নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনের কথা - প্রাণের কথা

শ্রীতোষ বন্দ্যোপাদ্যায়

শ্রীতোষ বন্দ্যোপাদ্যায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক অনন্য অভিজ্ঞতা

১৯ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ৭:২০

কাল (২২/০২/২০১৫) গেছিলাম উলুবেড়িয়ার গুটিনাগোড়ী গ্রামে এক "বাঙালী বাড়ি" তে ভাষা দিবস উদযাপনে। বাঙালী বাড়ি শব্দটা অত্যন্ত জেনে বুঝে লিখলাম কারণ এই বাড়ির অধিবাসীদের - মানুষ গুলোর কোন জাত নেই, আছে এক জাতি স্বত্বা - আছে এক "ধর্ম" - "নিজের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা"। এই মানুষরাই প্রকৃত মানুষ কারণ তাদের আছে "মান" আর আছে "হুঁস"।

সেখানেই ৯১ বছরের এক তরুণ পরিবেশন করলেন এই অসাধারণ শিল্প। তিনি প্রমাণ করলেন বয়স মানুষকে - তার শিল্প সত্ত্বাকে হার মানাতে পারে না কোনও দিন সে নিজেই যায় হেরে।

এই অনুষ্ঠানের আরও ছবি দেব - একটি লেখার সাথে।

সব লেখার একটা শুরু থাকে – একটা শিরোনাম লাগে, ভাবছিলাম এ লেখা শুরু করব কি করে – কি নামে পরিচয় পাবে এ লেখা ? মন বলল শুরু করে দাও – দেখবে তুমি আর লিখছ না তোমার লেখা তোমাকে লিখিয়ে নিয়ে চলেছে। বললাম তাই হোক – শুরু হোক এক অদ্ভুত বাস্তব গল্পের।

এ রচনার শুরু আজ থেকে ৫ বছর আগের এক ২১ শে ফেব্রুয়ারি – না ভুল বললাম। সব শুরুর তো একটা শুরু থাকে তাই এ কাহিনীর সূচনা দিবস ২৫ শে জানুয়ারী, ২০১০ – “জন্ম যদি এই বঙ্গে তবে তিষ্ঠ ক্ষণকাল” হ্যাঁ, বাংলার মধু কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের ১৫০ তম জন্ম বর্ষে পার্ক স্ট্রীটের সমাধি স্থানে তাঁর সমাধির সামনে একটি অনুষ্ঠানে। সেদিন আমাদের সাথে প্রথম দেখা মাস্টারমশাই মহিয়ুদ্দিন সাহেবের (এর পর থেকে এ লেখায় তাঁর পরিচয় মাস্টারমশাই) সাথে। নিজে এগিয়ে এসে আমাদের সাথে আলাপ করলেন এই সরল – নিরহঙ্কারী মানুষটি। সে দিন আমাদের একটি ছোট্ট প্রযোজনা তার বিশাল অন্তরের ছোঁয়া পেয়েছিল। তিনি বললেন – না তাঁর সেই শব্দ গুলো আজ ৫ টি বছর পরে মনে নেই, মনে আছে নন্দনের হাত ধরে তাঁর মূল অনুরোধ – তাঁদের গ্রামে ২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি আমাদের পেতে চান।

আমরা তখন নাট্যজগতে জন্ম নেওয়া এক শিশু – হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলি, যদিও বুকে রেখেছিলাম বিশ্বাস (এখনও রাখি তা) একদিন দাঁড়াব বটচ্ছায়া হয়ে – কারণ স্বপ্ন না দেখলে পথ চলা যায় না। সেদিন স্বীকার করেও আমন্ত্রণ তাঁর ভুল করেছিলাম ! কি ভুল ? ভেবেছিলাম এরকম তো ডাক আসে অনেক, উনিও (হ্যাঁ তখন মাস্টারমশাই ছিলেন উনি) তেমন ভাবে ডেকেছেন ! ২০১০ সালের ২১ শে। ধীরে সুস্থে পথ চলা শুরু আমাদের – বারে বারে বাজে ফোন – আমরা ভাবি কি রে বাবা ! সেই তো সবার শেষে নাটক হবে, দেখব তখন গুটিকয় মানুষ আছে বসে – হয় তাদের নেই কোন কাজ কাম অথবা সংগঠক অথবা ডেকোরেটর – অথবা যারা কোন ভাবে বাঁধা ওই সংগঠকদের চটির তলায়। হ্যাঁ ১০০ জনের মাঝে পাব ১ জনকে যে নাটক বোঝে আর আরও ১০ জন যারা নাটক ভালোবাসে – আর ! বাকি সব শূন্য ! আমরা গিয়ে পৌঁছালাম উলুবেড়িয়ায় সময় তখন ১০ টা – ১১ টার সময় “রাবেয়া নিবাস” – মাষ্টার মশাইয়ের গৃহ প্রাঙ্গণে।
তারপর – তারপরের কাহিনী “এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়” ।

