![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দূর মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠের ভোরের আযানের সুর প্রকৃতিতে প্রবাহমান বাতাসের সাথে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কি সুমধুর সে আযান--‘আসসালাতো খাইরুম মিনান নাউম...।’ প্রকৃতিতে কেমন জানি নিরবতা ভাঙ্গতে শুরু করল। দূর থেকে আযানের ধ্বনি ধীরে ধীরে এ গাঁয়ে এসে বাতাসের সাথে মিশে যায়। পদ্মার শাখা বেস্টিত পলি-বালিময় এ গ্রামটির নাম স্বর্ণগ্রাম। এ গাঁয়ে এককালে সোনা ফলত। সোনার ফসলে মুখরিত হত এ গাঁয়ের সহজ সরল জীবন যাত্রার। মাটির মত মায়াশীল মায়েরা মেয়ের ডাক নাম তাই হয়তো রাখতো স্বর্ণলতা, সবুজী, সোনাবিবি...। ফসলের নামে ডাক নাম রাখত ছেলেদের-- শৈশষা, ধইন্না, নীলা...। আজ আর সেই দিন নেই। আউশ ধানের চালের সাথে মিশে গেছে ইরি ধানের চাল। খাঁটি সরিষা আজ আর পাওয়া যায় না। এ এলাকার মানুষেরা আজ ছন্নছাড়া, ক্ষূধার্ত, তৃষ্ণার্ত। দু’বেলা জোটে না দু’মুঠো ভাত। দরিদ্র চাষী বৃষ্টির অভাবে দেহের ঘাম দিয়ে চৈত্রালী ফসল ফলায়। তবুও জীবনের বিড়ম্বনা।
আযানের সুমধুর কন্ঠের তান শেষ হতেই ছোট এক কুঁড়েঘর থেকে চান্দু মিয়া বের হল।আরেক কুঁড়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাকতে লাগল, ‘আদু--, আরে ঐ আদু--, দরজা খোল, আযান দিয়া হালাইছে...।’ চান্দু ঘরের কোণার মাটির কলস থেকে এক বালতি পানি নিয়ে বাইরে গেল। তারপর বালতি থেকে এক বদনা পানি ভরে নিয়ে জঙ্গলে ঘেরা বাঁশ আর পাটের চট দিয়ে বানানো পায়খানায় চলে গেল। প্রকৃতির কাজ শেষ করে পুকুরে গিয়ে ওযু করে ঘরে এল। উত্তর ঘরে চেয়ে দেখল আদু তখনও দরজা খুলে নাই। চান্দু আবার ডাকতে শুরু করল। না, কোন সারা শব্দ নাই। দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা বারবার ধাক্কা দিল। পটপট্ করে উঠল পাটখড়ির দরজা, কয়েকটা পাটখড়ি ভেঙ্গেই গেল। গতকাল আদু হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খেটেছে। তাই তার এত গভীর ঘুম। ‘আদু--, আরে ঐ আদু--, পাট বেঁচতে যাবি কোন সুম্?’ আদু এবার গোঙ্গানী দিয়ে উঠল, হাত-পা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে দরজা খুলল। ‘কিরে, তর ঘুম অইল, ওসমানগো টলার তো যাইবগানে, তারাতারি আগদে যা--।’ চান্দু নামাজটা শেষ করে বউয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘জহুরা, আরে এই জহুরা ওট--।’ তারপর নিজেই পান্তা ভাত থালে নিয়ে মরিচ, পিয়াজ খুঁজতে লাগল। কোথাও পিয়াজ-মরিচ না পেয়ে জহুরাকে আবার ডাকতে লাগল--‘ঐ জহুরা পিয়াজ-মরিচ কৈ রাকছছ? হুদা পান্তা ভাত খাওন যায়! এই জহুরা--।’
