নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি জ্ঞান আহরণ করতে এসেছি। দেওয়ার মত সামর্থ্য এ গরিবের ঝুলিতে নেই।

@শুভ

ঠিক সবার মতই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। যথেষ্ঠ?

@শুভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মণিপুরী সম্প্রদায়ে একই গোত্র বা সমগোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ এবং অজাচার বিষয়ক মতাদর্শ

২৯ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১২:৪৭

বাংলাদেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ বাঙালি হলেও অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি রয়েছে। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিদের আমরা সচারচর উপজাতি বলেও উল্লেখ করে থাকি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৭। বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির মধ্যে “মণিপুরী জাতি” একটি ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ঠ্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম।
মণিপুরী জাতির বসবাস ভারত ও বাংলাদেশে। এদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা দেশ ত্যাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। আসাম রাজ্যে ত্রিপুরা রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এবং বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরী অভিবাসন ঘটে বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীরসিংহ সহ সিলেটে আশ্রয়গ্রহণ করেন।

বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে। অন্যান্য কিছু এলাকায় মণিপুরীদের বসবাস লক্ষ্য করা গেলেও বৃহত্তর সিলেটেই মণিপুরীদের বসবাস বেশি। বাংলাদেশের মণিপুরীরা তিনটি শাখায় বিভক্ত এবং স্থানীয়ভাবে তারা নিন্মোক্ত তিনটি নামে পরিচিতঃ
১. বিষ্ণুপ্রিয়া
২. মৈতে
৩. পাঙ্গন
মণিপুরী সম্প্রদায়ে শ্রেণী তিনটি হলেও প্রত্যেকটি শ্রেনীর মধ্যে গোত্র রয়েছে। মণিপুরী সম্প্রদায়ে এরকম প্রায় ৪৭ টি গোত্র রয়েছে। গোত্র বলতে আমরা দুই বা তার অধিক গোষ্টির একটি জ্ঞাতিদলকে বুঝি। গোত্র এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল 'Clan'। বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতে, পাঙ্গন শাখার মধ্যে রয়েছেঃ মধুকল্য, সিংহ, সিনহা, খোমল, ব্যগ্রহ, আংরিশ এই গোত্রগুলো।
মণিপুরী সমাজে একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ কিন্তু একই শাখার মধ্যে না। গোত্র আর শাখা দুইটি আলাদা বিষয়। দুটিকে এক করার কোন সুযোগ নেই। ‘মধুকল্য’ একটি গোত্র। এই গোত্রের নারী পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ বা এটাকে অজাচার বলে মনে করা হয়। মধুকল্য গোত্রের পুরুষের সাথে সিংহ কিংবা সিনহা গোত্রের নারীর বিবাহ বৈধ। কিন্তু সিংহ বা সিনহা গোত্রের একই নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। মধুকল্য, সিংহ এবং সিনহা গোত্রের মতই মণিপুরী সম্প্রদায়ের সকল গোত্রের ক্ষেত্রে একই নিয়ম।
মণিপুরী সম্প্রদায় যেসকল কারণে সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ বা অজাচার মনে করে বা এই বিষয়ে তাদের মতাদর্শ গুলো নিচে তুলে ধরা হলঃ
•মণিপুরী সম্প্রদায়ে একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ 'বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা'। একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ দিলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেই। “সমগোত্রে বিবাহের ফলে অটিজম” অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জন্মগতভাবেই মানসিক বা শারীরিক বিকারগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনোই স্বভাবিক হবে না। “ব্লাড ক্যান্সার” হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে তারা মনে করেন।
•মণিপুরীদের মতে সমগোত্রে বিবাহের ফলে শারীরিক যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়ঃ
1.ন্যাংরা বা খোঁড়া হবে
2.একচোখে দেখবে অন্য চোখ কানা হবে
3.জন্ম নেওয়ার পর থেকেই অসুস্থতাই ভুগবে
4.কম বয়সে মারা যাবে
5.জন্মের সময় থেকেই বোবা হয় অর্থাৎ কথা বলতে পারে না।
•সমগোত্রে বিবাহের ফলে একজন গর্ভবতী নারী তার গর্ভপাতের সময় মারা যায়। এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। আবার গর্ভপাতের সময় মা এবং মেয়ে দুইজন’ই মারা যায়। অনেক সময় দেখা যায় মা বেঁচে আছে কিন্তু বাচ্চা মারা যায়।
•একই গোত্রের সকলে ভাই বোন। গোত্রের নারী-পুরুষ দের মণিপুরীরা নিজের ভাই-বোন মনে করেন। যেহুতু নিজের ভাই-বোনের মধ্যে সকল ধর্মেই বিবাহ নিষিদ্ধ তাই মণিপুরীরা সমগোত্রের বিবাহ মেনে নেয় না। মণিপুরীরা তাদের চাচাতো, মামাতো ও ফুফাতো ভাই বোনদের আপন ভাবে। এক্ষেত্রে তাদের ধারণা তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে আগত। দেশের বাহিরে অর্থাৎ বিদেশেও যদি একই গোত্রের মানুষজন পাওয়া যায় তাদেরও তারা সমগোত্রীয় মনে করে। অর্থাৎ বিবাহ নিষিদ্ধ কারণ তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে আগত।
