![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রধান প্রধান ধর্মগুলির বিবাহরীতি আলোকপাত করা যাক।
হিন্দু বিবাহরীতি : হিন্দুশাস্ত্রে আট প্রকারের বিবাহরীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন –- (১) ব্রাহ্ম বিবাহ, (২) দৈব বিবাহ, (৩) আর্য বিবাহ, (৪) প্রাজাপত্য বিবাহ, (৫) অসুর বিবাহ, (৬) গান্ধর্ব বিবাহ, (৭) পিশাচ বিবাহ এবং (৮) রাক্ষস বিবাহ। হিন্দু বিবাহে যৌতুকের কোন স্থান নেই এবং বহির্ভূতএবং বিবাহর্পূর্ব অনৈতক সম্পর্ক করা নিষিদ্ধ।
(১) ব্রাহ্ম বিবাহ : ব্রাহ্ম বিবাহ ছিল ব্রাহ্মণ্য আচার সম্পৃক্ত বিবাহ। ব্রাহ্ম বিবাহ রীতি অনুসারে কোনো বেদজ্ঞ সৎ চরিত্র ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে এনে যৌতুকাদি সহ কন্যা সম্প্রদান করা হত। এই বিবাহে মন্ত্র উচ্চারণ সহ যজ্ঞানুষ্ঠান করে স্ববস্ত্রা ও সুসজ্জিতা কন্যাকে বরের হাতে সম্প্রদান করা হত। বিবাহ যজ্ঞাগ্নির সামনে বর-কনে উভয়েই তিনবার যজ্ঞাগ্নি প্রদক্ষিণ করতে করতে বলত -- “তুমি আমি, আমি তুমি। তুমি স্বর্গ, আমি পৃথিবী। আমি সাম, তুমি ঋক। এসো আমরা বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করি।“ মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্রুতিশীলবতে স্বয়ম্।/আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ”।। (৩/২৭)।
(২) দৈব বিবাহ : জ্যোতিষ্টোমাদি বিস্তৃত যজ্ঞ আরম্ভ হলে সেই যজ্ঞে পুরোহিতরূপে যজ্ঞকার্যনিষ্পাদনকারী ঋত্বিককে যদি সালঙ্কারা কন্যা দান করা হয়, তাহলে এইরকম বিবাহকে মুনিগণ দৈব নামক শাস্ত্রবিহিত বিবাহ বলে থাকেন। (ব্রাহ্মবিবাহে নিঃশর্তভাবে কন্যাদান করা হয়। দৈববিবাহে কন্যাদান করা হয় বটে, কিন্তু যজ্ঞকর্মে নিযুক্ত ঋত্বিকের কাছ থেকে পূণ্যফল লাভের সম্ভাবনা থাকায় এই কন্যাদানটিকে একেবারে শুদ্ধদানের পর্যায়ে ফেলা যায় না)। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্বতে।/অলংকৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে”।। (৩/২৮)।
(৩) আর্য বিবাহ : আর্য বিবাহ প্রাচীন ঋষিদের মধ্যে যে বিবাহ প্রচলিত ছিল তার নাম ছিল আর্য বিবাহ। এই বিবাহে যৌতুকের পরিবর্তে নামমাত্র কন্যামূল্য হিসাবে একটি গোরু এবং একটি ষাঁড় দেওয়া হত। আর্য বিবাহে ধর্মীয় কাজে ব্যবহার হওয়ার জন্য পাত্র কন্যার পিতাকে এক জোড়া গোরু অথবা মহিষ প্রদান পূর্বক তাহার কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত। যা পণপ্রথা নামে প্রচলিত ছিল। কন্যার পিতাকে টাকা, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি প্রদান করতে হত। এমনকি “কন্যাপণ” একটি আভিজাত্যের প্রতীকও ছিল। অনেক ধনাঢ্য ব্যাক্তি পণ প্রদানের মাধ্যমে উচ্চবংশীয় কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতেন। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ।/কন্যাপ্রদানং বিধিবদার্ষো ধর্মঃ স উচ্যতে”।। (৩/২৯)।
(৪) প্রাজাপাত্য বিবাহ : প্রাজাপাত্য বিবাহ রীতি অনুসারে পাত্র নিজে অথবা তাহার অবিভাবক কন্যার পিতার নিকট নিজে প্রার্থনা করে অনুমতি লাভ করলে পরে কন্যার পিতার আমন্ত্রেণের মাধ্যমে তার কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত। এই নিয়মেই এখন সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিবাহ করেন। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “সহোভৌ চরতাং ধর্মমিতি বাচানুভাষ্য চ।/কন্যাপ্রদানমভ্যর্চ্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্মৃতঃ”।। (৩/৩০)।
উপরে বর্ণিত চার প্রকারের বিবাহ ধর্মশাস্ত্রে অনুমোদিত বিবাহরূপে স্বীকৃত হয়।
(৫) আসুর বিবাহ : আসুর বিবাহ কন্যার পিতা পাত্রপক্ষের কাছে কন্যার মূল্য বা পণ দাবি করত, যে সবচেয়ে বেশি পণ বা মূল্য প্রদান করত তার কাছে কন্যা সম্প্রদান করা হত। এইরূপ বিয়েতে পয়সা দিয়ে কন্যা ক্রয় করা হত। অর্থাৎ বিয়েতে মেয়ের বাবাকে কিংবা তার অভিভাবককে পণ বা মূল্য দিতে হত। মাদ্রির সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহ এবং দশরথের সাথে কৈকেয়ীর বিবাহ-দুটি এই বিবাহের দৃষ্টান্ত হতে পারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ।/কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাসুরো ধর্ম উচ্যতে”।। (৩/৩১)।
(৬) গান্ধর্ব বিবাহ : গান্ধর্ব বিবাহ পাত্রপাত্রীর স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই ধরনের বিয়ে প্রেমঘটিত বিয়েরই প্রাচীন রূপ। ছেলে-মেয়ে তাদের স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোনো দেবতার সামনে মালাবদল বা অন্য রূপে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে। এই রূপ বিবাহকে সামাজিক রূপদান বা অনুষ্ঠানাদি পালনে কোনো প্রথাগত বাধা নেই। পাত্রপাত্রীর ইচ্ছায় এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হত। অর্থাৎ পাত্রপাত্রী স্বেচ্ছায় একে অপরকে মাল্যদানের মাধ্যমে যে বিবাহ করত, তাকে বলা হত গান্ধর্ব বিবাহ । মহাভারতের নায়কদের মধ্যে অনেকেই গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেছিলেন, যেমন -- অর্জুনের সঙ্গে উলুপি, চিত্রাঙ্গদার বিবাহ, দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার বিবাহ প্রভৃতি। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “ইচ্ছয়ান্যোন্যসংযোগঃ কন্যায়াশ্চ বরস্য চ।/গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্যঃ কামসম্ভবঃ”।। (৩/৩২)।
(৭) রাক্ষস বিবাহ : হিন্দু ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা বর্ণের লোকদের মধ্যে রাক্ষস বিবাহ অধিক প্রচলিত ছিল। বলপূর্বক কন্যা ছিনিয়ে নিয়ে রাক্ষস বিবাহ সম্পন্ন হত। যদি কোনো রূপসি নারীকে লাভ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে, তখন তাকে কোনো বাগান বা পথ থেকে লোকজনের সাহায্যে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে পরে ব্রাহ্মণ ডেকে হোম করে বিয়ে করার নাম রাক্ষস বিবাহ। পুরাকালে ক্ষত্রিয় রাজারা এইভাবে বাহুবলে বহু নারীকে ধরে এনে বিয়ে করত। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “হত্বা চ্ছিত্ত্বা চ ভিত্ত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদতীং গৃহাৎ।/প্রসহ্য কন্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে”।। বাধাপ্রদানকারী কন্যাপক্ষীয়গণকে (আহত) নিহত করে, (অঙ্গ) প্রত্যঙ্গ ছেদন করে এবং গৃহ প্রাচীর প্রভৃতি ভেদ করে যদি কেউ চিৎকারপরায়ণা ও ক্রন্দনরতা কন্যাকে গৃহ থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে, তবে একে রাক্ষস বিবাহ বলা হয়। (৩/৩৩)।
(৮) পৈশাচ বিবাহ : যদি কোনো তরুণ-তরুণীর মধ্যে গান্ধর্ব বিয়ে করার উপায় না থাকে, তাহলে আর-এক যে উপায় প্রচলিত ছিল তা হল পৈশাচ বিবাহ। পৈশাচ বিবাহ বাৎস্যায়নের যুগেও ছিল। দুজনে আগে প্রেম করবে, তারপর সুযোগ বুঝে গোপনে নারীকে কোনো মাদকদ্রব্য খাইয়ে উত্তেজিত করে যৌনমিলন করবে। এরপর পুরোহিত ডেকে সেই নারীকে বিয়ে করবে। কোনো কুমারী কন্যাকে মাদকদ্রব্য সেবনে নিদ্রিত অবস্থায় বা মাতাল করে কেউ যদি তাকে ধর্ষণ করত, তবে সেই ব্যক্তি সেই নারীর স্বামী হতে পারত। তবে এই বিয়ে শুধু অননুমোদিতই নয়, অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিল। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি।/স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ”।। (৩/৩৪)। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “কৃষ্ণচরিত্র” গ্রন্থে চতুর্থ খণ্ডে লিখেছেন, “অষ্টপ্রকার বিবাহে সকল বর্ণের অধিকার নাই। ক্ষত্রিয়ের কোন্ কোন্ বিবাহে অধিকার, দেখা যাউক। তৃতীয় অধ্যায়ের ২৩ শ্লোকে কথিত হইয়াছে, “ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহ বরান্”। ইহার টীকায় কুল্লূটভট্ট লেখেন, “ক্ষত্রিয়স্য অবরানুপরিতনানাসুরাদীংশ্চতুরঃ।” তবে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে কেবল আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ –- এই চার প্রকার বিয়ে বৈধ। বাকি সবকটিই অবৈধ।
