![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক। মতাদর্শে মার্কসবাদী। কোলকাতার বাসিন্দা
মিশরে আবার পালাবদল। তিউনিশিয়া থেকে আরব বসন্তের সূত্রপাত হলেও তার সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে প্রভাব সঞ্চারী, আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাবলী ২০১১ র প্রথমার্ধ জুড়ে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল মিশরে। চার দশকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়েছিল হোসনি মুবারকের পতনের মধ্য দিয়ে। অতঃপর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিশরে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন নির্বাচিত সরকার, রচিত হল নতুন সংবিধান। সেই সরকারের নেতৃত্বে রইলো মুসলিম ব্রাদারহুড, রাষ্ট্রপতি হলেন তাদের দীর্ঘদিনের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। জনপ্রিয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার অবসান ও তারপর গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হবার বছর খানেকের মধ্যেই কেন মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুড এর বিরুদ্ধে মিশরে আবার বিরাট বিক্ষোভ শুরু হল, আর সেই গণ আন্দোলনের ঢেউয়ের ওপর দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারের ওপর হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেল, তাকে বরখাস্ত করে পছন্দমতো রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের মাধ্যমে নিজেদের ছায়া শাসন কায়েম করতে পারল, তা বুঝতে গেলে মিশরের ইতিহাসের দিকে ফেরা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আরব দুনিয়ার অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ শক্তি মিশর। তিউনিশিয়ায় বেন আলি জমানার পতন অব্যবহিত উদ্দীপক হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠে মুবারক জমানার বিরূদ্ধে জনগণকে উত্তাল করলেও এর প্রেক্ষাপট মিশরের দীর্ঘ মেয়াদী ইতিহাসের মধ্যেই আমাদের খুঁজতে হবে। ১৯৫০ এর দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে মিশর কখোনোই সেনা শাসনের বাইরে আসে নি। এমনকী নাসের জমানায় যেটুকু সংস্কারমূলক কাজকর্ম সংগঠিত হয়েছে, তাতেও ওপর থেকে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সক্রিয় থেকেছে, তলা থেকে জনসাধারণের সক্রিয়তা সৃষ্টি বা গণতান্ত্রিক কার্যক্রম খুব একটা লক্ষ্য করা যায় নি। নাসেরের পরবর্তীকালে সাদাত এবং তার পর হোসনি মুবারক জমানায় আমলাতান্ত্রিকতা, পুলিশীরাজ ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। যে কোন রকম প্রতিবাদী স্বরকে দমন করা হয়েছে।
মিশরের আধুনিকতার বিকাশের পথে দুটি গুরূত্বপূর্ণ উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তার সংকট গভীর হয়েছে। উনিশ শতকের গোড়ায় মহম্মদ আলি প্রতিষ্ঠিত শাসন তার সমস্ত পুঁজিবাদী ঝোঁক ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জাপানের মত উন্নত আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার যেটুকু সম্ভাবনা তৈরি করতে পেরেছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তা ধ্বংস করে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পুতুল দেশীয় রাজন্যর বিরূদ্ধে যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ১৯২০ সাল নাগাদ সময় থেকে, তাও এক আধুনিক মিশরের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। এর ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি, সামাজিক প্রগতি। ব্রিটিশরা এই গণতান্ত্রিক মিশরের উত্থানকে রুখতে চেয়ে রাজতন্ত্র, জমিদার ও ধনী কৃষকদের মদত দিয়েছে। ১৯২৭ এ চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও গণতন্ত্রবিরোধী ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ গঠনে ব্রিটিশ ও মিশরের রাজতন্ত্র বিশেষ সচেষ্ট থেকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ‘স্টুডেন্ট