বাঁশ, কাঠ আর পাটের দড়ি দিয়ে বানানো ছোট পাটাতনে চান্দুর বড় মেয়ে স্বর্ণলতা আর ছোট মেয়ে ফতি, নীচে মাটির উপর হোগলা আর কচুরী দিয়ে বানানো মাদুর বিছিয়ে চান্দু আর জহুরা ঘুমায়। জহুরা হোগলা ও কচুরী অথবা রোদে শুকানো শুধু কচুরী ডগা দিয়ে মাদুর বানাতে পারে। কাঠের দাম বেশী বলে কাঠ দিয়ে পাটাতন গড়তে পারেনি। খাট কিনার সামর্থ নেই বলে মেয়ে দু’টোর জন্য বাঁশ, জীর্ণ কাঠ আর পাট দিয়ে নিজ হাতে পাটাতন বানিয়েছে। গত কয়েক মাসের গতরে খাটা জমানো টাকা দিয়ে নিজের পরিবারের জন্য দু’চালা ঘর তৈরী করেছে। আর উত্তরের ঘরটা--ছন, বাঁশ আর পাটখড়ির তৈরী, যেখানে আদু থাকে, সেটা একই অবস্থায় আছে। তবে স্বর্ণার বিয়ের আগে ঐ ঘরটার ছনের ছাউনি পরিবর্তন করে টিন দিয়ে চালা দেবার বিষয়ে জহুরার সাথে তার প্রায়ই কথা হয়।
জহুরা পোয়াতি দেহ নিয়ে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে পিয়াজ-মরিচ-লবণ দিয়ে ভর্তা তৈরী করেছে। আদু লুঙ্গি দিয়ে হাত-মুখ মুছে চান্দু মিয়ার সাথে খেতে বসল। জহুরা দু’জনার থালাতে সব ভর্তা ভাগ করে দিল।
--এ কি করলা, সব বত্তা--
--আরো পিয়াইজ-মরিছ আছে, তুমি খাও, অগো পরে বানাইয়া দিমু
খাওয়া শেষে আদু ঢেকুর দিল।
--চাচীগো গলা দিয়া বেক ভাত বাইর অইয়া আইতে চায়--
--যাও বাজান দুপুরে তোমার বরশীতে ধরা টাকী মাছ রান্দুমনে-
মজার খাবারের কথা শুনে আদু মুচকী হাসি দিল।
-- চাচী, গোটা দুই টাকী দিয়া বত্তা কইরেন।
--আইচ্চ--
চান্দু ঘরে গিয়ে বড় মেয়েকে ডাকতে লাগল--
-- স্বর্ণা, মাগো, ওট মা, পাটগুলান উত্তর ঘর থিকা উডানে আন, টলারে উডাইতে অইব। ওট মা--
স্বর্ণা এক পাইরা শাড়ীটা ঠিক করে দিয়ে বিছানা থেকে উঠল। ছিঁড়া-ফাঁড়া কাঁথাটা ঘুমন্ত ছোট বোন ফতির গায়ে ভালভাবে জড়ায়ে দিল। উত্তর ঘর থেকে তিনটা চটের টুকরা এনে উঠানে বিছিয়ে দিল। আর এই সুযোগে আদু আশে-পাশে তাকিয়ে ভিজা হাত স্বর্ণার শাড়ীর আঁচলে মুছে নিল।
--এই কর কি!
--কিরে তোর শাড়ীতে গন্ধ কেন ? রাইতে বিছিনায় মুতছসনি ?
--দূর! তোমার মতনি...
স্বর্ণা লজ্জা পেয়ে উত্তর ঘরে চলে গেল। না, আদু এ পরিবারের কেউ নয়। পিতৃমাতৃহীন এই ছেলেটি শরীয়তপুরের নাওখোলা, নাওডোবা, বড়কৃষ্টনগর--নানান হাটে ভিক্ষা করত। চান্দুর নিজের কোন ছেলে সন্তান না থাকায় ছেলেটির জন্য তার খুব মায়া লাগে। ছেলেটি দরাজ গলায় বেশ পল্লীগীতি গায়। প্রায়ই চান্দু ওকে হাটে দেখতে পায়। গত বছর নাওডোবার হাটে এসে ওর সাথে খাতির করে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকে সে চান্দুর সাথে গৃহস্থালী কাজ করে।
-- চাচা, আগের মতন এইবার পাট ফিরতি আনুম না
-- কছকি! দুই আজার টাকা দরে বেচতে না পারলে মোল্লাগো সুত দিমু কেমনে? মাইয়া ডাঙ্গর অইচে না--বিয়া দেওন লাগব না?
