![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চন্দ্রিমার আধো আলোতে
মোঃ সানোয়ার হোসেন
আকাশে যখন পরিশ্রান্ত সূর্যটা ক্লান্ত হয়ে বিষন্ন বদনে পশ্চিম কোণে ঝিমুনির বেগে ঢলে পড়ছে ঠিক তখন পাখিদেরও যেন নীড়ে ফেরার সময় হয়ে এলো। প্রকৃতির এই কর্মব্যাস্ততার সাথে সাথে আমারো যেন ঘরের জানালা দরজা বন্ধকরে দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু টেবিল থেকে উঠতে যে আর মন চায় না। অনেক দিন বাদে আজ টেবিলে বসে লিখতে বসলাম। কতকাল পেড়িয়ে গেল, কত ঘটনা ঘটে গেল জীবনের তার কোনটা মনে আছে আবার কোনটা মনে নেই। কিন্তু কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখার সময়টার কথা আজো ভুলতে পারিনি। এই জগৎ সংসারে কত ঘটনাইতো বিলীন হয়ে যায় কালের আবর্তে। আবার কতকিছুই তো জ্বলজ্বল করে সবার চোখের সমনে। কয়জনই বা কয়টা মনে রাখে? লিখতে আমি পারিনা, পাকা কোন লেখকও নই, তার পরেও নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো লিখতে লেখক হতে হয় কিনা আমার তা জানা নেই। পাখিরাও বাসা বাঁধে, সংশার করে। আর আমার বেলাতেই উল্টো। জীবনে সংসারের স্বাধটা বোধহয় আর অনুভব করা গেলো না। তবুও সংসারকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এখানে কিভাবে একটা জীবনের উত্থান পতন হয় তা সংশারের খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। জীবনটা যতটা সহজ ভাবা হয় ততটা সহজ নয়। আজ এত কাল পরে কেনই বা সে কথাগুলো বার বার মনে পড়ছে? কেন সেই দিনের কথা আজো ভুলতে পারিনি। বাইরের জানালা দিয়ে শিরশির করে ঠান্ডা বাতাস এসে শরীরে লাগছে। চাদরটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে আবার লেখায় মন দিলাম। অনেক গুলো হিসেব আজো বাকি আছে। আজো অনেক কিছু জানার আছে যা হয়তোবা জীবনের ভুল ছিল। সত্যিই কি সেদিন ভুল হয়েছিল? নাকি সব কিছুই প্রতারনা ছাড়া আর কিছুই না। স্কুলের পাঠ চুকে যখন কলেজে উঠলাম তখন বন্ধুরা প্রায়ই বলত আমি নাকি বড্ড চাপা স্বভাবের। আসলে অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করলেও তা তৎক্ষণাৎ মুখে আসত না। এটাই ছিল আমার বড় দুর্বলতা। সেটা আসলে কেউ বুঝতে চাইত না। সমস্যটা সেখানেই বড় রকমের হয়ে উঠল। এ নিয়ে আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হত। তবুও সেটানিয়ে কোন প্রকার মান অভিমান বা অভিযোগ ছিল না আমার। আজ বড়ই ক্লান্ত লাগছে। এই কয়টা মাস একা থাকতে থাকতে অনেক হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। একা আর থাকতে ভাল লাগে না। তবুও এইতো সেদিন সুশান্ত আমাকে দেখতে এসেছিল। বলল, ‘ বাবা তোমাকে আর একা থাকতে দেব না আমি। তুমি আমাদের সাথেই থাকবে। তোমার কোন কথাই আর শুনব না আমি।” ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে তবেই বিদায় জানাতে পারলাম। অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে থাকার চেয়ে নিজে একা থাকাই ভালো বটে। এই কথাগুলো তখনো মনে মনে গুছিয়েই নিচ্ছি। লেখাটা এখনো শুরু করতে পারলাম না। একটা সিগারেট হলে মন্দ হয় না। সাথে এক কাপ কফি। কিন্তু সেটা এই মুহুর্তে আমার জন্য কষ্টকর। কারণ কফিটা আমাকেই বানাতে হবে। তাই আর কফি নাবানিয়ে সিগারেটটাই ধরালাম। একটু গোড়া থেকে সবকিছু গুছিয়ে নেয়া যাক। তারপর নাহয় ঘটা করে লিখতে বসি। জীবনের গল্পটা পুর্নউদ্যম ঢেলেই লিখি। তাতে আর যাই হোক না কেন মনের তৃপ্তি তো পাওয়া যাবে। ঘরের মধ্যেই পায়চারী করছি। কটা বাজে, ঘড়ির দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না। যার জীবনের গতি থেমে গেছে তার ঘড়ির কাটার গতির দিকে দেখেই বা কি হবে? আগের মত তো সেই ব্যাস্ততা নেই। নেই সেদিনের মত সকালের তাড়া। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই করার আদম্য ইচ্ছা আজ মরে কবেই পাথর হয়ে গেছে তার হিসেব কে রাখে? সেই পাথরে যতই পানি ঢালা হোকনা কেন তা আর মাটির মত নরম হবে না। পাথরের গা বেয়ে পানি শুধুই গড়িয়ে অকুলে হারাবে। যে যায় তাকে কি আদৌ কখনো কেউ ফেরাতে পেরেছিল? যাই হোক সিগারেটটা টানার পর এখন তবু একটু হালকা লাগছে। মনের ভিতর থেকে ঘুমোট ভাবটা ক্রমশ পরিস্কার হচ্ছে। মনটা প্রফুল্ল হচ্ছে প্রথমও দেখার সেই শরতের রৌদ্রউজ্জ্বল দিনটির মত। বেশ লাগছে এখন। এখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এখনি লেখার উপযুক্ত সময়। প্রথম থেকেই সব শুরু করা যাক। মনে হচ্ছে আজ আর রাতের রান্নাটা করতে পারব না আর রাতের খাবারটাও খেতে পারব না। তবু শান্তি এইযে প্রায় একমাস থেকে ভাবতে ভাবতে আজ লেখার মত একটা পরিবেশ পাওয়া গেল। এটাকে আর নষ্ট করা বোধহয় ঠিক হবে না। আমার এতোদিনের বিক্ষিপ্ত মনটাকে অতি কষ্টে ইনিয়ে বিনিয়ে আজ ঝড়ো হাওয়ার এই সন্ধ্যায় বাগে আনা গেল। এটাকে কোন ক্রমেই হাতছাড়া করা যাবে না। শুরু করব কিন্তু তার আগে আর একটা সিগারেট যে ধরাতে হয়!
***
এক
স্কুল আর কোচিং এর ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেলো। উফ! এতো পড়া আর ভালো লাগে না, সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয়টা হলো গণিত। বাসায় এসে দেখি আম্মু আমার জন্য পায়েশ রান্না করে রেখেছে। আপা আমার জন্য একবাটি পায়েশ এনে বলল, ‘ তোর জন্য আজ পায়েশ রান্না করা হয়েছে। বল তো কেন?” আমি ঠিক মনে করতে পারলাম না কেন আজ আমার জন্য পায়েশ রান্না করা হয়েছে? মনে মনে ভাবতে লাগলাম কি কারণ হতে পারে? আপা বলল, “ আরে গাধা আজ তোর জন্মদিন। এটাই তোর মনে নেই?”
“উফ! মাঝে মাঝে আমার নিজের জম্নদিনের কথাই মনে থাকে না। মাঝে মাঝে কেন, কোন দিনও কী মনে ছিল রে আপা? তুই বল?”
