নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনেক সুখের গল্প হল-এবার কিছু কষ্টের কথা শুনি...
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বন্দী শেখ মুজিব।
আমরা রাও ফরমান আলীর বাকি আলোচনার আগে একটু ' পাকিস্তানের হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছিলেন নাকি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পন করেছিলেন তা নিয়ে ৯৩ বছর বয়সী কলামিস্ট লেখক ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক বদরুদ্দীন উমরের একটা সাক্ষাতকারের কিছু অংশ শুনে আসি;
'পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হওয়ার পরও তার বাড়িতে থাকার কারণ কী হতে পারে?' এমন প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দিন বলেন, “শেখ মুজিব আত্মসমর্পণ করার জন্য বাড়িতেই ছিলেন। আওয়ামী লীগের লোকেরা এবং তাদের বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। কিন্তু আমি বলছি, সে নিজেই আত্মসমর্পণ করেছে।
“তারা (আওয়ামী লীগ) আমার উপর ক্ষুব্ধ কারণ আমি বারবার বিভিন্ন নিবন্ধে উল্লেখ করেছি যে শেখ মুজিব নিজেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন,” তিনি আরও বলেন, “শেখ মুজিব সবাইকে পালানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন, এবং তিনি বাড়িতেই ছিলেন, তার মানে তিনি অপেক্ষা করছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে। সুতরাং, এটি একটি গ্রেপ্তার ছিল না, এটি ইচ্ছাকৃত আত্মসমর্পণ ছিল,” তিনি বলেছিলেন।
“তিনি যুদ্ধের কোনো খবর জানতে পারেননি বা মহান বীর হিসেবে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কারো সঙ্গে দেখা করেননি। মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে হয়েছিল তাও তিনি জানতেন না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লন্ডনে যান যেখানে তিনি জানতে পারেন যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে।
কিন্তু তার মেয়ে (শেখ হাসিনা) বলতে থাকেন যে তিনি (শেখ মুজিব) মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ছিলেন, তিনি বলেন, “তারা (আওয়ামী লীগ) শেখ মুজিবের ভাবমূর্তিকে তাদের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করেছে, এটাই। কিন্তু শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
“পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু নেই। তারা ভারত সরকারের হাতে দেশ স্বাধীন করার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। এ কারণেই ভারতীয়রা বলে যে এটি একটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যা এক অর্থে সত্য। ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষিত 'মুজিব বাহিনী' যুদ্ধ করেনি,” যোগ করেন তিনি।
বদরউদ্দিন বলেন, “আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, বরং তারা কলকাতায় যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল সেখানে অবস্থান করতে পেরেছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এখানে যুদ্ধ করেছেন। সামরিক বাহিনী যে যুদ্ধ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ তা চায়নি।
দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাইরের আক্রমণের প্রভাব কম ছিল, তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় অবদান দেশের জনগণের দ্বারা যুদ্ধ করা হয়েছিল। তাদের জীবন উৎসর্গ করা।"
~ বদরুদ্দীন উমর
****
এবার আসি রাও ফরমান আলীর বাকি আলোচনায়;
আগের পর্বঃ
শত্রুদের চোখে বাংলাদেশের অভ্যুদয়!
