![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
## জনৈক ভদ্রলোক তার স্ত্রীর সাথে কলকাতায় গেলেন বেড়াতে। পার্ক স্ট্রীটে হাটতে হাঁটতে তিনি দেখতে পেলেন এক লোককে। বয়স সত্তর এর বেশী। যথেষ্ট স্মার্ট। কিছুক্ষন কথা বলতেই, লোকটি বললেন,
=ওপার থেকে এসেছো?
=হ্যা।
=কোথায় থাকো?
=ঢাকায়। ফার্মগেটে
=ওয়ারী চেন?
=হ্যা। চিনি।
একথা বলতেই, লোকটি হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। ব্যপারটি ঠিক বোধগম্য হলো না। তাকে জিজ্ঞেস করার পর তিনি বললেন, তিনি বাংলাদেশের সন্তান। বাংলাদেশ থেকে ভাষা আন্দোলনেরও আরো আগে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। এরপর বিয়ে করেন কলকাতাতেই। ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, আপনার দেশ তাহলে কোনটা? লোকটি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, অবশ্যই বাংলাদেশ। খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো, তাহলে এটা কি? এই দেশ কি তাহলে? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, এটা তো ভারত। আমি থাকি এখানে। এটাতো আমার জন্মভূমি নয়। আমার জন্মভূমি, মাতৃভূমি আমার বাংলাদেশ। আমি বাংলাদেশের সন্তান।
এই কথাগুলো এক দাদার কাছ ত্থেকে শোনা। ওই জনৈক ভদ্রলোক দাদা স্বয়ং নিজেই।
## একুশে ফেব্রুয়ারি এটি কি? সবাই নির্দ্বিধায় বলে দেবেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আসলেই কি তাই?
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, শফিক, বরকত, সালাম, জব্বার সহ আরো অনেকে। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।
উপরের ঘটনা আমাদের সবারই জানা। এখন, প্রশ্ন হলো, ২১ ফেব্রুয়ারিতে যা ঘটেছিলো, সেটিকে আপনি কি হিসেবে দেখছেন? এটিকে কি আপনি উদযাপন করছেন? এটি কি একটি উৎসব নাকি একটি অর্জন নাকি একটি শোকবহ দিন? এই ২১শে ফেব্রুয়ারীতে রফিক শফিক সালাম সহ আরো অনেকে প্রাণ দিয়েছেন কিসের জন্য? তারা শহীদ। তাই না? সব শহীদরাই শহীদ। ১৯৭১ সালে যে সাওতাল নারী শহীদ হয়েছেন সেও শহীদ। যে কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার শহীদ হয়েছেন তারাও শহীদ। কিন্তু এই রক্ত দান, প্রাণের বলিদান কিসের উদ্দেশ্যে? একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড রক্ষার জন্য। পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পেতেই এই বলি দান। তাই নয় কি? বেশ। কিন্তু, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তা কিসের জন্য? শুধুমাত্র ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মা কে মা বলে ডাকার জন্য। তারাও পারতো উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষাতে মেনে নিতে। তবে কেন এই বলিদান? জাতীয়তাবাদ, শ্রদ্ধা, দেশপ্রেম তাদেরই কেন বা শুধু ভাষার জন্য দেখাতে হলো? হ্যা। আমরা বাঙালি। আমরাই একমাত্র জাতি, যারা বুকের রক্ত ঢেলে ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি। এই ক্রেডিট বাঙালির। বিশ্বের অন্য মানুষ এসে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য প্রাণ দিয়ে যায় নি। কিংবা সূচ ফুটিয়ে একফোটা রক্ত দিয়ে লিখে যায়নি অক্ষরমালা। তবে এই অর্জন কেন আমি ভাগ করে নেব বিশ্বের অন্য দেশের সাথে? কেন এই মাতৃভাষা দিবস তাদেরও মাতৃভাষা দিবস হবে? তাদের কোন অবদান নেই এতে।
