![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক। মতাদর্শে মার্কসবাদী। কোলকাতার বাসিন্দা
পাটনা হাইকোর্ট সম্প্রতি ১৯৯৭ সালের লখিমপুর গণহত্যার যে রায় দিয়েছে তাতে গোটা দেশ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। যে গণহত্যায় নারী ও শিশু সহ ৫৭ জন দলিত মানুষকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল, তার কোনও একজন খুনিকেও শাস্তি দেবার উপযুক্ত বলে ‘উচ্চ’ আদালত খুঁজে পায় নি। গত ৯ অক্টোবর লখীমপুর বাথে গণহত্যার রায় দিতে গিয়ে পাটনা হাইকোর্ট এমনকী নিম্ন আদালতের রায়কেও সম্পূর্ণ উলটে দিয়েছে। নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রণবীর সেনার যে ২৬ জনকে উচ্চ আদালতের এই রায়ে বেকসুর খালাস করা হয়েছে নিম্ন আদালত তাদের মধ্যে ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১০ জনকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেবার মত মারাত্মক অপরাধের প্রমাণ পেয়েছিল।
গত দেড় বছরের মধ্যে বিহার হাইকোর্ট লখিমপুর বাথে এবং বাথানিটোলা সহ তাদের দেওয়া চারটি রায়ে দলিত হত্যায় অভিযুক্ত এবং নিম্নতর আদালতে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মত চরম সাজা প্রাপ্তদেরও বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। বাথে গণহত্যার রায়ের আগে বাথানিটোলা, নাগরি এবং মিয়াপুরের দলিত গণহত্যা সংক্রান্ত তিনটি মামলার রায়ে এরকম অদ্ভুত প্রহসন লক্ষ্য করা গেছে।
১৯৯৬ এ সংগঠিত বাথানিটোলা গণহত্যার রায় দিতে গিয়ে ১৭ এপ্রিল ২০১২ পাটনা হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে সাজা পাওয়া রণবীর সেনার ২৩ জন অপরাধীকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বাথানিটোলার ঘটনায় ২১ জন দলিতকে হত্যার দায়ে নিম্ন আদালত এই ২৩ জনের মধ্যে ৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ২০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল।
২০১৩ র ১লা মার্চ পাটনা হাইকোর্ট ১৯৯৮ এর নাগরি গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ১১ জনকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। নাগরি গণহত্যার ঘটনায় রণবীর সেনা ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল, এদের মধ্যে ৩ জনকে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড ও ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। ৩ জুলাই মিয়াপুর গণহত্যার রায় দিতে গিয়ে পাটনা হাইকোর্ট নিম্নতর আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তিপ্রাপ্ত ১০ জনের ৯ জনকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল। ২০০০ সালে সংগঠিত এই গণহত্যায় ৩২ জন দলিতকে খুন করে রণবীর সেনার লোকজন।
১৯৯৭ এর শেষ রাতে গোটা দেশ যখন নতুন বছর পালনের প্রস্তুতিতে মাতোয়ারা, রণবীর সেনা জাহানাবাদ জেলার লখিমপুর বাথে গ্রামে প্রায় ষাট জনকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। শোন নদীর দু ধারের দুই এলাকা, বাথানি এবং বাথে জাতীয় খবর হয়ে ওঠে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন বাথানিটোলার ঘটনাকে ‘জাতীয় লজ্জা’ বলে বর্ণনা করেন। গোটা দেশ জোড়া গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বরের চাপে লালু প্রসাদ বাধ্য হন রণবীর সেনার পেছনে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক মদতের অনুসন্ধানের জন্য আমীর দাস কমিশন তৈরি করতে। কিন্তু প্রথম থেকেই এই কমিশনকে পঙ্গু করে দেবার চেষ্টা চলে। কমিশন অভিযোগ করে তার কাছে যথেষ্ট অর্থ, কর্মী বা ক্ষমতা নেই। যদিও এর মধ্যেই মূলত সি পি আই (এম এল) এর ধারাবাহিক ও বহুমাত্রিক কার্যকলাপের দ্বারা রণবীর সেনাকে যথেষ্ট পরিমাণে জনবিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় এবং ২০০২ সালে ব্রহ্মেশ্বর সিং রাষ্ট্রের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করতে বাধ্য হন। ২০০৫ সালে বিহারে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় এবং বিজেপির সমর্থন নিয়ে নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হন। সরকারের প্রথম সিদ্ধান্তগুলির অন্যতম ছিল আমীর দাস কমিশনকে বাতিল করা। জেডি ইউ, বিজেপি নেতাদের অনেকেই, এমনকী আরজেডি বা কংগ্রেসের অনেক নেতাও এতে গভীর স্বস্তি পান কারণ তদন্তের জন্য এই কমিশন তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সরকারের দ্বিতীয় দফার সূচনাতেই বেল পেয়ে যান ব্রহ্মেশ্বর সিং। কেবলমাত্র জনগণের তীব্র ঘৃণাই তার সমাপ্তি সূচীত করতে সক্ষম হয়। এরই আগে পরে বাথানি আর বাথে সহ দলিত গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ও নিম্ন আদালতে চরম শাস্তিপ্রাপ্তদের পাটনা হাইকোর্ট মুক্তি দিয়ে দিলেন। নীতীশ কুমার ‘ন্যায়ের সঙ্গে উন্নয়ন’ এর মধুমাখা বুলি আওড়াচ্ছেন এবং তার সময়কালে বিহার দেখছে ‘আইনি গণতন্ত্রের স্বরূপ’।
হাইকোর্ট এর এইসব রায়কে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব ? এটা কি বিচারব্যবস্থার মধ্যেকার কয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ? এই দৃষ্টিকোণের বিপরীতেই বরং স্বাক্ষ্য দিয়ে অতীত নথি আমাদের বলে বিহারে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণভাবে গ্রামীণ গরীবদের হত্যাকারীরা সবাই এখানে বেকসুর মুক্তি পেয়ে যায়, এমনকী তারাও যারা বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীনই বেশ কয়েক বছর অন্তরীণ থেকেছে। তাহলে কি বিহারে অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় নি ? নীতীশ কুমারের ‘পরিবর্তিত’ বিহারেও সামন্ত পক্ষপাত প্রবলভাবেই বর্তমান আছে ?