কিন্তু ২৫ শ্লোকে আছে — “পৈশাচশ্চাসুরশ্চৈব ন কর্তব্যৌ কদাচন”।। পৈশাচ ও আসুর বিয়ে সকলেরই অকর্তব্য। অতএব ক্ষত্রিয় পক্ষে কেবল গান্ধর্ব ও রাক্ষস -- এই দ্বিবিধ বিবাহই বিহিত রহিল। তন্মধ্যে, বরকন্যার উভয়ে পরস্পর অনুরাগ সহকারে যে বিবাহ হয়, তাহাই গান্ধর্ব বিবাহ। এখানে সুভদ্রার অনুরাগ অভাবে সে বিবাহ অসম্ভব, এবং সেই বিবাহ “কামসম্ভব”, সুতরাং পরম নীতিজ্ঞ কৃষ্ণার্জুনের তাহা কখনও অনুমোদিত হইতে পারে না। অতএব রাক্ষস বিবাহ ভিন্ন অন্য কোন প্রকার বিবাহ শাস্ত্রানুসারে ধর্ম্য নহে ও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রশস্ত নহে; অন্য প্রকার বিবাহেরও সম্ভাবনা এখানে ছিল না। বলপূর্বক কন্যাকে হরণ করিয়া বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। বস্তুতঃ শাস্ত্রানুসারে এই রাক্ষস বিবাহই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে একমাত্র প্রশস্ত বিবাহ। মনুর ২৪ শ্লোকে আছে— “চতুরো ব্রাহ্মণস্যাদ্যান্ প্রশস্তান্ কবয়ো বিদুঃ।/ রাক্ষসং ক্ষত্রিয়স্যৈকমাসুরং বৈশ্যশূদ্রয়োঃ।। যে বিবাহ ধর্ম্য ও প্রশস্ত, আপনার ভগিনীর ও ভগিনীপতির গৌরবার্থ নিজকুলের গৌরবার্থ, কৃষ্ণ সেই বিবাহের পরামর্শ দিতে বাধ্য ছিলেন। অতএব কৃষ্ণ অর্জুনকে যে পরামর্শ দিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার পরম শাস্ত্রজ্ঞতা, নীতিজ্ঞতা, অভ্রান্তবুদ্ধি এবং সর্বপক্ষের মানসম্ভ্রম রক্ষার অভিপ্রায় ও হিতেচ্ছাই দেখা যায়।“
বাৎসায়ন তাঁর “কামশাস্ত্রম্”-এ চেহারা ও গণাগুণ অনুযায়ী নারীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন--
(১) উত্তমা কুমারী, (২) মধ্যমা কুমারী, (৩) অধমা কুমারী।
উত্তমা কুমারীর লক্ষণ : যে কন্যা শ্যামাঙ্গী, যার কেশ মনোহর, দেহে অল্প অল্প লোম বিরাজমান সে কন্যা মনোহারিনী। মনোহর ভ্রূযুক্তা, সুশীলা, মৃদু গতিশালিনী। সুদন্তা, পঙ্কজ নয়না। যার কটি ক্ষীণ, যার কথা অতি উত্তম ও মিষ্টভাষী বলে মনে করবে। যে কন্যা কুলের কল্যাণকারিণী। যার দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিহ্রাস। যার বর্ণ শ্যাম, দেহ ক্ষীণ, গতি হংসিনীর মতো। করতল রক্তপদ্মের মতো, স্তন নাতিউচ্চ, নাতি ক্ষুদ্র, যোনিপৃষ্ঠ কচ্ছপাকৃতি, ধর্মপরায়ণ, পতিব্রতা, তাকেই উত্তমা রমনী বলে মনে করা চলে।
মধ্যমা কুমারীর লক্ষণ : যার শরীর মধ্যবিত্ত, কেশ দীর্ঘ। যে রমণী সর্বদা আলস্য পরিত্যাগ করে। কী সুখ কী দুঃখ উভয় যার সমজ্ঞান। যে সর্বদা হাসি মুখে কথা বলে, যার নাভিদেশ গভীর, যে রমণী সকলের প্রতি মিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করে, যে সদাচারপরায়ণ, যার মতি সর্বদা ধর্মে প্রতিষ্ঠিত। অল্পমাত্র আহারেই যার তৃপ্তিবোধ হয়, সর্বজীবে যার আত্মজ্ঞান, যে রমণী গুরুভক্তিপরায়ণ, দেবপূজায় নিযুক্ত ও দ্বিজ সেবায় রত এবং যে রমণী সাধ্বী, তাকেই মধ্যমা রমণী বলে।
অধমা কুমারীর লক্ষণ : অধমা কুমারী হস্ত ও পদ ক্ষীণ, চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, দন্ত সুদীর্ঘ ও বিরল (ফাঁকা ফাঁকা) এবং উদর বৃহৎ হয়ে থাকে। এর শরীর অধিক লোমে পরিপূর্ণ। এই রমণী অতি উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করে এবং বেশি কথা বলে। এই রমণী অতি নির্লজ্জ, সদা ক্রোধপূর্ণ এবং চিত্ত সদা বিকল। অধমা কুমারীর হস্ত ও পদে দীর্ঘ এবং কেশ খর্ব হয়ে থাকে। এদের সমস্তই কুলক্ষণে পরিপূর্ণ। অধমা রমণী কদাচ স্বধর্মবিহিত সদাচারের অনুষ্ঠান করে না। সুতরাং রমণীকে পরিত্যাগ করা কর্তব্য।
যে নারী বিবাহের উপযুক্ত নয় : যেখানে অধমা রমণী বাস করে, লক্ষ্মী কখনও সেখানে বিরাজ করেন না। যে-লোক এহেন কন্যাকে বিবাহ করে, তাকে আজীবন মহাদুঃখ ভোজ করতে হয় এতে সন্দেহ নাই। অতএব সব সময় এরূপ নারীর সংসর্গ ত্যাগ করা উচিত। যার সর্বাঙ্গ লোমে পরিপূর্ণ সেরূপ কন্যা কুলে উঁচু হলেও বিবাহযোগ্যা নহে। সে কন্যা কুলক্ষণাযুক্তা।
যে কন্যা শুভ্রবর্ণা, অধিকাঙ্গী, রোগিণী, লোমশূন্য অধিক রোমান্বিত, বাচাল, পিঙ্গলবর্ণা, নক্ষত্র নাসিকা, বৃক্ষনাসিকা, নদীনাম্নী, পক্ষীনাম্নী, সর্পনাম্মী, ভীষণনাম্মী, সেরূপ কন্যাকে বিবাহ করা কর্তব্য নহে। সেরূপ লক্ষণযুক্ত কন্যা শাস্ত্রে কুলক্ষণা বলে কথিত হয়ে থাকে। নদীনাম্নী, বৃক্ষনাম্নী ও নক্ষত্রনাম্নী কন্যাকে বিয়ে করা উচিত নয় পূর্বে একথা বলা হয়েছে বটে-- কিন্তু গঙ্গা, যমুনা, গোমতী, স্বরস্বতী এই সব নদীর নাম। তুলসী ও মালতী এই দুই বৃক্ষের নাম এবং রেবতী, অশ্বিনী ও রোহিনী এই তিন নক্ষত্রের বেলায় কোনো দোষ নয়। যে কন্যার চক্ষুদ্বয় ট্যারা ও চপল, যে কন্যা দুঃশীলা ও পিঙ্গলবর্ণ এবং হাস্যকালে যার গণ্ডস্থলে কূপাকার চিহ্ন দৃষ্ট হয় তাকে কামুকী বলে জানবে।
বাৎসায়ন তাঁর শাস্ত্রে শুভাশুভ বিচার করতে গিয়ে বলেছেন : যখন বরপক্ষরা কন্যা দেখতে যাবেন, তখন নিম্নলিখিত চিহ্নগুলি তাদের অবশ্য দেখা উচিত -- (১) কন্যাটি এই সময় ঘুমোচ্ছে বা কাঁদছে কি না, কিংবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে কি না। (২) কন্যার নাম সহজে এবং প্রকৃতপক্ষে উচ্চরণ করা যায় কি না, তার নাম অকল্যাণ সূচক কি না। (৩) খবর নেওয়া উচিত, ঐ কন্যার আগে অপর কারও সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল কি না। (৪) কন্যার গায়ের রং পিঙ্গলবর্ণ কি না। তার মুখে সাদা সাদা দাগ আছে কি না। (৫) কন্যার মুখ দেখতে পুরুষের মত যেন না হয়। (৬) তার মুখে চুল আছে কি না। (৭) তাঁর কাঁধ নিচে ঝুলে পড়া কি না। (৮) পা দুটি বাঁকা কি না। (৯) কপাল বাইরে ঠেলে বের হয়েছে কি না, অথবা খুব উঁচু কি না। (১০) তার স্তন দু’টি অনুদ্ভিন্ন কি না। (১১) যদি কন্যা তার পিতার শবদাহ করে থাকে। (১২) যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে আগে যৌন মিলন করে থাকে এবং তা জানা যায়। (১৩) যদি তার বিয়ের বয়স পার হ’য়ে গিয়ে থাকে। (১৪) যদি কন্যা রুগ্না বা বোবা হয়। (১৫) কন্যার সঙ্গে যদি কোনও সম্পর্ক যেমন খুড়তুতো কী মামাতুতো বোন ইত্যাদি থাকে। (১৬) যদি কন্যা বয়সে বরের চেয়ে খুব ছোটো বা বড়ো হয়। কন্যার এইসব লক্ষণ থাকলে বিবাহ করা কখনও উচিত নয়।
আসলে আমরা কেউ ‘Perfect’ নই, তাই Mr. Right অথবা Miss Right’ সারা জীবন ধরে খুঁজে বেড়ালেও পাওয়া যাবে না। কারণ একটা imperfect মানুষ আর-একটা perfect মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই।
