নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীর

ভালবসি এই দেশ কে, ভালবাসি আমাকে......

নীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

অগ্নিগর্ভ দেশ।। গুলিতে নিহত ৫৬ : পুলিশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, একদিনে গুলি করে মানুষ খুনের রেকর্ড, বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের প্রতিরোধ, নিহতদের মধ্যে পুলিশ চারজন, চাঁপাইয়ে প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি-গাড়িতে আগুন, সাতকানিয়া লোহাগাড়ায় থানা অবরোধ।।

০১ লা মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:৩৬

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে সারাদেশ। বিক্ষুব্ধ সাঈদী ভক্তদের ওপর ইতিহাসের বর্বর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৫ পুলিশ ও কমপক্ষে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। রাত ৯টায় ঢাকার মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলছিল। সারাদেশে আহত হয়েছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। গুলিবিদ্ধ হয়েছে শত শত মানুষ। থানা অবরোধ, পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও, রেললাইন উপড়ে ফেলা, যানবাহন ভাংচুরসহ পুরো দেশ হয়ে পড়েছে রণক্ষেত্র। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সারাদেশে পুলিশ, র্যাব,

বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, এপিবিএন ও রিজার্ভ পুলিশের

সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।

আমার দেশ প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী পুলিশের গুলিতে ঢাকার মিরপুরে ১ ও উত্তরায় ১, সাতক্ষীরায় ১০, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭, রংপুরে ৭, গাইবান্ধায় তিন পুলিশ ও ২ জামায়াত কর্মী, নোয়াখালীতে ৪, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২, কক্সবাজারে ২, দিনাজপুরে ২, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এক কনস্টেলবসহ ২, সাতকানিয়ায় ২, নাটোরে ১, সিরাজগঞ্জে ২, মৌলভীবাজারে ২ ও বগুড়ায় ১ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির মতো গুলিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এক নজিরবিহীন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। গাইবান্ধায় বিক্ষুব্ধ জনতার পিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছে তিন পুলিশ সদস্য। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় পিকেটারদের ইটের আঘাতে মারা গেছে একজন পুলিশ কনস্টেবল।

পুলিশের সঙ্গে জামায়াত কর্মীদের ওপর যৌথভাবে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। তারা ব্যাংক, হাসপাতাল, বীমা, জামায়াতে ইসলামী সমর্থক ব্যক্তিদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুর এবং লুটপাট করেছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মী ও মাওলানা সাঈদীভক্তরাও দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি, থানা ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের বাড়িতে হামলা ও ভাংচুর চালিয়েছে, একই জেলায় পর্যটন করপোরেশনের সোনামসজিদ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী বিক্ষুব্ধ জনতার ভয়ে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।

এদিকে গত রাতে জামায়াতে ইসলামী দাবি করেছে, সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে কমপক্ষে ৬৬ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। তাদের দেয়া হিসাবে পুলিশের গুলিতে সাতক্ষীরায় ১০, রংপুরে ৭, পঞ্চগড়ে ৭, চট্টগ্রামে ৩, কক্সবাজারে ৪, সিরাজগঞ্জে ৩, নারায়ণগঞ্জে ৩, দিনাজপুরে ৩, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪, নোয়াখালীতে ৩, মৌলভীবাজারে ৩, গাইবান্ধায় ৩, ঢাকার মিরপুরে ১, উত্তরায় ১, কুমিল্লা, নাটোর, যশোর, লক্ষ্মীপুরে ১ জন করে মোট ৬৫ জন নিহত হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী আরও বলেছে, সারাদেশে পুলিশের গুলিতে ৫ হাজারের মতো সাধারণ মানুষ আহত হয়েছে। তার মধ্যে গুলিবিদ্ধ অন্তত ৫০০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সরকার সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর ও ১০ নম্বরসহ পুরো মিরপুর এলাকা পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মিরপুরে অসমর্থিত খবরের সূত্র থেকে ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ মিরপুর এক নম্বরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর স্বীকার করেছে। এছাড়া ঢাকার উত্তরায় জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে রাতে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে তাদের নাম জানা যায়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানেও সংঘর্ষ চলছিল।