তাই এবার আর দেরী নয় – “ধর গো তোরা – হাতে হাতে ধর গো” ২২/০২/২০১৫ সকাল বেলা ৬ নং গড়িয়া বাস স্ট্যান্ডে আমরা সবাই। মৌমিতার সামান্য একটু দেরী আর বাপ্পা ও রণজিতের যথাক্রমে “সোনার বাংলা” কমপ্লেক্স ও ৫ নং বাস স্ট্যান্ড” এ দাঁড়িয়ে থাকাটা আব্বুলিশ ! বাস ছাড়ল – আর ছাড়ল মুখ ! তবে অল্প সময়ের জন্য ! আসলে আগের রাত্রে রাত ১১.৩০ - ১২ টার আগে ঘুমাতে যেতে পারে নি কেউ – মৌমিতার মেসোমশাই ICU তে। বাস হাওড়া স্টেশনে – লেডিস লাইনে দাঁড়িয়ে সব সময়ের মত সুরিতার টিকিট কাটা (আসলে হাওড়া দিয়ে যখনই গড়িয়া সুচর্চা লোকাল ট্রেনে যায় টিকিট কাটে সুরিতা আর সাথী মৌমিতা)। সুশান্ত (ও আসছিল শ্যাম নগর থেকে) র সাথে দেখা হল সেই বড় ঘড়ির নিচে। ৮ টা ৮ এর মেদিনীপুর লোকাল। আনন্দ বাজারের রবিবাসরীয় তে তার আগেই চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েছি এক অসাধারণ শব্দ বন্ধ “ভাষা গজাচ্ছে” (এর পর হয় তো শুনব সন্তান গজাচ্ছে / বাপ – মা গজিয়েছে তাই গজাচ্ছে”)।

ট্রেন চলে – মুখ চলে – চলে ক্যামেরা! মনের ছবি আবছা হয়ে যায় তাই তাকে ধরে রাখা আগামীর তরে। উলুবেড়িয়া ষ্টেশন – লাল অটো দাঁড়িয়ে, সারথী মানিক ভাই (সত্যি ওর পুরো নাম টা মনে রাখতে পারিনি)। পথ চলে পথের নিয়মে – কখনও নাচায় – কখনও দৌড়ে চলে দুরন্ত আবেগে। সঙ্গে চলে প্রদীপ আর রণজিতের মজা – মাঝে মাঝে সুশান্তের টিপ্পনী। মূল রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথে ঢোকা – বাপ্পা ছিল আমার পিছনে দাঁড়িয়ে, একমাত্র ওরই মুখে ঢুকল খড়।

দেখতে পেলাম সেই খেলার মাঠ, পাশে পাঠাগার – পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা। মাস্টারমশাই হাত জোড় করে আসেন – লজ্জিত আমরা ! পিছনে এক সুদর্শন মানুষ – মনে হয় কত চেনা, কত জানা ! HAND SHAKE নয় বুকে মেলে বুক – চিরকেলে কোলাকুলি। দুটি ছোট্ট ফুল – হাত জোড় করে আসে এগিয়ে, বুঝি পরবর্তী প্রজন্মের যাত্রা হয়েছে শুরু – থামবে না চলা – মশাল ধরার জন্য তৈরি হচ্ছে চারটি দৃপ্ত হাত। চোখ ভরে আসে জলে – আনন্দাশ্রু !