•সামদেব (বিষ্ণুপ্রিয়াদের বেদ) এর বিবাহ প্রণালীতে সমগোত্রের বিবাহ লিখিতভাবে নিষেধ করা আছে। তাদের আদিপিতা অর্জুন একই গোত্রে বিবাহ দিতেন না।
•গোত্রের উৎপত্তি একজন গুরুর কাছে থেকে হওয়ায় একই গোত্রের সকলে গুরু ভাইবোন। সত্যযুগ থেকেই সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ।
•একই গোত্রে বিবাহ করলে বিবাহ পূর্নাংগ হয় না। এখানে পবিত্রতার প্রশ্ন উঠে আসে। কারণ বিয়ের সময় কন্যাকে পাত্রের গোত্রে স্থানান্তর করা বিয়ের প্রধান শর্তগুলোর মধ্যে একটি। একই গোত্রে বিবাহ হলে এই নিয়মের পরিপন্থী হয়ে যায়। ফলে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না। বিবাহ সম্পূর্ন না হলে বিবাহ না হওয়া আর অসম্পূর্ণতাকে তারা একই বলে মনে করে। এ বিবাহ পরবর্তী অবস্থায় যদি একজন নারী-পুরুষ নিজেদের স্বামী-স্ত্রী মনে করে একত্রে বসবাস করে তাহলে সেটা অপবিত্রতা হয়ে যায়। এ সম্পর্কের সবকিছুই অপবিত্র গণ্য করা হয়। ভবিষ্যৎ বংশধর ও অপবিত্র হয়ে যায়।
•সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ এটি মণিপুরী সম্প্রদায়ের একটি বিশ্বাস। পূর্বপুরুষ থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। পূর্বপুরুষদের এ বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই তারা সমগোত্রে বিবাহ করে না। অনেকে পূর্বপুরুষদের এ নিয়মকেই প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। ধর্মীয় কারণকে অনেকে প্রধান কারন মনে করেন না। ধর্মীয় ব্যখ্যা পন্ডিতগণ ছাড়া সাধারণ মণিপুরী লোকজন ভালভাবে জানে না। আদি পুরুষরা কখনোই সমগোত্রের বিবাহ মেনে নেন নি। তাই বর্তমানে তারাও সমগোত্রের বিবাহ মেনে নেয় না।
•মণিপুরী সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন যারা মনে করেন সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ এটা ঠিক নয়। আসলে সমাজ এটাকে মেনে নেয় না। সমগোত্রীয় বিবাহ সামাজিকভাবেই নিষিদ্ধ
•মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা সীমিত। তাদের আত্মীয়তার মধ্যেও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এই আত্মীয়তা বাড়ানো এবং সীমিত এলাকা থেকে বিভিন্ন এলাকাতে ছড়িয়ে পরার লক্ষ্যে তাদের সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ।
•মণিপুরীরা সমগোত্রীয় সকল পরিবারকে নিজের পরিবারের মত মনে করে। নিজের পরিবারে যেহুতু বিবাহ নিষিদ্ধ বা অজাচার মনে করা হয় তাই তারা সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ মনে করে।
•সমগোত্রে রক্তের সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা বেশি। রক্তের সম্পর্কে বিবাহ হলে পরবর্তী প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে বিকলঙ্গতা সহ নানা সমস্যায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়েদের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
•মণিপুরীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্যে সমগোত্রে বিবাহ দেন না।
•সমগোত্রের বিবাহ পুরোহিত/ঠাকুররা মেনে নেয় না। সমগোত্রের বিবাহ তারা সম্পন্ন করেন না। পুরোহিতরা সমগোত্রীয় বিবাহকে অপবিত্র বা পাপ বলে মনে করেন।
•বিবাহের সাথে একটি পরিবারের মান-সম্মান জড়িত থাকে। যদি কোন পরিবারে সমগোত্রীয় বিবাহ হয় তাহলে সমাজের কাছে সেই পরিবারের সম্মানহানি ঘটে।
•প্রত্যেক ধর্ম বা জাতিগোষ্টিতেই সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সমাজকে সবাই মেনে চলে। সমাজের বাহিরে গিয়ে কেউ কিছু করে না। সমাজের বাহিরে গিয়ে কিছু করলে সে পরিবার বা ব্যাক্তিকে একঘরে করে দেওয়া হয়। সমাজের কোন সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করতে পারে না। সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে মণিপুরীরা সমগোত্রীয় বিবাহ করে না বা দেই না।
•একই গোত্রে বিবাহ করলে পুরুষ ও নারীকে উভয় পরিবার হতে ত্যাজ্য করা হয়। এতে পারিবারিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। একারণেও সমগোত্রীয় বিবাহ নিষিদ্ধ।
•মণিপুরী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস সমগোত্রীয় বিবাহ হলে দেবতারা রুষ্ঠ হন। দেবতারা রুষ্ঠ হলে পরিবারের অমঙ্গল হয়। এ বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেও তারা সমগোত্রের বিবাহ নিষিদ্ধ করেছেন।

এই ধারনা বা মতাদর্শগুলো যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। যুগের পর যুগ ধরে মণিপুরী নৃগোষ্ঠীদের মাঝে এই ধারণাগুলোর প্রচলন চলে আসছে। তবে বর্তমানে অনেকেই একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ করছে। এবং এই বিবাহকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের কলহের সৃষ্টি হচ্ছে। একটা সময় দুই পরিবার মেনেও নিচ্ছে আবার কোন পরিবার প্রতিষ্ঠিত রীতিতে অনড়। মণিপুরী সমাজ নিয়ে অনেকেই অনেক কাজ করলেও বিবাহ প্রথা নিয়ে কাজ নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ কাজ'ই মণিপুরীদের ভাষা, সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবন, মণিপুরীদের নৃত্য, মহারাসলীলা ইত্যাদি। এই লেখাটি মণিপুরীদের বিবাহ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিষয়গুলো তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.