মিনিট হয়ে গেছে। এতো দেরী হলো, তানিমা ফুল নেবে কি নেবে না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। কিন্তু পারে এসে পৌছানোর পর হাঁপাতে হাঁপাতে যখন কদম ফুল তানিমার সামনে তুলে ধরে তখন করিমকে অবাক করে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলো তানিমা। ওর কান্নাতেই নতুন এক করিমের জন্ম হয়েছিলো সেদিন। আজ মনে হচ্ছে সেদিন নতুন করিমের জন্ম না হলে তানিমা আজো বেঁচে থাকতো।
করিম ঐ করিম... করিম,
হ্যাঁ হ্যাঁ কে মজনু, হ্যাঁ বল। মজনুর ডাকে যেনো হঠাৎ ধ্যান ভাঙ্গে করিমের।
চুপ মাইরা গেছিলি কেন ? প্রশ্ন করে মজনু।
এডা কতা ভাবতাছিলাম।
কী কতা ?
ছুটো বেলায় তুই আর আমি একটা কসম কাটছিলাম। মনে আছে তোর ?
কতো কসমি তো কাটছি, কোনডার কতা কইতাছোস ?
মরার আগ তুরি তুই আমারে বাঁচাবি আর আমি তোরে। মনে পড়ে ?
কিছু বলে না মজনু, চুপ করে থাকে। অল্প সময় বিরতি নিয়ে মুখ খোলে, তুই স্যারের কুনো ক্ষতি করিস না, যা হইছে সব ভুইলা যা।
ভুইলা যামু ! এইডা ভুইলা যাবার মতোন ! গোখরার মতোন ফণা তুলে তাকায় মজনুর দিকে।
জানি ভুলোন কষ্ট, কিন্তু কী করবি ক, স্যারের রক্ত আমাগো চাইয়া মেলা উঁচায়, তুই আমি নাগল পামু না। মানুষজন যে আমাগো ভয় পায় তা স্যারের লাইগাই। তাই কইতাছি সব ভুইলা যা, তুই আমার বন্ধু, তোর মরা মুখ যানি আমার দেহন না লাগে।
স্যারের পর তানিমার ভাগ তুই নিছিলি ?
নারে, অতো বড় হারামি এহনো হয়নাই।
খুনডা কেরা করছাল ?
তাও জানি না, আমি খালি লাশডা মাটি চাপা দিতে গেছিলাম। বিশ্বাস কর এই কামে আমি হেলা করি নাই, যতডা সম্ভব সম্মান দিয়াই কব্বর দিছি।
কথা খুঁজে পায় না করিম, উদ্দেশ্যহীন ভাবে নদীতে ঠিল ফেলে। একদলা মাটির চাপে যমুনার পানি খানিকটা উপরে উঠে আসে। করিম সেদিকেই অপলক চেয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর ,খানিকটা নিজের সাথেই কথা বলার মতোন করে বলতে থাকে, আইজকা সন্ধ্যায়ও তোরে ভুল বুঝছিলাম, কিন্তু এহন আমি জানি, আমার যদি কিছু হয় তাইলে বেকের আগে তুই বুক পাইতা দিবি। কী দিবি না ? প্রশ্ন করে ঠিকই তবে মজনুর উত্তরের আশা করে না।
মজনু এমন কোনো আশ্বাসের বাণী শোনাতে পারে না। তুই স্যারের বিরুদ্ধে যাইস না। হের দুয়ার হাত আমাগো মাতার ওপর থেইকা উইঠা গেলে আমরা বেকডি পঁচা ডিমের নাহাল পঁইচা যামু। কেউ দুইদিন বাঁইচা থাকবার পারমু না।
চিন্তা করিস না, তোরে কোনো কিছুতেই টানমু না। যা করার আমি একলাই করমু।
কেউ কথা বলে না, চাঁদের দিকে চেয়ে থাকে। মজনুর গ্লানি আজো কাটেনি। করিম তানিমার লাশ দেখেনি কিন্তু ও তো দেখেছে। কী বীভৎস। শরীরের প্রতিটি জায়গায় মেপে মেপে অত্যাচার করেছে, সেদিন শিকদার মাঝরাতের পর মাঝিদের হাতে তুলে দিয়েছিলো তানিমাকে। নয়জন মাঝি ওকে টেনে হিচরে চরে নামিয়ে নিয়েছিলো। নাহ নাহ বলে পুরো দেহ ঝাঁকুনি খেলো মজনুর। এসব আর ভাবতে চায় না।
তোর আবার কী হইলো ? প্রশ্ন করলো করিম।
কিছুই না, ঘুম পাইতাছে, আয় বাংলোয় যাই।
যা তুই ঘুমা। আজ রাইতে আর ঘুম হইবো না, তুই যা , সক্কালেই চইলা আসিস।
এনেই থাকবি ?