সেই উঠোন – সেই দাওয়া – সেই চিরচেনা, চির জানা মানুষ ! হ্যাঁ – মানুষ ! আমরা যাই হারিয়ে সেই মানব মাঝারে – তাদের অনুচ্চারিত সেই স্বর “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না” ! বৃষ্টির ফোঁটা বলেছিল “আমি বড় একা – কোথায় থাকব আমি ?” প্রকৃতি বলেছিল “চিন্তা নেই তুমি চলে এস সমুদ্র মাঝে, তুমি নিজেই সমুদ্র হয়ে যাবে” ! একের পর এক – গান, কবিতা পড়া, নাচ, পুরস্কার বিতরণ – কিন্ত তার মাঝে সবচেয়ে সেরা যে সুর বয়ে চলে তা হল প্রেম – ভাষার প্রতি, নিজস্ব জাতি সত্ত্বার প্রতি ভালোবাসা আর তাই সেই জাতি স্বত্বা মর্যাদা দেয় – দিতে জানে অন্য ভাষাকে।

আসে সময় – আমরা পরিবেশন করি আমাদের নতুন প্রযোজনা “শিকড়ের সন্ধানে” – প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান হয় শেষ।

এবার আড্ডা – আলোচনা চলে সমৃদ্ধ হয় মনন – চিন্তন ! তারপর খাওয়া – মন তো গেছে ভরে কিন্ত শরীরের – অন্য দাবী ! জমিয়ে খাওয়া – মুখ চলে দুভাবে, ১) খাবার চিবানোয় আর ২) মজার কথায়। এর বর্ণনা দেব আমার সাধ্য কি তার – যা বলব তা হবে অন্ধের হস্তি দর্শন (যারা ছিল না তাদের কাছে) !

২য় পর্বের অনুষ্ঠান হয় শুরু – কবিতা পাঠ। অনেক আসরে গেছি, দেখেছি কবিরা নিজের কথা শুনতে বড় আগ্রহী (মানে নিজের কবিতা পড়তে) – বেশ কিছু কাব্য পাঠ আসরে (এমনকি জীবনানন্দ সভাগৃহে পর্যন্ত) দেখেছি কিছু নির্লজ্জ মুখ যাদের মননে উচ্চারিত হয়ঃ
নিজের কথা হল শেষ / নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় / বলে বেশ বেশ বেশ / এখন আরও আছে মোর আরও ডাক / অথবা দু – হাঁটুর মাঝে জেনো আছে বড় ফাঁক / কিংবা মোর ঘর বড় দূর বড় দূর / ডাকিয়াছ মোরে / আসিয়া করেছি ধন্য / শুনাইয়া মোর বায়স সুর / তাই আমি যাই চলে / নিজের কবিতা নামক শব্দ গুলিকে দলে / বলে যাই বাই বাই / আবার আসিব আমি / উচ্চারিব কোকিল কুজনে ওরে – ওরে / ডাক মোরে ডাক / হ্যালো হাই – সুইটি পাই / আপনি আমার বড় ভাই”