ঠাকুরগাঁওয়ে নিহত ৭ : ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরগাঁওয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালালে ৭ জন নিহত হয়েছেন। এতে গুলিবিদ্ধ মহিলাসহ গুলিবিদ্ধ হয় অন্তত ২০ জন। এছাড়াও আরও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই এলাকায় কয়েক হাজার সাঈদীভক্ত জড়ো হতে থাকেন। রায় ঘোষণার পর পরই ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা গড়েয়ায় বিক্ষুব্ধ জনতা ব্যাপক বিক্ষোভ, ভাংচুর ও রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঘটনাস্থলে বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ ও বিজিবি ব্রাশফায়ার শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই নিরঞ্জন (২০) রুবেল (১৮) দায়মুল (২১) সুমন (২০) ফিরোজ (১৯) নামে ৪ জন নিহত হয়। মনির (১৮) নামের অপর একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নিলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। সংঘর্ষে এ সময় মহিলাসহ আরও প্রায় ২৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়, আহত হয় আরও অর্ধশতাধিক। আহতদের অনেককেই ঠাকুরগাঁওসহ রংপুর ও দিনাজপুর মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে দুলাল ইসলামের (২০) অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের সার্জারি চিকিত্সক সুপেন্দ্রনাথ রায়।

প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে এলাকার বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা নিহতদের লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে গ্রামবাসী। পুলিশের গুলিতে মহিলাসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীও গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে। হঠাত্ এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ায় এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতদের বাড়ি বাড়ি নেমে আসে কান্নার রোল।

নোয়াখালীতে নিহত ৪ : নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী দত্তেরহাট, বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারসহ বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় ৩ শতাধিক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। গুলিতে পথচারী পিকআপ চালক খোকন (২৪) মারা যায়। ৩০ থেকে প্রায় ৩৫ জন গুলি বিদ্ধসহ শতাধিক লোক আহতের খবর পাওয়া গেছে। এ সময় জেলা শহর মাইজদী থেকে উত্তর সোনাপুর পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জেলা ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক সাবের আহমেদ দাবি করেন সংঘর্ষ চলাকালে দত্তেরহাট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কয়েকটি বাড়িতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা হামলা-ভাংচুর ও গুলি বর্ষণ করে। এতে নোয়াখালী পৌর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিক্ষুব্ধরা কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে।

এদিকে জেলার বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জবাজারে বিকালে স্থানীয় জনতা ও জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ মিছিল করে। পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর দুই শতাধিক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী লিটন (২৬) ও দুই শিবির কর্মীসহ ৩ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধরা রাজগঞ্জবাজার সংলগ্ন একটি বসতবাড়ির ২টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। সংঘর্ষ চলাকালে ৩০ থেকে ৪০ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক লোক আহতের খবর পাওয়া গেছে। একই সময় তথ্য সংগ্রহকালে সাংবাদিক মোহতাসিম বিল্লাহ বিক্ষোভকারীদের হামলায় গুরুতর আহত হন।

অপরদিকে সুবর্ণচর উপজেলার আটকোপালিয়াবাজারে সন্ধ্যায় জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ করলে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা মিছিলের পেছন থেকে হামলা চালায়। এতে ১০ নেতাকর্মী আহত হয়।

বৃহস্পতিবার দুপুরের পর জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশ আওয়ামী লীগ কর্মী ও শিবিরকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে পুরো জেলায় সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এদিন হরতাল চলাকালে হাট-বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতে উপস্থিতি ছিল কম। বিশেষ কাজ ছাড়া অধিকাংশ লোকজন আতঙ্কে ঘর থেকে বের হননি। অনেকের চোখে-মুখে ছিল আতঙ্ক ও ভয়-ভীতির চাপ।

এদিকে এ ঘটনায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও নোয়াখালী জেলা সভাপতি মো. শাহজাহান ও জেলা সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী পৌর মেয়র হারুনুর রশিদ আজাদ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, জামায়াত-শিবিরের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে পথচারী খোকন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং ৩০ থেকে ৪০ জন পথচারী ও সাধারণ জনগণ গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় পুলিশের ছত্রছায়ায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দত্তের হাটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও বিএনপি এবং জামায়াত সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট করে। এতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং পুরো বাজার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেখানে উত্তেজনা প্রশমিত করবে সেখানে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উসকানিতে পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তোলে। পুলিশ বাহিনীর ছত্রছায়ায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এ তাণ্ডব চালায়। এতে সাধারণ জনগণের মাঝে ধারণা জাগবে দেশে প্রশাসন বলতে কিছুই নাই। পুলিশ প্রশাসনকে ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকতে তারা অনুরোধ জানান এবং সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন ও হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