--স্বর্ণার বিয়ার বয়স কি অইছে?
-- হ, বয়স কি অইছে, দেহস না কালাই বেপারী কেমন তাগাদা শুরু করছে। আরে বেডা, তর বউ আছে, পোলা আছে, আমার মাইয়া লইয়া টানাটানি কেন?
-- চাচা, এই পাট ধইরা কইতাছি--অরে খুন করুম। এক রুজ হালার পাট কাইট্রা দিলাম, হালায় ৩০০ টেহার কথা কইয়া ২০০ টেহা দিল। আর কইল তার পশ্চিমের ক্ষেত কাইট্রা দিলে তহন এই ১০০ টেহা দিয়া দিব।
-- হ, অইছে, মাথায় ল। হুন, গাঙ্গে যাইয়া ওসমাইননাগো টলারে উডাবি, বুজছস্--
-- হ, বুজছি--
ট্রলারে চান্দু মিয়ার সাথে শওকত মিয়ার কথা চলছে। সেও হাটে পাট বিক্রি করতে যাচ্ছে। গতকাল একজন মহিলা শওকত মিয়ার বাড়িতে এসে তার পরিবারের সবাইকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বুঝিয়ে গেছে। সে বিষয়ে শওকত চান্দুকে বলছে, জানস চান্দু, কাউলকা এক শিখখিত মাতারি আমাগো বাইতে আইয়া আমাগো কাসুরে ইসকুলে যাওনের কতা কইতাছে। আমাগোও পড়নের কতা কইতাছে। হেয় কয় আমরা নাকি চোখ থাকতেও কানা। নিজেগো নামডা নিজেরা লিখতে পারলে কত কামে লাগে। ঠিক অইতো কইছে, তাই না? আরে এট্রু লেহাপড়া জানলে মোল্লায় আমাগো জমিডা টিপসই দিয়া লইতে পারত? কিন্ত কি করুম চান্দু, সংসারে ১০ জন মানুষ আমরা, একলা কামে সংসার চলে না। কাসু আমার লগে কামে গেলে ১00 টাকা পায়। অহন কও, লেহাপড়া আগে, না কাম আগে। আগে পেডের মইদ্যে ভাত গেলে তো তারপর অন্য কথা। না খাইয়া মইরা গেলেও তো কোন হালায় জিগায় না। চান্দু বলে, আর কইও না শওকত বাই, আমাগো জীবনে শান্তি নাই। দেহ আউজগা হাডে পাডের কি অবস্থা অয়।
গোয়ালী মান্দ্রার হাট থেকে ফিরে এসেছে চান্দু। আদু চাচীর সামনে বসে কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘আমি কত কইরা কইলাম, পাটের কি দোষ, পাটে আগুন দিয়েন না। না আমার কতা হুনলনা। শওকত চাচায়ও পাটে আগুন দিছে। চাচায় আমারে ডোবার মইধ্যে ধাক্কা দিয়া হালাইয়া দিল। পাটের লগে জিদ করে। হু--, আমগো জিদ নাই আর কি?’ জহুরা পাট পুড়ানোর কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। কেঁদে কেঁদে সে বলতে লাগল, ‘ তুমি বেবাক পাট পুড়াইয়া দিলা? তোমার দিলের মইধ্যে এট্রু মায়াও লাগলো না। তুমি জল্লাদ, তুমি মাইয়া দুইডারেও মাইরা হালাইতে পার।’ চান্দু জহুরার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘জহুরা--!’
স্বর্ণা, ফতি চান্দুর কাছে এল। চান্দু দু’মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। দুই হাজার টাকা দরের পাট এক হাজার টাকা দরে বেচতে হবে, এটা চান্দু কিছুতেই মেনে নিতে পারে নাই। জমি তৈরি-আগাছা পরিষ্কার-বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা-কাটা-ধোয়া-জাগ দেওয়া-শুকানো--তারপর বাড়িতে আনা কত কাজ, কত কষ্ট! অথচ চালানটাও উঠে না। গত বছর আষাঢ়-শ্রাবণ--দুই মাস বৃষ্টি হয়েছে খুবই কম, খাল-বিল-পুকুর-ডোবায় পানি না থাকায় পাট জাগ দিতে কেউ চেয়ারম্যান, কেউ পুরানা জমিদার বাড়ির বড় পুকুর ভাড়া নিয়েছে, কেউ বাঁশ-দড়ি দিয়ে এক মাইল দূরে নদীর পানিতে জাগ দিয়েছে। আধুনিক রিবনার পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে গেলে অনেক খরচ। এক বিঘা পাট কাটতে ষাট জন মজুর লাগে, পাতা ছাড়াতে আরো দশ জন, তিনশত টাকা মজুরী দরে একুশ হাজার টাকা খরচ। সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা পাট পঁচিয়ে সংগ্রহ করতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাগে।
অনেক বছর ধরে যে খালের পানিতে চান্দুরা পাট জাগ দিত, সে খাল নর্দমার নালা হয়ে গেছে, কোথাও ভরাট হয়ে বাড়ি হয়েছে। আবার যদি খাল-বিল-ডোবা-নালা-মাঠ-ঘাট পানিতে পূর্ণ থাকে, সে সময় পাটের পরে কোন শষ্য জন্মানো যায় না। তখন মাজা পর্যন্ত পানি থাকে। বাড়ীতে পাটের আঁশ, পাটখড়ি রাখার জন্য বিস্তর জায়গা দরকার, অথচ চান্দুর মাত্র দুইটি ঘর। পাটগুলো আদুর ঘরে এক বছর ধরে যক্ষের ধনের মত চান্দু আগলে রেখেছিল। ঝড় বৃষ্টিতে প্রায়ই পাট ভিজে যায়। পাট ভিজে গেলে ভ্যাপসা একটা গন্ধ বের হয়। আদু ভ্যাপসা গন্ধে কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। পরের দিন হয়তো চান্দু, জহুরা, আদু, স্বর্ণা সবাই মিলে উঠানে পাট শুকাতে দেয়।
পশ্চিমে উচুঁ ঢিবির উপর পাটখড়ি আর পলিথিন দিয়ে তৈরী এক ভাঙা-চুড়া গরু ঘর। আবহমানকাল থেকেই অতি উপকারী এই গরুর জন্য নির্মিত ঘর এমনি হয়ে থাকে। এই ভাঙ্গা-চুড়া জীর্ণ ঘরে চান্দুর একটি গরু আর একটি বাছুর বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে অতি কষ্টে দিন-রাত কাটাচ্ছে।
পাটের দাম মোটেই বাড়ছে না বরং দিন দিন কমেই চলেছে। এতগুলি পাট আদুর ঘরে জায়গা হতে চায় না। তার মধ্যে এক কোনাতে পাটের সাথে গাদাগাদি করে মাদুর বিছিয়ে আদু ঘুমায়। রান্নার জন্য পাটখড়ি বা লাকড়ী না থাকলে মাঝেমাঝে জহুরা জ্বালানী হিসাবে আর চান্দু তার ঘরের যাবতীয় বেড়া বাঁধতে, গরুর গলার দড়ি তৈরি করতে পাট ব্যবহার করে। এভাবেই তারা এক বছর ধরে পাটের অপব্যবহার করে আসছে।
আজকে চান্দু হাটে পাটের ভয়ানক ব্যবহার করেছে। সময়ের মুখে, দরিদ্রতার মুখে আগুন দিয়েছে। না, সে পাটকে পোড়াতে চায়নি। পোড়াতে চেয়েছে সময়ের নিষ্ঠুরতাকে, তার জ্বালা-যন্ত্রনাকে। কিন্তু জ্বালা-যন্ত্রণা তার আরো বেড়ে গেছে। কে এর জন্য দায়ী? সে নিজে, নাকি সময়, নাকি পাটের দর এক হাজার টাকা বলে? দুই হাজার টাকা হলেও কি তার সব সাধ পূর্ণ হত?