হ।
থাক তাইলে, আমি যাই। এই বলে মজনু উঠে চলে যায়।
দিনেরা বেলায় এখান থেকেই চর’টা দেখা যায়। কতো আর দূর হবে, নৌকায় যেতে বড়জোর পনেরো বিশ মিনিট লাগতে পারে। এতো কাছে তবুও তানিমার শেষ আশ্রয়টি একবারের জন্যও দেখতে যায়নি। যদি কাল সকালের পর বেঁচে থাকে তবে একবার সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। মাথার নীচে হাত রেখে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো করিম। হতে পারে এটাই তার জীবনের শেষ রাত। তাই আজ আর ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না।
৪
সত্যি সত্যিই পুরা রাইত এনেই আছিলি ? ভোরে ঘাটে এসে করিম কে একই ভাবে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে মজনু।
উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটু পানিতে নেমে হাতমুখে পানি দেয়। গড়গড় শব্দে কুলি করে উপরে উঠে আসে। একটা বিড়ি ধরা, বলে পেছন পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেটটা ছুঁড়ে মারে করিমে দিকে। করিম সিগারেট ধরায়। সাধারণত সকাল বেলায় সিগারেটের ধোয়া ওর সহ্য হয় না কিন্তু আজ অবস্থা ভিন্ন। ইট ভাটার মুখ থেকে যেমন করে ধোয়া বের হয় ঠিক তেমন করেই করিমের মুখ থেকে ধোয়া বের হচ্ছে।
করিম সামনে তাকা, অবাক সুরে কথাটি বলল মজনু। এই সাত সকালে নদীর কুয়াশা ভেদ করে বিলাসপুর ঘাটের দিকে আসছে। তা দেখে মজনু অবাক হয়েছে। করিম সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে হয়তো তার সময় শেষ হতে চললো।
ঘটনা কী, বজরা এহন ঘাটে ভিরতাছে কেন ? উত্তরটা যে করিমের কাছে নেই তা জেনেই প্রশ্ন করে মজনু। কথা বলে না করিম , চুপ করে থাকে। কোমরে হাত দিয়ে ছুরিটার স্পর্শ নেয়, যদি মরতেই হয় তবে মরার আগে শিকদারের বড় কোনো ক্ষতি করে দিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে নদীবাংলোর ঘাট ধরে বিলাসপুর। করিম মুহূর্ত মুহূর্ত অপেক্ষা করছে কখন বজরা থেকে রেরে করে মাঝিমাল্লারা দৌড়ে নেমে আসে। করিম পালাবে না বলেই ঠিক করেছিলো গত রাতে। মাটিতে শক্ত করে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যে করেই হোক মরার আগে একবার শিকদারের কাছে পৌছাতেই হবে। আর কিছু হোক না হোক শয়তানটার শরীরে দুটো ঘা বসিয়ে দিতে পারলেও মরে শান্তি পাবে। অশান্ত নদীর বুকে শান্ত হয়ে বিলাসপুর দাঁড়ায়। কিন্তু কই, এখনো তো কেউ তেড়ে এলো না।
করিম ভাই, নাওয়ের মদ্যোর মালডারে হাসপাতালে নিয়া যাবার কইছে আপনেগো। মাঝি সর্দার বজরায় বসেই কথাটা বলল। আর এক মুহূর্ত দেরী করে না করিম। দৌড়ে বজরায় উঠে। কিছু না বুঝেই পেছনে পেছনে মজনু দৌড়ায় কিন্তু করিমের নাগাল পায় না।