সাতক্ষীরায় নিহত ১০ সাতক্ষীরায় সাঈদী মুক্তি পরিষদ ও জামায়াত-শিবির কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবির সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন জামায়াত-শিবির কর্মী নিহত হয়েছে। এরা হলো—সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা গাজীপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম, সদর উপজেলার বহেরাডাঙ্গা গ্রামের শাহীন মিয়া, খানপুর গ্রামের সাইফুল্লাহ, বেলেডাঙ্গা গ্রামের আবুল হাসান, দেবহাটা উপজেলার শশাডাঙ্গার আলী মোস্তফা, হরিশপুর গ্রামের তুহিন মিয়া, ঘোনা গ্রামের আনোয়ারুল। এছাড়া মোশাররফ, এমদাদ ও ইকবাল নামে তিনজনের নাম জানা গেছে। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।

বিকাল ৪টায় সদর উপজেলার সাঈদী মুক্তি পরিষদ, জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা শহরের কদমতলা বাজার থেকে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে শহর অভিমুখে আসার চেষ্টা করলে সার্কিট হাউস মোড়ে পুলিশ ও বিজিবি বাধা দেয়। এসময় মিছিলকারীরা বাধা উপেক্ষা করে সামনে এগোতে চাইলে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় ছাত্রলীগ-পুলিশ-বিজিবির নির্বিচার গুলিতে কমপক্ষে ৫০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাত সাড়ে ৯টায় এরিপোর্ট লেখার সময় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতে ইসলামীর দাবি, তারা শহরের বাইরে সমাবেশ করে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিলসহকারে শহরে আসতে চাইলে পুলিশ ও বিবিজি বাধা দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ ও বিজিবি নির্বিচারে নিরস্ত্র জনতার ওপর ব্রাশফায়ার করে। এতে বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় সাতক্ষীরা জেলা ছিল এক মৃত্যুপুরী। সর্বত্র ক্ষোভ, আতঙ্ক আর উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বিরাজ করছে। মানুষ বাসাবাড়ি থেকে বের হচ্ছিল না। শহরজুড়ে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ টহল দিচ্ছে। ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ‘ধর ধর শিবির ধর—ধইরা ধইরা জবাই কর’ ইত্যাদি স্লোগানসহ মিছিল করছিল। পুরো জেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে

রংপুরে নিহত ৭ : রংপুরের মিঠাপুকুরে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবির কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে জামায়াত-শিবিরের ৭ কর্মী ও মাওলানা সাঈদীর ভক্ত নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হয়েছেন প্রায় ৬০০ জামায়াত-শিবির কর্মী। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে অন্তত ৫০ জন। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ পুলিশ সদস্য।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষ মিঠাপুকুরের জায়গীর থেকে লতিফপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ওই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়েছে প্রায় অর্ধশত। আহত হয়েছে ২ শতাধিক। আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। মিঠাপুকুর ও আশপাশ এলাকায় পুলিশ গণগ্রেফতার শুরু করেছে। এলাকাবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, যে কোনো মুহূর্তে আবারও বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে। তাই পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জায়গীর ও লতিফপুরে পুলিশ ও তৌহিদি জনতার সংষর্ষে প্রায় হাজার রাউন্ড গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়েছে। তবে পুলিশের দাবি, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির ওপর হামলা করায় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি করেছে। এর প্রতিবাদে ইসলামী ছাত্রশিবির রংপুর মহানগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ২২ জনকে আটক করেছে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষর্শীরা জানান, হরতালের সমর্থনে সকাল থেকেই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রায় বিশ হাজার সাঈদীভক্ত মিঠাপুকুরের জামায়াত কার্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেয়। তারা হরতালের সমর্থনে মিছিল করতে চাইলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। পরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা তাদের ঘিরে রাখে। অন্যদিকে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর জনতা মিছিল করতে চাইলে আবারও পুলিশ-র্যাব-বিজিবি তাদের বাধা দেয়। এসময় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে জামায়াত-শিবির ও সাঈদী ভক্তরা মিছিল করতে থাকলে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে টিয়ার শেল ও পরে মুহুর্মুহু ও এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। গুলির শব্দে এলাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে জনতা লাঠিসোটা, দা, বটি, ইটপাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে ঘটনাস্থলেই জামায়াত-শিবির কর্মী বালারহাট হুলাশু এলাকার মাহমুদুল হাসান (২৮), মির্জাপুরের মশিউর রহমান (২৫), লতিফপুরের সাদেকুল ইসলাম (২৫), মাঠের হাটের আশিকুর রহমান এবং কাশিপুরের সাহেদ আলী (৪৩) নিহত হন। জায়গীরহাট এলাকায় নিহত হন রবিউল নামে একজন শিবির কর্মী। এছাড়াও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছে একজন। তার নাম পাওয়া যায়নি।

