নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌভিকের চিন্তাচর্চা

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি

সৌভিক ঘোষাল

পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক। মতাদর্শে মার্কসবাদী। কোলকাতার বাসিন্দা

সৌভিক ঘোষাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

উপমহাদেশ ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি : প্রাক স্বাধীনতা পর্ব

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:৩৫


বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদীদের দিক থেকে সচেতনভাবেই বারবার সামনে আনা হয় মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি। আজকের দিনে বিশ্বজুড়ে পলিটিকাল ইসলাম এর উত্থান ও মৌলবাদীদের ইসলামের নামে চালানো নানা তাণ্ডব কতটা মুসলিম ধর্ম-দর্শনের ‘অনিবার্য আগ্রাসন’ আর কতটা সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা তার স্বার্থে সৃষ্ট, তার আলোচনা, সে সম্পর্কে ইতিহাস অনুগ বিশ্লেষণ বিশেষভাবেই জরুরী। সেই বিস্তৃত পরিসরে বর্তমান প্রবন্ধে আমরা খুব একটা প্রবেশ করতে চাইছি না। আগ্রহী পাঠক এই অংশটির জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি সমৃদ্ধ বিশ্লেষক সমীর আমীন এর ‘মান্থলি রিভিউ’ এ প্রকাশিত পলিটিকাল ইসলাম শীর্ষক আলোকসম্পাতি প্রবন্ধটি দেখতে পারেন।
(লিংক-http://monthlyreview.org/2007/12/01/political-islam-in-the-service-of-imperialism/)
আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটটির সূত্র মাথায় রেখে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের একটি অংশের সম্প্রদায়গত চিন্তা কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ করেছে ও তা সমাজ রাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তার মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি।
নিঃসন্দেহে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিশেষ একটি ধরণ ভারতের ক্ষেত্রে সামনে আসে স্যর সৈয়দ আহমেদ ও তার আলিগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। হিন্দু এলিট ও তার সঙ্গে শাসকের বোঝাপড়ার বিপরীতে তা শাসক ইংরেজের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় নিয়ে আসতে চায় তখনো পর্যন্ত এই নিরিখে অনেকটাই পরান্মুখ মুসলিম সমাজকে। সৈয়দ আহমেদ ও আমীর আলির নেতৃত্বাধীন মুসলিম সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কথায় আসার আগে অবশ্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক নাগাদ (রামমোহনের সংস্কার আন্দোলনের পর্বেই) বিশ্বজোড়া মুসলিম মানসের মধ্যে ওঠা এক ঢেউ এর দিকে, কেননা ভারতের মধ্যেও তা ভালোমাত্রাতেই আলোড়ন তুলেছিল এবং যথেষ্ট সামাজিক ভিত্তি খুঁজে নিয়েছিল। পাঠক বুঝতে পারছেন আমরা ওয়াহাবী আন্দোলনের কথাই বলছি।
ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব ছিলেন মিশরের বাসিন্দা। তার প্রচারিত একটি মতবাদ মুসলিম সমাজে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার মূল কথা ছিল – নানা বহিরঙ্গের আচার অনুষ্ঠান ও পুরোহিততন্ত্রের প্রভাব ইসলামের প্রাণশক্তিকে খর্ব করছে, অতএব ইসলামের বিশুদ্ধি প্রয়োজন এবং এই বিশুদ্ধিকরণ অভিযান সার্থক করতে হলে সর্বত্র ইসলামিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। প্যান ইসলামিক এই আন্দোলনের সঙ্গে ভারত ভূখণ্ডের মুসলিম সমাজের সম্পর্ক তৈরি করে দেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভি। ১৮২২-২৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মক্কায় যান ও সেখানে ওয়াহাবী মতবাদে প্রাণিত হন। দেশে ফিরে ব্রেলভি নিজেকে ইমাম বলে ঘোষণা করে ওয়াহাবী মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। বলেন - যারা মুসলমান নয় – অর্থাৎ হিন্দু শিখ খ্রীষ্টান প্রভৃতি – তারা সকলেই দার – উল-হাবাব বা ঈশ্বরের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। পেশোয়ারের সন্নিহিত উপজাতি এলাকা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভি ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইংরেজরা এই সংবাদ পেয়েও এতে কোনও হস্তক্ষেপ করে নি। বহু নরসংহারের মাধ্যমে ওয়াহাবীরা পেশোয়ার অধিকার করে এবং কোয়ায়েৎ উপত্যকার সিত্তানাতে একটি ক্ষুদ্র ওয়াহাবী রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হয়। এক বছরের