নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তমনা, সকল রকমের সংস্কার মুক্ত, আমি ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধতা আমাকে কখনো গ্রাস করে নিতে পারেনি।আমি সুস্থ্য চিন্তা আর মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। আমার শক্তি আমার আবেগ আবার সে আবেগ-ই আমার বিশেষ দুর্বলতা। নেহায়েত সখের বশে এক আধটু কাব্য চর্চা করি, এই আর কি। প্রিয় বিষয় সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, সংগীত, দর্শন, দেশ ভ্রমন আর গোয়েন্দা সিরিজের বই পড়া।ভীষণ ভোজন রসিক আমি। জন্ম যদিও চট্টগ্রামে কিন্তু ঢাকা শহরেই লেখা পড়া আর বেড়ে উঠা। আমার জীবনের গল্প তাই আর দশ জনের মতো খুবই সাদামাটা।
ইমাম আহমদ রেযা খান কাদিরী ব্রেলভী (রহঃ) ছিলেন সত্যিকারার্থে একজন কবি। বিন্দু মাত্র শরীয়তের গন্ডী অতিক্রম না করেও যে, রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সুগভীর ভক্তি, অনুরাগ ও আন্তরিক ভালবাসা প্রকাশ করে উচ্চমানের রসোত্তীর্ণ কাব্য রচনা করা যায়, তার সার্থক প্রমান দেখিয়েছেন ইমামে আহলে সুন্নাত, হযরত আহম্মদ রেযা খান কাদিরী ব্রেলভী(রহঃ)। শরীয়তের বিধানাবলীর প্রতি কঠোর দায়বদ্ধতা, অপরিমেয় রাসুল প্রেম, অতুলনীয় ভাষাশৈলী, ছন্দের লালিত্য ও ভাবেশ্বৈর্যের বিপুল গতিময়তা তাঁকে একজন অপ্রতিদ্বন্ধী আশেকে রাসুলের মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছে। অভিনব অথচ বিষয়ানূগ উপমার সার্থক ব্যবহার, উপস্থাপনায় অভিনবত্ব আর সর্বোপরি রাসুলের প্রতি আত্মনিবেদনের একনিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ সুগভীর প্রেমময় আহবান তাঁর কাব্যকে দিয়েছে ব্যাপক পরিচিতি।তাঁর রচিত প্রতিটা কাসীদা তাই রূপায়িত হয়েছে ‘নবী প্রেমের ঝংকারে অণুরণিত অমর গাঁথা’য়’।আর সেই সাথে তাঁর নাতগুলোও পেয়েছে বহুল লোকপ্রিয়তায় বিপুল অর্ঘ্য, ঈর্ষণীয় সাফল্যের স্বর্ণ শিখর। সম্ভবতঃ একারনেই অনেক সমালোচক তাঁকে "ইমামে ইশক ও মুহাব্বাত" অভিধায় বিভূষিত করেছেন। আর এরূপ অভিধার সার্থকতা তাঁর কাব্যের পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে।
অতি সম্প্রতি "আলা হযরতের (রহঃ) রচিত নাত সাহিত্য” এর উপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভকারী গবেষক জনাব মাওলানা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাহেবের একটা মন্তব্য তুলে ধরা এখানে প্রাসংগিক হবে মনে করছি।ডক্টর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন লিখেছেন,“ জ্ঞান বিজ্ঞানের ছিয়াত্তোর্ধ বিষয়ে সদর্পে বিচরণকারী, লেখালেখির ভূবনে এক অবিশ্বাস্য কিংবদন্তির নাম আ’লা হযরত।বিশেষ করে কাব্য ও নাত সাহিত্য জগতে তিনি অনন্য। ইমামুল কালাম ও ইমামুশশে’র আসনে সমাসীন।আলা হযরত তাঁর না’তগুলোকে আরবী কবিতার বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন পরিভাষা, অলংকরণ, উপমা, প্রবাদ-প্রবচন, ছন্দ ও অন্তমিলের সাযুজ্য ইত্যাদি গুণের অভূতপূর্ব সমাহার ঘটিয়েছেন। ফলে তাঁর নাত সাহিত্য সমগ্র বিশ্বে বিপুলভাবে সমাদৃত ও অতুলনীয়। তাঁর সাহিত্য কাব্য বাস্তবিকই এক তৃষ্ণার্ত মরুচারির কাছে অমৃততুল্য”।
তথ্যসূত্র- স্মারক গ্রন্থ - ২০১৭, পৃষ্টা নং ৪৭, আলা হযরত কনফারেন্স, ঢাকা।
আলা হযরতের (রহঃ) কবিতার ছত্রে ছত্রে নবী অকৃত্রিম নবী প্রেমের যে শাশ্বত সুর মন্দ্রিত হয়েছে তা রাসুলে পাকের প্রতি তাঁর একান্ত আনুগত্য ও মুহাব্বতের অক্ষয় প্রতিধ্বনি। তিনি রচনা করেছেন রাসুলের প্রতি প্রেম ভালবাসার অপূর্ব নিদর্শন নাতিয়া কালাম – “মোস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম, শময়ে বজমে হেদায়াত পে লাখো সালাম”। এমন শাশ্বত পংক্তির কোন নজীর নাই. শত সহস্রবার উচ্চারিত হলেও এর আবেদন, সৌরভ এতটূকু নিস্প্রভ হয় না।রাসুলের সুমহান শানমান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন, আকিদাগত বিভ্রান্তি নিরসন ও বাতুলতার স্বরূপ উম্মোচনে তাঁর লিখনি এক অব্যর্থ প্রতিষেধক।রাসুল প্রেমের অপূর্ব মুর্ছনায় সিক্ত, উচ্চ মার্গের ভাষা ও শব্দ শৈলীর যে কাব্য গাঁথা তিনি নির্মাণ করে গেছেন। আজ পর্যন্ত তা কেউ অতিক্রম করতে পারেননি।
সৃষ্ট জগতে সবচাইতে উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন প্রিয় নবী হাবীবে খোদার প্রশংসায় ঝলসে উঠে আলা হযরতের (রহঃ) কলম। তিনি লিখলেন,
“উয়হী লা মকাঁকী মকীন হুয়ে, সরে আরশ তখত নশীন হুয়ে, উয়হ নবী হ্যায় জিনকে ইয়ে মকাঁ, উয়হ খোদা হ্যায় জিসকা মকাঁ নেহি”।
(হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ৪০)।
অনুবাদ -
তিনি মুহুর্তে পৌঁছেন লা মকান, খোদার আরশে বানান সিংহাসন,
যদি নবীর হয় এ অবস্থান, তবে খোদার না জানি কত উচ্চে স্থান?