মনুসংহিতায় কোন্ বিয়ে শুদ্ধ কোন্ বিয়ে অশুদ্ধ সে ব্যাপারে উল্লেখ আছে। কয়েকটি শ্লোক অনুবাদসহ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। --- (১) “হীনক্রিয়ং নিষ্পুরুষং নিশ্ছন্দো রোমশার্শসম্। ক্ষয্যাময়াব্যপস্মারিশ্চিত্রিকুষ্ঠিকুলানি চ”।। যে বংশ ক্রিয়াহীন (অর্থাৎ যে বংশের লোকেরা জাতকর্মাদি সংস্কার এবং পঞ্চমহাযজ্ঞাদি নিত্যক্রিয়াসমূহের অনুষ্ঠান করে না), যে বংশে পুরুষ সন্তান জন্মায় না (অর্থাৎ কেবল স্ত্রীসন্তানই প্রসূত হয়), যে বংশ নিশ্ছন্দ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নরহিত, যে বংশের লোকেরা লোমশ (অর্থাৎ যাদের হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গে বড়ো বড়ো লোম দেখা যায়), যে বংশের লোকেরা অর্শ অর্থাৎ মলদ্বারাশ্রিত রোগ বিশেষের দ্বারা আক্রান্ত, যে বংশের লোকেরা ক্ষয়রোগগ্রস্ত, যে বংশের লোকেরা আময়াবী (আমাশয় রোগাক্রান্ত বা মন্দাগ্নি অর্থাৎ ভুক্ত দ্রব্য যাদের ঠিকমতো পরিপাক হয় না), যে বংশের লোকেদের অপস্মার রোগ (যে রোগ স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বৈকল্য ঘটায়) আছে, যে বংশের লোকদের শ্বেতরোগ আছে এবং যারা কুষ্ঠরোগ দ্বারা আক্রান্ত। এইসব বংশের কন্যাকে বিয়ে করা চলবে না। (৩/৭)। (২) “অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।/সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে”।। যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহ বংশজাত না হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্ব-সম্পাদক বিয়ে ব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।(৩) “নোদ্বহেৎ কপিলাং কন্যাং নাধিকাঙ্গীং ন রোগিণীম্।/নালোমিকাং নাতিলোমাং ন বাচাটাং ন পিঙ্গলাম্”।। কপিলা কন্যাকে (যার কেশসমূহ তামাটে, কিংবা কনকবর্ণ) বিয়ে করবে না; যে কন্যার অঙ্গুলি প্রভৃতি অধিক অঙ্গ আছে (যেমন, হাতে বা পায়ে ছয়টি আঙ্গুল আছে), যে নারী নানা রোগগ্রস্তা বা চিররোগিণী বা দুষ্প্রতিকার্য ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত, যে কেশশূন্যা (অথবা যে নারীর বাহুমূলে ও জঙ্ঘামূলে মোটেই লোম নেই, সে অলোমিকা), যার শরীরে লোমের আধিক্য দেখা যায়, যে নারী বাচাল (অর্থাৎ অতিপ্রগলভা) এবং যে নারীর চোখ পিঙ্গলবর্ণের -- এই সমস্ত নারীকে বিয়ে করবে না। (৩/৮)। (৪) “নর্ক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীং নান্ত্যপর্বতনামিকাম্।/ই পক্ষ্যহিপ্রেষ্যনাম্নীং না চ ভীষণনামিকাম্”।। নক্ষত্রবাচক নামযুক্তা (যেমন, আর্দ্রা, জ্যেষ্ঠা প্রভৃতি), বৃক্ষবাচক নামযুক্তা (যেমন, শিংশপা, আমলকী প্রভৃতি), নদীবাচক শব্দ যার নাম (যেমন, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি), অন্ত্যনামিকা অর্থাৎ অন্ত্যজজাতিবোধক নামযুক্তা (যেমন, বর্বরী, শর্বরী প্রভৃতি), পর্বতবাচক নামযুক্তা (যেমন, বিন্ধ্যা, মলয়া প্রভৃতি), পক্ষিবাচক নামযুক্তা (যেমন, শুকী, সারিকা প্রভৃতি), সাপবোধক নামযুক্তা (যেমন, ব্যালী, ভুজঙ্গী প্রভৃতি), ভৃত্যবাচক নামযুক্তা (যেমন, দাসী, চেটী প্রভৃতি) কন্যাকে এবং (ডাকিনী, রাক্ষসী প্রভৃতি) ভয়বোধক যাদের নাম এমন কন্যাকে বিবাহ করবে না। (৩/৯)। (৫) “মহান্ত্যপি সমৃদ্ধানি গোহজাবিধনধান্যতঃ।/স্ত্রীসম্বন্ধে দশৈতানি কুলানি পরিবর্জয়েৎ”।। বক্ষ্যমান দশটি কুল (বংশ বা পরিবার) গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশু এবং ধন ও ধান্যে বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হলেও স্ত্রীসম্বন্ধ ব্যাপারে সেগুলি বর্জনীয়। (৩/৬)। (৬) “সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।/কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ”।। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য -- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে (অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্য স্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে) দ্বিজাতির পক্ষে বক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (৩/১২)। (৭) “অব্যঙ্গাঙ্গীং সৌম্যনাম্নীং হংসবারণগামিনীম্।/তনুলোমকেশদশনাং মৃদ্বঙ্গীমুদ্বহেৎ স্ত্রিয়ম্”।। যে নারীর কোনও অঙ্গ বৈকল্য নেই (অর্থাৎ অবয়বসংস্থানের পরিপূর্ণতা বর্তমান), যার নামটি সৌম্য অর্থাৎ মধুর, যার গতি-ভঙ্গি হংস বা হস্তীর মতো (অর্থাৎ বিলাসযুক্ত ও মন্থরগমনযুক্তা), যার লোম, কেশ ও দন্ত নাতিদীর্ঘ, এবং যার অঙ্গসমূহ মৃদু অর্থাৎ সুখস্পর্শ (অর্থাৎ যে নারী কোমলাঙ্গী), এইরকম নারীকেই বিবাহ করবে। (৩/১০)। (৮) “যস্যাস্তু ন ভবেদ্ভ্রাতা ন বিজ্ঞায়েত বা (বৈ) পিতা।/নোপযচ্ছেত তাং প্রাজ্ঞঃ পুত্রিকাধর্মশঙ্কয়া”।। যে কন্যার কোনও ভ্রাতা নেই, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেই কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ হওয়ার আশঙ্কায় (ভ্রাতৃহীনা কন্যাকে পিতা ইচ্ছা করলে পুত্রের মত বিবেচনা করতে পারতেন, এইরকম কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত। আবার ভ্রাতৃহীনা কন্যার কোনও পুত্র হলে সে নিজে পুত্রস্থানীয় হয়ে সপিণ্ডনাদি কাজ সম্পন্ন করবে -- অপুত্রক পিতার এইরকম অভিসন্ধি থাকলে সেই কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত।) অথবা যে কন্যার পিতা সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না তাকে জারজ বা মদ্যপ ব্যক্তির দ্বারা জাত সম্ভাবনায় অধর্ম হওয়ার ভয়ে বিয়ে করবে না। (অতএব, পুত্রিকাশঙ্কায় ভ্রাতৃহীনা কন্যা অবিবাহ্যা এবং যার পিতৃসম্বন্ধ অজ্ঞাত-জারজত্ব সম্ভাবনায় এইরকম কন্যা অধর্মাশঙ্কায় অবিহাহ্যা)। (৩/১১)। (৯) “শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।/তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ”।। একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিয়ে করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে। (এটা ‘অনুলোম’ বিবাহের প্রসঙ্গ। উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নীচবর্ণের কন্যার বিয়েকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিয়ে অর্থাৎ তুলনামূলক উচ্চবর্ণের কন্যাকে নিম্নবর্ণের পুরুষ কর্তৃক বিয়ের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিয়ে সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সঙ্গে বিয়েই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেওয়া হয়েছে)। (৩/১৩)। (১০) “শূদ্রাবেদী পতত্যত্রেরুতথ্যতনয়স্য চ।/শৌনকস্য সুতোৎপত্ত্যা তদপত্যতয়া ভৃগোঃ”।। শূদ্রা স্ত্রী বিয়ে করলেই ব্রাহ্মণাদি পতিত হন --- এটি অত্রি এবং উতথ্য-তনয় গৌতম মুনির মতো শৌনকের মতে, শূদ্রা নারীকে বিবাহ করে তাতে সন্তান উৎপাদন করলে ব্রাহ্মণাদি পতিত হয়। ভৃগু বলেন, শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের সন্তান হলে ব্রাহ্মণাদি দ্বিজাতি পতিত হয়। (মেধাতিথি ও গোবিন্দরাজের মতে, কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের শূদ্রা স্ত্রীর ক্ষেত্রেই এই পাতিত্য বুঝতে হবে। কুল্লুক ভট্টের মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য -- এই তিনজাতির শূদ্রা স্ত্রী সম্বন্ধেই এই পাতিত্য হবে)। (৩/১৬)। (১১) “হীনজাতিস্ত্রিয়ং মোহাদুদ্বহন্তো দ্বিজাতয়ঃ।/কুলান্যেব নয়ন্ত্যাশু সসন্তানানি শূদ্রতাম্”।। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দ্বিজাতিরা যদি মোহবশত (ধনলাভজনিত অবিবেকবশতই হোক অথবা কামপ্রেরিত হয়েই হোক) হীনজাতীয়া স্ত্রী বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সেই স্ত্রীতে সমুৎপন্ন পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে নিজ নিজ বংশ শীঘ্রই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। (৩/১৫)। (১২) “শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।/জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে”।। সবর্ণা স্ত্রী বিয়ে না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিয়ে করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তান উৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন [অতএব সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়]। (৩/১৭)। (১৩) “ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্যঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ।/গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ”।। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট (নিন্দিত) পৈশাচ- বিবাহ এই আটরকমের। (৩/২১)। (১৪) “ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহবরান্।