মধ্যেই অবশ্য ব্রেলভি যুদ্ধে নিহত হন ও সিত্তানা রাজের পতন হয়। ওয়াহাবীদের বিদ্রোহমূলক অভিযান অবশ্য চলতে থাকে এবং ১৮৬৩ সালে ওয়াহাবীরা সিত্তানা পুনর্দখলে সমর্থ হয়। বাংলার তিতুমীরের বিদ্রোহ বা ফরাজী আন্দোলন এর মধ্যে কৃষক আন্দোলনের মর্মবস্তুর সঙ্গেই ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রেরণা বহুলাংশে মিশে ছিল। বস্তুতপক্ষে ফরজ বা মুসলমানদের পালনীয় কর্তব্যের সূত্রেই ফরাজী আন্দোলনের এরকম নাম হয়। এই আন্দোলনের মূল প্রবক্তা শরিয়ৎউল্লা মক্কায় হজ করতে গিয়ে ওয়াহাবী মতাদর্শে দীক্ষিত হন। তার পুত্র দুদুমিঞা এই আন্দোলনকে অনেক বিস্তৃত করেন। তিতুমীরও মক্কায় হজ করতে গিয়েই ওয়াহাবী মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং দেশে ফিরে ওয়াহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য একটি দল গঠন করেন।
ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিম সমাজের বোঝাপড়ার বেশ অভাব ছিল এবং ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের পর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও তিক্ততা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু শাসন প্রণালীর নিরিখ থেকে বিরাট জনসংখ্যার মুসলিম সমাজের সঙ্গে ইংরেজদের বোঝাপড়ার প্রয়োজনিয়তাও অনুভূত হয়েছিল। সাম্রাজ্যের শোষণ ও শাসনকে নিরঙ্কুশ রাখার জন্য ভারতবর্ষ শাসনের ক্ষেত্রে বহুখ্যাত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি গ্রহণের একটা তাগিদও রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ অনুভব করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে মহাবিদ্রোহের আগে কোম্পানির শাসন চলাকালীনই এটা অনুভূত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এলফিনস্টোন এরকম কথাই রাজকর্মচারিদের পরামর্শ দিতে গিয়ে সরাসরি বলেছিলেন। তখন অবশ্য মহাবিদ্রোহ হয়ে গিয়েছে এবং কোম্পানীর শাসনের জায়গায় সরাসরি রাণীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতায় মুসলিম সমাজ তখন হতাশাগ্রস্থ এবং অভিমানে তারা ইংরেজদের নিয়ে আসা আধুনিকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন। অনেক শিক্ষিত আধুনিক মনস্ক মুসলিম মনে করতে থাকেন এটা মুসলিম সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হচ্ছে। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর তাকে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেও মুসলিম এলিট সমাজের অনেকে শাসক ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিমদের সংযোগের প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেছিলেন। এই সংযোগের প্রাথমিক দুই কারিগর ছিলেন স্যর সৈয়দ আহম্মদ ও সৈয়দ আমির আলি।
আমির আলি মুসলিমদের উন্নতির জন্য ১৮৭৭ সালে তৈরি করেন ন্যাশানাল মহমেডান সোসাইটি। পরে একে সর্বভারতীয় চরিত্র প্রদানের সময় এর নাম দেওয়া হয় সেন্ট্রাল মহমেডান সোসাইটি। আমির আলির মতবাদের মধ্যে ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে মুসলিম জয়গানের প্রবণতা প্রকট। তিনি বলেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূচনা হয় ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে, তার আগে ভারতের কোনও ইতিহাস ছিল না। আমির আলি এলিট মুসলিমদের একাংশের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক স্থাপনের গোড়াপত্তনের কাজটি করেছিলেন ইংরেজদের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত্য রেখেই। ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকদের তিনি পিতৃস্থানীয় মনে করতেন। মুসলিম সমাজের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে তিনি ইংরেজ নয়, হিন্দুদেরই দাঁড় করিয়েছিলন।
স্যর সৈয়দ আহমেদ ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের সময় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছিলেন। এর পুরস্কার হিসেবে ইংরেজ সরকার তাকে মাসিক দুশো টাকা বিশেষ পেনসন মঞ্জুর করেন। মহাবিদ্রোহের পরবর্তী বছরগুলিতে মুসলিমদের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি সচেষ্ট হন। এই উপলক্ষ্যেই ১৮৭৫ সালে আলিগড়ে তৈরি হয় মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ। অনতিবিলম্বে আলিগড় মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষনৌতে এক প্রকাশ্য বক্তৃতায় তিনি মুসলিমদের জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করার জন্য আহ্বান জানান। অতঃপর এই কাজ তিনি নানাভাবে চালিয়ে যান এবং আলিগড় কলেজের শিক্ষকদেরও এই কাজে নিযুক্ত করেন। আধুনিক ভারতের সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির প্রথম দিককার কাণ্ডারীদের মধ্যে সৈয়দ আহম্মেদ অন্যতম। অথচ অবাক করার মত বিষয় একসময় তিনি বলেছিলেন, “ আমি আন্তরিকভাবে আমার দেশ এবং জাতির সেবা করতে চাই। জাতি কথাটি দিয়ে আমি হিন্দু এবং মুসলমান উভয়কেই বোঝাতে চাইছি। কেননা আমার জাতি কথাটির এইটেই একমাত্র অর্থ”। ১৮৮৪ সালে দেওয়া এই বক্তৃতা তিন বছরের মধ্যেই বদলে গেল। ১৮৮৭ সালে তিনি মতাদর্শ সম্পূর্ণ পালটে বললেন, “ যখন আমাদের হিন্দু ভাইরা অথবা বাঙালি বন্ধুরা এমন কিছু করতে চান যাতে আমাদের ক্ষতি হবে এবং আমাদের জাতির অপমান হবে তখন আমরা তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থাকতে পারি না এবং তখন আমাদের অবশ্যই কর্তব্য হবে হিন্দু এবং বাঙালিদের আক্রমণ থেকে আমাদের জাতিকে রক্ষা করা – এই আক্রমণ যে আমাদের জাতির ক্ষতি করবে সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত”। কংগ্রেসের প্রতি তীব্র বিদ্বেষই তার মতাদর্শ পরিবর্তনের কারণ কিনা সে অনুমান অনেকেই করতে চাইবেন। বস্তুতপক্ষে ১৮৮৯এ তিনি সরাসরি বললেন, “ কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলি যে দেশে দুটি স্বতন্ত্র জাতি বাস করে সেই দেশের পক্ষে নিতান্তই অযৌক্তিক। ধরে নেওয়া গেল সব ইংরাজ ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেল। তখন কারা ভারতবর্ষ শাসন করবে ? এটি কি সম্ভব যে এইরকম অবস্থায় হিন্দু এবং মুসলমান দুটি জাতি একই সিঙ্ঘাসনে অধিরুঢ় হবে এবং ক্ষমতার ক্ষেত্রে উভয়েই হবে সমান ? তা কখোনোই হতে পারে না। যা হবে তা হল একটি অপরকে পরাভূত করবে এবং নিপীড়িত করবে। দুটিতে সমান হয়ে থাকবে এমন আশা করা হল অসম্ভব এবং অভাবনীয়কে প্রত্যাশা করা”।
এই ভাবনাকে ইংরেজরা অবশ্যই উশকে দিতে চেয়েছিল এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে কোনও মুসলিম ব্যক্তি বা সংগঠনের তরফে এরকম ভাবনা আসার আগে লর্ড ডাফরিনই ১৮৮৮ সালে এরকম একটি প্রস্তাব আনেন। এর অনেক পরে ১৯০৯ সালে ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর কাছে মুসলিমদের পক্ষ থেকে এই দাবি তোলা হয়। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রত্যক্ষভাবে একটি মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশ ও একটি অবাঙালি সংখ্যাগুরু প্রদেশ তৈরির মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুর বিকাশমান জাতিয়তাকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। ঢাকার নবাবের প্রাসাদে মুসলমান নেতাদের কার্জন সরাসরি বলেছিলেন, “আমি আপনাদের একটি মুসলিম প্রদেশ দিচ্ছি”। তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব শেষপর্যন্ত বাতিল করে দিতে হয় এবং এতে অনেক মুসলমান নেতা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।
বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা ভাবেন। সরকার লক্ষ্য করেছিল আমির আলি বা সৈয়দ আহমেদের মত মানুষদের প্রভাব উচ্চবিত্ত এবং প্রতিষ্ঠিত মুসলিমদের একাংশের মধ্যেই বিদ্যমান। সাধারণ মুসলিম সমাজ রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে নি। মুসলিম নেতারাও সংগবদ্ধ ছিলেন না। ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতিকে ব্যাপক জনগণের মধ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সাংগঠনিক উদ্যোগের প্রয়োজনিয়তা ইংরেজরা চতুর মস্তিষ্কে অনুভব করে। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজদেরই সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। আগা খাঁর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে মুসলিম সমাজের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন। ভাইসরয় সেই দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেন। ওই বছরেই ৯ অক্টোবর নবাব সালিমুল্লা একটি বিবৃতি প্রকাশ করে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলেন। এর কিছু দিন পরে ডিসেম্বর মাসে ঢাকা শহরে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। সে সময় অনেক মুসলিম নেতা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেন নি, যেমন আগা খাঁ। এজন্য তাকে যথেষ্ট সমালোচিত হতে হয় এবং তিনি মুসলিম লীগের সভাপতির পদ থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯০৮ সালে, আলিগড়ে। এখানে বঙ্গব্যবচ্ছেদকে অভিনন্দন জানিয়ে ও স্বদেশী আন্দোলনের নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। একদিকে হিন্দু মহাসভা ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ অন্যদিকে মুসলিম লীগ হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মূল নির্যাসকে বহন করে এগিয়ে চলে।