একজন বিচক্ষণ মুফতি, সুবিজ্ঞ ধর্ম বিশারদ তথা ধর্ম প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন রসজ্ঞ সুসাহিত্যক। নূর নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা, অপরিসীম কল্পনা শক্তি, সুবিশাল শব্দ ভান্ডারের সুসামঞ্জস ব্যবহার, শব্দ চয়ন, উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগে সার্থকতা, ছন্দ বৈচিত্র, শব্দগুচ্ছ ভিত্তিক চিত্রকল্প এবং সর্বোপরি অসাধারণ প্রকাশভঙ্গী তাঁর কবিতাগুলোকে বিশেষ উচ্চতার আসনে পৌঁছে দিয়েছে।তাঁর ভাষার প্রয়োগ, উপমা, চিত্রকল্প নির্মাণ কৌশল একদম ভিন্নতর।পড়তে গেলে পাঠকের মনে হয়, কবি যা বলছেন, তার সবকিছুই যেন একদম বাস্তবে চাক্ষুষ দেখে দেখে তিনি তা বর্ণনা করছেন।
অদ্বিতীয় আশেকে রাসুল ইমাম আহমদ রেযার (রহঃ) অগাধ এশকের জ্যোতি, তাঁর কাব্য সম্ভারে ছড়িয়েছে অনন্য সুন্দর দ্যুতি।ইশকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নতুন এক মাত্রা ও প্রকাশভঙ্গী দিয়েছেন তিনি। নাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লেখার কাজকে এমনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে পৌঁছিয়েছেন আলা হযরত (রহঃ), যার ধারে কাছেও এখন পর্যন্ত যেতে পারেননি কোন কবি বা নাত রচয়িতা। এটাই ইমাম আহমদ রেযার (রহঃ) পরম কৃতিত্ব।
অন্য কোন লেখনীর কথা বাদ দিলেও শুধু মাত্র ইশকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমৃদ্ধ ১২১ টি কসীদার অনন্য কাব্য সম্ভার “হাদায়েকে বখশিশ” তাঁকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখবে। সুগভীর ইশকে রাসুলের ঠাস বুনুনিতে গ্রন্থিত আলা হযরতের (রহঃ) অমর কাব্য সংকলন “হাদায়েকে বখশিশ” তামাম রাসুল প্রেমিক কাব্য রসিকদের জন্য যেন অমৃত রসে পরিপূর্ণ এক মধুকুঞ্জ। আলা হযরতের ইশকে রাসুলের প্রগাঢ়তা ও প্রেম বেদনা তাঁর এ কাব্য গ্রন্থের প্রতি ছত্রে ছত্রে অনুরণিত ও প্রতিফলিত। নবীজ়ীর প্রেমে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেয়ার চরম আকুতি ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়। নূর নবীজীর প্রেমে নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়েও তাঁর অন্তরে রয়ে গেছে অতৃপ্তির হাহাকার।অতৃপ্ত হৃদয়ে ব্যথিত কন্ঠে আলা হযরত (রহঃ)তাই গেয়ে ওঠেন,
"করো তেরে নামপে জাঁ ফিদা,
না বস এক জাঁ দো জাঁহা ফিদা,
দো জাঁহাসে ভি নেহি জী ভরা,
করো কেয়া করোরো দো জাঁহা নেহি।" (হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ৪০)।
অনুবাদ -
"তব নামে করবো এ জ়ীবন দান, শুধু একটি নয় মোর দুই জাহান,
দুই জাহান দিয়েও ভরলো না এ মন, কি করি হায়! নাই মোর কোটি ভূবন?
তাঁর লিখিত ১৭১ পংক্তি সম্বলিত সালামে রেযা তথা “মুস্তফা জানে রহমত” (হাদায়েকে বখশিশ' ২য় খন্ড, কবিতা নং –১২) দীর্ঘতম সালামের কসীদা হিসেবে স্বীকৃত। এখানে তিনি নুর নবীজ়ীর প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগের প্রতি সালাম দিয়েছেন লাখো বার। নুর নবীজ়ীর জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা ও মুজিজার প্রতি নিবেদন করেছেন লাখো সালামের অর্ঘ্য। নুর নবীজ়ীর সাহাবা, বংশধর, চার তরীকা ও মাযহাবের ইমামগণের প্রতিও তিনি সালাম জানিয়েছেন লাখো বার। সব শেষে নূর নবিজীর সকল উম্মত, সবার মাতা-পিতা-শিক্ষক, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয় স্বজনদের প্রতি তিনি সালাম দিয়েছেন লাখো বার।
মিরাজের ঘটনা নিয়ে আলা হযরত লিখেছেন “কসীদায়ে মিরাজ”
(হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং – ৭৯) নামে ৬৭ পংক্তির এক বিরাট কবিতা।
ওহাবী-নজদীসহ সব নিন্দুকের মুখে ছাই দিতে আলা হযরত লিখেছেন ৫৯ পংক্তি বিশিষ্ট “কসীদায়ে নূর” (হাদায়েকে বখশিশ' ২য় খন্ড, কবিতা নং –২)নামে এক অতি মনোরম কবিতা।
রাসুলে খোদার(দঃ)নূরাণী তনুর সৌন্দর্য শোভায় বিমোহিত আলা হযরত লিখলেন,
“সর তা বাকদম হ্যায় তনে সুলতানে জমন ফুল, লব ফুল, দাহান ফুল, জকন ফুল, বদন ফুল”।
(‘হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং –২৬)।
অনুবাদ - “আপাদমস্তক নবীজীর শরীর, গোলাপ যেন সুগন্ধি,
আনন, চিবুক, অবয়ব, ঠিক যেন কুসুম কলি।”
ব্যক্তি জীবনাচরণের ন্যায় অগাধ ইশক্বে রাসুল সুবাস ছড়িয়েছে আলা হযরতের কবিতার ছত্রে ছত্রে। শুধু মাত্র এক জিহবা দিয়ে রাসুলে পাকের প্রশংসা করে তাঁর অন্তরের তৃপ্তি মিটে নাই। তাই তিনি দুঃখের সাথে বলেন, "কুছ হার মোহে মান যাবা বুয়দ হ্যায়, দরশনা হ্যায় তো ইয়া রাসুলাল্লাহ!" অর্থাৎ - "আহা! হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমার প্রতিটা চুল ও লোম আপনার প্রশংসার জন্য রসনা হতো!"
মহান আল্লাহ পাকের দরবারে মহা সম্মানিত আমাদের প্রিয় নূর নবীজ়ীর যথাযোগ্য প্রশংসাসূচক নাত রচনায় নিজের অজ্ঞতা, অক্ষমতা, দৈন্য এবং অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আলা হযরত (রহঃ) লিখেছেন,
“আয় রেযা!খোদ সাহেবে কুরআ হে মদ্দাহে হুজুর, তুঝছে কব মুমকিন হে ফির মিদহাত রাসুলুল্লাহ কি”? (হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ৫৮০)।
অনুবাদ -
“ওরে রেযা! খোদ কোরআনের মালিক আল্লাহ ব্যস্ত তাঁর প্রশংসায়,
তোমা হেন অধম দ্বারা রাসুলের প্রশংসা হয়েছে, কবে কোথায়?
আলা হযরত (রহঃ) ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাচ্চা আশেকে রাসুল। তাঁর জীবনের প্রতিটা কাজ-কর্ম ছিল কুরআন ও সুন্নাতে রাসুলের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলা হযরত (রহঃ) বলতেন, "আমি পবিত্র কুরআন শরীফ থেকে নাত লেখা শিখেছি। বাস্তবিকই তাঁর প্রতিটা নাত পবিত্র কুরআন এর কোন আয়াতে কারীমা কিংবা কোন হাদীস শরীফের নির্যাস থেকে উৎসারিত।
যেমন - পবিত্র হাদীস শরীফে আছে যে, "আমাদের প্রিয় নূর নবীজির নূরানী দেহ মুবারাকের কোন ছায়া ছিল না"।এ হাদীসের মর্ম অনুসরণ করে আলা হযরত (রহঃ) লিখেছেন,
“তু হ্যায় ছায়া নুরকা, হার আধো টুকড়া নুর কা,
ছায়াকা ছায়া না হোতা হ্যায়, না ছায়া নুরকা”। (হাদায়েকে বখশিশ- ২য় খন্ড কবিতা নং-০২)।
অনুবাদ -
“আলোর প্রতিবিম্ব আপনি, আপনার সর্বাংগ তৈরী নুরের দ্বারা,
ছায়ার কোন হয় না ছায়া, যেমনি আলোকের থাকে না ছায়া”।
ঐ একই কবিতার অন্য এক পংক্তিতে পবিত্র আহলে বায়তের সদস্যদের সম্মানে তিনি লিখেছেন,
“তেরে নসলে পাক মে হে বাচ্চা বাচ্চা নূর কা
তু হ্যায় আইনে নূর তেরা সব ঘরানা নূর কা”।
অনুবাদ -
“হে প্রিয় রাসুল!তোমার পূত বংশ ধারায় সব শিশুরা হয় নুরের,
তুমি নুরের ঝর্ণা যে এক, তব সব বংশ ধারা তৈরী নুরের”।
একইভাবে পবিত্র আহলে বায়্যাতে কেরামগণের প্রতি আকন্ঠ প্রেম ও শ্রদ্ধায় নিবেদিত আলা হযরতের কলম থেকে বেরিয়ে আসে,
