নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শাশ্বত স্বপন

শাশ্বত স্বপন › বিস্তারিত পোস্টঃ

’৫২ সালের সময়ের উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক গল্পঃ সময়ের লাশ ১ম পর্ব

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৫১







স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকারে অনন্তের পথে ছুটে চলা স্মৃতিগুলো প্রত্যেক মানুষের জীবনে জোনাকীর মত জ্বলে আর নিভে। ‘সময়ের লাশ’--গল্পে বৃদ্ধ বয়সে নায়িকা তার নায়কের সাথে প্রেমের কাহিনী এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভুমির আত্নোপলব্দির কিয়দংশ উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে বর্ণনা করেছেন। এখানে নায়ক ’৫২ সালের সময়ের ধারক, নায়িকা মাতৃভূমির ধারক অর্থাৎ গল্পটি যেন, ’৫২ এর সময়ের সাথে লাজুক মাতৃভূমির ভালোবাসা-লুকোচুরি-মিছিল-আন্দোলন-যুদ্ধ-মৃত্যুর খেলা।



সময়ের লাশ ১ম পর্ব



দরজার বাইরে বাবার হাসির শব্দ শোনা গেল। বাবার সাথে আর একজনের হাসিও শুনতে পেলাম। আমি রাম প্রসাদের মাথায় জল ঢালতে ঢালতে রামকে জিজ্ঞাসা করলাম--‘রাম, আরো জল ঢালব?’--না, শব্দটি বলেই দৌঁড়ে দরজা খুলতে গেল। আনন্দে নেচে নেচে বলতে লাগল, ‘বাবা আসছে, বাবা আসছে।’ আমি প্রায় অপ্রস্তুত ছিলাম। রামকে ডেকেও আর থামানো গেল না। জল বেয়ে পড়ছে সারা শরীরে। জ্বর অথচ দুষ্টামীর শেষ নেই। রাম দরজা খুলে দিল। আমি তো হতভম্ব! কারণ বাবা প্রায়ই দুপুরবেলা একজন অতিথি নিয়ে আসেন। ঘরের ভিতরে আমি না যেতেই রাম দরজা খুলে দিল। তখন আমার শরীরে ছিল পাতলা ধুতি--যা জড়িয়ে কোন রকমে লজ্জা নিবারণ করেছি। রামকে মাথায় জল দেবার আগে দুপুরে প্রতিদিনের মত লক্ষ্মী দেবীর পূজাটুকু মাত্র সেরেছি। পূজা শেষ হতেই মা ডেকে বলল--‘হাত ব্যথা হয়ে গেছে কল্যাণী, এবার তুই ওর মাথায় আর কতক্ষণ জল দে--।’ সব জামা-কাপড় ছিল অশুদ্ধ। আলমারীতে শুদ্ধ কাপড় থাকলেও মার ধমকে বের করতে পারিনি। তাই ধুতি পড়েই পূজা দিলাম। ধুতি না ছাড়তেই মার ডাকে রামের মাথায় জল দিতে লাগলাম। ভালই লাগে ধুতি পড়তে; কোন রকমে লজ্জা নিবারণ মাত্র। কিন্তু আমার মনে হয়, আমি যেন নগ্ন হয়ে আছি। বারবার কাঁধের আঁচলটা মাটিতে পড়ে যায়। রাম দরজা খুলতেই দেখি, বাবার আগে একটি ছেলে ঘরে ঢুকেছে। আমি লজ্জায় ড্রয়িং রুম লাগোয়া ছোট ঠাকুর ঘরে ঢুকে পড়েছি। একটু পরে বাবা ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাকে ডাকতে ডাকতে ভিতরে চলে গেলেন। রামকে কোলে নিয়ে বাবা মাকে বলছে, ‘একি অবস্থা লক্ষ্মী! ওর মাথাটা মুছে দাওনি?’ মা বলছে, ‘কল্যাণীতো মাথায় জল দিয়েছে, মেয়েটা মুছেও দেয়নি?’ বোধহয়, মা আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে।