/ বিটশূদ্রয়োস্তু তানেব বিদ্যাদ্ধর্ম্যানরাক্ষসান্”।। (প্রথম থেকে) ক্রমানুসারে ছয় প্রকার বিবাহ (ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব) ব্রাহ্মণের পক্ষে ধর্মজনক (অতএব বিহিত); শেষ দিকের চারটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ) ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বিহিত; এবং রাক্ষস ভিন্ন শেষের বাকি তিনটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব ও পৈশাচ) বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে বিহিত বলে জানবে। (৩/২৩)। (১৫) “দৈবপিত্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।/নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি”।। শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (যথা, দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ প্রভৃতি এবং দেবতার উদ্দেশ্যে যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম, যথা, শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন, অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ওই কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ওই সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়)। (৩/১৮)। (১৬) “যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।/যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ”।। যে বংশে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্রালঙ্কারাদির দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন (আর প্রসন্ন হয়ে তাঁরা পরিবারের সকলকে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন), আর যে বংশে স্ত্রীলোকদের সমাদর নেই, সেখানে (যাগ, হোম, দেবতার আরাধনা প্রভৃতি) সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়। (৩/৫৬)।
প্রত্যেক ধর্মের মতো হিন্দু আইনে বিয়ের উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হল স্বামী-স্ত্রী রূপে দুই জন নর-নারীর একত্রে বসবাস করা বা পবিত্রভাবে জীবনযাপন করা। প্রাচীনকালের বিবাহের নিয়ম ছিল গোত্র যেন এক না হয় এবং পিতৃকুলে সাতপুরুষ এবং মাতৃকুলে পাঁচ পুরুষ বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে বিয়ে করতে পারত। মনুর মতে, “অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।/সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।“ অর্থাৎ, যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহ বংশজাত না-হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না-হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্বসম্পাদক বিবাহব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।। প্রাচীনকালের হিন্দু পুরাণে সতীত্বের আদর্শ বর্তমানকালের মতো ছিল না। অনেক সময় একের স্ত্রী অন্যে হরণ করত। যেমন, চন্দ্র বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করেছিল। চন্দ্রের ঔরসে তারার বুধ নামের পুত্র জন্মে। পরে চন্দ্র তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেয়। বৃহস্পতি তারাকে ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করেনি। নারী স্বেচ্ছায় পরকীয়ায় লিপ্ত হলে অসতী বলে গণ্য হত, কিন্তু জোরপূর্বক বলাৎকৃত বা ধর্ষিত হলে ‘অসতী’ বলে গণ্য হত না।
অসবর্ণ বিবাহ : ভারতে ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইন অনুযায়ী অসবর্ণ বিবাহের বিধান আছে। এই ধরনের বিয়ে উভয় পক্ষকে প্রাপ্তবয়ষ্ক হতে হবে। এই আইন ১৯২৩ সালে সংশোধিত হয়। ১৯২৯ সালের হিন্দু বিবাহ নিরোধ আইন দ্বারা কনের বয়স ১৬ এবং বরের বয়স ১৮ ধার্য করা হয়েছিল। পরে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৫৫ সালে কনের বয়স ন্যূনতম ১৮ এবং বরের বয়স ২১ করা হয়েছে।এর কম বয়সি পাত্রপাত্রীর বিবাহ আইনসিদ্ধ হবে না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অসবর্ণ বিবাহের কথা আছে এবং এর ফলে যে সব সংকর বা মিশ্র জাতির উদ্ভব হয়েছিল, তা উল্লিখিত হয়েছে, যেমন -- অন্বষ্ঠ (পিতা ব্রাহ্মণ এবং মাতা বৈশ্য), নিষাদ বা পরশর (পিতা ব্রাহ্মণ এবং মাতা শূদ্র), উগ্র (পিতা ক্ষত্রিয় এবং মাতা শূদ্র), চণ্ডাল (পিতা শূদ্র এবং মাতা ব্রাহ্মণ), সূত (পিতা ক্ষত্রিয় এবং মাতা ব্রাহ্মণ) ইত্যাদি। চণ্ডালসহ সমস্ত মিশ্র জাতিকে শূদ্রের পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করা হত । চিত্তরঞ্জন দাশ যে অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে ছিলেন তার প্রমাণ মিলে তাঁর নিজ কন্যাদের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারে বিবাহ দানের ঘটনায়। ১৭ বছর বয়সে সরোজিনী ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তাঁর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী তাঁদের বিবাহ হয়। ১৯ শতকের ৬০ ও ৭০ দশকে কেশবচন্দ্র সেন স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে ব্রাহ্মসমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। লেখিকা সাবিত্রী রায় ১৯৩৮ সালে বিএ ও পরে বিটি পাশ করার পর ১৯৪০ সালে অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের সাথে অসবর্ণ বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন স্মৃতির বিবরণ অনুযায়ী সাত প্রজন্ম ধরে এরকম অসবর্ণ বিবাহ দিলে কোনো শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারত। মহাভারত মতে, কচের অভিশাপে (কখনো ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেবযানীর বিয়ে হবে না), ততদিনে দেবযানী সত্যি সত্যি কচের প্রেম থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। আর তাই ক্ষত্রিয়রাজ সুপুরুষ সাহসী যোদ্ধা যযাতির প্রেমে পড়ে যেতে সময় লাগে না দেবযানীর। যযাতি প্রথমে রাজি না হলেও পরে সম্মতি দেন। এর কিছুকাল পরে যখন শুক্র দেবযানীর সঙ্গে যযাতির অসবর্ণ বিয়ে দেন, তখন তিনি যযাতিকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, দাসী শর্মিষ্ঠাকে যযাতি যেন কখনো বিয়ে না করেন। যযাতি সেই সাবধানবাণী না মেনে গোপনে শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করেন। কানাডায় অসবর্ণ বিয়ের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসেবে হিসেবে দেখা যায় ২০০৬ সালে দেশটিতে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা ছিল ২৮৯,৪০০ জন। ২০০১ সালে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা যা ছিল তার তুলনায় এই সংখ্যা শতকরা ৩৩ ভাগ বেশি। হিসেবে আরও দেখা যায় এই সব অসবর্ণ দম্পত্তিদের পরিবারে ৩ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি সন্তান রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে অসবর্ণ এই দম্পত্তিদের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ অন্যজন অশ্বেতাঙ্গ বা এথনিক গ্রুপের। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুইজনই দুই এথনিক গ্রুপের। হিন্দুদের নাগরিক সমাজে অসবর্ণ বিবাহ বর্তমানে প্রচলন আছে। BBC NEWS জানিয়েছে, “The government in Uttar Pradesh, northern India, is offering newlyweds 50,000 rupees ($810; £530) and throwing in a medal and certificate too, the Times of India reports. There's only one condition - either the bride or groom must belong to one of India's "scheduled castes". The term refers to those on the lowest rung of the Hindu caste system, who are officially considered socially disadvantaged. Inter-caste marriages are still considered taboo in India, and there have been cases of couples being murdered by their own families - so-called honour killings - as a result of mixed relationships.”
