![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক। মতাদর্শে মার্কসবাদী। কোলকাতার বাসিন্দা
২১ জুন, ২০১৩ কলকাতা দেখল এক ভরসা জোগানো পথচলা। বিদ্বজ্জনেদের ডাকে সংগঠিত সেদিনের মিছিল আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের এক মহামিছিলে পরিণত হয়। শঙ্খ ঘোষ, অশোক মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়রা মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। আর ছিলেন ছাত্র, যুব, মহিলা, মেহনতি মানুষ, শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী সহ সমাজের সব ক্ষেত্রের মানুষ। ছিলেন কামদুনির প্রতিবাদরত গ্রামবাসীরা, মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় যারা শুধুই ‘মাওবাদী’ আর ‘ষড়যন্ত্রকারী’।
কেন এত মানুষ, এত বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ পা মেলালেন সে অর্থে অসংগঠিত এক উদ্যোগে? প্রত্যক্ষ কারণটা নিশ্চয় কামদুনির এক ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা আর তার আগে পরে নারী নির্যাতনের এরকম আরো কিছু দৃষ্টান্ত। কিন্তু যে আবেগ আর শপথ এই মিছিলের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল, তার ভাষাকে ভেতর থেকে পড়তে পারলে বেরিয়ে আসে আরো অনেক কিছু। মিছিল যেমন আওয়াজ তুলেছিল সমাজবিরোধী গুণ্ডা রাজের বিরুদ্ধে, শুভবুদ্ধির জাগরণ ও প্রতিরোধের বিস্তারের আহ্বান রেখেছিল, তেমনি এই মিছিল শাসককেও স্পষ্ট কিছু বার্তা দিয়েছে। বার্তা দিয়েছে প্রশাসন ও শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের। কামদুনি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাকা আর চাকরির টোপ দেখিয়ে বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনাগুলিকে বস্তুতপক্ষে ধামাচাপা দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে এই মিছিল সোচ্চার আওয়াজ তুলেছে, জানিয়েছে ঘুষ নয়, প্রকৃত বিচার চাই।
মিছিল ভুলে যায় নি পার্ক স্ট্রিট এর ধর্ষিতা মহিলার উদ্দেশ্যে তৃণমূলের একের পর এক নেতা মন্ত্রীর নক্কারজনক উচ্চারণের, যেখানে ধর্ষণের ঘটনাটিকে এক মহিলা সাংসদ উল্লেখ করেন খদ্দের আর মহিলার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে। যেভাবে স্ব-অবিভাকত্ব দেখিয়ে অনেকে মেয়েদের পোষাকবিধিকে যাবতীয় ধর্ষণের কারণ হিসেবে সামনে আনার চেষ্টা করেছিলেন তার বিরুদ্ধেও মিছিল গর্জে উঠেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ছোট’ পোষাক পরে পোষ্টার হাতে পথ হেঁটেছে ছাত্রীরা, আর তাদের সেই পোষ্টার জানিয়ে দিয়েছে, “আমার এই ছোট পোষাক কোনও আমন্ত্রণ নয়”। মিছিলে পথচলা ছাত্র যুবরা সমস্বরে দাবি জানিয়েছে ‘নির্ভয় স্বাধীনতা’র। পড়ার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, পছন্দমতো বিয়ে করা বা না করার স্বাধীনতা, খাপ পঞ্চায়েত থেকে স্বাধীনতা, পিতৃতন্ত্রের থেকে স্বাধীনতা।