ওয়ার্কার্স ব্লক’ নতুন করে প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশপ্রভুকে ক্ষমতচ্যুত করে মিশরে নাসের জমানা শুরু হবার পর তলা থেকে গণতান্ত্রিক উত্থান এর মডেলকে পরিত্যাগ করে ওপর থেকে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার শুরু হয়। নাসের জমানায় ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক হাবভাব’ এর পাশাপাশিই ছিল রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র ও সেনাশাসনের সুদৃঢ়করণ, ফলে তলাকার গণতন্ত্র তাতে কিছুটা উপেক্ষিত ছিল। ১৯৬৭র পর থেকে মিশরে ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচার হাবভাব’ এর পরিবর্তে পুঁজিবাদী মুক্ত বাজারের অনুপ্রবেশ শুরু হয় এবং নাসের পরবর্তী সাদাত জমানায় এই দক্ষিণপন্থী অভিযাত্রা বৃদ্ধি পায়। সাদাত মুসলিম ব্রাদারহুডকে তার নতুন স্বৈরতন্ত্রী শাসনে অঙ্গীভূত করে নেন। সাদাত পরবর্তী জমানায় মুবারকও একই স্বৈরতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করেন।
সাদাত ও মুবারক জমানা মিশরের ছাত্র শ্রমিক ব্লকের আন্দোলন তো বটেই, এমনকী নাসের শাসনের প্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষাগুলির প্রতিও ছিল পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা। সমালোচনার জায়গা থাকলেও নাসের জমানা চেষ্টা করেছিল শিল্পায়নের, মিশরকে উল্লেখযোগ্য সুতি রপ্তানীকারকের জায়গায় নিয়ে যেতে সে সফলও হয়েছিল। শিল্পায়নের পথ ধরে নিম্নবিত্তের দারিদ্র বৃদ্ধি না করেই নাসের জমানায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোজগার বাড়ানোর সফল উদ্যোগ লক্ষিত হয়েছিল। আর যাই হোক নাসের জমানায় জনগণকে শাসনের অংশভাগ করার যে প্রবণতা ছিল, সাদাত ও মুবারক জমানা সম্পূর্ণ তার উলটো পথে হাঁটে। মিশরের উৎপাদনমুখী শিল্পায়নের পথকে বাতিল করে, কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সংগে সংযুক্ত একচেটিয়া পুঁজি নির্ভর ফার্মগুলিকে উৎসাহিত করার নীতি নেয় এবং জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে মুবারক তার জমানা চালিয়ে যান। বাহ্যত মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু রাষ্ট্র যেভাবে জনগণকে এবং যাবতীয় রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মকে তার শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, সেই ফাঁক পূরণ করার প্রধান শক্তি হিসেবে তারাই শেষপর্যন্ত জনগণের কাছাকাছি থেকে যায়। শাসকশ্রেণির কাছেও ছাত্র শ্রমিক ব্লকের প্রগতিশীল কার্যকলাপ ও চিন্তাভাবনার পরিবর্তে এই শক্তির গ্রহণযোগ্যতা বেশি, কারণ শাসকের সামগ্রিক নীতির সঙ্গে এদের নীতি অনেক সাযুজ্যপূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবেও অনেক নিকটবর্তী।
সাদাত জমানা নাসের এর শেষদিকেই শুরু হওয়া উদার অর্থনীতিকে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতাতে মুবারক জমানায় বিশ্বব্যাঙ্ক, আই এম এফ এর দাওয়াই অনুযায়ী ‘খোলা দরজা নীতি’ আরো উদার করা হয়, শুরু হয় ব্যাপক কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস। রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থাগুলির ব্যাপক বেসরকারীকরণ শুরু হয়। ২০০৫ সালের মধ্যে মোট ৩১৫ টি রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থার ২০৯টির পুরোপুরি বা আংশিক বেসরকারীকরণ করা হয়। এর একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক সংস্থাগুলির হাতে। মার্কিন ও ইতালীয় সংস্থাগুলির কাছে চলে যায় বিভিন্ন বিদেশী, বিশেষত মার্কিন ও ইতালীয় সংস্থার হাতে। পাশাপাশি চলতে থাকে রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থা ও অন্যত্র শ্রমিক ছাঁটাই। গত চার বছরে মিশরে ৩ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে গিয়েছে। সাবেকি বস্ত্রশিল্প, খনিজ তেল শিল্প থেকে বিনিয়োগ সরে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে রপ্তানি নির্ভর