![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বার তারিখে সমাবেশ হল। সব শুনলাম, বুঝলাম, আমরা কেমন আছি, কোথায় আছি? যে ভাষায় আমরা কথা বলি--যে ভাষা রক্তের সাথে আছে মিশে--সে ভাষা পাকিস্তানীরা কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করবে সমুদ্রে আর তার পরিবর্তে পাকিস্তানীদের উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে। তার মানে আমাদের দেহের রক্ত পরিবর্তন করে ওদের রক্ত আমাদের দেহে ভরে দেবে। মিটিং এর শেষটা অত্যন্ত লজ্জাস্কর পরিস্তিতিতে শেষ হল। তখন সুমাদ বক্তব্য রাখছে--‘মাতৃভাষাকে কেড়ে নেওয়া মানে আমার মাকে তথা আমাদের মাকে কেড়ে নেওয়া। আজ আমাদের যুদ্ধের যাবার সময়--আজ আমাদের মিছিলে যাবার সময়। আমরা যুদ্ধে যাব--আমরা মিছিলে যাব। মাননীয় অধ্যাপক সাহেব, সম্মানিত...ওদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে দেব না। আমরা স্বাধীনতা চাই...।’ হঠাৎ কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠি চার্জ সেদিন সমস্ত মিটিং পন্ড করে দিল। ছত্রভঙ্গ হলো সবাই।
যাই হোক, আরেকদিন দাদুর কাছে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি সেই আগের মত ইটের নিচে চিঠি রেখে চলে গেল। সেদিন আর ভয় পেলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চিঠিটা উঠালাম। পা দিয়ে ইট সরাতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলাম। সুমাদ দৌঁড়ে এল, ‘--দেখি দেখি।’ পায়ের আঙ্গুল আলতো ভাবে ছুঁইয়ে দিল। গোড়ালী থেকে নখ পর্যন্ত ম্যাসাস করতে লাগল। ‘-- ব্যথা কমেছে?’ আমার কি যে ভালো লাগলো। সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। পায়ে চুমু দিতেই আমি দৌঁড়ে চলে এলাম। পথে দু’একজন ছোকরা দেখেছে । বাড়ী ফিরে ড্রইং রুমে আসলাম। বাবা-মা-রাম তিন জনেই রামকৃষ্ণ মিশনে গেছে। অতএব, চিঠিটা খুলতে শুরু করলাম। পুরো চিঠিতে প্রকৃতির আবছা চিত্র। আর চিত্রের উপর দিয়ে নিপূন হাতে লেখা--‘কল্যাণী দি, কেমন আছো? নিশ্চয়ই স্নান সেরেছ? চুলগুলি নুয়ে পড়েছে বিছানায়। কি দেখছ? এ লেখা। তোমার অস্তিত্বের কাল্পনিক মানচিত্র এখানে লুকিয়ে আছে। তুমি ওকে খুঁজে পাবে না কারন তুমি এখনও তোমাকে চিনতে পারনি। চুলের গুচ্ছ থেকে দু’এক ফোঁটা জল ফেলে দেখ, কাগজটি কাঁদবে। এ কাগজ আমার শত জনমের না পাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস; হারিয়ে যাওয়া লক্ষ বছরের বেদনাময় স্মৃতির গন্তব্যহীন ঠিকানা। কাগজের প্রান্তগুলো দেখ। বামদিকে সিঁদুরের স্পর্শ দেখেছ? ডানদিকে সবুজ রং? সূক্ষ্ণ কতগুলো সূতা চুল হয়ে ছড়িয়ে আছে। নদীর মত প্রশান্ত জলরেখার দাগ সবুজ আর সিঁদূরের প্রান্ত ছুঁয়ে যায়। নিচে তাকাও--চঞ্চল, নৃত্য পটিয়সী, লাস্যময়ী ঝর্ণার নৃত্য শুনতে পাও। ভয় পেয়েছ? পায়ের ঘুঙুর বাঁধানো পদধ্বনি শুনেছ? আবার ভয় পেয়েছ? ভয় নেই, এতো তুমি আর আরেক জন--যে তোমারি মত--ঠিক তোমারি মত। তাই তোমাকে এত ভালবাসি। আমার প্রেমিকার রূপ খুঁজতে খুঁজতে একটা প্রতীক, একটা সুন্দর ছবি হিসেবে তোমাকে পেয়েছি। আমার সেই প্রেমিকা তোমারি মত। বুঝতে পারনি কিছু? লুকিয়ে রাখ হৃদয়ের গভীরে, স্মৃতির সাগরের হাজার ফুট নিচে। মরুভূমির ছোঁয়া পেলে এ লেখা আবার আসবে--তখন বুঝবে কি এর অর্থ। খারাপ লাগছে? আজ আর নয়, এটুকুই থাক। স্বাধীন হোক, তোমার জীবন।’
সরস্বতী পূজার পরের দিন দাদুর জন্য লুচি, চিড়া, নাড়– আর মোয়া নিয়ে দাদুর কাছে যাচ্ছি। পথে হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কোকিল সুরে একটা ধ্বনি দিল। পাশে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম। সুমাদ হাসছে। অথচ ওর কপাল আর মাথায় ব্যান্ডেজ। ‘--আমাকে সারা রাত বুকের কাছে নিয়ে শুয়েছিল। এখন আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ। আমার চোখের কাছে তার চোখ রেখে বলল, ক্ষুধা পেয়েছে, মিছিল করে আসলাম তো। পথে যেতে দেখি, তুমি আসছ। ভাবলাম টিফিনে নিশ্চয় খাবার আছে। দেবে খেতে? জান, মিছিলে মার খেয়েছি... তারপর হাসপাতালে...।’ আমি টিফিন বাটি ওর হাতে দিয়ে মাথা কাঁত করলাম। টিফিন বাটি খুলেই একটা নাড়– আমার মুখে দিল। আমি মুখে নাড়ুটা নিয়ে মুখটাকে স্থির করে রেখেছি। বাম হাতে একটা লুচি আর ডান হাতে একটা মোয়া, একটা নাড়ু নিল।
--কি গো, খাবার সব অশুদ্ধ হয়ে গেল, তাই না ?