না এখানে সেরকম কেউ ছিলেন না – এখানে ছিল মানুষ। মানুষ তো অন্যের কথা শোনে – নিজের কথা বলার আগে। যুগ থেকে যুগান্তরে – জীবন চলে বয়ে জীবনের হাত ধরে। শুরু হল – আহা ! মনে হল চলতে থাকুক – কত সহজ ভাবে মানুষের কথা বলা যায়, কবিতায় – ছন্দে মাতাল মন ! এক জন বড় সুন্দর হাসি – এক মুখ গোঁফ দাড়ির ফাঁকে ! শুরু করলেন এমন – “এক চড়েতেই ঠাণ্ডা”। না চড়ে না ! রসিক জনের রসের হাঁড়ির উপচে পড়া রসের স্বাদেই ভোমরা গুলো বিভোর ! শুরু যদি হয় মির্জা গালিব কে দিয়ে তারপর – না শুধু মাথা দোলানো আর নির্মল হাসির উচ্ছ্বাসে ভরে যাওয়া। বললাম “ফোন নাম্বারটা দেবেন?” “আমি বাউন্ডুলে – আমার ফোন নাম্বার নিয়ে কি করবে তুমি ?” (প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ঢোকার আগেই সেই মানুষটির ফোন – “কবি কি বাড়ির পথে ?” আর তার নাম্বারটা কি নামে আমার ফোনে রেখে দিয়েছি জানেন “মন বাউল” ! ) উনি আমার মন ছুঁয়েছেন আর বলেছেন “আমি বাউন্ডুলে” তাকে “মন বাউল” ছাড়া কি নামে ডাকব বলুন তো সাথীরা ? কত সুন্দর এই আড্ডা – একজন কবিতা পড়তে উঠে বললেন “আমি দীর্ঘদিন কিছু পড়ি না তাই পরিবারের বড় মানুষটি আমার উপর বড় রাগ করেছেন – তাই পড়ছি” একটু দূর থেকে তাঁর জীবন সাথীর টিকা “এত আস্তে পড়লে শোনা যায় না কিছুই” অতএব ! আর এক মাষ্টার মশাই (মাত্র ৯১ বছরের ছয় ছোট্ট যুবক) উঠে দাঁড়ালেন – তখন তার চোখে দেখলেম নতুন প্রদোষ ! ছাত্র বলে মাষ্টার মশাই “বোধন” হবে নাকি ! মাষ্টার বলেন হয়ে যাক ! আমি বলি আমার গিন্নীকে “যদি হয় তাহলে শুধু মনের ক্যামেরায় নয় ধরে রাখব মোবাইল ক্যামেরায়!” গিন্নী একটু অবিশ্বাসী বলে “উনি কি পারবেন?” আমি মুখে কিছু না বলে মোবাইল রেডি করি (জানি আসলে - দেখতে উনি বুড়ো / মাথায় পাকা চুলের বোঝা / তবু নন তো বুড়ো উনি / মন যে ওনার তাজা) – “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে” । কি বলব – মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আর শুনছিলাম ভাই – বোনের সাথে মাষ্টার মশাইয়ের পরিবেশনা। ভাই যেখানে গান ছাড়ছে বোন সেখানেই কবিতা ধরছে এবং ঘটছে উলটো কাজও আর মাষ্টার মশাই এর শরীরী বিভঙ্গ সাথী হচ্ছে তার ! মিথ্যা কথা বলব না ঈর্ষা হচ্ছিল – কোন অনুশীলন ছাড়া এই – আমি তো পারি না ! মনে হচ্ছিল “কতটা চর্চা করলে তবে এমন হওয়া যায় – কতটা হৃদয় থাকলে তবে সজীব থাকা যায় – কতটা সুর থাকলে পরে মনকে ছোঁয়া যায় – প্রশ্ন বড় সহজ কিন্ত উত্তর নেই জানা” ! তারপর এলেন আসল মানুষটি – এই অনুষ্ঠানের ধ্রুবতারা – ওনার, ওনাদের নাকি অনেক ত্রুটি – বিচ্যুতি আছে ! মনে মনে বলি, তাই যদি থাকে তবে তাই থাক মানুষগুলো তো মানুষ থাক।

সব ভালো এক সময় তো থামে – আকাশে তখন অন্ধকার আসে ছেয়ে – সময় গেছে বয়ে – দিন গেছে কেটে ! এবার বাঁধন ছেঁড়ার পালা । বারে বারে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে – বিদায় নিতে হবে ! কি বলব – “আবার আসিব ফিরে” অথবা “কভি অলবিদা না ক হ না” অথবা “অ্‌ রিভোয়া” জানি না – শুধু জানি মনের মণিকোঠায় থেকে গেল এই সুন্দর দিনটা ! নিজেদের প্রযোজনা শেষের পরে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে পারিনি কারণ আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি – এত ভালোবাসায় আমরা

এখনও আমার চোখ ভিজে উঠেছে জলে – একটি বাঙালী পরিবার থেকে সাময়িক বিচ্ছেদের দুঃখে। আসার সময় আমার অন্য ভাই বোনদের বলেছিলাম “আজকের দিনটা তোমাদের জীবনের এক স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে” ওরা প্রথমে অত গুরুত্ব দেয় নি (শ্রীতোষ দা হয়তো আমাদের মানসিক ভাবে উজ্জীবিত করার জন্য এই সব বলছে) ফেরার সময় ও ফেরার পরে সকলের মুখে এক কথা – “এমনটিও হয়” আর আমি, মৌমিতা আর সুরিতা কি বলছি – বলছি “এমনটাই হয় এবং এমনটাই হওয়া উচিত – এমন সমাজ তৈরি করার জন্যই তো আমাদের লড়াই”।

এবার শেষ করি কি ভাবে - শেষ তো করতে হবে তাই না

না এই লেখার কোন শেষ হবে না
এই লেখার শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের ২৫ শে জানুয়ারী
আর তার পর
যতদিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি আসবে
ততদিন আমরা আসব
আর এ লেখা নতুন শব্দে – নতুন কথায় উঠবে ভরে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.