শিল্প, পর্যটন, রিয়েল এস্টেট, ফাটকাবাজী ও ফিনান্সিয়াল ক্ষেত্রে। ২০০৪ থেকে ২০০৯ এর মধ্যে মিশরে ৪২০০ কোটি ডলার বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে, যা পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে সর্বাধিক। বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের ওপর সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে, মুনাফা দেশের বাইরে পাচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে, বিদেশী কোম্পানীগুলির ডিভিডেন্ট ব্যবসাকে পুরোপুরি করমুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ভারত সহ বিভিন্ন দেশের কুখ্যাত এস ই জেড এর মতো স্থাপন করা হয়েছে ভয়াবহ শ্রম আইন নির্ভর ‘কোয়ালিফায়েড ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল জোন’ বা কিউ আই জেড। আমেরিকাতে মিশরের রপ্তানির ৪০ শতাংশই যায় এই বিশেষ অঞ্চল থেকে। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই মিশরে শুরু হয় ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন। ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকলেও তা বিস্ফোরণের চেহারা নেয় ২০০৬ সালে নীলনদের বদ্বীপ অঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমিক বোনাসের দাবিতে সংগ্রাম শুরু করলে। শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলন মিশরে ক্রমশ শক্তি পেতে থাকে।
তিউনিশিয়ার পর আরব বসন্তের ঢেউয়ে মিশর যখন আন্দোলিত হচ্ছে তখন বিভিন্ন ধরণের প্রতিযোগী শক্তি একযোগে মুবারক বিরোধী আন্দোলনে নামে। স্বৈরতন্ত্রের পতন যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন দেশের ভেতরের এলিট রাজ ও আমেরিকি সাম্রাজ্যবাদ মুবারকের পতনের পর কীভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যতদূর সম্ভব বজায় রাখা যায় সেই পরিকল্পনা শুরু করে। মনে রাখা দরকার সুয়েজ খালের সূত্রে মিশর আন্তর্জাতিক তেল ও অন্যান্য বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য পথ। বানিজ্য পথের ওপর নিয়ন্ত্রণের তাগিদে আমেরিকা মিশরের সেনাবাহিনীকে বছরে প্রায় ১৩০ কোটি ডলার সাহায্য দিয়ে থাকে ও তার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। উপরন্তু মিশরই সেই দেশ যে ইজরায়েল এর মত আরব দুনিয়ার ঘোষিত শত্রু ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রধান মিত্রর সঙ্গে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সম্পর্ক ও চুক্তিতে আবদ্ধ ও যার সাহায্যে আমেরিকা ইজরায়েল অক্ষ আরব রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এইসব নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখাটা আমেরিকার দুনিয়াদারীর জন্য বিশেষ প্রয়োজন। সেই নিরিখে মুবারক বিরোধী আন্দোলনের হ্রাস জাগ্রত শ্রমিক ও র্যা ডিকাল আন্দোলনের হাতে চলে যাওয়ার পরিবর্তে কট্টর ইসলামিস্টদের হাতে যাওয়াটাই তাদের কাছে বেশি বাঞ্ছিত ছিল।
মনে রাখতে হবে অতীতেও আফগানিস্থানে লাদেনকে মদত দেওয়ার মত বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকা র্যাতডিকাল শক্তির মুখোমুখি কট্টর ধর্মীয় ধর্মীয় শক্তিকে দাঁড় করিয়ে নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছে। উলটোদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড তার জন্মলগ্নতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় রাজন্যদের বদান্যতা পেয়েছিল ও র্যামডিকাল আন্দোলন ভাঙার কাজে নিজের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ করেছিল। সাম্প্রতিক অতীতে মুবারক জমানাতেও ব্রাদারহুড তাদের শ্রমিক আন্দোলন বিরোধী অবস্থান ধরে রাখে। ১৯৯৮ সালে সুব্রা আল খায়ামা বস্ত্র কারখানায় ধর্মঘটের পর সেখানকার শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলে ব্রাদারহুড সেই কাজকে স্বাগত জানায়। প্রেস বিবৃতি দিয়ে তারা বলে যাদের ধরা হয়েছে তারা কমিউনিস্ট এবং ইহুদী এবং দমনই তাদের জন্য উপযুক্ত। পরবর্তীকালে শ্রমিক নেতাদের নাম ঠিকানা তুলে দিয়ে পুলিশকে তারা সাহায্যও করে।