মস্কোর সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়েনের চেষ্টা ও ভারতের বাধাঃ
এটা ছিল পাকিস্তানের সেই 'ইতিহাসের স্থান' যা বৃহৎ শক্তিবর্গকে নতুন এই বিষয় ও ঘটনার প্রতি গুরুত্বসহকারে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই পাকিস্তানকে নিজেদের সান্নিধ্যে নিতে অথবা সম্ভব হলে তৎকালীন ভাষায় ও অর্থে নিজেদের কক্ষপথে নিতে চেয়েছিল। পাশ্চাত্যের উন্নত ও মুক্ত সমাজের নেতা থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কোনো জটিলতার বিষয় ছিল না। পাকিস্তান তার নিজের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল এবং সে কারণে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তার কোনো বাধা বা অনীহার কারণ ছিল না। প্রকৃত সমস্যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যেঅর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল এবং সে কারণে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তার কোনো বাধা বা অনীহার কারণ ছিল না। প্রকৃত সমস্যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে কোনো এক বা অন্য দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে আদর্শকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করত। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ও ভারত যখন জন্ম নিচ্ছিল, তখনো সে লৌহ যবনিকা ক্রিয়াশীল ছিল।
এই সব আদর্শগত অসুবিধা সত্ত্বেও বিদেশ সফরের আয়োজনকালে প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মস্কোকে অগ্রাধিকার দিতে চেয়েচিলেন। মস্কো সফরের বিষয়টি এগিয়ে নিয়েছিলেন রাজা গজনফর আলী খান। কমনওয়েলথ প্রধান মন্ত্রীদের সম্মেলন থেকে প্রত্যাবর্তনকালে লিয়াকত আলী খান তেহরানে যাত্রা বিরতি করেন। তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় রাজা গজনফর আলী খান সোভিয়েট চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্সকেও আমন্ত্রণ জানান। এখানেই প্রধান মন্ত্রী তাঁর মস্কো সফরের আগ্রহ ব্যক্ত করে ইঙ্গিত দেন যে, একটি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেলে তিনি মস্কো যাবেন। এই আমন্ত্রণটি জুন মাসে পাওয়া যায়। তারিখ চূড়ান্ত করা হয় এবং সোভিয়েত সরকারের ব্যক্ত ইচ্ছানুসারে মিঃ শোয়েব কোরেশীকে মস্কোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। কিন্তু কোথাও কোনো গোলমাল হয়ে যায় এবং তারিখগুলোকে রুশরা পাকাভাবে নিশ্চিত করেনি। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে করাচী ও মস্কোর মধ্যকার যোগাযোগ চ্যানেলকে আকস্মিকভাবে তেহরান থেকে নতুন দিল্লীতে স্থানান্তরিত করা হয়। এবার নতুন দিল্লীস্থ সোভিয়েট দূতাবাস থেকে আরো এক দফা মূলতবির খরব করাচীকে জানানো হয়। এর ফলে এমন সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, লিয়াকত আলী খানের মস্কো সফরের বিষয়টির মধ্যে আরো কোনো পক্ষ নাক গলিয়েছে। সেই অন্য পক্ষটি স্পষ্টত ছিল ভারত। এবারের মুলতবির পর লিয়াকত আলীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। বাগদাদ চুক্তির পরবর্তীকালে যা সেন্টো হয়, তার সদস্যপদ গ্রহণ ছিল এর পরিষ্কার পরিণতি।
সেই থেকে মস্কো পাকিস্তানের প্রতি বৈরীভাবাপন, এমন কি অধিকৃত কাশ্মীরকে সে ভারতের পক্ষ নাক গালয়েছে। এমন কি অধিকৃত কাশ্মীরকে সে ভারতের অংশ হিসেবেও বর্ণনা করেছে। মস্কোর এমন বিরূপভাবের পর লিয়াকত আলীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। বাগদাদ চুক্তির পরবর্তীকালে যা সেন্টো হয়, তার সদস্যপদ গ্রহণ ছিল এর পরিষ্কার পরিণতি।
আইয়ুব খানের চেষ্টায় যদিও এর পরে মস্কোর সাথে সম্প্ররকের বরফ গলতে শুরু করে কিন্তু ভারত মস্কোর সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক সম্পর্ক বজায় রাখতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করার লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সম্ভাব্য সকল সাহায্য করে। এর কারণ শুধু ভারত ও ইউ এস এস আর-এর পুরনো সম্পর্ক ছিল না, মূল কারণটি ছিল আমেরিকা ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক মধুর করার এবং দুই বৃহৎ শক্তির নতুন পর্যায়ে স্বাভাবিক সম্পর্কে আসার পথ খুলে দেয়ার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের পালিত অসাধারণ ভূমিকা। এভাবেই ঘটনা প্রবাহ ঘটেছিল।
কেন ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত ভারতকে সাহায্য করেছিল আর চীন ছিল নিশ্চুপ ও কিভাবে ইয়াহিয়ার চেষ্টায় আমেরিকার সাথে চীনের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছিল?