বঙ্গভঙ্গ ছাড়া প্রথম পর্বের মুসলিম লীগের অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল মর্লে মিন্টো সংস্কার। এই শাসন সংস্কারে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রথার কথা বলা হয়। এই পৃথক নির্বাচন প্রথা পরবর্তীকালের ভারত বিভাজনের ভ্রূণ, এমনটাই অনেকে মনে করেছেন। জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে থেকে এই শাসন সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়েছিল। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের তৃতীয় সাধারণ অধিবেশন কিন্তু মর্লে মিন্টো সংস্কারকে অভিনন্দন জানায় এবং এই সংস্কারের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলন বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রবল চাপে ব্রিটিশ সরকার শেষপর্যন্ত বঙ্গভঙ্গর সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগকে আশাহত করে এবং জন্মের পর থেকে তাদের শাসক আনুগত্যে প্রথম বারের জন্য চিড় ধরায়। সমকালে ইউরোপীয় ভূখণ্ডের বেশ কিছু ঘটনা ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের সঙ্গে শাসকদের দূরত্ব বাড়িয়ে তোলে। ১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধ হয় এবং তার জেরে তুরস্ক সাম্রাজ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তুর্কীর সুলতান মুসলিম জগতের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু বা খলিফা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। বলকান যুদ্ধের ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির দখলে চলে যায়। ব্রিটেন তুর্কি সাম্রাজ্যের অঙ্গচ্ছেদে পরোক্ষে ব্যাপক সহায়তা করেছিল। ভারতের মুসলিম নেতৃত্বের একাংশের অবিচল ব্রিটিশ ভক্তি এর ফলে নড়ে গিয়েছিল। মুসলিম লীগের অবস্থান এই সময় থেকে কিছুটা পাল্টাতে শুরু করে এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তার কিছু নতুন সমীকরণ তৈরি হয়।
মহম্মদ আলি জিন্নার মত অনেকেই এসময় একইসঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। জিন্না স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন ভারতের জাতীয় স্বার্থে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন এবং মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে আছেন। ১৯১৬ র লক্ষনৌ চুক্তির মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের নেতারা প্রথমবারের জন্য কাছাকাছি আসেন এবং এতে জিন্নার বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই সময় থেকে ১৯১৯ এ খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের যৌথ সূচনা পর্যন্ত সময়কালটি উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব ছিল। অসহযোগ আন্দোলন আকষ্মিকভাবে প্রত্যাহার করার পর ঐক্যের সম্পর্কে অনেকটাই ফাটল ধরে এবং দাঙ্গার বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯২৩ এ সাভারকরকে ঘিরে হিন্দু মহাসভার পুনরুজ্জীবন পর্ব শুরু হলে মুসলিম লীগের সক্রিয়তাও নতুন গতি পায়। প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর থেকেই উপযুক্ত কর্মসূচী ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে লীগের কাজকর্মে কিছু ভাঁটা পড়েছিল। হিন্দু মহাসভার সক্রিয়তা, পৃথক নির্বাচনের দাবি এবং দেশে সাধারণ নির্বাচন মুসলিম লীগের কাছে একটি বড় কর্মসূচী উপস্থিত করে। বস্তুতপক্ষে পৃথক নির্বাচন, আসনের সংরক্ষণ কেন্দ্রিক বাঁটোয়ারা, শাসন সংস্কার দেশভাগের প্রত্যক্ষ দাবি ওঠার আগে পর্যন্ত সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির অন্যতম বিষয় ছিল আর সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার পরিকল্পিত আয়োজনও আমরা ভালোভাবেই লক্ষ্য করি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণার প্রবর্তন একটি প্রভাবসঞ্চারী বিষয়। সংখ্যালঘু সহ বিভিন্ন অংশের জন্য উপযুক্ত আসন সংরক্ষণ এক জিনিস আর পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণা আর এক। আসন সংরক্ষণ করলেও যদি পৃথক নির্বাচক মণ্ডলীর পরিবর্তে সাধারণ অর্থাৎ মূলত হিন্দু মুসলিম যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী থাকে, তবে মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত প্রার্থীকেও জয়ের জন্য হিন্দু ভোটের ওপর নির্ভর করতে হবে বা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রার্থীকে মুসলিম বা ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ভোটের ওপর। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাবাদী দুর্বুদ্ধির প্রশ্রয় সম্ভাবনা তুলনায় কম। বিপরীতে হিন্দু নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা হিন্দু প্রতিনিধি ও মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবাধে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রচারের সম্ভাবনা থাকে। এই সম্ভাবনার আশঙ্কা বিভিন্ন নির্বাচনের আগে পরে বাস্তব চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং নির্বাচনের আগে পরে বহু সংখ্যক দাঙ্গার ঘটনা ঘটত। যেমন ১৯২৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে ওই বছরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পঁয়ত্রিশটি ছোট বড় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনে ভোট আদায় করার জন্য সাম্প্রদায়িক প্রচারকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। লালা লাজপত রায়, পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য হিন্দু ভোটারদের নিজেদের দিকে আনতে যেভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলেও এটা ধরা পড়ে।
পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টি লক্ষনৌ চুক্তির (১৯১৬) সময় কংগ্রেস নেতৃত্বও মেনে নিয়েছিলেন। উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণে সাম্প্রদায়িক দূরত্বকে কমিয়ে আনার এই প্রচেষ্টা বাস্তবে বিপরীত ফলই দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় প্রথম পর্বে জিন্না নিজেও এ কারণে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণাকে সমালোচনা করেছিলেন, ১৯১০ সালে এর বিরোধিতা করে তিনি একটি প্রস্তাবও উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে ফেলে তিনি পৃথক নির্বাচন সমর্থন করে সাম্প্রদায়িকতার বোধকে প্রশাসনের মধ্যে যুক্ত করতে সাহায্য করেন। মুসলিম সমাজের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে উঠে আসায় জিন্নার সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। কংগ্রেসের ভেতরের মুসলিম নেতৃত্ব যেমন একদিকে ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন কংগ্রেসের বাইরের বিভিন্ন মুসলিম নেতা, যেমন বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক, পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টির সিকান্দর হায়াত খাঁ, সিন্ধুপ্রদেশে আল্লা বক্স, উত্তরপ্রদেশে খালিকুজ্জমান। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে খালিকুজ্জমান জিন্নার শিবিরে যোগ দেন। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা কংগ্রেসের অনাগ্রহে ব্যর্থ হবার পর ফজলুল হক জিন্নার দিকে সরে যান। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের অবিমিশ্রকারিতা জিন্নার অপ্রতিহত উত্থান ও দেশভাগের রাজনীতির বিস্তারে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে আধুনিক ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তারের ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা-আর এস এস এবং মুসলিম লীগ দ্বিত্বের বাইরে কংগ্রেসের অবস্থান কী ছিল, সেটাও বিবেচ্য।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং দেশভাগের মধ্যে দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ৮৩৬ টি অমুসলমান আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৭১৫ টিতে জয়লাভ করে। কিন্তু মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৪৮৫ টি আসনের মধ্যে ৮৫ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কংগ্রেস মাত্র ২৬ টি আসনে জয়ী হতে সমর্থ হয়। মুসলিম আসনের ক্ষেত্রে অবশ্য মুসলিম লীগও সর্বত্র বিশেষ সাফল্য পায় নি। পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ ৮৬ টি মুসলিম আসনের মধ্যে মাত্র দুটি পায়। বাংলায় ১১৯ টির মধ্যে পায় ৪০ টি। সিন্ধুপ্রদেশ এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একটি মুসলিম আসনেও তারা জিততে পারে নি। বিহারে ২৯ টির মধ্যে ২০ টি তে, মাদ্রাজে ২৮ টির মধ্যে ১১ টি তে এবং উত্তরপ্রদেশে ৬৪ টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২৭ টি তে তারা জয়লাভ করে। কংগ্রেস কোথাও মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথভাবে মন্ত্রীসভা গঠনে রাজী হয় নি এবং এই সিদ্ধান্ত বিশেষত উত্তরপ্রদেশকে কেন্দ্র করে জিন্নাকে রুষ্ট করেছিল। যৌথভাবে মন্ত্রীসভা গঠনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মধ্যে অবশ্যই আলোচনা হয়েছিল কিন্তু কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান সূত্র মেলে নি। কংগ্রেসের দুই সামনের সারির নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং জহরলাল নেহরু উত্তরপ্রদেশে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠনের বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানে ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া গোবিন্দবল্লভ পন্থ মুসলিম লীগ নেতা খালিকুজ্জমান এর সঙ্গে বৈঠক করে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা বিষয়ে অনেকদূর এগিয়েছিলেন। মৌলানা আজাদও খালিকুজ্জমান এর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর খালিকুজ্জমান এবং নবাব ইসমাইল খাঁ মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নেহরু আজাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের সম্ভাবনা বাতিল করে দেন। কংগ্রেসের প্রগতিপন্থী অবস্থান এই নেতারা মানতে পারবেন না – এটাই নেহরুর বক্তব্য ছিল। আজাদ গান্ধীজীকে প্রথমে তার স্বপক্ষে আনলেও নেহরুর সঙ্গে কথা বলে গান্ধীজী নেহরুর অবস্থানেই সম্মতি দেন। কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ায় মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে অচিরেই তীব্রতর করে তোলে। জিন্না এবং মুসলিম লীগের সামনে অন্যান্য মুসলিম নেতৃত্বের যে চ্যালেঞ্জ ছিল, যেমন বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হকের, তাও আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন না হওয়ায় ফজলুল হক বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগের দিকে ঝোঁকেন এবং এই নতুন বিন্যাস মুসলিম লীগের জমিকে বাংলায় দৃঢ়তর করে। ভারত বিভাজনের সঙ্গে বঙ্গ বিভাজনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে ফজলুল হকের সমঝোতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাকে মুসলিম লীগের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য করা অনেকাংশে দায়ী।
মুসলিম লীগের ১৯৩৭ এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কড়া সাম্প্রদায়িক অবস্থান ও কার্যকলাপ হিন্দু মহাসভাকে নতুন শক্তিতে আত্মপ্রকাশের জমি তৈরি করে দিয়েছিল এবং মুসলিম ও হিন্দু মৌলবাদ পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল। কংগ্রেস এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গিয়ে এই দুটি সংগঠন এর সঙ্গেই নিজেদের সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয় এবং ১৯৩৮ এর ডিসেম্বরে এক নির্দেশিকা জারী করে জানিয়ে দেয় তার কোনও সদস্য এই দুটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। এই বিচ্ছেদ কেবল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিচ্ছেদ হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা দেশের দুটি প্রধান জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল। হিন্দুদের প্রধান অংশটি অবশ্য হিন্দু মহাসভাকে উপেক্ষা করে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ মুসলিম মানসে কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ তৈরিতে সফল হয়ে তাদের কংগ্রেস ও জাতীয় আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। শুধু তাই নয় সে তার অনুগামীদের একটি বড় অংশের মধ্যে কংগ্রেস সম্পর্কে তীব্র জিঘাংসার মনোভাব তৈরি করে দিয়েছিল। এই মানসিকতারই শেষ পরিণতি দেশভাগ।