শ্রমিক ও র্যাসডিকাল আন্দোলনের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান স্বত্ত্বেও ধর্মীয় কট্টরপন্থার প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে শাসক বিরোধী অবস্থানে থাকায় ও মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় মুবারক বিরোধী আন্দোলনের পর্বে দেশজোড়া তার ভালো পরিমাণ জনভিত্তিও বর্তমান ছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসর দেশীয় এলিটদের সামনে মুসলিম ব্রাদারহুডই ছিল কিছুটা অস্বস্তিকর কিন্তু শ্রমিক ও র্যাসডিকাল গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক গ্রহণযোগ্য বিকল্প। সহজপাচ্য ধর্মীয় অ্যাজেন্ডা নিয়ে মুসলিম প্রধান দেশে সেকুলার, র্যা ডিকাল শক্তির তুলনায় বেশি সামাজিক ভিত্তিও ব্রাদারহুডের সঙ্গে ছিল।
মিশরের সাধারণ নির্বাচনে মোবারক বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বত্ত্বেও মুসলিম ব্রাদারহুড ফ্রিডম অ্যাণ্ড জাস্টিস পার্টির নামে শেষপর্যন্ত ভালো পরিমাণ গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসে। কিন্তু সরকারে আসার পর মুবারক বিরোধী আন্দোলনের গণতান্ত্রিক দাবিগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিবর্তে তারা তাদের শরিয়ত আইনের কাছাকাছি আইন ও সংবিধান বানানোতেই মনযোগী হয়। শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করা শুরু হয়, নিষিদ্ধ করা হয় ধর্মঘট। শ্রমিকদের নয়া জমানার প্রতি দ্রুত মোহভঙ্গ হয় ও ক্ষোভ দানা বাঁধে। দমন পীড়ণ কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুবারক জমানাকেও ছাপিয়ে যায়। একদিকে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১২০০০ নাগরিক আন্দোলন কর্মীর বিচার হয় সেনা আদালতে। আর অন্যদিকে ‘কোরান’ই আমার সংবিধান – এই স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর দেশের নয়া সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে শরিয়তি আইন অনুগ কট্টর ধর্মীয় শাসন কাঠামো গড়ে তোলা হলে বামপন্থী, র্যা ডিকাল ও সংখ্যালঘু খ্রীষ্টান সম্প্রদায় রাস্তায় নামেন।
নব্য উদারনীতির সামগ্রিক আর্থিক সঙ্কট ও তার নীতিমালার বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া উত্তুঙ্গ প্রতিবাদ প্রতিরোধের জমানায় শ্রমিক ও র্যারডিকাল আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন অংশগ্রহণ সমৃদ্ধ মিশরের যে গণতান্ত্রিক স্বর মুবারক জমানার পতন ঘটিয়েছিল, মুসলিম ব্রাদারহুডের মত শক্তির পক্ষে তাকে ধারণ করা সম্ভব ছিল না। নিজস্ব কট্টর ধর্মীয় অ্যাজেন্ডা ও শ্রমিক র্যাযডিকাল আন্দোলন বিরোধী মানসিকতাকে সরিয়ে গণতান্ত্রিক মিশরের নির্মাণে তার চূড়ান্ত অনাগ্রহ ও বিরোধিতা দ্রুত উন্মোচিত হয়ে যাবার পরেই মিশরের রাজপথ আবার প্রতিবাদ মঞ্চে রূপান্তরিত হয়ে যায়। শ্রমিক, ছাত্র ও র্যাতডিকাল অংশ পরিস্থিতির ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার আগেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও দেশীয় এলিট স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে জনগণের ত্রাতা হিসেবে সেনাবাহিনী দ্রুত হস্তক্ষেপ করে। প্রাথমিকভাবে মুরসি বিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয় হাওয়ায় ভর করে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর তারা তাদের ছায়া শাসন বলবৎ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মিশর সহ সারা পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন লড়াইয়ের নতুন সময়ে দ্রুতই পরিস্থিতির নাটকীয় মোড় বদলের সমস্ত সম্ভাবনা বর্তমান আছে। ছাত্র, বামপন্থী ও র্যা ডিকাল অংশের সামাজিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কতটা সম্ভব হয় ও তা মিশরের সামগ্রিক রাজনৈতিক ছবিকে কতটা প্রভাবিত করে সে দিকে আমাদের নজর থাকবে।
©somewhere in net ltd.