আমি মাথা নাড়লাম।
--বা! তুমি তাহলে তোমাদের সংস্কার নামক কুসংস্কার মান না।
আবার মাথা নাড়লাম।
--এই মেয়ে, কথা বল না কেন? ও মা! মুখে এখনো নাড়ু? কষ্ট দিলাম, যাই আবার দেখা হবে।
আবার পেছন ফিরে আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
-- আমি কে জানতে ইচ্ছে করে না?’
কিছু বললাম না। ও চলে গেল। মাথা কতটুকু ফেটেছে, কিভাবে ফাটল কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। কারণ আমি কখনও ওর সাথে কোন কথা বলিনি। বাড়িতেও খুব কম কথা বলি। খুব সুন্দর দেখতে। নাকটা তীরের মত চোখা; বিশাল বুক যেন, মাঠ। বোতাম খোলা শার্টটা যা ময়লা! হোস্টেলে থাকে, কে ধুইয়ে দেবে। টিফিনের বাটি আলগা করে রেখে গেছে। আমি শক্ত করে আঁটকাতে গিয়ে দেখি লাল আর সাদা কি যেন। উপরের বাটিটা উঠালাম। ওমা! রক্ত মাখা কাগজ। দ্রুত বুকের ভিতর কাগজটা লুকিয়ে রাখলাম। দাদুকে টিফিন বাটিসহ খাবার দিয়ে চলে এলাম বাড়ীতে। বাথরুমে ঢুকলাম।
চিঠিটা খুলে পড়ছি। একি! সারাটা চিঠি রক্ত মাখা। আবছা একটা মানুষের ছবি--হাতে ফেস্টুন--গুলিবিদ্ধ হয়ে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আমার সারাটা শরীর কেঁপে উঠল। পড়তে শুরু করলাম--‘হ্যাঁ, সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমি গর্ভবতী হব। আমার গর্ভ থেকে জন্ম হবে একজন মহাবিদ্রোহীর--যে সারা বিশ্বকে শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে মুঠি মুঠি বিদ্রোহী ভালবাসা উপহার দেবে। বিভক্ত ভারতবর্ষকে আবার একত্র করবে। আতুড়ে ঘরে প্রসূতি যেমন অব্যক্ত যন্ত্রণা, অসহ্য বেদনায় সমস্ত দেহ-মন নিয়ে বিদ্রোহ করে নারী জাতির প্রতি ঘৃনা অথবা ভালবাসা ঢেলে দেয়; মা, মা বলে চিৎকার করে; সাগর যখন সমস্ত জল শুকিয়ে মরুভূমি হবার সীমাহীন বেদনার শেষ গোধূলীর ছায়া আঁকড়ে ধরবে--তেমনি কোন এক সময়ে আমার মৃত্যু হবে বড় নির্মমভাবে--যা দেখে যত ধাই, যত দর্শক আছে, সবাই কাঁদবে, বিলাপ করবে কিন্তু বিশ্ব কাঁপানো ভবিষ্যৎ মহাবিদ্রোহী বেঁচে থাকবে বেদনার উল্টোপিঠে। যতদিন জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হবে, যতদিন অন্যায়-অবিচার, বিশৃংঙ্খলা থাকবে--ততদিন সে আমারি আজ্ঞাবাহী, বিদ্রোহ করে যাবে অনন্তকাল। সে অমর-অক্ষয়-অবিনশ্বর। অপেক্ষা করো কল্যাণী, সেই দিনের আশায়। আজকের রক্তের কাছে এই আমার প্রদীপ্ত অঙ্গীকার...।’ পাগল, কি সাব লিখেছে? গর্ভবতী হবে? ও কি নারী নাকি? কিছু বুঝি না। হ্যাঁ, সেদিন কিছু বুঝি নাই। আজ বুঝি, সব বুঝি।
(চলবে)
২য পর্বঃhttp://www.somewhereinblog.net/blog/sswapan/30012213
২| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:০৩
অবনি মণি বলেছেন: চলুক । আমরা আছি ।
৩| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:০৬
দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: নিরন্তর পথ চলার কামনা।
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:৪৭
নিলু বলেছেন: লিখে যান