“থাক তোর আর মনে রেখে কাজ নেই। আমরা আছি কিসের জন্য? সাহেব বাবুদের কি অতসব মনে রাখতে আছে নাকি! লেখাপড়া শেষ করে তুই মস্তবড় সাহেব হবি, তখন তোর সেক্রেটারি সব দিনক্ষণ মনে রাখবে। এখন নে তো, পায়েশটুকু খেয়ে নে দেখি। আমার হাতে অনেক কাজ আছে বাবা।”
আমি আর কি, স্কুলের কাপড়চোপড় না খুলেই ডাইনিং টেবিলে অধির উল্লাসে পায়েশ খেতে বসলাম। মা হলে অন্তত পক্ষে এতক্ষন কাপড় খুলিয়েই ছাড়ত। আপা, তাই সবকিছুতেই আমার মাফ। আমার বোন তাই সব কিছুতেই আমার জন্য সে সাফাই গায়। আমি কিছু একটা বেঙ্গে ফেলেছি তো, মা সেটা নিয়ে তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলেছে, কিন্তু আমার আপা আমার অপরাধের সব ভার সে নিজের কাঁধে নিয়ে আমাকে শাস্থির হাত থেকে রেহায় দেয়।
আপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ কী হলো রে প্রত্যয়? কি ভাবছি তুই? পায়েশটা শেষ কর আগে।”
আমি সংবিৎ ফিরে পেয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বোকা একটা হাসি দিয়ে বললাম, “ কিছু না আপা। এইতো খাচ্ছি।” বলেই পায়েশের বাটিটা একেবারে খালি করে দিয়ে আপার দিকে তাকালাম। আমার তাকানোর ভঙ্গি দেখেই আপা বুঝতে পারল আমার আরো চাই। ব্যাচ! আবার একবার বাটি ভর্তি পায়েশ দিয়ে দিলো। আর আমি আবারো চেটেপুটে সবটুকুন খেয়ে নিলাম। এই আমার স্বভাব।
আপা বলল, ‘ প্রত্যয় এখন স্কুলের কাপড় খুলে গোসল করে নে। আমি আর তুই এক জায়গায় যাব। যা তাড়াতাড়ি, ওঠ?”
“ কোথায় যাবি আপা? বলনা প্লীজ।”
“আগে গোসল সেরে আয়, যেতে যেতে সব বলব।”
কথাটা বলে আপা ওর রুমের দিকে গেলো। আপার এই স্বভাবটা আমার একেবারে ভালো লাগে না। চাপা স্বভাব। যেটা বলবে না তো কারো সাধ্য নেই যে সেটা ওর মুখ থেকে বের করবে। দেখা যাবে কোথায় যাচ্ছি সেটা সেই জায়গায় না যাওয়া পর্যন্ত আমি ওর মুখথেকে বের করতেই পারব না। বলবেই না একেবারে। আর আমার স্বভাব খুঁতখুঁতে। কোনকিছু পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত পেটের ভাত হজমই হতে চায় না। কিন্তু আপার কাছ থেকে জানার সাধ্য আমার নেই। সাহসে কুলোয় না একেবারে। এমনিতে আমাকে ও সবচেয়ে বেশি আদর করে। কোনদিন আমার ওপর হাত তোলেনি। কিন্তু ও রাগলে মা-বাবা দুজনেই অনেক ভয় পায় ওকে। আর আমি তখন একেবারে ওর ধারের কাছে যাই না যতক্ষন পর্যন্ত না ও আমাকে কাছে ডাকছে। এমনকি আমার বড় ভাই, মানে আপারো বড় সেও আপাকে অনেক ভয় পায়। ভাইয়া বাউন্ডেলে প্রকৃতির ছেলে। একমুহুর্ত বাসায় থাকে না। শুধু খাওয়ার সময় বাসায় আসে। আর প্রতিদিন তো রাত বারোটার পর বাসায় আসবে। এই নিয়ে বাবা কত বকাঝকা করেছে ভাইয়াকে! কে শোনে কার কথা? আপাও অনেক বকেছে, কিন্তু তাতেও কিছু হয় নি। তবে ভাইয়া আপার সাথে মাঝে মাঝে কি সব পরামর্শ করে তার কিছুই আমি বুঝি না। আমি এখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি। অতসব বড়দের কথার আগামাথা কিছুই বুঝি না। হ্যাঁ! তবে ক্রিকেট খেলা নিয়ে কথা বললে আমি সেটা খুব বুঝি। ওদের সাথে তখন কথাও ধরতে পারি। আমরা তিন ভাইবোন যখন ক্রিকেট খেলা দেখতে বসি তখন তো প্রায় একপ্রকার হড্ডগোল বেঁধে যায়। ভাইয়া তখন আপাকে বলে , “আমাদের প্রত্যয় কিন্তু সত্যি ক্রিকেটটা ভালো বোঝে রে নীলু। কি বলিস?”