বজরায় শিকদার নেই। একটি ছোট্ট নিস্পাপ দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। চারদিক রক্তে ভেসে গেছে, মেয়েটার জ্ঞান নেই। করিম দ্র্রুত হাতে চাদর দিয়ে মেয়েটাকে আগাগোড়া ঢেকে নেয়।
মজনু কইরে, আয় ভাই, ওরে হাসপাতালে নিয়া যা। আমার মা’রে মরবার দিসনা। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কথাটি বলে করিম। হতভম্ব মজনু কিছুই বুঝতে পারে না। কী করবে না করবে তা বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
খাড়াইয়া আছোস কেন ? ধর, আমি শইলে শক্তি পাইতাছি না।
এতক্ষণে যা বুঝার বুঝে যায় মজনু। চিতার মতোন ক্ষিপ্রতায় মেয়েটাকে বুকে তুলে নেয়। দৌড়ে বজরা থেকে নেমে যায়, পেছন পেছন টালমাটাল মজনু। বাংলো থেকে গাড়ি বের করে মেয়েটাকে পেছরে সীটে শোয়ায়।
তুই যাবি আমার লগে ? করিম কে প্রশ্ন করে মজনু।
তুই যা, আমি যাইতে পারুম না রে।
কামডা ভালা করোস নাই। তুই আর শিকদার আলাদা হইলি কেমনে ? দুইজনেই তো দেহি একি।
এহন আর কতা কইস না ভাই, মাইয়াডা বাঁচবো কিনা ঠিক নাই, তাড়তাড়ি কর।
মজনু আর কথা বাড়ায় না, পেছনে ধুলো উড়িয়ে শহরের দিকে যায়।
ঘন্টা দুয়েক পর
ছোট একটি নৌকা নিয়ে চরের দিকে যায়। করিম ঠিক জানে, ঐ চরের পশ্চিম কোণায় হামিদ শিকদার মুখ লুকিয়ে আছে। এখনো বেঁচে আছে যখন তখন একবার দেখা না হলে চলছেই না। হাজারো মা বাবার বুক ফাঁটা কান্নার যে কারণ, আজ তার কান্নার দিনে তাকে কেমন দেখতে হয়েছে তা দেখবে না !
সবে দিনের প্রথম সূর্য উঁকি দিচ্ছে। বিলাসপুরে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক আগেই তবে এখনো আড়মোড়া ভাঙ্গেনি। মানুষজন বের হতে শুরু করেছে। নদীতে নৌকা বাড়ছে। অন্যান্য দিনের মতোর গেরস্ত গরু নিয়ে যাচ্ছে, জেলে জাল নিয়ে। পুব পাড়ার বুড়ি দাদি তার নাতির কাঁথা কম্বল নিয়ে ঘাটে এসেছে। ঘাটপাড়ার জোয়াদ্দারদের ছেলে রুকন সমান তালে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, তাকে এখনো গাছের সাথেই বেঁধে রাখা হয়েছে। একটু পরেই খবর যখন দিকবিদিক ছড়িয়ে যাবে, তখন গেরস্ত গরু নিয়ে গোয়ালে ফিরবে, জেলে তার জাল গুটিয়ে রাখবে। বুড়ি দাদি তার কাঁথা কম্বল ফেলেই দৌড়াবে। অনেক দিন পর রুকনের বাঁধনটাও খুলে দেয়া হবে। সে তখন দৌড়ে দৌড়ে চিৎকার করে যাবে, এটাই তার উল্লাস। সব যেনো করিম চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। পুরো গ্রামে ঘরে ঘরে উৎসব লেগে যাবে। আতসবাজি পুড়বে, গানর আসর বসবে, ছেলেমেয়ের দল স্কুলের বইখাতা ছুড়ে ফেলবে, অঘোষিত ছুটিতে মেতে উঠবে পুরো বিলাসপুর, অথচ তারা সবাই জান্নাতকে বড় ভালবাসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে জান্নাতের জন্য করিমকে দোষারোপ করবে না, তা কিন্তু নয়। করিম চায় এমন দোষারোপ ওকে অনেকেই করুক। জান্নাত মেয়েটা যে সাক্ষাৎ দেবী। গ্রামের আগত অনাগত সকলের ভবিষ্যৎয়ের জন্য সে দেবী কে বিসর্জন দিয়েছে। করিম চায় সেই দেবীকে মানুষ মনে রাখুক, শ্রদ্ধার সাথে তার নাম উচ্চারণ করুক।