বিধবা-বিবাহ : এককালে স্বামীর মৃত্যুর পর কমবয়সি বিধবাদের সহমরণে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হত।কিংবা তাঁদের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত । সিঁথির সিঁদুর মুছে, দেহের সমস্ত অলংকার খুলে ফেলে, চুল কেটে, সাদা থান পরে, একবেলা নিরামিষ খেয়ে অনশনক্লিষ্ট অবস্থায় তাঁদের বৈধব্য পালন করতে হত। পাছে বিধবা নারীর যৌবন, দীর্ঘ কেশ ও রঙিন শাড়ি-গয়নায় পুরুষরা আকৃষ্ট হয়, সেই কারণেই এই ব্যবস্থা। বিধবা মহিলার নিজের মধ্যেও যেন কামনার উদ্রেক না হয় সেজন্য শুধু আমিষ বর্জন। শুধু আমিষ বর্জনই নয়, অনেক জায়গাতে মুসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারেও বাধানিষেধ ছিল। কারণ আমিষকে মনে করা হয় কামোত্তেজক খাদ্য। এছাড়া বিধবার পুনরায় বিয়ে হলে মৃত স্বামীর অর্থাৎ পূর্ব স্বামীর অবাঞ্ছিত স্ত্রীরূপে জীবনসত্বরূপে তার সম্পতির দখল করবার অধিকার লোপ পাবে। কিন্তু পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত পুত্র সন্তানের মাতারূপে পুত্রের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত হবে না। কারণ বিধবার পুনরায় বিবাহ হলেও পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের সঙ্গে পুত্র সম্পর্ক থেকে যায়। বাটোয়ারার মাধ্যমে সম্পত্তির প্রকৃত বণ্টন না-হওয়া পর্যন্ত অবিবাহিত কন্যার বিবাহের ব্যয় যৌথ পরিবারের সম্পত্তি থেকে নির্বাহ করতে হয়। বিধবা নারীদের ধর্মের নামে সমাজের চরম পীড়ন-অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনটি হল ১৮২৭ সালের সতীদাহ নিবারণ আইন। এই আইনে সতীদাহকে বে-আইনি বলে ঘোষণা করা হল। এই আইন হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অবমাননা করছে বলে সেযুগের নামিদামি অনেকেই ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু রামমোহন রায় ও অন্যান্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির প্রচেষ্টায় তাঁদের আপত্তি টেঁকেনি।
১৮৫৬ সালে গৃহীত বিধবা-বিবাহ আইনটি বিধবাদের স্বার্থরক্ষার জন্য আর-একটি মহত্তম পদক্ষেপ। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। বিধবা-বিবাহ অবশ্য এই আইনের আগেও হয়েছে। “ইংলিশম্যান” পত্রিকায় ১৮৫৪ সালে কৃষ্ণনগরে একটি পনেরো বছর বয়স্কা বিধবার পুনর্বিবাহের খবর প্রকাশিত হয়। ওই সময়ের কিছু আগের থেকেই সমাজের কিছু প্রগতিশীল লোক পণ্ডিতদের সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসন্মত। তবে বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন, এটি শুধু শাস্ত্রসন্মত প্রমাণ করলেই সমাজ তা মানবে না, এটির জন্য আইনের সমর্থন প্রয়োজন। বিদ্যাসাগর, বর্ধমানের মহারাজা, কৃষ্ণনগরের মহারাজা ও আরও কিছু ব্যক্তির বিশেষ প্রচেষ্টায় বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের বিধবা-বিবাহ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। বিধবা-বিবাহ আইন গৃহীত হয় ২৬ জুলাই, তার চার মাস বাদে ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ঘটা করে একটি বিধবার বিবাহ দেন। কিন্তু সাধারণভাবে সেই সময়কার হিন্দুসমাজ বিধবা-বিবাহকে স্বীকৃতি দেয়নি। উদবেগের বিষয়, আজ ১৬০ বছর বাদেও বিধবা-বিবাহকে হিন্দুসমাজ সুনজরে দেখে না। বিধবাদের পুনর্বিবাহ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সংখ্যায় সেগুলি অত্যন্ত নগণ্য। ভারতবর্ষের কোনো কোনো অঞ্চলে বিধবার সঙ্গে মৃত স্বামীর ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রথা আছে। এই পুনর্বিবাহে সদ্য-বিধবার নিজস্ব কতটা সায় থাকে জানা মুশকিল। তবে বাসস্থান ও ভরণপোষণের সমস্যাটা দূর হয় বটে।
বহু বিবাহ : হিন্দুধর্মে বা সনাতন ধর্মে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ। অনেক অহিন্দুরা দাবি করে যে হিন্দুধর্মে বহু বিবাহ অনুমোদিত। প্রকৃত সত্যটা কী ? প্রকৃত সত্যটা দেখে নেওয়া যাক-- ঋগবেদের তিনটি মন্ত্র যথাক্রমে ১.২৪.৭, ৪.৩.২ ও ১০.৭১.৪ -এ বলা হয়েছে, “যায়েব পত্য উষতে সুভাসহ”। অর্থাৎ যেভাবে জ্ঞানীগণ জ্ঞানপ্রাপ্ত হন ঠিক সেভাবে একক পতি-পত্নীযুক্ত সংসার আনন্দ ও সুখ লাভ করে। ঋগবেদ ১০.৮৫.২৩-এ বলা হয়েছে স্বামী ও স্ত্রীর সবসময় উচিত পুনরায় বিয়ে না-করার ব্যপারে সংযমী হওয়া। অথর্ববেদ ৭.৩৮.৪ বলেছে "স্বামীর উচিত শুধু একমাত্র স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত থাকা। দ্বিতীয় কোনো নারীর প্রতি অনুরাগ তো দুরে থাক, অন্য কোনো নারী সম্বন্ধে তার আলোচনাও করা উচিত নয়।" ঋগবেদ ১০.১০৫.৮ বলেছে যে, একাধিক স্ত্রীর অস্তিত্ব মানেই জাগতিক সকল দুঃখের আনয়ন। ঋগবেদ ১০.১০১.১১ বলেছে দুই স্ত্রীযুক্ত ব্যক্তিকে সেভাবেই কাঁদতে হয় ঠিক যেভাবে চলমান রথের ঘোড়া উভয় দিক থেকে চাবুকের আঘাতে হ্রেষা রব করে ! ঋগবেদ ১০.১০১.১১-এও বলেছে যে একাধিক স্ত্রী জীবনকে লক্ষ্যহীন করে তোলে। অথর্ববেদ ৩.১৮.২ বলেছে একজন নারীর কখনো যেন কোনো সতীন না-হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে আপনারা সকলেই জানেন যে বহু বিবাহের ক্ষতিকর দিকের শেষ নেই। সামাজিক বিশৃঙ্খলা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, সেক্স ট্রান্সমিটেড ও কমুনিকেবল ডিসিসের প্রাদুর্ভাবসহ অসংখ্য ক্ষতিকর প্রভাব আছে এর। তবে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রচুর ধান্ধাবাজ মানুষ বহু বিবাহ করতেন। একথা অস্বীকার করা যায় না। ভারত সরকার এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ১৯৫৪ সালে আইন করে হিন্দুদের বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করে। মনুসংহিতায় মনু স্পষ্ট করে বলেছেন – (১) “অত্র গাথা বায়ুগীতাঃ কীর্ত্তয়ন্তি পুরাবিদঃ।/যথা বীজং ন বপ্তব্যং পুংসা পরপরিগ্রহে।।“