পুলিশ জানিয়েছে, জনতার রোষানলে পড়ে ৮ পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। এরা হলেন—এএসআই জুয়েল, কনস্টেবল আবদুল আজিজ, লক্ষ্মণ, রফিকুল ইসলাম, হিরু মিয়া, শফিকুল ইসলাম ও কল্লোল। মিঠাপুকুরে আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ রসুলপুরের ফুয়াদ (২৮), রাহুল (২৬), নুরুল হুদাসহ ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

অন্যদিকে বেলা সোয়া ৩টার দিকে রংপুরের পীরগাছায় বিএনপি, জামায়াত-শিবির এবং সাঈদী ভক্তরা মিছিল বের করতে চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশ টিয়ার শেল ও গুলি নিক্ষেপ করে। এতে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রাঙ্গাসহ গুলিবিদ্ধ হন ৬ জন। এ ঘটনায় ওই থানার ওসি বজলুর রশিদ, এসআই মিজান, কনস্টেবল সিরাজ ও মোজহারুল আহত হন। মোজহারুলকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রংপুর পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমরা ৩ জনের মৃত্যুর খবর শুনেছি। তার মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে দু’জন গুলিবিদ্ধ। এদের মধ্যে একজন মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আছে। তিনি বলেন, সংঘর্ষে পুলিশের ৬ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছে।

রংপুর মহানগর ছাত্রশিবির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ৫ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে। মহানগর সভাপতি মোস্তাক আহমদ বলেন, মিঠাপুকুরসহ সারা দেশে জনগণের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ যেভাবে গুলি চালিয়েছে তা আমাদের সেই রক্ষীবাহিনীর বর্বরতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এভাবে গুলি, মামলা করে জনগণের আন্দোলন দমানোর শক্তি আওয়ামী সরকারের নেই। বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের সর্বস্তরের নেতাদের তিনি মুক্তি দাবি করেন।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পুলিশসহ নিহত ৫ : সাঈদীর ফাঁসির রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে তিন পুলিশ ও ২ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। জামায়াত-শিবির ও সমমনারা অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করেছে। সুন্দরগঞ্জ থানার সামনে পুলিশের গুলিতে অজ্ঞাত ২ ব্যক্তি নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছে। নিহত তিন পুলিশ সদস্য জনতার লাঠিপেটায় নিহত হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

বিক্ষুব্ধ জনতা বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি, রেল স্টেশন, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল অফিসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলে জনতার লাঠিপেটায় ৩ পুলিশ নিহত এবং অপর ২ পুলিশ কনস্টেবল আহত হয়েছে। নিহত ৩ পুলিশ কনস্টেবলের নাম বাবলু, নাদিম ও হযরত আলী। আগুন নেভাতে দমকল বাহিনী কাজ করছে। সুন্দরগঞ্জের বেলকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুলের চাতালে, সুন্দরগঞ্জ- বামনডাঙ্গা সড়কের কদমতলী এলাকায় এবং বিশ্ব রোডের নান্টুর ইটের ভাটার সামনে সড়ক অবরোধ করে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই সড়ক দুটিতে শতাধিক গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। মাস্টারের মোড় ও জহুরুল সর্দারের মোড় নামক স্থানে আ’লীগ সমর্থিতদের দোকানপাটে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, অসংখ্য রিকশা-ভ্যান, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল ভাংচুর ও পথচারীদের মারধর করে। কোনো যানবাহন ও বহিরাগত লোকজনকে এলাকায় ভিড়তে দেয়া হচ্ছে না।