“কেয়া বাত হ্যায় রেযা!উস চমনিস্তানে করমকি,
যাহ রা হ্যায় কলি, জিসমে হোসায়ন আউর হাসান ফুল” (হাদায়েকে বখশিশ- কবিতা নং-২৯)।
অনুবাদ -
“একবার ভেবে দেখো রেযা!ঐ বাগিচার দয়ার কথা,
যাহরা যেথা কুসুম কলি, হোসায়ন আর হাসান পূর্ণ কুসুম”।
হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লামের অনন্য মুজিযা আঙ্গুলির ইশারায় আকাশের চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়া, এবং এক যুদ্ধ যাত্রায় খাবার পানির চরম সংকট দেখা দিলে তাঁর আঙ্গুলি মুবারাক থেকে সুমিষ্ট পানির নহর প্রবাহিত হয়। যা দিয়ে উপস্থিত শত শত সাহাবী এবং তাঁদের সওয়ারী জন্তুগুলির পানির প্রয়োজনীয়তা দূর হয়েছিল। এ দুটি মুজিযার উল্লেখ করে আলা হয্রত লিখেছেন,
“নুরকে চশমে লেহরায়ে দরিয়া বহে,
+উঙ্গুলিউ কি কারামাত পে লাখো সালাম।
অনুবাদ –
নূরের যে ঝরণা ধারার ঢেউ ঊঠলো সাগরসম,
নূরানী ঐ আঙ্গুলির কারামতকে জানাই লাখো সালাম।।
(হাদায়েকে বখশিশ', ২য় খন্ড কবিতা নং ৩৬)।
আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের পাক বদনের ঘাম মুবারাক ছিল কস্তুরীর চাইতেও বেশী সুরভিত। এ হাদীসের উপর ভিত্তি করে আলা হযরত (রহঃ) লিখলেন,
“গুজরে জিস রাহ সে উয়হ সাইয়েদে ওয়ালা হো কর, রাহ গেয়ী সারি জমিন আম্বর সারা হো কর” (হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং –২২)।
অনুবাদ - “যে পথ দিয়ে করেছেন গমন নূর নবীজী,
হয়ে গেছে সে পথটুকু কস্তুরীসম সুগন্ধি”।
‘হাদায়েকে বখশিশ', গ্রন্থের আর এক খানা কবিতায় প্রিয় নূর নবীজীর ঘামের সুবাসে বিমোহিত হয়ে আলা হযরত লিখলেন,
“ওয়াল্লাহ!জো মিল যায়ে মেরে গুল কা পসীনা
মাঙ্গে না কাভি ইতর, না ফির চাহে ফুল”
(হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং –২৬)।
অনুবাদ - “মোর গোলাপের ঘাম যদি দেই নব বধূরে,
ভুলে যাবে সে সুগন্ধি ও গোলাপ চিরতরে”।
নূর নবীজীর (দঃ)পবিত্র ঘাম মুবারাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আলা হযরত (রহঃ) কলমে ঝংকৃ্ত হলো অমর বাণী,
“উন কি মেহেক নে দিল কি গুঞ্ছে খিলা দিয়ে হ্যায়
জিস রাহ চল গায়ে হ্যায়,কুচে বসা দিয়ে হ্যায়”।
(‘হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং –৩৭)।
অনুবাদ - সুগন্ধিতে তাঁর ফুল হয়ে, ফোটে মোর মনের কলি,
তাঁর গমন পথের চিহ্ন ধরে, বসে গেছে লোক বসতি”।
সত্যিকার রাসুল প্রেমিকের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রিয় নূর নবীজীর প্রেমে সদা উদ্বেলিত আলা হযরত লিখলেন,
“দিল হ্যায় উয়হ দিল, জু তেরে ইয়াদছে মামুর রাহা,
ছর হ্যায় উয়হ ছর, জু তেরে কদমো পে কুরবান গ্যায়া”। (হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং –১৪)।
অনুবাদ - “হৃদয় বলি তারে, যা তব স্মরণে সদা থাকে উজ্জীবীত”।
এত সুবিস্তৃত পরিসরে নূর নবীজীর(দঃ) প্রশংসায় আলা হযরতের(রহঃ)মত আর কোন কবি বা নাত রচয়িতা আলোকপাত করেন নাই। কেউ তাঁর পবিত্র চেহারা মুবারাকের অপার সৌন্দর্যের কথা বলেছেন, আবার কেউবা আমাদের নূর নবীজীর (দঃ) পূত কদম মুবারকের প্রতি ভক্তি বিগলিত চিত্তে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন। কিন্তু একমাত্র আলা হযরত ছিলেন (রহঃ)এর ব্যতিক্রম। প্রিয় নূর নবীজীর আপাদমস্তক প্রতিটা অংগ প্রত্যংগের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে প্রশংসার ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছেন তিনি। প্রিয় নবীজীর (দঃ) পবিত্র কেশ মুবারাককে দয়া ও করুণার মেঘমালাস্বরূপ বর্ণনা করে প্রশংসায় বিগলিত আলা হযরত (রহঃ) নবীজ়ীর দয়া ভিক্ষা করে লিখেছেন,
"আনা ফি আতাশিন, ওয়া ছখাকা আতম, আয় গেছুয়ে পাক আয় আবরে করম,
বরছন হারে রিমঝিম রিমঝিম, দো বুঁদ ইধারভি গিরা জানা।(হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং –০৯)।
অনুবাদ – “পিপাসার্ত আমি, আর তুমি বদান্যতার খনি!
