![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তখন ইউনিভার্সিটিতে সবে ঢুকেছি। সকালে কার্জন হল, দুপুরে চারুকলা, বিকেলে কলাভবন, সন্ধ্যায় টি.এস.সি, রাতে হল এই করে মাঝ রাতে যখন রুমে ফিরি তখন শুরু হয় রুমের ছেলেপেলেদের সাথে আড্ডা। আশেপাশের অন্য সব রুমের ছাত্ররা এক হয়ে সে আড্ডা চলে ভোর পর্যন্ত। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ি যেন সকালের আড্ডায় দেরি হয়ে না যায়।
আমাদের এই আড্ডার মধ্যে সাহেব নামের ছেলেটা কিভাবে যেন ঢুকে পড়ে। বেশির ভাগ সময় টি.এস.সি’র আড্ডায় উল্কার মতো হাজির হয়, কিছু সময় অনর্গল কথা বলে, উল্কার মতোই আবার মিলিয়ে যায়। যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ আমাদের আর কথা বলার সুযোগ থাকে না। আমরা শুধু শুনি। সাহেব থাকে আড্ডার মধ্যমণি। যে বিষয়েই কথা হয় তাতেই তার অগাধ জানাশোনা, যার যে সমস্যাই হোক, সমাধান তার কাছে কোনো বিষয়ই না। তার ভাষাটা অনেকটা এরকম, এইটা কোনো ব্যাপার? ওইটা কোনো সমস্যা হইলো? এইটা তো আমার হাতের মুঠোয়, ওকে উড়িয়ে দেওয়া তো আমার জন্য দুই মিনিটের ব্যাপার। আশেপাশের মানুষ সম্পর্কে ও তার একটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল – ও একটা মানুষের জাত হইলো, অমুক তো একটা অপদার্থ। তার ভাবখানা এমন ছিল যে সেই শুধু মানুষ নামের এক উৎকৃষ্ট প্রাণী, বাকী সব আবর্জনা।
সাহেবকে নিয়ে আমাদের কিন্তু একটা দ্বিধা এবং সন্দেহ ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু প্রতিবাদ করিনি কখনো। বরং তার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। কারণ, তার কথা সেই সব লম্ফজম্ফ কথা বার্তা শুনতে কিন্তু খারাপ লাগত না। কথাগুলো বলতো এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে সেগুলো অবিশ্বাস করার সাহস আমাদের হতো না। আমরা তখন তো সবে কলেজ শেষ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। ভারী লোকজন দেখে তখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। সাহেবকে আমাদের ভারী লোক মনে হতো।
সাহেব সবসময় নিজের বিষয় নিয়ে কথা বলতো। আসতো অল্প সময়ের জন্য। নিজের কথা শেষ হলেই কোনো এক ছুতায় উঠে পড়তো। অন্যের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাত না। জীর্ণ-শীর্ণ, শ্যাম বর্ণের সাহেবের চলাফেরা ও ছিল সাহেবী কায়দায়। প্যান্টের ভিতর শার্ট গুঁজে বেল্ট বেঁধে চকচকে জুতা পড়ে মাথায় কড়া করে তেল মেরে কায়দা করে চুল আঁচরে কেতাদুরুস্থ হয়ে চলতো সব সময়। কখনো এর ব্যাতিক্রম দেখিনি। বুকে আড়াআড়ি ভাবে ফিতায় ঝুলানো থাকতো একটা ব্যাগ। সেই ব্যাগ সব সময় ঠাসা থাকতো নানা রকম জটিল জটিল ইংরেজি কিতাবে। সেই সব কিতাব খুলে আমাদের কী সব বুঝাতো তার আগামাথা আমরা কিছুই বুজতাম না। শুধু মাথা ঝুলাতাম।