অর্থাৎ, পরস্ত্রীতে বীজ বপন করা পুরুষের যে উচিত নয় সে সম্বন্ধে অতীতকালজ্ঞ পণ্ডিতেরা বায়ুকথিত কতকগুলি গাথা অর্থাৎ ছন্দোবিশেষযুক্ত বাক্য বলে গিয়েছেন। (৯/৪২)। (২) “অন্যদুপ্তং জাতমন্যদিত্যেতন্নোপপদ্যতে।/উপ্যতে যদ্ধি যদ্বীজং তত্তদেব প্ররোহতি।।“ অর্থাৎ, একরকম বীজ বপন করা হল আর অন্য রকম শস্য জন্মালো, এরকমটি হতে পারে না; কিন্তু যেমন বীজ বপন করা হয় সেইরকমই ফসল তা থেকে জন্মায়। (৯/৪০)। (৩) “তৎ প্রাজ্ঞেন বিনীতেন জ্ঞানবিজ্ঞানবেদিনা।/আয়ুষ্কামেণ বপ্তব্যং না জাতু পরযোষিতি।।“ অর্থাৎ, অতএব বীজ যখন ওইরকম প্রভাবসম্পন্ন, তখন প্রাজ্ঞ (যিনি স্বাভাবিক প্রজ্ঞার দ্বারা যুক্ত), বিনীত অর্থাৎ শিক্ষিত, জ্ঞানে (অর্থাৎ বেদাঙ্গশাস্ত্রে) এবং বিজ্ঞানে (অর্থাৎ তর্ককলা প্রভৃতি বিষয়ক শাস্ত্রে) অভিজ্ঞ এবং আয়ুষ্কামী ব্যক্তি নিজশরীরস্থিত ওই বীজ কখনো যেন পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে বপন না-করেন। (৯/৪১)। বহু বিবাহ যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ — প্রমাণ করছিলেন বিদ্যাসাগর। বহু বিবাহ নিরোধ নিয়ে সেকালের সামাজিক আন্দোলনে ‘উপযুক্ত ভাইপোস্য’ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিদ্যাসাগরের বহু বিবাহ নিরোধ আন্দোলন নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র লিখছিলেন “বঙ্গদর্শন”-এ। বঙ্কিম আলোচনায় আনেন -- “যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ শাস্ত্রনিষিদ্ধ, সেই কারণেই বহু বিবাহ হইতে নিবৃত্ত হইতে বলিলে একটি দোষ ঘটে। বহু বিবাহপরায়ণ পক্ষেরা বলিতে পারেন, “যদি আপনি আমাদের শাস্ত্রানুসারে কার্য করিতে বলেন, তবে আমরা সম্মত আছি। কিন্তু যদি শাস্ত্র মানিতে হয়, তবে আপনার ইচ্ছামত, তাহার একটি বিধি গ্রহণ করা, অপরগুলি ত্যাগ করা যাইতে পারে না। আপনি কতকগুলিন বচন উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন, এই এই বচনানুসারে তোমরা যদৃচ্ছাক্রমে বহু বিবাহ করিতে পারিবে না। ভাল, আমরা করিব না। কিন্তু সেই সেই বিধিতে যে যে অবস্থায় (স্ত্রী বন্ধ্যা, মৃতপ্রজা হইলে, পুত্র জন্ম না হইলে বা স্ত্রী অপ্রিয়বাদিনী হইলে—বঙ্কিমের উল্লেখ অনুসারে বর্তমান লেখক) অধিবেদনের অনুমতি আছে, আমরা এই দুই কোটি হিন্দু সকলেই সেই সেই বিধানানুসারে প্রয়োজনমত অধিবেদনে প্রবৃত্ত হইব—কেন না, সকলেরই শাস্ত্রানুমত আচরণ করা কর্ত্তব্য।…” নবজাগরণ পর্বের এক জ্যোতিষ্ক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বহু বিবাহ প্রথা নিয়ে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল -- “That marriage is looked upon as traffic by the cool in Brahmins, is an evil, the existence of which can not denied. Many, many poor creatures have suffered keenly from this, and if we but consider the enormity of the crime, we cannot entertain any doubts about the course we, as members of society should pursue with respect to persons that recklessly marry a number of wives without fixing their affections on any.”
জীমূতবাহনের ব্যাখ্যায় এবং প্রাচীন শিলালিপিতে বহুবিবাহের প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণ চার পত্নী, ক্ষত্রিয় তিন পত্নী আর বৈশ্য দুই পত্নী গ্রহণ করতে পারেন। পুরুষের বহুবিবাহ শুধু শাস্ত্রীয় অনুমোদনই লাভ করেনি, কার্যক্ষেত্রেও বহু প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল। আর দাম্পত্য জীবনে প্রাচীনকাল থেকেই নারীর প্রধান অশান্তির কারণ ছিল গৃহে সপত্নীর বা সতীনের অবস্থান। ধর্মের বিধানে রাজারা যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারত। শাস্ত্র পুরুষের শত শত বিবাহ সমর্থন করেছে। সেই শাস্ত্রের বিধানেই আবার নারীর একাধিক পতিত্ব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনু নারীর একপতিত্বের বিধান দিয়েছেন এবং স্বামী দুশ্চরিত্র হলেও স্ত্রীকে সারাজীবন পাতিব্রত্য পালন করতে বলেছেন। পতিপরায়ণতা সাধ্বী স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম।
দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেন প্রবর্তিত কৌলীন্যপ্রথা ধীরে ধীরে তার ধর্মীয় লক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়ে এক ধরনের বিবাহ-ব্যবসায়ে পরিণত হয়। হিন্দুধর্মীয় কুলীন পুরুষের বহু স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় এই প্রথা ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করে। উনিশ শতকে কুলীন ব্যবসায়ীরা বিবাহের জন্য এককালীন পণ এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন উপলক্ষে অর্থলাভের আশা করতেন। ‘কুলমর্যাদা’ অর্থাৎ কিঞ্চিৎ অর্থগ্রহণ না করে এঁরা শ্বশুরবাড়িতে গমন করে উপবেশন, স্নান ও আহার কিছুই করতেন না, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে আলাপও করতেন না। দীর্ঘদিন পরে কুলীন জামাতা বেড়াতে এলে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন তাই তাকে খুশি করার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। এমনকি অনেকে রাতে শোওয়ার আগে শুভ সাক্ষাৎ উপলক্ষে জামাই স্ত্রীর নিকট অর্থ দাবি করতেন।
শাস্ত্রে যাই-ই থাকুক না-কেন, বাস্তব ছবিটা ভিন্ন। মৌর্য যুগে পুরুষদের মধ্যে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল । প্রাচীন সমাজে পুরুষরা বহু বিবাহ করতেন। বহু পুরুষ একাধিক বিয়ে করত। বড়ো বউ, মেজ বউ, ছোটো বউরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল। বাংলা সাহিত্যে এমন বহু পুরুষকে পাওয়া যাবে যারা একাধিক বিয়ে করেছেন। রাজা, উচ্চবংশীয় পুরুষ, ঋষিদের বহু স্ত্রী থাকার প্রমাণ ইতিহাসে এবং পুরাণে পাওয়া যায়। স্বামী অকালে মারা গেলে, সন্ন্যাসী হলে বা দৈহিক মিলনে অক্ষম কিংবা হিজড়া হয়ে পড়লে বা স্বামী সমাজচ্যুত হলে এরকম কিছু বিশেষ কারণে কখনো-কখনো স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ের অধিকার পেত। এ ক্ষেত্রে স্বামীর ভাইকে বা ভাই না-থাকলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারত। কোনো কোনো প্রাচীন হিন্দু জাতি বা সমাজে স্ত্রীলোকেরও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়।। উদাহরণস্বরূপ, মারিষা নাম্নী কণ্ডু কন্যাকে দশজন নৃপতি একত্রে বিয়ে করেছিলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর কাহিনিটিও প্রসিদ্ধ। অনেকে মনে করেন স্ত্রীলোকের বহু বিবাহ অনার্য প্রথা। অর্থশাস্ত্রে বহু বিবাহের উৎসাহ দেওয়া হয়নি এবং সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের কথাও বলা হয়েছে। মহিলাদের মধ্যেও বহু বিবাহ একেবারে অজ্ঞাত ছিল না, যদিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদের পক্ষে তা এক প্রকার অসাধ্য ছিল । তবে ভারতের গোয়ায় বসবাসকারী হিন্দুদের জন্য বিশেষ আইনবলে স্ত্রী যদি বিয়ের ২৫ বছরের মধ্যে সন্তান অথবা ৩০ বছরের মধ্যে পুত্র-সন্তান জন্ম না-দিতে পারে তাহলে স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে। তবে বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান ভদ্রশ্রেণি পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে বহুবিবাহের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। কালক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বহুবিবাহ বিরল হয়ে পড়ে এবং শিক্ষিত শ্রেণিতে এক বিবাহ দাম্পত্য আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মেয়েদের বিয়ের বয়স : মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ঠিক কত ধার্য করা উচিত এবং সেটার যুক্তি ঠিক কী হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা দেশে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। ভারত উপমহাদেশে হিন্দুদের সমাজজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে প্রধানত মনুর বিধান অনুসারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, মেয়েদেরকে ৮ (আট) বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দিতে হবে। হিন্দুসমাজে আট বছর বয়সি মেয়েকে বলা হত গৌরী। ব্রিটিশ-ভারতে আমলে ১৮৯১ সালে আইন পাশ হয় স্ত্রীর বয়স ১২ (বারো) বছরের কম হলে স্বামী তার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না। কারণ এর চাইতে কম বয়সি মেয়ের সঙ্গে সহবাস করবার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীর মৃত্যু ঘটতে দেখা যায়। এই আইনকে বলা হয় “সহবাস সম্মতি আইন” (Age of Consent) । ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন যখন পাশ হয়, তখন ইংলন্ডে ১২ বছরের কম বয়সি কোনো মেয়ে গণিকার খাতায় নাম লেখাতে পারত না। “সহবাস সম্মতি আইন” নিয়ে গোঁড়া হিন্দুসমাজে প্রচুর প্রতিবাদ উঠে। মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত হিন্দু নেতা বালগঙ্গাধর তিলক বলেন, “ইংরেজরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করছে। নষ্ট করছে হিন্দু-সংস্কৃতি। কিন্তু আইনটা থেকেই যায়। ১৯৫২ সালে “হিন্দু কোড বিল” পাশ হয়। এ সময় ভারতের হিন্দু মেয়েদের ন্যূনতম বিবাহের বয়স ধার্য করা হয় ১৮ (আঠেরো) এবং ছেলেদের ন্যূনতম বিবাহের বয়স ধার্য করা হয় ২১ (একুশ)। বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স ধার্য করা হয় ভারতেরই অনুকরণে। কিন্তু ভারতে মুসলমান বিয়েতে এই ন্যূনতম বয়স প্রয়োজ্য নয়। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও হিন্দু ও মুসলমানের ক্ষেত্রে বিবাহ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন এখনও এক হতে পারেনি।
নারীর পক্ষে মনু : বিবাহের বিষয়ে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে -- “কন্যা বিবাহ উপযুক্ত কাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পিতৃগৃহেই অবস্থান করবে সেও ভালো, তবুও গুণহীন বরের (অর্থাৎ বিদ্যা, শৌর্য, সুন্দর চেহারা, উপযুক্ত বয়স, মহত্ত্ব, লোক ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ দ্রব্যাদি বর্জন এবং কন্যার প্রতি অনুরাগ –- এইগুলি নেই যে পাত্রের) হাতে কন্যাকে দান করবে না”। (মনুসংহিতা ৯/৮৯) “কুমারী কন্যা ঋতুমতী হলেও তিন বত্সর পর্যন্ত গুণবান বরের অপেক্ষা করবে; ওই সময়ের পরও যদি পিতা তার বিবাহ না দেন তাহলে এ পরিমাণ কাল অপেক্ষার পর কন্যা নিজ সদৃশ পতি নিজেই বেছে নেবেন”। (মনুসংহিতা ৯/৯০) “ঋতুমতী হওয়ার তিন বছর পরেও যদি ওই কন্যা পাত্রস্থ করা না হয়, তাহলে সে যদি নিজেই পতি বরণ করে নেয়, তার জন্য সে কোনো পাপের ভাগী হবে না। কিংবা সেই পতিরও কোনো পাপ হবে না”। (মনুসংহিতা ৯/৯১)
বরপণ বা যৌতুক : যৌতুক বা পণপ্রথা একটি সুপ্রাচীন সামাজিক ব্যাধি। এর ফলে প্রবহমান নারীজীবন হয়েছে বিপর্যস্ত, ব্যাহত ও সীমাহীন পশ্চাৎপদ। সনাতন হিন্দু সমাজে ‘স্ত্রী ধন’ হিসেবে যৌতুক প্রচলিত ছিল। বাঙালি মুসলিম সমাজে এ যৌতুক ব্যাধি উনিশ শতকের পর দেখা যায়। যৌতুকের বিষফল হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজকেই করেছে যুগপৎ অনগ্রসর ও পশ্চাৎমুখী। আজও উনিশ-বিশ শতকের পরও প্রকৃত নারী স্বাধীনতা আসেনি। আজও থেমে যায়নি যৌতুক-প্রথা। পণপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও কোনো-না-কোনো চেহারায় পণের লেনদেন যে চলছেই, সে কথা সকলেরই জানা। অথচ সেটা আইনে প্রমাণ করা যায় না। পণপ্রথা টিকে আছে। পণপ্রথা বিরোধী আইন অনুসারে বিয়েতে পণ দেওয়া-নেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে ১৯৬১ সাল থেকেই। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কেউই পণ দেওয়া-নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। পাত্রপক্ষ মানে না, তারা পণ নিয়েছে। বিয়ে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পাত্রীপক্ষও বলে না যে, তারা পণ দিয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র সমীক্ষা বলছে, পণের জন্য বধূহত্যার ঘটনা বরং দিনকে দিন বাড়ছে। ২০১১ সালে গোটা দেশে ৮৬১৮টি এই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, ২০১০-এ সংখ্যাটা ছিল ৮৩৯১। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়েই পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জমি কেনাবেচা হয়।
মনুসংহিতায় বরপণ বা যৌতুক নেওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। বলা হয়েছে -- “কন্যার আত্মীয়রা যদি কন্যার স্ত্রীধন (সম্পত্তি, ধনাদি, স্ত্রীযান বা বস্ত্রাদি) অপহরন করে তবে তারা অধোগতি প্রাপ্ত হয়। (মনুসংহিতা ৩/৫২) তাই মনুস্মৃতিতে যে-কোনো যৌতুক নিষিদ্ধ হয়েছে। তাই মেয়েদের সম্পত্তিতে কেউ হাত দিতে পারবে না। পরবর্তী শ্লোকে এই বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যে-কোনো স্পর্শযোগ্য (tangible) সম্পত্তির সামান্যতম আদান-প্রদান মহতী বিবাহের নীতির বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে মনু বলেন যে, যৌতুকযুক্ত কোনো বিবাহ হচ্ছে ‘আসুরী বিবাহ’। শাস্ত্রে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতে বরপণ বা যৌতুক হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। আমাদের সমাজে পণপ্রথা একটি অভিশাপ রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। পণপ্রথাকে কেন্দ্র করে বধুহত্যা, বধু-নির্যাতন। বধুদের এহেন অত্যাচার থেকে রেহাই ভারতীয় দণ্ডবিধি ৪৯৮(ক) ধারার প্রবর্তন হয় ১৯৮৩ সাল থেকে।
