নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।

সত্যের সারথি সাদেক

সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, যে কখনো করেনা বঞ্চনা !

সত্যের সারথি সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

এই আমতলা, সেই আমতলা

০২ রা মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৪৭

১৯৫২ সালের ২১ তারিখ এক রক্তিম সকাল। সবেমাত্র সূর্য কিরণ দিতে শুরু করেছে। থমে থমে অবস্থা ঢাকা শহরে। যদিও বিরাজ করছে পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা। ছাত্রজনতা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার। সেই মিটিং স্থানটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। সেই স্থানটি ছিল সেসময়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কলা অনুষদ। আজ তা ঢাকা মেডিকেল কলেজের অংশ। বলছিলাম ঐতিহাসিক আমতলা’র মিটিং এর কথা। আমগাছটি নেই, জায়গাটিও বদলে গেছে অনেক। কালের যাত্রায় সঠিক ভাবে সংরক্ষিত হয়নি সেই আমতলা। বর্তমানে সেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ফটক হিসেবে ব্যবহৃত সেই স্থানটি নানা সমস্যায় জর্জরিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশপথের পূর্বপাশের গেটটি থেকে শুরু হয়েছিল ভাষা রক্ষার মিছিল। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঁঙ্গণ আজও যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি।
ছবি: ১ে৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই সকাল, সেই আমতলা

এখন সেই আমতলাকে চিহ্নিত করার জো নেই। যদি না সেই ফটকের উপর ‘ভাষা আন্দোলন পরিষদ’ এর উদ্যোগে কালো প্লেটে সাদা কালিতে লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ থেকে, এর পর লাল কালিতে নিচের দিকে একটি তীর চিহ্ন দিয়ে সাদা কালিতে লেখা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এই দিনে ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে’ সাইনবোডটি চোখে না পড়ে। যদিও সাইবোর্ডের একটা অংশ দেয়াল থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। ভাষা সংগ্রামীরা শহিদহয়েছেন সেই স্থানটি আজও অরক্ষিত।
ছবি: ঐতিহাসিক সেই আমতলার একমাত্র স্মৃতিবাহক সাইনবোর্ড

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ফটক থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহিদহন রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম। অনেক শহীদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ সেই ঐতিহাসিক ফটকটি সংস্কারের মাধ্যমে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন তা পড়ে আছে অবহেলা আর অনাদরে।
ছবি: ঐতিহাসিক সেই আমতলার বর্তমান অবস্থা