আমাদের মাথা ঝুলাবার একটা বিশেষ কারণ আছে। সাহেব ছিল অসাধারন মেধাবী ছেলে। মেধাবী ছেলেদের শ্রেণীতে আলাদা গুরুত্ব থাকে। সব মেধাবী ছেলেরা সেই গুরুত্ব উপভোগ করে না। কিন্তু সাহেব করতো। শুধু করতোই না, সে সে গুরুত্বকে শ্রেণীর বাহিরেও ছড়িয়ে দিতো। সাহেব অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিল। আমাদের সমাজে মেধাবী ছাত্রদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা থাকায় পছন্দ হোক বা না হোক তাদের সেসব কথা সাধারনের মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। আমরাও সাহেবের কথা শুনতাম, মনোযোগ দিয়েই শুনতাম।
একদিন সন্ধ্যায় বইমেলার জন্য স্টল সাজাচ্ছি। একটা গাড়ি এসে থামলো আমাদের স্টলের সামনে। গাড়ি থেকে সাহেব বেরিয়ে এলো। হাসি হাসি মুখে বলল, - জার্মানির সাথে ২ মিলিয়ন ডলারের একটা চুক্তির কথা তোদের বলেছিলাম না, সে কাজটা আজ সম্পন্ন হল। আব্বু আজ ডেলিগেটদের সাথে জার্মান চলে গেলো। পরশু আমিও যাবো।
জার্মানির সাথে ২ মিলিয়ন ডলারের চুক্তির! আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। এ ব্যাপারে কেউ কিছু জানে বলেও মনে হলো না।
চল তোদের আজ খাওয়াবো - বলল সাহেব।
আমরা ডলারের মানুষ না, সে সব বুঝিও কম। আমাদের আগ্রহ যাতে সেই খাবারের কথা শুনে হুড়মুড় করে ওর গাড়িতে ঢুকে পড়লাম। সে রাতে ভীষণ খাওয়া দাওয়া হলো। সাহেব সত্যিই আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দিলো। আমাদের মধ্যেই নিচু গলায় আলোচনা শোনা গেলো , ডলার ফলারের কোনো ঘটনা মনে হয় আসলেই একটা ঘটেছে।
আমাদের মাথা আরো একবার ঘুরে গেলো যেদিন আমাদের স্টলে বিক্রির জন্য সাহেব নিজের লেখা বই দিয়ে গেলো। আমরা ভেবে পাই না, একজন মানুষের মধ্যে এতো প্রতিভা, এতো ক্ষমতা, এতো জ্ঞানের বাহার কিভাবে সম্ভব!
সাহেবের বাসা বা দেশের বাড়ি কোথায় থাকতো আমরা কিন্তু কেউ জানতাম না। এমন কি ওর ক্লাসের সহপাটিরাও না। কেউ বলতো ধানমণ্ডি, কেউ বলতো বনানী। কেউ কেউ ওকে মিরপুরেও দেখা গেছে। জিজ্ঞেস করলে বলতো- জন্ম মিডেলইস্টে, শৈশব ল্যাটিনে, কৈশোর স্কানডিনেভিয়ায়, এখন আছি সাব-কন্টিনেন্টে। তোরা কোনটাকে দেশ আর কোনটাকে বাড়ি বলবি। পুরো পৃথিবীটাই তো আমার দেশ, হা হা হা......
একবার কয়েক মাস নিরুদ্দেশ থাকার পর হটাৎ একদিন আড্ডায় হাজির,
- আন্তর্জাতিক অর্থনীতি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য জেনেভায় গিয়েছিলাম। ওখানে আমার একটা গবেষণার উপর বক্তৃতা দিয়েছি। আমার বক্তৃতা শুনে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসের ডীন তার একটা প্রোজেক্টে গবেষণার প্রস্তাব দিলো। সোজা ‘নো’ করে দিলাম। বললাম, আগে আমার ডিগ্রী শেষ হোক, তারপর দেখা করেন।
ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বলল - নোবেল লরিয়েট উমুক প্রফেসর তার নিজের লেখা এই বইটা আমাকে উপহার দিয়েছে। এই দেখ তার অটোগ্রাফ। আমরা প্রায় সবাই একসাথে বইয়ের উপর উপুড় হয়ে পড়লাম নোবেল বিজয়ী প্রফেসরের অটোগ্রাফ দেখার জন্য। ঠিক তখন বলে উঠলো,
- ওহ্ , আমার তো ডীন স্যারের সাথে একটা মিটিং ছিল, ভুলেই গিয়েছিলাম।