বাথানিটোলা বাথে সহ নব্বই দশক জুড়ে বিহারে একের পর এক দলিত গণহত্যা যেমন লালু জমানার সমাজ রাজনৈতিক চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল, তেমনি এপ্রিল ২০১২ থেকে অক্টোবর ২০১৩ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আসা হাইকোর্টের চারটি রায় – যাকে আমরা বলতেই পারি আইনী গণহত্যা – নীতীশ কুমারের বিহারের সমাজ রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রকট আয়না হয়ে উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্থদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে হাইকোর্টের রায়কে যেমন সুপ্রিম কোর্টের পুনর্বিচার করা দরকার, তেমনি আমাদের অবশ্যই বোঝা দরকার দলিত গণহত্যার প্রেক্ষাপট এবং ইঙ্গিৎগুলিকে। আর দরকার এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের সম্মান ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো।
অতীতের জগন্নাথ মিশ্র আর বিন্দেশ্বরী দুবেদের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে লালুপ্রসাদ নীতীশ কুমার দের হাতে। কিন্তু বাথানি আর বাথে দুই আমাদের দেখিয়ে দেয় ক্ষমতা একইভাবে সামন্তী শক্তির হাতে রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কংগ্রেস ঘনিষ্ঠতার পর্বের আগে নীতীশ কুমার সেই বিজেপির সাথে দীর্ঘস্থায়ী জোট বেঁধে তাদের বাড় বাড়ন্তের সুবিধা করে দিয়েছিলেন যারা সামন্তী মৌলবাদী শক্তির সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিনিধি। আর লালুপ্রসাদও উচ্চবর্গের আধিপত্যের বিরূদ্ধে তার সব আলঙ্কারিক কথাবার্তার পরেও গ্রামীণ গরীব তথা সি পি আই (এম এল) এর বিরূদ্ধে এবং সামন্তী শক্তিকে তোষণের রাস্তাতেই হাঁটেন। এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় যে ভূমি সংস্কার কমিশন এর রিপোর্ট কে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এগুলোও নয় যে রিপোর্ট দাখিলের আগেই আমীর দাস কমিশনকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং বাথে বাথানিসহ গণহত্যার অভিযুক্তদের ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং ডজন ডজন গণহত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারীরা বেল এ মুক্ত হয়ে গিয়েছেন।
বিহারের প্রকৃত পরিবর্তন শাসকদের রঙ বদলের ওপর নির্ভর করে নেই। নির্ভর করে নেই শাসকদের জনমোহিনী সব শ্লোগান – লালুপ্রসাদের ‘সামাজিক ন্যায়’ বা নীতীশ কুমারের ‘সুশাসন’ এর ওপরও। চলতি জমানার আধা সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর বিশ্বায়ন ও কর্পোরেটীকরণ এর চকচকে পালিশ লাগিয়ে কাগজে কলমে অসাধারণ পরিসংখ্যানগত বৃদ্ধি দেখানোর ওপরও তা নির্ভর করে নেই।
১৯৮৬ র এপ্রিলে আরওয়াল গণহত্যার সময়, যখন কংগ্রেসী জমানায় আর একবার জালিয়ানওয়ালাবাগের পুনরাভিনয় দেখা গেল বিহারে, কমরেড বিনোদ মিশ্র লিখেছিলেন, “মেঠো পথের ছোট্ট জনপদ আরওয়ালের অজানা অশ্রুত কৃষকদের মধ্যে গরীবতমদের অনালোচিত মৃত্যু যখন বিহারের শাসকদের রাজনৈতিক সংকটকে রূপ দিতে শুরু করেছে, তখন নিশ্চিতভবেই দাবী করা যায় নায়কেরা অবশেষে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন”। আদালতের রায় নিরপেক্ষভাবেই আরওয়াল, বাথানি বা বাথে মুছে যাচ্ছে না এবং বিহারের ন্যায় ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে নতুন বাতাস সঞ্চার করছে।
[ এই লেখায় বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট ও বিভিন্ন প্রবন্ধের সূত্র ব্যবহার করা হয়েছ]
©somewhere in net ltd.