১৯৭০ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং ২৫ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে এক ঘণ্টাস্থায়ী একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। তিন সপ্তাহ পর ইয়াহিয়ার চীন সফরের কথা ছিল। নিক্সন ইয়াহিয়াকে চীনের নেতৃবৃন্দের কাছে তাঁর চীন সফরের ইচ্ছার কথা পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন এবং একদিন অবস্থান করার পর সেখানে থেকে তিনি বেইজিং যান। বেইজিং এ তিনি চৌ এন-লাই- এর সঙ্গে নিক্সনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। নিক্সন ও চৌ এন-লাই-এর মধ্যেএই গোপন কূটনীতির ফলাফল বিশ্ব শান্তির অগ্রগতি ঘটানোর ক্ষেত্রে একাট প্রধান অবদান রেখেছিল, কিন্তু পাকিস্তানকে তার ভূমিকার জন্য অব্যবহিত অশুভ ফল ভোগ করতে হয়েছিল। সংবাদটি শোনার পর ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন উভয়ই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, বিশেষ করে সোভিয়েট ইউনিয়ন ক্ষিপ্ত হয় বেশি। অচিরেই মস্কো ও নতুন দিল্লীর মধ্যে সফর বিনিয়ম হতে থাকে। ১৯৭১ সালের আগস্টে ঘোষিত হয় তাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত 'সুদূরপ্রসারী শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি'র কথা যাতে ভারতের ওপর আক্রমণের সময় সোভিয়ে্ত ইউনিয়নের জন্য হস্তক্ষেপের সুযোগ যোগানো হয়। এতে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সম্প্রসারণ করা হয় যে,
'একজনের ওপর আক্রমণকে। অন্য জনের ওপর আক্রমণ' হিসেবে বিবেচনা করার কথা সংযোজিত হয়। অক্টোবরের শেষদিকে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকৃত শত্রুতার শুরু হয় সোভিয়েট ইউনিয়ন তখন পাকিস্তানের অবস্থান নির্ধারণের জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহার করার সুযোগসহ ভারতকে সকল প্রকার সামরিক সাহায্যের যোগান দিয়েছিল।
আমেরিকা কি আসলেই পাকিস্তানকে যুদ্ধকালীন সময়ে সাহায্য করেছিল?
আমেরিকা ছিল যথারীতি অনির্ভরযোগ্য। ১৯৬২ সালে সংঘটিত চীন-ভারত যুদ্ধকালে আমেরিকা ভারতকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিল, যদিও প্রেসিডেন্ট আইউব খান এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন যে, সরবরাহকৃত সমরাস্ত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। আইউবের প্রতিবাদ সত্ত্বেও আমেরিকা ভারতকে অস্ত্র দিয়েছিল। ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে আমেরিকা তার অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং বিশ্ব ব্যাংকের কনসোর্টিয়াম বৈঠক স্থগিত করিয়ে দেয়। দু'মাস পর যখন ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করে তখন আমেরিকা পাকিস্তানে সকল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, এমন কি খুচরো যন্ত্রাংশ বহনকারী জাহাজগুলোকে গভীর সমুদ্র থেকে দিক পরিবর্তন করে সে অন্য দেশে নিয়ে যায়। এ সব কিছুর পরও চীন ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালে অবদান রাখেন, কিন্তু তথাপি পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি বা হস্তান্তরের ওপর মার্কিন কংগ্রেস নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, এমন কি ১৯৭১ সালেও অন্যান্য উৎসের কাছে সামরিক সরঞ্জামাদি চাইতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন সূত্র থেকে সরবরাহ না থাকায়, বিশেষ করে খুচরো যন্ত্রাংশের অভাব পূরণ করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বেশির ভাগ অস্ত্রশস্ত্র ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী। ফলে যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামাদির অভাবে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপনে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে বলেছিল। ইয়াহিয়া