জহুরা দুই থালে ভাত ঢেলে বসে আছে। চান্দুকে, আদুকে খেতে ডাকে। চান্দু পরে খাবে বলে পূর্বদিকে তেঁতুল গাছের দিকে চলে যায়। পশ্চিমে গরু ঘর আর অভুক্ত গরুগুলির দিকে তাকিয়ে তার কান্না আসে। সেই কান্না চেপে তেঁতুল গাছের গোড়ায় বসে পাটের ভাল দিনগুলোর কথা চান্দু মনে করতে লাগল।
এক সময় পাটের বেশ দাম ছিল। তখন পাট থেকে অনেক জিনিস তৈরি হত। আজকের দিনে পাটের করুণ অবস্থা। সেদিন জহুরা, স্বর্ণলতা, ফতি নিজের হাতে পাট দিয়ে রংইন ছিকা, পুতুল, দোলনা আরো কত কিছুই তৈরি করেছে অথচ মেলায় নিয়ে চারভাগের এক ভাগও বিক্রি করতে পারল না। কুটির শিল্প আজ দারুনভাবে অবহেলিত। পলিথিন ব্যাগ আর প্লাস্টিক সামগ্রীতে দেশ ভরে গেছে। এগুলো নাকি খারাপ, পরিবেশ নষ্ট করে। সরকার কেন এসব তৈরী বন্ধ করে না?
পূর্বদিকে তাকিয়ে চান্দুর সমস্ত শরীর কাঁপুনী দিয়ে উঠে। কষ্টে তার বুক ফেটে যায়। এ বছর গরুর দুইটা বাচ্চার একটা মারা গেল। পাটের দুঃসহ অবস্থা! নিজের কবরে বাতি জ্বালানোর জন্য কোন ছেলে সন্তান নেই, সর্বোপরি দারিদ্রতা তার জীবনে লেগেই আছে। মনে পড়ে তার, চৈত্র মাসে এক ফোঁটা বৃষ্টিও আকাশে ছিল না। শরীরের ঘাম আর খাল থেকে অতি কষ্টে আনা পানি দিয়ে মাটি চাষ করল। তারপর বীজ... সেকি কষ্ট! সরকার মাটি থেকে পানি উত্তোলনের জন্য ডিপ টিউবওয়েল দিয়েছে। কিন্তু তার খরচ মেটানোর মত ক্ষমতা তার নেই। যদিও বা থাকে তবুও কোন কৃষক ক্ষেতের আল কেটে পানি নিতে নাও দিতে পারে। চিন্তা-ভাবনা করে চান্দু ডিপ টিউবওয়েলের ধারে কাছেও যায়নি। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বৃষ্টি তেমন হয়নি, পানির অভাবে পাট জাগ দিতে তাকে এক মাইল দূরে বাঁশ, গুণা নিয়ে নদীতে যেতে হয়েছে। কারো ডোবা-পুকুরে পাট জাগ দিতে দেয় না। রাস্তা পাকা হওয়াতে গাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক বেড়ে গেছে। মানুষের দখলে খাল ভরাট হয়ে গেছে। এই কয়েক বছর আগেও খালের চিহৃ কিছুটা ছিল। আজ আর নেই।
তেঁতুল গাছের গোড়ায় বসে চান্দু হঠাৎ ঘাড়ে পোকার কামড় অনুভব করে। ঘাড়ে হাত দিতেই হাতের দু’আঙ্গুলের চাপে চলে আসে ক্ষুদে ভোমড়া পোকা। যেন, তাকে কামড় দিয়ে বুঝিয়ে দিল পাট পোড়ানো তার ঠিক হয়নি। সে পোকাটিকে না মেরে ছেড়ে দিল। পাট পুড়ানোর জ্বালা চান্দু নিজের বুকের মধ্যে অনুভব করে। শওকত, মদন, হোসেন--ওরাও নিজের হাতে পাট পুড়িয়ে দিয়েছে। চান্দু অনুভব করল তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। সেই সকালে এক মুঠো ভাত খেয়েছে। এখন পর্যন্ত কিছু খায়নি। স্বর্ণা, ফতি চান্দুর দু’পাশে দাড়িয়ে আছে। স্বর্ণা কাঁদছে। ফতি গম্ভীর হয়ে আছে। স্বর্ণা চান্দুর হাত ধরে বলে, বাজান...