“হুম ও তো ক্রিকেটও ভালো খেলে রে। আমি দেখেছি ওর খেলা। আর তুইও তো ভালোই খেলতি রে অন্তু। এখন তো আর খেলিস না।”
ভাইয়া আপার খুব বেশি বড় না। এক বছরের বড়। তাই আপা ভাইয়াকে তুই বলেই ডাকে। ভাইয়াও আপাকে তুই বলে। ইস! আর আমার তুই বলার কেউ নেই। তবে স্কুলের বন্ধুরা তো আছেই। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু রিহান। আমাদের পরিবারের সাথে ওর একটা কানেকশন আছে সেটা বুঝতে পারলেও বিষয়টা আমি জানি না। রিহানকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। সালা কোন উত্তর দেয় না। কেমনজানি বড়দের মত করে কথা বলে। তবে কানেকশনটা যে ভাইয়ার দিক থেকে সেটা খুব বুঝি। এতোটুকু বুঝেই বা কী? আমি আর রিহান একই স্কুলে পড়ি। ও আমাদের ক্লাসের ফাস্ট বয়। আর ওর চেহারাটা যে কী মিষ্টি তা বলে বোঝাতে পারবনা। ধ্যাত খালি আমি অসুন্দর একটা ছেলে। শ্যামলা দেখতে। একেবারে যে মন্দ তা না, কিন্তু রিহানের মত অত কিউট না আমি। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা তো ওর পিছনে লাইন দিয়ে থাকে। অথচ রিহান পাত্তাই দেয় না ওদের। ইস! আমার পিছে যদি একজনও লাইন দিত আমি তো ওকে সাদরে গ্রহণ করতাম। ভাইয়ার দিক থেকে রিহানের সাথে সম্পর্কটা ঠিক এখনো আমি জানি না। ভাইয়া ওকে অনেকবার আমাদের বাসায় থাকতে বলেছিল। শুধু ভাইয়া কেন, আমি ছাড়া বাসার সবাই রিহানকে আমাদের বাসায় থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু ও কারোর কথা শোনে নি। একা একা হোস্টেলে থাকে। কেনজানি রিহান বাসায় আসলে ওকে সবাই অনেক আদর করে। বিশেষকরে ভাইয়া। ভাইয়া অনেক আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছে, ছোটখাটো একটা কি যেন কাজ করে। আর তার বড় কাজটা হলো রাজনীতি করা। তবে কাজটা করে যে টাকা পায় তার পুরোটাই রিহানকে দিয়ে দেয়। কেমনজানি খটকা লাগে আমার কাছে বিষয়টা। এটানিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করব তারো উপায় নেই। সবার যা মেজাজ! রিহানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অনেকবার, কিন্তু ও জবাবে শুধু বলেছি তোর ভাইয়াকেই বলিস, তাহলেই জানতে পারবি। ওর কথা বলার ভঙ্গি একেবারে বড়দের মত। রহস্য রেখে কথা বলে। আধাভাঙ্গা কথা বলবে আর একা একা মিট মিট করে হাসবে। কেন যে আমি এতো বোকা সেটাই মাঝে মাঝে বুঝি না? অথচ রিহান কত কি বোঝে! আমি তার আগামাথা কিছুই বুঝিনা সালা। ধ্যাত নিজের ওপরই অনেক রাগ হয়। এর মধ্যেই আমি গোসল সেরে ফেলেছি। একটা গামছা পেচিয়ে পরেছি। শরীর আর মাথা একে বারে ভেজা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আপা বলে চিৎকার করছি এমন সময় মা চলে এলো। মা আমাকে দেখে একেবারে অবাক। তার কারণটা হলো মা আমাকে আগে কোন দিন এতো তাড়াতাড়ি গোসল করতে দেখি নি তো! তাই আর কি!
মা ভূত দেখার মত চোখদুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-“কি রে আজ এতোসকালে গোসল করলি যে? ব্যাপারখানা কি বলত?”
_ “মা, ব্যাপার কিছুই না। আমি আর আপা বাইরে বেরহব তাই।”
-“ কোথায় যাবি?”
-“সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। আমি নিজেও সে ব্যাপারে কিছুই জানি না। মহারানী যেখানে হুকুম করে সেখানেই যাওয়া হবে।”
_ “ও কেমন কথা রে প্রত্যয়! তোর বড় আপা সম্পর্কে এমন বাজে ভাবে কথা বলতে কে শেখাল? একটু একটু করে বড় হচ্ছিস আর বড্ড ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস তুই ইদানিং। তা নীলা তোকে নিয়ে কোথায় যাবে কিছুই বলে নি?”
_ “ মা! তুমি আপাকে চেন না? ও কি কখনো কাউকে কিছু বলে নাকি?”
-“ হা তা তো জানিই। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না।” মা এই সমস্ত কথা বলতে বলতে নিজের কাজে চলে গেল।
কিচ্ছুক্ষনের মধ্যে আমি তৈরি হয়ে গেলাম। এর ভিতরে আপাও তৈরি হয়ে আমাকে ডাকতে এসেছে।
_ “তুই রেডি? চল তাড়াতাড়ি, দেরিহয়ে যাচ্ছে।”
আমি ভেবে পাচ্ছিনা আপা এতো তাড়াহুড়ো করছে কেন? দুর বাবা! কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বলে না বুঝি কি করে? মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো তো ঘুরপাক খাচ্ছে খালি। আর আমার পেটের ভিতরে গুড়গুড় ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। আমরা মগবাজারের ওয়ালেস গেটটা পার হয়ে মগবাজার মোড়ের ওভার ব্রিজের নিচে এলাম। আপা একটা রিক্সা ডাকল। আমি চুপচাপ রিক্সায় উঠে বসলাম। আপা রিক্সা ওয়ালাকে মালিবাগ সুপারমর্কেটে যেতে বলল। এইবার কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। আপার মতলবটা আসলে কি সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। ও নিজের জন্য কিছু কেনাকাটা করবে নাকি? আমি চুপচাপ রিক্সায় বসে বসে বিলবোর্ডগুলো দেখতে লাগলাম। কোথাও মডেলদের ছবি, কোথাও নাটকের প্রমোশনের ছবি। বড় বড় বিজ্ঞাপনের ছবি। কোথাও অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু বিষয় যা বলা যাবে না।
“বিত্তবৈভব না থাকলেও ওদের একটা সুন্দর মন আছে। যেখানে আবেগগুলো আলতো করে খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধে। যেখানে সম্পর্কগুলো অটুট থাকে মায়ার বাঁধনে। যেখানে অর্থের মাপকাঠিতে জীবন চলে না, ওদের জীবন চলে ভালবাসা আর বিশ্বাস নামক দুটি বন্ধনে।”
আমরা মালিবাগ সুপার মার্কেটের সামনে চলে এসেছি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলাম আমরা। আপা দেখি ছেলেদের শার্ট প্যান্টের দোকানের দিকেই যাচ্ছে। এইবার বুঝেছি। আমার জন্মদিনে আমাকে কিছু একটা কিনে দেব। একটা দোকানের সামনে গিয়ে আমরা দাড়ালাম। দুজন লোক দোকানে। একজন সম্ভবত দোকানের মালিক আর একজন কর্মচারী হবে। কর্মচারীটির বয়স পনেরো কি ষোল হবে। ফর্সা, চিকন। টিশার্ট আর একটা কালো প্যান্ট পড়া। মাথার চুল বিলেতী ধরণের সিল্কি, কানের লতি অবধি নেমে গেছে। এক কানে আবার ছোট দুল ও পরা আছে। দেখতে কিছুটা মেয়েদের মতই দেখাচ্ছে। তবে আমার কাছে হিজড়াদের মতই লাগছে। আমি ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে আছি দেখে ছেলেটা সামান্য ভ্রু কুচকে একটা হাসি দিয়ে দিল। কেমন জানি গা গোলানো ভাব হলো হাসিটা দেখে। আপা ছেলেটার সাথে কথা বলা শুরু করল। আমি চুপ করে শুনছি।
-“এই যে ভাই। এর মাপের একটা শার্ট দেখান তো?”
ছেলেটা আবারো আমার দিকে তাকিয়ে ভুকুচকিয়ে হাসল।
-“আপা, কি রঙয়ের শার্ট দিব?”
-“গাড় নীল বা কফি কালার এর আছে?”
_ “আপা নীল রঙের হবে না, কফি রঙের আছে দুটা, দেখাব?”
_ “ হা দেখাও।”
-“ এই রংটা তোর কেমন লাগে রে প্রত্যয়?” আপা আমাকে জিজ্ঞেস করাতে আমার তন্দ্রা ভাঙ্গল। আমি যেন কিছুই শুনছিলাম না এতক্ষণ। মাঝে মাঝে আমার কিযে হয় কিছুই বুঝিনা।
-“হু আপা। এটাই ভালো।”
_ “তোর পছন্দ হয়েছে এটা? পছন্দ না হলে বল আর একটা দেখি।”
-“হু পছন্দ হয়েছে। কিন্তু দাম……?”