বলেই এক লাফে উঠে পড়লো। যে ডীন স্যার আমাদের গরু ছাগলের থেকে উত্তম কিছু মনে করে না সেই ডীন স্যার আমাদেরই সাহেবের সাথে মিটিং করে। আমরা ভাবি আর বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রই।
মন্ত্রী মিনিস্টারদের সাথে সাহেবের হরহামেশা ওঠা-বসার গল্প ওর কাছে প্রায়ই শুনি। এতোদিন সাহেবকে দেখার পর যে ব্যাপারটা হয়েছে, ওর অনেক কথা ঠিক অবিশ্বাস করতে পারি না আবার চট করে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। কেমন যেন ধাঁধা লাগে। কী এক কাজে একবার শিক্ষা মন্ত্রী এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহেব তখন আমাদের আড্ডায় বসা। বলল - সারে সাত কোটি টাকার একটা প্রোজেক্টের ব্যাপারে কথা বলার জন্য মন্ত্রী কয়েকবার আমার কাছে খবর পাঠিয়েছিলো। কিন্তু সময়ই বের করতে পারিনি। সামনে যখন পেয়েই গেলাম তখন ভাবছি কাজটা সেরেই ফেলি। মন্ত্রী গাড়িতে উঠতে যাবে তখন মন্ত্রীর সাথে কি কথা যেন বলতে বলতে আমাদের অবাক করে সত্যি সত্যি মন্ত্রীর গাড়িতে উঠে চলে গেলো।
যে সব ছেলেরা নিজেরা ঘন ঘন চমকাতে পারে এবং সে চমকে অন্যদেরকেও চমকিত করতে পারে, মেয়েরা সে সব ছেলেদের চমকিত করার জন্য ব্যকুল থাকে। চমকে চমকিত হয়ে হোক বা ভালবাসার কারণেই হোক অনার্স ফাইনাল শেষে আমাদের ফ্যাকাল্টির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে লিজাকে সাহেব তার বিবি বানিয়ে ফেলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে ছেলেমেয়েরা কাল্পনিক একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। কিন্তু শেষের দিকে তারা কল্পনার সাথে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক বুজতে শুরু করে। অনাগত বাস্তবতার প্রস্তুতি চলে মনের ভিতর। তাছাড়া আজন্ম শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্টটাও তীব্র হয়ে ওঠে। এসব কারণে আড্ডা আর জমে না। সব পানসা লাগে। কখনো সখনো দু’ চার জন একত্র হলেও কথাবার্তা বিশেষ হয় না। গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার যে যে যার যার দিকে চলে যায়। শুধুমাত্র কিছু ভাগ্যবান ছেলেমেয়েরা বাবার কারণে বা স্বামীদের কারণে তখনও খিলখিলিয়ে হাসতে পারে। এই খিলখিল হাসি শুনলে আমরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকি। বড় অসহায় লাগে তখন। কাছের সব মানুষগুলো কেমন যেন অচেনা মনে হয়। কেমন যেন ছাড়া ছাড়া হয়ে যায় সব।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটা কলেজে মাস্টারি চাকরির নিয়েছি। কলেজের কাজে গিয়েছি সিলেটের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কলেজের অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান একজন নিবেদিত প্রান মানুষ। এলাকায় শিক্ষার হার খুবই কম, মানুষও খুব দরিদ্র। তাই এলাকায় শিক্ষার প্রসারের জন্য তার অনেক প্রচেষ্টা। স্কুল থেকে যারা ভাল রেজাল্ট করে তাদের তিনি উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। এলাকার সচ্ছলদের ধরে কলেজে একটা কম্পিউটারের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। সে সময় দেশে সবে কম্পিউটার এসেছে। কলেজের লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যা নেহাত কম না, যেখানে এ রকম অজপাড়া গাঁয়ের অনেক কলেজে কোনো লাইব্রেরীই থাকে না। ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য এলাকার কৃতি সন্তানদের নামের একটা তালিকা কলেজের সামনে টানিয়ে রেখেছেন। তার নানা প্রচেষ্টা দেখে মুগ্ধ হলাম।
কী এক কথা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান তাঁর এলাকার এক কৃতি সন্তানের কথা বললেন, যিনি একাধারে ব্যবসায়ী, স্কলার, লেখক, শিক্ষক, একজন অর্থনীতিবিদ, বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে উঠাবসা, বিদেশেও তাঁর ভাল যোগাযোগ আছে। এরকম প্রতিভাবান মানুষ দেশে বিরল। স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রতিভাবান মানুষটার ব্যাপারে আমার কৌতূহল জন্মায়। অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে তুখড় মেধাবী ছাত্র ছিলেন, নাম সাহাবুদ্দিন। চমকে উঠলাম। আমাদের সেই সাহেব না তো ? তার অন্য কোনো নাম আছে কি না জানতে চাইলে মফিজুর রহমান বললেন – অন্য নাম আছে কী না জানি না। সে আমার ছাত্র না। তাকে আমি দু’ একবার দেখেছি। বাকী সব লোক মুখে শোনা।
মফিজুর রহমান সাহাবুদ্দিন সম্পর্কে আর তেমন কিছু বলতে পারলেন না। কৌতূহল কিন্তু আমাকে চেপে ধরলো। বললাম - তার বাড়িতে যেতে চাই।
মফিজুর রহমান আমতা আমতা করে বললেন – বর্ষা কাঁদার মধ্যে সে বাড়ি যাওয়ার রাস্তা সুবিধার হবে না। আমি বরং সাহাবুদ্দিন সাহেবের বড় ভাইকে খবর দেই। আপনার সাথে এসে না হয় দেখা করবে।
আমি নাছোড়বান্দা হয়ে বললাম - যাওয়ার রাস্তা যতই দুর্গম হোক সমস্যা না। আপনাদের সাহাবুদ্দিনকে আমি এতো সহজে ছাড়ছি না, হা হা হা...
কোনো লোকালয়ে যাওয়ার রাস্তা যে কতো দুর্গম হতে পারে জনাব সাহাবুদ্দিনের বাড়ি না গেলে আমার ঠিক বিশ্বাস হতো না। হাঁটু সমান কাঁদার মধ্যে কারো বাড়ির উঠোনের উপর দিয়ে, কারো বাড়ির রান্না ঘরের পেছন দিয়ে, কারো বাড়ির পায়খানার সামনে দিয়ে, পচা শামুকে পা কেটে, চার পাঁচটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, ওহ! কৌতূহলের এ কী মূল্য দিচ্ছি। এরমধ্যে একবার কোমর সমান পানি সাঁতরাতে হয়েছে। কলেজের একজন প্রভাষক আর একজন দপ্তরী ছিল আমার সাথে। দপ্তরী পড়নের লুঙ্গি মাথায় তুলে নির্দ্বিধায় পানি সাঁতরে পাড় হয়ে গেলো। সাথে আমি না থাকলে প্রভাষকও হয়তো একই কাজ করতো। সাহাবুদ্দিনের বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন আমরা তিনজনই জলে-কাঁদায় মাখামাখি।
একজন সফল মানুষের বাপ দাদার ভিটে দুর্গম কোথাও হতেই পারে। এতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু সে ভিটের আবাস যদি হয় জরাজীর্ণ, ভগ্নদশাগ্রস্থ আর সে আবাসের যদি বাসিন্দা হয় জন্মদাতা জন্মদাত্রী, তাহলে সে সফল মানুষ কতটুকু সফলতার দাবী রাখে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কাঁদাময় উঠোনের দু’পাশে ভিটেমাটি জাপটে থাকা দু’টো ছোট একচালা ঘর। এই হলো বিখ্যাত সাহাবুদ্দিনের বাড়ি।