চান্দুর স্বর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। না, এ বছরে মেয়েটিকে বিয়ে আর দেওয়া যাবে না। ওসমান একটা ভাল সমন্ধের কথা বলেছিল। চান্দু তার কপালের দোষ ভেবে উঠে দাড়াল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফতিকে কাছে এনে পশ্চিমের গরুগুলির দিকে তাকাল। তারপর জোড়ে আদুকে ডাকতে লাগলো, আদু , ঐ আদু, গরু দুইডারে ঘাস দেছ নাই?
তার হৃদয়ের বেদনা আদু বুঝে। সে উত্তর ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে জমানো ঘাস গরু দু’টিকে খাওয়াতে লাগল। আর সাথে সাথেই মনের দুখে গান গাইতে শুরু করল, আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে, অকূল ধরিয়ার বুঝি কূল নাইরে...।
চান্দু ঘরে এসে দু’মুঠো ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ল। জহুরা তার মাথার সামনে বসে চুল বিলি দিতে লাগল। স্বর্ণা বাবার গা ঘেষে শুয়ে পড়ল। ফতি বই নিয়ে পড়তে বসল। চান্দুর মনে পড়ল, আনন্দবাবু বলেছিল, ফতিকে বৃত্তি দেওয়ালে ফতি নির্ঘাত বৃত্তি পাবে। বৃত্তি পেলে সরকার পড়ার খরচ বহন করবে। দূর থেকে আছরের আযান ভেসে এল। আযান শেষ হতেই পড়ার শব্দ আবার শুনতে পেল--‘পাট ও পাট থেকে তৈরী পণ্য বস্ত্র বিদেশে বিক্রি করে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত বলে পাটকে একদা সোনালী আঁশ বলা হত...।’ ফতি পড়ছে। চান্দু পাটের আগুন আবার বুকের মধ্যে অনুভব করল। পাটের স্মৃতি বারবার তার স্মরণ হতে লাগলো। কত কষ্টে জোঁকের কামড় খেয়েও সে আর আদু পাট কেটেছিল। আদু চান্দুর বিড়ি ফুকা দেখে নিজেও টানতে শিখেছে। সে তাকে বন্ধুর মত একদিন বলে ফেলেছে,
-- কি যে খান চাচা, এসব বিড়ি ফুকতে ভাল্লাগে?