প্রথমত, জানি বলবেন বাংলা ভাষাকে সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এটিকি সন্মান প্রদর্শন করে পালন করা হলো নাকি আমাদের অর্জনের ক্রেডিটটা তারা নিয়ে নিলো। মাতৃভাষা দিবস বাঙালিদের অর্জন। অন্য কেউ এটি পালনের অধিকার রাখে না। আমার বাসা মিরপুরে। আমার পাশেরই বিহারিপট্টি। এই দেশ স্বাধীন হওয়া স্বত্তেও তারা এখনো উর্দু ভাষায় কথা বলে। তাদের কাছে এখনো মাতৃভাষা উর্দু। তারা তাহলে কি প্রমান করতে চাইছে? তাদের অস্তিত্ব? নাকি জাতীয়তাবাদ? এই যে ভাষাসৈনিকেরা লড়াই করেছিলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। আর কিছু নয়। স্পেনে কাতালালিয়া সামে এক সম্প্রদায় আছে যারা কাতালালিয়ান ভাষায় কথা বলে। তারা চাইছে স্পেন থেকে আলাদা হয়ে যেতে। এই যে ভাষাগত একটা ভিন্নতা কাজ করছে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। ইউক্রেন চাইছে রাশিয়া থেকে আলাদা হয়ে যেতে। তাদেরও একই সমস্যা। ভাষাগত। মূল কথা হলো, যদি উর্দুই থাকতো রাষ্ট্রভাষা, তবে আমরা কি পারতাম বুকে ধারন করতে লালনের দর্শ্ন? লালনের যে গানে আমরা ঈশ্বরকে খুঁজি, আমরা কি পারতাম তাদের অনুভব করতে? যদি উর্দু হতো মাতৃভাষা, হবে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হেলাল হাফিজ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এদের আর কবিতা লেখা হতো না। এদের আমরা ধারন করতে পারতাম না।
দ্বিতীয়ত, ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোর কাছে লিখিতভাবে প্রস্তাব করে, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সংস্থার ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে পাশ হয়। তাহলে, সাধারন অধিবেশনে কত তারিখে সমর্থন পেয়ে প্রস্তাবটি পাশ হলো? ১৭ নভেম্বর। আর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কি হয়েছিলো? রফিক শফিক, সালাম বরকত সহ আরো অনেকজন শহীদ হন। সেদিন তো কোন ঘোষনা আসে নি মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সেদিন আমরা হারিয়েছিলাম কিছু শ্রেষ্ঠ সন্তান। সেদিন পালন করতে হবে শোক দিবস। জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত। শহীদ মিনারে থাকবে কালো পতাকা।
ভাষা আন্দোলন কোন উৎসব নয়। এটি একটি অর্জন। অনেক কষ্টের বিনিময়ে অনেক রক্ত দিয়ে কেনা এই ভাষা। এটিকে উদযাপন করার জন্য চিকন সূতোর শাড়ী পড়ে খোঁপায় ফুল গুঁজে উদযাপন করার কোন মানে হয় না। মাথা নত করো বিনম্র শ্রদ্ধায়। বুক উঁচু করো গর্বে, স্ফীত পাহাড় প্রদর্শনের জন্য না। এই অর্জন আমাদের। সুখ ভাগ করে নেয়া যায়। দুঃখ ভাগ করে নেয়া যায়। অর্জন নয়। ধরুন, আপনি সারা মাস অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিলেন। ১০০ তে ১০০ পেলেন। আর বাকি সবাই কোনরকমে টেনে টুনে পাশ। এখন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি বলে, তুমি তো অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছো, আমরা তোমার এই কষ্টকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে পরীক্ষায় ১০০তে ১০০ দিয়ে দিলাম। কেমন লাগবে আপনার? ব্যপারটা অনেকটা স্বার্থপরের মতোই শোনায়। যদি তা হয়, তবে তাই। আমার জাতীয়তাবাদ আমাকে এই শিক্ষা দেয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নয়। শোক দিবস।
©somewhere in net ltd.