ওগো পবিত্র কুন্তলধারী! করুণামাখা ওগো বাদলধারা
এদিকেও ঝরাও তব করুণার রিমঝিম ধারা"।
ভব সংসারের বিষাদ-বেদনাক্লিষ্ট আলা হযরত (রহঃ)প্রিয় নবীজীর পবিত্র চরণ কমলে চির শান্তির ছায়া খুঁজে পান। নীচে উল্লিখিত তাঁর কবিতার একটা চরণে খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে সে কথা। যেমন – তিনি লিখেছেন,
“দিল করো ঠান্ডা মেরা, উয়হ কাফে পা চাঁদসা,
সিনে পে রাখ দো জেরা, তুমপে কড়োড়ো দুরূদ”।(হাদায়েকে বখশিশ' ২য় খন্ড, কবিতা নং – ০৮)।
অনুবাদ – "মোর বক্ষ মাঝে দাওনা রেখে, তব চন্দ্রসম পাক কদম,
শান্ত করি হৃদয় মম, তোমায় কোটি দরুদ সালাম"।
নূর নবীজীর প্রশংসায় আলা হযরতের (রহঃ) কবিতায় অবাধ প্রেমের প্রতিফলন দেখা গেলেও তা কখনো শরীয়তের নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করে নাই। রাসুল প্রেমের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে আজীবন ভেসে বেড়ালেও কখনো জোশের মুখে হুঁশ হারা হননি তিনি এবং জোশের তোড়ে মাঝ পথে হারিয়ে যায়নি তাঁর বিবেক ও ঔচিত্যবোধ। বরং তাঁর কবিতাগুলো আবর্তিত হয়ছে একটি মাত্র আদর্শকে কেন্দ্র করে আর সেটি হচ্ছে, "বাআদ আজ খোদা বুযুর্গ তুয়ী, কিসসা মুখতাসার"।
এ প্রসঙ্গে আলা হযরত (রহঃ)এর বাণী চির স্মরণীয়, তিনি বলেছেন যে, "আমার হৃদয় কে দ্বিখন্ডিত করা হলে দেখতে পাবে, তার এক খন্ডে "আল্লাহ" এবং অপর খন্ডে মুহাম্মদ" লেখা আছে।"
সদা ইশকে নবীতে বিভোর আলা হযরত নূর নবীজীর অতুলনীয় সৌন্দর্যের প্রশংসায় সাহাবী কবি হযরত হাসসান বিন ছাবিত (রাদিঃ) এর পদাংক অনুসরণ করে লিখলেন(আরবী-ফারসী-হিন্দি-উর্দু এ চার ভাষার সমন্বয়ে) এক অমর কবিতা,
"লাম ইয়াতি নাজিরুকা ফি নাজারিন,
মিসলে তু না শুদ পয়দা জানা"
জগ রাজ কো তাজ তুরে ছর ছো,
হে তুজকো শাহে দোছরা জানা"। (হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ০৯)।
অনুবাদ - "তুলনা তোমার পাইনা খুঁজে, তব তুল্য সৃষ্টি হয়নি ভবে,
রাজত্বের মহা মুকুট তব শিরে শোভে
দুই ভূবনের রাজাধিরাজ তোমায় নিলাম মেনে"।
আলা হযরতের (রহঃ) কবিতার প্রতিটি চরণে ইশকে রাসুলের (দঃ)অমৃত ধারা সতত বহমান। বস্তুতঃ ইশকে রাসুল(দঃ)আলা হযরতের (রহঃ) কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আর ইশকে রাসুলই(দঃ)হচ্ছে তাঁর কবিতার প্রাণশক্তি।শব্দ চয়ন, বাক্য নির্মাণ, উপমার প্রয়োগ সব কিছুই প্রবল ইশকে রাসুল(দঃ) দ্বারা তাড়িত। উর্দু কবিতার ক্ষেত্রে তিনি এক নতুন ধারা ও দিক দর্শনের জন্ম দিয়েছেন, তাঁর অমর নাতগুলোর মাধ্যমে।নাত সাহিত্যের ইতিহাসে ইশকে রাসুলের সর্বিক প্রয়োগ ইতিপূর্বে এত প্রকটভাবে আর কখনো দৃষ্টি গোচর হয়নি। আলা হযরতের (রহঃ) চিন্তা চেতনা আর কাব্য ভাবনার সবটুকু ইশকে রাসুলকে(দঃ) ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তাই বিজ্ঞ সমালোচকদের মতে, “কাব্য ও নাত সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইশকে রাসুলের এক সফল রূপকার হলেন আলা হযরত(রহঃ)”।শব্দের গাঁথুনীতে, ছন্দের উৎকর্ষে আর ভাবের বিচিত্রতায় অনন্য তাঁর কাব্য শৈলী। তাঁর সৃষ্ট কবিতার অনবদ্য পংক্তিগুলোতে পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়েছে ইশকে রাসুলের (দঃ) সৌরভ। নূর নবীজ়ীর প্রশংসায় সদা প্রাঞ্জল আলা হযরত(রহঃ) এর লিখনি।বিরহ ব্যথায় ব্যাকুল আশেকে রাসুলদের ব্যাথিত (দঃ)চিত্তে প্রশান্তির সুকোমল পরশ বুলিয়ে দেয়, তাঁর অমর কাব্য সম্ভার – ('হাদায়েকে বখশিশ'। তাঁর কবিতাগুলো বাস্তবিকই তৃষ্ণার্ত কোন মরুচারীর কাছে অমৃত তূল্য।