সিরাজগঞ্জে নিহত ২ : জেলা সদরের চণ্ডিগাতিতে পুলিশ ও জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষে ২ শিবির কর্মী নিহত ও কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাস্তায় কাঠের গুঁড়ি ফেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা সড়ক অবরোধ করে হরতাল পালন করে। এসময় পুলিশ তাদের ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ বাধে। হঠাত্ করেই পুলিশ জনতার সমাবেশে চাইনিজ রাইফেল থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এতে ২৫ শিবির নেতাকর্মী আহত ও ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। হাসাপাতালে নেয়ার পথে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রাজাখাঁর চরের আলমগীর হোসেনের ছেলে মুক্তার হোসেন (১৮) ও চণ্ডিদাসগাতির আবদুল জলিলের ছেলে রুহুল আমিন (২০) নিহত হন। হরতাল সমর্থকদের ইটপাটকেলে র্যাবের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে পুরো এলাকা ছিল রণক্ষেত্র। আহতদের সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েও পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি হননি। সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের সিনিয়র সার্জন ডা. গোলাম রব্বানী তালুকদার দু’জন নিহত হওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছেন। পুরো সিরাজগঞ্জে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। জেলাজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও রিজার্ভ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ ৪ শিবির কর্মীকে আটক করেছে।

অপরদিকে, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বেলকুচি পৌরসভার সামনে শিবির হরতালের সমর্থনে পিকেটিং করতে থাকলে পুলিশ পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করতে ১০-১২ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল ছোড়ে। এতে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে অন্তত ১০ শিবির কর্মী আহত হয়।

নাটোরে নিহত ১ : সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নাটোরের রায়পুরে জামায়াতের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে একজন নিহত, সাত পুলিশ আহত ও দুই জামায়াত কর্মী গুলিবিদ্ধসহ মোট ১২ জন আহত হয়েছে। ঘটনার পরপরই খায়রুল বাশার (৩৭) নামে একজন নিহত হয়েছে। এসময় হরতালকারীরা পুলিশের ব্যবহৃত একটি সিএনজি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার সময় খোয়া যাওয়া পুলিশের দুটি অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় বিকালে পুলিশ উদ্ধার করে। বিকালে এলাকায় এক ব্যাটালিয়ান বিডিআর মোতায়েন করা হয়েছে।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, লালপুর উপজেলার কদিমচিলানের গোধরা গ্রামে আগে থেকে পিকেটিংয়ে থাকা হরতাল সমর্থকরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। এসময় সংঘর্ষে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কর্মীরাও যোগ দেয়। হরতালকারীরা এসময় পুলিশের ব্যবহৃত একটি হিউম্যান হলারে (সিএনজি) আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির ঘটনা ঘটে। মারধরে এসআই আবদুর রব, সাইফুল ইসলাম, হাবিলদার আবদুল মান্নান, সিপাহি আনিসুর রহমান, সাইদুল ইসলামসহ সাত পুলিশ আহত, জামায়াত কর্মী সাইফুল ও সানোয়ার গুলিবিদ্ধ এবং নিহত খায়রুলের চাচা মজনুসহ ১২ জন আহত হয়। নিহত খায়রুল ইসলাম (৩৭) কদিমচিলান গ্রামের দেলু ডাক্তারের ছেলে। নিহত খায়রুলকে জেলা যুবলীগের সভাপতি মোঃ শরিফুল ইসলাম রমজান নিজেদের দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা দাবি করলেও লালপুর থানা ছাত্রশিবির দক্ষিণের সভাপতি শামিম আহমেদ বলেছেন, নিহত খায়রুল হরতাল সমর্থক। এর আগে একই স্থানে সকালে হরতাল সমর্থক মহিলারা নাটোর-পাবনা মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে ঝাড়ু মিছিল করে। ভোর পৌনে ৬টার সময় হরতাল সমর্থকরা লালপুর উপজেলার পুরনো ঈশ্বরদীর এয়ারপোর্ট মোড়ে পাবনা থেকে রাজশাহীগামী একটি ট্রাকে (পাবনা ট-২১৫৮) আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে লালপুর ও ঈশ্বরদী ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত ২ : সাঈদীর ফাঁসির আদেশ শুনেই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। ওই সময় সাধারণ মানুষ ও জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে পেকুয়া একজন ও ঈদগাঁও উপজেলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।

বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পেকুয়া বাজারে জড়ো হওয়া জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে পথচারী কিশোর মারা যায়। পুলিশের গুলিতে সাজ্জাদ (১৫) নামের ওই কিশোরের মাথার খুলি উড়ে যায়। সে পেকুয়া ইউনিয়নের পূর্ব মেহেরনামার জালাল আহমদের ছেলে। এছাড়া কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের ঈদগাঁও স্টেশন এলাকায় পুলিশের গুলিতে আবদুর রশিদ নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি ৫ মাস আগে সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন। সম্প্রতি তার বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। তিনি উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের সাতজোলাকাটা গ্রামের হাজী মো. ইলিয়াসের ছেলে।

বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে রায় ঘোষণার পরপরই জেলার প্রতিটি উপজেলা সদর ও আশপাশ এলাকার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে মিছিল করার চেষ্টা চালান। কিন্তু তারা পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। পুলিশের বাধার মুখে কক্সবাজার শহরে কোনো মিছিল না হলেও জেলার সদর উপজেলাধীন ঈদগাঁও বাজার ও স্টেশন, চকরিয়া ও পেকুয়া বাজার, পেকুয়ার রাজাখালী এবং উখিয়ার কোটবাজারে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে। চকরিয়া ও পেকুয়ায় পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও যোগ দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শতাধিক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেছে। পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

রায় ঘোষণার পরপরই কক্সবাজার শহর, ঈদগাঁও স্টেশন, চকরিয়ার চিরিঙ্গা স্টেশন, পেকুয়া বাজার, উখিয়ার কোর্টবাজার স্টেশনের সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাঘাট পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। রাস্তায় বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা টহল দিচ্ছে।

এরআগে ঈদগাঁও থেকে সাংবাদিক আনোয়ার হোসাইন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রায় ঘোষণার পরপরই জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালায়। ওই সময় অধিকাংশ পুলিশ সদস্য ঈদগাঁও স্টেশনে টহলে ছিল। এই ঘটনার পর পুলিশ সদস্যরা দ্রুত তদন্ত কেন্দ্রে ছুটে গেলে স্থানীয় শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ ঈদগাঁও স্টেশনে পুলিশকে বহনকারী একটি ‘ম্যাজিক গাড়ি’তে আগুন ধরিয়ে দেন। ওই সময় পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা এই সংঘর্ষে ২৫ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ কয়েকজন হলেন—মাদরাসা ছাত্র আবদুল আজিজ (২৬), আবদুল্লাহ (১৬), টমটম চালক বেলাল (২৬) ও বাবার জন্য দোকান থেকে ডাব নিতে আসা শাহজাহান (১১)। ওই সময় ঈদগাঁও স্টেশনে ৭-৮টি গাড়ি ও ৫-৬টি দোকান এবং ঈদগাঁও বাজারে ৮-১০টি দোকান ভাংচুর করা হয়।

পেকুয়ায় কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ ও জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী পেকুয়া বাজারে জড়ো হলে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে বাজারের সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ করে দেন। তবে সাধারণ মানুষ জড়ো হলেও কোনো ধরনের মিছিল ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি বিকাল ৪টা পর্যন্ত। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। ওই সময় পুলিশের গুলিতে পেকুয়া বাজারেই মারা যায় কিশোর সাজ্জাদ (১৫)। গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। এসময় আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

চকরিয়ায় জামায়াতে ইসলামী ও সাধারণ মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঝটিকা মিছিল বের করার চেষ্টা করেন। তারা চিরিঙ্গার বাস স্টেশনের কাছে কুচপাড়া এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। ওই সময় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়।

স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৩০ রাউন্ডেরও বেশি গুলিবর্ষণ করে। এতে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়। গুলিবর্ষণের পর মিছিলের চেষ্টাকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

এছাড়াও জামায়াত নেতাকর্মীরা চকরিয়া-মহেশখালী আন্তঃসড়কের বাটাখালী ব্রিজের পাটাতন খুলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