সাহাবুদ্দিনের বড় ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। খালি গা, খালি পা, লুঙ্গি পড়া। সাহেবের চেহারায় ওনার ছায়া পড়ে। মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, এই সাহাবুদ্দিনই আমাদের সেই সাহেব। আমাদের আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে গেলো। চাঁটায়ের বেড়ার সাথে ঝুলানো গলায় ফুলের মালা দেওয়া সাহেবের হাসি হাসি ছবি। ছবিটা মনে হয় খুব বেশী আগের না। উঁচু একটা খাটে শুয়ে ছিলেন সাহেবের বৃদ্ধ বাবা। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। পুরোটা সময় আমার সাথে একটা কথাও বলেননি তিনি।
অন্য ঘর থেকে হাতল ভাঙ্গা একটা চেয়ার নিয়ে আসা হল আমার বসার জন্যে। ভিতর থেকে বৃদ্ধা এক মহিলার গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। অনুমান করলাম সাহেবের মা হবেন। একটু পরেই ভিতর থেকে আমার ডাক আসলো। অন্ধকার একটা খুপরির মধ্যে সাহেবের অন্ধ মা দু’হাত দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে হাতড়ালো। তারপর আমার হাত দুটো ধরে সাহেবকে নিয়ে অনর্গল প্রলাপ বকতে লাগলো।
-
- আর সাবুর মাত কিতা মাততাম, ভাইসাব হুনুক্কা, বুল তো খরছি অনেক আগে। তারে জনম দিয়া বুল খরিলাইছি। তাইন আমেরিকা ওমেরিকা বহুত বড় বড় দেশ মারিয়া বেড়ায়। তাইন কিতা পারতানানি মাজে মাজে দেশত আইতা। আমার কিতা খস্ট ইতা আপনারা বুজতা না । আইছ্ছা, আফনে আমারে এখান খথা খউক্ষা, আপনের পোয়া যদি ফরা লেখা জ্ঞান বিজ্ঞানো আগাই তাখে, তে আফনার মার অতো দুখ কিতা, আফনের মা চোখো ফানি তাকতো খেনে...
কথা প্রসঙ্গে সাহেবের বড় ভাইর কাছ থেকে জানলাম, সাহেব একটা স্কলারশিপ নিয়ে এখন লন্ডনে পড়াশোনা করছে। তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রীর মেয়েকে সাহেব প্রাইভেট পড়াতো। সেই সুবাধে মন্ত্রীর সাথে ভালো জানাশোনা ছিল। তিনিই স্কলারসিপটার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাড়ির সাথে কোনোই যোগাযোগ নেই। শেষ এসেছিলো তাও অনেক দিন আগে। বিয়ের কথা শুনলেও সাহেবের বৌ তারা দেখেনি। বিয়ের এক বছর পরেই সাহেবের সাথে লিজার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার খবরও তাদের লোক মুখে শোনা।
আমাদের আপ্যায়ন করার জন্য সরবত, মুড়ি, গুড় দেওয়া হল। মুহূর্তের মধ্যে লেকচারার আর দপ্তরী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিমিষেই সে খাবার শেষ। দপ্তরী মিনমিন করে বলল – এইনতাইন ঢাখার মানুষ, খালি মুড়িত তারার অইতো নায়। তারা গনগন চা খায়।
ভিতর থেকে গুঞ্জন শোনা গেলো –
- চা, চা ...
- চা’র ফানি বয়াও...
- চা’র ফাতা নাই...
সাহেবের বড় ভাই চা আনতে কাকে যেন বাজারে পাঠালো। আমি নিষেধ করে বেরিয়ে এলাম। সন্ধ্যা হতে বেশী বাকী নাই। আলো থাকতে থাকতে পৌঁছতে হবে। দপ্তরী বলল- ছার, ছা টা খাইয়া গেলে...