মদীনাওয়ালার প্রেম সাগরে নাতের তরী ভাসিয়ে আলা হযরত (রহঃ)নিশ্চিন্তে পৌঁছে গেছেন লক্ষ্যাভিমূখে। আর যথারীতি লাভ করেছেন, চির বাঞ্ছিত ইশকে রাসুলের (দঃ) অনন্ত সওগাত। মূলতঃ মদীনাওয়ালাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর নাতিয়া কালামের ভূবন।নূর নবীজীর প্রেমে সদা বিভোর আলা হযরতের কবি সত্তা উষর মরুতে ফুটিয়েছে নাতের নব্য কুসুম কলি।
মহা সম্মানিত নূর নবীজীর (দঃ) মর্যাদার সুউচ্চ সোপান মনোরম ভাষায় বিম্বিত হয়েছে আলা হযরতের “সবছে আওলা ও আলা হামারা নবী” শীর্ষক কবিতায়। ('হাদায়েকে বখশিশ', কবিতা নং – ৫৩)।
আমদের প্রিয় নূর নবীজ়ী(দঃ) যে সৃষ্টির মূল কারণ এবং তামাম সৃষ্ট বস্তু ও রূহ জগতের কেন্দ্রবিন্দু আলা হযরতের (রহঃ) কবিতায় সে কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে এভাবে-
"উয়হ জু না থি তো কুছ নাথা, উয়হ জু নাহো তো, কুছ নাহো,
জান হ্যায় উয়হ জাহান কি, জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়"।
অনুবাদ – "তিনি যখন ছিলেননা, না ছিল কোন সৃষ্টি হেথায়,
জগতের প্রান কেন্দ্র তিনি, থাকলে তিনি আছে সবই"।
সৃষ্টিতত্ত্ব অতি সূচারুভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে
তাঁর নীচের পংক্তি দু'টিতে -
"দাহান মে জুবা তুমহারে লিয়ে, বদনমে হে জা তুমহারে লিয়ে,
হাম আয়ে ইয়াহা তুমহারে লিয়ে, উঠেভি ওয়াহা তুমহারে লিয়ে"।
('হাদায়েকে বখশিশ' ২য় খন্ড, কবিতা নং – ২৮)।
অনুবাদ – মানুষের জিহবা পেলো যে ভাষা, ওগো নবী তোমারই তরে,
মানব দেহে বয়ে চলে প্রাণ, সে-তো ওগো নবী তোমারই তরে,
এসেছি এ ভবে ওগো নবী তোমারই কারণে, উঠবো আবার রোজ হাশরে, সে-তো ওগো নবী তোমারই তরে"।
প্রিয় নবীজ়ীর শহর মদিনা শরীফে জিয়ারতের জন্য সাময়িকভাবে অবস্থানকালে সহসা বিচ্ছেদের আশংকায় শঙ্কিত আলা হযরত তাঁর সফর সংগীদের উদ্দেশ্য করে নিবেদিত পংক্তি ছিল এরকম,
"এয়া কাফিলাতি! জিদি আজালাক, রহমে বর হাসরত তিসনা লবক,
মোরা জিয়ারা লারজে দারাক, দারাক, তাইবাছে আভি না সুনা জানা"।(হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ০৯)।
অনুবাদ-
"ওগো মোর সহযাত্রীরা! দীর্ঘ করো তব তীর্থ যাত্রা,
মনের আশা হ্য়নি পুরা, শোকে কাঁদে মোর হতাশ তৃষিত ঠোঁট দু'খানা,
আজ বিদায় বারতা মোরে দিও না"।
নজদী/ওহাবীরা মানুষকে মদিনা শরীফ জিয়রাতে বাধা দিয়ে বলে যে, "জিয়ারতে মুস্তাফা হজ্জের কোন অংশ নয় এবং তা ফরজ/ওয়াজিব কিছুই নয়।তাই হজ্জের আগে-পরে মদিনা শরীফ জিয়রাতের কোন প্রয়োজনীয়তা নাই"। নজদী/ ওহাবীদের এসব বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচারের জবাবে আলা হযরত (রহঃ) দৃপ্ত ভাষায় লিখলেন,
"হাজ়ীও আও শাহানশাহ কা রওযা দেখো,
ক্বাবা তো দেখ চুকে, ক্বাবেকা ক্বাবা দেখো"। (হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ৪৮)।
অনুবাদ- "এসো ওরে ক্বাবার হাজী! শাহানশাহের রওযা দেখো,
ক্বাবাতো দেখেছ তুমি, এবার ক্বাবার ক্বাবা
দেখো"।