_ “তোকে সে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না বাছাধন। পছন্দ হয়েছে কি না সেটা আগে বল।”
-“ দাম জিজ্ঞেস কর আপা। কত বলে আগে শুনি।” আমি বিজ্ঞের মত কথাটা বললাম। ছেলেটা বার বার আমার দিকে তাকআচ্ছে। ইস! কী অসস্থিকর একটা ব্যাপার। আমার এখানে থাকতে একদমই ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এখন যদি বলি আপা চল অন্য কোথাও দেখি, তো আপা হাজারটা প্রশ্ন করে বসবে। আপাকে কি সব কথা বলা যায়? আমি কি বলতে পারব যে , “আপা দেখ ছেলেটা আমার দিকে কী খারাপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে? কি বিশ্রী না আপা? একে বারে গা ঘিনঘিন করে?”
-“ এই যে শোন, এই শার্টার দাম কত?”
_ “আপা নিয়ে যান কম করে রাখব। আপনাদের সাথে দামে বাজবে না।”
_ “ নিয়ে যাব মানে কি? দাম লাগবে না?”
_ “না মানে বলছিলাম যে কম সম করে রাখা যাবে আর কি। হেহেহে।”
ইস! হাসলে যে এই হিজড়াটাইপের ছেলেটাকে কী বিশ্রী দেখা যায়? আয়নাতে কি ও নিজের হাসিটা দেখে না?”
-“দামটা বলো এখন।”
- “জি আপা , বারোশ টাকা দেন। আপনার জন্য কম।”
- “কি বলো! ছোটদের কাপড়ের দাম বারোশটাকা? তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কত রাখতে পারবা সেটা বল। না হলে অন্য জায়গায় দেখতে হবে।”
_ “ না না আপা অন্য দোকানে যেতে হবে না। নেয়ার মত একদাম বলতে পারি। সাতশ টাকা রাখা যাবে। একদম কেনা দামে ছেড়ে দিচ্ছি।”
_ “ ঠিক আছে আমি পাঁচশ টাকা দিব। হলে প্যাক করে দাও।”
_ “ইয়ে মানে আপা আর একটু বাড়ানো যায় না? আর পঞ্চাশ টাকা?”
-“ না একটাকাও আর দিতে পারব না।”
_ “ ঠিক আছে আপা। শুধু আপনাদের জন্য এই দামে ছাড়লাম।”
_ “ ঠিক আছে প্যাক করে দাও।”
ছেলেটা প্যাক করে দিলে আমরা দোকান ছেড়ে চলে যাচ্ছি, ছেলেটা বলল আপা আবার আসবেন। আপনার ভাইটা অনেক সুন্দর আপা। আপা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে হাটতে লাগল। ছেলেটার মুখে এই কথাটা শোনার পরথেকে আমার গা গোলানী ভাবটা আরো বেরে গেলো দ্বিগুণ। কি বিশ্রীভাবে কথাটা বলল আর আপা কি সেটা লক্ষ্য করল না?? এখন আমার বমি বমি লাগছে। আল্লাহই জানে কখন যে আবার বমি হয়ে যায় তার ঠিক নেই।
_ “কিছু খাবি প্রত্যয়? তোর জন্য একহাজার টাকা বাজেট ধরে ছিলাম, কিন্তু টাকা তো আরো পাঁচশ বাচল। চল ফুচকা খাই।”
_ “আপা আমার এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না । তুই খা, আমি দেখি। তোর খাওয়া দেখতেও ভালো লাগে।”
_ “কেন? তোর শরীর খারাপ লাগছে? কই আসার সময়ও তো ঠিকই ছিলি। আর তোকে বাদ দিয়ে আমি একা একা খাব নাকি?”
_ “ না আপা ঠিক আছি। কেমন জানি খালি বমি বমি লাগছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।”
আপা হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে শুরু করে দিলো।
_ “কি বলিস? এসব তো মেয়েদের বিশেষ অসুখের লক্ষণ। হাহাহাহাহ হেহেহেহে হুক‼ ”
_ “দুর তুই কিযে বলিস না আপা? অসুখের আবার মেয়ে ছেলে আছে নাকি? তাই কি হয় কখনো?”