এদিকে ছেলেটি ঠাকুর ঘরে ঢুকে প্রণাম করল। পরিধানের কারণে লজ্জায় কিছু বলতেও পারছি না। ছেলেটা বলতে লাগল, মা দেবী, তোমার পূজা যদি স্বল্প পোশাকেই করতে হয়, তবে পোশাক না পরলে হয় না? এরপর আমার দেহের বর্ণনা দিতে দিতে যা বলেছে--তা আর বলার মত না। একটু পরে সরস্বতী দেবী মূতির্র দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল--‘সরস্বতী মহাভাগে--বিদ্যে কমললোচনে--বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি--বিদ্যাংদেহী নমস্তোতে-- ।’ ’আহা! দেবী, এই মন্ত্র পাঠ করিলে যদি তুমি বিদ্যাই দিতা, তবে এই কিশোরী আর যাই হোক ধর্মে আর অংকে ফেল মারিত না।’ বুঝতে আর বাকী রইল না, ছেলেটা আমাকে দেখেছে। ঠাকুর ঘরের দরজার কোনায় রোদে শুকানো মায়ের শাড়ী টেনে দিয়ে নিজেকে পর্দার আড়াল করেছি। হঠাৎ করেই সে শাড়ী টান দিয়ে ফেলে দিল। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে চেয়ে রইল আমার চোখ আর মুখের দিকে। আমি এমন হতভম্ব হয়েছি যে, কাঁধের উপর ধুতির অংশটুকু কখন যে পড়ে গেছে আমার পায়ের কাছে, টেরও পাইনি। নবম শ্রেণীর ছাত্রীর বুকের আকাশটা কি রকম আকর্ষণীয় হতে পারে--সে অভিজ্ঞতার দৃশ্য তখন বুঝিনি। আজ নাতনীর বুক দেখে সে দিনকার কথা মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে, ছেলেটা শুধু তাকিয়ে ছিল; হাত দিয়ে কোথাও ছুঁয়ে দেখেনি। শুধু বলেছে, ‘তুমি এত সুন্দর! ইচ্ছে করে রক্ত দিয়ে তোমাকে সাজাই--দেখি, আরো কত সুন্দর দেখায়।’ কি আশ্চর্য! যে বটি দা দিয়ে পূজার ফল কেঁটেছিলাম, সে দা দিয়ে সে তার আঙ্গুল কাঁটা শুরু করতেই হঠাৎ বাবার কণ্ঠস্বরে সে দৌঁড়ে চলে যায়। সে যাত্রা আমার জীবনের...। ছেলেটা বাবার সাথে আবার বাইরে চলে গেল। অবাক হলাম, কি করে জানল, আমি অংকে আর ধর্মে ফেল করেছি। নিশ্চয়, বাবা বলেছে।



এই সেই ছেলে--এই সেই যুবক--এই সেই শহীদ, সুমাদ জাকারিয়া। দাদুর কাছে পড়তে গেলে ওকে প্রতিদিন পলাশ গাছের গোড়ায় বসতে দেখি। প্রায়ই দেখতাম, মায়াময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিগত ষাট বছরে স্বামী তথা সকলের ভয়ে, লোক লজ্জায় এ লেখা প্রকাশ করতে পারিনি। জীবনের গভীর মায়াময় স্মৃতিটা আজো বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছি। ছেলেরা বড় হল, বিয়ে করল, মেয়েদের বিয়ে দিলাম। আজ নিঃসঙ্গ চিত্তে নাতী-নাতনীদের ভিড়ে খুঁজে বেড়াই সুমাদকে। প্রতিবছর খুঁজি বই মেলায়--শহীদ মিনারে--পথে পথে; কোথাও ওকে খুঁজে পাইনি; পাইনি ওকে নিয়ে লেখা কোন গদ্য বা পদ্য। জানিনা, এ লেখা প্রকাশ হবার পর ছেলে-মেয়েরা কি ভাববে। আমি বলব, সবাই আমরা মানুষ। সবারই জীবনে ঘটনা আছে, স্মৃতি আছে। কারোটা গভীর ক্ষত হয়ে আছে, কারোটা ভাসা-ভাসা। আগে একুশের মাঝে ওকে খুঁজে পেতাম; এখন কেমন যেন, ঝাপসা দেখায়। বয়সের ভার বোধহয়, এ নশ্বরদেহ আর বইতে পারছে না।



স্বামীর মৃত্যুর পর কি যেন, হারালাম। আমি শুধু স্বামীই নয়, সুমাদের স্মৃতিও যেন, হারাতে লাগলাম। নিজেকে বড় শূন্য লাগে। বাড়ীতে অনেক লোক থাকা সত্ত্বেও মনে হয়, কেউ নাই। এরকম মনে হয়েছিল সুমাদের মৃত্যুর কয়েক মাস আর বিয়ের পর বিমল বোম্বে চলে গেলে। শূন্যতা যে কি অসহায় অবস্থা--তা আমার মত বৃদ্ধরাই জানে। সময়ের কাছে জীবনের পরাজয় মেনে নিলেও সময়ের সাথে সুমাদের স্মৃতি বিস্মৃত হবে, এ আমি মেনে নিতে পারি না; আর পারি না বলেই, গদ্যের এই স্মৃতিগত ক্ষুদ্র প্রয়াস।



চলবে

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৯

কাবিল বলেছেন: ভাল লাগল
২য় পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

ধন্যবাদ

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:১১

শাশ্বত স্বপন বলেছেন: কাবিল ভাই, পড়ার জন্য ধন্যবাদ

২| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:০৮

এম এল গনি বলেছেন: পড়ার মত গল্প বটে | বেশ ভালো লাগলো |

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০৪

শাশ্বত স্বপন বলেছেন: গনি ভাই, উৎসাহ পেলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.