হিন্দু সমাজে পাত্র-পাত্রীর কোষ্ঠী বিচার করে দেখার রীতি আছে। পাত্রী-পাত্রীর অন্য কোন বিষয়ে আপত্তি না থাকলেও কোষ্ঠী বিচারে যোটক না মিললে বিবাহের আর অগ্রগতি হয় না। পারিপার্শ্বিক প্রভাবে মুসলিম সমাজেও পূর্বে কোষ্ঠী বিচার করে ছেলেমেয়ের বিবাহ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বাঙালি হিন্দু বিবাহ বলতে বোঝায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ সংক্রান্ত নিজস্ব প্রথা ও রীতিনীতি। বৈদিক ও লৌকিক -- উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত এই দুইটি আচারগত বিভাগ লক্ষিত হয়। লৌকিক প্রথাগুলি মেয়েলি আচার বা স্ত্রী আচার। এই কারণে এগুলি ‘স্ত্রী আচার’ নামে লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই, বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়। বাঙালি ব্রাহ্মণ সমাজে পাঁচটি শাখা রয়েছে — রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক, সপ্তশতী ও মধ্যশ্রেণী। বাঙালি কায়স্থ সমাজে রয়েছে চারটি শাখা — উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ। বৈদিক আচারে সাম, যজুঃ ও ঋক্ বেদত্রয়ের অনুসরণকারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ প্রথায় আবার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। হিন্দু বিবাহের বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অপরিহার্য হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম। এছাড়া পালিত হয় অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন, ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন, শিলারোহণ ইত্যাদি কয়েকটি বৈদিক প্রথাও। বৈদিক প্রথাগুলি বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথা ও বিবাহের মূল অঙ্গ। বাঙালি হিন্দু বিবাহের লৌকিক আচার বহুবিধ। এই প্রথাগুলি বর্ণ, শাখা, উপশাখা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়। এগুলির সঙ্গে বৈদিক প্রথাগুলির কোনো যোগ নেই।
পাটিপত্র : পাটিপত্র বাঙালি হিন্দু বিবাহের প্রথম আচার। এই আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ নামেও পরিচিত। ঘটক বা অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্বন্ধ করে বিবাহ স্থির হলে নগদ বা গহনাপত্রে যৌতুক ও অন্যান্য দেনাপাওনা চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয়, তাকেই পাটিপত্র বলে। এই আচারের মাধ্যমেই বিবাহের অন্যান্য আচারের সূচনা ঘটে।
পানখিল : পানখিল বাঙালি হিন্দু বিবাহের দ্বিতীয় আচার। এটি পাটিপত্রের ঠিক পরেই পালিত হয়। পানখিলের অর্থ পান পাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে খিল দেওয়া বা খড়কে বেঁধানো। এই আচারটি প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে কনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। পানখিল আচারে কোথাও কোথাও বাড়ির মেয়েরা এবং প্রতিবেশিনীরা বিয়ের গান গেয়ে থাকে। এই গানের বিষয়বস্তু হল রাম ও সীতার বিবাহ। তবে বিয়েতে গান গাওয়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।
দধিমঙ্গল : বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপোস বা উপবাস। তবে উপবাস নির্জলা নয়। জল-মিষ্টি খাওয়ার বিধান আছে। তাই সারাদিনের জন্য সূর্যোদয়ের আগে বর ও কন্যাকে চিড়ে ও দই খাওয়ানো হয়।
গায়ে-হলুদ : হিন্দু ধর্মে কয়েকটি জিনিসকে শুভ বলা হয়, তার মধ্যে গায়ে-হলুদ বা গাত্রহরিদ্রা একটি। এছাড়া শঙ্খধ্বনি, হলুদ ইত্যাদিও শুভ। প্রথমে বরকে ও নিতবরকে সারা গায়ে হলুদ মাখানো হয়। পরে সেই হলুদ কন্যার বাড়ি পাঠানো হয়। কন্যাকে সেই হলুদ মাখানো হয় এবং স্নানপর্ব সমাপ্ত হয়।
শঙ্খ-কঙ্কন : কন্যাকে শাঁখা পরানোর অনুষ্ঠান।
এরপর বিকালে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।
বর-বরণ : নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে বর বিবাহ করতে আসে কনের বাড়ি। এলে তাকে স্বাগত জানান কন্যাপক্ষের সন্মানীয়ারা। সাধারণত কন্যার মা তার জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান-দুর্বা ও অন্যান্য কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে বরণ করেন। তবে মার অবর্তমানে কনের জেঠিমা, কাকিমা, বউদি, মামি তুল্য মহিলারাও বরণ করতে পারেন। যাই হোক, এরপর বরকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও দুধ এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয়।
সাতপাক : বিবাহের মণ্ন্ডপে প্রথমে বরকে আনা হয়। এরপর কন্যাকে পিঁড়িতে বসিয়ে আনা হয়। সাধারণত: কন্যার জামাইবাবুরা পিঁড়ি ধরে থাকেন। কন্যা পান পাতা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন। কন্যাকে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হয়।
শুভদৃষ্টি : কনে দুটি পানপাতা নিয়ে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে বিবাহের মন্ডপে আসে। এরপর জনসমক্ষে কনে মুখ থেকে পানপাতা সরিয়ে নেয় এবং বর-কনে উভয় উভয়কে দেখে, এরই নাম শুভদৃষ্টি। শুভদৃষ্টির অর্থ হল যে পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, বিয়ের আসরে সেই পাত্রী উপস্থিত আছে কি না তা পরীক্ষা করে নেওয়া। বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে ছাদনাতলায় এই স্ত্রী-আচারটি করতে হয়। পাত্রী বদলা-বদলা করে দেওয়ার ঘটনা একদা ঘটত। তুলনামূলক সুন্দরী মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে তুলনামূলক কুৎসিত হাজির করা হত। এটা প্রতারণারই নামান্তর। তাই মনুসংহিতায় বলা হয়েছে – “অন্যাং চেদ্ দর্শয়িত্বান্যা বোঢ়ুঃ কন্যা প্রদীয়ক্তে।/উভে তে একশুল্কেন বহেদিত্যব্রবীন্মনুঃ।।“ অর্থাৎ, বরের নিকট থেকে পণ নেওয়ার সময়ে একটি কন্যাকে দেখিয়ে বিবাহের সময়ে যদি তাকে (বরকে) অন্য একটি মেয়েকে দেওয়া হয়, তা হলে সেই বরটি ওই একই শুল্কে দুইটি কন্যাকেই পাবে (৮/২০৪)।
মালাবদল : কন্যা ও বর মালাবদল করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দুজন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিলেন। (মুসলমান মতে একইভাবে কন্যাকে বলতে হয় ‘কবুল’। আবার ঠিক এই রকমই খ্রিস্টান মতে চার্চের ফাদারের সামনে বর ও কন্যা বিবাহে সন্মতি জানান)।
সম্প্রদান : কন্যার পিতা কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করেন বেদমন্ত্রে। পিতার অবর্তমানে জ্যাঠা, কাকা, দাদা সম্পর্কীয় ব্যক্তিরা সম্প্রদান করার অধিকার রাখে। বরও জানান যে তিনি কন্যার ভরণপোষণের দ্বায়িত্ব নিলেন। বিবাহের মন্ত্র হল " ওঁ যদেতদ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।" অর্থাৎ, “তোমার হৃদয় আমার হৃদয়ে থাকুক, আমার হৃদয় তোমার মধ্যে থাকুক”।
লাজাঞ্জলি : কনের পিছনে বর চার হাত এক জায়গা করে কুলোয় খই নিয়ে যজ্ঞের আগুনে দেন। প্রচলিত বাংলায় একে বলে খই পোড়া। বৈদিক যুগে মানুষ নানা ধরনের শক্তির উপাসনা করতেন। অগ্নিও তাদের মধ্যে অন্যতম। যজ্ঞ হচ্ছে পবিত্র আগুনের সামনে পুরোহিত দ্বারা বর এবং কনেকে বেদমন্ত্র পাঠ করানো। মন্ত্র : “ওঁ ইয়ং নার্যুপধ্রূতে লাজানাবপন্তিকা। দীর্ঘয়ুরস্তু মে পতিরেধন্তাং জ্ঞাতয়ো মম।। “ওঁ ইমাল্লাঁজানাবপাম্যাগ্নৌ সমৃদ্ধকরণং তব। মম তুভ্য চ সংবননং তদগ্নিনুমন্যতামিয়ং স্বাহা।।" অর্থাৎ, “হোমের অনলে লাজাজ্ঞলি দিই। আমার পতি ও জ্ঞাতিরা দীর্ঘজীবী হন। এই লাজ অগ্নিতে সমর্পণ করে তোমার সমৃদ্ধি চাইছি। তোমার আমার মনে জাগুক অনুরাগ। অগ্নি ও স্বাহা এই আমাদের মিলন মেনে নিক”।
প্রিয় পাঠকগন সময়সল্পতার জ্ন্য আরো একটি পর্ব বৃদ্ধী করা হলো ।
©somewhere in net ltd.