"গওরছে ছুনতু, রেযা!ক্বাবাছে আতি হ্যায় ছদা, মেরি আখোছে মেরে পেয়ারে কা রওযা দেখো"। (হাদায়েকে বখশিশ' কবিতা নং – ৪৮)।
"মন দিয়ে শোন রেযা!ক্বাবা থেকে আসা ঘোষনা,
আমার চোখে প্রিয়তমের রওযাখানা তুমি দেখো"।
আলা হযরতের (রহঃ) ইশকে রাসুল যেখানে পূর্ণ যৌবনা প্রাণ চঞ্চলা তরুনীর মত উচ্ছল ও প্রাণবন্ত, সেখানে মওলানা জামীর (রহঃ) ইশকে রাসুল হল প্রাণ শীতল করা মৃদু মন্দ প্রভাত সমীরণের মত শান্তি ও স্বস্তিদায়ক।ম আর ইকবালের (রহঃ) ইশকে রাসুল হল স্বচ্ছ সলিলা ঝর্ণা ধারার মত কোমল, সুমিষ্ট ও তৃষ্ণা নিবারক।
নবী প্রেমের অসীম তৃষ্ণার ছটফটানিতে ব্যাকুল আলা হযরত (রহঃ) ইশকে রাসুলের অতলান্ত মহাসাগরে ডুব সাঁতার কেটেছেন আজীবন। কিন্তু সে মহাসাগরের অতলান্তিক গভীরতায় ঠাঁই খুঁজে পান নি কখনো। নিজেকে বার বার প্রিয় নবীজীর ইশকের মহা সমুদ্রে হারিয়ে ফেলে অবশেষে আত্মসমর্পন করেছেন নূর নবীজীর (দঃ) পবিত্র নুরানী চরণ যুগলে। তাও প্রেমিকের দাবীতে নয়, একজন নগণ্য গোলাম হয়ে।আর সেজন্যই তাঁর নামের সাথে সে গোলামীর চিহ্ন “আবদুল মোস্তফা” বয়ে বেড়িয়েছেন আলা হযরত (রহঃ) আজীবন সগৌরবে।
আলা হযরতের ইশকে (রহঃ) রাসুল সদা সঞ্চারমান পাহাড়ী ঝর্ণাধারার মত প্রবল ও শক্তিমান। প্রেমের পাগলামী তাঁর কবিতার মূল সুর। ইশকে রাসুলকে তিনি নিজের ধর্ম-কর্ম ও জীবনাদর্শ বানিয়ে নিয়েছেন। তাই কারো আচরণে নবীজ়ীর প্রতি সামান্যতম বেয়াদবী প্রদর্শনও তাঁর কাছে অসহ্য। নবী প্রেমের খাতিরে সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যক্তিকে তিনি কুফুরীর ফতোয়া আরোপ করেছেন নির্র্দ্বিধায়। নজদী-ওহাবীদের ধ্বংশ কামনা করে তাঁর লিখনীতে ঝংকৃ্ত হ্য় অমোঘ বাণী-
“মিসলে ফারিস জ্বলজ্বলা হো নজদমে,
জিকরে আয়াতে বিলাদত কিজিয়ে”, (হাদায়েকে বখশিশ- কবিতা নং ৭৬)।
অনুবাদ- “পারস্যের ভূমিকম্পসম নজদ ভূমি ধ্বংশ হবে,
নবীজীর জন্ম ক্ষণের আয়াত পড়ো উচ্চ রবে”।
শুধু কি তাই, এ সব গোস্তাখে রাসুল ওহাবী–নজদীদের প্রতি লানত দেবার জন্য তাঁর কলম ঝলসে ওঠে সুতীক্ষ্ণ তরবারির মত। আলা হযরত লিখলেন, “শিরক ঠেহরে জিসনে তাযীমে হাবীব, উছ বুরে মাজহাব পে লানত কিজিয়ে।(হাদায়েকে বখশিশ- কবিতা নং ৭৬)।
অনুবাদ- নূর নবীজীর তাযীম যারা শিরক বলে ভাবে, লানৎ দাও সবে মিলে, সে সব বদ মাজহাবে”।
গোস্তাখে রাসুল ওহাবী–নজদীদের প্রতি কেবল অভিসম্পাত বর্ষন করেই আলা হযরত (রহঃ) ক্ষান্ত হন নি, বরং আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ঐ একই কবিতায় তিনি আবার লিখলেন, “এয়া রাসুলুল্লাহ! দুহায়ী আপকি, গোশেমালে আহলে বিদআত কিজিয়ে”।
অনুবাদ- “দয়াল নবীজী!দোহাই আপনার, আরজি দিলাম পাক কদমে, বিদাতিরা হও সাবধান! পড়োনা নবীজীর রোষানলে”।
এর সাথে সাথে তিনি গাউসে পাকের (রহঃ) কাছেও নিবেদন পেশ করলেন এভাবে, “গাউসে আযম আপসে ফরিয়াদ হ্যায়, জিন্দা ফির ইয়ে পাক মিল্লাত কিজিয়ে”
অনুবাদ - “গাউসে আযম তব পাক চরণে করি মিনতি,
জিন্দা করুন আবার নবীজীর এ পাক জাতি”।
গোস্তাখে রাসুল ওহাবী–নজদীদের উদ্দেশ্য করে আলা হযরত (রহঃ) লিখলেন,
“তুযসে আউর জান্নাত সে কিয়া মতলব, ওহাবী দূর হো, জান্নাত রাসুলুল্লাহকি আউর হাম রাসুলুল্লাহকি”। (হাদায়েকে বখশিশ- কবিতা নং-৫৮)।
অনুবাদ -
“তোদের সাথে জান্নাতের কী সম্পর্ক! ওরে ওহাবীর দল দূরে যা!
