নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুমন নিনাদ

বাংলা ও বাংলাদেশ- আমার ভাগফল, আমার ভাগশেষ

সুমন নিনাদ

সুমন নিনাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাউল আর ব্লুজ-এর পৃথিবীতে কোন ভৌগলিক সীমারেখা নাই

১৩ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৩:৫৩



আমরা উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড এর গল্প জানি। এই অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসারকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘বীর প্রতীক’ প্রদান করে। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া আমরা জর্জ হ্যারিসনের কথাও জানি। পপ সঙ্গীতের জনপ্রিয় এই ব্রিটিশ শিল্পী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পন্ডিত রবিশংকরের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১লা আগষ্ট “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” আয়োজন করেছিলেন। এই কনসার্ট হতে সংগৃহীত ২,৫০,০০০ ডলার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য দেয়া হয়েছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে হয়ত আরও অনেক বিদেশীদের কথা জানা যাবে, যারা যুগে যুগে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের প্রতি তাদের ভালবাসা আত্মায় লালন করেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুখ্যাতি পেয়েছেন কিংবা বিখ্যাত হয়েছেন আবার কেউবা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছেন।



এমনি এক লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা বিস্ময়কর বাঙালি যিনি ছিলেন জন্মসূত্রে পর্তুগীজ, তার নাম হ্যান্সম্যান অ্যান্টনি। যাকে বাংলার মানুষ ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী’ নামেই চেনে। অ্যান্টনি ১৯ শতকের শুরুর দিকে বাংলায় আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের ফরাসডাঙ্গায় বসবাস শুরু করেন। তার ছিল কবিগানের নেশা। শুরুতে নিজের ভাষাতেই তিনি গ্রামে গ্রামে গান শুনিয়ে বেড়াতেন। তার সে গান শুনে সাধারণ মানুষ হয়ত দুটো হাততালি ঠিকই দিতো, কিন্তু অ্যান্টনি অনুধাবন করেন তাকে বাঙালিদের মনে পৌঁছাতে হলে সত্যিকারের বাঙালি হতে হবে। বাংলায় গান গাইতে হবে তাকে।



তখন এই দেশে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। সৌদামিনী নামক এক হিন্দু ব্রাহ্মন নারীকে অ্যান্টনি সতীদাহের চিতায় নিক্ষিপ্ত হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে উদ্ধার করে আনেন এবং তাকে বিয়ে করেন।



এরপর শুরু হয় অ্যান্টনির বাঙালি হবার প্রাণপণ সংগ্রাম। তখন এদেশে কবিগানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। অ্যান্টনি বিভিন্ন কবিগানের আসরে যাতায়াত শুরু করেন। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন নিজের কবিগানের দল। প্রথম দিকে তিনি অন্যের লেখা গান গেয়ে কবিগানে লড়তেন। তার দলেই একজন গান লিখিয়ে ছিল। তার সাথে বনিবনা না হওয়ায় অবশেষে নিজেই বাংলায় গান লেখা শুরু করেন অ্যান্টনি। এরপর শুরু হয় তার বাজিমাতের ইতিহাস। সে অঞ্চলের কবিগানের সকল রথী মহারথীকে একে একে পরাভূত করেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী।



অ্যান্টনি শুধু ভাষায়-গানে আর বেশভূষায় নয়, মনে প্রানে বাঙালি হতে চেয়েছিলেন। তিনি দক্ষিন কলকাতায় একটি কালি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি নামে পরিচিতি পায়। এমনকি দুর্গাপূজায় অ্যান্টনির নিজের বাড়ীতেও ঠাকুর উঠতো।



একবার দুর্গাপূজার সময় অ্যান্টনি বাড়ি ছেড়ে কবিগানের যুদ্ধে বেরিয়েছেন। গোঁড়া হিন্দুরা ক্রোধে আক্রোশে অ্যান্টনির বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়ী ফিরে অ্যান্টনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী সৌদামিনীকে জলন্ত আগুনের ভেতর থেকে দগ্ধ কয়লারূপে উদ্ধার করেন।



