নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনের কথা - প্রাণের কথা

শ্রীতোষ বন্দ্যোপাদ্যায়

শ্রীতোষ বন্দ্যোপাদ্যায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুনামি - এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।

২১ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:২৬

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০০৪। প্রতিদিনের মত শুরু হচ্ছে আর এক নতুন দিন। তার আগের দিন রাত আড়াইটে পর্যন্ত ছিলাম সমুদ্রের পারে। গীতেশ, মিঠু, সুরিতা আর আমি – আড্ডা মেরেছিলাম খাওয়া দাওয়ার পরে। পোর্ট ব্লেয়ারের ভূতের গল্প – তারা কোথায় থাকে – কি করে – কখন দেখা যায় শুনছিলাম আমাদের সারথির কাছ থেকে। তার পর ফ্ল্যাটে ফিরে ঘুমানো – তার আগে একটা ছোট্ট কাজ কলের নীচে একটা খালি বালতি রেখে দেওয়া। পোর্ট ব্লেয়ার শহরে একদিন বাদে একদিন ১৫ মিনিটের জন্য জল আসে। ১৫ মিনিটের জন্য। তার মধ্যেই দৈনন্দিন প্রয়োজনের সব জল ভরে নিতে হত। ফলে রাতে ঘুমানোর আগে ওই কাজটি করে ঘুমাতে যেতাম।

আমাদের শোয়ার ঘরে দুটো খাট একসঙ্গে জোড়া দেওয়া। তখন ৬ টা ১৫ মিনিট। ঘুম ভেঙ্গে গেছে দুজনে গল্প করছি। হঠাৎ খট্‌ খট্‌ শব্দ। আমাদের অভ্যাস গোড়ালিতে ব্যথা হলে অনেক সময় খাটে জোরে জোরে পা দিয়ে মারি। আমি তাই সুরিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি পায়ে ব্যথা ? ও বলল – না। আর কোন কথা নয়। এক লাফে খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের ঘরে। তখন বইয়ের র্যা ক থেকে বই পত্র মাটিতে পড়তে শুরু করেছে। ছিটকিনি লাগানো ছিল না – একটানে হ্যাচবোল্ট খুলে সুরিতা কে ধাক্কা দিয়ে সামনের খোলা জায়গায় ঠেলে দিয়ে আমি ও একলাফে সেখানে। তারপর যা হল সে কথা বলতে গেলে আজও কেঁপে উঠি। দেখছি আমাদের দোতলা ফ্ল্যাট বাড়িটা ঝড়ে যেমন বাঁশ গাছ দোলে সেই ভাবে দুলছে। সুরিতা আমাকে ধরে আছে – আমরা দুজনে কোন রকমে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছি। ফ্রাকশান অফ এ সেকেন্ড মাথার মধ্যে চিন্তা খেলে গেল – যদি পায়ের তলার মাটি ফাঁক হয়ে যায়। তবে ঠিক করেছিলাম প্রথম থেকেই চোখ বন্ধ করব না এক মুহূর্তের জন্যও। প্রকৃতির এই অনুপম ধ্বংসলীলা উপভোগ করব দু চোখ ভরে। চারি পাশে চীৎকার। শাঁখের আওয়াজ। একটি বাড়ি তৈরি হচ্ছে পাশেই তার বার হয়ে থাকা রডগুলো একে অন্যের সাথে তুমুল ভাবে মারপিটে ব্যস্ত। কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম – ধরুন একটা বাস প্রায় ৫০ কি মি স্পীডে রাস্তার উপর যে ছোট ছোট হাম্প থাকে সেরকম অন্তত ১০০ হাম্পের উপর দিয়ে চলছে এবং আপনি সেই বাসের মধ্যে কোন রকম হ্যান্ডেল না ধরে দাঁড়িয়ে আছেন অনুভূতিটা অনেকটা সেই রকম। গীতেশ – মিঠু কে দেখলাম একটু বাদেই – দেখলাম অভিজিৎ দার পুরো পরিবারকেই। কিন্ত আমাদের গ্রুপ ডি অফিসার পিচাই জী ও তার পরিবার নামতে পারেন নি দোতলা থেকে। কতক্ষণ চলেছিল এই কম্পন জানি না । মনে হয়েছিল অনন্ত কাল। প্রকৃতির নিয়মে একসময় থামল সেই কম্পন।

একটু সামলে প্রথমেই ফোন করার চেষ্টা করলাম কলকাতায়। এক দু বারের চেষ্টায় সুরিতাদের বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে শুধু এইটুকু জানাতে পেরেছিলাম যে আমরা সবাই অফিসের সব স্টাফ ভালো আছি – নিরাপদে আছি। এবার ঘরের দিকে তাকানো। দেখলাম টি ভি ঝুলন্ত, অল্পের জন্য মাটিতে পড়ে নি। মেঝে থেকে দেওয়াল আলাদা হয়ে গেছে, বাথরুমের দরজা গেছে ভেঙ্গে। রান্না ঘরের কবজা খুলে গেছে আর দেওয়াল জুড়ে অজস্র ফাটল। বেরিয়ে দেখলাম দোতলার সিঁড়ির পাশে দাঁড় করানো আমার এম – ৮০ মাটিতে উল্টে পড়ে।

একটু পরে দেখতে পেলাম রামকৃষ্ণ মিশনের এক মহারাজ বেশ কিছু ছেলেকে নিয়ে চড়াই ভেঙ্গে উপরে আমাদের দিকে আসছেন। এর কিছুক্ষণ পরে পরিচয় হল “সুনামি” শব্দটির সাথে। ২৬ শে ডিসেম্বর থেকে ২৯ শে ডিসেম্বর এই দিন গুলিতে ওই খোলা জায়গাই ছিল আমাদের আস্তানা। যৌথ রান্না ঘর পদ্ধতিতে রান্না – খাওয়া। খিচুড়ি আর পাঁপড়। ঘরে যতক্ষণ থাকা – প্রতিটা ঘরের মেঝেতে আধ ভরা জলের বোতল রেখে দেওয়া। টয়লেট – ল্যাট্রিন করার সময় দরজা ভেজান, কোন অবস্থাতেই বন্ধ করা নয়। রাতে আলো নেই কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র জলের তলায়। এক রাতের কথা মনে আছে, অফিসের চেয়ার গুলো বাইরে এনে ওর সাথে মশারির দড়ি বেঁধে মশারি টানানো। শোয়ার তোড়জোড় হচ্ছে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে মাটি উঠল কেঁপে। দেখি মিঠু মশারির বাইরে বেরিয়ে আসছে। হেসে বললাম – “ঘর ছেড়ে মাঠে এসেছ – এবার কোথায় যাবে ? একদিকে জঙ্গল – অন্যদিকে সমুদ্র”।

শেষে একটা কথা বলি, সুনামি তে সারা পৃথিবী তে মারা গেছিল ৩ থেকে ৪ লাখ মানুষ। যদি ওই MAGNITUDE এর ভূমিকম্প কোন দিন কলকাতায় হয় শুধু কলকাতা / দিল্লী / মুম্বাই / চেন্নাই তে প্রথম ধাক্কাতেই মরবে অন্তত ৪ থেকে ৫ লাখ। বাকি ২ থেকে ৩ লাখ মরবে হাসপাতালে (যে গুলো আস্ত থাকবে) গুরুতর আঘাত ও সংক্রমণে। আরও লাখ দেড় – দুই মরবে পেটের রোগ ইত্যাদিতে। ফলে এখন থেকেই সাবধান হওয়া ভালো।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.