রায়ের পর উখিয়ার কোটবাজারে জামায়াত-শিবির ও সাধারণ মানুষ মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এখানে অন্তত ১৫ রাউন্ড গুলি করা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তবে এ ঘটনায় কেউ আহত হয়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিহত ২ : চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে ব্যাপক সহিংসতায় পর্যটন করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ দুজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের একজন জামায়াতের কর্মী; কিন্তু তার নাম জানা যায়নি। বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালিয়েছে বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে এবং বিআরটিসি বাসসহ ৫টি গাড়িতে আগুন দিয়েছে। বিস্ফোরিত হয়েছে ককটেল। ব্যাপক ভাঙচুরের পর জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, শিবগঞ্জে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে। সোনামসজিদে নির্মাণাধীন পর্যটন মোটেলের ছাদ থেকে আতঙ্কে লাফিয়ে পড়ে নিহত হয়েছেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম (৫৫)। কানসাটে পল্লী বিদ্যুত্ অফিসে হামলা হয়েছে। জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ৫টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। ভোলাহাটে পুলিশের গুলিতে ৬ জামায়াত-শিবিরকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জেলা সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।

রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই উত্তপ্ত ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ভোর থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ- সোনামসজিদ স্থলবন্দর মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। দুপুর পর্যন্ত তারা থেমে থেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। দুপুরে রায় ঘোষণার পরপরই হঠাত্ করেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জেলা শহরের অক্ট্রয় মোড় এলাকায় দুপুর আড়াইটার দিকে বিক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবিরকর্মীরা বিআরটিসি দোতলা গাড়িসহ ৬টি গাড়িতে আগুন দেয়। একটি পত্রিকাবাহী মাইক্রোবাসেও আগুন দেয়া হয়। এছাড়া একই সময় মহানন্দা সেতুর টোলঘর, বারোঘরিয়া, বিশ্বরোড মোড়, সিসিডিবি মোড়, দারিয়াপুর, হরিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে শতাধিক যানবাবহন ও দোকানপাটে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। মহানন্দা সেতু এলাকায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবনেও ভাঙচুর চালানো হয়। এসময় বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

এদিকে সকাল থেকে শিবগঞ্জ উপজেলা সদরও ছিল ব্যাপক উত্তপ্ত। সকাল ৮টার দিক থেকে কয়েক হাজার জামায়াত-শিবিরকর্মী বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। রায় ঘোষণার পর শিবগঞ্জের সেলিমাবাদ এলাকায় বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। কানসাটে দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে হরতাল সমর্থকদের ইটের আঘাতে মফিজ উদ্দিন নামে এক বিজিবি সদস্য আহত হন। তাকে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় বিকাল ৩টা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

ওদিকে ভোলাহাট উপজেলার ইমামনগর বাজারে সকালে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে ২ পুলিশসহ ৮ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে ৬ জন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জামায়াত-শিবিরের একটি মিছিল উপজেলা চত্বরের দিকে আসার সময় ইমামনগর বাজার এলাকায় হঠাত্ করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষে ভোলাহাট থানার দুই কনস্টেবল আহত হন। এছাড়া আবদুল কাদের, আসির, সাদিকুল, মোস্তফা, মুকুল ও সারওয়ার নামে জামায়াত-শিবিরের ৬ কর্মী গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলাজুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। চারদিকে ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। সন্ধ্যা ৬টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মী, পুলিশ ও জামায়াত-শিবিরকর্মীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল।

শহরের শিবতলা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষে একজন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। নিহতের নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি। আহতদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকালে সাড়ে ৪টার দিকে শহরের আরামবাগ এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ চলাকালে আরামবাগ, পিটিআই ও শিবতলা মোড়সহ আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে বাতেন খাঁ মোড়ে ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথ, আরামবাগে বঙ্গবন্ধু ক্লাব ও একটি ছাত্রাবাস ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলিবর্ষণ করে। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক যুবক মারা যায়। গুলিবিদ্ধ একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং আরেকজনকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমির নজরুল ইসলাম নিহত যুবককে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছেন।

লোহাগাড়ায় পুলিশসহ নিহত ২ : সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় গণবিস্ফোরণ ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ নির্বিচারে গুলি চালালে ঘটনাস্থলে মিজবাহ নামে এক জামায়াত কর্মী নিহত। বিক্ষুব্ধ জনতার ইটপাটকেলে মো. তারেক নামে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। সন্ধ্যা ৭টায় উপজেলার আমিরাবাদ রাজঘাটা এলাকায় মহাসড়কের ওপর তার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.