মুসলিম লীগের তোলা দেশভাগের প্রস্তাবের আগেই অবশ্য বিভিন্ন সময়ে মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রগঠনের কথা বিভিন্ন সময়ে নানা অবস্থান থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের সময়েই আগা খাঁ নেহরু পরিকল্পিত ইউনিটারি গভর্মেন্ট এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং অনেকগুলো রাষ্ট্র নিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। জিন্না এই সময়ে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন না। পরবর্তীকালে উত্তরপ্রদেশের প্রভাবশালী নেতা খালিকুজ্জমান ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে জিন্নাকে বোঝান এবং জিন্না তাকে বলেন তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধী নন এবং বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করার যোগ্য। ১৯৩৯ এর মার্চে এই প্রস্তাব নিয়ে খালিকুজ্জমান ভারত সচিব জেটল্যাণ্ডের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। এই কথার পেছনে ছিল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহমৎ আলির তোলা একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রস্তাব। ১৯৩০ এর গোলটেবিল বৈঠকের সময় রহমৎ আলি হিন্দু ভারতবর্ষ থেকে পৃথক করে ভারতবর্ষের মধ্যেই একটি জাতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন শুরু করেন এবং এই সূত্রে পাঞ্জাব, আফগানিস্থান, কাশ্মীর, সিন্ধুপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তান নিয়ে পাকিস্থান এর কথা বলেন। এই দাবিকে জনপ্রিয় করার জন্য রহমৎ আলি ‘নাউ অর নেভার’ নামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন।
(Click This Link)
রহমৎ আলি যখন মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশগুলি নিয়ে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পরামর্শ দিচ্ছিলেন সেই সময়েই মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে বিশিষ্ট কবি ইকবালও এই ধরণের প্রস্তাব পেশ করছিলেন। এলহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ইকবাল সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “ আমি দেখতে চাই পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তান একটি রাষ্ট্রে সমন্বিত হবে। এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতরে বা বাইরে স্বশাসিত রাষ্ট্র হবে। সংযুক্তি সাধনের মাধ্যমে গঠিত উত্তর ভারতের মুসলিম রাষ্ট্রই হল সকল মুসলমানের, অন্তত উত্তর পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চরম ভাগ্য”। ইকবাল এই বক্তৃতাতেই আরো বলেন, “আমরা হলাম সাত কোটি মানুষ। ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত মানুষদের চেয়ে আমরা বেশি সমগোত্রীয়। বস্তুত ভারতবর্ষের মুসলমানরাই একমাত্র জনগোষ্ঠী যাদের সম্পর্কে আধুনিক অর্থে জাতি শব্দটি প্রয়োগ করা যায়। হিন্দুরা যদিও প্রায় সব বিষয়েই আমাদের থেকে এগিয়ে আছে তবু একটি জাতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সমগোত্রীয়তা তারা অর্জন করতে পারে নি। ইসলামের দান হিসেবে আমরা তা পেরেছি। সুতরাং ভারতবর্ষের মধ্যে মুসলমানদের দাবি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মন্ত্রীসভাগুলির সঙ্গে পরামর্শ না করে ভারতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামিল করা হলে দেশের অধিকাংশ প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। মুসলিম লীগ এর সুযোগ গ্রহণ করে। জিন্না ১৯৩৯ এর ২২ মার্চ তারিখটিকে ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি পালনের মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে মুসলিম সংহতি গড়ার চেষ্টা শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ এ উল্লিখিত ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব মুলতুবি রাখা হয়েছিল। জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ মুলতুবে রাখা এই ফেডারেশন কে একেবারে বাতিল করার দিকেই জোর দেন। জিন্না লিনলিথগোকে এই দাবির কথা জানিয়েছিলেন এবং লিনলিথগো ব্রিটিশের তরফে এই দাবি মেনে নেন। তখন থেকেই স্পষ্ট হতে থাকে দেশভাগের পরিকল্পনার ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি নেই। এই পর্বেও অবশ্য মুসলিমদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশভাগ যখন সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। জিন্না লাহোর কংগ্রেসের স্টেটস কথাটি ছাপার ভুল বলে বর্ণনা করে বলেন এটি আদতে হবে স্টেট। বাংলার লীগ সম্পাদক জিন্নার এই সাফাইতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি এবং অনেকের মনেই সন্দেহ জেগেছিল জিন্না চাতুরী করে স্টেটস কথাটি লিখে পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের সমর্থন আদায় করেছিলেন এবং সময় বুঝে তা থেকে পিছিয়ে আসেন। তাদের মতে এটি কোনও ভুল ছিল না, ছিল শঠতা। পাকিস্থানের গৃহযুদ্ধ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিষয়টি ভালোভাবেই সামনে আসে।