_ “হ্য় হয়। তুই অতসব বুঝবিনা এখন। হেহেহেহে। ”
ইস! আবারো সেই বিদঘুটে হাসি। এমনিতেই বমির ভাবটা আরো বেড়ে গেছে তার ওপর মহারানীর অট্টহাসি‼ দুর বাবা ভালো লাগে না। ওয়াক! ওয়াক!… যা শেষমেশ হয়েই গেলো। চোখ দুটো বড় বড় করে আপা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আপা যেন ভাবতেই পারেনি আমি হঠাৎ বমি করে দিব। আপা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আমাকে দিলো। ততক্ষণে আমার বমি পর্ব শেষ। এখন নতুন পর্ব শুরু। শরীর ভাসা পর্ব। আসলে বমি হলে আমার শরীর কেনজানি অনেক হালকা হালকা লাগে। তখন হাটলেও মনে হয় বাতাসে ভাসছি। তাই আমি এর নাম দিয়েছি ভাসা পর্ব। বমি করার পর এখন কিছুটা ভালো লাগছে। শরীর হালকা লাগছে। শুন্যে ভাসমান পাখির মত হালকা। আমি শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। আপা আমার দিকে আগের মতই অবাক হওয়া ভাবটা নিয়ে তাকিয়ে আছে।
_ ‘ কিরে? এখন একটু ভালো লাগছে?”
_ ‘ হু! ঠিক হয়ে গেছি মনে হচ্ছে।”
_ ‘ সামান্য হাটতে পারবি তো? নাকি ধরে ধরে তোকে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে হবে?”
_ ‘না আপা , আমি ঠিক আছি। হাটতে পারব। কোন সমস্যা নেই। চল যাই।”
_ ‘হঠাৎ করেই তোর শরীর এতোটা খারাপ করবে ভাবতেই পারিনি। আগে জানলে তো, তোকে নিয়েই আসতাম না আজকে।”
আমরা মালিবাগ সুপার মার্কেটের নিচে নেমে রিক্সা নিলাম। রিক্সায় উঠেও আপা আমাকে এক হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। আমার তাতে ভালোই লাগছে। হিসাবের বয়সের তুলনায় আমার আবার মনের বয়সটা অনেক বেশি। তাইতো কারোর আবেগ মাখা চাহনী দেখলেই আমি বুঝতে পারি সে আমার সম্পর্কে কি ভাবছে। আর আপা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওর প্রতিটা স্পর্শই আমার খুব চেনা।
দুই
সকালে উঠেই আমার ব্যাস্ততা বেড়ে গেলো। এই কয়দিনে পড়াশুনার বারোটা বাজিয়েছি। অনেক পড়া জমে আছে। সামনে ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষা অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে। ……………………………………………………………………
মনে হচ্ছে বাবা আমার সাথে কথা বলতে খুব মজা পাচ্ছে।
-“প্রত্যয়?”
-“হুম।”
_ “তোরা স্কুলে স্যারদের আর কি কি নামে ডাকিস? হো হো হো…।”
উফ! বাবার হাসি তো দেখছি আর থামছেই না। মনে হয় গ্রামথেকে ফেরার পর বাবার হাসি রোগ হয়েছে, আর না হয় জ্বীন ভূতে ধরেছে। তানাহলে সুস্থমানুষ সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতো হাসে নাকি? আমি বাবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আর ভাবছি।
-“বাবা তুমি ওসব শুনে কি করবে? তুমি শুনলে রাগ করবে।”
-“নানা রাগ করব না। তুই বলে যা, আমি শুনি।”
_ “ জানো বাবা, আমরা স্যারকে যখন সালাম দেই তখন অস্পষ্ট স্বরে বলি আছাড় মারব স্যার। এই কথাটাকে খুব দ্রুত বললে শোনায় আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। মজা না বাবা?”
_ “কি বলিস তুই? স্যাররা বোঝেন না?”
-“সব স্যারকে তো বলিনা। শুধু গনিত স্যারকে বলি। ঐ দারকাক মার্কা স্যারকে।”
_ “যদি স্যার বোঝেন যে তুই উনাকে আছাড় মারতে চেয়েছিস তবে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে কিন্তু।”
_ “স্যার বুঝলে তো।”
বাবা আবারো হাসতে শুরু করে দিলো। আমি জানিনা বাবার কি হয়েছে, তবে কোন একটা সমস্যা হয়েছে সেটা খুব বুঝতে পারছি। আমি টেবিল থেকে উঠে বেচিনে গেলাম হাত ধুতে।
©somewhere in net ltd.