নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘না তাহলে আপনার অমনোযোগও কম নয়; আমি গোড়া থেকেই আপনাকে ফোনে "আমার করা ডিজাইনে" বলে আসছিলাম .. কী করা জগত নিঠুর .. আধা মনোযোগেই কিয়ামত চলে আসবে।'
জন্মদিনের উপহার হিসেবে পাঞ্জাবী-র প্রসঙ্গ আসার আগেই তিনি ফোনে বলেছিলেন,
‘তাহলে জায়গাটা কোথায়? হুমম ধানমন্ডি।’
‘যদি এক ঘন্টার জন্য থাকতে চাই, কোন সময়ের মধ্যে আসতে হবে?
আমি জানিয়েছিলাম,
‘রাত আটটা থেকে দশটা’
তিনি বললেন,
‘ঠিকাছে, তবে সাথে কোন উপহার থাকবেনা’।
জন্মদিনের দাওয়াতে ‘উপহার’ থাকবে না। এই আগাম প্রস্তুতি আমন্ত্রণকারীকে জানিয়ে দেবার বিষয়টি এখনো মধ্যবিত্ত কেতায় ততটা জনপ্রিয় হয়নি। তবে ছ’ বছর পর ঢাকায় ফিরেছি, হতেও পারে।
অনুমান করি যে বিষয়টা অনেকের কাছে খটকা হিসেবেই গণ্য হবে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এমনটাও ভাবতে পারেন যে,
‘আরে ভাই দাওয়াত দিয়েছি, উপহার নিয়ে মাথাব্যাথা আছে নাকি?’
‘অহেতুক জটিলতা’।
আরো একদল এমনও ভাবতে পারেন,
‘কি এক আদিখ্যেতা, একটা দেখানো দেখানো ব্যপার, আমি আলাদা হুমম!’।
হুয়ায়ুন আহমেদের পাঠকরা অবশ্য এই কথপোকথনে মিসির আলি-কেও দেখতে পেতে পারেন, এক অনাড়ম্বর অনড় খটমটেপনা।
তবে সেই হুমায়ুনও আর নেই, আর সেইসব ‘চরিত্র’ নিয়ে উত্তেজনাও আগের মত নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মানস চৌধুরী একজন ‘ক্যারেকটার’। এবং আপনার শিক্ষা জীবনে; এমনকি জীবনেও এমন মানুষেরা দূর্লভ। এটা ঠিক হওয়া যায় না। হতে হয়।
তো সেই সেপ্টেম্বর থেকেই পাঞ্জাবী নিয়ে আমাদের আলাপচারিতা। মানস চৌধুরী যে পোশাকে এবং পরিবেশনে অনন্য তা মোটামুটি একটা সাধারণ জ্ঞান। কথা হলে স্যারকে প্রায়ই বলি,
‘ক্লাসের বদলে, আপনি মঞ্চ অনেক এনজয় করতেন’।
উত্তরে স্যার হাসেন।
তো জন্মদিনের উপহার হিসেবে তিনি ঠিক করলেন আমাকে দুটো পাঞ্জাবী দেবেন। ফলে কিছুদিন আমরা পাঞ্জাবীর সাইজ এবং আড়ং এর সাইজ নাম্বার নিয়ে কোস্তাকুস্তি করলাম। তাতে ঠিক হলনা। মানে স্যারের। স্যার তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কাপড় কিনে পাঞ্জাবী বানিয়েই দেবেন। আসলে স্যার হয়ত আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। আমার ভেতরের মন তখন প্রায় হাঁসফাঁস করছিল; মনে মনে বলছিলাম,
‘স্যার এটাতো টিউটরিয়াল না,আমার জন্মদিনের উপহার’
শরমে আর বলা হয় নাই।
স্যার লেগেই থাকলেন এবং একদিন জানালেন, মোহাম্মদপুরের আসল বাসস্ট্যান্ড মোড় সংলগ্ন, “ইসলামিয়া টেইলার্সে” মাপ দিয়ে আসতে। সেখানে আছেন স্যারের পরিচিত, অত্যন্ত যোগ্য নিষ্ঠাবান আবুল কাশেম সাহেব। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই স্যারের পাঞ্জাবী বানিয়ে আসছেন এবং সেই ভদ্রলোকের বানানো পাঞ্জাবী স্যারের পছন্দ হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
এরইসাথে এখনো মাপে হয় এমন একটি পাঞ্জাবী নিয়ে গেলে যে খুব ভালো হয়, সে কথাও তিনি জানালেন। সেদিন স্যারের সাথেও দেখা হল এবং প্রস্তুতি হিসেবে আমি একটি পাঞ্জাবীও সাথে নিয়ে গেলাম। বলা তো যায়না দেখা হবার পর যদি আবার প্রশ্ন করে বসেন,
‘পাঞ্জাবী কই?’