মুসলিম লীগের অধিবেশনে দেশভাগের প্রস্তাব গৃহীত হবার কয়েক দিন পরেই দিল্লিতে কিছু মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে আহরার, জমায়েত উল উলেমায়ে ই হিন্দ, শিয়া রাজনৈতিক সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ যোগদান করেছিলেন। কংগ্রেসের কয়েকজন মুসলমান নেতাও এতে যোগ দেন কিন্তু মুসলিম লীগের কেউ অংশগ্রহণ করেন নি। সম্মেলনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আজাদ মুসলিম সম্মেলন’ এবং এর সভাপতিত্ব করেছিলেন সিন্ধুপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আল্লা বক্স। সম্মেলনে পাকিস্থান ধারণার তীব্র সমালোচনা করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশের দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিকেই সমর্থন দেওয়া অব্যাহত থাকে। জিন্না অবশ্য ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতা এবং যুদ্ধে ব্রিটিশের সঙ্গীন অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৪৩ এ অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে তিনি স্বাধীনতার দাবিটিকে সংযোজন করে নেন দেশভাগের দাবীর সঙ্গে এবং স্লোগান তোলেন “ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’। অনেকে অবশ্য মনে করেন ইংরেজদের ভারত ত্যাগের আসন্ন সম্ভাবনায় দেশভাগের পক্ষে তাদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার দিকটি জিন্নার এই আহ্বানের মধ্যে ধ্বনিত। কারণ গান্ধীজী ততদিনে ইংরেজদের বলেছেন দরকারে অরাজকতার মধ্যে ভারতকে রেখেও ইংরেজরা যেন দেশ ত্যাগ করে। অতঃপর ভারতবাসী নিজেই তার ভাগ্য বুঝে নেবে। ভারত সচিব আমেরিও ১৯৪৩ এর ফেব্রুয়ারীতে বলেছিলেন, “ আমরা যদি তাদের পথ থেকে সরে আসি তবে ভারতবাসীরা ঐক্যমত্যে আসতে পারবে গান্ধীজীর এই যুক্তির মধ্যে কিছু সত্য আছে”। জিন্না এই দৃষ্টিকোণকেই ভয় পেয়ে ব্রিটিশ যাবার আগেই দেশভাগকে নিশ্চিত করার তাগিদ অনুভব করে থাকতে পারেন। ব্রিটিশরা অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ অটুট রাখার জন্য বিশ্বস্ত স্বাধীন পাকিস্থানকে চেয়েছিল কারণ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের প্রতি তাদের নিরঙ্কুশ আস্থা ছিল না। কংগ্রেসের বিরোধিতা বা গান্ধীজীর ঘোষণা (আমার মৃতদেহের ওপর দিয়েই দেশভাগ হবে) ব্রিটিশ এবং মুসলিম লীগ উভয়কেই নিজ নিজ আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে ভীত ও মরিয়া করে তুলেছিল এবং বিশ্বযুদ্ধ অবসানে জিন্নার অবস্থান ও প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ঘোষণায় এই উদগ্রতাই আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৬ এ ক্যাবিনেট মিশনের ভারত রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবকে মুসলিম লীগ মানতে পারে নি এবং তারা ভারত ও পাকিস্থান – দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। কংগ্রেস এই বিকল্প প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। ক্ষমতা প্রদর্শনের নিরিখে ১৬ অগস্ট ১৯৪৬ তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয়। এই সূত্রেই শুরু হয় দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এবং ভয়াবহ এই দাঙ্গা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মত বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ দাঙ্গার মুখে দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত ভারতভাগ ছাড়া সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষরণের কোনও সমাধান চোখে পড়ে নি।
দেশভাগ পরবর্তী উপমহাদেশ ব্যাপী মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস তিনটি আলাদা দেশে তিনটি আলাদা প্রেক্ষাপটে এগিয়েছে। সেটা আমাদের বর্তমান পর্যালোচনার বাইরেই থাকছে, অন্য কোনও পরিসরে এই নিয়ে আলোচনা করা যাবে। সাম্প্রদায়িকতার রক্তাক্ত বাস্তবের মোকাবিলা কোন কোন পথে কীভাবে হতে পারে সে নিয়েও কোনও আলোচনা এখানে করলাম না আমরা। অকিঞ্চিৎকর এই লেখাটির পাঠক পাঠিকারা চলমান সেই আলোচনা ও প্রক্রিয়ায় সামিল থাকবেন, তাকে শক্তিশালী করবেন, এটুকুই আশা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.