এর অনেক বছর পরের কথা। আমি গিয়েছি বার্লিনে আন্তর্জাতিক একটা সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে সাহেবের সাথে দেখা। সাথে মাঝ বয়েসি এক বিদেশিনী। পরিচয় করিয়ে দিলো, তার স্ত্রী এরিকা স্মিথ। স্ফীতকায় শরীর, চোখে ভারী চশমা, ব্রাউন টপস, মেরুন স্কার্ট, । আলাপ চারিতায় জানলাম সাহেব আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষিকা এরিকা স্মিথ। ভদ্রমহিলার মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি। আমারই মতো তিনি এসেছেন সম্মেলনে যোগ দিতে। সাহেব এসেছে স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে।
সাহেবের স্বভাব চরিত্রের কোনো পরিবর্তন নেই। সেই আগের মতোই লম্ফঝম্ফ। এরিকা স্মিথের অনেক পিড়াপীড়িতে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে নইলে আমেরিকান কতো সুন্দরী মেয়েরা তার বগলের নিচ দিয়ে যায় আসে, জার্মানীর চ্যাঞ্চেলর তার বাসায় প্রায়ই ডিনার করে, তার নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা এখন শুধু সময় মাত্র...এইসব এইসব।
সম্মেলন শুরুর পূর্বে সদস্যদের বিশেষ এক সভা। সাহেবের স্ত্রীর ডঃ এরিকা স্মিথের সাথে আমিও সভা কক্ষে ঢুকলাম। কক্ষ ঠিক বলা যাবে না, বড় একটা হল রুম। গোল গোল সাজানো টেবিল। প্রত্যেক টেবিলের মাঝখানে তাজা ফুলের বুকে। তাজা ফুলের কারনে হোক বা এয়ার ফ্রেসনারের কারণেই হোক হলের মধ্যে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে। সদস্যরা প্রায় সবাই বসে পড়েছে। আমি আর এরিকা একটা টেবিল বেছে পাশাপাশি বসলাম। সাহেবের মতো এরিকাও অনর্গল কথা বলে। প্রত্যেক টেবিলেই চা কফির ব্যবস্থা ছিল। কফি বানাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, দুজন অনর্গল কথা বলা মানুষ এক সাথে থাকে কিভাবে? স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ এরিকা কথাবার্তা সবই স্বামীকে কেন্দ্র করে, যদিও সে সব কথা শুনতে আমার মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে শোনার ভান করছি। এরিকা বলছে – সাহেবের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা অনেক মজার। একদিন খুব ভোরে তুষারপাত হচ্ছে...
সম্মেলনে আমার একটা স্পীচ আছে। সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য ব্যাগ থেকে স্পীচ পেপার বের করে এরিকার সামনে নাড়াচাড়া করছি। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রশ্ন-উত্তর পর্বটা কী স্পীচের মাঝেই হবে না কী আলাদা ভাবে হবে?
উত্তরটা এক বাক্যে দিয়েই এরিকা আবার শুরু করলো –ও আমাকে প্রথম যে প্রেম নিবেদন করলো, সে গল্পটা বলি, তুমি শুনলে অবাক হবে...
এতো উচ্চ মাপের একজন বিদেশিনী স্ত্রী তার অতি কৃশকায় একজন বাংলাদেশী স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ। মুগ্ধ আমিও হলাম, সাহেবের প্রতিভায়। ওয়েস্টার্ন মানুষেরা সহজে কোন কিছুতে মুগ্ধ হয় না। এ জটিল কাজটা সাহেব করতে পেরেছে। এরিকা সম্বন্ধে সাহেবের ধারনা যাই থাকুক, এরিকাকে কিন্তু স্বামীর ব্যপারে যথেষ্ট অনুরাগী মনে হয়েছে।
- সায়েবের সব চেয়ে যে গুনটা আমাকে আকৃষ্ট করে তা হল, ওর নিজেকে আড়াল করে রাখার স্বাভাবটা!
এরিকা বলতে লাগলো।
সাহেব নিজেকে আড়াল করে রাখে, এই মহিলা বলে কী? টেবিল থেকে চামচ পড়ে গিয়েছে নিচে। উপুর হয়ে উঠাতে উঠাতে জিজ্ঞেস করলাম
- সাহেব নিজেকে আড়াল করে রাখে! তোমার তাই মনে হয়?
- অবশ্যই। একটা বড় উদাহরন দিচ্ছি। আমার সাথে সম্পর্ক হাওয়ার অনেক পরে আমি জানতে পেরেছি যে সাহেবের বাবা আসলে তোমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট ছিল। ও তো এ ব্যাপার নিয়ে....
আমি ধপাস করে চেয়ার থেকে পড়ে গেলাম। আসপাশ থেকে কয়েকজন দৌড়ে এগিয়ে এলো আমাকে উঠানোর জন্য। এরিকা বলল, Are you ok?
আমি বললাম, না।
সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে টেবিলের নিচে ঝুঁকে পড়লো - কী হয়েছে? ব্যাথা পেয়েছো?
মনে মনে বললাম, তার চেয়েও বেশী।
টেবিলের নিচে বসেই ভাবছি, কোন প্রেসিডেন্টের ছেলে সাহেব? কার নাম ও বলেছে? কম পরিচিত কোনো প্রেসিডেন্ট, নাকি জিয়াউর রহমান, নাকি বঙ্গবন্ধু?
©somewhere in net ltd.