স্ত্রীকে হারানোর এই নির্মম শোক বেশিদিন সইতে হয়নাই অ্যান্টনিকে। মৃত্যুযন্ত্রণায় ধুকে ধুকে অবশেষে ১৮৩৬ সালে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী দেহত্যাগ করেন। অ্যান্টনি চলে যান, কিন্তু অবাঙ্গালি হয়েও বাংলা ভাষা-বাংলা গান আর বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধের প্রতি তার যে ভালবাসার নিদর্শন তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন, তা সত্যিই অনুকরনীয়।



এখন আর একজন মানুষের কথা না বললে খুব অবিবেচনা হবে। তিনি এখনো জীবিত এবং খুব সম্ভবতঃ সেই অর্থে কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন নাই। তার নাম পাণ্ডুরাঙ্গা ব্লুমবার্গ। ইনি জন্মসুত্রে একজন মার্কিন। তার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। পণ্ডিত রবিশঙ্করের গুনমুগ্ধ শিশ্য পাণ্ডু। ২০১১ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এদেশে এসে তার সাথে পরিচয় হয় শিল্পি আনুশেহ আনাদিলের। কিছুদিনের মধ্যেই আনুশেহর পুত্র আরাশ আর কন্যা রাহা’র খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠেন পাণ্ডু। আরাশ আর রাহাকে খুশি রাখাই যেন তার একমাত্র কর্তব্য হয়ে ওঠে। আনুশেহও ধীরে ধীরে তাকে মন দিয়ে ফেলেন। আনুশেহর পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে পাণ্ডু এখন এক নয়নের মনির নাম।



পাণ্ডু মুলতঃ একজন গিটারিস্ট। ফোক গানে কিংবা বাউল গানে তিনি যেন নাড়ির টান অনুভব করেন। ইতিমধ্যেই এদেশের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা মিউজিশিয়ানদের সাথে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন কাঙালিনী সুফিয়া আর শফি মণ্ডলের মত শিল্পীদের এ্যালবামে।



আনুশেহর সাথে পাণ্ডু ঘুরে বেড়ান আশ্রমে আশ্রমে আর বিভিন্ন সাধু সংঘে। যেখানেই যান সেখানেই মানুষের মন জয় করে নেন মুহূর্তেই। যেন মানুষের মনে স্থান করে নিতেই এদেশে এসেছেন পাণ্ডু। পাণ্ডু যে পৃথিবীতে বাস করেন সেই পৃথিবীর কোন ভৌগলিক সীমারেখা নাই। সেখানে কোন জাতপাত নাই। ধর্মের, বর্ণের কিংবা ভাষার কোন বিভেদ নাই। সেই পৃথিবীতে বাউল আর ব্লুজ-এ কোন পার্থক্য নাই।



আমি এই লেখাটা শুরু করার আগে ব্যক্তিগতভাবে আনুশেহ আনাদিল আর পাণ্ডুর কাছে অনুমোদন চেয়েছিলাম। দুইজনেই আমাকে সানন্দে অনুমতি দেন। লেখাটা মোটামুটি দাঁড় করিয়ে আমি আনুশেহকে দেখাই। আনুশেহ সেটা পড়ে আমাকে একটা প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটা ছিল, “অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী কী বাঙালি হবার জন্য এসব করেছিলেন নাকি প্রেমের কারণে?” আমি এই প্রশ্নটার উত্তর দেবার আগে আনুশেহকেই পাল্টা প্রশ্ন করি। প্রশ্নটা ছিল, “পাণ্ডুর এদেশে থেকে যাবার পেছনে তোমার প্রেমের ভুমিকা কতটুকু?”



আনুশেহ আনাদিল হেসে উত্তর দেন, “পুরোটুকুই।”

























মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.