করিম ঠিক ভেবেছিলো, পশ্চিম কোণেই শিকদার বসে আছে। গুটিগুটি পায়ে শিকদারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ না ঘুরিয়েই বলে উঠলেন, করিম, আয় বয়। তোর লাইগাই অপেক্ষা করতাছিলাম।
থমকে দাঁড়ায় করিম। শিকদারের এমন ঠান্ডা গলা এর আগে শোনেনি।
কী হইলো আয়, আমার পাশে বয়।
করিম বাধ্য ছেলের মতোন শিকদারের পাশে যেয়ে বসে। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলে না। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশাল নদী, যার মাঝখানে বসেও কুলকিনারা ভাল দেখা যায় না। নীরবতা শিকদার নিজেই ভাঙে, আমি একশো খুন কইরাও ভরা আদালতে স্বীকার করবার পারি কিন্তু এই অপরাধের স্বীকার নিজের কাছেই করবার পারমু না রে।
করিম কেঁপে উঠে। এ তার সেই চেনা শিকদার নয়, বড্ড অচেনা লাগছে। শিকদারকে এমন ভেঙে পড়তে করিম কখনোই দেখেনি। সে কী খুব বড় অপরাধ করে ফেলল ? এই কথাটা মনে খঁচখঁচ করছে।
স্যার আপনে থাকেন আমি যাই।
যাবি? যা। তয় যাওয়ার আগে একটা কতা কইয়া যা, এমনটা তুই কেন করলি ? আমার জান্নাতরে আমি নিজে...নানানা...হুহু করে কেঁদে ফেলে শিকদার। কান্নার দমক একটু কমতেই বলে, এর চাইয়া আমারে খুন কইরা ফালাইতি। আমি একবারের লাইগাও বুঝবার পারি নাই আমার তলে আমার মা মরে। কী দুক্কুডাই না দিছি তারে, ও আল্লা মাপ করো মাপ করো।
করিম বুঝতে পারে না, শিকদারের এমন পরিণতিতে সে খুশি হবে নাকি অপরাধ বোধে ভুগবে।
স্যার, আপনের সাথে এমনটা হওয়া দরকার আছিলো।
তারপর আবার দুজনেই চুপ। নীরবতার সুযোগে করিমের মনে ভেসে উঠে গতরাতের স্মৃতি। জুসের সাথে নেশা খাইয়ে জান্নাতকে বজরার আসরে পৌছে দেয়ার স্মৃতি। সেখানে দাঁড়িয়েই করিম কিছুটা দেখে এসেছে , মাতাল শিকদার কী করে হিংস্র হায়নার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠে। অতটুকো বাচ্চাকে কী করে নিজের মাতাল দু হাতে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। সামান্য অপরাধবোধ টুকোও তখন করিমের মনে জাগেনি বরং অস্বাভাবিক এক তৃপ্তিতে মনটা ভরে গিয়েছিলো।
তুই তানিমারে বড় বেশী ভালবাসতি তাই না ?
শুধু ভালবাসা না স্যার, ওর পেটে আমার বাচ্চাও আছিলো। আপনে দুইজনরেই মাইরা ফালাইছেন।
বাচ্চা আছিলো ?
হ।
তাইলে ঠিক আছে তাইলে ঠিক আছে। অসগলগ্ন মানুষের মতো কথা বলতে থাকে শিকদার। করিম বুঝতে পারে এখানে তার কাজ ফুরিয়েছে। এবার আর বিদায় না চেয়েই উঠে দাঁড়ায়। সোজা উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। যেতে যেতে করিম শুনতে পায় শিকদার বার বার বলছে, তাইলে ঠিক আছে, তাইলে ঠিক আছে।
©somewhere in net ltd.