সর্বান্তকরণে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন। তিনি শুধু বৈঠকই আয়োজন করে দেননি, হেনরি কিসিঞ্জারের পিকিং সফরের জন্য বিমান এবং অন্যান্য সকল সুবিধা যুগিয়েছেন। আমরা আশা করেছিলাম যে, বিনিময়ে অন্তত খুচরো যন্ত্রাংশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কিন্তু নিক্সনের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, যুদ্ধের ব্যাপারে সাধারণত কংগ্রেস সিদ্ধান্ত প্রণেতা হয়ে থাকে, প্রেসিডেন্ট নন। হেনরি কিসিঞ্জারের সাফল্যের প্রতিদানে আমরা কিছুই পেলাম না। অন্য দিকে রাশিয়ার শত্রুতা বৃদ্ধি পেল। ভারতীয়রা পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগাল এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি সম্পাদন করল। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয়রা সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের কবল থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বাহিনী পাঠিয়েছিল, এমন কি প্রকাশ্যে আক্রমণের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি, কেবল পাকিস্তানের প্রতি তথাকথিত 'কাত হওয়া' ছাড়া। হেনরি কিসিঞ্জারের গ্রন্থ থেকে এ কথাটিপরিষ্কার হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের অনুকূলে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিল। আমরা যেভাবে আমাদের ধর্মে বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসও ঠিক একইভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। কোনো একনায়কের অধীনে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ভারতের বিরুদ্ধে কোনোদিনই পাকিস্তানকে সাহায্য করবে না। একথা পাকিস্তানকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। বাকি সবই স্বপ্নচারিতা। বহুল আলোচিত সপ্তম নৌবহর পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানকে সাহয্য করতে আসছিল না, এটা অগ্রসর হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
চীন তার বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্য করলেও পরে কেন সরে গেল?
পাকিস্তান যখন সিয়্যাটো-র সদস্য ছিল তখনও চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় চীন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিল। চীন তার ট্রুপসকে ভারতীয় সীমান্তে পাঠিয়েছে এবং ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে এক ধরনের চরমপত্র জারি করেছে। পাকিস্তানও চীনের সমর্থনে ভূমিকা রেখেছে- প্রথমবার আইউবের শাসনকালে, যিনি ১৯৬১ সালে আমেরিকা সফরকালে প্রকাশে চীনের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন। তারপর ইয়াহিয়া খান চীন ও আমেরিকার মধ্যে সেতু বন্ধন হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭০-৭১ সালে দু'টি কারণে চীনের মনোভাব সতর্ক ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এতে জড়িত ছিল এবং তাদের মতামত ও অনুভূতিকে চীনারা উপেক্ষা করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া অভ্যন্তরীণ নীতির প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থনের ফলে ঐ প্রদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ চীনের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যাপারে নিজেদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে চীনারা ঐ অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে অবন্ধুসুলভ সম্পর্ক ও মনোভাব সৃষ্টি করতে চায়নি। দ্বিতীয় কারণটি ছিল চীন ও ভারতের প্রতি রাশিয়ার মনোভাব। ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর সামরিক চুক্তি সম্পাদনের পর চীন সীমান্তে চল্লিশ ডিভিশন সৈন্যের বিশাল সমাবেশ ঘটানোর মাধ্যমে রুশরা চীনের নিরপেক্ষতাকে নিশ্চিত করেছিল। চীন যদি ভারতের বিরুদ্ধে ট্রপস পাঠাতো তাহলে রুশরা চীনকে আক্রমণ করত। অমন একটি নিশ্চিত নিশ্চয়তার পরই কেবল ভারতীয়রা ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে পেরেছিল।