--কতা কম ক, কাম কর, দেখ, ফতি ভাত লইয়া কদ্দুর আইল ।
-- দেকতাছি
পাটের আঁশ মুক্ত করানো মহিলাদের মাঝে পাট খড়িগুলি অর্ধেক ভাগ দিতে হয়েছে। মোল্লার ক্ষেত বলে পাটের সোনালী আঁশের তিন ভাগের একভাগ তাকে দিতে হয়েছে। তবুও যদি ১৫০০/১৮০০ টাকায় পাট বিক্রি হত, তবে তার কিছু লাভ হত। জহুরা, স্বর্ণলতাকে একটি করে শাড়ী আর ফতির জন্য দুইটা কলম, পাঁচ দিস্তা নিউজপ্রিন্ট খাতা, বৃত্তির বই--এই স্বপ্ন নিয়ে আজ সে হাটে গিয়েছিল। মেয়েটাকে আর বৃত্তি দেওয়ানো যাবে না। প্রাইভেট পড়ানোর খরচ চালাবার মত সমর্থ তার আর রইলো না।
হায়রে পাট! পাটকে নিয়ে সব স্বপ্ন তার হারিয়ে গেছে। কাকে সে দায়ী করবে? সে জানে না, বাজারজাত কি? কিভাবে পাট রপ্তানী করে? কিভাবে তারা শোষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত? কেন দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম হয়ে যাচ্ছে? সে জানে ভাত, মাছ আর তরকারি খেলে শক্তি হয়, বেঁচে থাকার জন্য এগুলো মানুষের খেতে হয়, এগুলো খেলে কাজ করা যায়। কিন্তু পেটের ভিতরে কি হয়--তা সে জানে না । ফিতা কৃমি, গুড়া কৃমি, চ্যাপ্টা কৃমি ক্রমাগত তাদের রক্ত শোষণ করে চলেছে--তারা তার খবরও রাখে না। তবে মাঝে মাঝে শুনে ঐ খাদ্যে ভিটামিন, এই খাদ্যে আমিষ থাকে। যেমন, সে শুনতে পায় ঢাকার শহরে প্রায়ই গন্ডগোল হয়। কোন গন্ডগোল শুনে ভয় পেলে চান্দু হয়তো বলেই উঠে--ভাই, হেই গন্ডগোলের মতন নাতো? আমার মা বাবা তো হেই গন্ডগোলেই মরছে। হুদাহুদি মেলেটারিরা দু’জনরেই মারল। ছোট দুইডা বইনেরে গ্রামের মনু, সিকদার--অরা অগো দলবল লইয়া হেই যে ধইরা লইয়া গেল, বইন দুইডা আর ফিরা আইল না। মনুরে তো মুক্তিবাহিনীরা মাইরাই হালাইছে। সিকদার অহন সিকদার চৌধুরী, ঢাহাতে বড় বাণিজ্য করে।
চান্দু এখন গভীর ঘুমে অচেতন। গভীর রাতে সে স্বপ্ন দেখে পাটের দাম বেড়ে গেছে। সরকার পাটের দাম মনপ্রতি ২৭০০ টাকা করেছে...। সেই মসলিন আবার চালু হয়েছে। পাটের তৈরী দ্রব্যের দারুণ কদর! না, তার স্বপ্ন বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। ফতি পাঠাতন থেকে নিচে নেমে বাবার গলা ধরে ঘুম ঘুম চোখে ডাকতে লাগল, বাজান, ও বাজান, মুতুম।
আবার সকাল শুরু হল। শুরু হল চান্দু ও তার পরিবারের জীবন নাটক। স্বর্ণা মায়ের মত করে সংসারের কাজ করতে লাগল। আদু ভাত খেয়ে আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা সহ কিছু ভাত সানকিতে নিয়ে, গামছা দিয়ে বেধেঁ ছুটল দূরের কোন গ্রামে, যেখানে কাজ করে ২০০/৩০০ টাকা পাওয়া যাবে। চান্দু ঘরে জমানো একটা টিন, যে টিন দ্বারা আদুর জন্য নতুন ঘরের চালা দিতে চেয়েছিল--তা নিয়ে বিক্রি করতে বাজারে ছুটল।
২| ১৮ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:০১
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
পাটকে একসময় সোনালী আঁশ বলা হতো অথচ আজ এই কথা রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।
৩| ১৮ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৫
মামুন রশিদ বলেছেন: চিরায়ত গ্রামীন পরিবেশের গল্প । দুঃখ, দুর্দশা আর ভালোবাসার গল্প ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:০০
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
সেই অতীতে ফিরে গেলাম।
এমন গল্প আজকাল পাওয়া যায়না বললেই চলে। অসাধারন, অসাধারন লিখেছেন ভাই। +++++++++++++