কিন্তু এই মিছিল শেষপর্যন্ত শুধু নারীর ওপর অত্যাচারের তীব্র বিরোধিতা আর তার নির্ভয় স্বাধীনতার জন্য আওয়াজ তুলেই থেমে যায় নি। মিছিল আওয়াজ তুলেছে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধেও। স্পষ্টতই মুখ্যমন্ত্রীর আদব কায়দা, চলন বলনকে হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হয়েছে এই রাজ্য কোনও রাজা বা ‘রাণী’র খাসতালুক নয়, যে তিনি যখন বলবেন “চোপ”, তখন সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে। এই মিছিল জানিয়ে দিয়েছে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করা যাবে না। অন্যায় অবিচার হলে আওয়াজ উঠবেই, প্রতিবাদ পৌঁছবে প্রতিরোধে।
বস্তুতপক্ষে ২০০৭ সালে তদানীন্তন শাসক সি পি এমের নন্দীগ্রামে ধারাবাহিক গণহত্যা ও তাকেই আবার ‘সূর্যোদয়’ বলে অভিহিত করার বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক মিছিল সে বছরের ১৪ নভেম্বর কোলকাতা দেখেছিল, এই ২১ জুনের মিছিল তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। শাসকের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠিয়েছে, তুমি কে সেটা দেখার দরকার নেই, তুমি কি করছ, সেটাই দেখার। রাজার পোষাকের রঙ বারবার বদলালেও যদি দিন না বদলায়, তবে দিন বদলের জন্য মানুষ বারবার পথে নামবেই। ‘লাইফ হেল’ করে দেওয়ার হুমকি বা মাওবাদী তকমা দিয়ে, ‘চোপ’ বলে ধমকানি দিয়ে কোনও কাজ হবে না। এই শক্তি পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ অর্জন করেছে, তাকে দমিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অতীতে তা রাজ্য রাজনীতিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে, এই মিছিল বুঝিয়ে দিয়েছে শাসক নিরপেক্ষভাবে ভবিষ্যতেও করবে।
এই প্রসঙ্গেই এই মিছিল নিয়ে কিছু সংশয়, যা কোনও কোনও মহল থেকে ব্যক্ত হয়েছে, তার পর্যালোচনা জরুরী। অনেকে মনে করেছেন এই মিছিল এর আহ্বানে, পথচলায় এরকম অনেকে ছিলেন, যারা সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সদর্থক ভূমিকা পালন করেন নি। ইঙ্গিৎটা নিশ্চিতভাবেই সেই সমস্ত বিদ্বজ্জনদের প্রতি, যারা সি পি এম সমর্থক এবং সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বেও সেই জায়গা থেকে সরে আসেন নি। এই সংশয়কে আরো অনেক উষ্কে দিতে চেয়ে, পল্লবিত করতে চেয়েই শাসক তৃণমূলের বিশিষ্ট নেতা শ্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন এই মিছিল অপ্রয়োজনীয়, সি পি এমের গোলমাল পাকানোর চেষ্টা, বিদ্বজ্জনেরা যেন এতে সামিল না হন। এ প্রসঙ্গে এটুকুই বলার ১৪ নভেম্বরের মিছিল যেমন তৃণমূলের পক্ষে ছিল না, ছিল শাসকের চূড়ান্ত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, এই মিছিলও তেমনি কোনওভাবেই সি পি এমের পক্ষে সমর্থন নয়, থাকার কথাও নয়, কারণ মানুষের স্মৃতিভ্রংশ হয় নি এত দ্রুত। এই মিছিলও নৈরাজ্য ও স্বৈরাচারী প্রবণতা আর গুণ্ডারাজের বিরুদ্ধে। মিছিল তাই কোনওভাবেই সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের নির্যাতিতাদের বিচারের দাবি তুলতে পিছ পা হয় নি, তাপসী মালিকের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবী জোরের সাথে তুলে ধরতে মিছিলের ভুল হয় নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্টার ব্যাপকতর সংগ্রাম দলীয় রাজনীতির সীমাকে বারবার অতিক্রম করে যাবে, আধুনিক সমাজের এই স্বাভাবিক সত্যকে সব রাজনীতি উৎসুক মানুষই স্বীকার করবেন। অতীতের মতো সাম্প্রতিক বিশ্বের নানা সংগ্রামে, তাহরির স্কোয়ার থেকে অকুপাই আন্দোলন, চলমান সময়ে তুরস্ক বা ব্রাজিলের বিক্ষোভ – এই শিক্ষাকেই তুলে ধরছে। প্রকৃত বিপ্লব বা মৌলিক কোনো দিনবদল শেষপর্যন্ত পার্টির দ্বারা সাধিত হতে পারে না, হয় জনগণের দ্বারা – এই মৌলিক শিক্ষা কোনও কমিউনিস্টের অন্তত ভুলে যাবার নয়।