দেখাটেখা শেষ হবার পরে বেশ কষ্ট করেই সেই ভদ্রলোক আর তাঁর দোকানকে খুঁজে পাওয়া গেল। মাগরিবের নামাজ শেষ করে সবে ফিরেছেন।স্যারকে ফোনে জানালাম। তিনিও কথাটথা বললেন। আমি ভাবলাম যাক শেষ হল। তবে কাশেম সাহেবের সাথে কথা শেষ করতেই বুঝলাম,পাঞ্জাবী নিয়ে হলেও, ওনার মানস চৌধুরীর সাথে নিয়মিত কথা হয়। আর এই কথোপকথনের ছাপ কাশেম সাহেবের কথাতেও বেশ বোঝা যাচ্ছিল।
আমার তখন পাঞ্জবী জমা দিয়ে একটা মুক্তি মুক্তি ভাব। মনে ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার আনন্দ।
মনেমনে ভাবছি ‘আর্গুমেন্ট মনে হয় ঠিকই আছে, ফুকোর একটা লোকালাইজড ইন্টারপ্রিটেশন…স্যার মনে হয় ধরতে পারবেন’। পরক্ষণেই মনে হল ‘আরে আমি তো পাঞ্জাবী দিতে এসেছি।’
এরও বেশ কয়েকদিন পরের কথা।
এবার স্যার বললেন,
‘আপনার জোড়া পাঞ্জাবি + ১ টা এখন আমার জিম্মায়। প্রিফার্ড ঠিকানা পাঠান আমি পোস্ট করে দিচ্ছি। পোঁটলা পেয়ে দুঃখ পেলাম যেহেতু ডিজাইনটা আমার বলা রাখেননি। কাশেম ভাইকে ফোন (আমি না গিয়ে শ্যালিকার ড্রাইভারকে পাঠিয়েছিলাম) দেয়াতে তিনি দৃঢ় গলায় দাবি করলেন যে আপনি তাঁকে স্যাম্পল দেয়ার সময় কেবল মাপ নয়, ওই ডিজাইনে বানাতে বলেছেন। তিনি সত্য বলে থাকলে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। আর তিনি কাল্পনিক বললে আপনারই নিজ দায়িত্বে তাঁর সাথে ফোন করে ঝগড়া করা ও ডিজাইনবদল করা ছাড়া অনেক রাস্তা থাকে না।’
ফেইসবুকে স্যার যখন এই কথাগুলো বলছিলেন তখন ধ্বক! করে উঠেছিল। আমাদের তো এখন আর সহজে ধ্বক! করে ওঠা হয় না। আমরা জেনে গেছি সব। জন্মদিন হবে, এক একজন বিভিন্ন ব্র্যান্ড থেকে দাম দিয়ে উপহার কিনে আনবেন। সেই উপহারে, উপহার প্রদানকারীর এবং গ্রহণকারীর সামাজিক মর্যাদা আর সক্ষমতার বিষয়টা থাকবে।
সবই মাপ করা।
একজন মানুষ এত যত্ন করে এত চিন্তা করে, এত মনোযোগ দিয়ে তাঁর ডিজাইনে তাঁর ছাত্রের জন্য পাঞ্জাবী বানাতে দিয়েছেন, সেই ভালোবাসা, সেই অনন্যতা হারিয়ে যাবে।
ভীষণ খটমটে এই মানুষটার উপন্যাসে “নায়ক” আত্মহত্যা করে। তিনি অভিমান করেন,তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের ছটায় সেটা কোণায় বসে থাকে। কিন্তু সেটা তো আছে।
আজ সেই শুভদিন। আম্মা হাসতে হাসতে হলুদ রংয়ের একটা প্যাকেট নিয়ে হাজির।
আমি বললাম ‘কি?’
তিনি বললেন, ‘তোমার পাঞ্জাবী মনে হয়’
আমি বললাম, ‘কে?’
তিনি বললেন,‘কে আবার মানস পাঠিয়েছে’
একটা হলুদ প্যাকেটের বামদিকে লেখাঃ
ড. মানস চৌধুরী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, সাভার, ঢাকা।
প্যাকেটটার দিকে তাকালাম, রংটা হলুদ। হিমুর রং। হুমায়ুন নেই, কিন্তু মানস চৌধুরী আছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার।
২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:২১
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: আরে জন্মদিন তো কবেই চলে গেছে। তবে স্যারের ভালোবাসা তো অটুট। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৯:২২
রাজীব নুর বলেছেন: বাহ!!!
খুব ভালো।
২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:২২
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: রাজীব নুর অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা।
৩| ৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১:৫০
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: কথা সেটা না, কথা হচ্ছে শ্যালিকার ড্রাইভারকে পাঠিয়েছিলাম মানে কি??
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৪৪
অন্তরন্তর বলেছেন: জন্মদিনের শুভেচ্ছা শরৎ ভাই। কতটা আন্তরিক ভালবাসা ছাত্রের প্রতি থাকলে এভাবে পাঞ্জাবি বানিয়ে উপহার দিতে পারে অকল্পনীয়। স্যালুট স্যারের প্রতি। আপনি যে স্যারের যোগ্য ছাত্র তার প্রমাণ এমন সুন্দর লিখা। শুভকামনা রইল।