আমতলার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দেশের তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির সব কর্মকান্ডই এই আমতলা থেকে পরিচালিত হতো। আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বহু স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই আমতলা। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আমতলায় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৯৬) বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করেছিলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল।’
সরেজমিনে দেখা যায়, একুশে ফ্রেবুরয়ারি উপলক্ষে ফুটপাতে বসতে পারেনি অস্থায়ী দোকানদারেরা। তবে বছরের সব সময়ই আমতলা গেইটের সামনে বসে ছোট খাটো বাজার। হাঁড়ি-পাতিল, থালা-গ্লাস, প্লাস্টিকের বালতি, মগ, টুল, চেয়ার, বালিশ-চাঁদর-মাদুর-মশারি, জুতা, প্রসাধনী দ্রব্য, ফল, পান-সিগারেট, চা, ফিরনি, ঝালমুড়ি, খাবার হোটেল ও বিড়ি সিগারেটের দোকান থেকে শুরু করে মশারি, কম্বল ও ফলের দোকান। কী নেই সেখানে? যেন জায়গাটিতে ‘মিনি বাজার’ গড়ে উঠেছে। তার যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে সেই খবর জানেন না অনেকেই।
ঐতিহাসিক এই স্থাপনার গায়ে লোহার পেরেক দিয়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির নির্বাচনের ব্যানার সহ বেশকিছু রাজনৈতিক ব্যানার ও পোস্টার। সামনের ফুটপাথ হকারদের দখলে। গেটের ভেতরের দুই পাশে দুটি ভাসমান বসত ঘরও রয়েছে। সামনের ফুটপাথের দোকানীদের এই গেট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা কিছুই বলতে পারেনি। দেখে বোঝার উপায় নেই, এখান থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের হয়েছিল। যে মিছিল পাল্টে দিয়েছিল এদেশের ইতিহাস।
আমতলার গেইটের সামনে গত ৭/৮ বছর ধরে চা বিক্রি করছেন অলি উল্লাহ। বিকেলেই আবারর চা দোকান বসাবেন বলে জানালেন। এই আমতলার গুরুত্ব তিনি জানেন কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানি। তবে এতো বেশি না। শুনছিলাম এখানে কিছু লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। তবে আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে এখানে বসি। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশনের লোকজন দোকান তুইল্লা দেয়। কয় দিন পর আবার বসি। তবে ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই এই জায়গার কদর বাড়ে। অনেকেই এখানে আসে। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ রাখে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) প্রাণি তত্ত্বাবধায়ক পদে ১৯৭৭ সালে কাজ শুরু করে ২০১৫ সালে অবসরে যাওয়া এলাহী বক্স শেখ এখন পাশেই একটি হোটেল চালন। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তিনি এখানে কাজ করতেন বলে জানান। পুরাতন কর্মচারী হিসেবে ঢামেক’র অনেক কিছুই তার জানা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমতলার আম গাছের আমগুলো ছিল মধুর মতো মিষ্টি। বাচ্চারা কাঁচা আমই খেয়ে ফেলতো। বঙ্গবন্ধু এই আমতলায় আসতেন। মিটিং করতেন। এছাড়া বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী মানুষ ও নেতারা এখানে মিটিং করতেন। আমতলা, বেলতলা, মধুর কেন্টিন, রশিদ বিল্ডিং কোন কিছুই আর এখন আগের মতো নেই। হাসপাতালে নতুন নতুন বিল্ডিং উঠতেছে। সব কিছুই বদলায়ে গেছে। আগের দৃশ্যগুলার কথা বলা যায় কিন্তু দেখানো তো যায় না। কোন চিহ্নই তো আজ আর নেই।’ হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, ভ্রাম্যমাণ দোকানের পাশাপাশি এখানে রাজত্ব চলে মাদকসেবীদের। দিনের বেলা এ স্থানটি হকারদের দখলে থাকে আর রাতে বসে মাদকসেবীদের জমজমাট আড্ডা। এর সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এবং হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নেতারাও জড়িত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কয়েকবার উচ্ছেদ করলেও তারা পুনরায় ফিরে আসে। ফলে স্থানটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারাতে বসেছে।

শহিদমিনারে ফুল দিতে আসা বদরুন নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল শিফা বলেন, অনেকেই হয়তো এই আমতলার ইতিহাস জানেন না। অথচ আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা। তার কথা-এটা নিয়মিত ব্যবহার করা হলে হয়তো এর ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ জানতো।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষা গবেষক এবং ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী আমতলা। এই ঐতিহাসিক বেলতলা থেকেই ২১শে ফেব্রুয়ারির মিছিল বের করা হয়েছিল। কিন্তু বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলা।
এদিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যপক ও রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. বিশ^জিৎ ঘোষ বলেন, আমতলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। বলা যায় এখান থেকে মাতৃ ভাষার জন্য ডাকসু সংগ্রহশালায় যে মিছিল শুরু হয়েছিল তা এখনো চলামান। আক্ষরিক অর্থে এই আমতলাকে যথাযথ সংরক্ষণ করাই এখন আমাদের বড় দায়িত্ব। তবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করেছে। তাদের উচিত এই সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করতে ঐতিহাসিক আমতলাকে সংরক্ষণ করা।
ঐতিহাসিক এ স্থানটির অবৈধ দখল বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী শাহ্ মোঃ ইমদাদুল হক বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে এ স্থানটিতে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু অভিযান শেষ হওয়ার পরপরেই তা আবার দখল হয়ে যায়।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, ঢাকা।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৫৫

রামু দাস বলেছেন: খুব সুন্দর

২| ০৩ রা মার্চ, ২০২০ সকাল ৮:২৭

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অসাধারণ লেখা।

৩| ০৩ রা মার্চ, ২০২০ সকাল ৯:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: বর্তমানে আমতলা গেইট ও আমতলা প্রাঙ্গণ ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধীনে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.