আরেক ধরণের সংশয় অনেক সময় সাধারণভাবে মনে আসে। কোলকাতার এই প্রতিবাদ বৃহত্তর বঙ্গসমাজে কতটুকু ছাপ রাখে ? শাসক কি সত্যই খুব গুরূত্ব দেয় আমাদের কাছে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে চিহ্নিত এই প্রতিবাদের মাইল ফলকগুলিকে? শহরের প্রতিবাদ ব্যাপক গ্রাম বাংলায় কতটুকু ছাপ ফেলে ? আনন্দবাজার পত্রিকার ২৪ জুনের সম্পাদকীয় ‘সংস্কৃত ও প্রাকৃত’ এই সংশয়টা প্রতিনিধিস্থানীয়ভাবে তুলে এনেছে।
“পশ্চিমবঙ্গের, মুখ্যত কলিকাতার নাগরিক সমাজের একটি অংশ স্পষ্ট ভাষায় এবং ভঙ্গিতে জানাইয়া দিয়াছে, রাষ্ট্রশক্তির অন্যায় তাহারা মুখ বুজিয়া সহ্য করিবে না। শুক্রবারের মিছিলের কারণগুলির পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাহার একটি প্রতীকী অর্থ অবিস্মরণীয়। মুখ্যমন্ত্রী তাহার চার দিন আগে কামদুনি সফরে গিয়া যে ‘চুপ’ বলিয়াছিলেন, মহানগরীর মিছিলটি তাহার একটি সমুচিত জবাব হিসাবে তাঁহার সম্মুখে সপাটে আছড়াইয়া পড়িয়াছে। ২০০৭ সালে ঠিক এই ভাবেই তদানীন্তন শাসক দল তথা তাহার মুখ্যমন্ত্রীর স্পর্ধিত আস্ফালনের জবাব দিয়াছিল এই শহর। ক্ষমতার মুখের উপর সত্য বলিবার এই চেতনা গণতন্ত্রের অপরিহার্য রক্ষাকবচ। লক্ষণীয়, গত কয়েক বছরে দুনিয়া জুড়িয়া জনআন্দোলনের বহু নজির দেখা গিয়াছে, এই মুহূর্তেও তুরস্ক এবং ব্রাজিলের মতো দুই গোলার্ধের দুইটি দেশে আন্দোলন চলিতেছে। দুনিয়া জুড়িয়া শাসকরা বুঝিতেছেন, ‘চুপ’ বলিয়া জাগ্রত নাগরিক সমাজকে চুপ করাইয়া রাখা আর চলিবে না। এমনকী মমতা বন্দো্যপাধ্যায়েরও হয়তো সেই বোধ কিছুটা হইতেছে, হয়তো সেই কারণেই তিনি শুক্রবারের মিছিলের পরের দিন সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিদ্বজ্জনদের ‘সাহায্য’ চাহিয়াছেন, তাঁহাদের উদ্দেশে বলিয়াছেন, ‘মানুষের মধ্যে একটু জাগরণ করুন’! বিদ্বজ্জন তথা নাগরিক সমাজের এই ভূমিকা নিশ্চয়ই জরুরি। কামদুনির দুই তরুণ সাহসিনীর প্রতিক্রিয়াতেও তাহা স্পষ্ট। কিন্তু ইহার ফলে কি প্রশাসন এবং তাহার নিয়ামক রাজনীতিকদের আচরণ কিছুমাত্র বদলাইবে? মুখ্যমন্ত্রী নিজে যে কোনও প্রশ্নের মুখে পড়িলে যে ভাবে সম্পূর্ণ অহেতুক, অশোভন এবং অগণতান্ত্রিক ভঙ্গিতে আক্রমণ করিতেছেন তাহা কি বন্ধ হইবে? গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা ভরসা দেয় না, ঠিক যেমন ভরসা দেয় না তাহার পূর্ববর্তী তিন দশকের ইতিহাসও। কিন্তু এই সূত্রেই একটি গভীরতর প্রশ্ন ওঠে। কলিকাতার বুকে নাগরিক সমাজের যে প্রতিবাদ, বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজে তাহার প্রভাব বা প্রতিফলন কতটুকু? বিপরীত দিক হইতে দেখিলে, প্রশাসন তথা তাহার সর্বময়ী কর্ত্রীর যে সমস্ত আচরণ লইয়া নাগরিক সমাজের তীব্র এবং সঙ্গত আপত্তি, বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাহাতে কতটুকু বিচলিত বা ক্ষুব্ধ?”