জনাব ভুট্টো ও অন্যরা, অবশ্য অস্পষ্ট ও পরোক্ষভাবে, বলে আসছিলেন যে, চীনারা সাহায্য করবে। যদিও তার প্রতিনিধিদলের সফরকালে চীনারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল যে, রুশ হুমকির সুস্পষ্ট কারণে তাদের পক্ষে আমাদেরকে সাহায্য করা সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তা ভুট্টোর সঙ্গে চীন গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁদের সকলেই এ ধারণাটি দিয়েছেন যে, চীনা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জাতিকে সত্য কথাটি বলা হয়নি। চীনারা ইতিমধ্যেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সাহায্য করার অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু জনাব ভুট্টো এই ধারণাই দিয়েছিলেন যে, অমন একটি সাহায্য পাওয়া যাবে। ইয়াহিয়াকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ৪ নভেম্বর তিনি (ভুট্টো) বলেছিলেন যে, ভারত যদি আক্রমণ চালায় তাহলে গঙ্গার পানির রং পাল্টে যাবে। সামগ্রিক রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক পরিস্থিতি কিন্তু অমন একটি আশাবাদী বিশ্লেষণের কোনো কারণ উপস্থিত করেনি। এর একমাত্র কারণটি হতে পারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের শুরুকে নিশ্চিত করা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জি এইচ কিউ সম্ভাব্য চীনা হস্তক্ষেপের মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঢাকাকে আশ্বস্ত রাখতে চেয়েছে। গভর্নর তাঁর টেলেক্স বার্তায় বলেছিলেন, "যদি কোনো বন্ধুর সাহায্যের আশা থেকে থাকে তাহলে তার অ্যাকশন আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। অন্যথায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে আলাপ- আলোচনা শুরু করা উচিত...।" এর জবাবে হাই কম্যান্ড গভর্নরকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, 'চীনাদের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে।
১৪ ডিসেম্বর জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স থেকে টেলিফোনে নিয়াজী এই মর্মে একটি বার্তা পেয়েছিলেন যে, উত্তর দিক থেকে হলদেরা (চীনারা) এবং দক্ষিণ দিক থেকে শাদারা (আমেরিকান) আসছে। এই বার্তায় অনুপ্রাণিত হয়েই নিয়াজী এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, এমন কি ট্যাংকও যদি তার শরীরের ওপর দিয়ে যায়, তাহলে তিনি সে ট্যাংকগুলোকেও থামিয়ে দেবেন। বিস্তারিত জানার জন্য এবং সমন্বয় আয়োজনের উদ্দেশ্যে আমি চীনের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম কনসাল জেনারেল এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। তিনি পিকিং থেকে কোনো বার্তাই পাননি, যদিও তাঁদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন। অন্যদিকে বারবার তিনি আমাকে বলে চলছিলেন, "জনগণকে আপনাদের পক্ষে আনুন, জনগণকে আপনাদের পক্ষে আনুন।" আমি তাঁকে বলতে পারিনি যে, সেটাই ছিল প্রধান সমস্যা এবং পুর্ব পাকিস্তানের সব জনগণই ছিল আমাদের বিরুদ্ধে।। ...চলবে
মুল লেখাঃ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ( 'How Pakistan Got Divided ' গ্রন্থ)
ভূমিকাঃ মুনতাসীর মামুন
(সার সংক্ষেপ ও অনুলিখনঃ শেরজা তপন)
অনুবাদকের কথাঃ
'একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অপমানজনক পরাজয় বরণ করার জন্যে পাকিস্তানী জনগণের কাঠগড়ায় তখনকার জেনারেলদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই অপরাধ ও অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে অনেক জেনারেলই আত্মজীবনীতে একাত্তরের যুদ্ধে নিজেদের দোষ ও ভুল-ত্রুটিগুলাে ঢাকতে এবং সাফাই গাইতে চেষ্টা করেছেন। রাও ফরমান আলীও তার ব্যতিক্রম নন। এসব লেখায় তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনাই এসেছে এবং জেনারেলরা নিজেদের সুবিধামতাে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সব কারণে পাকিস্তান হেরেছিল, সেসব অনেক ভুল ও দোষ পরস্পরের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। জেনারেল রাও ফরমান আলীর How Pakistan Got Divided বইটি রচনাশৈলী বিন্যাসের দিক থেকে অন্য জেনারেলদের চাইতে অনেক উন্নত। বইটি তিনি কেন লিখেছেন এ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী খানের ভাষ্য, “অন্য অনেকে যা দেখেছেন বা দেখতে পেয়েছেন, আমি তার চেয়ে অনেক বেশী দেখেছি।” কী দেখেছেন রাও ফরমান আলী খান? বইটিতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা কতখানি সত্য? রাও ফরমান আলীর ভাষ্য অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসভাজন মনে হবে।'
***
সংক্ষিপ্ত জীবনী
রাও ফরমান আলী খান ১৯২৩ সালে পূর্ব পাঞ্জাবের রোহতকে এক রাজপুত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন (সোনারগাঁও এর ঈশা খাঁ ছিলেন একজন মুসলিম রাজপুত। ধর্মীয় ভিন্নতা থাকলেও যখনই রাজপুতদের অভিন্ন গৌরবের প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলিম উভয় রাজপুত গোষ্ঠী বহুবার একত্রিত হয়ে বহি:শত্রুর মোকাবেলা করেছে।) যা তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্টিলারি রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর, তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।
৪ জুলাই ১৯৭১ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি মেজর জেনারেল (রাজনৈতিক বিষয়ক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তী তারিখ থেকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।
হামিদুর রহমান কমিশন যদিও গণহত্যার জন্য তাকে দায়ী করে পরে অব্যাহতি দিয়েছিল, এই বলে যে তার অবস্থানের প্রকৃতির কারণে তিনি সরাসরি কোনও সামরিক অভিযানে জড়িত ছিলেন না, যা মূলত প্রশাসনিক ছিল।
( যদিও আমাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার মুল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে দায়ী করা হয়। গভর্নর হাউসে ও তার কার্যালয়ে কিছু দস্তাবেজ ও নোটবুক এমনই সাক্ষ্য দেয়। )
৭১-এর যুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তার সহকর্মী ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। যুদ্ধের পর তাকে সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তার সকল ব্যাজ ফিরিয়ে নেয়া হয়।
১৯৭৪ সালে তাকে ফৌজি ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়,তিনি ফৌজি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা ও রাসায়নিক সার তৈরিতে অবদান রাখেন -১৯৭৮ সালে ফৌজি সার কোম্পানির প্রথম পরিচালক ছিলেন।১৯৮৫ সালে, তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হকের প্রশাসনে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিযুক্ত হন, এই পদে তিনি ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর, ফরমান আলী আত্মগোপনে চলে যান এবং পেনশনের টাকায় রাওয়ালপিন্ডিতে খুব শান্ত জীবনযাপন করেন বলে জানা গেছে।
২০০৪ সালের ২০ জানুয়ারী, ফরমান আলী মারা যান এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতে ওয়েস্ট্রিজ কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অবদানের জন্য;
Burma Star
War Medal 1939-1945
Queen Elizabeth II Coronation Medal পদকপ্রাপ্ত হন।
©somewhere in net ltd.
১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:৩৭
ঢাবিয়ান বলেছেন: আওয়ামিলীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায় এক্কেবারে লালবাত্তি জ্বালিয়ে দিলেন। যাক এই পোস্ট এই ব্লগে অন্য আর কেউ দিলে জামাত শিবির ট্যগিং এর সাথে বোনাস কিছু চ বর্গীয় গালি খেয়ে যেত। এমনকি ব্যানও খেয়ে যেতে পারত।