রাসুলুল্লাহর গোলাম মোরা, আর জান্নাতের মালিক হলেন রাসুলুল্লাহ”।
ওফাতের কিছুদিন পুর্বে দেয়া আলা হযরত (রহঃ) এর অন্তিম নসীহত তাঁর ইশকে রাসুলের গতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অন্তিম অসিয়তে তিনি বলেন, ক) “যাতে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুলের(দঃ)সুমহান শান-মান মর্যাদার বিন্দুমাত্র অসম্মান ঘটে, এমন বস্তু-বিষয় বা ব্যক্তি তোমার যতই প্রিয় ও আপন হোক না কেন,,তা থেকে তুমি অতি সহসা আলাদা হয়ে যাও”।
খ)কারো মাঝে যদি রাসুলের(দঃ)সুমহান শান-মান মর্যাদার বিন্দুমাত্র বিরূপ মনোভাব বা বেয়াদবীপূর্ণ আচরণ দেখতে পাও, তবে সে ব্যক্তি তোমার যতই আপন বা সম্মানের পাত্র হোক না কেন, তাকে দুধের মধ্যে থাকা অবাঞ্ছিত মাছির মত নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দাও”।
ইন্তেকালের মুহুর্তে আলা হযরতের অসিয়তগুলোর মধ্যে দুইটা ছিল, এরকম, ক) “আমার জানাজা নেওয়ার সময় ‘কাবে কি বদরুদ্দোজা’ নাতটি পাঠ করবে”।
খ) “আমার কবরের ভিতরটা এত উঁচু করে রাখবে, যাতে আমি আমার প্রিয় নবীজীকে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে পারি”।
আলা হযরতের (রহঃ) ইশকে রাসুলের গতি এতই উত্তুংগ যে তা বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের দুকূল প্লাবী স্রোতধারার মত ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সবকিছু। দিদারে মোস্তফারূপ অমৃত সাগরের মোহনায় মিলিত হয়ে শান্ত সমাহিত হয় সে স্রোতধারার অভিযাত্রা।
আলা হযরতের (রহঃ) ইশকে রাসুল যেখানে তরংগ বিক্ষুদ্ধ উত্তাল সাগরের মত অশান্ত ও বেসামাল আল্লামা ইকবাল (রহ) সেখানে যথারীতি প্রশান্ত, সংযত ও পরিশীলিত।
নূর নবীজীর গোলামীর মধ্যেই শান্তি ও নিরাপত্তার সুনিশ্চিত গ্যারাণ্টি খুঁজে পেয়েছেন আলা হযরত (রহঃ)।তাই উচ্চ কন্ঠে তিনি গেয়ে উঠেন, “খওফ না রাখ রেযা জেরা, তু হ্যায় আবদে মুস্তফা, তেরে লিয়ে আমান হ্যায়, তেরে লিয়ে আমান হ্যায়”।
অনুবাদ- “ভয় করিস না ওরে রেযা!তুই যে গোলামে মুস্তফা
তোমার তরে শান্তিবাণী, তোমার তরে আছে নিরাপত্তা”।
অন্যদিকে নবী প্রেমের খনি সদৃশ মালানা জামীর (রহঃ)অমর কাসীদা ও নাতসমূহ গুনে ও মানে অদ্বিতীয়।সুগভীর নবী প্রেম, নবীজীর প্রতি অনন্য আদব আর ভাষার সহজবোধ্যতা আল্লামা জামীর (রহঃ) কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইশকে রাসুলের টানে বার বার জামী (রহঃ)ঝাঁপ দিয়েছেন নবী প্রেমের মহাসাগরে আর তুলে এনেছেন মনি মানিক্যসম হৃদয়স্পর্শী অজস্র নাতের অমূল্য সম্ভার। যা মাওলানা জামীকে(রহঃ)এ ভূবনে অমরত্ব দিয়েছে একজন শ্রেষ্ট আশেকে রাসুল হিসেবে।কিন্তু তাঁর এ নবী প্রেম আলা হযরতের (রহঃ)মত প্রেমের পাগলামীর পর্যায়ে কখনো পৌঁছায়নি। নবীজ়ীর প্রেমে জামীও (রহঃ) মজনুর মত সদা ছটফট করেছেন, কিন্তু সেটা আলা হযরতের (রহঃ) মত পাগল পারা মাতাল প্রেমিকের কাজের মত কখনো মনে হয়নি।
আলা হযরতের (রহঃ)নাত সম্ভারে রয়েছে গতি, মননশীলতা ও আধুনিকতা। বিষয় বৈচিত্র তাঁর নাতকে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। সেই সাথে নতুন নতুন উপমার প্রয়োগ তাঁর নাতকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।নাতে রাসুলের (দঃ) ক্ষেত্রকে তিনি করেছেন আরো উর্বরা, সুষমামণ্ডিত ও আলোকিত। ইশকে রাসুলের (দঃ) বাগানকে সাজিয়েছেন তিনি নিত্য নতুন ফুলের সাজিতে। তাঁর বাগানের ইশকে রাসুলের (দঃ)মৌ মৌ গন্ধ মাতিয়েছে দশ দিক-দিগন্ত। জগতের তাবৎ রাসুল (দঃ) প্রেমিক সুজনেরা সে ফুলের মধু আহরণের জন্য ব্যাকুল চিত্তে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তাঁর কাব্যের অমৃত ভাণ্ডারে। আর পরম তৃপ্তিভরে আস্বাদন করেছে ইশকে রাসুলের (দঃ) অমীয় সূধা।তাই তামাম আশেকে রাসুলের (দঃ) অন্তরে ইমাম আহমদ রেযা (রহঃ) স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরদিন। ইশকে রাসুলের (দঃ) এ মহান কারিগরকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম।
তথ্যসূত্র-
* স্মারক গ্রন্থ - ২০১৭, পৃষ্টা নং ৪৭, আলা হযরত কনফারেন্স, ঢাকা।
* রেযার বচনে নবীর চরণে নিবেদিত পংক্তিমালা- শাহজাহান মোহাম্মদ ইসমাঈল, প্রকাশক – আল সিরাজ ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
* কালামে রেযা- মুহাম্মদ আনিসুজামান, প্রকাশনায় – আলা হযরত ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
©somewhere in net ltd.