এই ধরণের বিশ্লেষণের সঙ্গে আমাদের একটা মৌলিক তফাৎ আছে। ওপর থেকে সংগঠিত চেতনা নিচু তলায় চুঁইয়ে পড়বে কিনা, তা নিয়ে এই ভাবনার উলটো দিকেই দাঁড়িয়ে বলা যায় তৃণমূল স্তরের আন্দোলনের জোয়ারই মূলত শহুরে শিক্ষিত নাগরিক সমাজকে অনুপ্রাণিত করে। সিঙ্গুর আন্দোলন বা নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নিচুতলার প্রতিবাদ, জমি কামড়ে প্রাণের বিনিময়ে প্রতিরোধই শেষপর্যন্ত বুদ্ধিজীবী মহলকে পথে নামার প্রেরণা দিয়েছিল। এখানেও কামদুনিতে সাধারণ মানুষ, মহিলাদের যে প্রতিবাদ, তাই আরো ব্যাপ্ত ভাষা পেতে চেয়েছে কোলকাতা শহরের দৃপ্ত মিছিলে। কৃষক আন্দোলন যদি ২০০৭ এর ১৪ নভেম্বরের মিছিলের প্রত্যক্ষ প্রেরণা হয়ে থাকে, তদানীন্তন শাসকের ‘ভিত’কে টলিয়ে দিয়ে থাকে, তবে ‘বঙ্গভূষণ’ ‘বঙ্গবিভুষণ’ পরিবৃত মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রাকৃত’ চেহারাটা বের করে এনেছে কামদুনির মহিলাদের মাটি কামরানো প্রতিবাদ, বা সাম্প্রতিক অতীতে ‘কৃষক’ শিলাদিত্যর দৃপ্ত প্রশ্ন। সারা পৃথিবীতেই নয়া অর্থনৈতিক নীতিমালা ও তার বিষময় প্রয়োগের বিরুদ্ধে বুনিয়াদী জনগণ, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ চলছে, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গেও তার কোনও অভাব বা ব্যতিক্রমের কোনও কারণ নেই। বুনিয়াদী আন্দোলনের তীব্রতা আর নাগরিক সমাজের প্রচার মাধ্যম আকর্ষক, পরিশীলিত উচ্চারণের সংযোগের কোনও অভাব নেই, তাদের মধ্যে মৌলিক বিরোধেরও কোনও জায়গা নেই। আজকের সময়ের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা আজকের বাস্তবতাতেই বহুস্থানে বহুস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে। তার সংযোগ আর বিস্তারের জন্যই আমাদের সৃষ্টিশীলভাবে কাজ করে যেতে হবে।
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:৪৯
রেজা এম বলেছেন: ভাই?????? আপনাদের ঝামেলা এখানে টানেন ক্যান ???????? আপনাদের ঝামেলা তে আমাদের মাথা ঢুকাবার শখ নাই!!!!!!!!!!!!!!!!!!!